কৌশিক জাতক

কৌশিক জাতক

একবার বারানসি রাজা সবলে যুদ্ধ জাত্রা করছিলেন। তিনি নগর বাইরে এক উদ্যানে শিবির স্থাপন করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব তখন রাজার অমাত্য ছিলেন।

ঐ সময় সেই উদ্যানে এক পেচক বাঁশের বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। পেচক নিশাচর প্রাণী। তারা দিনের বেলায় বের হয় না নিজ বাসা থেকে। পেচককে দেকতে পেয়ে দলে দলে কাক এসে তার চারিদিকে ভিড় করল।

পেচক তখন দিন কি রাত সূর্য অস্ত গেছে কিনা তা না দেখেই বাঁশের ঝোপ থেকে বের হয়ে পালাবার চেষ্টা করল। তখন কাকেরা তাকে আঘাত করতে করতে মাটিতে ফেলে দিল।

তখন তা দেখে রাজা বোধিসত্ত্বকে ডেকে বললেন, পণ্ডিত বর, কাকেরা পেচককে মাটিতে ফেলে দিল কেন?

বোধিসত্ত্ব বললেন, যারা অকালে বাসা থেকে বের হয়, তাদের এই দশাই হয়। এইজন্যই অকালে বাসিস্থান হতে বের হতে নেই। তারপর বোধিসত্ত্ব একটি গাথার মাদ্যমে বললেন, যারা বুদ্ধিমান তাদের কালাকাল জ্ঞান থাকে। তারা অকালে বাড়ি থেকে কোথাও যায় না। বহু সেনা থাকা সত্ত্বেও রাজাদের পক্ষে অকালে অথবা বর্ষাকালে জুদ্ধজাত্রা করা অনুচিত। তা হলে অশেষ দুর্গতি ভগ করতে হয়। বিচক্ষণ ব্যক্তি বিপক্ষের সব ছিদ্র জেনে জুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শত্রুদের দমন করে। পেচক দিনে দেখতে পায় না, কিন্তু কাকেরা রাত্রিকালে দেকতে পায় না। তাই পেচক যদি রাত্রি কালে বের হত তাহলে কাকেরা তার কিছুই করতে পারত না।

বোধিসত্ত্বের এই বাণী শূনে প্রীত হলেন বারানসি রাজ। তিনি ঘোষণা করে দিলেন, বর্ষাকালে তিনি যুদ্ধ যাত্রা করবেন না। তিনি নিজের ভুল বুজতে পারলেন। সামান্য একটি পেচকের দৃষ্টান্ত দ্বারা বোধিসত্ত্ব রাজাকে কালাকাল জ্ঞান দান করে কখন বাড়ি থেকে বের হতে হয় বা কখন কোন কাজে বাড়ি থেকে বের হতে নেই তা ব্যাখ্যা করে দিলেন।

কৌশিক পেচকের আর এক নাম।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

মহা মঙ্গল জাতক

মহা মঙ্গল জাতক

পুরাকালে বোধিসত্ত্ব এক এক দূর গ্রামে এক ধনী ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রক্ষিত কুমার। বয়ঃপ্রাপ্তির পর তিনি তক্ষশীলায় গিয়ে বিদ্যা শিক্ষা করেন। তারপর বাড়ি ফিরে এসে বিবাহ করেন।

এরপর তাঁর মাতা পিতার মৃত্যু হলে তিনি সঞ্চিত ধন দেখে বিষয়বৈরাগ্য জাগল তাঁর মনে। তিনি দান করে সমস্ত ধন শেষ করে দিলেন। তারপর বিষয়বাসনা ত্যাগ করে হিমালয়ে চলে গিয়ে ঋষি প্রবজ্যা গ্রহন করলেন। তিনি সেখানে বন্য ফলমূল খেয়ে একটি পর্ণশালায় বাস করতে লাগলেন। তিনি ধ্যানভিজ্ঞা লাভ করলেন। অনেক তাপস তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করল এবং ক্রমে তাঁর শিষ্যত্ব পাঁচশত হল।

একদিন এই সমস্ত তাপস আচার্য বধিসত্তের নিকট গিয়ে বললেন, আচার্য বর্ষাকাল উপস্থিত। আমরা এখন হিমালয় হতে নেমে লবণ ও অম্ল সংগ্রহের জন্য জনপদে গিয়ে ভিক্ষা করি। এতে আমদের শরীর সবল হবে এবং পদব্রজে তীর্থযাত্রাও হবে।

বোধিসত্ত্ব বললেন, যদি ইচ্ছা জয় তাহলে তোমরাই যাও। আমি এখানে থাকব।

তখন শিষ্যরা তাঁকে প্রণাম করে হিমালয় থেকে নেমে জনপদে ভিক্ষা করতে করতে বারাণসীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁরা রাজ্যধ্যানে বাস করতে লাগলেন। নগরবাসীরা বিশেষ সম্মানের সঙ্গে তাদের আদর অভ্যর্থনা করল।

তারপর একদিন বারণসী নগরে এক জায়গায় বহু লোক সমবেত হয়ে মঙ্গল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। কিন্তু সেখানে উপস্থিত সব লকের সংশয় ছেদন করে কেউ মঙ্গল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। তখন সেই সব লোক রাজ্যধ্যানে গিয়ে সেই সব তাপসদের ঐ প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞেস করল। বারণসীরাজ নিজেও সেই আলোচনাসভায় ছিলেন। তিনি সকলের সঙ্গে উদ্যানে তাপসদের কাছে গেলেন। তখন তাপসগণ রাজাকে বললেন, আমরা ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। আমাদের আচার্য মহাপ্রাজ্ঞ। তিনি হিমালয়ে থাকেন। তিনি দেবতা ও মনুষ্য সকলের হৃদয় জয় করে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।

রাজা বললেন, হিমালয় অতি দূর ও দুর্গম। আমি সেখানে যেতে পারব না। আপনারা দয়া করে আচার্যের কাছে গিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর শূনে ফিরে এসে আমাকে বলুন।

শিষ্যরা এতে সম্মত হয়ে হিমালয়ে চলে গেলেন। তাঁরা আচার্যকে প্রণাম করলে আচার্য তাদের জিজ্ঞাসা করল, রাজা কি ধার্মিক? জনপদে লকের চরিত্র কেমন দেখলে?

শিষ্যরা এই প্রশ্নের উত্তর দেবার পর রাজার মঙ্গল প্রশ্নের সব কথা বললেন। বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যই রাজা তাঁদেরকে এখানে পাথিয়েছেন। অনুগ্রহ করে এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে বুঝিয়ে দিন। তাঁরা একটি গাঁথার মাধ্যমে বললেন, স্বস্ত্যয়নকালে লোকে কোন বেধ, কোন সুত্ত পাঠ করে? টা কিভাবে জপ করে? ইহামুত্র কিভাবে সুরক্ষিত হবে?

তখন বোধিসত্ত্ব কয়েক্তি গাথায় মঙ্গল প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তিনি সব গাঁথার মাধ্যমে বলতে লাগলেন, দেবগণে, পিতৃগণে, সরীসৃপ আদিজীবগণে যে জন মৈত্রীগুণ দ্বারা তুস্ত করে সে সর্বদা সবার প্রীতি লাভ করে এবং এতে ভূত স্বস্ত্যয়ন সম্পন্ন হয়।

যারা সবিনয় ব্যবহারে নরনারী, স্ত্রীপুত্র পরিবার ও সর্বভূত পরিতুষ্ট হয়, যে ব্যক্তি অপ্রিয়বাদীদের প্রীয় ও মিস্তবাক্যদ্বারা তুস্ত করে এবং ক্ষমার অবতারের মত শোভা পায়, সে ইহলোক ও পরলোকে সর্বত্র মঙ্গল্ভাজন হয়। তার কোন শত্রুভয় থাকে না। এতেই হয় তার অধিবাস স্বস্ত্যয়ন।
আমি বিদ্যাবলে, কুলমানে, জাতিতে ধনে বড় বলে যে কখনো আস্ফালন করে না, বাল্যবন্ধুকে আত্মজ্ঞানে দেখে এবং কখন তার অপমান করে না, যে ব্যক্তি সাধু, প্রাজ্ঞ ও মতিমান, সে ব্যক্তি অনায়াসে কারজ বিচার করতে পারে, সে সহায় বা বাল্যবন্ধুদের প্রিয় হয় এবং এভাবেই তার সহায়ক স্বস্ত্যয়ন হয়।

যে জন সাধু ব্যাক্তির সাথে মিত্রতা করে মিত্রের বিশ্বাস ভাজন হয়, যে জন আত্মত্যাগী এবং মিত্রকে ধনের ভাগ দেয়, তার মিত্র সবস্ত্যন হয়।
যার স্ত্রীসমান গুণসম্পন্না, ধর্মপরায়ণা, অবন্ধ্যা ও কুলশীলে ধন্যা, তার দ্বার স্বস্ত্যয়ন হয়।

যার রাজা প্রতাপশালী, যশে,মানে, শীলে, তেজে অদ্বিতীয়, যাকে বন্ধুভাবে গ্রহন করে দ্বিধাহীন চিত্তে, সেই ব্যক্তি এতে রাজস্বস্ত্যয়ন হয়।
যে জন শ্রদ্ধার সঙ্গে অন্নদান, মাল্য ও গন্ধবিনোদন প্রসন্নচিত্তে দান করে সকলের মঙ্কে প্রীত করে, তার স্বর্গস্বস্ত্যয়ন হয়।

জ্ঞানবৃদ্ধ সুবিখ্যাত ও শীল্বান ঋষিগণে যে জন অর্চনা করে এবং তাদের কৃপাবলে যার মন শুদ্ধাচারে আর্য ধর্মে রত হয়েছে, যে জন সাধুসঙ্গপরায়ণ ও শ্রদ্ধাবান, তার নিঃসন্দেহে অর্হৎ স্বস্ত্যয়ন সম্পন্ন হয়েছে।

বোধিসত্ত্ব এইভাবে আটটি গাঁথার দ্বারা মঙ্গল প্রশ্ন সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে তার ব্যাখ্যা করলেন। তারপর বললেন, যারা বুদ্ধিমান, তারা এইভবে স্বস্ত্যয়ন করে চলে। নিমিত্ত অসত্য। তাই তার প্রয়োজন নেই।

শিষ্যরা প্রকৃত মঙ্গল কি তা জেনে নিয়ে আশ্রমে সাত আটদিন কাটিয়ে বারাণসীতে ফিরে গিয়ে রাজাকে মঙ্গল-প্রস্নের উত্তর দিলেন। সকলে প্রকৃত মঙ্গল কি তা জেনে মঙ্গল কর্মের অনুষ্ঠান করতে লাগল। এরপরে তাপসেরা হিমালয়ে ফিরে গেলেন।
বোধিসত্ত্ব ব্রহ্মবিহার ধ্যান করতে করতে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির উপযুক্ত হলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

 

সত্য ধর্ম   জাতক

সত্য ধর্ম জাতক

বারণসী রাজা ব্রম্মদত্তের সময় এক পুত্র ছিল। তার নাম ছিল দুষ্টকুমার। তার স্বভাবটা ছিল ঠিক নামের উপযুক্ত। দুষ্টকুমারের স্বভাব এতো নিষ্ঠুর ও ভীষণ ছিল যে, বারাণসী নগরের লোকেরা তাকে সব সময় ভয় করে চলত।
কারো সঙ্গে কোন কথা বলতে হলে দুষ্ট কুমার না হয় তাকে গালাগালি করত, না হয় প্রহার করত। সে রাজপুত্র বলে সবসময় মদমত্ত হয়ে চলত। কেও তার কথার উপর কোন কথা বলতে পারত না। তাকে দেখলেই সকলের মনে হত, একটা রাক্ষস জেন তাদের গ্রাস করতে আসছে।একদিন দুষ্ট কুমার জল ক্রীয়া করার জন্য অনুচরদের সঙ্গে নদী তীরে গেল। তারা নদীর জলে নেমে সকলে জল খেলায় মত্ত হয়ে উঠল। এমন সময় মেঘে মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল এবং ভীষণ জড় উঠল। নদীর ঢেউ গুলো উথাল পাতাল করতে লাগল। কুমার তার অনুচরদের বলল, তোমরা আমাকে মাঝ নদীতে স্নান করিয়ে আন।তখন অনুচরগণ নিজেদের মধ্যে যুক্তি করে বলাবলি করতে লাগল, এই সুযোগে পাপিষ্ঠ তাকে মেরে ফেলি। তারপর রাজা জা করার করবেন। এতো অত্যাচার আর সহ্য হয় না। এর হাত থেকে অন্তত নিস্তার পাই।এই বলে তারা কুমারকে ধরে মাঝনদীতে নিয়ে জলের মধ্যে ফেলে দিয়ে নিজেরা তাড়াতাড়ি জল থেকে উঠে এলো।
কুমারের যে কয়জন সচিব নদীতীরে অপেক্ষা করছিল তারা এ ব্যাপারে কিছু জানত না। তারা অনুচরদের জিজ্ঞাসা করল কুমার কথায়?অনুচরেরা বলল, ঝড়বৃষ্টি দেখে হয়ত আগেই উঠে এসেছেন, হয়ত তিনি জড় জলের মধ্যে বাড়ি চলে গেছেন।
এরপর তারা রাজ বাড়িতে সবাই ফিরে গেলে রাজা তাদের কুমারের কথা জিজ্ঞাসা করলেন।অনুচরেরা বলল, মহারাজ, জল ক্রীয়া করতে করতে দারুণ জড় জল শুরু হওয়ায় আমরা তাঁকে দেখতে না পেয়ে ভাবলাম তিনি হয়ত জল থেকে উঠে একাই বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাই আমরাও ফিরে এলাম।কিন্তু প্রাসাদে কোথাও কুমারকে পাওয়া গেল না। রাজা তৎক্ষণাৎ নিজে নদী তীরে গিয়ে চারদিকে খোঁজ করতে লাগলেন। অনুচরেরা তাঁকেও সাহায্য করতে লাগল। কিন্তু কোথাও খোঁজ পাওয়া গেল না কুমারের। তখন রাজা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।এদিকে দুষ্ট কুমার স্রোতের টানে ভেসে জেতে লাগল অসহায়ভাবে। সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগল। এমন সময় এক্তি বড় কাঠ ভেসে আসছে দেখে তার উপর চেপে বসল। পরে দেখল, একটি সাপ, একটি ইঁদুর ও একটি শুকপাখি স্রোতে ভাসতে ভাসতে সেই কাঠের উপর এসে বসল। দুষ্টু কুমার স্থির হয়ে কাঠের উপর বসে রইল। কাঠ ভেসে যেতে লাগল স্রোতের টানে। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এল। ঐ সাপ ও ইঁদুর পূর্বজন্মে কৃপণ বণিক ছিল। এই দুই জন বণিকই তাদের জীবিতকালে প্রচুর স্বর্ণ মুদ্রা অর্থাৎ একজন চল্লিশ কোটি ও অপ্র জন ত্রিশ কোটি নদীর তীরে এক জায়গায় গর্ত করে পুঁতে রাখে। মৃত্যুর পর ঐ ধন পাহারা দেবার জন্য তাদের একজন সাপ আর তাদের একজন ইঁদুর হয়ে সেই গর্তের মধ্যে বসে তাদের ঐ গুপ্তধন পাহারা দিতে থাকে। ঝর বৃষ্টিটিতে তাদের গর্তে জল ঢোকায় তারা বাইরে এসে নদীতে পরে গিয়ে ভাসতে ভাসতে ঐ কাঠের উপর উঠে বসে। শুকপাখিটি নদীর ধারে একটি গাছে বাস করত। প্রচণ্ড ঝরে গাছটি উপড়ে পরে নদীতে পরে যায়। তখন শুকপাখিটি ঝরের মদ্যে উরতে না পারায় নদীতে ভেসে যাওয়া ঐ কাঠের উপর বসে।এইভাবে একটি কাষ্ঠখণ্ডের উপর চারটি প্রাণী এসে আশ্রয় নেয়। ক্রমে রাত্রি হল। চারিদিকে অন্ধকারে ঢেকে গেল। যে সময়ে এই ঘটনা ঘটে, সেই সময় বধিসত্ত্ব এক ব্রাক্ষণ কুলে জন্ম নিয়ে পরে সন্ন্যাসী হয়ে ঐ নদীর তীরে এক জায়গায় এক পর্ণকুটিরে বাস করতেন। সেই রাত্রিতে তখন ঝর বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় তাঁর কুটিরের সামনে ইতস্ততঃ পায়চারি করছিলেন। এমন সময় তিনি রাজকুমারের আর্তনাদ সুন্তে পেলেন। তা সুনে তিনি ভাবলেন, দয়া দাক্ষিণ্যই আমার ব্রত। আমি থাকতে কোন প্রাণীর মৃত্যু হতে দেয়া উচিত নয়। আমি ওকে উদ্ধার করব।এই সংকল্প করে বোধিসত্ত্ব তখনি নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে সেই গুঁড়িটিকে সবলে টেনে তীরের কাছে আনলেন। তারপর রাজপুত্রকে ধরে তীরে উঠিয়ে আনলেন। তখন সেই গুরির উপর আর যে তিনটি প্রাণী ছিল তাদেরকেও একে একে তীরে উঠিয়ে আনলেন।পরে তাদের প্রত্যেককে পরম যত্ন সহকারে তাঁর আশ্রমে নিয়ে এলেন। আগুন জ্বেলে প্রথমে ইতর প্রানীদের এবং পরে রাজকুমারের দেহ সেকলেন। তারপর প্রথমে সাপ, ইঁদুর ও শুককে ও পরে রাজকুমারকে ফলমূল খেতে দিলেন।বোধিসত্ত্বের আচারণে ক্রুদ্ধ হলো দুষ্টকুমার। সে ভাবল আমি রাজপুত্র, আর অরা সব ইতর প্রাণী। অথচ সন্ন্যাসী ওদের আগে সেবা করছে।এই কারণে বোধিসত্ত্বের প্রতি দুষ্ট কুমারের মনে ক্রোধের সঞ্চার হলো। যাই হক দু এক দিনের মধ্যে ওরা সকলে সুস্থ হয়ে উঠল। বন্যার জল কমে গেল।একে একে তারা সকলে বিদায় নিল। প্রথমে সাপ বিদায় নেওয়ার সময় বোধিসত্ত্বকে বলল, প্রভু আপনি আমার বড়ই উপকার করেছেন। আমুক জায়গায় আমার অনেক ধন আছে। আপনার যখন প্রয়োজন হবে আপনি ওইখানে গিয়ে দীর্ঘা বলে ডাকবেন। আপনি ডাকলেই গর্ত হতে বের হয়ে আপনাকে সব ধন দিয়ে দেব।এরপর ইঁদুরও একই কথা বলল বোধিসত্ত্বকে। আপনি প্রয়োজন হলেই ওখানে গিয়ে ইঁদুর বলে ডাকবেন। আমি দাক শূনেই বেরিয়ে এসে ধন দিয়ে দেব।শুকপাখি বিদায় নেবার সময় বলল, প্রভু আমার ধন নেই, আমি ধান দিতে পারব। প্রয়োজন হলে ঐ গাছের তলায় গিয়ে শুক বলে ডাকবেন। আমি আমার জ্ঞাতি বন্ধুদের সাহায্যে রাশি রাশি ধান সংগ্রহ করে এনে দিব।রাজপুত্র দুষ্ট কুমার মনে মনে ভাবল, যদি একবার আমি এই সন্ন্যাসী কে হাতের কাছে পাই, তবে ওকে উচিৎ শিক্ষা দেবার পর ওর প্রাণ সংহার করব।কিন্তু সে মনের ভাব গোপন করে বলল, আমি রাজপদ পেলে আপনি সময় করে পায়ের ধুলো দেবেন। আমি যথাসাধ্য উপাচারে আপনার পূজা করব।একদিন বোধিসত্ত্ব এই চার প্রাণী দের মধ্যে কে কীভাবে তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখে তা একে একে পরীক্ষা করে দেখার সংকল্প করলেন। তিনি প্রথমে সাপের কাছে গেলেন। সাপকে তিনি দীর্ঘা বলে ডাকতেই সাপ এসে সসম্ভ্রমে বলল, আপনাকে আমি এখনি আমার সব ধন এনে দিচ্ছি।বোধিসত্ত্ব বললেন এখন না, আমি প্রয়োজন হলে আসব।তারপর তিনি ইঁদুরের কাছে গেলেন। ইঁদুরকেও ইঁদুর বলে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে বলল, আমি এখনি আমার আমার সব দ্গন এনে দিচ্ছি। বোধিসত্ত্ব বললেন এখন নয়, প্রয়োজন হলে এসে তা নিয়ে যাব।
এরপর তিনি নদীর ধারে সুখপাখির কাছে গেলেন। “শুক” বলে ডাকতেই শুক এসে বলল, আপনার কি ধান দরকার? তাহলে আমি তা যোগার করে অবিলম্বে আপনার কুটিরে পোঁছে দেব।
বোধিসত্ত্ব বললেন না এখন নয়, যখন প্রয়োজন হবে আমি এসে তোমায় বলব।
সবশেষে তিনি রাজবাড়িতে যাবার জন্য বারণসী নগরের পথে রওনা হলেন।

এদিকে পিতার মৃত্যুর পর দুষ্ট কুমার তখন রাজা হয়েছিলেন। যেদিন বোধিসত্ত্ব তার কাছে যাচ্ছিলেন সেদিন সে তার হাতির পিটে চড়ে নগর প্রদক্ষিণ করছিল। সে সহসা সেই সন্ন্যাসীকে দূর থেকে দেকতে পেয়েই ভাবল, ঐ সন্ন্যাসী একদিন আমার উপকার করেছে একথা যাতে কাউকে বলতে না পারে তার জন্য আগেই তার ব্যবস্থা করতে হবে।এই ভেবে সে তার কর্মচারীদের বলল, ঐ ভণ্ড সন্ন্যাসীকে এখনি বেঁধে মশানে নিয়ে যাও। ওকে চোঁরাস্তার মোড়ে মোড়ে দাড় করিয়ে প্রহার করবে। তারপর মশানে নিয়ে গিয়ে মাথা কাটবে। তারপর ধড়টাকে শূলে চড়াবে।রাজার লোকেরা বোধিসত্ত্বকে রাস্তার চোঁমাথায় নিয়ে গিয়ে যতই প্রহার করতে লাগল, বোধিসত্ত্ব কোনরূপ প্রতিবাদ না করে একটি গাথার মধ্যে দিয়ে বলতে লাগলেন, মানুষ আর কাঠ ভেসে যাচ্ছে, লকে বলে, মানুষ ভেসে যাক, কাঠ তুলে নাও। এখন বুঝেছি কথাটা খুবই সত্য। আমি কাঠ ছেঁড়ে মানুষকে তুলে এনে ভুল করেছি। কারণ কাঠই বেশী বেশী মূল্যবান।বোধিসত্ত্বকে যখন প্রহার করা হচ্ছিল তখন রাজপথের ওপর অনেক মানুষ ভিড় জমেছিল। তাদের মধ্যে কিছু বৃদ্ধ লোক ছিলেন। বোধিসত্ত্বকে প্রহার করার সময় তিনি বারবার ঐ একই কথা বলছিলেন। এতে বৃদ্ধ লোকদের মনে সন্দেহ জাগল। তাঁরা ভাবলেন, সন্ন্যাসীর একথা বলার পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। তিনি হয়ত রাজার কোন উপকার করেছিলেন।এই ভেবে তাঁরা বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি বারবার একই কথা বলছেন কেন?বোধিসত্ত্ব তখন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তিনি বললেন, একদিন সন্ধ্যার সময় এই রাজা একটি কাঠের ওপর বসে গঙ্গার স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছিলেন। তার আর্তনাদ শূনে আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে তাঁকে উদ্ধার করি। সেই কাঠের ওপর আরও তিনটি প্রাণী ছিল। তারা হল একটি সাপ, একটি ইঁদুর ও একটি শুকপাখি। আমি সকলকেই নিজের হাতে উদ্ধার করে আমার আশ্রমে নিয়ে আসি। তারপর তাদের সকলকে সেবা করে সুস্থ করে তুলি। কিন্তু ইতর প্রাণীরা মানুষের থেকে বেশি দুর্বল, তাই তাদের আগে সেবা করাই আমার উপর কুপিত হন রাজা। সেই ইতর প্রাণী তিনটি কিন্তু আজও আমার প্রতি কৃতজ্ঞ আছে। আম্র উপকারের কথা আজও ভোলেনি,আমাকে সাহায্য করতে চায়। অথচ এই রাজা আমার প্রাণ নাশ করতে উদ্যত হয়েছেন।বোধিসত্ত্বের এই কথা শূনে সেই বিজ্ঞ লোকেরা বলতে লাগ্লেন,আমাদের রাজা কিরকম দেখ। যে ব্যক্তি তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে, রাজা তাঁরই প্রাণবধ করতে যাচ্ছে। যে অকৃতজ্ঞ পিশাচ উপকারীর উপকার স্বীকার করে না, তাঁর ক্ষমা নেই। তখন সমবেত জনতা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। তখন তারা বলাবলি করতে লাগল, দুষ্ট রাজার দ্বারা আমাদের কোন কাজ হবে না, অতএব একে এক্ষনি মেরে ফেল।ওই বলে তারা তীর-ধনুক, লাঠি, বল্লম প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে আক্রমন করল রাজাকে। নগরেরে সব অধিবাসীরা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করল। রাজা প্রজাদের জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য ভয়ে পালিয়ে গেল। রাজার সেনারাও এই পাপিষ্ঠ রাজাকে রক্ষা করল না। তাছারা তাঁর ভাবল, রাজ্যের প্রজারা যদি রাজাকে না চায় তাহলে আর তাদের বশীভূত করে রাখা যাবে না।প্রজাদের এই আক্রমনে রাজা হাতির পিঠ থেকে পরে গেলেন মাটিতে। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রাণ ত্যাগ করলেন। বিক্ষুব্ধ প্রজারা রাজার মৃতদেহটাকে টেনে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দিল। তারা তখন এক বাক্যে বলল এই তপস্বী এখন হতে এই রাজ্য শাসন করবেন।প্রজারা এই বলে তখনি বোধিসত্ত্বকে রাজপ্রাসাদে যথাসময়ে নিয়ে গিয়ে রাজপদে অভিষিক্ত করল। বোধিসত্ত্ব যথাধর্ম রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করতে লাগলেন। তিনি নিয়মিত দানাদি পুন্যকাজ করতে লাগলেন।কিছুকাল পর বোধিসত্ত্ব কয়েকজন অনুচরের সাথে প্রথমে সাপের কাছে গেলেন। তিনি গর্তের বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘা বলে ডাকলেন। তখন সেই সাপ বোধিসত্ত্বকে দেখে প্রনাম করল। বোধিসত্ত্বকে সে চল্লিশ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা এনে তাঁর হাতে দিল।এরপর ইঁদুরের কাছে গেলে ইঁদুর ত্রিশ কোটি স্বর্ণমুদ্রা এনে বোধিসত্ত্বের হাতে দিল।সবশেষে শুকপাখিকে ডাকতেই সে এসে করজর করে বলল, আমি ধন সংগ্রহ করে এনে দেব।
বোধিসত্ত্ব বললেন প্রয়োজন হলে বলব।এই ভাবে তিনি সাপ, ইঁদুর ও শুকপাখিকে তিনি রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন। তারপর তাদের পরম যত্নের সাথে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করলেন। সাপ ও ইঁদুরের জন্য শোবার গর্ত ও সুড়ঙ্গ নির্দিষ্ট করে দিলেন। আর শুকপাখির জন্য তৈরি হলো শোবার খাঁচা। সাপ ও শুকের আহারের জন্য মধু মিশ্রিত খই আর ইঁদুরের জন্য সুগন্ধি আতপ চাল যোগার করে দিলেন বোধিসত্ত্ব।এইভাবে বোধিসত্ত্ব সাপ , ইঁদুর শুকপাখি ও প্রভৃতি ইতর প্রাণীর সাথে মৈত্রী নীতির সঙ্গে দিন জাপন করতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব রাজ্যের প্রজাদের নিজ সন্তানের মত স্নেহ করতেন। অবশেষে যথাকালে ভবলীলা সংবরন করে নিজ কাজের ফলভোগের জন্য স্বর্গলোক গমন করলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

কালভক্ষন জাতক

কালভক্ষন জাতক

পুরাকালে ব্রম্মদত্ত যখন বারাণসীর রাজা ছিলেন তখন বোধিসত্ত্ব এক ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বয়ঃপ্রাপ্তির পর তিনি তিন বেদে পারদর্শিতা লাভ করেছিলেন। তারপর তিনি আচার্য হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। পাঁচশত শিষ্য তাঁর কাছে বিদ্যা শিক্ষা করত। এই পাঁচশত শিষ্যও মনোযোগের সঙ্গে অধ্যায়ন করে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছিল।

কিন্তু এইসব শিষ্যদের গর্ব জন্মায়। তারা ভাবলেন, আচার্য যা জানেন আমরাও তা জানি। বিদ্যা সবন্ধে আচার্যের সঙ্গে আমাদের কোন পার্থক্য নেই।

এই গর্বের বশবর্তী হয়ে তারা আর আচার্যের কাছে বিদ্যাভ্যাস করতে গেল না। আচার্যের প্রতি শিষ্যদের কি করনীয় তাও করল না।

একদিন বোধিসত্ত্ব এক বাদরীবৃক্ষের তলায় বসেছিলেন। এমন সময় তাঁর শিষ্যগন তাকে উপহাস করার জন্য সেখানে গিয়ে নখ দিয়ে বৃক্ষে আঘাত করে বলল, এই বৃক্ষটি নিঃসার অর্থাৎ এতে কোন সার নেই।

বোধিসত্ত্ব বুঝতে পারলেন, শিষ্যগণ তাকে লক্ষ্য করেই উপহাস করছে। তিনি বললেন, শিষ্যগণ আমি তোমাদের একটি প্রশ্ন করব।
শিষ্যেরা বলল, বলুন, আমরা উত্তর দিচ্ছি।

বোধিসত্ত্ব তখন একটি গাথার মাধ্যমে বললেন, কালের হাতে সবকিছুর লয় হয়। কাল সবকিছুকেই গ্রাস করে নিজেকেও ভক্ষন করে। অর্থাৎ কাল প্রতি মুহূর্তে লয়প্রাপ্ত হয়। কাল অতিবাহিত হয়। কিন্তু কে কালকে গ্রাস করে বলতে পার?

এই প্রশ্ন শূনে শিষ্যদের কেউ উত্তর দিতে পারল না। বোধিসত্ত্ব তখন তাদের বললেন, মনে ভেব না, এই উত্তর বেদের মধ্যে আছে। তোমরা ভাব যে, আমি যা জানি, তা তোমরাও জান। এই গর্বে তোমাদের বাদরীবৃক্ষের দশা হয়েছে। অর্থাৎ বাইরে সুন্দর হলেও বাদরীবৃক্ষ ভিতরে সারবান নয়, তেমনি তোমরাও বাইরে জ্ঞানের বড়াই করলেও ভিতরে অন্তঃসারশূন্য। প্রকৃত জ্ঞান এখন লাভ হয়নি। যাই হোক, তোমরা এখন যাও, আমি তোমাদের সাতদিন সময় দিলাম। চিন্তা করে দেখ।

শিষ্যগণ আপন আপন স্থানে চলে গেল। সপ্তাহকাল চেষ্টা করেও আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারল না। তাঁরা বোধিসত্ত্বের কাছে গিয়ে প্রণাম করে বসল। বোধিসত্ত্ব বললেন, কিহে উত্তর পেলে?

শিষ্যগণ লজ্জিত হয়ে বললেন, না মহাশয়, আমরা এই প্রস্নের কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না।

বোধিসত্ত্ব তখন বললেন, অনেক মানুষ দেখেছি, তাদের গলা আছে, মাথা আছে, চখ আছে কিন্তু কিন্তু দুটি কান আছে কিনা সন্দেহ। তোমরা বর অপদার্থ। তোমাদের কানে ছিদ্র আছে, কিন্তু অন্তরে প্রজ্ঞা নেই।

এরপর বোধিসত্ত্ব নিজে সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন। যারা কামনার বশীভূত, তারাই কালের অধীন। সকল বস্তু ও জীব স্থান কাল, কার্যকারণের বন্ধনে আবদ্ধ কিন্তু যাঁরা সব কামনা বাসনা জয় করে নির্বাণ লাভ করেছেন, তাঁরা কালের অধীন নন, কাল তাদের গ্রাস বা ভক্ষন করতে পারেন না। এইভাবে জন্ম জরা মৃত্যুকে জয় করে তাঁরা কালকেও জয় করেন।

বধিসত্তের কথা শূনে তারা স্বীকার করল, ওহো আচার্যের কি জ্ঞান কি আশ্চর্য ক্ষমাতা!

এই বলে তারা আচার্যকে প্রণাম করে ক্ষমা প্রার্থনা করল। তাদের দর্প চূর্ণ হল। তারা যথারীতি আচার্য থেকে বিদ্যাভ্যাস ও তাঁকে সেবা করে যেতে লাগল।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

পরসহস্র জাতক

পরসহস্র জাতক

পুরাকালে বারাণসীরাজ ব্ৰহ্মদত্তের সময় বােধিসত্ত্ব উদীচ্য ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণপূর্বক তক্ষশিলা নগরে সর্বশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হইয়াছিলেন। তিনি বিষয়বাসনা পরিহার করিয়া প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং পঞ্চ অভিজ্ঞা ও অষ্ট সমাপত্তি লাভপূর্বক হিমালয়ে অবস্থিতি করিতেন। সেখানে পঞ্চশত তপস্বী তাহার শিষ্য হইয়াছিল। | একবার বর্ষাকালে তাহার প্রধান শিষ্য সার্ধদ্বিশত তপস্বিসহ লবণ ও অম্ন সংগ্ৰহাৰ্থ লােকালয়ে অবতরণ করিয়াছেন, এমন সময়ে বােধিসত্বের দেহত্যাগকাল সমাগত হইল। তখন উপস্থিত শিষ্যগণ, তিনি কি আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করিয়াছেন তাহা জানিবার অভিপ্রায়ে প্রশ্ন করিলেন, “আপনি কি গুণ লাভ করিয়াছেন?” বােধিসত্ত্ব বলিলেন, “নাস্তি কিঞ্চিৎ”  এবং ক্ষণকাল পরেই তমুত্যাগ করিয়া আভাস্বর ব্রহ্মলােকে * জন্মগ্রহণ করিলেন। তাঁহার উত্তর শুনিয়া তপস্বিগণ স্থির করিলেন, ‘আচাৰ্য্য কিঞ্চিত্র জ্ঞান লাভ করিতে পারেন নাই। অতএব তাহারা তাহার শ্মশান-সৎকার করিলেন না। | কিয়দিন পরে প্রধান শিষ্য আশ্রমে প্রত্যাগমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আচাৰ্য্য কোথায় ?” তাহারা বলিলেন, “আচাৰ্য্য উপরত হইয়াছেন।” “তােমর আচাৰ্য্যকে অধিগমসম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে কি?” “জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।” তিনি কি উত্তর দিয়াছিলেন ?” “তিনি বলিয়াছিলেন, ‘নাস্তি কিঞ্চিৎ। এইজন্যই আমরা তাহার শ্মশান-সৎকার করি নাই।” “তােমর। আচার্যের কথার অর্থ বুঝিতে পার নাই। নাস্তি কিঞ্চিৎ’ বলায় তাহার এই অভিপ্রায় ছিল যে, তিনি অকিঞ্চায়তন-সমাপত্তি। লাভ করিয়াছেন। প্রধান শিষ্য সতীর্থদিগকে এই কথা বুঝাইবার জন্য পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তাহারা তাহা বিশ্বাস করিলেন না । তপস্বীদিগকে সংশয়মান দেখিয়া বােধিসত্ত্ব ভাবিলেন, ‘ইহারা কি মূখ ; আমার প্রধান শিষের কথাতেও শ্রদ্ধা স্থাপন করিতেছে না। আমাকেই দেখিতেছি, প্রকৃত ব্যাপার প্রকট করিতে হইল। অনন্তর তিনি ব্রহ্মলােক হইতে আগমন করিয়া মহানুভব-বলে আশ্রমপাদের উপরিভাগে আকাশে অধিষ্ঠান করিয়া প্রধান শিষ্যের প্রজ্ঞাবল প্রশংসা করিতে করিতে এই গাথা পাঠ করিলেন ;

মুর্থ শিষ্য আচায্যের ক্লেশমাত্র হয় সার,

শ্রুতিমাত্র অর্থগ্রহ না হয় কখন তার।

হউক সহস্রাধিক হেন শিষ্য সমাগম,

কাঁদুক শতেক বর্ষ সেই সব শিষ্যাধম ;

তার চেয়ে প্রজ্ঞাবান এক শিষ্য প্রিয়তর,

বুঝিতে শ্রবণমাত্ৰ হয় যদি শক্তিধর। এইরূপে মহাসত্ব মধ্যাকাশে থাকিয়া সত্য ব্যাখ্যা করিলেন এবং তাহাদিগকে ভৎসনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি ব্রহ্মলােকে প্রতিগমন করিলেন এবং ঐ সকল তপস্বীও ব্ৰহ্মলােক-প্রাপ্তির উপযােগী উৎকর্ষ লাভ করিলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র ।

বণিক  জাতক

বণিক  জাতক

পুরাকালে বারাণসীরাজ ব্ৰহ্মদত্তের সময় বােধিসত্ব এক বণিকের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। নামকরণ দিবসে তাহার নাম রাখা হইয়াছিল “পণ্ডিত।” তিনি বয়ঃপ্রাপ্তির পর অপর এক বণিকের সহিত মিলিত হইয়া ব্যবসায় আরম্ভ করিলেন। এই ব্যক্তির নাম ছিল ‘অতিপণ্ডিত।” ইহারা দুই জনে পঞ্চশত পণ্যপূর্ণ শকটসহ জনপদে গিয়া ক্রয় বিক্রয় দ্বারা বিলক্ষণ লাভবান হইয়া বারাণসীতে ফিরিয়া আসিলেন। অনন্তর লাভ-বিভাগকালে অতিপণ্ডিত বলিলেন, আমি দুই অংশ লইব (তুমি এক অংশ লইবে)।” পণ্ডিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি দুই অংশ পাইবে কেন ?” অতি পণ্ডিত বলিলেন, “তুমি পণ্ডিত, আমি অতিপণ্ডিত। যে পণ্ডিত, সে এক ভাগ এবং যে অতিপণ্ডিত সে দুই ভাগ পাইবার উপযুক্ত।” “সে কি কথা? পণ্যের মূল্যই বল, আর গাড়ী বলদই বল, আমরা দুই জনেই ত সমান সমান দিয়াছি; তবে তুমি কিরূপে দুই ভাগ পাইবে ?” “অতিপণ্ডিত বলিয়া।” এই রূপে কথা বাড়াইয়া শেষে তাহার কলহ আরম্ভ করিল। অনন্তর অতিপণ্ডিত ভাবিলেন, “আচ্ছা ইহার মীমাংসার এক উপায় করিতেছি।” তিনি তাঁহার পিতাকে এক তরুকোটরে লুকাইয়া রাখিয়া বলিলেন, “আমরা আসিয়া মখন জিজ্ঞাসা করিব, তখন আপনি বলিবেন, অতিপণ্ডিত দুই ভাগ পাইবে।” তাহার পর তিনি বােধিসত্বের নিকট গিয়া বলিলেন, “ভাই, আমাদের কাহার কি ভাগ প্রাপ্য, তাহা বৃক্ষদেবতার জানা আছে; চল তাহাকে গিয়া জিজ্ঞাসা করি।” তদনুসারে সঁহার দুই জনে সেই তরুতলে উপস্থিত হইলেন এবং অতিপণ্ডিত প্রার্থনা করিলেন, “ভগবতি বৃক্ষদেবতে। আমাদের বিবাদ মীমাংসা করিয়া দিন।” তথন অতিপণ্ডিতের। পিতা স্ব-পরিবর্তন করিয়া বলিলেন, “তােমাদের বিবাদ কি বল।” অতিপণ্ডিত বলিলেন, “ভগবতি, এ ব্যক্তি পণ্ডিত ; আর আমি অতিপণ্ডিত ; আমরা একসঙ্গে ব্যবসায় করিয়াছিলাম ; তাহার লাভের অংশ কে কত পাইব।” ভরুকোটর হইতে উত্তর হইল, “পণ্ডিত এক ভাগ এবং অতিপণ্ডিত দুই ভাগ পাইবেন।” বােধিসত্ত্ব এই বিচার শুনিয়। ভাবিলেন, “এখানে দেবতা আছে কি না আছে, তাহা জানিতে হইতেছে।” তিনি পলাল সংগ্রহ করিয়া কোটরে পূরিলেন এবং তাহাতে অগ্নিসংযােগ করিলেন। ধক ধক্ করিয়া অগ্নি জ্বলিয়া উঠিল ; অতিপণ্ডিতের পিতা অর্ধদগ্ধশরীরে তাহা হইতে বাহির হইলেন এবং শাখাবলম্বনে ঝুলিতে ঝুলিতে ভূতলে অবতরণ পূর্বক এই গাথা পাঠ করিলেন –

                                                     সার্থক পণ্ডিত নাম ধর তুমি, সাধুবর,

                                      নাহি ইথে সন্দেহের লেশ ; অতিপণ্ডিতের নাম নিরর্থক, হায় হায় !

তারি দোষে এত মাের কেশ। ইহার পর তাহারা সমান অংশে লাভ ভাগ করিয়া লইলেন এবং যথাকালে স্ব স্ব কৰ্ম্মানুরূপ ফলভােগার্থ লােকান্তরে গমন করিলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র ।

 

error: Content is protected !!