পুরাকালে বারাণসি নগরে ব্রম্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। বোধিসত্ত্ব সেই রাজার পুত্ররূপে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর নাম হল মহীসাস কুমার।

বোধিসত্ত্বের বয়স যখন দুই কি তিন, তখন তাঁর এক সহদরের জন্ম হয়। সেই কুমারের নাম রাখা হল চন্দ্র কুমার। পরে চন্দ্রকুমারের বয়স যখন দুই তিন বছর হল তখন মহিষীর প্রাণ বিয়োগ হয়। পরে রাজা আবার বিবাহ করলেন। তখন তাঁর নতুন মহিষী জীবনসর্বস্ব হয়ে উঠল তাঁর।

কিছুকাল পর এই মহিষী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। এই পুত্রের নাম রাখা হলো সূর্যকুমার। রাজা নব কুমার লাভ করে অতিমাত্রায় আনন্দিত হলেন। তিনি মহিষীকে বললেন, তুমি এই পুত্রের জন্য জে বর চাইবে আমি তাই দেব।

কিন্তু মহিষী তখন কোন বর চাইলেন না। তিনি বললেন, মহারাজ যখন প্রয়োজন হবে, তখন আপনাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেব।
যথাকালে সূর্যকুমার বয়ঃপ্রাপ্ত হল। তখন একদিন মহিষী রাজাকে বললেন, এই বালকের যখন জন্ম হয় তখন আপনি একে একটি বর দিতে চেয়েছিলেন। এখন সে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে। অতএব একে এখন রাজপদ দান করুন।

রাজা বললেন, আমার প্রথম দুই পুত্র রাজপদের উপযুক্ত। তারা জলন্ত অগ্নির মত তেজস্বী। আমি তাদের ত্যাগ করে তমার পুত্রকে রাজ্য দিতে পারি না। কিন্তু মহিষী এতে ক্ষান্ত হলেন না। তিনি তাঁর প্রার্থনা পূরণের জন্য দিনরাত রাজাকে জ্বালাতন করতে লাগলেন। তখন রাজার আশঙ্কা হল মহিষী চক্রান্ত করে স্বপত্নিপুত্রদের প্রাণ নাশ করতে পারেন।

এই ভেবে রাজা মহিসাসকুমার ও চন্দ্রকুমারকে ডাকিয়ে বললেন, বৎসগণ, সুরজকুমারের যখন জন্ম হয় তখন আমি তোমাদের মাতাকে একটি বর দিতে চেয়েছিলাম, খন সেই বর তিনি নিতে চাননি, বলেছিলেন প্রয়োজন হলে নেব। এখন তিনি সেই দান চেয়ে তাঁর পুত্রকে রাজ্য দিতে বলেন। কিন্তু সূর্যকুমারকে রাজ্য দান করার একেবারে ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী, তোমাদের বিমাতা হইত প্রাণ নাশ করার চেষ্টা করবেন। তাই বলছি তোমরা বনে গিয়ে আস্রয় গ্রহণ কর।

এরপর রাজা সজল চোখে বিলাপ করতে করতে তাঁর দুই পুত্রের মুখচুম্বন করে বনে পাঠালেন।

দুই রাজকুমার পিতাকে প্রনাম করে বনে যাওয়ার জন্য প্রাসাদ হতে বেরিয়ে গেলেন। সুরজকুমার তখন সেই উঠোনেই ছিলেন। তিনি তাঁর দাদাদের ভালবাসতেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে খুবই সদ্ভাব ছিল। তাঁর দাদাদের বনবাসের কারণ জানতে পেরে দুঃখিত হয়ে সূর্যকুমারও বনবাস করতে সংকল্প করলেন। তখন তিন ভাই একসঙ্গে বনবাসে গেলেন।

রাজকুমারগণ পথ চলতে চলতে হিমালয়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে একদিন বোধিসত্ত্ব সুরজকুমারকে বললেন, ভাই ঐ সরবরে গিয়ে তুমি স্নান করে ও জল পান করে আমাদের জন্য পদ্মপাতায় করে কিছু জল আন।

পূর্বে ঐ সরোবর ছিল কুবেরের অধিকারে। কুবের উদক নামে এক রাক্ষসকে ঐ সরোবর দান করে বলে দিয়েছিলেন, দেবধর্মহীন কোন ব্যাক্তি এই সরবরে নামলেই তুমি তাকে ভক্ষন করবে। যারা জলে নামবে না তাদের উপর তোমার কোন অধিকার থাকবে না। সেই সরবরের জলে কেও নামলে উদক রাক্ষস থাকে জিজ্ঞেসা করত, দেবধর্ম কি? সে এর উত্তর দিতে না পারলে থাকে খেয়ে ফেলত।

সূর্য কুমার এইসব কথা জানত না। সে তাই নিঃশঙ্ক মনে জলে নামতেই উদক রাক্ষস তাকে ধরে জিজ্ঞেস করল, দেবধর্ম কাকে বলে জান কি?
সুরজকুমার বলল, জানি বৈ কি। লোকে সূর্য ও চন্দ্রকেই তো দেবতা বলে।

উদক বলল মিথ্যা কথা। তুমি দেবধর্ম জান না।

এই বলে সে সুরজকুমারকে গভীর জলে টেনে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখে দিল।

সূর্য কুমারের ফিরে আসতে বিলম্ব দেখে বোধিসত্ত্ব চান্দ্রকুমারকে তার খজে পাঠালেন। চন্দ্রকুমার সেই সরবরের জলে নামলে সেই উদক রাক্ষস তাঁকে ধরে সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করল। চন্দ্রকুমার বললেন, দিকচতুষ্টয়ই অর্থাৎ চারটি দিক দেবধর্ম বিশিষ্ট।

রাক্ষস বলল, মিথ্যা কথা তুমি দেব্দরম জান না। এই বলে সে চন্দ্রকুমারকে গভীর জলে টেনে নিয়ে গিয়ে তার ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখে দিল।

চন্দ্রকুমারও ফিরে এলেন না দেখে বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, দুই ভাইয়ের নিশ্চয় বিপদ হয়েছে। তিনি তখন তাদের সন্ধানে সেই সরবরে চলে গেলেন। তারপর পদচিহ্ন দেখে বুজতে পারালেন, তারা জলে নেমেছে, কিন্তু উঠে আসেনি। তখন বোধিসত্ত্ব বুঝতে পারলেন, এই সরবরে নিশ্চয় কোন জলরাক্ষস আছে। তাই তিনি মুক্ত তরবারি ও ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে রাক্ষসের উপেক্ষায় তীরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

উদক রাক্ষস তখন এক বনচরের বেশে সেখানে এসে বোধিসত্ত্বকে বলল, তুমি দেখছি পথশ্রমে ক্লান্ত। তুমি জল পান কর ও এই জলে স্নান করে ডেহ শীতল কর।

বোধিসত্ত্ব বুঝলেন, এই হল তিনি তখন রাক্ষস। তিনি তখন তাকে বললেন, তুমিই ত আমার ভাইদের ধরে রেখেছ?

বোধিসত্ত্ব আবার বললেন, কেন তাদের ধরে রেখেছ?

রাক্ষস বলল, কারণ তারা আমার ভক্ষ্য। যারা দেবধর্ম না জেনে এই সরবরেরে জলে নামে তারাই আমার ভক্ষ্য।
বোধিসত্ত্ব বললেন, দেবধর্ম কি তা শুনতে চাও?

রাক্ষস বলল, হ্যাঁ শুনতে চাই, বল।

বোধিসত্ত্ব বললেন, বলব বটে, কিন্তু পথশ্রমে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

উদক রাক্ষস তখহন তাঁকে স্নান করিয়ে খাদ্য ও পানীয় দ্বারা তৃপ্ত করল। তারপর একটি পর্যঙ্ক এনে তাঁকে দিল। তারপর সে তাঁর পদমূলে বসে দেবধর্ম শুনতে চাইল।

বোধিসত্ত্ব বললেন, যে ব্যাক্তি প্রসান্তচিত্ত, সত্যপরায়ণ, যে ব্যাক্তি নিয়ত অন্তরে সর্বদা ধর্ম রক্ষা করে চলে, যে ব্যাক্তি তার মনে কোন কুস্বভাব জাগলে যে মনে মনে লজ্জা পায়, তাকেই দেবধর্মবিশিষ্ট ব্যাক্তি বলে জানবে।

দেবধর্মের এই ব্যাখ্যা শুনে উদক রাক্ষস সন্তুষ্ট হলো। সে বলল তুমি সত্যিই জ্ঞানী। আমি তোমার একজন ভাইকে মুক্ত করে দেব। বল, তুমি তোমার কোন ভাইকে চাও?

বোধিসত্ত্ব বলল, আমার কনিষ্ঠ ভাই সূর্যকুমারকে মুক্ত করে আন।
রাক্ষস বলল, তুমি দেবধর্ম জান বটে, কিন্তু সেই মত কাজ কর না। জ্যেষ্ঠকে ছেড়ে, তুমি কনিষ্ঠকে বাঁচাতে চাও। এতে জ্যেষ্ঠের মর্যাদা রাখা হলো কি?

বোধিসত্ত্ব বলল, আমি দেবধর্ম আনুসারে কাজ করছি। কনিষ্ঠটি আমাদের বৈমাত্রয় ভাই। আমরা এর জন্য বনবাসী হতে বাধ্য হয়েছি। এর মাতা একে রাজ্য দান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের পিতা তাতে সম্মত হননি। তখন আমাদের প্রাণ নাশের আশঙ্কায় আমাদের বনে পাঠিয়ে দেন। এই কনিষ্ঠ ভাইটি তা জাতে পেরে সে স্বেচ্ছায় আমাদের সাথে চলে আসে সব কিছু ফেলে। সে রাজ্য চায় না, গৃহে ফিরে যেতে চায় না।

সে আমাদের ভালবাসে এবং আমাদের ভালবাসা চায়। তাছাড়া আমরা ফিরে গিয়ে যদি বলি, একে রাক্ষসে খেয়েছে, তা শুনে লোকে কি বিশ্বাস করবে? এই সব কারণে আমি কনিষ্ঠ ভাইকে মুক্ত করতে চাই।

রাক্ষস তখন বলল, সত্যিই তুমি দেব ধর্ম জান আর সেই মত কাজ কর। আমি তোমার দু ভাইকে মুক্ত করে দিচ্ছি।

বোধিসত্ত্ব তখন ভাইদের নিয়ে সেই বনে বসবাস করতে লাগলেন। তখন তিনি রাক্ষস্কে বললেন, তুমি তোমার কর্মদোষে বারবার রাক্ষসকূলে জন্মগ্রহণ করছ। তুমি জীবহিংসা কর নরমাংস ভক্ষণ করে এজন্মেও পাপ কাজ করছ। পরজন্মেও তুমি এরকম রাক্ষস হবে। এখন হতে তুমি এই রাক্ষসবৃত্তি ত্যাগ করে সৎ ও অহিংসা জীবন জাপন কর।

রাক্ষস তাই করল এবং তাঁদের কাছেই শুদ্ধভাবে বাস করতে লাগল।

এরপর বোধিসত্ত্ব নক্ষত্র গণনা করে দেখলেন তাঁর পিতা দেহত্যাগ করেছেন। তাই তিনি ভাইদের নিয়ে রাজবাড়ীতে ফিরে গিয়ে রাজ্যভার গ্রহন করলেন। চন্দ্রকুমারকে উপরাজ অর্থাৎ সহকারী রাজা করলেন এবং সূর্যকুমারকে প্রধান সেনপতি নিযুক্ত করলেন। এইভাবে তারা তিন ভাই রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

error: Content is protected !!