মখাদেব জাতক

মখাদেব জাতক

পুরাকালে বিদেহের অন্তঃপাতী মিথিলা নগরীতে মদেব নামক এক ধর্মপরায়ণ রাজা ছিলেন। প্রথমে কুমার, পরে উপরাজ, শেষে মহারাজভাবে তিনি একাদিক্রমে বিরাশি। হাজার বৎসর পরমসুখে অতিবাহিত করেন। একদিন তিনি নাপিতকে বলিলেন, “আমার মাথায় যখন পাকা চুল দেখিতে পাইবে, তখন আমায় জানাইবে।” ইহার বহুবৎসর পরে একদিন নাপিত রাজার কজ্জল-কৃষ্ণ কেশরাশির মধ্যে একগাছি পলিত কেশ দেখিতে পাইয়া তাঁহাকে জানাইল। রাজা বলিলেন, “চুলগাছি তুলিয়া . আমার হাতে দাও।” তখন নাপিত সােণার সয়া দিয়া ঐ চুলগাছি তুলিয়া রাজার হাতে দিল। মখাদেবের তখনও চুরাশি হাজার বৎসর পরমায়ুঃ অবশিষ্ট ছিল, কিন্তু একগাছি মাত্র পাকা চল দেখিয়া তাঁহার চিত্ত-বৈকল্য জন্মিল। তিনি ভাবিলেন, মৃত্যুরাজ যেন তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছেন, অথবা তিনি দহমান পর্ণশালার মধ্যে অবরুদ্ধ হইয়াছেন। তিনি মনে মনে বলিতে লাগিলেন, ‘মূখ মখাদেব! পাপবৃত্তি পরিহার করিবার পূর্বেই পলিত-কেশ হইলে! তিনি পলিত কেশের সম্বন্ধে যতই ভাবিতে লাগিলেন, ততই তঁাহার অন্তর্দাহ হইতে লাগিল, শরীর হইতে ঘর্ম ছুটিল ; রাজবেশ ও রাজাভরণ দুর্বিষহ বােধ হইতে লাগিল। তিনি স্থির করিলেন, ‘অদ্যই সংসার ত্যাগ পূর্বক প্রব্রজ্যা অবলম্বন করিব।” মহাদেব নাপিতকে, এক লক্ষ মুদ্রা আয় হয়, এমন একখানি গ্রাম দান করিলেন এবং নিজের জ্যেষ্ঠপুত্রকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, “বৎস, আমার কেশ পলিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে ; আমি বৃদ্ধ হইয়াছি। আমি এতদিন পূর্ণমাত্রায় মনুষ্যকাম্য ভােগ করিয়াছি ; এখন দেবকাম্য ভােগ করিব। আমার নিমণ-কাল উপস্থিত হইয়াছে। অতএব তুমি রাজ্য গ্রহণ কর; আমি মখাদেম্রকাননে অবস্থিতি করিয়া শ্ৰমণ-বৃত্তি অবলম্বন করিব।” রাজাকে প্রব্রজ্যাবলম্বনে কৃতদ্যোগ দেখিয়া অমাত্যগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ, আপনি সংসার ত্যাগ করিতেছেন কেন?” রাজা সেই পলিত কেশটী হাতে লইয়া বলিলেন

                    “দেবদুত আসিয়াছে করিতে আয়ুর শেষ,

                   মস্তক উপরি ধরি পলিত কেশের বেশ।

                   আর কেন থাকি মিছা বদ্ধ হয়ে মায়াপাশে ? .

                   প্রব্রজ্যা লইব আজি মুকতি-লাভের আশে।”

অনন্তর সেই দিনই তিনি রাজ্যত্যাগ করিয়া প্রব্রাজক হইলেন এবং উক্ত আম্রকাননে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন। সেখানে চুরাশি হাজার বৎসর তপস্যা করিতে করিতে মখাদেব পূর্ণজ্ঞানে ব্ৰহ্মলােক প্রাপ্ত হইলেন। অতঃপর ব্রহ্মলােক ত্যাগ করিয়া মিথিলার রাজরূপে জন্মগ্রহণ-পূৰ্ব্বক তিনি “নিমি” নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন। আত্মকুলের সকলকে একত্র করিয়া এ জন্মেও তিনি প্রব্রজ্যা অবলম্বন করেন এবং সেই আম্রকাননে বাস করিয়া ব্ৰহ্মবিহার * ধ্যান করিতে করিতে পুনৰ্ব্বার ব্রহ্মলােকে চলিয়া যান।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

কাষ্ঠহারি জাতক

কাষ্ঠহারি জাতক

পুরাকালে বারাণসী-রাজ ব্ৰহ্মদত্ত একদিন উদ্যানবিহারে গিয়াছিলেন। সেখানে তিনি ফলপুস্পাদির আহরণের নিমিত্ত ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছেন, এমন দেখিতে পাইলেন, একটী রমণী গান করিতে করিতে কাষ্ঠসংগ্রহ করিতেছে। ব্ৰহ্মদত্ত তাহার রূপে মুগ্ধ হইয়া তদ্দণ্ডেই তাহাকে গান্ধৰ্ববিধানে বিবাহ করিলেন। অনন্তর বােধিসত্ত্ব এই রমণীর গর্ভে প্রবেশ করিলেন। ‘রমণীকে গর্ভবতী জানিয়া রাজা তাহার হস্তে স্বনামাঙ্কিত একটী অঙ্গুরী দিয়া বলিলেন, “যদি কন্যা প্রসব কর, তবে ইহা বিক্রয় করিয়া তাহার ভরণ পোেষণ করিবে ; আর যদি পুত্র প্রসব কর, তবে তাহাকে এই অঙ্গুরিসহ আমার নিকট লইয়া যাইবে।রমণী যথাকালে বােধিসত্ত্বকে প্রসব করিল। বােধিসত্ত্ব যখন ছুটাছুটি করিতে শিখিয়া পাড়ার ছেলেদের সহিত খেলা আরম্ভ করিলেন, তখন অনেকে তাঁহাকে “নিষ্পিতৃক” বলিয়া উপহাস করিতে লাগিল। কেহ বলিত “দেখ, নিম্পিতৃক আমাকে মারিয়া গেল,” কেহ বলিত, “নিষ্পিতৃক আমাকে ধাক্কা দিল।” ইহাতে বােধিসত্বের মনে দারুণ আঘাত লাগিল। তিনি একদিন জননীকে জিজ্ঞাসিলেন, “আমার বাবা কে, মা ? রমণী বলিল, “বাছা, তুমি রাজার ছেলে।” “আমি যে রাজার ছেলে তাহার প্রমাণ কি, মা ?” “বাছা, রাজা যখন আমায় ছাড়িয়া যান, তখন এই অঙ্গুরি দিয়া গিয়াছিলেন। ইহাতে তাহার নাম আছে। তিনি বলিয়াছিলেন, যদি কন্যা জন্মে, তবে ইহা বেচিয়া তাহার ভরণ পােষণ করিবে, আর যদি পুত্র জন্মে, তবে অঙ্গুরিসহ তাহাকে আমার নিকট লইয়া যাইবে।”“তবে তুমি আমাকে বাবার কাছে লইয়া যাওনা কেন?” রমণী দেখিল, বালক পিতৃদর্শনের জন্য কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে। সুতরাং সে তাহাকে লইয়া রাজভবনে উপনীত হইল এবং রাজাকে আপনাদের আগমনবার্তা জানাইল। অনন্তর রাজসকাশে যাইবার অনুমতি পাইয়া সে সিংহাসনপার্শ্বে গিয়া প্রণিপাতপূৰ্ব্বক বলিল, “মহারাজ, এই আপনার পুত্র।” সভার মধ্যে লজ্জা পাইতে হয় দেখিয়া, রাজা প্রকৃত বৃত্তান্ত জানিয়াও না জানার ভাণ করিলেন। তিনি বলিলেন “সে কি কথা? এ আমার পুত্র হইবে কেন?” রমণী কহিল, “মহারাজ, এই দেখুন আপনার নামাঙ্কিত অঙ্গুরি। ইহা দেখিলেই বালক কে জানিতে  পারিবেন।” রাজা এবারও বিস্ময়ের চিহ্ন দেখাইয়া বলিলেন, “এ অঞ্চুরি ত আমার নয়।” তখন রমণী নিরুপায় হইয়া বলিল, “এখন দেখিতেছি, একমাত্র ধর্ম ভিন্ন আমার আর কোন সাক্ষী নাই। অতএব আমি ধর্মের দোহাই দিয়া বলিতেছি, যদি এ বালক প্রকৃতই আপনার পুত্র হয়, তবে যেন এ মধ্যাকাশে স্থির হইয়া থাকে, আর যদি আপনার পুত্র না হয়, তবে যেন ভূতলে পড়িয়া বিনষ্ট হয়।” ইহা বলিয়া সে দুই হাতে বােধিসত্ত্বের দুই পা ধরিল এবং তাঁহাকে ঊর্ধদিকে ছুড়িয়া দিল। | বােধিসত্ত্ব মধ্যাকাশে উঠিয়া বীরাসনে উপবেশন করিলেন এবং মধুর স্বরে ধর্মকথা বলিতে বলিতে এই গাথা পাঠ করিলেন; আমি তব পুত, শুন মহারাজ, ধর্মপত্নীগর্ভজাত ; পােষণের ভার লও হে আমার, এ মিনতি করি, তাত। কত শত জন ভরণ-পােষণ লভে নৃপতির ঠাই ; তাঁহার তনয় যেই জন হয়, তার ত কথাই নাই। আকাশ বােধিসত্বের মুখে এই ধর্ম-সঙ্গত বাক্য শুনিয়া রাজা বাহুবিস্তার পূর্বক বলিলেন, “এস, বৎস, এস ; এখন অবধি আমিই তােমার ভরণ পােষণ করিব।” তাহার দেখাদেখি আরও শত শত লােকে বােধিসত্বকে ক্রোড়ে লইবার জন্য বাহু তুলিল, কিন্তু বােধিসত্ত্ব রাজারই বাহুযুগলের উপর অবতরণ করিয়া তাহার ক্রোড়ে উপবেশন করিলেন। রাজা তাহাকে ঔপরাজ্যে নিযুক্ত করিলেন এবং তাহার জননীকে মহিষী করিলেন। কালক্রমে রাজার যখন মৃত্যু হইল, তখন বােধিসত্ত্ব “মহারাজ কাষ্ঠবাহন” এই উপাধি গ্রহণপূর্বক সিংহাসনারােহণ করিলেন এবং দীর্ঘকাল যথাধর্ম রাজ্যশাসন করিয়া কৰ্ম্মানুরূপ ফলভােগাৰ্থ লােকান্তরে চলিয়া গেলেন। 

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

তণ্ডুলনালী জাতক

তণ্ডুলনালী জাতক

( শান্তা জেতবনে অবস্থিতিকালে স্থবির লালুদায়ীর সম্বন্ধে এই কথা বলিয়াছিলেন। এই সময়ে মল্লজাতীয় স্থবির হবে। ভিক্ষুসংদের ভত্তোন্দেশক ছিলেন। তিনি প্রাতঃকালে যে শলাকা দিতেন । তাহা দেখাইয়া স্থবির উদায়ী কোন দিন উৎকৃষ্ট, কোন দিন বা নিকৃষ্ট ততুল পাইতেন। উদায়ী যে যে দিন নিকৃষ্ট ততুল পাইতেন, সেই সেই দিন শলাকাগারে ১ গণ্ডগােল করিতেন। তিনি বলিলেন, “দব্বো ভিন্ন কি আর কেহ শলাকা বিতরণ করিতে জানে না ? আমরা কি এ কাজ করিতে পারি না ?” এক দিন তাহাকে এইরূপ গণ্ডগােল করিতে দেখিয়া, অন্য সকলে তাহার সম্মুখে শলাকার ঝুড়ি রাখিয়া বলিল, “বেশ কথা, আজ আপনিই শলাকা বিতরণ করুন।” তদবধি উদায়ীই সংঘের মধ্যে শলাকা বিতরণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বণ্টন করিবার। সময় তিনি কোন্ তণ্ডুল উৎকৃষ্ট, কোন্ তণ্ডুল নিকৃষ্ট তাহা বুঝিতে পারিতেন না; কত দিনের ভিক্ষু হইলে উৎকৃষ্ট তণ্ডুল পায়, কত দিনের ভিক্ষুকে নিকৃষ্ট তণ্ডুল দিতে হয়, তাহাও তাহার জানা ছিল না। শলাকাগৃহে ভিক্ষুদিগের নাম ডাকিবার সময়েও কাহাকে অগ্রে ডাকিতে হইবে, কাহাকে পশ্চাতে ডাকিতে হইবে, তাহা তিনি জানিতেন না। কাজেই ভিক্ষুরা যখন শলাকাগৃহে উপবেশন করিতেন, তখন উদায়ী ভুমিতে বা ভিত্তিতে দাগ দিয়া স্থির করিয়া লইতেন এখানে অমুক দল ছিল, এখানে অমুক দল ছিল ইত্যাদি। কিন্তু পর দিন হয়ত এক  বিহারস্থ ভিক্ষুদিগকে প্রতিদিন ভােজ্য বণ্টন করিয়া দেওয়া ভভেদ্দেশকের কাৰ্য। ভিক্ষু কোন কোন দিন উপাসকদিগের গৃহে নিমন্ত্রিত হইতেন; সে দিন বিহার হইতে কোন ভােজ্য দিবার প্রয়ােজন হইত না। অন্যান্য দিন বিহারের ভাণ্ডার হইতে তণ্ডুলাদি বিতরণ করিতে হইত। ভিক্ষুরা প্রাতঃকালে এক একটী শলাকা পাইতেন। এই শলাকা বর্তমান কালের টিকেটস্থানীয়। ইহা দেখাইয়া তাহারা স্ব স্ব প্রাপ্য খাদ্য লইতেন। : যাহারা বণ্টন কাৰ্য্যে অভিজ্ঞ, ন্যায়পরায়ণ, বুদ্ধিমান, নির্ভীক এবং ধীরপ্রকৃতি, ঈদৃশ প্রবীণ ভিক্ষুরাই ভত্তো দেশকের পদে বৃত হইতেন। | যে গৃহে শলাকা বিতরণ করা হইত। দলের অল্প লােক ও অন্য দলের অধিক লােক উপস্থিত হইত। এরূপ ঘটিলে দাগ অল্প দলের জন্য নিয়ে এবং অধিক দলের জন্য উপরে পড়িবার কথা। কিন্তু উদায়ী তাহা গ্রাহ করিতেন না। তিনি পূর্বদিনের দাগ দেখিয়াই শলাকা বণ্টন করিতেন। অপিচ কোন্ দলকে কি দিতে হইবে তাহাও তিনি বুঝিতেন না।ভিক্ষুরা বলিতেন, “ভাই উদায়ী, দাগটা বড় উপরে উঠিয়াছে অপচ ভিক্ষুর সংখ্যা কম”, কিংবা “দাগটা বড় নীচে আছে, অথচ ভিক্ষুর সংখ্যা বেশী” কিংবা “এত বৎসরের ভিক্ষুদিগকে ভাল চাউল দিতে হইবে; এত বৎসরের ভিক্ষুদিগকে মন্দ চাউল দিতে হইবে” ইত্যাদি। কিন্তু উদায়ী তাহাদের কথায় কান দিতেন না। তিনি বলিতেন, “যেখানকার দাগ সেখানেই আছে। আমি তােমাদের কথা বিশ্বাস করিব, না আমার দাগ বিশ্বাস কৰিব ?” . . | এইরূপে জ্বালাতন হইয়া একদিন বালক ভিক্ষু * ও শ্রমণেরগণ উদায়ীকে শলাকাগার হইতে বাহির করিয়া দিল। তাহারা বলিল, “ভাই লালুদায়ী, তুমি শলাকা বিতরণ করিলে ভিক্ষুরা স্ব স্ব প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হয়। তুমি এ কাজের অনুপযুক্ত; অতএব এখান হইতে চলিয়া যাও।” ইহাতে শলাকাগারে মহা কোলাহল উপস্থিত হইল। শান্তা স্থবির আনন্দকে । জিজ্ঞাসা করিলেন, “শলাকাগারে কোলাহল হইতেছে কেন?” • আনন্দ তথাগতকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানাইলেন। তাহা শুনিয়া তথাগত বলিলেন, “উদায়ী নিৰ্ব্বদ্ধিতা বশতঃ এখনই যে কেবল অপরের প্রাপ্যহানি করিতেছে তাহা নহে; পুৰ্বেও সে ঠিক এইরূপ করিয়াছিল।” … আনন্দ বলিলেন “প্রভু, দয়া করিয়া ইহার অর্থ বুঝাইয়া দিন।” তখন ভগবান ভাবান্তর-প্রতিচ্ছন্ন সেই অতীত কথা প্রকট করিলেন 🙂 । 

পুরাকালে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। বােধিসত্ত্ব তাঁহার, অর্থকারকের কাজ করিতেন। তিনি হস্তী, অশ্ব, মণি, মুক্তা প্রভৃতির মূল্য নির্ধারণ করিয়া বিক্রেতাদিগের, যাহার যাহা প্রাপ্য, তাহা চুকাইয়া দিতেন। রাজা ব্ৰহ্মদত্ত অতি অর্থলােলুপ ছিলেন। এক দিন তাহার মনে হইল এই অর্ঘকারক যে ভাবে মূল্য নিরূপণ করিতেছে, তাহাতে অচিরে আমার ভাণ্ডার শূন্য হইবে। আমি ইহাকে পদচ্যুত করিয়া অপর কোন ব্যক্তিকে অর্ঘকারকের কাজ দিব। অনন্তর তিনি জানালা ৪ খুলিয়া দেখিলেন একটা পাড়াগেঁয়ে লােক উঠান দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছে। ঐ ব্যক্তি নিতান্ত নির্বোধ অথচ লােভী ছিল। কিন্তু ব্ৰহ্মদত্ত তাহা জানিতেন না; তিনি ভাবিলেন এইরূপ লােককেই অকারক করা উচিত। তিনি তাহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি আমার অর্ঘকারকের কাজ করিতে পারিবে কি ?” সে বলিল, “হ মহারাজ, আমি এ কাজ করিতে পারিব।” ব্রহ্মদত্ত তদ্দণ্ডেই সেই লােকটাকে নিযুক্ত করিয়া ভাণ্ডাররক্ষা সম্বন্ধে •নিশ্চিন্ত হইলেন। অতঃপর সে, যখন যেমন খেয়াল হইত, হস্তী, অশ্ব প্রভৃতির মূল্য নির্ধারণ করিত, কোন্ দ্রব্যের প্রকৃত মূল্য কত হইতে পারে তাহা একবারও ভাবিত না। কিন্তু রাজার অর্ঘকারক বলিয়া কেহই তাহার প্রতিবাদ করিতে সাহসী হইত না; সে যে মূল্য। অবধারণ করিয়া দিত, বিক্রেতাদিগকে তাহাই লইতে হইত।এক দিন উত্তরাঞ্চল হইতে এক অশ্ববণি পাঁচশত অশ্ব লইয়া বারাণসীতে উপনীত হইল। রাজা নুতন অর্ঘকারককে সেই সকল অশ্বের মূল্য নির্ধারণ করিতে বলিলেন। সে গিয়া স্থির করিল পাঁচশ ঘােড়ার দাম এক পালি চাউল, এবং অশ্ব-বণিকে ঐ মূল্য দিয়াই ঘােড়গুলিকে রাজার আস্তাবলে লইয়া যাইতে হুকুম দিল। অশ্ববণিক হতবুদ্ধি হইয়া বােধিসত্ত্বের নিকট গেল এবং যেরূপ ঘটিয়াছিল সমস্ত বলিয়া এখন কি কৰ্তব্য জিজ্ঞাসা করিল। বােধিসত্ত্ব বলিলেন, “যাও, উহাকে কিছু ঘুষ দাও এবং বল যে, মহাশয়, পাঁচশ ঘােড়র দাম যে এক পালি চাউল তাহা ত আপনি স্থির করিয়া দিলেন । কিন্তু এক পালি চাউলের কত দাম, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। দয়া করিয়া রাজার সাক্ষাতে এই কথাটা বুঝাইয়া দিবেন কি ? যদি ইহার উত্তরে সে বলে “হাঁ, বুঝাইয়া দিব, তবে তাহাকে সঙ্গে লইয়া রাজসভায় যাইবে। আমিও সেখানে উপস্থিত থাকিব।” | অশ্ববণিক কিছুমাত্র দ্বিধাবােধ না করিয়া এই পরামর্শ মত কাজ করিল। লােভী অর্ঘকারক ঘুষ পাইয়া বড় খুসী হইল এবং এক পালি চাউলের দাম কত তাহা রাজার নিকট বলিতে অঙ্গীকার করিল। অশ্ববণিক তখনই তাহাকে রাজসভায় লইয়া গেল। সেখানে বােধিসত্ত্ব এবং অমাত্যগণ উপস্থিত ছিলেন। অশ্ববণিক প্রণাম করিয়া বলিল, “মহারাজ, পাঁচ শত ঘােড়র দাম যে এক পালি চাউল এ সম্বন্ধে আমি আপত্তি করিতেছি না; কিন্তু দয়া করিয়া আপনার অর্ঘকারক মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করুন যে এক পালি চাউলের দাম কত।” বণিকের অভিসন্ধি বুঝিতে না পারিয়া রাজা বলিলেন, “বলত অর্ঘকারক, পাঁচ শ ঘােড়ার দাম কত ?” সে উত্তর দিল, “মহারাজ, পাঁচ শ ঘােড়ার দাম এক পালি চাউল।” রাজা আবার জিজ্ঞাসিলেন, “বেশ কথা ; এখন দেখ ত পাঁচ শ ঘােড়ার দাম এক পালি চাউল হইলে এক পালি চাউলের দাম কত হয়।” সে উত্তর দিল, “মহারাজ, এক পালি চাউলের দাম সমস্ত বারাণসী সহর ও সহরতলি।” এই কথা শুনিয়া অমাত্যগণ অট্টহাস্য করিয়া করতালি দিতে দিতে বলিলেন, “আমরা এত কাল জানিতাম পৃথিবী ও রাজ্যের কোন মূল্য অবধারণ করা যায় না; এখন শিখিলাম বারাণসীরাজ্য ও বারাণসীর রাজা উভয়ের মূল্য এক পালি চাউল মাত্র। আহা! অকারকের কি অদ্ভুত বুদ্ধি! কি কৌশলে যে এ অপদার্থ এতকাল এই পদ ভােগ করিয়া আসিতেছে তাহা আমাদের বুদ্ধির অগােচর। অথবা রাজা যেমন, তঁহার অর্ঘকারকও তেমন—যােগ্যং যােগেন যােজয়েৎ। তখন বােধিসত্ত্ব এই গাথা পাঠ করিলেন : উপকণ্ঠসহ বারাণসীধাম, মূল্য তার কত হয়? নালীকা পুরিতে যে তণ্ডুল চাই; তার বেশী কভু নয়। আশ্চর্য ব্যাপার শুন আর বার, পঞ্চশত অখ-মুল্য তাও নাকি ঠিক সেই মত এক তলনালিকা তুল্য! সর্বসমক্ষে এইরূপ অপদস্থ হইয়া রাজা তমুহূর্তেই সেই পাড়াগেঁয়ে লােকটীকে তল্পীতাড়া লইয়া প্রস্থান করিতে বলিলেন এবং বােধিসত্ত্বকে পুনর্বার অকারকের পদে প্রতিষ্ঠাপিত করিলেন। অনন্তর বােধিসত্ত্ব জীবনাবসানে কৰ্ম্মানুরূপ ফলভােগার্থ লােকান্তর গমন করিলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

 

সেরিবাণিজ জাতক

সেরিবাণিজ জাতক

পুরাকালে, বর্তমান সময়ের চাৰিকল্প পূর্বে বােধিসত্ব, সেরিব নামক রাজ্যে ফেরিওয়ালার কাজ করিতেন। তখন তাহার নাম ছিল সেরিবান। সেরিবরাজ্যে সেরিব নামে আরও এক ব্যক্তি ঐ কারবার করিত। উহার বড় অর্থলালসা ছিল। একদা বােধিসত্ত্ব তাহাকে সঙ্গে লইয়া তেলবাহনদের অপরপারে অন্ধপুরনগরে বাণিজ্য করিতে গিয়াছিলেন। সেখানে তাঁহারা কে কোন রাস্তায় ফেরি করিয়া বেড়াইবেন তাহা ভাগ করিয়া লইলেন; কথা হইল এক জন যে রাস্তায় এক বার ফেরি করিয়া গিয়াছেন, অপর জন তাহার পরে সেখানেও ফেরি করিতে পারিবেন। | অন্ধপুরে পূর্বে এক অতুলসম্পত্তিশালী শ্রেষ্ঠিপরিবার বাস করিত। কালে কমলার কোপে পড়িয়া তাহারা নিধন হয়, একে একে পুরুষেরাও মারা যায়। যে সময়ের কথা হইতেছে, তখন ঐ বংশে কেবল একটী বালিকা ও তাহার বৃদ্ধা পিতামহী জীবিত ছিলেন। তাহারা অতিকষ্টে প্রতিবেশীদিগের বাড়ীতে কাজকর্ম করিয়া দিনপাত করিতেন। বাড়ীর কৰ্ত্ত সৌভাগ্যের সময় যে সুবর্ণপাত্রে ভােজন করিতেন, সেটী তখনও ছিল; কিন্তু দীর্ঘকাল ব্যবহৃত না হওয়ায় এবং ভগ্নপত্রাদির মধ্যে পড়িয়া থাকায় উহার উপর এত ময়লা জমিয়াছিল, যে সহসা উহা সােণার বাসন বলিয়া বােধ হইত না। একদিন লােভী ফেরিওয়ালা কলসী কিনিবে”, “কলসী কিনিবে” বলিতে বলিতে | ঐ শ্ৰেষ্ঠীদিগের বাড়ীর পাশ দিয়া যাইতেছিল। তাহা শুনিয়া বালিকাটা বলিল, আমায় একখানা গহনা কিনিয়া দাওনা, দিদিমা।” দিদিমা বলিলেন, “বাছা, আমরা গরিব লােক, পয়সা পাইব কোথায় ?” তখন বালিকা সেই সােণার বাসনখানি আনিয়া বলিল, “এইখানা বদল দিলে হয় না কি? ইহা ত আমাদের কোন কাজে লাগে না।” বৃদ্ধা ইহাতে আপত্তি করিয়া ফেরিওয়ালাকে ডাকিলেন এবং তাহাকে বসিতে বলিয়া বাসনখানি দিয়া বলিলেন, “মহাশয়, ইহার বদলে আপনার এই বােটীকে যাহা হয় একটা জিনিস দিন।” | বাসনখানি দুই একবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া ফেরিওয়ালার সন্দেহ হইল, সম্ভবত উহা স্বর্ণনির্মিত। এই অনুমান প্রকৃত কি না তাহা পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত সে সূচী দিয়া উহার পিঠে দাগ কাটিল এবং উহা যে সােণার বাসন সে সম্বন্ধে তখন আর তাহার কিছুমাত্র সংশয় রহিল না। কিন্তু মেয়েমানুষ দুইটাকে ঠকাইয়া ইহা বিনামূল্যে লইব, এই দুরভিসন্ধি করিয়া সে বলিল, “ইহার আবার দাম কি ? ইহা সিকি পয়সায় । কিনিলেও ঠকা হয় * অনস্তর সে নিতান্ত অবজ্ঞার ভাণ করিয়া বাসনখানি ভূমিতে ফেলিয়া সে স্থান হইতে চলিয়া গেল। ইহার ক্ষণকাল পরেই বােধিসত্ত্ব সেই পথে ফেরি করিতে আসিলেন এবং “কলসী কিনিবে”, “কলসী কিনিবে” বলিতে বলিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে লাগিলেন। তাহা শুনিয়া বালিকাটী তাহার পিতামহীকে আবার সেই প্রার্থনা জানাইল। বৃদ্ধা কহিলেন, “যে বাসন বদল দিতে গিয়াছিলে তাহার ত কোন দামই নাই শুনিলে। আমাদের আর কি আছে, বােন, যাহা দিয়া তােমার সাধ পুরাইতে পারি ? ”বালিকা কহিল, “সে ফেরিওয়ালা বড় খারাপ লােক, দিদিমা। তাহার কথা শুনিলে গা জ্বালা করে। কিন্তু এ লােকটী দেখত কত ভাল, ইহার কথাও কেমন মিষ্ট। এ বােধ হয় ঐ ভাঙ্গা বাসন লইতে আপত্তি করিবে না।” তখন বৃদ্ধা বােধিসত্ত্বকে ডাকাইয়া বসিতে বলিলেন এবং বাসনখানি তাঁহার হাতে দিলেন। বােধিসত্ত্ব দেখিবামাত্রই বুঝিলেন উহা সুবর্ণনির্মিত। | তিনি বৃদ্ধাকে সম্বােধন করিয়া বলিলেন, “মা, এ বাসনের দাম লক্ষমুদ্রা। আমার নিকট এত অর্থ নাই।” | বৃদ্ধা কহিলেন, “মহাশয়, এই মাত্র আর একজন ফেরিওয়ালা আসিয়াছিল। সে বলিল ইহার মূল্য সিকি পয়সাও নহে। বােধ হয় আপনার পুণ্যবলেই বাসনখানি এখন সােণা হইয়াছে। আমরা ইহা আপনাকেই দিব; ইহার বিনিময়ে আপনি যাহা ইচ্ছা দিয়া যান।” বােধিসত্বের নিকট তখন নগদ পাঁচ শ কাহণ * এবং ঐ মূল্যের পণ্যদ্রব্য ছিল। তিনি ইহা হইতে কেবল নগদ আট কাহণ এবং দাঁড়িপাল্লাও থলিটা লইয়া অবশিষ্ট সমস্ত বৃদ্ধার হস্তে অর্পণ করিলেন এবং তাহার অনুমতি লইয়া বাসন খানি গ্রহণ করিয়া যত শী পারিলেন নদীতীরে উপস্থিত হইলেন। সেখানে একখানি নৌকা ছিল। তিনি ইহাতে আরােহণ করিয়া মাঝির | হাতে আট কাহণ দিয়া বলিলেন, “আমাকে শীঘ্র পার করিয়া দাও।”এদিকে লােভী বণিক শ্ৰেষ্ঠীদিগের গৃহে ফিরিয়া বাসনখানি আবার দেখিতে চাহিল। সে বলিল, “ভাবিয়া দেখিলাম তােমাদিগকে ইহার বদলে একেবারে কিছু না দিলে ভাল দেখায় না।” তাহা শুনিয়া বৃদ্ধা কহিলেন, “সে কি কথা, বাপু? তুমি না বলিলে উহার দাম সিকি পয়সাও নয়! এই মাত্র একজন সাধু বণিক আসিয়াছিলেন। বােধ হয় তিনি তােমার মনিব হইবেন। তিনি আমাদিগকে হাজার কাহণ দিয়া উহা কিনিয়া লইয়া গিয়াছেন।” এই কথা শুনিবামাত্র সেই লােভী বণিকের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে পাগলের মত ছুটাছুটি করিতে লাগিল; সঙ্গে যে সকল মুদ্রা ও পণ্যদ্রব্য ছিল তাহা চারিদিকে ছড়াইয়া ফেলিল। অনন্তর উলঙ্গ হইয়া, “হায়, সর্বনাশ হইয়াছে, দুরাত্মা ছল করিয়া আমার লক্ষ মুদ্রার সুবর্ণ পাত্র লইয়া গিয়াছে,” এইরূপ প্রলাপ করিতে করিতে এবং তুলাদণ্ডটী মুদগরের ন্যায় ঘুরাইতে ঘুরাইতে সে বােধিসত্বের অনুসন্ধানে নদীতীরে ছুটিল। সেখানে গিয়া দেখে নৌকা তখন নদীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গিয়াছে। সে “নৌকা ফিরাও” “নৌকা ফিরাও” বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল; কিন্তু বােধিসত্ত্ব নিষেধ করায় মাঝি নৌকা ফিরাইল না। বােধিসত্ত্ব অপর পারাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন ; দুষ্টবুদ্ধি বণিক একদৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া।রহিল ; অনন্ত, সূর্যের তাপে জলহীন তড়াগের তলদেশস্থ কর্দম যেমন শতধা বিদীর্ণ হয়, দারুণ যন্ত্রণায় তাহার হৃৎপিণ্ডও সেইরূপ বিদীর্ণ হইল; তাহার মুখ দিয়া রক্ত উঠিতে লাগিল এবং সেই মুহূর্তেই সে প্রাণত্যাগ করিল। ইহার পর বােধিসত্ত্ব দানাদি সৎকার্যে জীবন | যাপন করিয়া কৰ্ম্মফলভােগের জন্য লােকান্তর গমন করিলেন।এইরূপে অহৰ লাভের উপায় প্রদর্শন করিয়া শান্তা সত্যচতুষ্টয় ব্যাখ্যা করিলেন; তাহা শুনিয়া সেই হীনৰীৰ্য্য ভিক্ষু অহরূপ সর্বোত্তম ফল প্রাপ্ত হইলেন। সমবধান তখন দেবদত্ত * ছিল সেই ধূর্ত বণিক, এবং আমি ছিলাম সেই সুবুদ্ধি ও ধর্মপরায়ণ বণিক।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

jatok-3

jatok-3

 

সুমনাদেবীর কাহিনী

“ ইহলোকে নন্দিত হয় “ এই ধম্ম দেশনা ভগবান জেতবনে অবস্থান করিবার সময় সুমনাদেবীর কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন ।

শ্রাবস্তীতে অনাথপিন্ডিকের গৃহে প্রতিদিন দুই হাজার ভিক্ষু ভোজন করেন । সেইরুপ মহাউপাসিকা বিশাখার গৃহেও । শ্রাবস্তীতে নাকি যাহারা দান দিতে ইচ্ছে করেন,তাহারা অনাথপিন্ডিক ও বিশাখা এই দুই জনের অবকাশ লইয়া দানকাজ আরম্ভ করেন। কেন না লোকেরা জিজ্ঞাসা করেন – তোমাদের দানকাজে বিশাখা এবং অনাথপিন্ডিক আসছিল কিনা ? যদি আসেন নাই বলিল বলেন , তাহা হইলে এত সহস্র কোটি দান করিলেও সেই আবার কি দান ? বলিয়া উপহাস করেন । তাহারা উপাসক উপাসিকা দুইজনেই ভিক্ষুসঙ্গের অভিরুচি ও অনুরূপ কাজসমূহ ভাল জানেন । ভিক্ষুদের খাবার সময় সেখানে যদি তাহারা বিচরণ করেন, তাহা হইলে ভিক্ষুরা যতারুচি আহার করিতে পারেন ।তাই সকলে দান দিবার আশাই তাঁহাদিগকে লইয়া যান । এই হেতু তাহারা ভিক্ষুদের নিজের ঘরে পরিবেশন করিতে করিতে লাগিলেন । অনাথপিন্ডিক ও তাহার মেয়ে মহাসুভদ্রকে তাহার কাজের ভার অর্পণ করিলেন এই অবসরে মহাসুভদ্রা ধম্মকথা শুনিয়া স্রোতাপত্তি ফল লাভ করিলেন । অনন্তর তিনি স্বামীর ঘরে চলিয়া আসিলেন । তৎপর তাহার কন্যা ছোট সুভদ্রার উপর এই কাজের ভার অর্পণ করিলেন। তিনিও সেইরূপ ভাবে ভিক্ষুদের পরিচর্যা করিতে করিতে শ্রোতাপন্ন হইয়া পতিকুলে চলিয়া গেলেন ।

অতঃপর তাহার ছোট মেয়ে সুমনাদেবীকে এই কাজে নিযুক্ত করিলেন।ইনি সকৃদাগামী ফল লাভ করিলেন।ইনি না-কি কুমারি অবস্থানতেই ছিলেন।এই সময় তাহার রোগ হয়,রোগাবস্থায় আহারে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন । মৃত্যুর আসন্ন কাল বুঝিয়া পিতাকে দেখিবার ইচ্ছায় ডাকাইয়া পাঠাইলেন । তখন অনাথপিন্ডিক ছিলেন এক নিমন্ত্রন গৃহে। তিনি মেয়ের রোগসংবাদ শুনিয়াই চলিয়া আসিলেন। আসিয়া মেয়েকে জিজ্ঞেস করিলেন- মা সুমনা , তুমি কি বলিতে চাও ?

মেয়ে তাঁহাকে কহিলেন – কি বলিতেছে কনিষ্ঠভ্রাতা ?

মা প্রলাপ বকিতেছে ?

না, প্রলাপ বকিতেছিনা কনিষ্ঠভ্রাতা।

ভয় পাইতেছ মা ?

না ভয় পাইতেছিনা কনিষ্ঠভ্রাতা।

এতদুর বলিয়াই তাহার মৃত্যু হইল। শ্রেষ্ঠী স্রোতাপন্ন হইলেও মেয়ের মৃত্যুতে শোক সম্বরণ করিতে পারিলেন না । মেয়ের অন্তোষঠীক্রিয়া সম্পাদন করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন । ভগবান তাঁহাকে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন – কি গৃহপতি তুমি যে দুঃখিত মনে অশ্রুমুখে কাঁদিতে কাঁদিতে আসিতেছ ? এইরূপ বলিলে শ্রেষ্ঠী কহিলেন – ভন্তে আমার মেয়ে সুমনাদেবী মারা গিয়াছে।

তবে সেই জন্য এত অনুশোচনা কেন ? তুমি কি জান না, সকলেরই মৃত্যু একান্ত অনিবার্য ?

তাহা ত জানি ভন্তে,আমার মেয়ে যে ছিল লজ্জাশীলা,পাপকে বড় ভয় করিত,আমার এইরূপ মেয়ে না-কি মরণকালে স্মৃতি ঠিক রাখিতে পারিল না , প্রলাপ বকিতে বকিতেই মারা গেল, তাই আমার অন্তরে বড় দুঃখ উৎপণ্ণ হইতেছে।

তোমার মেয়ে কি বলিয়াছিল মহাশ্রেষ্ঠী ?

আমি ভন্তে,তাঁহাকে মা সুমনে বলিয়া ডাকিলাম,সে আমাকে জবাব দিল- – কি বলিতেছে কনিষ্ঠভ্রাতা ? তৎপরে আমি বলিলাম – প্রলাপ বকিতেছ মা ? না, প্রলাপ বকিতেছিনা কনিষ্ঠভ্রাতা । ভয় পাইতেছ মা ?

না ভয় পাইতেছিনা কনিষ্ঠভ্রাতা। এতদূর বলিয়া মারা গেল।

অতঃপর ভগবান তাঁহাকে কহিলেন – মহাশ্রেষ্ঠী তোমার মেয়ে প্রলাপ বকে নাই ।

তবে এইরূপ বলিল কেন ?

তুমি কনিষ্ঠ বলিইয়াই,তোমার কন্যা মার্গফল হিসাবে তোমার হইতে বড় । তুমি নাকি স্রোতাপন্ন , তোমার মেয়ে হইল সকৃদাগামিনী,সে মার্গফলের দ্বারা তোমার বড় বলিয়াই এইরূপ কহিয়াছে ।

তাই নাকি ভন্তে ?

হ্যাঁ গৃহপতি ! তাই আর কি ।

ভন্তে, এখন সে কোথাই উৎপন্ন হইয়াছে ?

তুষিত ভবনে গৃহপতি ।

ভন্তে আমার মেয়ে এখানে জ্ঞ্যাতগণের মধ্যে আনন্দ মনে বিচরণ করিয়া পুনঃ এখান হইতে যাইয়াও আনন্দময় স্থানেই উৎপন্ন হইল ?

অতঃপর বুদ্ধ বলিলেন – হ্যাঁ গৃহপতি, যাহারা অপ্রমত্ত হইয়া বাস করে তাহারা গৃহী হউক, অথবা প্রব্রজিত হউক, তাহারা ইহলোকেও আনন্দিত হয় । এই বলিয়া ভগবান এই গাথাটি কহিলেন ঃ-

কৃতপূণ্য ব্যাক্তি ইহলোক ও পরলোক উভয়ত্রই আনন্দিত হন । আমার দ্বারা পুন্য কর্ম করা হইয়াছে , ইহা স্বরণ করিয়া তিনি আনন্দিত হন এবং সুগতি প্রাপ্ত হইয়া তিনি আরও পরমানন্দ লাভ করেন ।

তথায় “ইহলোকে ”- ইহলোকে আনন্দিত হয় ।

“পরলোকে ” – পরলোকে বিপাক আনন্দে আনন্দিত হয়।

“ কৃতপুণ্যব্যক্তি ” নানা প্রকার পুন্যকর্মের কর্তা ।

“ উভয় লোক ”- ইহলোকে কুশল করিয়াছি, অকুশল করি নাই, এই মনে করিয়া আনন্দিত হয়, পরলোকে কুশল কম্মের ফল অনুভব করিয়া আনন্দিত হয় ।

“ অধিক “বিপাক নন্দন হইল – দেবলোকে যাইয়া সাতপঞ্চাশ কোটি ষাট লক্ষ বৎসর যাবৎ দিব্য সম্পত্তি অনুভব করত তুষিত পুরে অধিকতর আনন্দ পায় ।

গাথা শেষ হইলে বহুজন স্রোতাপন্নাদি ফল প্রাপ্ত হইলেন । সমবেত মনুষ্যগণের পক্ষে ধম্মদেশনা সার্থক হইয়াছিল ।

 

 

   

    Founder and Editor : Engr. Anik Barua

            ka-95/5,Noddha,Gulsan,Dhaka1212.                                                                                             Mobile :  +8801845839031 /  +8801407666587        

 

           

   

 

Social Media

jatok-3

jatok-2

আনন্দ শ্রেষ্ঠী

মাৎসয্য উন্নত লাভের প্রধান বাঁধা । সে হীনমন্যতা নিয়ে বাঁচতে চায় । আপনার যাহা সম্পদ , তাহা নিজের প্রয়োজনের জন্য অপরকে বিলিয়ে দিতে বা দান করতে নারাজ। উদারতা, বদান্যতা ও মহত্ত প্রভৃতি গুন ধর্ম তার অনতরে থাকে না । তার এই হীন , নীচ মনোবৃত্তিটা দ্বেষ চিত্তেই উৎপন্ন হয়ে থাকে ।তার প্ররিণতি হয় দুঃখ , দুর্ভোগ ও অশান্তি । এই সম্পর্কে একজন ব্যাক্তির জীবন কাহিনি তুলে ধরছি –

বুদ্ধের সময়কালে শ্রাবস্তির জেতবন কৌশল রাজ্যের অন্তভুক্ত ছিলেন । অনাথপিন্ডিক নির্মিত এই জেতবন বিহার বৌদ্ধ উপাসক ও উপাসিকাগ্ণের তীর্থক্ষেত্রে পরিনত হয়েছিলো । কারণস্বয়ং ভগবান বুদ্ধ এই বিহারে ১৯ বৎসর বরসাব্রত যাপন করেছিলেন। কোশলের সমগ্র রাজ্যে ৭ কোটি জনগণের বাস । তাদের মধ্যে ৫ কোটি আরযশ্রাবক,২ কোটি পৃথক জন । প্রতিদিন জেতবন বিহারে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম হত। ভগবান বুদ্ধ সেই বিহারে আগত জনগ্ণকে স্বর্গ এবং মোক্ষ মার্গ প্রসঙ্গে ধরমদেশনা করতেন ।

আমার পুত্র আছে । এই ধর্মদেশনা বুদ্ধ শ্রাবস্তীতে অবস্থানকালে আনন্দ শ্রেষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছিলেন । শ্রাবস্তিতে আনন্দ শ্রেষ্ঠী নামে চল্লিশকোটি বিভর সম্পন্ন অথচ মহাকৃপণ এক ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি মাসের প্রতি পক্ষে জ্ঞাতিগ্ণকে একত্রিত করিয়া পুত্র মুলশ্রীকে তিন বেলা উপদেশ দিতেন

এই চল্লিশ কোটি ধন অনেক বেশী “ এই কথা মনে করিও না । যে ধন আছে তা দিবে না । নতুন ধন উৎপাধন করিতে হইবে । এক একটি কারজাপণ করিতে করিতে ধন ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । সেইজন্য –

তিনি অন্য এক সময় নিজে পঞ্চ নিধির কথা পুত্রকে না জানাইয়া ধনগর্বিত ও কার্পণ্যদোষদুষ্ট হইয়া কালগত হইয়া সেই নগরেরই দ্বারপ্রদেশে বসবাসকারী সহস্র চন্ডাল পরিবারের এক চন্ডালির গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করিলেন (গর্ভে উৎপন্ন হইলেন ) রাজা তাহার মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া পুত্র মুলশ্রীকে ডাকাইয়া শ্রেষ্ঠীস্থানে প্রতিষ্ঠিত করিলেন । সেই সহস্র চন্ডাল পরিবার একত্রে জিবিকা অর্জন করিয়া জীবন ধারণ করিত । কিন্তু সেই (কৃপণ শ্রেষ্ঠী ) ব্যাক্তি প্রতিসন্ধি গ্রহণের পর হইতে তাহাদের জীবিকা বন্ধ হইয়া গেল। তাহারা দিন যাপন করিবার জন্য পিন্ডমাত্র অন্নও লাভ করিত না । তাহারা ভাবিল – আমরা এখন কাজ করিয়াও পিন্ডমাত্র অন্নও লাভ করিতেছি নাআমাদের মধ্যে কোন কালকর্নীর আবিরভারব হইয়াছে বোধ হয় । এই বিষয়কে কেন্দ্র করিয়া সমস্ত চন্ডাল পরিবার দ্বিধাবিভক্ত হইল। গর্ভস্ত কৃপণ শ্রেষ্ঠীর মাতাপিতাও একে অন্য হইতে আলাদা হইয়া গেল । তখন তাহারা দৃঢ় নিশ্চয় হইল যে একই পরিবারেই কালকর্নী জন্মিয়াছে এবং তাহারা ঐ চন্ডালিকে বহিস্কৃত করিল । সেও (চন্ডালি) যতদিন সে (কৃপণ শ্রেষ্ঠী ) কূক্ষিগত ছিল ততদিন অতি কষ্টে জীবন অতিবাহিত করিয়া পুত্রের জন্ম দিল । কিন্তু তাহার হাত , পা , চোখ , কান , নাক যতাস্থানে ছিল না । সে এইরুপ অঙ্গবৈকল্য যুক্ত হওয়াতে পান্ডুপিশাছের ন্যায় কুৎসিতদর্শন হইছিল। ততসত্তেও মাতা তাঁহাকে প্ররিত্যাগ করিল না । যাহাকে গর্ভে ধারন করা হয়, তাহার প্রতি স্নেহ বলবান হয়। সে তাঁহাকে অতি কষ্টে লালন পালন করিতে লাগিল । পুত্রটি এতই অভাগা যে যেইদিন পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে যাই ঐদিন সে কিছুই পাই না । আর যেইদিন পুত্রকে রাখিয়া যাই সেইদিন কিছুনা কিছু পাইতো । যখন ছেলেটি বড় হইল অথাৎ স্বয়ং ভিক্ষার জন্য জিবিকা নির্বাহ করিতে পারিবে মনে হইল তখন মা তাঁহার হাতে একটি ভিক্ষাপাত্র দিয়া বলিল – বৎস তোমার জন্য আমরা এক মহাদুঃখে পতিত হইইয়াছি । তোমাকে আমরা আর বরণ পোষণ করিতে পারিব না ।এই নগরে ভিখারিদের অন্নসত্রের ব্যাবস্থা আছে । সেইখানে ভিক্ষা করিয়া তুমি বাচিবার চেষ্টা কর । এই বলিয়া তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। সে এক গৃহ হতে এক গৃহ এইভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে আনন্দ শ্রেষ্ঠীর জন্মস্থানে যাইয়া জাতিস্মর হইয়া নিজের গৃহে প্রবেশ করিল। তিনটি দ্বার প্রকোষ্টে কেহই তাঁহাকে দেখিতে পাইল না । ৪র্থ দ্বার প্রকোষ্টে তাঁহাকে দেখিয়া উদ্বিগ্ন হৃদয়ে কাঁদিতে লাগিল। তখন শ্রেষ্ঠীর লোকজনেরা আসিয়া তাঁহাকে দেখিয়া হে কালকর্নী, তুমি দূর হউ । বলিয়া তাঁহাকে প্রহার করিয়া টানিতে টানিতে আবর্জনাস্তূপে ফেলিয়া দিল । বুদ্ধ আনন্দকে লইয়া পিন্ডাচরণ করিতে করিতে সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া স্থবিরের দিকে তাকাইয়া জিজ্ঞেস করিলে স্থবির সব বৃত্তান্ত জানাইলেন । স্থবির মুলশ্রীকে ডাকাইলেন । তখন অনেক লোকের সমাগম হইল । বুদ্ধ মুলশ্রীকে ডাকিয়া জিজ্ঞেস করিলেন –

তুমি ইহাকে জান ?

না ভন্তে, জানি না ।

ইনি তোমার পিতা আনন্দ শ্রেষ্ঠী । কিন্তু পুত্র বিশ্বাস করিল না । তখন বুদ্ধ আনন্দ শ্রেষ্ঠীকে বলিলেনআনন্দ শ্রেষ্ঠী, তোমার পঞ্ছনিধি কোথায় আছে পুত্রকে দেখাইয়া দাও । আনন্দ শ্রেষ্ঠী দেখাইয়া দিলে তার পুত্র সব বিশ্বাস করিল । সে তখন বুদ্ধের শরণাগত হইল। তাঁহাকে ধর্মদেশনারচছলে বুদ্ধ এই গাথা বলিলেন

আমার পুত্র আছে,আমার ধন আছে, মূর্খরা এইরূপ চিন্তা করিয়া যন্ত্রণা ভোগ করে ’। যখন নিজেই নিজের নহে, তখন পুত্র কিংবা ধন কিভাবে আপনার হইবে ?

আমার পুত্র আছে, আমার ধন আছে,এইরূপ চিন্তা করিয়া পুত্রতৃষ্ণা এবং ধনতৃষ্ণার দ্বারা মূর্খগ্ণ নিজেদের নষ্ট বিনষ্ট করে, দুঃখ পায় – আমার পুত্রগ্ণ বিনষ্ট হইয়াছে মনে করিয়া কষ্ট পায় , বিনষ্ট হইতেছে মনে করিয়া কষ্ট পায় , বিনষ্ট হইবে মনে করিয়া কষ্ট পায় । ধনের ক্ষেত্রেও ঠিক তদ্রূপ । এইভাবে ছয় প্রকার (অথাৎ তিন প্রকার হইতেছে পুত্রের ক্ষেত্রে আর তিন প্রকার হইতেছে ধনের ক্ষেত্রে ) কষ্ট পায় । পুত্রদের পোষণ করিব বলিয়া দিবারাত্র স্থলজল পথা দিতে নানা প্রকার প্রচেষ্টা চালাইতে যাইয়া কষ্ট পায় । ধন উৎপাদন করিব বলিয়া কৃষি – বাণিজ্য ইত্যাদি করিতে করিতে কষ্ট পায় । এইরূপ দুঃখ প্রাপ্ত ব্যাক্তি নিজেই নিজের নহে এই বিঘাতে দ্বারা দুঃখিত নিজেকে সুখি করিতে অক্ষম ব্যাক্তি জীবিতকালেও নিজেই নিজের নহে মরণ্মঞ্ছে নিপন্ন ব্যাক্তির , মারণাতস্তিক বেদনার দ্বারা অগ্নি জ্বালার দ্বারা পরিদাহ্যমান ব্যাক্তির যাহার (দেহের ) সন্ধিবন্ধনাদি ছিন্ন হইতেছে , যাহার অস্তিসংঘাট ভিন্ন হইতেছে , চক্ষু নিমীলিত করিয়া পরলোকে,চক্ষু উম্মীলিত করিয়া ইহলোক দর্শনকারীর , দিবসে দিবসে দুইবার স্নান করাইয়া , তিনবার ভোজন করাইয়া গন্ধমালাদির দ্বারা অলঙ্কৃত করিয়া যাবজ্জীবন পোষিত হইয়াও সহায়ভাবে দুঃখ পরিত্রাণ

করিতে অসমর্থতার জন্য ‘নিজেই নিজের নহে ’। পুত্র কিংবা ধন কিরুপে আপনার হইবে অথাৎ পুত্র কিংবা ধন সেই সময়ে কি করিবে, আনন্দশ্রেষ্ঠীও কাহাকেও কিছুই না দিয়া পুত্রের জন্য ধন রাখিয়া পূর্বেই মরণমঞ্চে নিপন্ন হইয়াছিলেন। এখন যে এই দুঃখ ভোগ করিতেছেন – তাহার কেহ বা পুত্র, কেহ বা ধন। পুত্রগ্ণ বা ধন সেই সময়ে কি দুঃখ দূর করিয়াছে ? কি সুখই বা উৎপন্ন করিয়াছে ?

দেশনাবসানে চতুরশীতি সহস্র প্রানীয় ধর্মাভিসময় হইয়াছিল । দেশনা জনগণের নিকট সার্থক হইয়াছিল ।

 

 

   

    Founder and Editor : Engr. Anik Barua

            ka-95/5,Noddha,Gulsan,Dhaka1212.                                                                                             Mobile :  +8801845839031 /  +8801407666587        

 

           

   

 

Social Media

error: Content is protected !!