পুরাকালে বারাণসী-রাজ ব্ৰহ্মদত্ত একদিন উদ্যানবিহারে গিয়াছিলেন। সেখানে তিনি ফলপুস্পাদির আহরণের নিমিত্ত ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছেন, এমন দেখিতে পাইলেন, একটী রমণী গান করিতে করিতে কাষ্ঠসংগ্রহ করিতেছে। ব্ৰহ্মদত্ত তাহার রূপে মুগ্ধ হইয়া তদ্দণ্ডেই তাহাকে গান্ধৰ্ববিধানে বিবাহ করিলেন। অনন্তর বােধিসত্ত্ব এই রমণীর গর্ভে প্রবেশ করিলেন। ‘রমণীকে গর্ভবতী জানিয়া রাজা তাহার হস্তে স্বনামাঙ্কিত একটী অঙ্গুরী দিয়া বলিলেন, “যদি কন্যা প্রসব কর, তবে ইহা বিক্রয় করিয়া তাহার ভরণ পোেষণ করিবে ; আর যদি পুত্র প্রসব কর, তবে তাহাকে এই অঙ্গুরিসহ আমার নিকট লইয়া যাইবে।রমণী যথাকালে বােধিসত্ত্বকে প্রসব করিল। বােধিসত্ত্ব যখন ছুটাছুটি করিতে শিখিয়া পাড়ার ছেলেদের সহিত খেলা আরম্ভ করিলেন, তখন অনেকে তাঁহাকে “নিষ্পিতৃক” বলিয়া উপহাস করিতে লাগিল। কেহ বলিত “দেখ, নিম্পিতৃক আমাকে মারিয়া গেল,” কেহ বলিত, “নিষ্পিতৃক আমাকে ধাক্কা দিল।” ইহাতে বােধিসত্বের মনে দারুণ আঘাত লাগিল। তিনি একদিন জননীকে জিজ্ঞাসিলেন, “আমার বাবা কে, মা ? রমণী বলিল, “বাছা, তুমি রাজার ছেলে।” “আমি যে রাজার ছেলে তাহার প্রমাণ কি, মা ?” “বাছা, রাজা যখন আমায় ছাড়িয়া যান, তখন এই অঙ্গুরি দিয়া গিয়াছিলেন। ইহাতে তাহার নাম আছে। তিনি বলিয়াছিলেন, যদি কন্যা জন্মে, তবে ইহা বেচিয়া তাহার ভরণ পােষণ করিবে, আর যদি পুত্র জন্মে, তবে অঙ্গুরিসহ তাহাকে আমার নিকট লইয়া যাইবে।”“তবে তুমি আমাকে বাবার কাছে লইয়া যাওনা কেন?” রমণী দেখিল, বালক পিতৃদর্শনের জন্য কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে। সুতরাং সে তাহাকে লইয়া রাজভবনে উপনীত হইল এবং রাজাকে আপনাদের আগমনবার্তা জানাইল। অনন্তর রাজসকাশে যাইবার অনুমতি পাইয়া সে সিংহাসনপার্শ্বে গিয়া প্রণিপাতপূৰ্ব্বক বলিল, “মহারাজ, এই আপনার পুত্র।” সভার মধ্যে লজ্জা পাইতে হয় দেখিয়া, রাজা প্রকৃত বৃত্তান্ত জানিয়াও না জানার ভাণ করিলেন। তিনি বলিলেন “সে কি কথা? এ আমার পুত্র হইবে কেন?” রমণী কহিল, “মহারাজ, এই দেখুন আপনার নামাঙ্কিত অঙ্গুরি। ইহা দেখিলেই বালক কে জানিতে  পারিবেন।” রাজা এবারও বিস্ময়ের চিহ্ন দেখাইয়া বলিলেন, “এ অঞ্চুরি ত আমার নয়।” তখন রমণী নিরুপায় হইয়া বলিল, “এখন দেখিতেছি, একমাত্র ধর্ম ভিন্ন আমার আর কোন সাক্ষী নাই। অতএব আমি ধর্মের দোহাই দিয়া বলিতেছি, যদি এ বালক প্রকৃতই আপনার পুত্র হয়, তবে যেন এ মধ্যাকাশে স্থির হইয়া থাকে, আর যদি আপনার পুত্র না হয়, তবে যেন ভূতলে পড়িয়া বিনষ্ট হয়।” ইহা বলিয়া সে দুই হাতে বােধিসত্ত্বের দুই পা ধরিল এবং তাঁহাকে ঊর্ধদিকে ছুড়িয়া দিল। | বােধিসত্ত্ব মধ্যাকাশে উঠিয়া বীরাসনে উপবেশন করিলেন এবং মধুর স্বরে ধর্মকথা বলিতে বলিতে এই গাথা পাঠ করিলেন; আমি তব পুত, শুন মহারাজ, ধর্মপত্নীগর্ভজাত ; পােষণের ভার লও হে আমার, এ মিনতি করি, তাত। কত শত জন ভরণ-পােষণ লভে নৃপতির ঠাই ; তাঁহার তনয় যেই জন হয়, তার ত কথাই নাই। আকাশ বােধিসত্বের মুখে এই ধর্ম-সঙ্গত বাক্য শুনিয়া রাজা বাহুবিস্তার পূর্বক বলিলেন, “এস, বৎস, এস ; এখন অবধি আমিই তােমার ভরণ পােষণ করিব।” তাহার দেখাদেখি আরও শত শত লােকে বােধিসত্বকে ক্রোড়ে লইবার জন্য বাহু তুলিল, কিন্তু বােধিসত্ত্ব রাজারই বাহুযুগলের উপর অবতরণ করিয়া তাহার ক্রোড়ে উপবেশন করিলেন। রাজা তাহাকে ঔপরাজ্যে নিযুক্ত করিলেন এবং তাহার জননীকে মহিষী করিলেন। কালক্রমে রাজার যখন মৃত্যু হইল, তখন বােধিসত্ত্ব “মহারাজ কাষ্ঠবাহন” এই উপাধি গ্রহণপূর্বক সিংহাসনারােহণ করিলেন এবং দীর্ঘকাল যথাধর্ম রাজ্যশাসন করিয়া কৰ্ম্মানুরূপ ফলভােগাৰ্থ লােকান্তরে চলিয়া গেলেন। 

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

error: Content is protected !!