রবিবার ১৪ই জুলাই ১৯৯৬ ইংরেজী। বর্ষাবাসের দ্বিতীয় উপোসথ অমবস্যার রাত। বন্দনার পর সমবেত উপাসক-উপাসিকারা সহ আমি (সংকলক) শ্রদ্ধেয় বনভান্তেকে বন্দনা করার জন্য তাঁর ধ্যান কুঠিরের উপরের তলাই যাই।
প্রথমেই শ্রদ্ধেয় বনভান্তে আমাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন- তোমরা শীলবান, প্রজ্ঞাবান ও ধার্মিক হও। উদাহরণ দিয়ে বলেন- জনৈক হিন্দু ভদ্রলোক আমার নিকট এসে প্রশ্ন করলেন- দুঃখ মোচন হবে কবে? আমি বললাম-
চক্ষু মুদি অবিরাম জপে শুধু হরিনাম
কাম্যসুখ ভোগ মত্ত মন,
সত্যভাব যতদিনে না উদিবে তব মনে
ভব দুঃখ হবেনা মোচন।
নাই জীবে ভাই ভাই হিংসা, দ্বেষ শুধু তাই
ত্রিলক্ষণে নাই যার জ্ঞান,
অন্তরেতে অহংকার মুখে শুধু হরিনাম সার
কিছুতেই নাই তার ত্রান।
এ আট লাইন কবিতা বলার পর তিনি পরমার্থ ভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন- তোমরা পরধর্ম কর না। পরধর্ম পাপ, দুঃখ ও মুক্ত নয়। মিথ্যা ধর্ম পাপ, দুঃখ ও মুক্ত নয়। তোমরা নিজ ধর্ম কর। নিজ ধর্মে পূণ্য, সুখ ও মুক্ত হয়। নিজ ধর্ম, সত্য ধর্ম ও খাঁটি ধর্ম হল লোভ, দ্বেষ ও মোহ শূণ্য। লোভ, দ্বেষ ও মোহ মুক্ত হতে হলে আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ পথে চলতে হবে। তাতেই তোমাদের পূণ্য অর্জন, নানাবিধ দুঃখ হতে পরিত্রান ও চিত্তে অনাবিল সুখ বয়ে আনবে। তোমরা নকল হতে সাবধান থাক। ভেজালে যেয়ো না। খাঁটি বৌদ্ধ ধর্মে গন্ডগোল, ভেজাল, আবোল-তাবোল নেই।
তিনি বলেন- চারি প্রত্যয় পেলে ভিক্ষুদের সুখ হয়। তারা কাম ত্যাগ, রূপ ত্যাগ ও বেদনা ত্যাগ করতে পারলে অনন্ত সুখের অধিকারী হয়ে বিমুক্তি সুখে অবস্থান করে। যারা কামের আস্বাদ গ্রহণ করে, রূপের আস্বাদ গ্রহণ করে ও বেদনার আস্বাদ গ্রহণ করে তারা কখনো সুখী হতে পারে না। সুখী হতে হলে অতীতের পূণ্য পারমী, ইহ জন্মের প্রচেষ্ঠা ও সৎ গুরুর উপদেশ দরকার। বর্তমানে আচরণ নেই বলে প্রায় লোকেরা ব্যর্থ হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন- আমার যথেষ্ঠ হয়েছে, চারি প্রত্যয়, সুযোগ-সুবিধা, ধ্যান কুঠির, সৌচাগার, স্নানাগার এবং ধর্ম প্রচারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সদ্ধর্ম থাকলে সকলে দান দিবে। পরধর্ম করলে কেউ দেবে না। ডঃ শরনাংকর ভিক্ষু বলেছেন বনভান্তে না থাকলে অথবা মরে গেলে তাঁর শিষ্যদেরকে কিছু দেবে না। শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। যদি তারা ত্যাগ করে সদ্ধর্ম হারা না হয় নিশ্চয়ই সকল সুযোগ-সুবিধা পাবে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- লেখাপড়াও এক প্রকার শত্রু। এম. এ. পাশ করলে শুধু ভাত খেতে পারে। কেননা, তারা সারা জীবন চাকুরী বা ব্যবসা বাণিজ্য করে সময় অতিবাহিত করে। আবার অন্যদিকে দেখা যায় এম. এ. ডিগ্রী নিয়ে অর্হত্বফল লাভ করতে পারলে তাঁর ডিগ্রী ধ্বংস হবে না। আমি যেভাবে অভিজ্ঞা দ্বারা ব্যক্ত করতে পারি সেরকম সবাই যদি সচেষ্ঠ হয় নিশ্চয়ই ফলপ্রসূ হতে পারবে। ভিক্ষু শীলবান, প্রজ্ঞাবান ও ধার্মিক হলে স্বর্গের দেবতারাও সাহায্য করে। পৃথিবীতে যেমন তোমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম ও খ্রিষ্টান আছ তেমন স্বর্গেও হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম ও খ্রিষ্টান দেবতারা আছেন। তাঁরা সৎকর্ম ও শীল পালন করে স্বর্গে গিয়েছেন। হিন্দু দেবতারা হিন্দুদেরকে, বৌদ্ধ দেবতারা বৌদ্ধদেরকে, মুসলিম দেবতারা মুসলিমদেরকে ও খ্রিষ্টান দেবতারা খ্রিষ্টানদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকেন। কিন্তু বৌদ্ধ দেবতারা অন্যদের তুলনায় উজ্জ্বল ও শান্ত। তাদের নিকট অন্যান্যদের চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ আছে। দেবতাদের ধন সম্পদ গুলির তুলনায় মনুষ্যের ধন সম্পদ অতি নগণ্য। তারা অনেক সময় শীলবানদেরকে আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করেন। মনুষ্য লোকে, স্বর্গে ও ব্রহ্মলোকে যা ধন সম্পদ আছে তদ্ অপেক্ষা ভগবান বুদ্ধের ধন সম্পদ অনেক অনেক বেশী। তা তুলনা করা যায় না। বনভান্তে প্রমাণ করতে চান বৌদ্ধ ধর্মে কি আছে? কতটুকু গুণ আছে? কতটুকু সম্পদ আছে? কিন্তু বনভান্তে কাহারো নিকট কিছু খোঁজেন না। মধ্যে মধ্যে শুধু ইট, সিমেন্ট, লোহা ও বালির কথা বলেন।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে আরো বলেন- তোমরা শীল পালন কর, ইন্দ্রিয় সংযম কর, ভোজনে মাত্রা জ্ঞান হও এবং সর্বদা জাগ্রত থাক। তাতে তোমাদের লোকোত্তর সুখ, মার্গসুখ ও ফলসুখ লাভ হবে এবং দুঃখ হতে মুক্তি পাবে। তাতে তোমাদের নিচে পড়ার বা দুঃখে পড়ার আশংকা থাকবে না। অবশ্য এতে তোমাদের উৎসাহ ও অধ্যবসায় থাকা চাই।
পরিশেষে তিনি বলেন- শাস্ত্রে আছে গাধার ৩টি গুণ। তারা অতিরিক্ত শীত সহ্য করে, অতিরিক্ত গরমও সহ্য করে এবং নিরলসভাবে ভার বহন করতে পারে। তোমরাও গাধার ৩টি গুণ সংগ্রহ করে তোমাদের অগ্রগতির দিকে অগ্রসর হও।
#লেখাটি Subrata Barua কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ।