মানবজীবনে মূল্যবোধ  | ত্রিরত্ন ডট কম

মানবজীবনে মূল্যবোধ | ত্রিরত্ন ডট কম

মানবজীবনে মূল্যবোধ

ঝর্না বড়ুয়া

শিক্ষা হলো মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন। যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব বিকাশ সাধন করে তাই প্রকৃতশিক্ষা। একজন মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করে থাকে জীবনের প্রয়োজনে। যেশিক্ষা লাভ করে মনুষ্যত্বের পূর্ন বিকাশ ঘটে তাকেই পরিপূর্ণ মানুষ বলা যেতে পারে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে “মানব জীবন দূর্লভ”। এ দূর্লভ মানব জীবনকে সার্থক করতে হলে চাই আর্দশজীবন গঠন। এ আর্দশ জীবন গঠনে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ধারন ও অনুশীলন করতে হবে।

আপাতদৃষ্টিতে মূল্যবোধ (Values) ও নৈতিকতা (Moral Principles / Code of Conduct) মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মাঝে স্পষ্টতই সুনির্দিষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। মূল্যবোধ শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভৌগোলিক অবস্থানভেদে এর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়ে থাকে। কিন্ত নৈতিকতা হলো বিশাল অর্জন যা সর্বদা অনুশীলনীয়। এর প্রভাব সার্বজনীন ও গোটা জীবনে। পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্থানে, সর্ববয়সেও সর্বত্র নিজেকে উপস্থাপন করার একমাত্র শিক্ষা হলো নৈতিকতা। তাই যার মধ্যে একবার নৈতিকতার বীজ বপন করা যায় তিনি সারাজীবন সুন্দরভাবে জীবন অতিবাহিত করে এবং অপরকেও আর্দশময় জীবন গঠনে সহযোগিতা করে। পরিবার সমাজ রাষ্ট্রে সর্বত্র প্রশংসিত হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে ভুটান দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটি রাজতন্ত্রের দেশ। ভুটান উত্তরে চীনের অঞ্চল, পশ্চিমে ভারতের সিকিম ও তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা, পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ এবং দক্ষিণে আসাম ও উত্তরবঙ্গ বিশাল বনভূমি বেষ্টিত সবুজে সবুজে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দৃষ্টিনন্দিত দেশ। ভুটানের মানুষ এক ঘন্টায় ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) গাছ লাগিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। মোট আয়তন মাত্র ১৪,৮২৪ বর্গমাইল। বিশ্বের ১৩৩তম ক্ষুদ্র দেশ। প্রাণী ও উদ্ভিদের এক অভয়ারণ্যে। ভুটান জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। দেশটিকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বলা হয়। যেখানে তামাক চাষ নিষিদ্ধ এবং বিক্রিও নিষিদ্ধ। পর্যটকরাএ আইন ভঙ্গ করলে বিরাট অংকের ফ্রি প্রদান করতে হয়। মোট জনসংখ্যা প্রায় আট লক্ষ। কৃষিনির্ভর দেশটিকে মোট জনসংখ্যার ৭০% লোক কৃষিজীবী। ভুটানের রাস্তায় কোন গৃহহীন মানুষ নেই। যদি কোন কারণে গৃহ হারান শুধুমাত্র রাজার শরণাপন্ন হতে হয়। রাজা জমি ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন যাতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। তাহলে সহজে অনুমেয় বিশ্বের ১৩৩তম ছোট্ট একটা দেশ অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা না হয়েও কতটা সুখী জীবনের অধিকারী। মহাকারুনিক তথাগত বুদ্ধের দেশিত নৈতিক আর্দশ অনুশীলন ও ধারণ করে প্রতিটি নাগরিক হয়ে উঠেছেন সঠিক আদর্শবান ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। পরিশ্রম, সততা ও ন্যায়পরায়নতা দেশটিকে মহান সম্মান এনে দিয়েছে। সর্ব প্রাণীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বেশির ভাগ লোক নিরামিষ ভোজী ও প্রকৃতিপ্রেমী। কথিক আছে, কোন পর্যটক ভুল করে কোন ব্যাগ বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হারালে আবার সে স্থানে গিয়ে ঐসব হারানো দ্রব্যাদি একই অবস্থায় পেয়ে থাকে। কেউ কারো জিনিস অনুমতি ছাড়া ধরে না। কেমন মহৎ জীবনের অধিকারী ~ তা শিক্ষণীয় ও অনুশীলনীয়। বৌদ্ধিক আর্দশে ও ধর্ম শিক্ষালয়ে তাদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। মহামতি বুদ্ধের পঞ্চশীল পালন করলে বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক হয়ে উঠতে পারে আর্দশিক মানবতাসম্পন্ন ~ তা সহজে প্রমাণ পাওয়া যায় ভুটানের জীবনযাত্রা থেকে। বজ্রড্রাগনের দেশ নামে পরিচিত ভুটান এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ হিসাবে খ্যাত।

সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও আর্দশে বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসাবে লেলিন ও মাওসেতুংয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁরা রাশিয়া ও চীনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। অথচ আজকের দিনে সমাজতান্ত্রিক আর্দশের নেতারা শ্রমিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে নিজেরাই ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করে থাকেন। এমন কি সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সরে এসে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার দিকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ছে। গনতান্ত্রিক আর্দশ বিকশিত হয়েছিল মানুষের মৌলিক অধিকার যথা বাক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকৃত মানবাধিকার গঠনে।

ইউরোপ ও আমেরিকার সমাজে যে মূল্যবোধ বিদ্যমান তা উপমহাদেশের সমাজে বড্ড বেমানান। পশ্চিমের সমাজে লিভ টুগেদার, বিবাহ বর্হিভূত সন্তান জন্ম দেওয়া, মধ্যপান খুবই নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের অংশ। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে এ সমস্ত বিষয়াদি কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না বরঞ্চ নিন্দাযোগ্য। তেমনি আরব সমাজে বহু বিবাহ ও অধিক সন্তান জন্ম দেওয়াও আমাদের উপমহাদেশের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নেয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে মানব জীবনের মূল্যবোধকে বিচার করলেও প্রকৃত পক্ষে, সেইটাই প্রকৃত মূল্যবোধ হবে যা নিজের জন্য মঙ্গলজনক অপরের জন্যও মঙ্গলজনক এবং মানব সভ্যতাকে সুরক্ষার কর্মে বিরাজমান থাকবে ।

মানব শিশু জন্মের পর থেকে প্রথম পাঁচটা বছর যা শিখে যেমন হাঁটা, চলা, বসা, কথা বলা, খাওয়া-দাওয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, জীবন পদ্ধতি এবং আশে পাশে পরিবেশ সম্বন্ধে ~ সেই শিক্ষা সারা জীবনের সাথে গেঁথে যায়। প্রকৃতির আলো, বাতাস, গাছপালা, ঝড়-বৃষ্টি, নদী- নালা, পশু-পাখী প্রভৃতি থেকেও মানব শিশু শিক্ষা লাভ করে থাকে। অর্থাৎ মায়ের কোলে শিশুর প্রথম হাতে কড়ি। ঘুম থেকে উঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত একটা শিশুর করণীয় কর্তব্যগুলো ধাপে ধাপে মাতাপিতার কাছ থেকে আয়ত্ব করে। এতে করে পরিবারের আর্দশ শিশুর জীবনে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। মাতাপিতার সততা, সৎ চিন্তা, চেতনা ও উপদেশ ধীরে ধীরে শিশু মনে ধারণ করতে থাকে। পরিবারে কথা ও কাজে সমন্বয় থাকা চাই অন্যথা শিশুর কোমলমনে দ্বিধা-দ্বন্ধ দেখা দিবে। তাই পরিবারের কাছ থেকে সর্বদা শিশু সততা, সৎ, সত্যবাদিতা, মনের উদারতা ও ন্যায়পয়ারনতা শিক্ষা লাভ করবে। এভাবে শিশুরা পরিবার, বিদ্যালয়, খেলার সাথী, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে আর এই নৈতিক শিক্ষায় মানব জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করে ।

শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলেন। সামাজিক, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রীতিনীতি মূল্যবোধ ও নৈতিকতা তৈরী করেন। দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মানবিক গুনাবলীর বিকাশ ঘটানোর গুরু দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরা। যথা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুতে ধর্মীয় উপদেশ, জাতীয় সংগীত এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে দিনের কর্মসূচী আরম্ভ করা হয়ে এতে করে শিশু মন থেকে ধার্মিকতা বা ধর্ম পরায়ন হওয়ার বীজ বপন করা , জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে দেশপ্রেম সৃষ্টি করা এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে শরীরকে শক্ত মজবুত ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিক্ষা বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে শিশুদের মননশীলতা বিকাশে সৃজনশীল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। যেমন বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতা, ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, বির্তক ও উপস্থিত বক্তব্য, কবিতা আবৃত্তি, গানের প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোর পর্যালোচনাসহ আরো নানামুখী সংস্কৃতি কর্মে উদ্ভুদ্ধ করে শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। এভাবে আজকের প্রজন্ম আগামী দিনের সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে।

গুরুজনদের সন্মান করা, নমনীয় আচার আচরন করা, একে অন্যের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালবাসা, স্নেহ-মমতার মধ্য দিয়ে মানব প্রেম তৈরী করা সর্বজনীন মানবতাসম্পন্ন জীবন গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা মাতাপিতা ও শিক্ষকদের দায়িত্ব মূখ্য। বিপদে ধর্য্য ধারণ করা, রাগসংবরণ করা, আপদে বিপদে একে অন্যকে সহযোগিতা করা, বন্ধুবৎসল হওয়া, পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া, পরিশ্রমী ও মনোবল সম্পন্ন হওয়া, সঠিক অধ্যাবসার মাধ্যমে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো, ভদ্রতা, নম্রতা ও দেশপ্রেম দিয়ে জীবন কে জয় করার নিয়মানুবর্তিতা যদি একবার ছাত্রছাত্রীর জীবন পদ্ধতির সাথে পরিচিত করে দেওয়া যায় তাতে মাতাপিতার জীবন সাথর্ক হয়ে উঠে। তাই সৎ নিষ্ঠাবান চরিত্র গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে শিশুকালের গুরুত্ব সর্বাধিক। সে শিক্ষা পরবর্তীতে গোটা জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

তাই আর্দশ মানবিক মূল্যবোধ তৈরী করার মূল সূতিকাগার হলো পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেক মাতাপিতা চান তাদের সন্তানরা অনেক বড়ো হোক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হউক। যদি মাতাপিতা এমন মানবিক শিক্ষায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেন প্রতিটি সন্তানকে তাতে মা বাবার আশার যেমন প্রতিফলন ঘটে তেমনি মানবজীবনের সাথর্কতা পাওয়া যায়। সুখী সমৃদ্ধ ও আর্দশ জীবনের অধিকারী হয়ে সমাজে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।

ব্যক্তিগত অনুভবে দেখা যায় প্রতিটি সন্তানের সাথে যদি মাতাপিতাগণ বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে । সন্তানের মনের কথাগুলো আন্তরিকতার সহিত শুনা, তাদের চাহিদা গুলো যথাসম্ভব পূরণ করা, স্কুলের প্রতিদিনের কার্যাদি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষন করা, কোন ধরনের পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে ভালোভাবে তদারকি করা। ভালো, মন্দ, হিতাহিত জ্ঞান সম্বন্ধে সম্যক ধারনা দেওয়া। আশে পাশের পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে কিভাবে নিজেকে খাপ খাওয়ানো যায় তা কাউন্সিলিং করা। উপস্থিত বুদ্ধি তৈরী করা। অনন্ত প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘন্টা সময় আলাপ আলোচনা করা । উভয়ে মন খুলে কথা বলে এক কথায় মননশীলতা তৈরী করে দেওয়া মাতাপিতার প্রধান কাজ। কৈশোর বয়সে হরমোন পরিবর্তনে কারনে সন্তানের মাথা কীটে কীটে হয়ে উঠে তখন বিশেষ করে মাকে বেশী করে সন্তানদের সময় দিয়ে শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন সম্বন্ধে ধারনা দিয়ে কিভাবে নিজেদের সুরক্ষিত করা যায় তা খোলামেলা ভাবে আলোচনা করা দরকার। এতে করে সন্তানরা নিরাপদ বোধ করে পরিবারকে। এককথায় ব্যক্তি , সমাজ , জাতি সর্বক্ষেত্রে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হলে প্রথমে পরিবার থেকে শিক্ষাটা শুরু করতে হবে ।

ব্যাপক অর্থে সন্তানকে জানতে হবে এবং জানাতে হবে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন, মূল্যবোধের কথা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প সংস্কৃতিবোধ এবং ইতিহাস, দেশপ্রেমও মানবতার মহাপ্রেম । তবেই “আলোয় আলো ভরা” হবে আগামী প্রজন্মের এই সন্তানেরা। গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ দেশ, সুন্দর বিশ্ব ও আর্দশ মূল্যবোধের মানব জীবন । জীবনে মূল্যবোধ থাকলেই সে জীবন হবে সুন্দর , স্বার্থক , সর্বজন নন্দিত আত্মশুদ্ধির মানব জীবন |
তাই প্রত্যেকের কর্ম হোক “DO ALL THINGS WELL”
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

দীর্ঘ জীবন, সুখ ও সম্মান

দীর্ঘ জীবন, সুখ ও সম্মান

চীনদেশে চেং নামে একজন নিম্নপদস্থ সরকারী লােক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ এবং দয়ালু ছিলেন। যদিও তিনি সামান্য বেতনের চাকুরী করতেন, মাঝে মাঝে বাজার থেকে জীবিত মাছ ও মুরগী কিনে ছেড়ে দিতেন।

তার অনেক ছেলেমেয়ে এবং নাতি-নাতনি ছিলেন। চীনদেশের পরিবারে সন্তানাদি বেশী থাকলে তাদেরকে সৌভাগ্যবান পারিবার নামে অভিহিত করা হয়। চেং কোন সময় আজে বাজে খরচ করতে পছন্দ করতেন না।

চেং এর অনেক বয়স হয়েছে, তাই সরকারী অফিস থেকে অবসর নিয়েছেন। বাড়ীতে ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতিনীদের নিয়ে তার সময় কাটে । পরিবারের কেউ প্রাণী হত্যা করেন না। বাড়ীর সবাই নিরামিষাশী ছিলেন। এর ফলে চেং এবং তার পরিবারের সবাই ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। চেং এর বয়স এখন প্রায় একশত বছর। তিনি এখনও একজন পূর্ণ যুবকের মত চলাফেরা করেন। তার চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, গায়ের চামড়া টান টান, চুলগুলি কালাে। এমনকি তার শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়েনি।

একদিন চেং বাড়ীর সবাইকে ডাকেন। চেং বলেন, আমার বিগত জীবনে, আমি অনেক প্রাণীর জীবন রক্ষা করেছি। ভগবানের কৃপায় আমরা সবাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। জীবনে, আমি কোনদিন জীবহত্যা করি নাই, এজন্য তােমাদের সবাইকে নিয়ে আমি সুখী আছি। আমার কৃতকর্মের জন্য স্বর্গের রাজপ্রাসাদ হতে আমার ডাক এসেছে। তােমাদের সবাইকে | আশীর্বাদ করছি। আমার উপদেশ মতাে তােমরা জীবন-যাপন করবে। এতে তােমরা। | অনেক উন্নতি করবে। আমার মৃত্যুর পর তােমরা আমার উপদেশ মনে রাখবে এবং অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। জীবনে কখনও প্রাণীহত্যা করবেনা। অন্য কাউকে হত্যা করতে দেখলে তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করবে।

চেং এর কথা শেষ হলে, পরিবারের সকলেই এক মধুর সঙ্গীত শুনতে পায়। তারা কোনদিন এরকম সঙ্গীত শুনেনি। মধুর সংগীতের শব্দটি আকাশ হতে শােনা যায়। কিন্তু আকাশে কিছুই দেখা যায় না। পরিবারের লােকজন উপরে তাকিয়ে আছেন এবং হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে দেখেন, স্বর্গ হতে পাঠানাে এক স্বর্ণকারুকার্যময় চেয়ারে চেং বসে আছেন। ঘরের মধ্যে চেৎ নেই। তার সমস্ত শরীর স্বর্গীয় আভায় দিপ্তমান। তিনি অর্হৎ প্রাপ্ত হয়ে তুষিত স্বর্গে চলে যান। পরিবারের লােকেরা অহং চেং এর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন। করেন এবং সবাই দীর্ঘজীবন লাভ করে সুখে ও শান্তিতে বাস করতে থাকেন।

সুত্রঃ সজল কান্তি বড়ুয়ার লিখা প্রানির প্রতি দয়া বই থেকে সংগৃহীত

হরিণ ও ছোট্ট ছেলে

হরিণ ও ছোট্ট ছেলে

ঘন সবুজ এবং চমৎকার বুনােফুল দ্বারা আচ্ছাদিত নদীর পাশে একটি ছােট্ট ঘর। মা তার ছেলেকে নিয়ে কুড়ে ঘরে বসবাস করেন। সেদিন আকাশে চমৎকার সূর্য উঠেছে। হঠাৎ একটি শিংওয়ালা হরিণ তাদের বাড়ীর আঙ্গিনায় ঢুকে পড়ে। ছােট ছেলেটি বাড়ী সংলগ্ন উঠানে খেলা করছিল। হরিণ ছেলেটির একেবারে কাছে গিয়ে আংটার মতাে করে ছেলেটির গায়ে জড়ানাে কাপড়ে তার শিং দিয়ে জড়িয়ে নেয়। এটি করতে দেখে ছেলেটি ভয়ে চীৎকার দেয়। ছেলের চীৎকার শুনে তার মা ঘর থেকে ছুটে এসে দেখেন, একটি হরিণ দৌড়ে পালাচ্ছে এবং হরিণটির শিঙ্গের সঙ্গে শাট আটকানাে অবস্থায় তার ছেলেও হরিণের সঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ছেলের এরকম পরিণতিতে মা অত্যন্ত আতংকিত হয়ে পড়েন। ছেলেকে রক্ষার জন্য তিনি হরিণের পিছু পিছু দৌড় দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর মা দেখেন তার ছেলে মাঠের এক জায়গায় পড়ে আছে এবং হরিণের শিংয়ের সঙ্গে আটকানাে শার্ট খুলে গেছে। মাকে আসতে দেখে ছেলে মায়ের বুকে মুখ লুকায়। ছেলেকে পেয়ে আনন্দে মা কেঁদে ফেলেন।

মা ছেলেকে নিয়ে দ্রুত বাড়ীর দিকে রওনা দেন। বাড়ী ফিরে আশ্চর্য হয়ে দেখেন পাশের বড় গাছটি ভেঙ্গে তার বাড়ীর উপর পড়ে আছে। অতবড় গাছের নীচে পড়ে বাড়ীটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মােরগ এবং কুকুরটি ও গাছের নীচে পড়ে মরে আছে। এ দৃশ্য দেখে মা শিউরিয়ে উঠেন। সে সময় হরিণটির শিংগে তার ছেলের শাট আটকানাে অবস্থায় বাইরে টেনে না নিলে, আজ গাছের নীচে পড়ে তাদের সবাইর মৃত্যু ঘটত।

এসময় ছেলেটির মায়ের এক বছর পূর্বের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। একটি হরিণ শিকারির তাড়া খেয়ে তার ঘরে ঢুকে পড়েছিল। মা তখন রান্নার কাজেই ব্যস্ত। হঠাৎ হরিণটিকে তার ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে ছেলেটির মা ভয় পান। এসময় ঘরের বাইরে তীর ধনুক হাতে একজন লােক দেখেন। সেই লােকটিকে দেখে মার মনে সন্দেহ জাগে, তবে লােকটি কি হরিণকে খুঁজছে। এই কথা ভেবে মা হরিণটিকে শিকারির চোখ থেকে আড়াল করার জন্য তার পরনের কাপড় দিয়ে হরিণের শরীর ঢেকে রাখেন।

শিকারি বাড়ীর এদিক ওদিক তাকিয়ে হরিণটির কোন চিহ্ন দেখতে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। শিকারিকে চলে যেতে দেখে, ছেলেটির মা হরিণের গা থেকে কাপড়টি সরিয়ে নেয়। হরিণ সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। হরিণ বুঝতে পারে ছেলেটির মা শিকারীর হাত থেকে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। চলে যাওয়ার সময় হরিণ মাথা নত করে ছেলেটির মাকে কৃতজ্ঞতা জানায়।

মা এখন বুঝতে পারে হরিণ কেমন করে যেন বুঝতে পেরেছিল বাড়ীর পাশের গাছটি পড়ে । গিয়ে মা এবং ছেলের ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রতিদানে হরিণ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। মা ও ছেলেকে রক্ষা করেছে।

মা একটি প্রবাদ বাক্য স্মরণ করেন,

“কারও বিপদে যদি কেউ তার জীবন রক্ষা করে,

নিজের বিপদে ও দেবতারা তাকে রক্ষা করেন।”

সুত্রঃ সজল কান্তি বড়ুয়ার লিখা প্রানির প্রতি দয়া বই থেকে সংগৃহীত


কচ্ছপের কৃতজ্ঞতা

কচ্ছপের কৃতজ্ঞতা

 ৪র্থ শতাব্দীর চান রাজত্বে কুং ইউ নামে এক বৃদ্ধ লােক শহরে বাস করেন। তিনি

রাজপ্রাসাদে স্বল্প বেতনের নিম্নপদে চাকরি করতেন এবং অনেক দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপন করতেন।

একদিন ভােরে তিনি লক্ষ্য করেন, এক লােক একটি কচ্ছপ বাজার থেকে কিনে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। কচ্ছপের পরিণতির কথা ভেবে কুং ইউ খুবই ব্যথিত হন। কুং ইউ কচ্ছপের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। কচ্ছপটি নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষার জন্য লােকটির নিকট কুং ইউ বেশী দামে কচ্ছপটি ক্রয় করার প্রস্তাব দেন। বেশী দাম পাওয়ার লােভে, লােকটি কুং ইউর কাছে কচ্ছপটি বিক্রী করেন। কুং ইউ কচ্ছপটি কিনে নিয়ে নদীতে ছেড়ে দেন।

কচ্ছপটি বুঝতে পারে কুং ইউ তার জীবন রক্ষা করেছেন। এজন্য কচ্ছপটি নদীর গভীর পানিতে যাওয়ার সময় কুং ইউর দিকে কৃতজ্ঞতাভরে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকায়। কুং ইউ এই অভাবনীয় দৃশ্য লক্ষ্য করেন এবং কচ্ছপটি গভীর জলে ডুব দেয়া পর্যন্ত তার গমনপথের দিকে কুং ইউ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন।

এ ঘটনার কয়েক বছর পর, কুং ইউর চাকুরীতে পদোন্নতি হয়। ইতিমধ্যে রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে সেই দেশের রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। রাজ্যের এই সংকটময় মুহুর্তে কুং ইউর পরামর্শে রাজা সেই বিদ্রোহ দমন করেন। রাজা এতে খুশী হয়ে রাজ্যের খুব উচু এবং সম্মানী পদে কুং ইউকে অধিষ্ঠিত করেন।

কুং ইউ যখন উচ্চ পদে আসীন হন, তাকে লর্ড সম্মান সূচক উপাধি প্রদান করার জন্য একটি ধাতুনির্মিত সীলমােহর তৈরি করতে রাজকীয় কারিগরকে আদেশ দেয়া হয়। রাজার আদেশ পেয়ে কারিগর সীলমােহর তৈরির কাজে লেগে যায়। সীলমােহরটি তৈরির জন্য কারিগর যখন ছাচে ঢালাই দিতে যায়, তখন এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখা যায় । পিছনে ঘাড় বাঁকা তাকানাে অবস্থায় একটি কচ্ছপের ছবি সীলমােহরে ফুটে উঠে। এই দৃশ্য দেখে কারিগর বিস্মিত হয়। কারিগর পুনরায় সীলমােহর তৈরির কাজে হাত দিতেই একই ঘটনার দৃশ্য দেখা যায়। যখনই সীলমােহর তৈরির জন্য কারিগর চেষ্টা করেন, ততবার কচ্ছপের ছবি ভেসে উঠে। কারিগর এই ঘটনায় খুব হতচকিয়ে যান। কি ভুতুরে কান্ড! কারিগর মহামান্য লর্ড কুং ইউকে নতজানু হয়ে এই আশ্বর্য ঘটনা সর্ম্পকে বলেন,

“মহামান্য লর্ড, আমাদের মহামান্য রাজার নির্দেশে আপনাকে নতুন পদমর্যাদার সম্মান সূচক উপাধি প্রদানের জন্য একটি সীলমােহর তৈরির আদেশ পাই। কিন্তু যতবার সীল তৈরির প্রস্তুতি নিতে যাই, ঘাড় বাঁকিয়ে তাকানাে একটি কচ্ছপের ছবি পুনঃ পুনঃ সীলমােহরে ভেসে উঠে।” এ ঘটনা শােনার পর নতুন মহামান্য লর্ড কুং ইউ সীলমােহর করতে গিয়ে ঘাড় বাঁকানাে একটি কচ্ছপের ছবি দেখতে পান। নতুন লর্ড কুং ইউ এ ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে এই অদ্ভুত ঘটনা মহামান্য রাজা জানাতে পারেন। মহামান্য রাজা নতুন লর্ড কুং ইউকে এই আশ্চর্য ঘটনা সর্ম্পকে জানতে চান। তার জন্য সীলমােহর তৈরি করতে কেন কচছপের ছবি ভেসে উঠে। রাজার এই প্রশ্নে নতুন লর্ড কুং ইউ হতবিহ্বল হয়ে চুপ করে থাকেন। একদিন কুং ইউ রাজপ্রাসাদ থেকে কাজ শেষে বাড়ীতে রওনা হতেই হঠাৎ পূর্বের ঘটনাটি মনে পড়ে। পরদিন মহামান্য রাজদরবারে লর্ড কুং ইউ পূর্বের ঘটনার কথা রাজাকে জানান।

“অনেক বছর পূর্বে আপনার দরবারে যখন নিম্নপদে কাজ করতাম, তখন এক লােক বাজার থেকে একটি কচ্ছপ কিনেন, বাড়ীতে নিয়ে রান্না করার উদ্দেশ্য। কচ্ছপটির নিশ্চিত মৃত্যু হবে – এই কথা ভেবে – আমি টাকা দিয়ে লােকটির কাছ থেকে কচ্ছপটি কিনে নিই এবং পানিতে ছেড়ে দেই। কচ্ছপটি কেন জানি বুঝতে পেরেছিল আমি তার জীবন রক্ষা করেছি এবং পানিতে ছেড়ে দেয়ার পর কচ্ছপটি ঘাড় বাঁকা করে আমার দিকে তাকিয়ে যেন বারবার আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিল।”

“মাননীয় ধর্মাবতার, বর্তমানে আমাকে লর্ড উপাধিতে ভূষিত করেছেন। সীল তৈরির সময় যে কচ্ছপের ছবি বারবার ভেসে উঠে, আমার মনে হয়, আমার বর্তমান উন্নতির প্রধান কারণ উক্ত কচ্ছপের হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষার কারণে স্বর্গের দেবতাগণ খুশী হয়ে আমার জন্য আশীর্বাদ করছেন।”

মহামান্য সম্রাট রাজসভাসদগনের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “যারা ভাল কাজ করেন, স্বর্গের দেবতাগণ তাদের পুরস্কার এবং উন্নতির জন্য আশীর্বাদ করেন। লর্ড কুং ইউ এর ঘটনা একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন।”

সুত্রঃ সজল কান্তি বড়ুয়ার লিখা প্রানির প্রতি দয়া বই থেকে সংগৃহীত


পরসহস্র জাতক

পরসহস্র জাতক

পুরাকালে বারাণসীরাজ ব্ৰহ্মদত্তের সময় বােধিসত্ত্ব উদীচ্য ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণপূর্বক তক্ষশিলা নগরে সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হইয়াছিলেন। তিনি বিষয়বাসনা পরিহার করিয়া প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি লাভপূর্বক হিমালয়ে অবস্থিতি করিতেন। সেখানে পঞ্চশত তপস্বী তাহার শিষ্য হইয়াছিল। | একবার বর্ষাকালে তাহার প্রধান শিষ্য সার্ধদ্বিশত তপস্বিসহ লবণ ও অম্ন সংগ্ৰহাৰ্থ লােকালয়ে অবতরণ করিয়াছেন, এমন সময়ে বােধিসত্বের দেহত্যাগকাল সমাগত হইল। তখন উপস্থিত শিষ্যগণ, তিনি কি আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করিয়াছেন তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে প্রশ্ন করিলেন, “আপনি কি গুণ লাভ করিয়াছেন?” বােধিসত্ত্ব বলিলেন, “নাস্তি কিঞ্চিৎ”  এবং ক্ষণকাল পরেই তমুত্যাগ করিয়া আভাস্বর ব্রহ্মলােকে * জন্মগ্রহণ করিলেন। তাঁহার উত্তর শুনিয়া তপস্বিগণ স্থির করিলেন, ‘আচাৰ্য্য কিঞ্চিত্র জ্ঞান লাভ করিতে পারেন নাই। অতএব তাহারা তাহার শ্মশান-সৎকার করিলেন না। | কিয়দিন পরে প্রধান শিষ্য আশ্রমে প্রত্যাগমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচাৰ্য্য কোথায় ?” তাহারা বলিলেন, “আচাৰ্য্য উপরত হইয়াছেন।” “তােমর আচাৰ্য্যকে অধিগমসম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে কি?” “জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।” তিনি কি উত্তর দিয়াছিলেন ?” “তিনি বলিয়াছিলেন, ‘নাস্তি কিঞ্চিৎ। এইজন্যই আমরা তাহার শ্মশান-সৎকার করি নাই।” “তােমর। আচার্যের কথার অর্থ বুঝিতে পার নাই। নাস্তি কিঞ্চিৎ’ বলায় তাহার এই অভিপ্রায় ছিল যে, তিনি অকিঞ্চায়তন-সমাপত্তি। লাভ করিয়াছেন। প্রধান শিষ্য সতীর্থদিগকে এই কথা বুঝাইবার জন্য পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তাহারা তাহা বিশ্বাস করিলেন না । তপস্বীদিগকে সংশয়মান দেখিয়া বােধিসত্ত্ব ভাবিলেন, ‘ইহারা কি মূখ ; আমার প্রধান শিষের কথাতেও শ্রদ্ধা স্থাপন করিতেছে না। আমাকেই দেখিতেছি, প্রকৃত ব্যাপার প্রকট করিতে হইল। অনন্তর তিনি ব্রহ্মলােক হইতে আগমন করিয়া মহানুভব-বলে আশ্রমপাদের উপরিভাগে আকাশে অধিষ্ঠান করিয়া প্রধান শিষ্যের প্রজ্ঞাবল প্রশংসা করিতে করিতে এই গাথা পাঠ করিলেন ;

মুর্থ শিষ্য আচায্যের ক্লেশমাত্র হয় সার,

শ্রুতিমাত্র অর্থগ্রহ না হয় কখন তার।

হউক সহস্রাধিক হেন শিষ্য সমাগম,

কাঁদুক শতেক বর্ষ সেই সব শিষ্যাধম ;

তার চেয়ে প্রজ্ঞাবান এক শিষ্য প্রিয়তর,

বুঝিতে শ্রবণমাত্ৰ হয় যদি শক্তিধর। এইরূপে মহাসত্ব মধ্যাকাশে থাকিয়া সত্য ব্যাখ্যা করিলেন এবং তাহাদিগকে ভৎসনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি ব্রহ্মলােকে প্রতিগমন করিলেন এবং ঐ সকল তপস্বীও ব্ৰহ্মলােক-প্রাপ্তির উপযােগী উৎকর্ষ লাভ করিলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র ।

বণিক  জাতক

বণিক  জাতক

পুরাকালে বারাণসীরাজ ব্ৰহ্মদত্তের সময় বােধিসত্ব এক বণিকের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। নামকরণ দিবসে তাহার নাম রাখা হইয়াছিল “পণ্ডিত।” তিনি বয়ঃপ্রাপ্তির পর অপর এক বণিকের সহিত মিলিত হইয়া ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। এই ব্যক্তির নাম ছিল ‘অতিপণ্ডিত।” ইহারা দুই জনে পঞ্চশত পণ্যপূর্ণ শকটসহ জনপদে গিয়া ক্রয় বিক্রয় দ্বারা বিলক্ষণ লাভবান হইয়া বারাণসীতে ফিরিয়া আসিলেন। অনন্তর লাভ-বিভাগকালে অতিপণ্ডিত বলিলেন, আমি দুই অংশ লইব (তুমি এক অংশ লইবে)।” পণ্ডিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি দুই অংশ পাইবে কেন ?” অতি পণ্ডিত বলিলেন, “তুমি পণ্ডিত, আমি অতিপণ্ডিত। যে পণ্ডিত, সে এক ভাগ এবং যে অতিপণ্ডিত সে দুই ভাগ পাইবার উপযুক্ত।” “সে কি কথা? পণ্যের মূল্যই বল, আর গাড়ী বলদই বল, আমরা দুই জনেই ত সমান সমান দিয়াছি; তবে তুমি কিরূপে দুই ভাগ পাইবে ?” “অতিপণ্ডিত বলিয়া।” এই রূপে কথা বাড়াইয়া শেষে তাহার কলহ আরম্ভ করিল। অনন্তর অতিপণ্ডিত ভাবিলেন, “আচ্ছা ইহার মীমাংসার এক উপায় করিতেছি।” তিনি তাঁহার পিতাকে এক তরুকোটরে লুকাইয়া রাখিয়া বলিলেন, “আমরা আসিয়া মখন জিজ্ঞাসা করিব, তখন আপনি বলিবেন, অতিপণ্ডিত দুই ভাগ পাইবে।” তাহার পর তিনি বােধিসত্বের নিকট গিয়া বলিলেন, “ভাই, আমাদের কাহার কি ভাগ প্রাপ্য, তাহা বৃক্ষদেবতার জানা আছে; চল তাহাকে গিয়া জিজ্ঞাসা করি।” তদনুসারে সঁহার দুই জনে সেই তরুতলে উপস্থিত হইলেন এবং অতিপণ্ডিত প্রার্থনা করিলেন, “ভগবতি বৃক্ষদেবতে। আমাদের বিবাদ মীমাংসা করিয়া দিন।” তথন অতিপণ্ডিতের। পিতা স্ব-পরিবর্তন করিয়া বলিলেন, “তােমাদের বিবাদ কি বল।” অতিপণ্ডিত বলিলেন, “ভগবতি, এ ব্যক্তি পণ্ডিত ; আর আমি অতিপণ্ডিত ; আমরা একসঙ্গে ব্যবসায় করিয়াছিলাম ; তাহার লাভের অংশ কে কত পাইব।” ভরুকোটর হইতে উত্তর হইল, “পণ্ডিত এক ভাগ এবং অতিপণ্ডিত দুই ভাগ পাইবেন।” বােধিসত্ত্ব এই বিচার শুনিয়। ভাবিলেন, “এখানে দেবতা আছে কি না আছে, তাহা জানিতে হইতেছে।” তিনি পলাল সংগ্রহ করিয়া কোটরে পূরিলেন এবং তাহাতে অগ্নিসংযােগ করিলেন। ধক ধক্ করিয়া অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল ; অতিপণ্ডিতের পিতা অর্ধদগ্ধশরীরে তাহা হইতে বাহির হইলেন এবং শাখাবলম্বনে ঝুলিতে ঝুলিতে ভূতলে অবতরণ পূর্বক এই গাথা পাঠ করিলেন –

                                                     সার্থক পণ্ডিত নাম ধর তুমি, সাধুবর,

                                      নাহি ইথে সন্দেহের লেশ ; অতিপণ্ডিতের নাম নিরর্থক, হায় হায় !

তারি দোষে এত মাের কেশ। ইহার পর তাহারা সমান অংশে লাভ ভাগ করিয়া লইলেন এবং যথাকালে স্ব স্ব কৰ্ম্মানুরূপ ফলভােগার্থ লােকান্তরে গমন করিলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র ।

 

error: Content is protected !!