পুরাকালে, বর্তমান সময়ের চাৰিকল্প পূর্বে বােধিসত্ব, সেরিব নামক রাজ্যে ফেরিওয়ালার কাজ করিতেন। তখন তাহার নাম ছিল সেরিবান। সেরিবরাজ্যে সেরিব নামে আরও এক ব্যক্তি ঐ কারবার করিত। উহার বড় অর্থলালসা ছিল। একদা বােধিসত্ত্ব তাহাকে সঙ্গে লইয়া তেলবাহনদের অপরপারে অন্ধপুরনগরে বাণিজ্য করিতে গিয়াছিলেন। সেখানে তাঁহারা কে কোন রাস্তায় ফেরি করিয়া বেড়াইবেন তাহা ভাগ করিয়া লইলেন; কথা হইল এক জন যে রাস্তায় এক বার ফেরি করিয়া গিয়াছেন, অপর জন তাহার পরে সেখানেও ফেরি করিতে পারিবেন। | অন্ধপুরে পূর্বে এক অতুলসম্পত্তিশালী শ্রেষ্ঠিপরিবার বাস করিত। কালে কমলার কোপে পড়িয়া তাহারা নিধন হয়, একে একে পুরুষেরাও মারা যায়। যে সময়ের কথা হইতেছে, তখন ঐ বংশে কেবল একটী বালিকা ও তাহার বৃদ্ধা পিতামহী জীবিত ছিলেন। তাহারা অতিকষ্টে প্রতিবেশীদিগের বাড়ীতে কাজকর্ম করিয়া দিনপাত করিতেন। বাড়ীর কৰ্ত্ত সৌভাগ্যের সময় যে সুবর্ণপাত্রে ভােজন করিতেন, সেটী তখনও ছিল; কিন্তু দীর্ঘকাল ব্যবহৃত না হওয়ায় এবং ভগ্নপত্রাদির মধ্যে পড়িয়া থাকায় উহার উপর এত ময়লা জমিয়াছিল, যে সহসা উহা সােণার বাসন বলিয়া বােধ হইত না। একদিন লােভী ফেরিওয়ালা কলসী কিনিবে”, “কলসী কিনিবে” বলিতে বলিতে | ঐ শ্ৰেষ্ঠীদিগের বাড়ীর পাশ দিয়া যাইতেছিল। তাহা শুনিয়া বালিকাটা বলিল, আমায় একখানা গহনা কিনিয়া দাওনা, দিদিমা।” দিদিমা বলিলেন, “বাছা, আমরা গরিব লােক, পয়সা পাইব কোথায় ?” তখন বালিকা সেই সােণার বাসনখানি আনিয়া বলিল, “এইখানা বদল দিলে হয় না কি? ইহা ত আমাদের কোন কাজে লাগে না।” বৃদ্ধা ইহাতে আপত্তি করিয়া ফেরিওয়ালাকে ডাকিলেন এবং তাহাকে বসিতে বলিয়া বাসনখানি দিয়া বলিলেন, “মহাশয়, ইহার বদলে আপনার এই বােটীকে যাহা হয় একটা জিনিস দিন।” | বাসনখানি দুই একবার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া ফেরিওয়ালার সন্দেহ হইল, সম্ভবত উহা স্বর্ণনির্মিত। এই অনুমান প্রকৃত কি না তাহা পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত সে সূচী দিয়া উহার পিঠে দাগ কাটিল এবং উহা যে সােণার বাসন সে সম্বন্ধে তখন আর তাহার কিছুমাত্র সংশয় রহিল না। কিন্তু মেয়েমানুষ দুইটাকে ঠকাইয়া ইহা বিনামূল্যে লইব, এই দুরভিসন্ধি করিয়া সে বলিল, “ইহার আবার দাম কি ? ইহা সিকি পয়সায় । কিনিলেও ঠকা হয় * অনস্তর সে নিতান্ত অবজ্ঞার ভাণ করিয়া বাসনখানি ভূমিতে ফেলিয়া সে স্থান হইতে চলিয়া গেল। ইহার ক্ষণকাল পরেই বােধিসত্ত্ব সেই পথে ফেরি করিতে আসিলেন এবং “কলসী কিনিবে”, “কলসী কিনিবে” বলিতে বলিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে লাগিলেন। তাহা শুনিয়া বালিকাটী তাহার পিতামহীকে আবার সেই প্রার্থনা জানাইল। বৃদ্ধা কহিলেন, “যে বাসন বদল দিতে গিয়াছিলে তাহার ত কোন দামই নাই শুনিলে। আমাদের আর কি আছে, বােন, যাহা দিয়া তােমার সাধ পুরাইতে পারি ? ”বালিকা কহিল, “সে ফেরিওয়ালা বড় খারাপ লােক, দিদিমা। তাহার কথা শুনিলে গা জ্বালা করে। কিন্তু এ লােকটী দেখত কত ভাল, ইহার কথাও কেমন মিষ্ট। এ বােধ হয় ঐ ভাঙ্গা বাসন লইতে আপত্তি করিবে না।” তখন বৃদ্ধা বােধিসত্ত্বকে ডাকাইয়া বসিতে বলিলেন এবং বাসনখানি তাঁহার হাতে দিলেন। বােধিসত্ত্ব দেখিবামাত্রই বুঝিলেন উহা সুবর্ণনির্মিত। | তিনি বৃদ্ধাকে সম্বােধন করিয়া বলিলেন, “মা, এ বাসনের দাম লক্ষমুদ্রা। আমার নিকট এত অর্থ নাই।” | বৃদ্ধা কহিলেন, “মহাশয়, এই মাত্র আর একজন ফেরিওয়ালা আসিয়াছিল। সে বলিল ইহার মূল্য সিকি পয়সাও নহে। বােধ হয় আপনার পুণ্যবলেই বাসনখানি এখন সােণা হইয়াছে। আমরা ইহা আপনাকেই দিব; ইহার বিনিময়ে আপনি যাহা ইচ্ছা দিয়া যান।” বােধিসত্বের নিকট তখন নগদ পাঁচ শ কাহণ * এবং ঐ মূল্যের পণ্যদ্রব্য ছিল। তিনি ইহা হইতে কেবল নগদ আট কাহণ এবং দাঁড়িপাল্লাও থলিটা লইয়া অবশিষ্ট সমস্ত বৃদ্ধার হস্তে অর্পণ করিলেন এবং তাহার অনুমতি লইয়া বাসন খানি গ্রহণ করিয়া যত শী পারিলেন নদীতীরে উপস্থিত হইলেন। সেখানে একখানি নৌকা ছিল। তিনি ইহাতে আরােহণ করিয়া মাঝির | হাতে আট কাহণ দিয়া বলিলেন, “আমাকে শীঘ্র পার করিয়া দাও।”এদিকে লােভী বণিক শ্ৰেষ্ঠীদিগের গৃহে ফিরিয়া বাসনখানি আবার দেখিতে চাহিল। সে বলিল, “ভাবিয়া দেখিলাম তােমাদিগকে ইহার বদলে একেবারে কিছু না দিলে ভাল দেখায় না।” তাহা শুনিয়া বৃদ্ধা কহিলেন, “সে কি কথা, বাপু? তুমি না বলিলে উহার দাম সিকি পয়সাও নয়! এই মাত্র একজন সাধু বণিক আসিয়াছিলেন। বােধ হয় তিনি তােমার মনিব হইবেন। তিনি আমাদিগকে হাজার কাহণ দিয়া উহা কিনিয়া লইয়া গিয়াছেন।” এই কথা শুনিবামাত্র সেই লােভী বণিকের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে পাগলের মত ছুটাছুটি করিতে লাগিল; সঙ্গে যে সকল মুদ্রা ও পণ্যদ্রব্য ছিল তাহা চারিদিকে ছড়াইয়া ফেলিল। অনন্তর উলঙ্গ হইয়া, “হায়, সর্বনাশ হইয়াছে, দুরাত্মা ছল করিয়া আমার লক্ষ মুদ্রার সুবর্ণ পাত্র লইয়া গিয়াছে,” এইরূপ প্রলাপ করিতে করিতে এবং তুলাদণ্ডটী মুদগরের ন্যায় ঘুরাইতে ঘুরাইতে সে বােধিসত্বের অনুসন্ধানে নদীতীরে ছুটিল। সেখানে গিয়া দেখে নৌকা তখন নদীর মধ্যভাগ পর্যন্ত গিয়াছে। সে “নৌকা ফিরাও” “নৌকা ফিরাও” বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল; কিন্তু বােধিসত্ত্ব নিষেধ করায় মাঝি নৌকা ফিরাইল না। বােধিসত্ত্ব অপর পারাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন ; দুষ্টবুদ্ধি বণিক একদৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া।রহিল ; অনন্ত, সূর্যের তাপে জলহীন তড়াগের তলদেশস্থ কর্দম যেমন শতধা বিদীর্ণ হয়, দারুণ যন্ত্রণায় তাহার হৃৎপিণ্ডও সেইরূপ বিদীর্ণ হইল; তাহার মুখ দিয়া রক্ত উঠিতে লাগিল এবং সেই মুহূর্তেই সে প্রাণত্যাগ করিল। ইহার পর বােধিসত্ত্ব দানাদি সৎকার্যে জীবন | যাপন করিয়া কৰ্ম্মফলভােগের জন্য লােকান্তর গমন করিলেন।এইরূপে অহৰ লাভের উপায় প্রদর্শন করিয়া শান্তা সত্যচতুষ্টয় ব্যাখ্যা করিলেন; তাহা শুনিয়া সেই হীনৰীৰ্য্য ভিক্ষু অহরূপ সর্বোত্তম ফল প্রাপ্ত হইলেন। সমবধান তখন দেবদত্ত * ছিল সেই ধূর্ত বণিক, এবং আমি ছিলাম সেই সুবুদ্ধি ও ধর্মপরায়ণ বণিক।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

error: Content is protected !!