by admin | Dec 25, 2021 | blog, great monk
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান জীবনী
By- Jnanasree Bhikkhu, International Buddhist College, Thailand
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হলেন একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত যিনি পাল সাম্রজ্যের আমলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারক ছিলেন। তিনি ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁর জীবনটা উৎসর্গ করেছেন।
জন্ম:
মহা মহোপাধ্যায় সতীশ্চন্দ্র বিদ্যাভূষণ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতানুসারে পালযুগে মগধের পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশ অঙ্গদেশের পূর্ব প্রান্তের সামন্তরাজ্য সহোর, যা অধুনা ভাগলপুর নামে পরিচিত, তার রাজধানী বিক্রমপুরীতে সামন্ত রাজা কল্যাণশ্রীর ঔরসে রাণী প্রভাবতী দেবীর গর্ভে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়। কিন্তু কিছু ঐতিহাসিকের মতে তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশব:
ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন।তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়।
শিক্ষা:
প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মায়ের কাছে। তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখা ও ১০ বছর নাগাদ বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন তিনি। মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান।
১২ বছর বয়সে নালন্দায় আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব অবধূতিপাদের নিকট সর্ব শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বারপন্ডিত নাঙপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা করেন। এরপর মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহা সাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহণ করেন। ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গমন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত পন্ডিত রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রের আধ্যাত্নিক গুহ্যাবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন।
দীপঙ্কর ১০১১ খ্রিস্টাব্দে শতাধিক শিষ্যসহ মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) গমন করেন এবং আচার্য ধর্মপালের কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে স্বদেশে ফিরে আসার পর তিনি বিক্রমশীলা বিহারে অধ্যাপনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
তিব্বত যাত্রা:
গুজ রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদ কয়েক জন দূতের হাতে প্রচুর স্বর্ণ উপঢৌকন দিয়ে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বত ভ্রমনের আমন্ত্রন জানালে দীপঙ্কর সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে নিরাশ না হয়ে ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদ সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের জন্য গেলে কারাখানী খানাতের শাসক তাঁকে বন্দী করেন ও প্রচুর সোনা মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করেন। ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদ তাঁর পুত্র ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদকে মুক্তিপণ দিতে বারণ করেন এবং ঐ অর্থ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয় করতে বলেন। ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ গুজ রাজ্যের রাজা হয়ে গুং-থং-পা নামে এক বৌদ্ধ উপাসককে ও আরো কয়েক জন অনুগামীকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত সোনা নিবেদন করে ভূতপূর্ব রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদের বন্দী হওয়ার কাহিনী ও তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অভিভূত হন। আঠারো মাস পরে ১০৪০ খৃস্টাব্দে বিহারের সমস্ত দায়িত্বভার লাঘব করে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন। তিনি দোভাষী সহ বারো জন সহযাত্রী নিয়ে প্রথমে বুদ্ধগয়া হয়ে নেপালের রাজধানীতে উপস্থিত হন এবং নেপালরাজের আগ্রহে এক বছর সেখানে কাটান। এরপর নেপাল অতিক্রম করে থুঙ বিহারে এলে তাঁর দোভাষী ভিক্ষু গ্য-চোন-সেঙ অসুস্থ হয়ে মারা যান। ১০৪২ খৃস্টাব্দে তিব্বতে র পশ্চিম প্রান্তের ডংরী প্রদেশে পৌছন। সেখানে পৌছলে ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে তাঁকে থোলিং বিহারে নিয়ে যান। এখানে দীপঙ্কর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিপথপ্রদীপ রচনা করেন। ১০৪৪ খৃস্টাব্দে তিনি পুরঙে, ১০৪৭ খৃস্টাব্দে সম-য়ে বৌদ্ধ বিহার ও ১০৫০ খৃস্টাব্দে বে-এ-বাতে উপস্থিত হন।
তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার:
দীপঙ্কর তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করে বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার করেন। বোধিপথপ্রদীপ রচনাকে ভিত্তি করে তিব্বতে ব্কা’-গ্দাম্স নামে এক ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়।
রচনা:
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ তাঞ্জুর নামে বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র, চিকিৎসা বিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে তিব্বতী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতীরা তাকে অতীশ উপাধীতে ভূষিত করে। অতীশ দীপঙ্কর অনেক সংস্কৃত এবং পালি বই তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করেন। দীপঙ্করের রচিত গ্রন্থগলির মধ্যে বোধিপথপ্রদীপ, চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ, সত্যদ্বয়াবতার, মধ্যমোপদেশ, সংগ্রহগর্ভ, হৃদয়নিশ্চিন্ত, বোধিসত্ত্বমণ্যাবলী, বোধিসত্ত্বকর্মাদিমার্গাবতার, শরণাগতাদেশ, মহযানপথসাধনবর্ণসংগ্রহ, শুভার্থসমুচ্চয়োপদেশ, দশকুশলকর্মোপদেশ, কর্মবিভঙ্গ, সমাধিসম্ভবপরিবর্ত, লোকোত্তরসপ্তকবিধি, গুহ্যক্রিয়াকর্ম, চিত্তোৎপাদসম্বরবিধিকর্ম, শিক্ষাসমুচ্চয় অভিসময় ও বিমলরত্নলেখনা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ইতালির বিখ্যাত গবেষক গ্যুসেপ তুচ্চি দীপঙ্করের অনেকগুলো বই আবিস্কার করেন।
মহাপ্রয়াণ:
তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪ খৃস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরের কাছে চে-থঙের দ্রোলমা লাখাং তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লিখেছেন ঃ Jnanasree Bhikkhu, International Buddhist College, Thailand
by admin | Nov 26, 2021 | blog
১লা এপ্রিল ১৯৯৪ ইংরেজী রোজ শুক্রবার। ট্রাইবেল অফিসার্স কলোনী, রাঙ্গামাটি। সার্বজনীন সংঘদান ও অষ্ট পরিষ্কার দান উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সশিষ্যে শুভ আগমন। বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করেন বাবু বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা। উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন বাবু রনজিত দেওয়ান। পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন বাবু প্রগতি রঞ্জন খীসা। অনুষ্ঠানের আহবায়ক বাবু যামিনী কুমার চাকমা ও পরিচালনা করেন শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার ভিক্ষু।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সকাল ১০টা ২০ মিনিট হতে ১০টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ধর্মদেশনা প্রদান করেন। তিনি প্রথমেই বলেন- শ্রদ্ধার সহিত ধর্ম কথা বা ধর্ম দেশনা শ্রবণ, গ্রহণ, ধারণ ও আচরণ করতে হয়। তাতে শ্রোতার অনেক ফল লাভ হয়। শ্রদ্ধা দু’প্রকার। লৌকিক ও লোকোত্তর। ত্রিরত্ন, কর্ম ও কর্মফলকে বিশ্বাস করলে লৌকিক শ্রদ্ধা হয়। ইহকাল-পরকাল ও চারি আর্যসত্যকে বিশ্বাস করলে লোকোত্তর শ্রদ্ধা হয়। অশ্রদ্ধার সহিত ধর্মদেশনা শ্রবণ করলে কোন ফল হয় না।
মনুষ্য ধর্ম পাপ মুক্ত নয় ও দুঃখ। প্রথম সত্য ও দ্বিতীয় সত্য লৌকিক। অর্থাৎ নানাবিধ দুঃখ ও দুঃখের কারণ লৌকিক নামে অভিহিত। এ দু’সত্যে মানুষ সহজে মুক্তি পায় না। তৃতীয় ও চতুর্থ সত্য লোকোত্তর। অর্থাৎ নিরোধ সত্য ও মার্গ সত্য বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে মানুষ মুক্তি পায়। নির্বাণের পথকে মার্গ সত্য বলে। আবার নির্বাণ সত্যকে কুশলও বলা হয়।
এ কুশল কর্মস্থান বা শমথ-বিদর্শন ভাবনাও বলা হয়। ভাবনা হলো মনের কাজ। ভাবনা ছাড়া বুদ্ধ জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। অলোভ, অদ্বেষ ও অমোহ ব্যক্তি ভাবনা করতে পারে। এগুলিকে ত্রিহেতুক পুদগল বলে। তারা সহজে মুক্তির পথে চলতে পারে বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।
কেউ কেউ দান করে ইহজীবনে সুখভোগ করার জন্যে এবং পরজীবনেও সুখ ভোগ করার জন্যে। কিন্তু নির্বাণ অধিগত করার জন্যে দান করা অতি উত্তম। যেমন দান এভাবে করতে হয়- এ দানের ফলে আমার নির্বাণ লাভের হেতু উৎপন্ন হোক।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ একত্রিশ লোকভূমির মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।
তাঁর প্রচারিত ধর্মই জ্ঞানের ধর্ম। তাও অসংখ্য বৎসর পর আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্য সম্পত্তি, দেব সম্পত্তি ও নির্বাণ সম্পত্তি উৎপত্তি হয়। কিন্তু বর্তমানে কিছু সংখ্যক লোকের ধারণা ভগবান বুদ্ধ অজ্ঞানী ও গরীব। তাদের অবিশ্বাসের ফলে তারা বুদ্ধের নির্বাণ পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। যেমন কোন কোন ভিক্ষু গড়ে তোলতেছে। কেউ কেউ সামাজিক কর্মে নিজকে সারাক্ষণ নিয়োজিত রাখছে। আর কেউ কেউ নানাবিধ কর্মের অধীনে থাকে। অর্থের ও প্রতিপত্তির মোহে নিজেও মুক্ত হতে পারছে না এবং অপরকেও মুক্ত করতে পারছে না।
অন্যদিকে সত্যের আশ্রম হলো শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা। সত্যের আশ্রমে অকুশল ধর্মগুলি ত্যাগ করা যায় এবং উচ্চতর জ্ঞান লাভ হয়। কুশলে পূণ্য উৎপত্তি হয়, পাপ ক্ষয় হয়, দুঃখ সমূলে ধ্বংস হয় এবং ইহকাল-পরকালে পরম সুখ লাভ হয়। কর্মের অধীনে থাকা মহা দুঃখজনক। নির্বাণের অধীনে মহাসুখ।
দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- এম. এ পাশ করে নরকে পড়লে সে লেখাপড়ার কোন মূল্যই নেই। যে যতটুকু লেখাপড়া করুক না কেন তার পাপে লজ্জা থাকতে হবে। ভয় থাকতে হবে। পাপের প্রতি ঘৃনা থাকতে হবে। তবেই এম. এ পাশের মূল্য থাকে। শুধু বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করে পাপে নিমগ্ন থাকলে সেই ডিগ্রীর কোন মূল্য থাকে না। অপ্রমাদ বা সাবধানে থাকলে পাপ নেই ও মার নেই। নিজকে নিজে সর্বদা সাবধানে থাকলে পরম সুখ উৎপত্তি হয় এবং অপরকেও সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিতে পারে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- অন্ধকে যে কোন জিনিস দেখানো যেমন বৃথা ঠিক তেমনি মূর্খকেও চারি আর্যসত্য ও উচ্চতর জ্ঞান সম্বন্ধে বুঝানো তেমন বৃথা। মূর্খেরা নানাবিধ দোষ করে ও অবাধ্য থাকে। সব সময় অজ্ঞানে অজ্ঞানে সংঘর্ষ বাঁধে। দুঃশীল, অধর্ম পরায়ন ব্যক্তি বৌদ্ধ ধর্মের নষ্টের কারণ।
তিনি উপসংহারে বলেন- তোমরা মিথ্যার আশ্রয়ে যেয়ো না। সত্যের আশ্রয়ে যাও। সত্য তোমাদের রক্ষা করবে এবং পরম সুখ প্রদান করবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তে, কথায়, কাজে ও চিন্তায়, অন্যায়, অপরাধ, ভুল, ত্রুটি, দোষ ও গলদ করো না। অচিরেই তোমাদের পরম সুখ বয়ে আসবে। এ বলে আমার দেশনা আপাততঃ এখানেই শেষ করলাম।
সাধু – সাধু – সাধু।
by admin | Nov 20, 2021 | blog, content
বৌদ্ধ ধর্মে মার কী বা কারা? মার কীভাবে
সত্ত্বদের মুক্তির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে?
—————————————————
বৌদ্ধ ধর্ম মতে, মার হচ্ছে শত্রু, শয়তান বা অশুভ শক্তি। সত্ত্বগণের বা মানুষের মুক্তি মার্গে অন্তরায় সৃষ্টি করাই মারের কাজ। সৎ কাজে মারের শত অনিহা ও অজুহাত। মার মনে নানা রকম যুক্তি উপমা দাঁড়। করায় এবং বাস্তবায়ন যাতে না হয় সেজন্য সর্বশক্তি প্রযােগ করে বাধা সৃষ্টি করে। আবার অকুশল কাজ বা খারাপ কাজে মার মনে মনে যথেষ্ট কুবুদ্ধি ও পরামর্শ খাটিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য লেগে থাকে এবং বাস্তবায়নের পর কেটে পরে। সৎ কালে শত বাধা এবং অসৎ কাজে উৎসাহ যােগানাে মারের লক্ষণ।
সাধারণত পাঁচ প্রকার মার দেখতে পাওয়া যায়, যথা –
১। দেবপুত্র মার:
অসৎ দেবতাদেরকে দেবপুত্র মার বলা হয়। যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মানুষের মুক্তির পথে বাধার সৃষ্টি করে। কখনাে পশুপাখীর রূপ ধারণ করে, কখনাে বুদ্ধমূর্তি, কখনাে ভয়ানক ভীষণ আকারআকৃতি, কখনাে জীবিত মা, বাবা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে মৃত অবস্হায় দেখায়, আবার কখনও বা ঘর-বাড়ী আগুণে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে দেখায়, এসব দেবপুত্র মারের চক্রান্ত।তথাগত বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ব মুহূর্তে পর-নির্মিত বশবর্তী দেবলােকের দুর্দান্ত মার রাজ গিরিমেখলা হাজার সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে হসহিরাজের পিঠে আরােহন করে মায়ার চক্র তৈরী করে গৌতম বােধিসত্ত্বকে প্রলােভন দেখিয়েছিলেন। আক্রমন করেছিলেন সিদ্ধার্থকে ধ্যানচ্যুত করার জন্য, কিন্তু জন্ম জন্মান্তরের অপ্রমেয় দান ও ধর্মের প্রভাবে সিদ্ধার্থ সসৈন্য মাররাজাকে পরাজিত করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
২| অভিসংস্কার মার:
অভিসংস্কার বলতে এই জন্মের সংস্কার ছাড়াও অতীত অতীত জন্মের অতিরিক্ত স্পষ্ট সংস্কারের। প্রতিফলনকে বুঝায়। এখানে অভি শব্দকে অধিকতর বা অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। এটা ধর ধাতু নিস্পন্ন ধারণ করা, সমর্থন করা, স্পর্শ প্রতিভাত হওয়া। সংস্কার বলতে কায়, বাক্য ও মনের দ্বারা যা সংস্কৃত বা নিত্য সম্পাদ্যরূপে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়, তাই সংস্কার। ভাবনাকারীর ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে উপাচার সমাধির প্রারম্ভে, পূর্বের সংস্কার গুলাে দেখা দেয় এবং তা অনন্ত জন্মেরও হতে পারে। এ সংস্কার গুলাে কর্মস্রোত বা কর্মপ্রবাহ বা চিত্ত সন্ততিতে সুপ্তাকারে সঞ্চিত। থাকে। যেমন, এই জন্মে পূর্বে ছিল না এমন কিছু কিছু উপসর্গ, রূপ, তীব্র ব্যাথা, বেদনা, দুঃখ, ভাবনাকালে প্রকাশ পেতে দেখা যায়।
৩া ক্লেশ মার:
যার প্রভাবে কুশল কর্মে বাধা সৃষ্টি এবং জন্ম জন্মান্তরে সত্ত্বগণকে দুঃখ কষ্ট প্রদানে সহায়ক হয় তাকে ক্লেশ | বলে। ক্লেশ দশ প্রকার ও উপক্লেশ দশ প্রকার। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কুলষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রসহ, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে। এগুলাের দ্বারা মার-রূপে ধ্যানে বাধা সৃষ্টি হয় বলে এগুলােকে ক্লেশ মার বলে।
দশবিধ ক্লেশ—১. লােভ, ২. দ্বেষ, ৩. মােহ, ৪. মান, ৫. মিথ্যা দৃষ্টি, ৬. বিচিকিচ্ছা, ৭. ভ্যান-মিদ্ধ, ৮.ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য, ৯. আহ্ৰী, ১০. অনপত্রপা। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কলুষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে।
দশবিধ উপক্লেশ —১. ওভাস, ২. প্রীতি, ৩. প্রশ্রদ্ধি, ৪. অধিমােক্ষ ৫. প্রগ্রহ, ৬. সুখং, ৭. ঞানং, ৮. উপটঠানং, ৯. উপেক্ষা, ১০. নিন্তি।। ক্লেশ যেমন স্মৃতিভাবনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তদ্রুপ উপক্লেশও এক প্রকার বাধা যা ভাবনাকারীর চিত্ত উদিত হয়। এগুলাে চিত্তের কুশল সংস্কার জাত। এরা নানাবিধ আকারে সাধকের চিত্তে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। উপক্লেশ মুক্ত বিদর্শন জ্ঞানই প্রকৃত মার্গ।
৪. স্কন্ধ মার:
স্বন্ধ অর্থে গুচ্ছ, পুঞ্জ, সমাহার বুঝায়। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে পঞ্চ স্কন্ধ বলা হয়। দৈনন্দিন কাজকর্মে মানুষের মাঝে কতগুলাে কুঅভ্যাস পরিলক্ষিত হয়, যেমন- অশােভনীয় কথাবার্তা বলা,হাত-পা নাড়া, মাথা দোলানাে, অহিরতা, চঞ্চলতার কারণে নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গি ইত্যাদি, এগুলাে সংগঠিত হয় শীল ভঙ্গের কারণে বা শীল সম্পর্কিত সচেতনার অভাবে। আরাে লক্ষ্য করা যায়, মাথা ব্যাথা, পেটের পীড়া, হাইতােলা, খিটখিটে মেজাজ, বদরাগী, হিংসুটে ইত্যাদি প্রকাশ পায়, কেহ কেহ পুণ্যময় কাজে | রত থাকে। স্মৃতি ভাবনা অনুশীলনের সময় এসব ভাল ও মন্দ স্বভাবগুলাে কায়, বাক্য ও মনে প্রসফুটিত হয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে এদেরকে স্কন্ধ মার বলে
৫. মৃত্যু মার :
মৃত্যু হচ্ছে কর্ম প্রবাহের সাময়িক বিরতী। মৃত্যু অর্থে অন্যস্হানে জন্ম নিদের্শ করে অর্থাৎ একস্হান হতে চ্যুত হয়ে অন্যসহানে উৎপত্তি বুঝায়। মৃত্যুকে এখানে মার বলা হয়েছে এ কারণে, ধ্যানী যখন অত্যন্ত একাগ্রতা ও গভীরভাবে ধ্যানানুশীলন করতে করতে ক্রমশঃ ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে থাকেন অর্থাৎ পরিকর্ম ধ্যান শেষ করে গােত্রভূ ধ্যানে প্রবেশ করেন, এমতাবস্হায় অনেক সময় ধ্যানীর আয়ুস্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়। এজন্য মৃত্যুকে মার রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। করণীয় কাজ সমাপনান্তে মৃত্যু বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
# তথ্যসূত্র ঃ- মহামুনি সম্যক সম্বুদ্ধ ( http://ms-sambuddha.com )
by admin | Sep 10, 2021 | blog
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ঠেগরপুনি গ্রামে অবস্থান করতেন চকরিয়া নিবাসী রাজমঙ্গল মহাস্থবির। চন্দ্রজ্যোতি ভিক্ষু কর্তৃক ব্রক্ষদেশ থেকে আনিত একটি এিভঙ্গ বুদ্ধমূর্তি তার পিতৃব্য রাজমঙ্গল মহাস্থবির ঠেগরপুনি গ্রামের বিহারের পার্শে কাঠের ঘর প্রতিষ্ঠা করেন ৷ প্রাকৃতিক দূর্যোগ এর কারণে পরবর্তিতে কাঠের ঘরটি ভগ্নদশায় পতিত হলে মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে যায়৷ অনেককাল পর পটিয়ার বাকখালী নিবাসী শ্রীধন বড়ুয়ার পত্নি নীলাকুমারী স্বপ্নাদেশ পেয়ে বুদ্ধমুর্তিটি উদ্ধার করেন ৷ পরবর্তিতে পটিয়ার করল নিবাসী ভগ্নিপুএ আরাধন মহাস্থবিরের সহায়তায় ১৮৫৫ সালে নির্মাণপূর্বক বুদ্ধমূর্তিটি পূনরায় প্রতিষ্ঠা করেন ৷ মূর্তিটির মধ্যাংশ পাওয়া যায়নি, বর্তমানে যা আছে তা উপরের অংশ ও নির্বাণের সংযোগ মাএ৷ প্রাচ্যের রাণী খ্যাত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম পীঠভূমি এই চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের আদি ও প্রাচীনতম ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্ররূপে স্মরণাতীত কালের ইতিহাসে ভাস্বর এই চট্টগ্রাম। বিভিন্ন বৌদ্ধ পুরাকীর্তি স্তম্ভের অবস্থান থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়। তেমনি এক প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান হচ্ছে ‘বুড়া গোসাঁই মন্দির’। পটিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪ কি. মি. দক্ষিণে ঠেগরপুনি গ্রামে এর অবস্থান। পটিয়া সদর থেকে রিক্সাযোগে সরাসরি অথবা টেম্পোযোগে ভাটিখাইন নেমে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়।বর্তমানে বিহারটি ৪০ শতক ভিটার উপর পর পর সারিবদ্ধ তিনটি গম্বুজ নিয়ে স্থাপিত। মাঝখানের গম্বুজটি সমতল হতে ৫৯ ফুট উচু এবং দুপাশের গম্বুজ দুটির উচ্চতা ৪৮ ফুট। মূল বিহারের দেওয়াল ৩ ফুট ২ ইঞ্চি পুরু। বিহারটির দক্ষিন পাশে শ্রীমতি খাল প্রবাহিত। ঠেগরপুনি প্রবেশ করে সুদৃশ্য বিশাল মন্দির চোখে পড়লেই মন শুভ্র উপলব্ধিতে সঞ্জীবিত হয়ে উঠে। ছায়াঘেরা নয়নাভিরাম পরিবেশে অনন্য এক পবিত্র অনুভূতি নিজের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। মন্দিরের মূল গেইট সোজা পুকুরের ঘাট আর ছাদ বিশিষ্ট প্লাটফরম। মন্দিরের গেইট থেকে সিঁড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠলেই চোখে পড়বে প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘বুড়া গোঁসাই’ খ্যাত বুদ্ধমূর্তিটি।ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এই স্থানটি তৎকালীন আরাকান রাজ্যের অংশ ছিল। আনুমানিক ৩৫০-৪০০ বছর পূর্বে অথ্যাৎ ১৫০০ শতাব্দীর শেষদিকে ছান্ধমা রাজার আমলে এ স্থানে একটি সুবিস্তীর্ণ দীঘি ছিল যা ‘ছান্ধমা দীঘি’ নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে উক্ত রাজবংশ এ স্থান হতে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা পরিত্যক্ত খোয়াইল্লা (প্রচলিত শব্দ) বনে পরিণত হয়। উক্ত বনের মাটির নীচে চাপা পড়ে প্রাচীন বুদ্ধমুর্তিটি। এক সময় বাকখালী নিবাসী শ্রীধন বড়ুয়ার স্ত্রী নীলাকুমারী উক্ত স্থান থেকে খোয়াইল্লা উঠাতে কোদাল দিয়ে মাটি খনন করতে থাকে। এক জায়গায় প্রচন্ড আঘাত করার সাথে সাথে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। উল্লেখ্য কোদালের আঘাতে মূর্তির মাথার ডান পার্শ্বে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কিছুই অনুমান করতে না পেরে উক্ত মহিলা নীলাকুমারী আতঙ্কিত হয়ে চলে যান। এক সময় তাঁর উপর স্বপ্নাদেশ হয় যে, “আমি এ জায়গায় অধিষ্ঠিত আছি, তোমরা আমাকে উঠাও”। নীলাকুমারী নিজে তা করার জন্য সাহস করেননি। অগত্য তিনি পার্শ্ববর্তী করল গ্রামের বাসিন্দা ভগ্নিপুত্র ভদন্ত হারাধন মহাস্থবিরকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন। তারই আনুকূল্যে মাটি খননপূর্বক সেই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা পায় এবং মুর্তিটি মাটির নীচ থেকে উধ্বার করে সেই জায়গাতেই মন্দির নির্মাণ করা হয়। তখন থেকে মূর্তিটি ‘বুড়া গোঁসাই’ নামে পরিচিত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে সেই সিদ্ধস্থানে প্রতি মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সপ্তাহব্যাপী মেলার প্রচলন হয় এবং তা এখনো বিদ্যমান। বৌদ্ধ পুরাকীর্তির নিদর্শন এ ‘বুড়া গোঁসাই’ মূর্তিটিকে প্রতি মাঘী পূর্ণিমার পূর্বের দিন ডাবের পানি, দুধ, জল দিয়ে স্নান করানো হয়। কর্মসূচির মধ্যে থাকে বুদ্ধ পূজা, সংঘদান, অস্ট পরিষ্কার দান ও ধর্মীয় সভা। প্রায় ৮০/৯০ বছর পূর্বের এ মন্দিরের সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের দিকে। স্থানীয় গ্রামবাসী তথা ধর্মপ্রাণ দানশীল বৌদ্ধ সাধারণের অর্থানুকূল্যে পুরনো মন্দিরের ভাঙ্গার কাজ চলে প্রায় এক বছর ধরে। অতঃপর আরও এক বছর পুনঃনির্মাণ কাজ চলার পর ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এ মন্দিরটি যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় ও উৎসবের মধ্য দিয়ে উৎসর্গীত হয়।এই ‘বুড়া গোঁসাই’ নিয়ে নানাজনের নানা অভিমত। কেউ কেউ বলেন এটি কোন অর্হৎ ভিক্ষুর অধিষ্ঠান। আবার অনেকের মতে তৎকালীন ছান্ধমা রাজার আমলে হারিয়ে যাওয়া কোন বুদ্ধমূর্তির অংশবিশেষ। প্রবাদ আছে “বুড়া গোঁসাই”র নিকট কেউ একান্ত মনে প্রার্থনা করলে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। উল্লেখ্য, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষ করে নব দম্পতিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরকে ঘিরে ‘ঠেগরপুনি ধর্ম্মচরণ বিহার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এই বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন ভদন্ত সংঘবোধি ভিক্ষু। হাজারেরও অধিক ধর্মীয় ও সাধারণ গ্রন্থের একটি পাঠাগার আছে। স্থানীয় গ্রামবাসী ভিক্ষু শ্রমনের সার্বিক ব্যয়ভার বহন করেন। মাঘী পূর্ণিমার মেলা ছাড়াও সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন স্থান থেকে পুণ্যার্থীরা ছুটে আসেন এ পবিত্র স্থানে। জগতের সকল প্রানী সূখী হওক।
সূত্র –সংগৃহিত।
by admin | Dec 10, 2020 | blog
৩রা অক্টোবর ১৯৯৬ ইংরেজী বৃহস্পতিবার। ভোর ৫ টায় তাঁর শিষ্যদেরকে ধর্মদেশনা দিচ্ছিলেন। প্রথমেই তিনি কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান সম্বন্ধে বলেন- বৌদ্ধ ধর্মে কিছু লইতে দেয় না, খাইতে দেয় না এবং কোন কিছু গ্রহণ করতে দেয় না। যদি অতি প্রয়োজন হয় অনাসক্তভাবে লইতে হয়, খাইতে হয় এবং কোন কিছু গ্রহণ করতে হয়। কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান সম্বন্ধে না জানলে, না বুঝলে বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে কিছুই জানবে না। বৌদ্ধ ধর্ম তিন প্রকারে শ্রেষ্ঠ। যেমন মার্গ, ফল ও নির্বাণে শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে টাকা, পয়সা, সোনা, রূপা, ধন, সম্পদ প্রভৃতি গ্রহণ করতে পারবে না। মার্গ, ফল ও নির্বাণ অজ্ঞানে বুঝতে পারে না।
তিনি একটি উপমা দিয়ে বলেন- দুইশত হাত পানিতে মাত্র আট হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠাঁই চাইলে ঠাঁই পাবে? কোন দিন পাবে না। সেরকম যারা বনবিহারে শ্রামণ ও ভিক্ষু হয়, তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক শ্রামণ ভিক্ষু কাপড় ছেড়ে চলে যায়। কেন যায় জান? দুইশত হাত পানিতে আট হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠাঁই পাচ্ছে না বলে। এখানে নির্বাণ হল দুইশত হাত পানি এবং তাদের জ্ঞান হল মাত্র আট হাত লম্বা বাঁশ। তলদেশ কোথায় তারা জানে না।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি যে বুঝতে পেরেছে সে তলদেশের নাগাল পেয়েছে। এবং বৌদ্ধধর্মে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সুতরাং সুখও পেয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে নির্বাণ খুব গভীর। তোমাদের চারি আর্য্যসত্য জ্ঞান ও প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি জ্ঞান অর্জন হলে বুঝতে হবে তলদেশ পেয়েছ। না পেলে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। মার্গ, ফল ও নির্বাণ তথা তলদেশ চর্মচক্ষে দেখা যায় না। তা জ্ঞান দ্বারা না জানলে জানা যায় না। জ্ঞান দ্বারা দর্শন না হলে বুঝা যায় না, দর্শন করা যায় না, পরিচয় হয় না এবং চিনা যায় না।
ভগবান বুদ্ধ বলেন- নির্বাণে যাও। অন্য জন বলে আমি যাব না। তাহলে কে বুঝেনি? সেরূপ বনভান্তে বলেন- তোমরা নির্বাণে যাও। তোমরা যদি বল আমরা নির্বাণে যাব না। এখানে কে বুঝেছে এবং কে বুঝেনি? বুদ্ধের কথা ধরলে অনাথ আশ্রম করবে না। সত্যের আশ্রম করবে। অজ্ঞানীরা কাম ভোগ করে এবং জ্ঞানী হলে কাম ভোগ করে না।
তিনি বলেন- বুদ্ধের আমলে বুদ্ধ মূর্তি, ধর্ম, বই ও মাইক ছিল না। বুদ্ধ মূর্তিকে ছোয়াইং দেয় কেন? ভগবান বুদ্ধ না থাকলেও তাঁর ধাতু অস্থি গুলি এখনও আছে। এখানে বুদ্ধ মূর্তিকে ছোয়াইং দেয়া হচ্ছে না। জ্ঞানকে দেয়া হচ্ছে। বুদ্ধ মূর্তি হল জ্ঞানের প্রতীক মাত্র। বুদ্ধ না থাকলেও তাঁর বাণীগুলো এখনও আছে। সকলের সুবিধার্থে বই আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দূরবর্তী লোকদের শোনার সুবিধার্থে, মাইকের ব্যবহার হচ্ছে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- এ দেহ থাকতে জন্ম, জরা, মরণাদি ধ্বংস করতে না পারলে মরণের পর বার বার জন্মগ্রহণ ও মৃত্যু বরণ করে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয়। নির্বাণ হলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করতে হয় না। নির্বাণ হলে দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অজ্ঞানীরা বলে থাকে মরে গেলে দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তা নিতান্তই ভুল। কিন্তু একমাত্র যার চিত্ত নিরোধ ও গতি নিরোধ হয়েছে সে শুধু মুক্তি পেয়ে থাকে। চিত্ত উৎপন্ন ও গতি উৎপন্ন হলে পঞ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। যেমন মানুষ, দেবতা, প্রেত, নরক ও তির্যক এ পঞ্চ গতিতে গমনাগমন হয়। অজ্ঞানীরা যাবতীয় দুঃখ পেয়ে মৃত্যু হলে উত্তম বলে মনে করে এবং বলে থাকে যে মরেছে সে দুঃখ থেকে মুক্ত হয়েছে। যাঁরা জ্ঞানী তাদের জন্ম মৃত্যু নেই। সুতরাং তাদের কোন দুঃখও নেই।
তিনি আরো বলেন- আনাপান স্মৃতি দ্বারা নির্বাণ লাভ করা যায়। তবে অজ্ঞানীরা শ্বাস-প্রশ্বাস টানলে ও ফেললে তাতে জ্ঞান নেই বলে তাদের জন্ম মৃত্যু হচ্ছে, নির্বাণ লাভ হচ্ছে না। যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা শ্বাস গ্রহণ করলে জ্ঞান যোগে গ্রহণ করে এবং নিশ্বাস ফেললে জ্ঞান যোগে ফেলে। আর যারা অজ্ঞানী তারা শ্বাস গ্রহণ করলে অজ্ঞানে গ্রহণ করে এবং নিশ্বাস ফেললে অজ্ঞানে ফেলে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন– যারা কাপড় ছেড়ে চলে যায়, তারা কি বুঝে চলে যায়? না বুঝে চলে যায়। উপবাস থাকলে বাবুর্চি বা স্ত্রীর প্রয়োজন হয় না। বনভান্তেও বহুবার উপবাস ছিলেন। তাঁর কোন দিন বাবুর্চি বা স্ত্রীর প্রয়োজন হয় নি। ভিক্ষুর পক্ষে স্ত্রী লোক গ্রহণ করা তো দূরের কথা, ছুঁইলেই পাপ হয়। একবার ডাঃ অরবিন্দ ভিক্ষু হওয়ার আশা করেছিল। তার স্ত্রী তাকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু সে ভিক্ষু হয় নি। তাহলে দেখা যাচ্ছে তার ততটুকু সাহস ও জ্ঞান নেই (এ কথাটি বলার পর সবাই হেঁসে উঠলেন)। তিনি বলেন- একবার দেবদত্ত ভগবান বুদ্ধকে বলেছিল- আমি ভিক্ষু সংঘ পরিচালনা করব। বুদ্ধ বললেন- আগে নিজেকে নিজে পরিচালিত কর, পরে অন্যজনকে পরিচালিত করতে পারবে। নিজে মুক্ত হয়ে অপরকে মুক্ত করতে পারে। ঠিক সেরকম নিজে সুপরিচালিত হলে অপরকে পরিচালিত করতে পারে।
বিনা মূল্যে নির্বাণ সুখ পাওয়া যায়। অন্যান্য জিনিস মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। কিন্তু নির্বাণ বিনামূল্যে। তাঁর জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও আকাঙ্খা। কি পরিশ্রম? শীল পরিশ্রম, সমাধি পরিশ্রম ও প্রজ্ঞা পরিশ্রম। কি অধ্যবসায়? শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা অধ্যবসায়। কি আকাঙ্খা? শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা আকাঙ্খা। তাতেই তোমরা পরম সুখ নির্বাণ প্রত্যক্ষ করতে পারবে। বনবিহারেও কোন কিছু মূল্য দিতে হয় না। তবে নির্বাণ প্রত্যক্ষ করতে হবে। বৌদ্ধ ধর্মে বলতে হয় সকল সংস্কার অনিত্য, সকল সংস্কার দুঃখ ও সকল সংস্কার অনাত্ম। অনিত্য অর্থাৎ ক্ষয় ব্যয়শীল, দুঃখ অর্থাৎ যাহা অহরহ নিষ্পেষিত হচ্ছে এবং অনাত্ম- যাহা অনিচ্ছাবশে সংগঠিত হয়, আপনার নহে বলে। ত্রিপিটককে বিস্তারিত করলে চারি আর্য্যসত্য বুঝায়। চারি আর্য্যসত্যকে বিস্তারিত করলে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বুঝায়। অষ্টাঙ্গিক মার্গকে বিস্তারিত করলে ৩৭ প্রকার বোধি পক্ষীয় ধর্ম বুঝায়। ৩৭ প্রকার বোধি পক্ষীয় ধর্মকে বিস্তারিত করলে চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধ বুঝায়। ভগবান বুদ্ধ প্রথমে সংক্ষিপ্ত দেশনা করেন। পরিশেষে বিস্তারিত ভাবে দেশনা করেন।
পরিশেষে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে দুই লাইন বিশিষ্ট গাথা বলে তাঁর দেশনা সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
সুবিচারে সবিনয়ে চালায় অন্যজন।
ধর্মস্থ মেধাবী নামে অভিহিত হন।।
by admin | Nov 2, 2020 | blog
Man cannot live alone. মানুষ একা বাস করতে পারে না। কথাটা সার্বজনীন এবং আদিম যুগ থেকে আধুনিক সভ্যতায় এখনও চলমান । হিংস্র পশুপাখির হাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য মানুষ সংঘবদ্ধ হতে থাকে , খাদ্য সংগ্রহের জন্য পশু শিকার করা , কৃষি কাজ করা, এমনকি সমষ্টিগতভাবে পাহাড়ের গুহায় একই স্থানে বসবাস শুরু করে। এভাবে সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে কালে কালে গঠন হয় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধতা যা থেকে সৃষ্টি হয় United Nation বা জাতিসংঘ। আর সামাজিক ঐক্যবদ্ধতা হলো যে কোন সমাজের একটি মূল স্তম্ভ। এ স্তম্ভের উপরেই নির্ভর করে সমাজের ঐক্যতা ও আদর্শ। এমন কি ধর্মীয় আচার-আচরন ধারণ, অনুশীলন ও প্রতিপালনের শক্ত ভীত তৈরী করার জন্য প্রয়োজন সামাজিক একাত্মতা ও সামাজিক ঐক্যবদ্ধতা। সামাজিক সংগঠনগুলো সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই মানুষ সামাজিক জীব হিসাবে সামাজিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়ানো ও সম্পর্ক রক্ষা করা সময়ের দাবী। দার্শনিক এরিস্টটল বলেন, ” Pleasure in the job put perfection in the work.সংগঠন মানুষের নেতিবাচকতা, হতাশা ও দুঃখবোধ দূর করে মানুষকে ইতিবাচকতা, আনন্দ ও সম্প্রীতিতে সাহায্য করে। সংগঠনের অপর নাম ঐক্যবদ্ধতা,সামাজিক ঐক্যবদ্ধতা জীবন চলার পথে একে অপরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা তৈরী করে। জীবনের প্রতি পলে পলে জীবনকে উপভোগ ও উপলব্ধি করার পূর্ন সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় প্রাণে প্রাণে ঐক্যের সেতুবন্ধনে । ঐক্যবদ্ধতা জাতি, সমাজ , পরিবারকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে ।এ প্রসঙ্গে ছোটবেলার এক গল্প মনে পড়ে গেল, এক বৃদ্ধের পাঁচ সন্তান ছিল। বৃদ্ধ একদিন সবাইকে ডেকে বললো, তোমাদের একটা করে লাঠি দিলাম, তোমরা ইহা ভাঙ্গতে পার কিনা চেষ্টা কর? নিমিষেই সন্তানেরা লাঠিখানা ভেঙ্গে ফেলল। এবার বৃদ্ধ পাঁচখানা লাঠি একত্রে করে সকল পুত্রদের ভাঙ্গতে আদেশ করলো। তখন কেউ আর শত চেষ্টা করেও পাঁচখানা লাঠি এক সাথে ভাঙ্গতে পারলো না। অতএব বৃদ্ধ পাঁচ পুত্রদের উপদেশ দিলেন তোমরা ব্যক্তিগত ভাবে যতই শক্তিশালী হও , একা একা থাকলে সবাইকে যে কোন কেউ ক্ষতি করতে পারবে আর একত্রে থাকলে কেউ তোমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ভাঙ্গতে বা ক্ষতি করতে পারবে না । শত কষ্ট হলেও “একতাই শক্তি” জেনে আমার অবর্তমানে সকল ভাইয়েরা মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করবে তাতে তোমাদের উন্নতি হবে এবং শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পাবে। তাই পবিত্র ত্রিপিটকে বলা হয়েছে “ সংঘং শরনং গচ্ছামি “ – আমি সংঘ বা একতার শরণ গ্রহন করছি । পবিত্র কোরানের আয়াতে উল্লেখ আছে, “তোমরা কল্যানমূলক কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অগ্রসর হও” ( সুরা বাকারা, আয়াত ১৪৮) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নবুওয়াত পাওয়ার আগেই সমাজ সেবার জন্য তরুনদের নিয়ে “হিজফুল ফুজুল” নামে সেবাসংঘ গঠন করেছেন। সারাদেশব্যাপী করোনাকালে মৃতদেহ সৎকারে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দায়িত্ব পালনে সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছেন যথাক্রমে ইকরামুল মুসলিমীন, টিম খোরশেদ, তাকওয়া ফাউন্ডেশন, আল-মারকাজুল, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, আল-মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন আল- রশিদ ফাউন্ডেশ ও মহানগর বৌদ্ধ দাহক্রিয়া কমিটিসহ আরো অনেক সংগঠন। আবার তদ্রুপ এই করোনাকালে মহামারীর দিনে খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে খাদ্যাভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে দেখা দিলে তখন প্রায় প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে মানবতাবাদী ভিক্ষু সংঘরা নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী প্রদানের সময় সমবেত হয়েছেন স্ব স্ব এলাকার হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান আবালবৃদ্ধরমণীসহ বোরখা পড়া মায়েদেরও একই কাতারে মিলেমিশে একাকার হতে দেখেছি। করোনা মানবসমাজকে সামাজিক ঐক্যবদ্ধতার এক অসাধারণ শিক্ষা চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে ধর্ম যার যার কিন্তু সামাজিক সংগঠনগুলো সবার। এভাবে যুগের পর যুগ ধরে মানুষের সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধতা সমাজের জন্য পাথেয় হিসাবে সামাজিক সংগঠনগুলো মানবতার কাজ করে চলেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, জার্মানি ইউরোপের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। জার্মানিতে নগরায়নের হার অত্যন্ত উঁচু। বার্লিন দেশের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। জার্মান ভাষা তাদের প্রধান ভাষা। জার্মানরা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বহু অবদান। জার্মানিতে বহু অসাধারণ লেখক, শিল্পী, স্থপতি, সঙ্গীতজ্ঞ এবং দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেছেন। কার্ল মার্কস, ফ্রিডরিশ নিৎসে, ইয়োহান, ভোলফগাং ফন গোটে এবং টমাস মান জার্মান সাহিত্যের দিকপাল। জার্মান বিশ্বের একটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। এটির অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পরে বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম। ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি যুক্তরাজ্য, মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত করে। মিত্র দেশগুলি দেশটিকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে। ব্রিটিশ ফরাসি মার্কিন ও সোভিয়েত সেনারা একেকটি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিমা শক্তিগুলির মধ্যকার মিত্রতা ১৯৪০ এর দশকের শেষে ভেঙ্গে গেলে সোভিয়েত অঞ্চলটি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র তথা পূর্ব জার্মানিতে পরিণত হয়। পশ্চিম নিয়ন্ত্রিত বাকী তিন অঞ্চল একত্রিত হয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করে। যদিও জার্মানির ঐতিহাসিক রাজধানী বার্লিন পূর্ব জার্মানির অনেক অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিল, তাসত্ত্বেও এটিকেও দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ব জার্মান অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক। পশ্চিম জার্মানিতে অভিবাসী হওয়া শুরু করলে ১৯৬১ সালে পূর্ব জার্মান সরকার বার্লিনে একটি প্রাচীর তুলে দেয়।১৯৮৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের জনগন বার্লিন প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে। এই ঘঠনাটিকে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদের পতন ও জার্মানির পুনঃ একত্রীকরণের প্রতীক হিসাবে গন্য করা হয়। ১৯৯০ সালে ৩রা অক্টোবর দুই জার্মানি একত্রিত হয়ে জার্মান ফেডারেল প্রজাতন্ত্র গঠন করে। পুনঃ একত্রীকরনে জার্মান অর্থনীতিতে চরম চাপ পড়লে আনুমানিক ১.৫ ট্রিলিয়ন ইউরো খরচ হয়। এ বিপুল ব্যয়ের মূলে ছিল পূর্ব জার্মানির দূর্বল অর্থনৈতিক কাঠামো। দুই জার্মানিক মুদ্রাকে সমমান করতে গিয়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে, ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করতে গিয়ে প্রচুর লোকসান হয়। এখনো প্রতিবছর পূর্ব জার্মানে উন্নয়নের জন্য ১০ বিলিয়ন ইউরো খরচ হয়। এরপরও সম্প্রীতি, সৌহার্দ ও ঐক্যবদ্ধতার জয়কে সকলে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর ৩রা অক্টোবর “জার্মান ঐক্য দিবস” পালন করে এবং ঐদিন সরকারী ছুটি ঘোষনা করা হয়।তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, সুখো বুদ্ধানং উপপাদো সুখা সদ্ধম্মদেসনা, সুখা সঙ্ঘসস সামগগী, সমগগানং তপো সুখো (পালি, ধম্মপদ-১৯৪)বাংলায় অনুবাদে হয়, জগতে বুদ্ধগনের উৎপত্তি সুখজনক, সদ্ধর্মের উপদেশ প্রচার সুখকর, সংঘের একতা সুখদায়ক, ঐক্যবদ্ধগণের তপস্যা সুখপ্রদ। মহামতি গৌতম বুদ্ধ সুদীর্ঘ ৪৫ বৎসর সদ্ধর্ম প্রচারে একসময়ে সারন্দদ চৈত্যে বৃজি বংশেদের সম্মিলিত করে “সপ্ত অপরিহানীয় ধর্ম্ম ” জাতিকে ঐক্যবদ্ধকরণে উপদেশ দিয়েছেন তা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য যদি কোন জাতি তা মনেপ্রানে ধারণ ও প্রতিপালন করেন সে জাতি উন্নত জাতিতে পরিনত হবে নিঃসন্দেহে। তা নিম্নে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।প্রথমতঃ সভাসমিতির মাধ্যমে যাঁরা সর্বদা একত্রিত হয় তাঁদের সর্বদা শ্রীবৃদ্ধি হয়।দ্বিতীয়তঃ যাঁরা একতাবদ্ধভাবে সভাসমিতিতে সম্মিলিত হয়, সভাশেষ হলে একত্রে চলে যায় এবং কোন প্রকার নূতন করণীয় উপস্থিত হলে সকলে মিলিতভাবে সম্পাদন করে, তাঁদের সর্বদা উন্নতি হয়ে থাকে এবং অবনতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।তৃতীয়তঃ যাঁরা সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নূতন কোন প্রকার দূর্নীতি চালু করে না, পূ্র্ব প্রচলিত সুনীতির উচ্ছেদ সাধনও করেনা এবং প্রাচীন নীতিগুলি যথাযথভাবে পালন করে চলে – সর্বদা তাঁদের শ্রীবৃদ্ধিই হয়ে থাকে, পরিহানী হয় না।চতুর্থতঃ যাঁরা বয়োবৃদ্ধদের সৎকার করে, তাঁদের প্রতি গৌরব প্রদর্শন করে, সম্মান ও পুজা করে এবং তাঁদের আদেশ পালন করা উচিত বলে মনে করে – গাহর্স্থ্য জীবনে সর্বদা তাঁরা উন্নতি লাভ করে থাকে।পঞ্চমতঃ যাঁরা অন্য কুল বধূ ও কুলকুমারীদিগকে বলপূর্বক ধরে এনে স্বীয় গৃহে আবদ্ধ করে রাখে না তাঁদের প্রতি কোন প্রকার অন্যায় আচরন করে না- গাহর্স্থ্য জীবনে সর্ব্বদা তাঁদের শ্রীবৃদ্ধিই হয়ে থাকে, কখনও পরিহানী হয় না।ষষ্ঠতঃ যাঁরা স্বগ্রামের বাইরে কিংবা অভ্যন্তরে পূর্ব্ব পুরুষদের নির্ম্মিত যে সমস্ত চৈত্য আছে, সেইগুলির যথাযথ সংস্কারসাধন করে, রীতিমত পূজা-সৎকার করে এবং সৈই চৈত্যগুলির উদ্দেশ্যে পূ্র্বপুরুষদের প্রদত্ত সম্পত্তি নিজেরা ভোগ না করে বিহারের কাজেই ব্যয় করে থাকে – গাহর্স্থ্য জীবনে তাঁদের উন্নতিই হয়ে থাকে, কখনও অবনতি হয় না।সপ্তমতঃ যাঁরা অর্হৎ ও শীলবান ভিক্ষুদিগকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি (চতুপ্রর্ত্যয়) দান দিয়ে সেবা ও রক্ষা করে, তাঁদের সর্বদিক সুখসুবিধার ব্যবস্থা করে দেয়, দেশে সে সকল অর্হৎ আগমন করেন নাই কি প্রকারে তাঁদের আনয়ন করা যায় সেই চিন্তা করে এবং স্বগ্রামে অবস্থিত অর্হৎ ও শীলবান ভিক্ষুদের নিরাপদে অবস্থান করছেন কিনা সব্বর্দা সন্ধান নিয়ে থাকে- গাহর্স্থ্য জীবনে সর্বদা তাঁদের শ্রীবৃদ্ধিই হয়ে থাকে, কখনও পরিহানী হতে পারে না।তথাগত বুদ্ধের উপরোক্ত উপদেশসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালন করে প্রাচীন ভারতে বৃজি বংশ অজেয় এবং উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছিলেন। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, “সংঘ শক্তি” তথা ঐক্যবদ্ধতা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সমাজের প্রতিটি ছোট বড় সামাজিক সংগঠন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে একত্রীভূত হয়ে সমাজ বির্নিমানে কাজ করলে সমাজের বহুবিধ কল্যান সাধিত হবে অবশ্যম্ভাবী।পরিশেষে অনুভবে বলতে চাই, সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধতার কোন বিকল্প নেই। আর এই ঐক্যবদ্ধতার মূলভিত্তি হচ্ছে শিক্ষা । যে জাতি শিক্ষা- দীক্ষা- জ্ঞান-গরিমায় যত উন্নত সে জাতি তত বেশী দেশপ্রেমের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ। শিক্ষিত জাতি সর্বদিকে অনেক সমৃদ্ধ ও নৈতিক গুণসম্পন্ন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজসেবা, গণসচেতনতা, সুনাগরিকত্ব, নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, শিল্পসাহিত্য, গঠনমূলক সমালোচনা, দায়িত্বশীলতা, প্রবীন- নবীনের সম্পর্ক, মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং নেতৃত্বগুণসম্পন জাতি গঠনে সামাজিক সংগঠনগুলো পাড়ায়, মহল্লায়, ওয়ার্ডে, ইউনিয়নে, গ্রামে, উপজেলা এবং জেলা ভিত্তিক গড়ে উঠলে , সাথে “চেইন-অব-কমান্ড” ফলো করলে সমাজে যে অবক্ষয় ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে তা সহজে চিহ্নিত করে সমস্যা দূর করা সম্ভব বলে মনে করি। যুব সমাজকে খেলাধুলায় ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় বেশী বেশী সম্পৃক্ততা করা হলে সৃজনশীল মেধার বিকাশ হবে এবং অপকর্ম থেকে সরে আসতে বাধ্য হবে। তাই মান-অভিমান ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে সম্মান করে , সমাজ বিনির্মাণে , উন্নত সমাজ তৈরীর চেষ্টায় ছোট-বড় সব সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে মিলেমিশে কাজ করে , সমাজের অনিয়মগুলোকে চিহ্নিত করে এবং সমাজের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর , আদর্শিক ও মানবিক সমাজ উপহার দেওয়ার চেষ্টা করাই হোক আমাদের আজকের লক্ষ্য। সাম্যের আর দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত বিদ্রোহী কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি,”যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত”।
লিখেছেন- ঝর্না বড়ুয়া