by admin | Nov 26, 2021 | blog
১লা এপ্রিল ১৯৯৪ ইংরেজী রোজ শুক্রবার। ট্রাইবেল অফিসার্স কলোনী, রাঙ্গামাটি। সার্বজনীন সংঘদান ও অষ্ট পরিষ্কার দান উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সশিষ্যে শুভ আগমন। বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করেন বাবু বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা। উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন বাবু রনজিত দেওয়ান। পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন বাবু প্রগতি রঞ্জন খীসা। অনুষ্ঠানের আহবায়ক বাবু যামিনী কুমার চাকমা ও পরিচালনা করেন শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার ভিক্ষু।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সকাল ১০টা ২০ মিনিট হতে ১০টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ধর্মদেশনা প্রদান করেন। তিনি প্রথমেই বলেন- শ্রদ্ধার সহিত ধর্ম কথা বা ধর্ম দেশনা শ্রবণ, গ্রহণ, ধারণ ও আচরণ করতে হয়। তাতে শ্রোতার অনেক ফল লাভ হয়। শ্রদ্ধা দু’প্রকার। লৌকিক ও লোকোত্তর। ত্রিরত্ন, কর্ম ও কর্মফলকে বিশ্বাস করলে লৌকিক শ্রদ্ধা হয়। ইহকাল-পরকাল ও চারি আর্যসত্যকে বিশ্বাস করলে লোকোত্তর শ্রদ্ধা হয়। অশ্রদ্ধার সহিত ধর্মদেশনা শ্রবণ করলে কোন ফল হয় না।
মনুষ্য ধর্ম পাপ মুক্ত নয় ও দুঃখ। প্রথম সত্য ও দ্বিতীয় সত্য লৌকিক। অর্থাৎ নানাবিধ দুঃখ ও দুঃখের কারণ লৌকিক নামে অভিহিত। এ দু’সত্যে মানুষ সহজে মুক্তি পায় না। তৃতীয় ও চতুর্থ সত্য লোকোত্তর। অর্থাৎ নিরোধ সত্য ও মার্গ সত্য বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে মানুষ মুক্তি পায়। নির্বাণের পথকে মার্গ সত্য বলে। আবার নির্বাণ সত্যকে কুশলও বলা হয়।
এ কুশল কর্মস্থান বা শমথ-বিদর্শন ভাবনাও বলা হয়। ভাবনা হলো মনের কাজ। ভাবনা ছাড়া বুদ্ধ জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। অলোভ, অদ্বেষ ও অমোহ ব্যক্তি ভাবনা করতে পারে। এগুলিকে ত্রিহেতুক পুদগল বলে। তারা সহজে মুক্তির পথে চলতে পারে বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।
কেউ কেউ দান করে ইহজীবনে সুখভোগ করার জন্যে এবং পরজীবনেও সুখ ভোগ করার জন্যে। কিন্তু নির্বাণ অধিগত করার জন্যে দান করা অতি উত্তম। যেমন দান এভাবে করতে হয়- এ দানের ফলে আমার নির্বাণ লাভের হেতু উৎপন্ন হোক।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ একত্রিশ লোকভূমির মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।
তাঁর প্রচারিত ধর্মই জ্ঞানের ধর্ম। তাও অসংখ্য বৎসর পর আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্য সম্পত্তি, দেব সম্পত্তি ও নির্বাণ সম্পত্তি উৎপত্তি হয়। কিন্তু বর্তমানে কিছু সংখ্যক লোকের ধারণা ভগবান বুদ্ধ অজ্ঞানী ও গরীব। তাদের অবিশ্বাসের ফলে তারা বুদ্ধের নির্বাণ পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। যেমন কোন কোন ভিক্ষু গড়ে তোলতেছে। কেউ কেউ সামাজিক কর্মে নিজকে সারাক্ষণ নিয়োজিত রাখছে। আর কেউ কেউ নানাবিধ কর্মের অধীনে থাকে। অর্থের ও প্রতিপত্তির মোহে নিজেও মুক্ত হতে পারছে না এবং অপরকেও মুক্ত করতে পারছে না।
অন্যদিকে সত্যের আশ্রম হলো শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা। সত্যের আশ্রমে অকুশল ধর্মগুলি ত্যাগ করা যায় এবং উচ্চতর জ্ঞান লাভ হয়। কুশলে পূণ্য উৎপত্তি হয়, পাপ ক্ষয় হয়, দুঃখ সমূলে ধ্বংস হয় এবং ইহকাল-পরকালে পরম সুখ লাভ হয়। কর্মের অধীনে থাকা মহা দুঃখজনক। নির্বাণের অধীনে মহাসুখ।
দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- এম. এ পাশ করে নরকে পড়লে সে লেখাপড়ার কোন মূল্যই নেই। যে যতটুকু লেখাপড়া করুক না কেন তার পাপে লজ্জা থাকতে হবে। ভয় থাকতে হবে। পাপের প্রতি ঘৃনা থাকতে হবে। তবেই এম. এ পাশের মূল্য থাকে। শুধু বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করে পাপে নিমগ্ন থাকলে সেই ডিগ্রীর কোন মূল্য থাকে না। অপ্রমাদ বা সাবধানে থাকলে পাপ নেই ও মার নেই। নিজকে নিজে সর্বদা সাবধানে থাকলে পরম সুখ উৎপত্তি হয় এবং অপরকেও সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিতে পারে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- অন্ধকে যে কোন জিনিস দেখানো যেমন বৃথা ঠিক তেমনি মূর্খকেও চারি আর্যসত্য ও উচ্চতর জ্ঞান সম্বন্ধে বুঝানো তেমন বৃথা। মূর্খেরা নানাবিধ দোষ করে ও অবাধ্য থাকে। সব সময় অজ্ঞানে অজ্ঞানে সংঘর্ষ বাঁধে। দুঃশীল, অধর্ম পরায়ন ব্যক্তি বৌদ্ধ ধর্মের নষ্টের কারণ।
তিনি উপসংহারে বলেন- তোমরা মিথ্যার আশ্রয়ে যেয়ো না। সত্যের আশ্রয়ে যাও। সত্য তোমাদের রক্ষা করবে এবং পরম সুখ প্রদান করবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তে, কথায়, কাজে ও চিন্তায়, অন্যায়, অপরাধ, ভুল, ত্রুটি, দোষ ও গলদ করো না। অচিরেই তোমাদের পরম সুখ বয়ে আসবে। এ বলে আমার দেশনা আপাততঃ এখানেই শেষ করলাম।
সাধু – সাধু – সাধু।
by admin | Nov 20, 2021 | blog, content
বৌদ্ধ ধর্মে মার কী বা কারা? মার কীভাবে
সত্ত্বদের মুক্তির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে?
—————————————————
বৌদ্ধ ধর্ম মতে, মার হচ্ছে শত্রু, শয়তান বা অশুভ শক্তি। সত্ত্বগণের বা মানুষের মুক্তি মার্গে অন্তরায় সৃষ্টি করাই মারের কাজ। সৎ কাজে মারের শত অনিহা ও অজুহাত। মার মনে নানা রকম যুক্তি উপমা দাঁড়। করায় এবং বাস্তবায়ন যাতে না হয় সেজন্য সর্বশক্তি প্রযােগ করে বাধা সৃষ্টি করে। আবার অকুশল কাজ বা খারাপ কাজে মার মনে মনে যথেষ্ট কুবুদ্ধি ও পরামর্শ খাটিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য লেগে থাকে এবং বাস্তবায়নের পর কেটে পরে। সৎ কালে শত বাধা এবং অসৎ কাজে উৎসাহ যােগানাে মারের লক্ষণ।
সাধারণত পাঁচ প্রকার মার দেখতে পাওয়া যায়, যথা –
১। দেবপুত্র মার:
অসৎ দেবতাদেরকে দেবপুত্র মার বলা হয়। যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে মানুষের মুক্তির পথে বাধার সৃষ্টি করে। কখনাে পশুপাখীর রূপ ধারণ করে, কখনাে বুদ্ধমূর্তি, কখনাে ভয়ানক ভীষণ আকারআকৃতি, কখনাে জীবিত মা, বাবা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে মৃত অবস্হায় দেখায়, আবার কখনও বা ঘর-বাড়ী আগুণে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে দেখায়, এসব দেবপুত্র মারের চক্রান্ত।তথাগত বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পূর্ব মুহূর্তে পর-নির্মিত বশবর্তী দেবলােকের দুর্দান্ত মার রাজ গিরিমেখলা হাজার সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে হসহিরাজের পিঠে আরােহন করে মায়ার চক্র তৈরী করে গৌতম বােধিসত্ত্বকে প্রলােভন দেখিয়েছিলেন। আক্রমন করেছিলেন সিদ্ধার্থকে ধ্যানচ্যুত করার জন্য, কিন্তু জন্ম জন্মান্তরের অপ্রমেয় দান ও ধর্মের প্রভাবে সিদ্ধার্থ সসৈন্য মাররাজাকে পরাজিত করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
২| অভিসংস্কার মার:
অভিসংস্কার বলতে এই জন্মের সংস্কার ছাড়াও অতীত অতীত জন্মের অতিরিক্ত স্পষ্ট সংস্কারের। প্রতিফলনকে বুঝায়। এখানে অভি শব্দকে অধিকতর বা অতিরিক্ত গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। এটা ধর ধাতু নিস্পন্ন ধারণ করা, সমর্থন করা, স্পর্শ প্রতিভাত হওয়া। সংস্কার বলতে কায়, বাক্য ও মনের দ্বারা যা সংস্কৃত বা নিত্য সম্পাদ্যরূপে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়, তাই সংস্কার। ভাবনাকারীর ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে উপাচার সমাধির প্রারম্ভে, পূর্বের সংস্কার গুলাে দেখা দেয় এবং তা অনন্ত জন্মেরও হতে পারে। এ সংস্কার গুলাে কর্মস্রোত বা কর্মপ্রবাহ বা চিত্ত সন্ততিতে সুপ্তাকারে সঞ্চিত। থাকে। যেমন, এই জন্মে পূর্বে ছিল না এমন কিছু কিছু উপসর্গ, রূপ, তীব্র ব্যাথা, বেদনা, দুঃখ, ভাবনাকালে প্রকাশ পেতে দেখা যায়।
৩া ক্লেশ মার:
যার প্রভাবে কুশল কর্মে বাধা সৃষ্টি এবং জন্ম জন্মান্তরে সত্ত্বগণকে দুঃখ কষ্ট প্রদানে সহায়ক হয় তাকে ক্লেশ | বলে। ক্লেশ দশ প্রকার ও উপক্লেশ দশ প্রকার। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কুলষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রসহ, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে। এগুলাের দ্বারা মার-রূপে ধ্যানে বাধা সৃষ্টি হয় বলে এগুলােকে ক্লেশ মার বলে।
দশবিধ ক্লেশ—১. লােভ, ২. দ্বেষ, ৩. মােহ, ৪. মান, ৫. মিথ্যা দৃষ্টি, ৬. বিচিকিচ্ছা, ৭. ভ্যান-মিদ্ধ, ৮.ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য, ৯. আহ্ৰী, ১০. অনপত্রপা। এগুলাে সত্ত্বগণের চিত্ত কলুষিত, পরিতপ্ত, ব্যাধিগ্রস্ত, মলিন, নীচ, হীন ও ঘৃণিত করে তােলে।
দশবিধ উপক্লেশ —১. ওভাস, ২. প্রীতি, ৩. প্রশ্রদ্ধি, ৪. অধিমােক্ষ ৫. প্রগ্রহ, ৬. সুখং, ৭. ঞানং, ৮. উপটঠানং, ৯. উপেক্ষা, ১০. নিন্তি।। ক্লেশ যেমন স্মৃতিভাবনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তদ্রুপ উপক্লেশও এক প্রকার বাধা যা ভাবনাকারীর চিত্ত উদিত হয়। এগুলাে চিত্তের কুশল সংস্কার জাত। এরা নানাবিধ আকারে সাধকের চিত্তে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। উপক্লেশ মুক্ত বিদর্শন জ্ঞানই প্রকৃত মার্গ।
৪. স্কন্ধ মার:
স্বন্ধ অর্থে গুচ্ছ, পুঞ্জ, সমাহার বুঝায়। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে পঞ্চ স্কন্ধ বলা হয়। দৈনন্দিন কাজকর্মে মানুষের মাঝে কতগুলাে কুঅভ্যাস পরিলক্ষিত হয়, যেমন- অশােভনীয় কথাবার্তা বলা,হাত-পা নাড়া, মাথা দোলানাে, অহিরতা, চঞ্চলতার কারণে নানা রকম অঙ্গ-ভঙ্গি ইত্যাদি, এগুলাে সংগঠিত হয় শীল ভঙ্গের কারণে বা শীল সম্পর্কিত সচেতনার অভাবে। আরাে লক্ষ্য করা যায়, মাথা ব্যাথা, পেটের পীড়া, হাইতােলা, খিটখিটে মেজাজ, বদরাগী, হিংসুটে ইত্যাদি প্রকাশ পায়, কেহ কেহ পুণ্যময় কাজে | রত থাকে। স্মৃতি ভাবনা অনুশীলনের সময় এসব ভাল ও মন্দ স্বভাবগুলাে কায়, বাক্য ও মনে প্রসফুটিত হয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে এদেরকে স্কন্ধ মার বলে
৫. মৃত্যু মার :
মৃত্যু হচ্ছে কর্ম প্রবাহের সাময়িক বিরতী। মৃত্যু অর্থে অন্যস্হানে জন্ম নিদের্শ করে অর্থাৎ একস্হান হতে চ্যুত হয়ে অন্যসহানে উৎপত্তি বুঝায়। মৃত্যুকে এখানে মার বলা হয়েছে এ কারণে, ধ্যানী যখন অত্যন্ত একাগ্রতা ও গভীরভাবে ধ্যানানুশীলন করতে করতে ক্রমশঃ ধ্যানের গভীরে প্রবেশ করতে থাকেন অর্থাৎ পরিকর্ম ধ্যান শেষ করে গােত্রভূ ধ্যানে প্রবেশ করেন, এমতাবস্হায় অনেক সময় ধ্যানীর আয়ুস্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়। এজন্য মৃত্যুকে মার রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। করণীয় কাজ সমাপনান্তে মৃত্যু বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
# তথ্যসূত্র ঃ- মহামুনি সম্যক সম্বুদ্ধ ( http://ms-sambuddha.com )
by admin | Sep 10, 2021 | blog
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ঠেগরপুনি গ্রামে অবস্থান করতেন চকরিয়া নিবাসী রাজমঙ্গল মহাস্থবির। চন্দ্রজ্যোতি ভিক্ষু কর্তৃক ব্রক্ষদেশ থেকে আনিত একটি এিভঙ্গ বুদ্ধমূর্তি তার পিতৃব্য রাজমঙ্গল মহাস্থবির ঠেগরপুনি গ্রামের বিহারের পার্শে কাঠের ঘর প্রতিষ্ঠা করেন ৷ প্রাকৃতিক দূর্যোগ এর কারণে পরবর্তিতে কাঠের ঘরটি ভগ্নদশায় পতিত হলে মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে যায়৷ অনেককাল পর পটিয়ার বাকখালী নিবাসী শ্রীধন বড়ুয়ার পত্নি নীলাকুমারী স্বপ্নাদেশ পেয়ে বুদ্ধমুর্তিটি উদ্ধার করেন ৷ পরবর্তিতে পটিয়ার করল নিবাসী ভগ্নিপুএ আরাধন মহাস্থবিরের সহায়তায় ১৮৫৫ সালে নির্মাণপূর্বক বুদ্ধমূর্তিটি পূনরায় প্রতিষ্ঠা করেন ৷ মূর্তিটির মধ্যাংশ পাওয়া যায়নি, বর্তমানে যা আছে তা উপরের অংশ ও নির্বাণের সংযোগ মাএ৷ প্রাচ্যের রাণী খ্যাত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম পীঠভূমি এই চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের আদি ও প্রাচীনতম ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্ররূপে স্মরণাতীত কালের ইতিহাসে ভাস্বর এই চট্টগ্রাম। বিভিন্ন বৌদ্ধ পুরাকীর্তি স্তম্ভের অবস্থান থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়। তেমনি এক প্রাচীন বৌদ্ধ ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান হচ্ছে ‘বুড়া গোসাঁই মন্দির’। পটিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪ কি. মি. দক্ষিণে ঠেগরপুনি গ্রামে এর অবস্থান। পটিয়া সদর থেকে রিক্সাযোগে সরাসরি অথবা টেম্পোযোগে ভাটিখাইন নেমে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়।বর্তমানে বিহারটি ৪০ শতক ভিটার উপর পর পর সারিবদ্ধ তিনটি গম্বুজ নিয়ে স্থাপিত। মাঝখানের গম্বুজটি সমতল হতে ৫৯ ফুট উচু এবং দুপাশের গম্বুজ দুটির উচ্চতা ৪৮ ফুট। মূল বিহারের দেওয়াল ৩ ফুট ২ ইঞ্চি পুরু। বিহারটির দক্ষিন পাশে শ্রীমতি খাল প্রবাহিত। ঠেগরপুনি প্রবেশ করে সুদৃশ্য বিশাল মন্দির চোখে পড়লেই মন শুভ্র উপলব্ধিতে সঞ্জীবিত হয়ে উঠে। ছায়াঘেরা নয়নাভিরাম পরিবেশে অনন্য এক পবিত্র অনুভূতি নিজের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। মন্দিরের মূল গেইট সোজা পুকুরের ঘাট আর ছাদ বিশিষ্ট প্লাটফরম। মন্দিরের গেইট থেকে সিঁড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠলেই চোখে পড়বে প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত ‘বুড়া গোঁসাই’ খ্যাত বুদ্ধমূর্তিটি।ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এই স্থানটি তৎকালীন আরাকান রাজ্যের অংশ ছিল। আনুমানিক ৩৫০-৪০০ বছর পূর্বে অথ্যাৎ ১৫০০ শতাব্দীর শেষদিকে ছান্ধমা রাজার আমলে এ স্থানে একটি সুবিস্তীর্ণ দীঘি ছিল যা ‘ছান্ধমা দীঘি’ নামে পরিচিত ছিল। কালক্রমে উক্ত রাজবংশ এ স্থান হতে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে তা পরিত্যক্ত খোয়াইল্লা (প্রচলিত শব্দ) বনে পরিণত হয়। উক্ত বনের মাটির নীচে চাপা পড়ে প্রাচীন বুদ্ধমুর্তিটি। এক সময় বাকখালী নিবাসী শ্রীধন বড়ুয়ার স্ত্রী নীলাকুমারী উক্ত স্থান থেকে খোয়াইল্লা উঠাতে কোদাল দিয়ে মাটি খনন করতে থাকে। এক জায়গায় প্রচন্ড আঘাত করার সাথে সাথে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। উল্লেখ্য কোদালের আঘাতে মূর্তির মাথার ডান পার্শ্বে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কিছুই অনুমান করতে না পেরে উক্ত মহিলা নীলাকুমারী আতঙ্কিত হয়ে চলে যান। এক সময় তাঁর উপর স্বপ্নাদেশ হয় যে, “আমি এ জায়গায় অধিষ্ঠিত আছি, তোমরা আমাকে উঠাও”। নীলাকুমারী নিজে তা করার জন্য সাহস করেননি। অগত্য তিনি পার্শ্ববর্তী করল গ্রামের বাসিন্দা ভগ্নিপুত্র ভদন্ত হারাধন মহাস্থবিরকে এ ব্যাপারে অবহিত করেন। তারই আনুকূল্যে মাটি খননপূর্বক সেই মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা পায় এবং মুর্তিটি মাটির নীচ থেকে উধ্বার করে সেই জায়গাতেই মন্দির নির্মাণ করা হয়। তখন থেকে মূর্তিটি ‘বুড়া গোঁসাই’ নামে পরিচিত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে সেই সিদ্ধস্থানে প্রতি মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে সপ্তাহব্যাপী মেলার প্রচলন হয় এবং তা এখনো বিদ্যমান। বৌদ্ধ পুরাকীর্তির নিদর্শন এ ‘বুড়া গোঁসাই’ মূর্তিটিকে প্রতি মাঘী পূর্ণিমার পূর্বের দিন ডাবের পানি, দুধ, জল দিয়ে স্নান করানো হয়। কর্মসূচির মধ্যে থাকে বুদ্ধ পূজা, সংঘদান, অস্ট পরিষ্কার দান ও ধর্মীয় সভা। প্রায় ৮০/৯০ বছর পূর্বের এ মন্দিরের সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের দিকে। স্থানীয় গ্রামবাসী তথা ধর্মপ্রাণ দানশীল বৌদ্ধ সাধারণের অর্থানুকূল্যে পুরনো মন্দিরের ভাঙ্গার কাজ চলে প্রায় এক বছর ধরে। অতঃপর আরও এক বছর পুনঃনির্মাণ কাজ চলার পর ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে এ মন্দিরটি যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় ও উৎসবের মধ্য দিয়ে উৎসর্গীত হয়।এই ‘বুড়া গোঁসাই’ নিয়ে নানাজনের নানা অভিমত। কেউ কেউ বলেন এটি কোন অর্হৎ ভিক্ষুর অধিষ্ঠান। আবার অনেকের মতে তৎকালীন ছান্ধমা রাজার আমলে হারিয়ে যাওয়া কোন বুদ্ধমূর্তির অংশবিশেষ। প্রবাদ আছে “বুড়া গোঁসাই”র নিকট কেউ একান্ত মনে প্রার্থনা করলে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়। উল্লেখ্য, বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বিশেষ করে নব দম্পতিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরকে ঘিরে ‘ঠেগরপুনি ধর্ম্মচরণ বিহার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এই বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন ভদন্ত সংঘবোধি ভিক্ষু। হাজারেরও অধিক ধর্মীয় ও সাধারণ গ্রন্থের একটি পাঠাগার আছে। স্থানীয় গ্রামবাসী ভিক্ষু শ্রমনের সার্বিক ব্যয়ভার বহন করেন। মাঘী পূর্ণিমার মেলা ছাড়াও সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন স্থান থেকে পুণ্যার্থীরা ছুটে আসেন এ পবিত্র স্থানে। জগতের সকল প্রানী সূখী হওক।
সূত্র –সংগৃহিত।
by admin | Oct 30, 2020 | blog
যেই গ্রামে বিহার যত
সেই গ্রামে বিভাজন তত।
যেই সমাজে নেতা যত,
সেই সমাজটি তত ক্ষত।
যাহা ঐক্য নাশে অবিরত।
প্রতিবন্ধক শত শত।
বর্তমানে বড়ুয়া সমাজে যে বিষয়টি বার বার পরিলক্ষিত হয় তা হল বিহার কমিটি, ভিক্ষু-গৃহীদের নেতৃত্বের বারাবারি। বিহার কমিটি আর দায়ক ভিক্ষু নিয়ে বর্তমানে প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম দু-তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে । আগে প্রতিটি গ্রামে পূর্বপুরুষদের স্থাপিত বিহারগুলো ছিল সার্বজনীন। সেখানে ব্যাপক উৎসাহ আর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে গ্রামের সকলের উপস্থিতিতে সকল অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হতো । কিন্তু সার্থান্বেষী নাম স্বর্বস ভিক্ষু ও গৃহীবাবুদের কবলে ক্রমেই সেই পূর্বপুরুষের ঐক্যতায় স্থাপিত বিহারগুলোতে চরম মতানৈক্য দেখা দেয় ও ভিন্ন একটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। বংশ গৌরব আর মাতব্বরি ফলানোয় ব্যাঘাত ঘটায়, একে অন্যকে মেনে নিতে পারে না। ফলে তাদের পক্ষ-বিপক্ষের রোষে উভয় সংকটের মুখে পরতে হয় ভিক্ষুকে। একপক্ষ আলাদা মন্দির স্থাপন করে, সেখানে তাদেরকেও সগৌরবে সমর্থন করতে অন্য ভিক্ষুরাও উঠে পরে লাগে। উভয় পক্ষের সমস্যার সমাধানের দিকে না গিয়ে আয়োজন করেন নানা অনুষ্ঠানাদি, অন্যপক্ষও তারই জবাবে চালিয়ে যান নানা অনুষ্ঠান, তাও আবার একই দিনে। এভাবেই আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান আর কীর্ত্তন চলতে থাকে দুইভাগে। কার আয়োজন কত ভালো হয়, কে কত সফলতার সাথে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলো, এমন অভ্যন্তরীণ তর্ক বিতর্কও চলে। মোটকথা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো দুইপক্ষের শক্তি সামর্থ্য আর হিংসা প্রদর্শনের এক অভিন্ন মাধ্যম হয়ে ওঠে।
এভাবেই ধর্মের নামে গ্রামবাসী দিনের পর দিন একে অপরের শত্রু হয়ে যায়। সামাজিকভাবেও তারা একে অপরকে বয়কট করতে শুরু করেন। এক পক্ষের কেউ অন্যপক্ষের কারো বাড়িতে বিয়ে, শ্রাদ্ধ বা যে কোন সামাজিক বা ধর্মীয় অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান ত্যাগ করতে থাকেন। একপক্ষের লোকজন অন্যপক্ষকে তাদের এলাকার রাস্তা ব্যবহার করতে দেবেন না, অন্যপক্ষের লোকজনের দেয়া দোকান থেকে কোন পন্য কিনবেন না, এমনি করে দুই পক্ষ সম্পূর্ণরুপে একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠেন।মাঝেমাঝে দুইপক্ষে ছোট-খাটো মারামারি হাতাহাতিও চলে, যা থানা কোর্টকাচারি অবদি গড়ায়। কয়েক দফায় মীমাংসা শালিশ হলেও, কে কার কথা শোনে!!!
ধর্ম অবশেষে আমাদের কি দিল? একজনও ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে বিহারে যান না। নীতি নৈতিকতার কোন চর্চা নেই। বাড়লো হিংসা বিভেদ আর হানাহানি। ধর্ম সমাজকে ভিন্ন করলো, নতুন জেনারেশনের মাঝে একটা আকাশ সমান দেয়াল তৈরী করে দিল, আর শত্রুতার বিষে ভাই বন্ধু হয়ে গেল শত্রু। বড়ুয়াদের অনৈক্যতার সূচনা হয় মূলত এখান থেকে। একারনে বড়ুয়ারা কোনো দিন ঐক্য থাকতে পারবে না। ঐক্য না থাকার কারণে যারা জ্ঞানী গুণী নিবেদিত প্রাণ এদের সম্মান ও মান্যতা কালে কালে উপেক্ষিত হয়েছে, হচ্ছে, এবং আগামীতেও হইবে। এমনকি জাতিয় পর্যায়েও স্বঅধিকার আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে। কিছু অদূরদর্শী গতানুগতিক ভিক্ষু ও গৃহীরাই এরজন্য দায়ী। এদের হাতেই সূচনা হয় পক্ষ বিপক্ষ
সমর্থন করা। এর মধ্যেই কিছু কিছু ভিক্ষুরাও এমন একটি পক্ষ বিপক্ষের কোন্দলে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগকে ভিক্ষুজীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন মনে করেন। তাই তারাও বুদ্ধাদর্শ ভুলেগিয়ে বাবুদের অধীনে অনুষ্ঠানাদিতে যোগাদান সহ দায়কদের ফাং গ্রহন-বর্জনে একচোখা হয়ে পরেন। আজ সংঘরাজ নিকায়ের কোন ভিক্ষু যদি সমাজ ও জাতীয় কল্যানে এগিয়ে আসে মাথের নিকায়ের পক্ষের ভিক্ষুরা বলবে ভিন্ন কথা, আবার অন্য দিকে মাথের নিকায়ের কোন ভিক্ষু যদি সমাজ ও জাতির কল্যানে ব্রতী হন সংঘরাজ নিকায়ের ভিক্ষুরা বলবে ভিন্ন কথা। এছাড়া উচিহ্লাবাদী, শীলানন্দবাদী, দিপাংকরবাদী, শরনংকরবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি, এক দল এক দলকে ভিন্ন চোখে দেখে। এদের সবাই সূচি পবিত্র পরিশুদ্ধ বলে নিজ নিজ ভক্তরা শ্লোগান তুলে। আর দায়ক ভক্তরা পূর্বাপর চিন্তা না করে অর্থবলে বিহারের পর বিহার, সংঘটনের পর সংঘটন প্রতিষ্ঠা করে।
সবার দাবী তাদের নিজ নিজ মান্যতাই শ্রেষ্ঠ। তারই সূত্র ধরে একগ্রামে পূর্বে অনেক গুলো বিহার থাকার পরও আবার নতুন বিহার হচ্ছে। কেউ যদি মনে করেন বিহার নির্মান পুন্যের কাজ বুদ্ধ প্রসংশিত। তবে তাতে আমার দ্বিমত রয়েছে। আপনি যদি এতো ধার্মিক হয়ে থাকেন তাহলে বলব- পুরোনো জীর্ণশীর্ণ পুর্বপুরুষদের স্থাপিত বিহারগুলো সংস্কার করুন আর না হয় যে গ্রামে ধর্মচর্চায় প্রতিকুল, যোগাযোগ বিছিন্ন, বিহার ভিত্তিক ধর্মচর্চা সুলভ্য নয় সেসব গ্রাম ও নগরে বিহার স্থাপন করুন তাতে আমার হাজারো সাধুবাদ। তবে দলাদলি আর নেতৃত্বের অপব্যবহারে পাশপাশি নতুন বিহার নয়। তবে হ্যাঁ, বিশ্বমানের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হলে ভিন্ন কথা। উভয় পক্ষের ভিক্ষুদের উচিত তাদের স্ব স্ব গৌরব অক্ষুণ্ণত রেখে জাতিয় ঐক্যের দূরদর্শী হয়ে কিছু স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া গৃহীনেতৃত্বের কবলে নিজেদেরকে বিলিয়ে না দেওয়া এবং বিহার কমিটির অধীনস্থ পঙ্গুত্বতা বরণ না করা। বিনয় লঙ্গিত সঙ্ঘ সদস্যেকে শাস্তি বা বর্জন করা। সাঙ্ঘিক কল্যাণমুখী কর্মে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখা। প্রতিটি বিহারের প্রভাতী ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ব্যয় সঙ্কোচন করে অসুস্থ ভিক্ষুদের চিকিৎসা, ফাং স্থাপন করা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরিশেষে আমাদের মনে রাখা উচিত- ভিক্ষুরা জাতির চালিকা শক্তি ও উত্তোরণের চাবিকাঠি। অনুরোধ থাকবে- কেউ বিষয়টিকে ব্যক্তিগতভাবে না নেওয়ার।
#লেখাটি Subrata Barua কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ।