২৭ শে ডিসেম্বর ৯৩ ইং রাত ৮টা। শ্রদ্ধেয় বনভান্তে উপোসথ পালনকারীদের প্রতি ধর্মদেশনা দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক যুবক ভিক্ষু কাঁদতে কাঁদতে বন্দনা করলেন। বনভান্তে জিজ্ঞাসা করলেন- কি হলো তোমার? কোন অসুখ হয়েছে নাকি? অন্য ভিক্ষু বললেন- ভান্তে, তার ভাই এসেছে। তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে হচ্ছে।এবার আমাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন- সে প্রথমেই পরীক্ষায় ফেল করে ফেললো। নির্বাণ লাভ করার আগে কি কাজ করতে হবে জান? প্রথমেই দশবিধ বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। দশবিধ বন্ধন হল- মা, বাপ, ভাই, বোন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আধিপত্য, লাভ-সৎকার ও দেশ। এগুলির মায়া-মমতা ত্যাগ করা মহাকঠিন ব্যাপার। তিনি নিজেকে উদাহরণ দিয়ে বলেন- আমি যদি এগুলি ছিন্ন না করতাম আজকে তোমাদের মধ্যে এমন থাকতাম না। অন্যান্য লোকের মত নানাবিধ দুঃখ কষ্টের মধ্যে কাল যাপন করতে হতো।ভগবান বুদ্ধ শাক্য রাজ্যের সিংহাসন, বিপুল ধন, ঐশ্বর্য, মায়ার বন্ধন রাহুল ও গোপাকে ছেড়ে নির্বাণের পথে ধাবিত হয়েছিলেন। এগুলিকে তুচ্ছ, হীন, দুঃখ ও অসার মনে করেছিলেন।দশবিধ বন্ধন ছিন্ন করলে শুধু চুপ করে বসে থাকলে হবে না। কামজয় করতে হবে। কামজয়ের মধ্যে প্রথমে নারীর প্রতি আসক্তি ত্যাগ। দ্বিতীয়তঃ পঞ্চ ইন্দ্রিয় সংযম করতে হবে। রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শের প্রতি সর্বদা অনাসক্তভাবে থাকতে হবে। তিনি জোড় তিয়ে বলেন- নারী-পুরুষ ও পঞ্চকাম হতে অনন্ত দুঃখের সৃষ্টি হয়। সামান্য ইতর প্রাণী হতে দেব ব্রহ্মা পর্যন্ত হয়। আবার দেব ব্রহ্মা হতে নীচতর প্রাণী হওয়া কত যে দুঃখ কষ্ট সহিতে হয় তার কোন পরিসমাপ্তি নেই। কামজয় হলে মুক্তির পথ আরো একটু সুগম হয়।পাঁচ প্রকার মার- ক্লেশমার, স্কন্ধমার, অভিসংস্কারমার, মৃত্যুমার ও দেবপুত্রমার। এগুলিকে জয় করতে না পারলে মুক্তির পথ বন্ধ থাকে। দেবপুত্র মার সম্বন্ধে তিনি নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলেন- “হে সিদ্ধার্থ, মায়ার বন্ধন রাহুল- গোপাকে ফেলে তুমি চোরের মত পালিয়ে এসেছ”। পুনরায় ফিরে যাও বাড়িতে। দেবপুত্র মার স্বয়ং সম্যক সম্বুদ্ধকে পর্যন্ত বিভিন্ন বাঁধার সৃষ্টি করেছিল। অন্যলোকের কথায় বা কি?তিনি বলেন- নিজেকে যে জয় করেছে সেই প্রকৃত জয়ী। নিজ কি? আমি কি? কেউ কেউ বলে রামচন্দ্র, শ্যামচন্দ্র প্রভৃতি থেকে নিজ বা আমি’র উৎপত্তি। কেউ কেউ বলে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান হতে নিজ বা আমি’র উৎপত্তি। সাধারণের মতে আমি সত্য, স্থায়ী ও ধ্বংস হয় না। জন্মে জন্মে ঘুরে ঘুরে থেকে যায়। তাদের মতে এগুলিকে আত্মাও বলে।শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- এগুলির সমন্বয়ে নিজ, আমি ও আত্মার সৃষ্টি হয়। তা কিছু নয়। যেখানে আমি’র উৎপত্তি সেখানে অহংকারের (মান) উৎপত্তি, মান উৎপত্তি হলে ধর্মচক্ষু ও ধর্মজ্ঞান উৎপত্তি হয় না। তারা জন্মান্ধ। জন্মান্ধ ব্যক্তি যা ধারণা করে তা মুখে ব্যক্ত করে। তা আবার সত্যেও পরিণত করতে চায়।মান সাধারণতঃ তিন প্রকার। আমি শ্রেষ্ঠ, আমি সমান ও আমি অধম। আবার এগুলিকে তিনগুণ করলে নয় প্রকার হয়। এ নয় প্রকার মান এর জন্যে মানুষ জন্মে জন্মে মুক্তি পায় না।তিনি দেশনায় বলেন- এগুলি আমি নয়, আমার নয় ও আমার আত্মাও নয়। শুধু ভ্রান্ত ধারণা। অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এ মান অনাগামী পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। অতএব মান জয় করাই প্রকৃত জয় ও পরম সুখ।তিনি উপসংহারে বলেন- মনুষ্য জন্মে যে দু’টির মধ্যে একটিও লাভ করতে পারবেনা তার জন্ম বৃথা। প্রথমটি হল বুদ্ধ অথবা বুদ্ধের প্রতিনিধির সাক্ষাৎ লাভ এবং অন্যটি হল চারি আর্যসত্য লাভ।
#লেখাটি কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে
Subrata Barua