স্বপ্নে কুকুর কামড়াতে চায়

স্বপ্নে কুকুর কামড়াতে চায়

পূজ্য বনভান্তেকে নিয়ে অলৌকিক ঘটনা
(স্বপ্নে কুকুর কামড়াতে চায়)
সময় বিকাল সাড়ে পাঁচটা শ্রদ্ধেয় বনভান্তে দেশনালয়ে বই পড়ায় রত আছেন। উপাসক-উপাসিকাসহ আমি অরবিন্দু বড়ুয়া তাঁর সামনে নীরবে বসে আছি। আমার চোখে পড়ল বিহারের দক্ষিণ পাশে কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে কি যেন বলাবলি করছে। হাঁটতে হাঁটতে তারা দেশনালয়ের দিকে চলে আসল। দেবাশীষনগরের জৈনক লোক কতগুলো থালা ও বাটি বনভান্তের সামনে রেখে বলল, “ভান্তে,এগুলি আমি চুরি করিনি। আমাদের পাড়ার লোক থেকে অল্পদামে কিনে নিয়েছি। সে লোকটি প্রতিদিন বনবিহারে এসে কাজ করে।”তারপর বনবিহারের কুকুরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ভান্তে, এ কুকুরগুলি স্বপ্নে আমাকে কামড়াতে চায়। দুই-তিন রাত স্বপ্ন দেখে অনন্যোপায় হয়ে আপনার নিকট চলে এসেছি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন। আমরা (স্বামী-স্ত্রী) যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারি মত আশীর্বাদ করুন।”
       বনভান্তে তাকে অভয় দিয়ে বললেন, “যাও, আর কামড়াবে না।” এ ঘটনা দেখে আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, এ রকম চুরি অনেক বিহারে হয়ে থাকে কিন্তু এরকম অলৌকিক প্রমাণ কোনোদিন আর দেখিনি। তাহলে তাদের পরকালে কি অবস্থা হবে?

লোকে যাহা বিষ বলে বিষ তাহা নয়।
সংঘের সম্পত্তি বিষ সম উক্ত হয়।
বারেক পানেতে বিষ বারেক মরণ।
সদা মৃত্যু সংঘদ্রব্য করিলে হরণ।

 
(তথ্যসূত্র: বনভান্তের দেশনা-১; পৃষ্টা নং ৮৬; লেখক: অরবিন্দু বড়ুয়া)
লাভীশ্রেষ্ঠ অর্হৎ সীবলী স্থবির

লাভীশ্রেষ্ঠ অর্হৎ সীবলী স্থবির

দরিদ্র এক পুণ্যবান ব্যক্তি। গুড়, দধি বিক্রয় করে যিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন বাজারে যাওয়ার সময় মধুপূর্ণ মৌচাক দেখতে পেয়ে তা সংগ্রহ করে সুকৌশলে মধু সংগ্রহ করে বিক্রয় প্রত্যাশায় বাজারের দিকে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে কিছু লোক উনার মধুসমেত পাত্রটি চড়া দামে ক্রয়ের জন্য সম্মত হলেন। সেই পুণ্যবান ব্যক্তি ভাবলেন কি ব্যাপার- উনারা এত দামে মধু কিনে কি করবেন? জিজ্ঞেস করলে ক্রেতারা- “বিপস্সী বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্খুসংঘকে দান করবেন বলে ব্যক্ত করলেন”।
নিজের সব খাবার নিজ হাতেই “বিপস্সী’’ বুদ্ধকে দান করে দিলেন। চিন্তা করেনি নিজে কি খাবেন! সেই দানের মহাফল আর পদুমুত্তর বুদ্ধ হতে বর প্রাপ্ত হয়ে তিনি হলেন গৌতম বুদ্ধের সময়ে “লাভীশ্রেষ্ঠ সীবলী স্থবির”।
শুন শুন সর্বজন অপূর্ব কাহিনী, যাহা প্রচারিল মুখে প্রভু মহামুনি।
সীবলী চরিতকথা অমৃত সমান, যাহার শ্রবণে নর লাভে দিব্যজ্ঞান।
সীবলীর গুণগাথা যে করে পঠন, হবে গ্রহদোষ শান্তি অন্যথা না হন।
ধুপ-দীপ-আদিবহু উপাচারে, ভক্তি চিতে যেই জন পূজে সীবলীরে।
অরহত শ্রী সীবলী মহাতেজবান, মহাজ্ঞানী, মহালাভী মহাপূণ্যবান।
তাঁহার প্রভাবে দুঃখ রবে না কখন, সীবলীর ব্রত সদা যে করে পালন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে বৃদ্ধি নিশ্চয় হইবে, সীবলীর গুণগাথা যে জন স্মরিবে।
খাদ্য বস্ত্র অভাবেতে আছ যত নর, সীবলী চরিত কথা অহরহ স্মর।
দরিদ্র লভিবে বিত্ত, ধনী, মহাধন সীবলীর ব্রত যেবা করে পালন
ধনের কামনা করি ভবে নরগণ, কাল্পনিক দেবদেবী করিয়া সৃজন।
করে নিত্য পূজা তারা ধনলাভ তরে; কিন্তু সীবলীর পূজা বহুগন ধরে।
লঙ্কা, ব্রম্মা, শ্যাম, চীন, তিব্বত, জাপান, সীবলী পূজাতে তাঁরা অতি নিষ্ঠাবান।
সীবলীর পরিচয় এবং নামকরণ:
ভারতের সমৃদ্ধ নগরী ‘বৈশালী’র লিচ্ছবি রাজ্যের রাজপুত্র মহালী কুমার। অন্যদিকে কোলীয় রাজকন্যা পরমা সুন্দরী সুপ্রবাসা। অতীতের কর্মসূত্রে এ দুই রাজপুত্র-কন্যা মণি-কাঞ্চনের মত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। যেদিন সুপ্রবাসা গর্ভবতী হল সেদিন হতেই তার গর্ভজাত সন্তান মহাপূণ্যবান তা উপলব্ধি করল। কেননা সেদিন হতে তিনি নানা উপঢৌকন, রাশি রাশি অর্থ, বস্ত্রালংকার এবং নানা প্রকার ঈস্পিত-মনোজ্ঞ বস্তুসামগ্রী তিনি লাভ করতে লাগলেন। রাজা-রাণীর রাজপরিবার ধন-দৌলতলতে পরিপূর্ণ হতে লাগল। এমনকি সুপ্রবাসাকে স্পর্শ করে কৃষক বীজ বপন করতঃ একবীজ হতে নাল জন্মে শত শত। সুপ্রবাসার হস্তস্পর্শে চাষীরা গোলাতে শস্য উঠালে, শস্য খরচ করার পরও গোলা পূর্ণ থাকত। অভূতপূর্ব-অকল্প
নীয় এ দৃশ্যে সবাই জ্ঞাত হল যে, সুপ্রবাসার গর্ভপুত্র যেন স্পর্শমনি!
রাজ্যের চতুর্দিকে আনন্দের সাড়া আর রাজা-রাণী পুত্র প্রেমে হলো মাতোয়ারা। সবাই অধির আগ্রহে রাজার নন্দনের জন্মক্ষণ গণনায় ব্যাকুল। ক্রমে ক্রমে দশমাস দশদিন গত হবার পরও রাজপুত্রের জন্ম হল না! সবাই বিষ্ময়ে হতবাক! এরূপে সাত বছর গত হবার পর রাণী সুপ্রবাসা প্রসব বেদনা অনুভূত করতে লাগলেন। অতঃপর সুপ্রবাসা মহাকারুণিক বুদ্ধের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে রাজপুরীতে আনন্দের বন্যা বয়ে সাত বছর সাতদিনে রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন। পুত্রমুখ দর্শনে রাণীর সমস্ত যন্ত্রণা দূর হল। অন্তর অপার পুত্রপ্রেমে প্রফুল্ল হল। রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ল আনন্দোল্লাস।
চারদিক সুশোভিত হল রাজপুরী। নৃত্য-গীত ধ্বনিতে রাজ্য যেন স্বর্গপুরী। আয়োজন করা হল দাল শালা। অকাতরে দানধর্ম চলছিল। ইষ্ট-মিত্র, জ্ঞাতিগণ সকলে সমবেত হলেন। সকলেই রাজকুমারকে এক নয়ন দেখার জন্য সানন্দে অধির অপেক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে রাজকুমারের দর্শন মিলল। রাজকুমারের এমন সুবর্ণ ন্যায় মুখ দেখে সকলের মনপ্রাণ যেন সুশীতল। এ হেতু নাম রাখা হয়- সীবলী কুমার।
প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষা এবং অর্হত্বলাভ:
রাজা-রাণীর আরাধনায় মহাকারুণিক বুদ্ধ, সারিপুত্র স্থবিরসহ সশিষ্যে রাজপ্রসাদে এসে উপস্থিত হলেন। তথায় বুদ্ধকে বন্দনা-পূজা সমাপন করে মাতা-পুত্রে সারিপুত্র স্থবিরকে বন্দনা করার প্রত্যয়ে স্থবিরের নিকটে উপস্থিত হলেন। সারিপুত্র স্থবির সীবলী কুমারকে উপলক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন- কুমার, তোমার সপ্তবর্ষ গর্ভবাস যন্ত্রণার কথা মনে আছে কী? কুমার প্রতুত্তরে বললেন- ভন্তে, অসহ্য অনন্ত দুঃখ গর্ভ কারাগার, লৌহকুম্ভী নরকের চেয়ে মাতৃগর্ভ কম কিছু নয়। তারপর সারিপুত্র স্থবির প্রকাশ করলেন- সজ্ঞানে তুমি জন্ম দুঃখ অবগত হয়েছ! নিরোধ নির্বাণ ব্যতীত সুখ নেই। তোমার প্রব্রজ্যা ইচ্ছা আছে কী? কুমার সবিনয়ে বললেন- ভন্তে, আমি প্রব্রজ্যাই গ্রহণ করব। ইহা ব্যতীত দুঃখ মুক্তি আর দেখি না। সপ্তম বর্ষীয় কুমারের এরূপ পরিপক্ষ জ্ঞান-ধর্মালাপে সুপ্রবাসা আনন্দিত হয়ে সারিপুত্র স্থবিরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ভন্তে, আপনাদের আলাপচারিতা কী নিয়ে? তখন সারিপুত্র স্থবির ব্যক্ত করলেন- দুঃখ সত্য প্রসঙ্গে আমাদের এ আলাপচারিতা। এবং কুমার ইচ্ছা পোষণ করছে প্রব্যজ্যা গ্রহণে! কিন্তু অনুমতি ব্যতীত কেমন করে প্রব্রজ্যা প্রদান করব!
ইহা শুনে সুপ্রবাসা সারিপুত্র স্থবিরকে বন্দনা নিবেদন করতঃ কুমারকে প্রব্রজ্যা প্রদান করার অনুমতি প্রদান করলেন। তখন বুদ্ধ সশিষ্যে সীবলী কুমারকে সাথে নিয়ে বৈশালী বিহারে উপস্থিত হয়ে প্রব্রজ্যা প্রদানের ব্যবস্থা করলেন। সারিপুত্র স্থবির আদি কর্মস্থান দিতে গিয়ে কুমারকে উপলক্ষ করে বললেন- হে কুমার, তুমি সপ্তবর্ষ গর্ভবাস যন্ত্রণা ভোগের কথা স্মরণ কর! সীবলী কুমার গর্ভবাস যন্ত্রণার নরকসম দুঃখের কথা স্মরণ করতে লাগলেন। এমতাবস্থায় মস্তক মুণ্ডনকালে চুলের প্রথম গোছা কর্তন করার সময় কেশ কেশ ভাবনাতে কুমার স্রোতাপন্ন হন, চুলের দ্বিতীয় গোছা কর্তন শেষে মার্গফল লাভ করলেন, তৃতীয় গোছাতে কুমার অনাগামী ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন এবং সর্ব কেশ ছেদন শেষে কোন প্রকার ক্লেশ আর অবশিষ্ট রইল না। তিনি অর্হত্ব ফল লাভের মধ্যদিয়ে দুঃখ জয়ে সমর্থ হলেন।
তদবধি ভিক্খুদের অভাব ঘুচিল, ভৈষজ্য-চীবর আদি চতুর্প্রত্যয়,
অজস্র করিছে দান দেবনরচয়।
রাশি রাশি খাদ্যভোজ্য সংখ্যা নাহি তার, দেখিয়া বিষ্ময় লাগে মনে সবাকার।
যেদিকে সীবলী থের করেন গমন, বৃষ্টিধারা সম দান হয় বরিষণ।
সপ্তবর্ষ গর্ভবাসের কর্মফল বর্ণনা:
অতীতের কর্ম্মশক্তি থাকে সুপ্তাকারে, সকলেই কর্ম্মতত্ত্ব বুঝিতে না পারে।
আম্র হতে আম্র জন্মে, কাঠাঁলে কাঠাঁল, নিম হতে জন্মে নিম, মাকালে মাকাল*।
তাই বলি কর্ম্মফলে হও সাবধান, কর সুচরিত কর্ম্ম হয়ে মতিমান।
ভাল কর্ম্মে ভাল ফল, মন্দে মন্দ হয়, কর্ম্মের প্রকৃতি ইহা জানিবে নিশ্চয়।
সুদূর অতীতে বারাণসীতে ব্রহ্মদত্ত নামে এক অধিপতি ছিলেন। তিনি উত্তমরূপে রাজধর্ম পালন করতেন। রাজ্যে তার সুখ্যাতি প্রত্যেক প্রজামুখে। কিন্তু অতর্কিতভাবে একদিন শত্রুরাজ দ্বারা বারাণসীতে আক্রমণ হল। শত্রুরাজ রাজা ব্রহ্মদত্তকে হত্যা করে বারাণসীর সিংহাসন দখল করে নিলেন। এবং পূর্ব রাজরাণীকে অগ্র মহিষীরূপে ভূষিত করলেন।
এদিকে রাজা ব্রহ্মদত্তের পুত্র গুপ্তদ্বার দিয়ে পলায়ন করে প্রাণ রক্ষা করলেন। তিনি দূরদেশী জ্ঞাতিকুলে আশ্রয় নিয়ে ধীরে ধীরে সৈন্য সংগ্রহ এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। অতঃপর, সৈন্যসহ পিতৃরাজ্য পুনরুদ্বারে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে বারাণসীর দিকে রওনা হলেন। গোপন সংবাদে মা পুত্রের আগমন বার্তা পেয়ে গোপন সংবাদ প্রেরণ করেন-
“আগে বন্ধ কর নগরের বহির্দ্বার, খাদ্যের অভাবে কষ্ট হোক সবার।
নগরবাসীরা যবে অতিষ্ঠ হইবে, ক্রোধে তারা শত্রুরাজে মারিয়া ফেলিবে।
তাহা হলে বিনাযুদ্ধে লভিবে বিজয়, ইহাই উত্তম যুক্তি জানিও নিশ্চয়”।
মায়ের বার্তা পেয়ে নগরের বাইরের দরজা সৈন্যদল দিয়ে সাত বছর অবরুদ্ধ করা রাখা হয়। তবুও রাজ্যের মধ্যে খাদ্যের অভাব, হাহাকার উঠেনি। কারণ নগরবাসীরা গুপ্তদ্বার দিয়ে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে আনত। তখন পুনরায় মায়ের সংবাদে গুপ্তদ্বার অবরোধ করা হলে নগর মাঝে খাদ্যদ্রব্যের হাহাকারে প্রজাসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে রাজাকে হত্যা করে। অতপরঃ রাজা ব্রহ্মদত্তের পুত্র পিতৃরাজ্য নিজের করে নিলেন। (রাজা ব্রহ্মদত্তের সেই রাজপুত্র ছিলেন ‘সীবলী কুমার’)।
সপ্তবর্ষ সপ্তদিন দ্বার রুদ্ধ করি, সেই পাপে লৌহকুম্ভী নরকেতে পড়ি।
ভুগিয়াছি, বহু দুঃখ না যায় বর্ণন, অবশেষে লভিয়াছি মানব জনম।
ভুগিয়াছি পাপের ফল কিছু বাকী ছিল, সে কারণে মাতৃগর্ভে এত কষ্ট হল।
সীবলী পরিত্রাণ (বাংলা):
০১) মহাজ্ঞানী বুদ্ধশিষ্যগণ সকলেই শ্রাবক পারমী পুর্ণ করিয়াছেন। সীবলীর এ পারমী গুণতেজ সম্বলিত সেই পরিত্রাণ পাঠ করিতেছি। (বন্ধনী স্থিত বিষয়গুলীর অর্থ সুবোধ্য নহে) সম্ববতঃ সীবলী গুণ প্রকাশক সাংকেতিক শব্দ।
০২) সমস্ত স্বভাব ধর্মে চক্ষুষ্মান পদুমুত্তর নামক বুদ্ধ এই হইতে লক্ষকল্প পূর্বে জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
০৩) সীবলী মহাস্থবির চতুর্ব্বিধ প্রত্যয়াদি পাইবার যোগ্য মহাপুরুষ। তিনি দেব-মানবগনের, উত্তম ব্রহ্মাগণের ও নাগসুপর্ণগণের প্রিয়পাত্র ছিলেন। সেই পীণেন্দ্রীয় মহাপুরুষকে আমি নমস্কার করিতেছি।
০৪) তিনি দেব-মানবগনের পূজিত, তাহার গুণ প্রকাশক “নাসং সীসো চ মোসীসং, নানজালীতি সংজলিং” এই বাক্যের প্রভাবে আমার সকল বিষয় লাভ হোক।
০৫) আমি ভূমিষ্ট হইবার সময় সপ্তাহকাল মাতৃযোনিতে মহাদুঃখ পাইয়াছি। আমার মাতাও এইরূপ মহাদুঃখ ভোগ করিয়াছেন।
০৬) আমি প্রব্রজ্যার জন্য কেশচ্ছেদনের সময় অর্হত্ব প্রাপ্ত হইয়াছি। দেব-নাগ-মনুষ্যগণ আমার জন্য উপকরণ করিয়া থাকেন।
০৭) আমি পদুমুত্তর ও বিপস্সী নামক বিনায়ক বুদ্ধকে বিশেষ বিশেষ বস্তুর দ্বারা সন্তুষ্ট চিত্তে পূজা করিয়াছি।
০৮) তাঁহাদের বিশিষ্টতা ও বিপুল উত্তম কর্মের প্রভাবে, বনে-গ্রামে-জলে ও স্থলে এই মহাপৃথিবীর সর্বত্র আমি প্রয়োজনীয় বস্তু লাভ করিয়া থাকি।
০৯-১০) তখন দেবতা আমার জন্য উত্তম বস্তু আনিয়াছিলেন। আমি সেই উপকরণের দ্বারা সঙ্ঘসহ লোকনায়ক বুদ্ধকে পুজা করিলাম। ভগবান বুদ্ধ রেবত স্থবিরকে দর্শন করিতে গেলেন। সেইখান হইতে জেতবনে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া আমাকে লাভীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থান প্রদান করিলেন।
১১-১২) জগতের অগ্রনায়ক বুদ্ধ ত্রিশহাজার ভিক্ষুসহ যখন রেবত স্থবিরকে দেখিতে গিয়াছিলেন, তখন সর্ব্বলোক হিতৈষী শাস্ত্রা ভিক্ষুদিগকে ডাকিয়া কহিলেন- হে ভিক্ষুগণ, আমার লাভী শিষ্যদের মধ্যে ‘সীবলী অগ্র’। এই বলিয়া পরিষদের মধ্যে আমার প্রশংসা করিয়াছিলেন।
১৩) আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হইয়া গিয়াছে। সমস্ত ভব (অর্থাৎ উৎপত্তির কারণ) বিহত হইয়াছে। আমি বন্ধন ছিন্ন হস্তীতুল্য সংসার-বন্ধন শুন্য হইয়া বিহরণ করিতেছি।
১৪) ভগবান বুদ্ধের চরণ তলে আগমন আমার পক্ষে “স্বাগতম” অর্থাৎ সুন্দর আগমন হইয়াছে। আমি ত্রিবিদ্যা লাভ করিয়া বুদ্ধের শাসন প্রতিপালন করিয়াছি।
১৫) আমি চারি প্রতিসম্ভিদা, অষ্টবিমোক্ষ ও ষড় অভিজ্ঞা প্রত্যক্ষ করিয়া বুদ্ধশাসন রক্ষা করিয়াছি।
১৬-১৭) বুদ্ধপুত্র, জিনশ্রাবক, মহাতেজীয়ান, মহাবীর, মহাস্থবির সীবলী নিজের শীলতেজে জিন-শাসন রক্ষা করিয়া যশস্বী-ধনবান সদৃশ ছিলেন।
১৮) বুদ্ধ মার সৈন্য পরাজয় করিবার জন্য কল্পকাল স্থায়ী বোধিদ্রুম মূলে উপবেশন করিয়াছিলেন। (সেই সত্য বাক্যের প্রভাবে ) সীবলী আমাকে সর্বদা রক্ষা করুন।
১৯) আমার (একান্ত পুজনীয়) সীবলী স্থবির অগ্রলাভী দশবিধ পারমিতা পূর্ণ করিয়া গৌতম জিন-শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ পূর্বক শাক্যপুত্র নামে পরিচিত হইয়াছেন।
২০) ভগবান বুদ্ধের অশীতিজন মহাশ্রাবকের মধ্যে পূণ্ণস্থবির যশস্বী আর ভোগ্য বস্তু লাভী মধ্যে সীবলী অগ্রলাভী। তাহাদিগকে আমি অবনত শিরে বন্দনা করিতেছি।
২১) বুদ্ধগুণ অচিন্তনীয়, ধর্ম্মগুণ অচিন্তনীয় এ প্রকার অচিন্তনীয় বিষয়ে যাঁহারা প্রসন্ন হন, তাহাদের প্রসন্নতার ফলও অচিন্তনীয়।
২২-২৩-২৪) [২২-২৩-২৪ নং গাথার অর্থ হল “তাঁহাদের সত্য, শীল, ক্ষান্তি ও মৈত্রী বলের দ্বারা তাঁহারা আমাকে রক্ষা করুন, আমার সকল দুঃখ বিনাশ হউক। আমার সকল ভয় ও সকল রোগ বিনাশ প্রাপ্ত হোক”]।
সীবলী বন্দনা ও পূজা উৎসর্গ:
বন্দনা: সীবলীযং মহাথের লাভীনং সেট্ঠতং গতো মহন্তং পুঞ্ঞাবন্তং তং অভিবন্দামি সব্বদা। (তিন বার)
পূজা উৎসর্গ: ইতিপি সো সব্ব লাভীনং সীবলী অরহং তম্হং ভগবন্তং সধম্মং সসঙ্ঘং ইমেহি আহারেহি, ইমেহি নানা বিধেহি, ফলমূলেহি, ইমেহি পূপ্ফেহি, ইমেহি পদীপেহি, উদকেহি, সুগন্ধেহি, মধুহি, লাজেহি, তাম্বুলেহি, নানাবিধেহি, অগ্গরসেহি, পূজোপচারেহি। তম্হং ভগবন্তং সধম্মং সসঙ্ঘং সীবলী নাম অরহং মহাথেরস্স পূজেমি, পূজেমি, পূজেমি।
ইমিনা পূজা সাক্খার অনুভাবেন যাব নিব্বাণস্স পত্তিতাব জাতি জাতিযং সুখ-সম্পত্তি সমঙ্গীভূতেন সংসরিত্বা নিব্বাণং পাপুনিতুং পত্থনং করোমি। তেজানুভাবেন সব্ব লাভং ভবন্তু মে।
ইদং নানা বিধেহি পূজাপচারেহি পূজানুভাবেন বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ, অগ্গসাবক, মহাসাবক, অরহন্তানং সদ্ধিং সীবলী মহালাভী স্বভাবসীলং।
অহম্পি তেসং অনুবত্তকো হোমি, ইদং পূজোপচারং দানি বণ্ণেনপি সুবণ্ণং, গন্ধেননপি সুগন্ধং, সণ্ঠানেনপি সুসণ্ঠানং, খিপ্পমেব দুব্বন্নং, দুগ্গন্ধং, দুস্সণ্ঠানং, অনিচ্চতং পাপুনিস্সতি। এবমেব সব্বে সংখার অনিচ্চা, সব্বে সংখার দুক্খা, সব্বে ধম্মা অনত্তা’তি।
ইমিনা বন্দনা মানন পূজা পটিপত্তি অনুভাবেন আসবক্খায বহং হোতু সব্বদুক্খা পমুঞ্চন্তু। ইমায ধম্মানুধম্মা পটিপত্তিযা বুদ্ধো ধম্ম সঙ্ঘস্স সদ্ধিং সীবলীযং পূজেমি।
অদ্ধা ইমায ধম্মানুধম্মা পটিপত্তিযা জাতি, জরা, ব্যাধি, মরণম্হা ধম্মো পরিমুচ্চিস্সামি।
পরিশিষ্ট:
‘সীবলী পরিত্রাণ’ পালি ও বাংলায় পাঠ করা কর্তব্য। সীমাহীন দুঃখের এ জীবনে ঈস্পিত বস্তু না পাওয়ায় দুঃখে আমরা যেখানে সদা জর্জরিত কিন্তু সেখানে লাভীশ্রেষ্ঠ অর্হৎ সীবলী স্থবির ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন লাভীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি যখন যা প্রত্যাশা করতেন তখন তা পেতেন। তিনি মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করার পর হতেই তার পিতা-মাতা/পরিবারের লাভ-সৎকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই বৌদ্ধগণও ঈস্পিত বস্তু এবং লাভ-সৎকার বৃদ্ধি মানসে সীবলী পূজা এবং সীবলী পরিত্রাণ পাঠ করে/শ্রবণ করে থাকে। অন্তরে প্রবল শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিশ্বাস নিয়ে সীবলী বন্দনা, পূজা, পরিত্রাণ পাঠ/শ্রবণ করতঃ লাভ-সৎকার বৃদ্ধি, পারিবারিক সৌভাগ্য-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি, নানাবিধ বিপদাপদ হতে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া এহেন পূজ্য অরতহের পূজার ফল কখনো বৃথা যায় না এতে প্রভূত পূণ্য ব্যতীত অপূণ্য সাধিত হয়না।
সীবলীর ব্রতকথা যে করে পঠন, তাহার দুঃখ রবে না কখন।
পাপগ্রস্থ দোষে দুঃখ যখন পাইবে, যতনে সীবলী পূজা তখনি করিবে।
হবে গ্রহদোষ-শান্তি নিশ্চয় নিশ্চয়, সর্বজ্ঞ বুদ্ধের বাণী কভু মিথ্যা নয়।
“সাধু, সাধু, সাধু, জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক”
*মাকাল = লতা জাতীয় উদ্ভিদ, বাইরে সুন্দর অথচ ভিতরে দূর্গন্ধ ও খাদ্য শাসযুক্ত ফলবিশেষ, সুদর্শন অথচ গুণহীন ব্যক্তি।

তথ্যসূত্র: সীবলী ব্রতকথা- বিশুদ্ধাচার স্থবির।

নামসিদ্ধী  জাতক

নামসিদ্ধী জাতক

পুরাকালে বােধিসত্ত্ব তক্ষশিলা নগরে একজন বিখ্যাত আচার্য ছিলেন। পাঁচশতশিষ্য তাঁর বিদ্যাভ্যাস করত। এই সব ছাত্রদের মধ্যে একজনের নাম ছিল পাপক। অন্যান্য ছারা তাকে সব সময় ‘এস পাপক’, যাও পাপক বলত। তাতে পাপক চিন্তা করতে লাগল, আমার নাম অমঙ্গল সূচক। অতএব আমি অন্য একটি নাম গ্রহণ করব। পাপক তাই আচার্যের কাছে গিয়ে বলল, গুরুদেব, আমার বর্তমান নামটা অমঙ্গলসূচক। আমার অন্য একটি নাম রাখুন। আচার্য বললেন, যাও, তুমিজনপদে গিয়ে ঘুরে একটা মঙ্গল সূচক নাম ঠিক করে এস। তুমি ফিরে এলে তােমারবৰ্তমান নামটা পরিবর্তন করে অন্য নাম রাখব। পাপক তখন যাত্রা শুরু করল। সে গ্রামে গ্রামে ঘুরে একটি নগরে গিয়ে উপস্থিত হলাে। সেই নগরে জীবক নামে একৰ্তি লােকের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন। সুতি কুলগণ তার সৎকারের জন্য তার মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে দেখে পাপক জানতে চাইল, এই লােকটির নাম কি ছিল?তারা বলল, এর নাম ছিল জীবক। পাপক তখন আশ্চর্য হয়ে বলল, সেকি! জীবক মানেই ত যে দীর্ঘজীবি। সেই জীবকেরও মৃত্য হলাে। তখন সেই শবযাত্ররা বলল, জীবকেরও মৃত্যু হয়, অনীকেরও মৃত্যুহয়। মরা বাঁচা কি নামের উপর নির্ভর করে নাম তাে কোন বস্তু বা ব্যক্তিকেছেনার বা জানার একটা উপায়। তুমি ত দেখছি বড় মােটা বুদ্ধির লােক।এই কথা শুনে পাপক তা নাম সম্বন্ধে মধ্যমভাব অবলম্বন করল। অর্থাৎ তার নামের উপর বিরক্তি বা অনুরক্তি রইল না। পাপক এবার নগরের ভিতরে গিয়ে দেখল একটি বাড়ির দরজায় এক দাসীকে এক প্রভু ওপ্রভুপত্নী দড়ি দিয়ে প্রহার করছে।পাপক তখন সেই দাসীর প্রভুর কাছে জানতে চাইল, আপনারা একে প্রহার করছেন কেন? প্রভু তখন বলল, এই দাসী আজকের উপার্জনের টাকা পয়সা কিছু আনেনি। পাপক তখন জানতে চাইল, এর নাম কি? দাসীর প্রভু বলল, এর নাম ধনপালী। পাপক আশ্চর্য হয়ে বলল সেকি! এর নাম ধনপালী, অথচ এর একদিনের বেতন দেবার ক্ষমতা নেই। তারা বলল, নাম ধনপালী হােক, বা অধনপালী হােক, তা কি অদৃষ্টিকে এড়াতে পারে? নামে কি আসে যায়?নাম শুধু ব্যক্তি কে, এই পরিচয় পাওয়া যায়। তুমি দেখছিঅতি স্কুলবুদ্ধি। এই কথা শুনে পাপক তা নিজের নাম সম্বন্ধে আগেরবিদ্বেষ ভাব ত্যাগ করল। সে নগর হতে বাইরে গিয়ে পথ চলতে লাগল।কিছুদূরগিয়ে সে দেখল, একটি লােক পথ হারিয়েছে। পাপক তার কাছে জানতে চাইল, আপনি কি করছেন? লােকটি বলল, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি, তাই পথ খুঁজছি। পাপক তার কছে নাম জানতে চাইল।। লােকটি বলল, আমার নাম পন্থক। পাপক একথা শুনে আশ্চার্য হয়ে ভাবল, পন্থক মানে যে অপরকে পথ দেখায়।তাই সে বল্ল, সেই! যে পন্থক সে পথ হারায় কি করে? লােকটি বলল, পন্থক হােক অপন্থকই হােক সব লােকই পথা হারায়। নামে কি আসে যায়?নাম শুধু কোন ব্যক্তি কে, এই পরিচয় জানা যায়। তােমার বুদ্ধি ত দেখছি খুবমােটা। এবার পন্থক নিজের নাম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ রূপে বিদ্বেষ ইন হলাে। সে আচার্যের কাছে ফিরে গেল।আচার্য তাকে জানতে চাইল, কি বতস নাম নির্বাচনকরে এলে? পাপক বলল, গুরুদেব , যার নাম জীবক সেও মরে, যার নাম অজীবক, সেও মরে।যার নাম ধনপালী সেও দরিদ্র হয় আর যার নাম অধনপালী সেও দরিদ্ৰহয়।যার নাম পন্থক সেও পথ হারায়, যার নাম অপন্থক সেও পথ হারায়।নামে কিআসে যায়? এখন দেখছি নামের কোন সারবত্তা নেই।নামদ্বারা কোন বস্তু বাব্যক্তি দে কি তা শুধু জানা যায়। নামে সিদ্ধি লাভ হয় না।সিদ্ধিলাভের উপায় হলাে কর্ম। অতএব আমার অন্য নামের প্রয়ােজন নেই।আমার যে নাম আছে তাই থাকুক।পপকের সব কথা শুনে বােধিসত্ত্ব এই উপদেশ দান করলেন যে, নামে কিছু আসে যায়না।একমাত্র সিদ্ধিদাতা হচ্ছে কর্ম- এই সত্য যেন সবাই মনে রাখে।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

দেবধর্ম  জাতক

দেবধর্ম জাতক

পুরাকালে বারাণসি নগরে ব্রম্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। বোধিসত্ত্ব সেই রাজার পুত্ররূপে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর নাম হল মহীসাস কুমার।

বোধিসত্ত্বের বয়স যখন দুই কি তিন, তখন তাঁর এক সহদরের জন্ম হয়। সেই কুমারের নাম রাখা হল চন্দ্র কুমার। পরে চন্দ্রকুমারের বয়স যখন দুই তিন বছর হল তখন মহিষীর প্রাণ বিয়োগ হয়। পরে রাজা আবার বিবাহ করলেন। তখন তাঁর নতুন মহিষী জীবনসর্বস্ব হয়ে উঠল তাঁর।

কিছুকাল পর এই মহিষী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। এই পুত্রের নাম রাখা হলো সূর্যকুমার। রাজা নব কুমার লাভ করে অতিমাত্রায় আনন্দিত হলেন। তিনি মহিষীকে বললেন, তুমি এই পুত্রের জন্য জে বর চাইবে আমি তাই দেব।

কিন্তু মহিষী তখন কোন বর চাইলেন না। তিনি বললেন, মহারাজ যখন প্রয়োজন হবে, তখন আপনাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেব।
যথাকালে সূর্যকুমার বয়ঃপ্রাপ্ত হল। তখন একদিন মহিষী রাজাকে বললেন, এই বালকের যখন জন্ম হয় তখন আপনি একে একটি বর দিতে চেয়েছিলেন। এখন সে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে। অতএব একে এখন রাজপদ দান করুন।

রাজা বললেন, আমার প্রথম দুই পুত্র রাজপদের উপযুক্ত। তারা জলন্ত অগ্নির মত তেজস্বী। আমি তাদের ত্যাগ করে তমার পুত্রকে রাজ্য দিতে পারি না। কিন্তু মহিষী এতে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি তাঁর প্রার্থনা পূরণের জন্য দিনরাত রাজাকে জ্বালাতন করতে লাগলেন। তখন রাজার আশঙ্কা হল মহিষী চক্রান্ত করে স্বপত্নিপুত্রদের প্রাণ নাশ করতে পারেন।

এই ভেবে রাজা মহিসাসকুমার ও চন্দ্রকুমারকে ডাকিয়ে বললেন, বৎসগণ, সুরজকুমারের যখন জন্ম হয় তখন আমি তোমাদের মাতাকে একটি বর দিতে চেয়েছিলাম, খন সেই বর তিনি নিতে চাননি, বলেছিলেন প্রয়োজন হলে নেব। এখন তিনি সেই দান চেয়ে তাঁর পুত্রকে রাজ্য দিতে বলেন। কিন্তু সূর্যকুমারকে রাজ্য দান করার একেবারে ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী, তোমাদের বিমাতা হইত প্রাণ নাশ করার চেষ্টা করবেন। তাই বলছি তোমরা বনে গিয়ে আস্রয় গ্রহণ কর।

এরপর রাজা সজল চোখে বিলাপ করতে করতে তাঁর দুই পুত্রের মুখচুম্বন করে বনে পাঠালেন।

দুই রাজকুমার পিতাকে প্রনাম করে বনে যাওয়ার জন্য প্রাসাদ হতে বেরিয়ে গেলেন। সুরজকুমার তখন সেই উঠোনেই ছিলেন। তিনি তাঁর দাদাদের ভালবাসতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে খুবই সদ্ভাব ছিল। তাঁর দাদাদের বনবাসের কারণ জানতে পেরে দুঃখিত হয়ে সূর্যকুমারও বনবাস করতে সংকল্প করলেন। তখন তিন ভাই একসঙ্গে বনবাসে গেলেন।

রাজকুমারগণ পথ চলতে চলতে হিমালয়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে একদিন বোধিসত্ত্ব সুরজকুমারকে বললেন, ভাই ঐ সরবরে গিয়ে তুমি স্নান করে ও জল পান করে আমাদের জন্য পদ্মপাতায় করে কিছু জল আন।

পূর্বে ঐ সরোবর ছিল কুবেরের অধিকারে। কুবের উদক নামে এক রাক্ষসকে ঐ সরোবর দান করে বলে দিয়েছিলেন, দেবধর্মহীন কোন ব্যাক্তি এই সরবরে নামলেই তুমি তাকে ভক্ষন করবে। যারা জলে নামবে না তাদের উপর তোমার কোন অধিকার থাকবে না। সেই সরবরের জলে কেও নামলে উদক রাক্ষস থাকে জিজ্ঞেসা করত, দেবধর্ম কি? সে এর উত্তর দিতে না পারলে থাকে খেয়ে ফেলত।

সূর্য কুমার এইসব কথা জানত না। সে তাই নিঃশঙ্ক মনে জলে নামতেই উদক রাক্ষস তাকে ধরে জিজ্ঞেস করল, দেবধর্ম কাকে বলে জান কি?
সুরজকুমার বলল, জানি বৈ কি। লোকে সূর্য ও চন্দ্রকেই তো দেবতা বলে।

উদক বলল মিথ্যা কথা। তুমি দেবধর্ম জান না।

এই বলে সে সুরজকুমারকে গভীর জলে টেনে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখে দিল।

সূর্য কুমারের ফিরে আসতে বিলম্ব দেখে বোধিসত্ত্ব চান্দ্রকুমারকে তার খজে পাঠালেন। চন্দ্রকুমার সেই সরবরের জলে নামলে সেই উদক রাক্ষস তাঁকে ধরে সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করল। চন্দ্রকুমার বললেন, দিকচতুষ্টয়ই অর্থাৎ চারটি দিক দেবধর্ম বিশিষ্ট।

রাক্ষস বলল, মিথ্যা কথা তুমি দেব্দরম জান না। এই বলে সে চন্দ্রকুমারকে গভীর জলে টেনে নিয়ে গিয়ে তার ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখে দিল।

চন্দ্রকুমারও ফিরে এলেন না দেখে বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, দুই ভাইয়ের নিশ্চয় বিপদ হয়েছে। তিনি তখন তাদের সন্ধানে সেই সরবরে চলে গেলেন। তারপর পদচিহ্ন দেখে বুজতে পারালেন, তারা জলে নেমেছে, কিন্তু উঠে আসেনি। তখন বোধিসত্ত্ব বুঝতে পারলেন, এই সরবরে নিশ্চয় কোন জলরাক্ষস আছে। তাই তিনি মুক্ত তরবারি ও ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে রাক্ষসের উপেক্ষায় তীরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

উদক রাক্ষস তখন এক বনচরের বেশে সেখানে এসে বোধিসত্ত্বকে বলল, তুমি দেখছি পথশ্রমে ক্লান্ত। তুমি জল পান কর ও এই জলে স্নান করে ডেহ শীতল কর।

বোধিসত্ত্ব বুঝলেন, এই হল তিনি তখন রাক্ষস। তিনি তখন তাকে বললেন, তুমিই ত আমার ভাইদের ধরে রেখেছ?

বোধিসত্ত্ব আবার বললেন, কেন তাদের ধরে রেখেছ?

রাক্ষস বলল, কারণ তারা আমার ভক্ষ্য। যারা দেবধর্ম না জেনে এই সরবরেরে জলে নামে তারাই আমার ভক্ষ্য।
বোধিসত্ত্ব বললেন, দেবধর্ম কি তা শুনতে চাও?

রাক্ষস বলল, হ্যাঁ শুনতে চাই, বল।

বোধিসত্ত্ব বললেন, বলব বটে, কিন্তু পথশ্রমে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

উদক রাক্ষস তখহন তাঁকে স্নান করিয়ে খাদ্য ও পানীয় দ্বারা তৃপ্ত করল। তারপর একটি পর্যঙ্ক এনে তাঁকে দিল। তারপর সে তাঁর পদমূলে বসে দেবধর্ম শুনতে চাইল।

বোধিসত্ত্ব বললেন, যে ব্যাক্তি প্রসান্তচিত্ত, সত্যপরায়ণ, যে ব্যাক্তি নিয়ত অন্তরে সর্বদা ধর্ম রক্ষা করে চলে, যে ব্যাক্তি তার মনে কোন কুস্বভাব জাগলে যে মনে মনে লজ্জা পায়, তাকেই দেবধর্মবিশিষ্ট ব্যাক্তি বলে জানবে।

দেবধর্মের এই ব্যাখ্যা শুনে উদক রাক্ষস সন্তুষ্ট হলো। সে বলল তুমি সত্যিই জ্ঞানী। আমি তোমার একজন ভাইকে মুক্ত করে দেব। বল, তুমি তোমার কোন ভাইকে চাও?

বোধিসত্ত্ব বলল, আমার কনিষ্ঠ ভাই সূর্যকুমারকে মুক্ত করে আন।
রাক্ষস বলল, তুমি দেবধর্ম জান বটে, কিন্তু সেই মত কাজ কর না। জ্যেষ্ঠকে ছেড়ে, তুমি কনিষ্ঠকে বাঁচাতে চাও। এতে জ্যেষ্ঠের মর্যাদা রাখা হলো কি?

বোধিসত্ত্ব বলল, আমি দেবধর্ম আনুসারে কাজ করছি। কনিষ্ঠটি আমাদের বৈমাত্রয় ভাই। আমরা এর জন্য বনবাসী হতে বাধ্য হয়েছি। এর মাতা একে রাজ্য দান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের পিতা তাতে সম্মত হননি। তখন আমাদের প্রাণ নাশের আশঙ্কায় আমাদের বনে পাঠিয়ে দেন। এই কনিষ্ঠ ভাইটি তা জাতে পেরে সে স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে চলে আসে সব কিছু ফেলে। সে রাজ্য চায় না, গৃহে ফিরে যেতে চায় না।

সে আমাদের ভালবাসে এবং আমাদের ভালবাসা চায়। তাছাড়া আমরা ফিরে গিয়ে যদি বলি, একে রাক্ষসে খেয়েছে, তা শুনে লোকে কি বিশ্বাস করবে? এই সব কারণে আমি কনিষ্ঠ ভাইকে মুক্ত করতে চাই।

রাক্ষস তখন বলল, সত্যিই তুমি দেব ধর্ম জান আর সেই মত কাজ কর। আমি তোমার দু ভাইকে মুক্ত করে দিচ্ছি।

বোধিসত্ত্ব তখন ভাইদের নিয়ে সেই বনে বসবাস করতে লাগলেন। তখন তিনি রাক্ষস্কে বললেন, তুমি তোমার কর্মদোষে বারবার রাক্ষসকূলে জন্মগ্রহণ করছ। তুমি জীবহিংসা কর নরমাংস ভক্ষণ করে এজন্মেও পাপ কাজ করছ। পরজন্মেও তুমি এরকম রাক্ষস হবে। এখন হতে তুমি এই রাক্ষসবৃত্তি ত্যাগ করে সৎ ও অহিংসা জীবন জাপন কর।

রাক্ষস তাই করল এবং তাঁদের কাছেই শুদ্ধভাবে বাস করতে লাগল।

এরপর বোধিসত্ত্ব নক্ষত্র গণনা করে দেখলেন তাঁর পিতা দেহত্যাগ করেছেন। তাই তিনি ভাইদের নিয়ে রাজবাড়ীতে ফিরে গিয়ে রাজ্যভার গ্রহন করলেন। চন্দ্রকুমারকে উপরাজ অর্থাৎ সহকারী রাজা করলেন এবং সূর্যকুমারকে প্রধান সেনপতি নিযুক্ত করলেন। এইভাবে তারা তিন ভাই রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

কালবাহু জাতক

কালবাহু জাতক

পুরাকালে রাজা ব্রম্মদত্তের সময়ে বোধিসত্ত্ব এক শুকপক্ষিরুপে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তাঁর নাম ছিল রাধ আর তাঁর কনিষ্ঠ ভাইয়ের নাম ছিল প্রোষ্ঠপাদ। বোধিসত্ত্বের শরীরটি বেশ বড় ছিল।

একদিন এক বেধ এই দুটি শুককে ধরে নিয়ে গিয়ে রাজাকে উপহার দিল। রাজা তাদের এক্তি সোনার খাঁচায় রাখলেন। তাদের সোনার পাত্রে মধু মিশ্রিত খই খাওয়াতে লাগলেন। শর্করা বা চিনিমিশ্রিত জল দেবার ব্যবস্থা করলেন। এই ভাবে তাদের যথেষ্ট আদর যত্ন করতে লাগলেন।

তারপর আর এক বেধ একদিন কাল্বাহু নামে ঘোর কাল রঙের এক বানর এনে রাজাকে দিল। রাজা সেই থেকে বানরকে বেশী আদর যত্ন করতে লাগলেন। শুকদের আদর কমে গেল। বোধিসত্ত্ব রাধ সর্বগুণসম্পন্ন ছিলেন। তিনি এজন্য কিছু মনে করলেন না। কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ ভাইয়ের মনে সেরকম উদারতা ছিল না। সে একদিন তার বড় ভাইকে বলল, আগে আমরা কত সুস্বাদু খাবার পেতাম। কিন্তু এখন কিছুই পাই না। তবে চল আমরা বনে চলে যাই।

বোধিসত্ত্ব বললেন, শোন প্রোষ্ঠপাদ, লাভ-অলাভ, সুখ-দুখ, যশ-অযশ, নিন্দা-প্রশংসা সবই অনিত্য। তাই সুখ পরিহার কর।
তবু প্রোষ্ঠপাদ বলল, দাদা তুমি বুদ্ধিমান, কিভাবে বানর তাকে তাড়ানো যায় তার উপায় স্থির কর।

বোধিসত্ত্ব বললেন, কিছুই করতে হবে না। বানর তার নিজের দোষেই বিতাড়িত হবে। তার ভ্রুকুটি ও চখ মুখের ভঙ্গি দেখে রাজকুমারেরা ভয় পাবে। তখন একে তাড়িয়ে দেবে।

বোধিসত্ত্ব যা বলেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যে তাই ঘটল। কাল বানরটার ভ্রুকুটি, মুখভঙ্গি ও কান নাড়ানো দেখে রাজকুমাররা ভয়ে চিৎকার করতে লাগল। রাজা বানরটার এই কুকীর্তির কথা জানতে পেরে আদেশ দিলেন, ওকে দূর করে দাও।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

error: Content is protected !!