এক সময় শ্রদ্ধেয় বনভান্তে নিজ আবাসিক ভবনে ভিক্ষুসঙ্ঘকে দেশনা প্রদান করছিলেন। তিনি প্রথমেই বলেন—ভিক্ষুদের যতদিন চারি আর্যসত্য জ্ঞান লাভ না হয় ততদিন তারা আপত্তিগ্রস্ত হবে। আপত্তি ভেদে নানাবিধ বিনয়কর্মও করতে হয় তাদেরকে। মনে রাখবে, পাপকর্মের মধ্যে মনচিত্ত থাকলে এবং পাপকে সুখ বলে মনে করলে আপত্তিগ্রস্ত হতে হয়। মনচিত্তে যদি অকুশল, পাপ চেতনা না থাকে তাহলে আপত্তিমুক্ত হওয়া যায়। আবার, নিত্য আপত্তিগ্রস্ত হলে তার প্রতিকার স্বরূপ বিনয় করতে করতেই তো জীবন শেষ হয়ে যাবে। তাই তোমরা চারি আর্যসত্য জ্ঞান জানতে, হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টাশীল হও। তাহলে আপত্তিগ্রস্ত হবে না এবং তার প্রতিকার স্বরূপ নিত্য বিনয় কর্মও করতে হবে না। এটাই যথাযথ নিরাপদ ব্যবস্থা। আর এভাবে প্রকৃত সুখ লাভ হয়। আপত্তিগ্রস্ত হওয়াকে দুঃখ বলে জানবে। অতিসত্বর সে দুঃখ ত্যাগ করতে চেষ্টাশীল হও। বুদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘকে কামসুখ ও আত্মপীড়ন অনুশীলন না করে শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা বা মধ্যম পথ অবলম্বন করে অবস্থান করতে শিক্ষা দিয়েছেন। কামসুখ, আত্মপীড়ন হীন, দুঃখ, অনার্য, পাপজনক এবং সত্য জ্ঞান লাভের প্রতিকুল অবস্থা। তাই বলা হয়েছে কামসুখ, আত্মপীড়নের দ্বারা পাপই উৎপন্ন হয়, দুঃখ সৃষ্টি হয়, এবং অজ্ঞানতা বৃদ্ধি পায়। কামসুখ, আত্মপীড়ন ত্যাগ করতে না পারলে দিন দিন অবিদ্যা, তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাবে। আর সে অবিদ্যা, তৃষ্ণার কারণে অজ্ঞান, অকুশলমূলক কর্মের দিকে মনচিত্ত ধাবিত হয়। তাই কামসুখ, আত্মপীড়ন দুঃখমুক্তি নির্বাণ লাভের প্রধান অন্তরায়। পক্ষান্তরে সে দুই অন্ত অনুশীলন না করলে পুণ্য-সুখ বৃদ্ধি পায়, ভ্রান্ত ধারণা দূর হয়ে জ্ঞান ভাবিত, বর্দ্ধিত, বহুলীকৃত হয় এবং দুঃখমুক্তি নির্বাণ লাভ করা সম্ভব হয়।

তোমরা কামসুখ ত্যাগ করতঃ নিষ্পাপ ব্রহ্মচর্য আচরণ কর। নিষ্পাপ ব্রহ্মচর্য আচরণ দ্বারা অনবদ্য সুখ লাভ হয়ে থাকে। কখনো শিথিলভাবে ব্রহ্মচর্য আচরণ করবে না। শিথিলভাবে ব্রহ্মচর্য আচরণ করলে সুফলের পরির্বতে কুফলই প্রদান করবে। দুগ্রহীত কুশতৃণ যেমন হস্তকে কর্তন করে তেমনি শিথিলভাবে আচরিত ব্রহ্মচর্য জীবনকে অধিকতর কলঙ্কিত করে। আর এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, পৃথিবীতে কোন কলুষিত ব্রতই মহৎ ফলপ্রসু হয় না। তাই শিথিলভাবে আচরিত ব্রহ্মচর্য আসক্তি প্রবৃত্তির দিকে বেশি আকর্ষণ করে থাকে।

‘আমি মানুষ’ এ ধারণা, ‘সে পুরুষ’ এ ধারণা, ‘সে মহিলা’ এ ধারণা পোষণ করে অবস্থান করো না। এ ধারণাসমূহ সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভ্রান্ত দর্শন মাত্র। পঞ্চস্কন্ধকে (শরীর) যদি বিভেদ করে দর্শন করা হয়, তাহলে সেখানে কোন ‘মানুষ-পুরুষ-মহিলা’ বা কোন সত্ত্বের অস্তিত্ব মিলে না। তাই ‘মানুষ-পুরুষ-মহিলা’ এ ধারণাসমূহের অস্তিত্ব খোঁজাকে অজ্ঞানতা বশতঃ মিথ্যা ধারণা বলা যায়। এতে শুধুমাত্র অজ্ঞান, মিথ্যাদৃষ্টি উদয় হয় ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। অজ্ঞান, মিথ্যাদৃষ্টি হতে বিবিধ দুঃখের উৎপত্তি। তোমাদের মনচিত্তে যদি অজ্ঞান, মিথ্যাদৃষ্টি উদয় হয়ে থাকে, তাহলে তোমাদেরকে দুঃখই পেতে হবে। তোমরা ‘আমি মানুষ’, ‘সে পুরুষ’, ‘সে মহিলা’ এ ধারণাসমূহ ত্যাগ করতঃ অজ্ঞান, মিথ্যাদৃষ্টি বিদূরীত করে প্রকৃত সদ্ধর্ম অনুশীলন কর।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন—সদ্ধর্ম আচরণ করতঃ পরধর্ম ত্যাগ কর। এবং পরকাজ ত্যাগ করে নিজকাজে প্রতিষ্ঠিত থাক। সেই সদ্ধর্ম কি? মার্গফল নির্বাণ সাক্ষাৎ করাকে সদ্ধর্ম বলে। আর স্বর্গ, ব্রহ্ম লাভ করার তাগিদে যে সমস্ত পুণ্যকাজ করা হয় তা’ পরধর্ম বলে জানবে। মার্গফল নির্বাণ ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম পুণ্য করাকে পরধর্মের মধ্যে অন্তর্গত করা যায়। জ্ঞানের সহিত অবস্থান করাকে নিজকাজ, অজ্ঞানের বশীভূত হয়ে অবস্থান করাকে পরকাজ বলে। অজ্ঞানীরা সব সময় পরধর্ম, পরকাজসমূহ করে থাকে, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিগণ সদ্ধর্ম অনুশীলন ও নিজকাজ সম্পাদন করে থাকে। আমি তো দেখতেছি যে, বর্তমানে প্রায় সবাই পরধর্ম, পরকাজ করতেই ব্যস্ত। পরকাজ, পরধর্মের মধ্যে তারা সুখ, আনন্দ, উলস্নাসের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। কিন্তু তাদের সে সুখ, আনন্দ, উলস্নাস একদিন মিথ্যা হয়ে যাবে। তাদেরকে পরকাজ, পরধর্ম করার মাশুল দিতে হবে—দুঃখ, কষ্টেভরা হাহাকার হৃদয়ে। পরধর্ম, পরকাজ সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও মরুভূমিতে সৃষ্ট মরীচিকা জালের ন্যায় সুখ ভ্রম দৃষ্ট হয় যায়। তোমরা সাধারণ জ্ঞান বাদ দিয়ে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন করতে চেষ্টাশীল হও। সে অসাধারণ জ্ঞান হল চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি জ্ঞান, আসবক্ষয় জ্ঞান। এসব জ্ঞানের দ্বারা পরধর্ম, পরকাজ করা বন্ধ হয়ে যায়, প্রকৃত সুখ লাভ হয়।

বৌদ্ধধর্ম মতে বি, এ পাশ, এম, এ পাশ, ডক্টরেট ডিগ্রীধারীদেরকে প্রকৃত শিক্ষিত বলা চলে না। যারা সপ্তত্রিংশ বোধিপক্ষীয় ধর্ম সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জ্ঞান লাভ করেছেন একমাত্র তারাই প্রকৃত শিক্ষিত। সে বোধিপক্ষীয় ধর্মসমূহ কি? চারি স্মৃতিপ্রস্থান, চারি সম্যক প্রধান, চারি ঋদ্ধিপাদ, পঞ্চেন্দ্রিয়, পঞ্চ বল, সপ্ত বোধ্যঙ্গ, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এ সকল বোধিপক্ষীয় ধর্মসমূহ জানতে, বুঝতে সক্ষম হলে অসাধারণ জ্ঞান অর্জন হয়। এসব ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ হলে অজ্ঞান বিদ্যমান থাকতে পারে না। অজ্ঞান বিদ্যমান না থাকলে প্রব্রজিত জীবন সুখে, শান্তিতে অতিবাহিত করা যায়। কিন্তু বোধিপক্ষীয় ধর্মসমূহ সম্বন্ধে অজ্ঞান হলে প্রব্রজিত জীবন দুর্বিষহ দুঃখে ভবে উঠে। এমন কি প্রব্রজিত জীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হতে হয়। আমি অনেক ভিক্ষুকে বলতে শুনেছি-‘খুব কষ্ট পাচ্ছি, মরে যেতে পারতাম ভালো হতো।’ এটা থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে যে, বর্তমানে অনেক ভিক্ষু বোধিপক্ষীয় ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞ। যেমন, বৃক্ষ্জিৎ, অক্ষ্রানন্দ তারাও বোধিপক্ষীয় ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল বিধায় বর্তমানে সংসারী হয়েছে। বর্তমান ভিক্ষুদিগের আচার-আচরণ অনুসারে আমি তিনভাগে ভাগ করে থাকি। যথা—১) কেহ প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে বিয়ে করতঃ সাধারণ সংসারী হয়ে যায়। ২) কেহ প্রব্রজিত অবস্থায় নারীর সাথে প্রেম করতঃ সে নারীকে নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। আর শেষে প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে। ৩) কেহ প্রব্রজিত জীবন ত্যাগ করে না .

# # লেখাটি Rony barua  Rony Barua কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে । 

 

error: Content is protected !!