অন্যায়,অপরাধ,ভুল,দোষ ও গলদ করো না- ত্রিরত্ন ডট কম

অন্যায়,অপরাধ,ভুল,দোষ ও গলদ করো না- ত্রিরত্ন ডট কম

১লা এপ্রিল ১৯৯৪ ইংরেজী রোজ শুক্রবার। ট্রাইবেল অফিসার্স কলোনী, রাঙ্গামাটি। সার্বজনীন সংঘদান ও অষ্ট পরিষ্কার দান উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সশিষ্যে শুভ আগমন। বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করেন বাবু বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা। উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন বাবু রনজিত দেওয়ান। পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন বাবু প্রগতি রঞ্জন খীসা। অনুষ্ঠানের আহবায়ক বাবু যামিনী কুমার চাকমা ও পরিচালনা করেন শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার ভিক্ষু।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সকাল ১০টা ২০ মিনিট হতে ১০টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ধর্মদেশনা প্রদান করেন। তিনি প্রথমেই বলেন- শ্রদ্ধার সহিত ধর্ম কথা বা ধর্ম দেশনা শ্রবণ, গ্রহণ, ধারণ ও আচরণ করতে হয়। তাতে শ্রোতার অনেক ফল লাভ হয়। শ্রদ্ধা দু’প্রকার। লৌকিক ও লোকোত্তর। ত্রিরত্ন, কর্ম ও কর্মফলকে বিশ্বাস করলে লৌকিক শ্রদ্ধা হয়। ইহকাল-পরকাল ও চারি আর্যসত্যকে বিশ্বাস করলে লোকোত্তর শ্রদ্ধা হয়। অশ্রদ্ধার সহিত ধর্মদেশনা শ্রবণ করলে কোন ফল হয় না।

মনুষ্য ধর্ম পাপ মুক্ত নয় ও দুঃখ। প্রথম সত্য ও দ্বিতীয় সত্য লৌকিক। অর্থাৎ নানাবিধ দুঃখ ও দুঃখের কারণ লৌকিক নামে অভিহিত। এ দু’সত্যে মানুষ সহজে মুক্তি পায় না। তৃতীয় ও চতুর্থ সত্য লোকোত্তর। অর্থাৎ নিরোধ সত্য ও মার্গ সত্য বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে মানুষ মুক্তি পায়। নির্বাণের পথকে মার্গ সত্য বলে। আবার নির্বাণ সত্যকে কুশলও বলা হয়।

এ কুশল কর্মস্থান বা শমথ-বিদর্শন ভাবনাও বলা হয়। ভাবনা হলো মনের কাজ। ভাবনা ছাড়া বুদ্ধ জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। অলোভ, অদ্বেষ ও অমোহ ব্যক্তি ভাবনা করতে পারে। এগুলিকে ত্রিহেতুক পুদগল বলে। তারা সহজে মুক্তির পথে চলতে পারে বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।

কেউ কেউ দান করে ইহজীবনে সুখভোগ করার জন্যে এবং পরজীবনেও সুখ ভোগ করার জন্যে। কিন্তু নির্বাণ অধিগত করার জন্যে দান করা অতি উত্তম। যেমন দান এভাবে করতে হয়- এ দানের ফলে আমার নির্বাণ লাভের হেতু উৎপন্ন হোক।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ একত্রিশ লোকভূমির মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।

তাঁর প্রচারিত ধর্মই জ্ঞানের ধর্ম। তাও অসংখ্য বৎসর পর আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্য সম্পত্তি, দেব সম্পত্তি ও নির্বাণ সম্পত্তি উৎপত্তি হয়। কিন্তু বর্তমানে কিছু সংখ্যক লোকের ধারণা ভগবান বুদ্ধ অজ্ঞানী ও গরীব। তাদের অবিশ্বাসের ফলে তারা বুদ্ধের নির্বাণ পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। যেমন কোন কোন ভিক্ষু গড়ে তোলতেছে। কেউ কেউ সামাজিক কর্মে নিজকে সারাক্ষণ নিয়োজিত রাখছে। আর কেউ কেউ নানাবিধ কর্মের অধীনে থাকে। অর্থের ও প্রতিপত্তির মোহে নিজেও মুক্ত হতে পারছে না এবং অপরকেও মুক্ত করতে পারছে না।

অন্যদিকে সত্যের আশ্রম হলো শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা। সত্যের আশ্রমে অকুশল ধর্মগুলি ত্যাগ করা যায় এবং উচ্চতর জ্ঞান লাভ হয়। কুশলে পূণ্য উৎপত্তি হয়, পাপ ক্ষয় হয়, দুঃখ সমূলে ধ্বংস হয় এবং ইহকাল-পরকালে পরম সুখ লাভ হয়। কর্মের অধীনে থাকা মহা দুঃখজনক। নির্বাণের অধীনে মহাসুখ।

দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- এম. এ পাশ করে নরকে পড়লে সে লেখাপড়ার কোন মূল্যই নেই। যে যতটুকু লেখাপড়া করুক না কেন তার পাপে লজ্জা থাকতে হবে। ভয় থাকতে হবে। পাপের প্রতি ঘৃনা থাকতে হবে। তবেই এম. এ পাশের মূল্য থাকে। শুধু বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করে পাপে নিমগ্ন থাকলে সেই ডিগ্রীর কোন মূল্য থাকে না। অপ্রমাদ বা সাবধানে থাকলে পাপ নেই ও মার নেই। নিজকে নিজে সর্বদা সাবধানে থাকলে পরম সুখ উৎপত্তি হয় এবং অপরকেও সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিতে পারে।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- অন্ধকে যে কোন জিনিস দেখানো যেমন বৃথা ঠিক তেমনি মূর্খকেও চারি আর্যসত্য ও উচ্চতর জ্ঞান সম্বন্ধে বুঝানো তেমন বৃথা। মূর্খেরা নানাবিধ দোষ করে ও অবাধ্য থাকে। সব সময় অজ্ঞানে অজ্ঞানে সংঘর্ষ বাঁধে। দুঃশীল, অধর্ম পরায়ন ব্যক্তি বৌদ্ধ ধর্মের নষ্টের কারণ।

তিনি উপসংহারে বলেন- তোমরা মিথ্যার আশ্রয়ে যেয়ো না। সত্যের আশ্রয়ে যাও। সত্য তোমাদের রক্ষা করবে এবং পরম সুখ প্রদান করবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তে, কথায়, কাজে ও চিন্তায়, অন্যায়, অপরাধ, ভুল, ত্রুটি, দোষ ও গলদ করো না। অচিরেই তোমাদের পরম সুখ বয়ে আসবে। এ বলে আমার দেশনা আপাততঃ এখানেই শেষ করলাম।

সাধু – সাধু – সাধু।

বৌদ্ধ ধর্মে মার কী বা কারা?

বৌদ্ধ ধর্মে মার কী বা কারা?

বৌদ্ধ ধর্মে মার কী বা কারা? মার কীভাবে

সত্ত্বদের মুক্তির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে?

—————————————————

বৌদ্ধ ধর্ম মতে, মার হচ্ছে শত্রু, শয়তান বা অশুভ শক্তি। সত্ত্বগণের বা মানুষের মুক্তি মার্গে অন্তরায় সৃষ্টি করাই মারের কাজ। সৎ কাজে মারের শত অনিহা ও অজুহাত। মার মনে নানা রকম যুক্তি উপমা দাঁড়। করায় এবং বাস্তবায়ন যাতে না হয় সেজন্য সর্বশক্তি প্রযােগ করে বাধা সৃষ্টি করে। আবার অকুশল কাজ বা খারাপ কাজে মার মনে মনে যথেষ্ট কুবুদ্ধি ও পরামর্শ খাটিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য লেগে থাকে এবং বাস্তবায়নের পর কেটে পরে। সৎ কালে শত বাধা এবং অসৎ কাজে উৎসাহ যােগানাে মারের লক্ষণ।

সাধারণত পাঁচ প্রকার মার দেখতে পাওয়া যায়, যথা –

                                                ১। দেবপুত্র মার:

অসৎ দেবতাদেরকে দেবপুত্র মার বলা হয়। যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মানুষের মুক্তির পথে বাধার সৃষ্টি করে। কখনাে পশুপাখীর রূপ ধারণ করে, কখনাে বুদ্ধমূর্তি, কখনাে ভয়ানক ভীষণ আকারআকৃতি, কখনাে জীবিত মা, বাবা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে মৃত অবস্হায় দেখায়, আবার কখনও বা ঘর-বাড়ী আগুণে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে দেখায়, এসব দেবপুত্র মারের চক্রান্ত।তথাগত বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ব মুহূর্তে পর-নির্মিত বশবর্তী দেবলােকের দুর্দান্ত মার রাজ গিরিমেখলা হাজার সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে হসহিরাজের পিঠে আরােহন করে মায়ার চক্র তৈরী করে গৌতম বােধিসত্ত্বকে প্রলােভন দেখিয়েছিলেন। আক্রমন করেছিলেন সিদ্ধার্থকে ধ্যানচ্যুত করার জন্য, কিন্তু জন্ম জন্মান্তরের অপ্রমেয় দান ও ধর্মের প্রভাবে সিদ্ধার্থ সসৈন্য মাররাজাকে পরাজিত করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন।                                                                            

                                             ২| অভিসংস্কার মার:

অভিসংস্কার বলতে এই জন্মের সংস্কার ছাড়াও অতীত অতীত জন্মের অতিরিক্ত স্পষ্ট সংস্কারের। প্রতিফলনকে বুঝায়। এখানে অভি শব্দকে অধিকতর বা অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। এটা ধর ধাতু নিস্পন্ন ধারণ করা, সমর্থন করা, স্পর্শ প্রতিভাত হওয়া। সংস্কার বলতে কায়, বাক্য ও মনের দ্বারা যা সংস্কৃত বা নিত্য সম্পাদ্যরূপে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়, তাই সংস্কার। ভাবনাকারীর ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে উপাচার সমাধির প্রারম্ভে, পূর্বের সংস্কার গুলাে দেখা দেয় এবং তা অনন্ত জন্মেরও হতে পারে। এ সংস্কার গুলাে কর্মস্রোত বা কর্মপ্রবাহ বা চিত্ত সন্ততিতে সুপ্তাকারে সঞ্চিত। থাকে। যেমন, এই জন্মে পূর্বে ছিল না এমন কিছু কিছু উপসর্গ, রূপ, তীব্র ব্যাথা, বেদনা, দুঃখ, ভাবনাকালে প্রকাশ পেতে দেখা যায়।

                                                  ৩া ক্লেশ মার:

যার প্রভাবে কুশল কর্মে বাধা সৃষ্টি এবং জন্ম জন্মান্তরে সত্ত্বগণকে দুঃখ কষ্ট প্রদানে সহায়ক হয় তাকে ক্লেশ | বলে। ক্লেশ দশ প্রকার ও উপক্লেশ দশ প্রকার। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কুলষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রসহ, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে। এগুলাের দ্বারা মার-রূপে ধ্যানে বাধা সৃষ্টি হয় বলে এগুলােকে ক্লেশ মার বলে।

দশবিধ ক্লেশ—১. লােভ, ২. দ্বেষ, ৩. মােহ, ৪. মান, ৫. মিথ্যা দৃষ্টি, ৬. বিচিকিচ্ছা, ৭. ভ্যান-মিদ্ধ, ৮.ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য, ৯. আহ্ৰী, ১০. অনপত্রপা। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কলুষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে।

দশবিধ উপক্লেশ —১. ওভাস, ২. প্রীতি, ৩. প্রশ্রদ্ধি, ৪. অধিমােক্ষ ৫. প্রগ্রহ, ৬. সুখং, ৭. ঞানং, ৮. উপটঠানং, ৯. উপেক্ষা, ১০. নিন্তি।। ক্লেশ যেমন স্মৃতিভাবনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তদ্রুপ উপক্লেশও এক প্রকার বাধা যা ভাবনাকারীর চিত্ত উদিত হয়। এগুলাে চিত্তের কুশল সংস্কার জাত। এরা নানাবিধ আকারে সাধকের চিত্তে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। উপক্লেশ মুক্ত বিদর্শন জ্ঞানই প্রকৃত মার্গ।

                                                 ৪. স্কন্ধ মার:

স্বন্ধ অর্থে গুচ্ছ, পুঞ্জ, সমাহার বুঝায়। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে পঞ্চ স্কন্ধ বলা হয়। দৈনন্দিন কাজকর্মে মানুষের মাঝে কতগুলাে কুঅভ্যাস পরিলক্ষিত হয়, যেমন- অশােভনীয় কথাবার্তা বলা,হাত-পা নাড়া, মাথা দোলানাে, অহিরতা, চঞ্চলতার কারণে নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গি ইত্যাদি, এগুলাে সংগঠিত হয় শীল ভঙ্গের কারণে বা শীল সম্পর্কিত সচেতনার অভাবে। আরাে লক্ষ্য করা যায়, মাথা ব্যাথা, পেটের পীড়া, হাইতােলা, খিটখিটে মেজাজ, বদরাগী, হিংসুটে ইত্যাদি প্রকাশ পায়, কেহ কেহ পুণ্যময় কাজে | রত থাকে। স্মৃতি ভাবনা অনুশীলনের সময় এসব ভাল ও মন্দ স্বভাবগুলাে কায়, বাক্য ও মনে প্রসফুটিত হয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে এদেরকে স্কন্ধ মার বলে

                                           ৫. মৃত্যু মার :

মৃত্যু হচ্ছে কর্ম প্রবাহের সাময়িক বিরতী। মৃত্যু অর্থে অন্যস্হানে জন্ম নিদের্শ করে অর্থাৎ একস্হান হতে চ্যুত হয়ে অন্যসহানে উৎপত্তি বুঝায়। মৃত্যুকে এখানে মার বলা হয়েছে এ কারণে, ধ্যানী যখন অত্যন্ত একাগ্রতা ও গভীরভাবে ধ্যানানুশীলন করতে করতে ক্রমশঃ ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে থাকেন অর্থাৎ পরিকর্ম ধ্যান শেষ করে গােত্রভূ ধ্যানে প্রবেশ করেন, এমতাবস্হায় অনেক সময় ধ্যানীর আয়ুস্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়। এজন্য মৃত্যুকে মার রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। করণীয় কাজ সমাপনান্তে মৃত্যু বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

# তথ্যসূত্র ঃ-  মহামুনি সম্যক সম্বুদ্ধ (  http://ms-sambuddha.com )

কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান

কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান

৩রা অক্টোবর ১৯৯৬ ইংরেজী বৃহস্পতিবার। ভোর ৫ টায় তাঁর শিষ্যদেরকে ধর্মদেশনা দিচ্ছিলেন। প্রথমেই তিনি কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান সম্বন্ধে বলেন- বৌদ্ধ ধর্মে কিছু লইতে দেয় না, খাইতে দেয় না এবং কোন কিছু গ্রহণ করতে দেয় না। যদি অতি প্রয়োজন হয় অনাসক্তভাবে লইতে হয়, খাইতে হয় এবং কোন কিছু গ্রহণ করতে হয়। কারণ, হেতু, প্রত্যয় ও নিদান সম্বন্ধে না জানলে, না বুঝলে বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে কিছুই জানবে না। বৌদ্ধ ধর্ম তিন প্রকারে শ্রেষ্ঠ। যেমন মার্গ, ফল ও নির্বাণে শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে টাকা, পয়সা, সোনা, রূপা, ধন, সম্পদ প্রভৃতি গ্রহণ করতে পারবে না। মার্গ, ফল ও নির্বাণ অজ্ঞানে বুঝতে পারে না।

তিনি একটি উপমা দিয়ে বলেন- দুইশত হাত পানিতে মাত্র আট হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠাঁই চাইলে ঠাঁই পাবে? কোন দিন পাবে না। সেরকম যারা বনবিহারে শ্রামণ ও ভিক্ষু হয়, তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক শ্রামণ ভিক্ষু কাপড় ছেড়ে চলে যায়। কেন যায় জান? দুইশত হাত পানিতে আট হাত লম্বা বাঁশ দিয়ে ঠাঁই পাচ্ছে না বলে। এখানে নির্বাণ হল দুইশত হাত পানি এবং তাদের জ্ঞান হল মাত্র আট হাত লম্বা বাঁশ। তলদেশ কোথায় তারা জানে না।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি যে বুঝতে পেরেছে সে তলদেশের নাগাল পেয়েছে। এবং বৌদ্ধধর্মে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সুতরাং সুখও পেয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে নির্বাণ খুব গভীর। তোমাদের চারি আর্য্যসত্য জ্ঞান ও প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি জ্ঞান অর্জন হলে বুঝতে হবে তলদেশ পেয়েছ। না পেলে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। মার্গ, ফল ও নির্বাণ তথা তলদেশ চর্মচক্ষে দেখা যায় না। তা জ্ঞান দ্বারা না জানলে জানা যায় না। জ্ঞান দ্বারা দর্শন না হলে বুঝা যায় না, দর্শন করা যায় না, পরিচয় হয় না এবং চিনা যায় না।

ভগবান বুদ্ধ বলেন- নির্বাণে যাও। অন্য জন বলে আমি যাব না। তাহলে কে বুঝেনি? সেরূপ বনভান্তে বলেন- তোমরা নির্বাণে যাও। তোমরা যদি বল আমরা নির্বাণে যাব না। এখানে কে বুঝেছে এবং কে বুঝেনি? বুদ্ধের কথা ধরলে অনাথ আশ্রম করবে না। সত্যের আশ্রম করবে। অজ্ঞানীরা কাম ভোগ করে এবং জ্ঞানী হলে কাম ভোগ করে না।

তিনি বলেন- বুদ্ধের আমলে বুদ্ধ মূর্তি, ধর্ম, বই ও মাইক ছিল না। বুদ্ধ মূর্তিকে ছোয়াইং দেয় কেন? ভগবান বুদ্ধ না থাকলেও তাঁর ধাতু অস্থি গুলি এখনও আছে। এখানে বুদ্ধ মূর্তিকে ছোয়াইং দেয়া হচ্ছে না। জ্ঞানকে দেয়া হচ্ছে। বুদ্ধ মূর্তি হল জ্ঞানের প্রতীক মাত্র। বুদ্ধ না থাকলেও তাঁর বাণীগুলো এখনও আছে। সকলের সুবিধার্থে বই আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দূরবর্তী লোকদের শোনার সুবিধার্থে, মাইকের ব্যবহার হচ্ছে।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- এ দেহ থাকতে জন্ম, জরা, মরণাদি ধ্বংস করতে না পারলে মরণের পর বার বার জন্মগ্রহণ ও মৃত্যু বরণ করে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয়। নির্বাণ হলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করতে হয় না। নির্বাণ হলে দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অজ্ঞানীরা বলে থাকে মরে গেলে দুঃখ থেকে মুক্তি পেয়েছে। তা নিতান্তই ভুল। কিন্তু একমাত্র যার চিত্ত নিরোধ ও গতি নিরোধ হয়েছে সে শুধু মুক্তি পেয়ে থাকে। চিত্ত উৎপন্ন ও গতি উৎপন্ন হলে পঞ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। যেমন মানুষ, দেবতা, প্রেত, নরক ও তির্যক এ পঞ্চ গতিতে গমনাগমন হয়। অজ্ঞানীরা যাবতীয় দুঃখ পেয়ে মৃত্যু হলে উত্তম বলে মনে করে এবং বলে থাকে যে মরেছে সে দুঃখ থেকে মুক্ত হয়েছে। যাঁরা জ্ঞানী তাদের জন্ম মৃত্যু নেই। সুতরাং তাদের কোন দুঃখও নেই।

তিনি আরো বলেন- আনাপান স্মৃতি দ্বারা নির্বাণ লাভ করা যায়। তবে অজ্ঞানীরা শ্বাস-প্রশ্বাস টানলে ও ফেললে তাতে জ্ঞান নেই বলে তাদের জন্ম মৃত্যু হচ্ছে, নির্বাণ লাভ হচ্ছে না। যাঁরা জ্ঞানী তাঁরা শ্বাস গ্রহণ করলে জ্ঞান যোগে গ্রহণ করে এবং নিশ্বাস ফেললে জ্ঞান যোগে ফেলে। আর যারা অজ্ঞানী তারা শ্বাস গ্রহণ করলে অজ্ঞানে গ্রহণ করে এবং নিশ্বাস ফেললে অজ্ঞানে ফেলে।

শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন– যারা কাপড় ছেড়ে চলে যায়, তারা কি বুঝে চলে যায়? না বুঝে চলে যায়। উপবাস থাকলে বাবুর্চি বা স্ত্রীর প্রয়োজন হয় না। বনভান্তেও বহুবার উপবাস ছিলেন। তাঁর কোন দিন বাবুর্চি বা স্ত্রীর প্রয়োজন হয় নি। ভিক্ষুর পক্ষে স্ত্রী লোক গ্রহণ করা তো দূরের কথা, ছুঁইলেই পাপ হয়। একবার ডাঃ অরবিন্দ ভিক্ষু হওয়ার আশা করেছিল। তার স্ত্রী তাকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু সে ভিক্ষু হয় নি। তাহলে দেখা যাচ্ছে তার ততটুকু সাহস ও জ্ঞান নেই (এ কথাটি বলার পর সবাই হেঁসে উঠলেন)। তিনি বলেন- একবার দেবদত্ত ভগবান বুদ্ধকে বলেছিল- আমি ভিক্ষু সংঘ পরিচালনা করব। বুদ্ধ বললেন- আগে নিজেকে নিজে পরিচালিত কর, পরে অন্যজনকে পরিচালিত করতে পারবে। নিজে মুক্ত হয়ে অপরকে মুক্ত করতে পারে। ঠিক সেরকম নিজে সুপরিচালিত হলে অপরকে পরিচালিত করতে পারে।

বিনা মূল্যে নির্বাণ সুখ পাওয়া যায়। অন্যান্য জিনিস মূল্য দিয়ে কিনতে হয়। কিন্তু নির্বাণ বিনামূল্যে। তাঁর জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও আকাঙ্খা। কি পরিশ্রম? শীল পরিশ্রম, সমাধি পরিশ্রম ও প্রজ্ঞা পরিশ্রম। কি অধ্যবসায়? শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা অধ্যবসায়। কি আকাঙ্খা? শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা আকাঙ্খা। তাতেই তোমরা পরম সুখ নির্বাণ প্রত্যক্ষ করতে পারবে। বনবিহারেও কোন কিছু মূল্য দিতে হয় না। তবে নির্বাণ প্রত্যক্ষ করতে হবে। বৌদ্ধ ধর্মে বলতে হয় সকল সংস্কার অনিত্য, সকল সংস্কার দুঃখ ও সকল সংস্কার অনাত্ম। অনিত্য অর্থাৎ ক্ষয় ব্যয়শীল, দুঃখ অর্থাৎ যাহা অহরহ নিষ্পেষিত হচ্ছে এবং অনাত্ম- যাহা অনিচ্ছাবশে সংগঠিত হয়, আপনার নহে বলে। ত্রিপিটককে বিস্তারিত করলে চারি আর্য্যসত্য বুঝায়। চারি আর্য্যসত্যকে বিস্তারিত করলে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বুঝায়। অষ্টাঙ্গিক মার্গকে বিস্তারিত করলে ৩৭ প্রকার বোধি পক্ষীয় ধর্ম বুঝায়। ৩৭ প্রকার বোধি পক্ষীয় ধর্মকে বিস্তারিত করলে চুরাশি হাজার ধর্মস্কন্ধ বুঝায়। ভগবান বুদ্ধ প্রথমে সংক্ষিপ্ত দেশনা করেন। পরিশেষে বিস্তারিত ভাবে দেশনা করেন।

পরিশেষে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে দুই লাইন বিশিষ্ট গাথা বলে তাঁর দেশনা সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

সুবিচারে সবিনয়ে চালায় অন্যজন।
ধর্মস্থ মেধাবী নামে অভিহিত হন।।

#লেখাটি  Subrata Barua  কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে
error: Content is protected !!