বৌদ্ধ ধর্মে মার কী বা কারা? মার কীভাবে

সত্ত্বদের মুক্তির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে?

—————————————————

বৌদ্ধ ধর্ম মতে, মার হচ্ছে শত্রু, শয়তান বা অশুভ শক্তি। সত্ত্বগণের বা মানুষের মুক্তি মার্গে অন্তরায় সৃষ্টি করাই মারের কাজ। সৎ কাজে মারের শত অনিহা ও অজুহাত। মার মনে নানা রকম যুক্তি উপমা দাঁড়। করায় এবং বাস্তবায়ন যাতে না হয় সেজন্য সর্বশক্তি প্রযােগ করে বাধা সৃষ্টি করে। আবার অকুশল কাজ বা খারাপ কাজে মার মনে মনে যথেষ্ট কুবুদ্ধি ও পরামর্শ খাটিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য লেগে থাকে এবং বাস্তবায়নের পর কেটে পরে। সৎ কালে শত বাধা এবং অসৎ কাজে উৎসাহ যােগানাে মারের লক্ষণ।

সাধারণত পাঁচ প্রকার মার দেখতে পাওয়া যায়, যথা –

                                                ১। দেবপুত্র মার:

অসৎ দেবতাদেরকে দেবপুত্র মার বলা হয়। যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মানুষের মুক্তির পথে বাধার সৃষ্টি করে। কখনাে পশুপাখীর রূপ ধারণ করে, কখনাে বুদ্ধমূর্তি, কখনাে ভয়ানক ভীষণ আকারআকৃতি, কখনাে জীবিত মা, বাবা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে মৃত অবস্হায় দেখায়, আবার কখনও বা ঘর-বাড়ী আগুণে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে দেখায়, এসব দেবপুত্র মারের চক্রান্ত।তথাগত বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ব মুহূর্তে পর-নির্মিত বশবর্তী দেবলােকের দুর্দান্ত মার রাজ গিরিমেখলা হাজার সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে হসহিরাজের পিঠে আরােহন করে মায়ার চক্র তৈরী করে গৌতম বােধিসত্ত্বকে প্রলােভন দেখিয়েছিলেন। আক্রমন করেছিলেন সিদ্ধার্থকে ধ্যানচ্যুত করার জন্য, কিন্তু জন্ম জন্মান্তরের অপ্রমেয় দান ও ধর্মের প্রভাবে সিদ্ধার্থ সসৈন্য মাররাজাকে পরাজিত করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন।                                                                            

                                             ২| অভিসংস্কার মার:

অভিসংস্কার বলতে এই জন্মের সংস্কার ছাড়াও অতীত অতীত জন্মের অতিরিক্ত স্পষ্ট সংস্কারের। প্রতিফলনকে বুঝায়। এখানে অভি শব্দকে অধিকতর বা অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। এটা ধর ধাতু নিস্পন্ন ধারণ করা, সমর্থন করা, স্পর্শ প্রতিভাত হওয়া। সংস্কার বলতে কায়, বাক্য ও মনের দ্বারা যা সংস্কৃত বা নিত্য সম্পাদ্যরূপে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়, তাই সংস্কার। ভাবনাকারীর ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে উপাচার সমাধির প্রারম্ভে, পূর্বের সংস্কার গুলাে দেখা দেয় এবং তা অনন্ত জন্মেরও হতে পারে। এ সংস্কার গুলাে কর্মস্রোত বা কর্মপ্রবাহ বা চিত্ত সন্ততিতে সুপ্তাকারে সঞ্চিত। থাকে। যেমন, এই জন্মে পূর্বে ছিল না এমন কিছু কিছু উপসর্গ, রূপ, তীব্র ব্যাথা, বেদনা, দুঃখ, ভাবনাকালে প্রকাশ পেতে দেখা যায়।

                                                  ৩া ক্লেশ মার:

যার প্রভাবে কুশল কর্মে বাধা সৃষ্টি এবং জন্ম জন্মান্তরে সত্ত্বগণকে দুঃখ কষ্ট প্রদানে সহায়ক হয় তাকে ক্লেশ | বলে। ক্লেশ দশ প্রকার ও উপক্লেশ দশ প্রকার। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কুলষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রসহ, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে। এগুলাের দ্বারা মার-রূপে ধ্যানে বাধা সৃষ্টি হয় বলে এগুলােকে ক্লেশ মার বলে।

দশবিধ ক্লেশ—১. লােভ, ২. দ্বেষ, ৩. মােহ, ৪. মান, ৫. মিথ্যা দৃষ্টি, ৬. বিচিকিচ্ছা, ৭. ভ্যান-মিদ্ধ, ৮.ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য, ৯. আহ্ৰী, ১০. অনপত্রপা। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কলুষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে।

দশবিধ উপক্লেশ —১. ওভাস, ২. প্রীতি, ৩. প্রশ্রদ্ধি, ৪. অধিমােক্ষ ৫. প্রগ্রহ, ৬. সুখং, ৭. ঞানং, ৮. উপটঠানং, ৯. উপেক্ষা, ১০. নিন্তি।। ক্লেশ যেমন স্মৃতিভাবনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তদ্রুপ উপক্লেশও এক প্রকার বাধা যা ভাবনাকারীর চিত্ত উদিত হয়। এগুলাে চিত্তের কুশল সংস্কার জাত। এরা নানাবিধ আকারে সাধকের চিত্তে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। উপক্লেশ মুক্ত বিদর্শন জ্ঞানই প্রকৃত মার্গ।

                                                 ৪. স্কন্ধ মার:

স্বন্ধ অর্থে গুচ্ছ, পুঞ্জ, সমাহার বুঝায়। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে পঞ্চ স্কন্ধ বলা হয়। দৈনন্দিন কাজকর্মে মানুষের মাঝে কতগুলাে কুঅভ্যাস পরিলক্ষিত হয়, যেমন- অশােভনীয় কথাবার্তা বলা,হাত-পা নাড়া, মাথা দোলানাে, অহিরতা, চঞ্চলতার কারণে নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গি ইত্যাদি, এগুলাে সংগঠিত হয় শীল ভঙ্গের কারণে বা শীল সম্পর্কিত সচেতনার অভাবে। আরাে লক্ষ্য করা যায়, মাথা ব্যাথা, পেটের পীড়া, হাইতােলা, খিটখিটে মেজাজ, বদরাগী, হিংসুটে ইত্যাদি প্রকাশ পায়, কেহ কেহ পুণ্যময় কাজে | রত থাকে। স্মৃতি ভাবনা অনুশীলনের সময় এসব ভাল ও মন্দ স্বভাবগুলাে কায়, বাক্য ও মনে প্রসফুটিত হয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে এদেরকে স্কন্ধ মার বলে

                                           ৫. মৃত্যু মার :

মৃত্যু হচ্ছে কর্ম প্রবাহের সাময়িক বিরতী। মৃত্যু অর্থে অন্যস্হানে জন্ম নিদের্শ করে অর্থাৎ একস্হান হতে চ্যুত হয়ে অন্যসহানে উৎপত্তি বুঝায়। মৃত্যুকে এখানে মার বলা হয়েছে এ কারণে, ধ্যানী যখন অত্যন্ত একাগ্রতা ও গভীরভাবে ধ্যানানুশীলন করতে করতে ক্রমশঃ ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে থাকেন অর্থাৎ পরিকর্ম ধ্যান শেষ করে গােত্রভূ ধ্যানে প্রবেশ করেন, এমতাবস্হায় অনেক সময় ধ্যানীর আয়ুস্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়। এজন্য মৃত্যুকে মার রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। করণীয় কাজ সমাপনান্তে মৃত্যু বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

# তথ্যসূত্র ঃ-  মহামুনি সম্যক সম্বুদ্ধ (  http://ms-sambuddha.com )

error: Content is protected !!