মানবজীবনে মূল্যবোধ

ঝর্না বড়ুয়া

শিক্ষা হলো মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন। যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব বিকাশ সাধন করে তাই প্রকৃতশিক্ষা। একজন মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করে থাকে জীবনের প্রয়োজনে। যেশিক্ষা লাভ করে মনুষ্যত্বের পূর্ন বিকাশ ঘটে তাকেই পরিপূর্ণ মানুষ বলা যেতে পারে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে “মানব জীবন দূর্লভ”। এ দূর্লভ মানব জীবনকে সার্থক করতে হলে চাই আর্দশজীবন গঠন। এ আর্দশ জীবন গঠনে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ধারন ও অনুশীলন করতে হবে।

আপাতদৃষ্টিতে মূল্যবোধ (Values) ও নৈতিকতা (Moral Principles / Code of Conduct) মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মাঝে স্পষ্টতই সুনির্দিষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। মূল্যবোধ শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট সমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভৌগোলিক অবস্থানভেদে এর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়ে থাকে। কিন্ত নৈতিকতা হলো বিশাল অর্জন যা সর্বদা অনুশীলনীয়। এর প্রভাব সার্বজনীন ও গোটা জীবনে। পৃথিবীর সর্বক্ষেত্রে, সর্বস্থানে, সর্ববয়সেও সর্বত্র নিজেকে উপস্থাপন করার একমাত্র শিক্ষা হলো নৈতিকতা। তাই যার মধ্যে একবার নৈতিকতার বীজ বপন করা যায় তিনি সারাজীবন সুন্দরভাবে জীবন অতিবাহিত করে এবং অপরকেও আর্দশময় জীবন গঠনে সহযোগিতা করে। পরিবার সমাজ রাষ্ট্রে সর্বত্র প্রশংসিত হয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে ভুটান দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটি রাজতন্ত্রের দেশ। ভুটান উত্তরে চীনের অঞ্চল, পশ্চিমে ভারতের সিকিম ও তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা, পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ এবং দক্ষিণে আসাম ও উত্তরবঙ্গ বিশাল বনভূমি বেষ্টিত সবুজে সবুজে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দৃষ্টিনন্দিত দেশ। ভুটানের মানুষ এক ঘন্টায় ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) গাছ লাগিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। মোট আয়তন মাত্র ১৪,৮২৪ বর্গমাইল। বিশ্বের ১৩৩তম ক্ষুদ্র দেশ। প্রাণী ও উদ্ভিদের এক অভয়ারণ্যে। ভুটান জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। দেশটিকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড বলা হয়। যেখানে তামাক চাষ নিষিদ্ধ এবং বিক্রিও নিষিদ্ধ। পর্যটকরাএ আইন ভঙ্গ করলে বিরাট অংকের ফ্রি প্রদান করতে হয়। মোট জনসংখ্যা প্রায় আট লক্ষ। কৃষিনির্ভর দেশটিকে মোট জনসংখ্যার ৭০% লোক কৃষিজীবী। ভুটানের রাস্তায় কোন গৃহহীন মানুষ নেই। যদি কোন কারণে গৃহ হারান শুধুমাত্র রাজার শরণাপন্ন হতে হয়। রাজা জমি ও বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন যাতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। তাহলে সহজে অনুমেয় বিশ্বের ১৩৩তম ছোট্ট একটা দেশ অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা না হয়েও কতটা সুখী জীবনের অধিকারী। মহাকারুনিক তথাগত বুদ্ধের দেশিত নৈতিক আর্দশ অনুশীলন ও ধারণ করে প্রতিটি নাগরিক হয়ে উঠেছেন সঠিক আদর্শবান ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। পরিশ্রম, সততা ও ন্যায়পরায়নতা দেশটিকে মহান সম্মান এনে দিয়েছে। সর্ব প্রাণীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বেশির ভাগ লোক নিরামিষ ভোজী ও প্রকৃতিপ্রেমী। কথিক আছে, কোন পর্যটক ভুল করে কোন ব্যাগ বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হারালে আবার সে স্থানে গিয়ে ঐসব হারানো দ্রব্যাদি একই অবস্থায় পেয়ে থাকে। কেউ কারো জিনিস অনুমতি ছাড়া ধরে না। কেমন মহৎ জীবনের অধিকারী ~ তা শিক্ষণীয় ও অনুশীলনীয়। বৌদ্ধিক আর্দশে ও ধর্ম শিক্ষালয়ে তাদের সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। মহামতি বুদ্ধের পঞ্চশীল পালন করলে বিশ্বের প্রতিটি নাগরিক হয়ে উঠতে পারে আর্দশিক মানবতাসম্পন্ন ~ তা সহজে প্রমাণ পাওয়া যায় ভুটানের জীবনযাত্রা থেকে। বজ্রড্রাগনের দেশ নামে পরিচিত ভুটান এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ হিসাবে খ্যাত।

সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও আর্দশে বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসাবে লেলিন ও মাওসেতুংয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁরা রাশিয়া ও চীনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। অথচ আজকের দিনে সমাজতান্ত্রিক আর্দশের নেতারা শ্রমিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে নিজেরাই ভোগ বিলাসী জীবন যাপন করে থাকেন। এমন কি সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে সরে এসে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার দিকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ছে। গনতান্ত্রিক আর্দশ বিকশিত হয়েছিল মানুষের মৌলিক অধিকার যথা বাক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকৃত মানবাধিকার গঠনে।

ইউরোপ ও আমেরিকার সমাজে যে মূল্যবোধ বিদ্যমান তা উপমহাদেশের সমাজে বড্ড বেমানান। পশ্চিমের সমাজে লিভ টুগেদার, বিবাহ বর্হিভূত সন্তান জন্ম দেওয়া, মধ্যপান খুবই নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের অংশ। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে এ সমস্ত বিষয়াদি কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না বরঞ্চ নিন্দাযোগ্য। তেমনি আরব সমাজে বহু বিবাহ ও অধিক সন্তান জন্ম দেওয়াও আমাদের উপমহাদেশের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নেয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে মানব জীবনের মূল্যবোধকে বিচার করলেও প্রকৃত পক্ষে, সেইটাই প্রকৃত মূল্যবোধ হবে যা নিজের জন্য মঙ্গলজনক অপরের জন্যও মঙ্গলজনক এবং মানব সভ্যতাকে সুরক্ষার কর্মে বিরাজমান থাকবে ।

মানব শিশু জন্মের পর থেকে প্রথম পাঁচটা বছর যা শিখে যেমন হাঁটা, চলা, বসা, কথা বলা, খাওয়া-দাওয়া, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, জীবন পদ্ধতি এবং আশে পাশে পরিবেশ সম্বন্ধে ~ সেই শিক্ষা সারা জীবনের সাথে গেঁথে যায়। প্রকৃতির আলো, বাতাস, গাছপালা, ঝড়-বৃষ্টি, নদী- নালা, পশু-পাখী প্রভৃতি থেকেও মানব শিশু শিক্ষা লাভ করে থাকে। অর্থাৎ মায়ের কোলে শিশুর প্রথম হাতে কড়ি। ঘুম থেকে উঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত একটা শিশুর করণীয় কর্তব্যগুলো ধাপে ধাপে মাতাপিতার কাছ থেকে আয়ত্ব করে। এতে করে পরিবারের আর্দশ শিশুর জীবনে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। মাতাপিতার সততা, সৎ চিন্তা, চেতনা ও উপদেশ ধীরে ধীরে শিশু মনে ধারণ করতে থাকে। পরিবারে কথা ও কাজে সমন্বয় থাকা চাই অন্যথা শিশুর কোমলমনে দ্বিধা-দ্বন্ধ দেখা দিবে। তাই পরিবারের কাছ থেকে সর্বদা শিশু সততা, সৎ, সত্যবাদিতা, মনের উদারতা ও ন্যায়পয়ারনতা শিক্ষা লাভ করবে। এভাবে শিশুরা পরিবার, বিদ্যালয়, খেলার সাথী, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে আর এই নৈতিক শিক্ষায় মানব জীবনে মূল্যবোধ জাগ্রত করে ।

শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলেন। সামাজিক, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রীতিনীতি মূল্যবোধ ও নৈতিকতা তৈরী করেন। দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মানবিক গুনাবলীর বিকাশ ঘটানোর গুরু দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষকরা। যথা প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরুতে ধর্মীয় উপদেশ, জাতীয় সংগীত এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে দিনের কর্মসূচী আরম্ভ করা হয়ে এতে করে শিশু মন থেকে ধার্মিকতা বা ধর্ম পরায়ন হওয়ার বীজ বপন করা , জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে দেশপ্রেম সৃষ্টি করা এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে শরীরকে শক্ত মজবুত ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিক্ষা বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে শিশুদের মননশীলতা বিকাশে সৃজনশীল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। যেমন বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতা, ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, বির্তক ও উপস্থিত বক্তব্য, কবিতা আবৃত্তি, গানের প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলোর পর্যালোচনাসহ আরো নানামুখী সংস্কৃতি কর্মে উদ্ভুদ্ধ করে শিশুর মানসিক বিকাশ সাধনে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। এভাবে আজকের প্রজন্ম আগামী দিনের সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে।

গুরুজনদের সন্মান করা, নমনীয় আচার আচরন করা, একে অন্যের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালবাসা, স্নেহ-মমতার মধ্য দিয়ে মানব প্রেম তৈরী করা সর্বজনীন মানবতাসম্পন্ন জীবন গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা মাতাপিতা ও শিক্ষকদের দায়িত্ব মূখ্য। বিপদে ধর্য্য ধারণ করা, রাগসংবরণ করা, আপদে বিপদে একে অন্যকে সহযোগিতা করা, বন্ধুবৎসল হওয়া, পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া, পরিশ্রমী ও মনোবল সম্পন্ন হওয়া, সঠিক অধ্যাবসার মাধ্যমে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো, ভদ্রতা, নম্রতা ও দেশপ্রেম দিয়ে জীবন কে জয় করার নিয়মানুবর্তিতা যদি একবার ছাত্রছাত্রীর জীবন পদ্ধতির সাথে পরিচিত করে দেওয়া যায় তাতে মাতাপিতার জীবন সাথর্ক হয়ে উঠে। তাই সৎ নিষ্ঠাবান চরিত্র গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে শিশুকালের গুরুত্ব সর্বাধিক। সে শিক্ষা পরবর্তীতে গোটা জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

তাই আর্দশ মানবিক মূল্যবোধ তৈরী করার মূল সূতিকাগার হলো পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেক মাতাপিতা চান তাদের সন্তানরা অনেক বড়ো হোক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হউক। যদি মাতাপিতা এমন মানবিক শিক্ষায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেন প্রতিটি সন্তানকে তাতে মা বাবার আশার যেমন প্রতিফলন ঘটে তেমনি মানবজীবনের সাথর্কতা পাওয়া যায়। সুখী সমৃদ্ধ ও আর্দশ জীবনের অধিকারী হয়ে সমাজে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।

ব্যক্তিগত অনুভবে দেখা যায় প্রতিটি সন্তানের সাথে যদি মাতাপিতাগণ বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে । সন্তানের মনের কথাগুলো আন্তরিকতার সহিত শুনা, তাদের চাহিদা গুলো যথাসম্ভব পূরণ করা, স্কুলের প্রতিদিনের কার্যাদি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষন করা, কোন ধরনের পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে ভালোভাবে তদারকি করা। ভালো, মন্দ, হিতাহিত জ্ঞান সম্বন্ধে সম্যক ধারনা দেওয়া। আশে পাশের পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে কিভাবে নিজেকে খাপ খাওয়ানো যায় তা কাউন্সিলিং করা। উপস্থিত বুদ্ধি তৈরী করা। অনন্ত প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘন্টা সময় আলাপ আলোচনা করা । উভয়ে মন খুলে কথা বলে এক কথায় মননশীলতা তৈরী করে দেওয়া মাতাপিতার প্রধান কাজ। কৈশোর বয়সে হরমোন পরিবর্তনে কারনে সন্তানের মাথা কীটে কীটে হয়ে উঠে তখন বিশেষ করে মাকে বেশী করে সন্তানদের সময় দিয়ে শরীরের বিভিন্ন পরিবর্তন সম্বন্ধে ধারনা দিয়ে কিভাবে নিজেদের সুরক্ষিত করা যায় তা খোলামেলা ভাবে আলোচনা করা দরকার। এতে করে সন্তানরা নিরাপদ বোধ করে পরিবারকে। এককথায় ব্যক্তি , সমাজ , জাতি সর্বক্ষেত্রে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হলে প্রথমে পরিবার থেকে শিক্ষাটা শুরু করতে হবে ।

ব্যাপক অর্থে সন্তানকে জানতে হবে এবং জানাতে হবে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন, মূল্যবোধের কথা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প সংস্কৃতিবোধ এবং ইতিহাস, দেশপ্রেমও মানবতার মহাপ্রেম । তবেই “আলোয় আলো ভরা” হবে আগামী প্রজন্মের এই সন্তানেরা। গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ দেশ, সুন্দর বিশ্ব ও আর্দশ মূল্যবোধের মানব জীবন । জীবনে মূল্যবোধ থাকলেই সে জীবন হবে সুন্দর , স্বার্থক , সর্বজন নন্দিত আত্মশুদ্ধির মানব জীবন |
তাই প্রত্যেকের কর্ম হোক “DO ALL THINGS WELL”
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।

error: Content is protected !!