রতন সুত্রের উৎপত্তি

রতন সুত্রের উৎপত্তি

ভগবান বুদ্ধের জীবদ্দশায় বৈশালী অতিশয় সমৃদ্ধশালী নগর ছিল। কালের গতিকে সর্ববিধ উপভোগ্য পরিভোগ্য বিত্তসম্পদ সমৃদ্ধ বৈশালীতে অনাবৃষ্টি দেখা দিল। অনাবৃষ্টির দরুণ কৃষকগণের শস্যক্ষেত্র বিনষ্ট হইয়া ভীষণ দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া পতিত হইল। প্রথমে সহায় সম্বলহীন দরিদ্র মানুষেরা অনাহারে মৃত্যু বরণ করিতে লাগিল। তাহাদের মৃতদেহ নগরের বাহিরে ফেলিয়া দেওয়া হইত। কাজেই মৃতদেহের ভীষণ দুর্গন্ধ পাইয়া প্রেত-পিশাচাদি অমনুষ্যগণ নগরে আশ্রয় গ্রহণ করিল। কালক্রমে এত অধিক লোকের মৃত্যু হইতেছিল যে, মৃতদেহের সৎকার করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। পঁচা-দুর্গন্ধময় মৃতদেহ দেখিতে দেখিতে ভয়ানক ঘৃণার উদ্রেক হইল, ঘৃণার দ্বারা নগরে বিসুচিকা রোগের প্রাদুর্ভাব হইল। দুর্ভিক্ষ, রোগ ও অমুনষ্য উপদ্রব এই ত্রিবিধ ভয়ে সন্ত্রস্ত বৈশালীবাসী প্রজাসাধারণ রাজার নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাদের অসহ্য দুঃখ-কাহিনী বিবৃত করিতেছিলেন-
“মহারাজ, নগরে ত্রিবিধ ভয় উৎপন্ন হইয়াছে। ইতিপূর্বে রাজ-পরম্পরা সাত রাজার রাজত্ব কাল পর্য্যন্ত এরূপ দুর্দশা দেখা যায় নাই। আমাদের মনে হয়- ইহা আপনার অধার্মিকতার দ্বারাই ঘটিতেছে।” এতদশ্রবণে রাজা উদ্বিগ্ন চিত্তে মন্ত্রণাগৃহে সম্মিলিত হইয়া বলিলেন- “তোমরা আমার অধার্মিকতা সম্বন্ধে বিবেচনা করিয়া দেখ।” তাহারা সকলে বিচার করিয়া রাজার কোনও দোষ দেখিতে পাইলেন না।
অতঃপর তাহারা রাজার কোন প্রকার দোষ দেখিতে না পাইয়া ভাবিতে লাগিলেন- “কি প্রকারে আমাদের এই দুর্দশার অবসান হইবে?” তথায় কেহ কেহ বলিতে লাগিল- পুরাণ কশ্যপ, মক্ষলি গোশাল প্রভৃতি আজীবক (সন্ন্যাসী) শাস্তাগণ আছেন। তাহাদের পদধূলি পড়িলেই বৈশালীর মঙ্গল হইবে। অপর কেহ কেহ বলিতে লাগিল- “জগতে বুদ্ধ উৎপন্ন হইয়াছেন। সেই ভগবান সমস্ত প্রাণীর হিতের জন্য ধর্মোপদেশ করিয়া থাকেন। তিনি মহাঋদ্ধিবান, মহাপ্রভাবশালী। তাঁহার পদার্পণেই আমাদের সমস্ত ভয় তিরোহিত হইয়া যাইবে।”
‘বুদ্ধ’ এই নাম শুনিয়া তাহারা সকলে আনন্দিত হইয়া বলিতে লাগিল- “ভগবান বুদ্ধ সম্প্রতি কোথায় অবস্থান করিতেছেন? আমরা যদি লোক প্রেরণ করি, তিনি আসিবেন কি?” এ প্রস্তাবে অপর কেহ কেহ বলিতে লাগিল- “বুদ্ধগণ লোকের প্রতি অনুগ্রহকারী, কেন আসিবেন না?” তিনি এখন রাজগৃহে আছেন, মহারাজ বিম্বিসার তাঁহার সেবা করেন। তিনি যদি আসিতে বাধা না দেন, তবে অবশ্যই আসিবেন। “তাহা হইলে রাজাকে জানাইয়া আনয়ন করিব।” এই ভাবিয়া তাহারা দুইজন লিচ্ছবিকুমারকে সৈন্যবাহিনীসহ প্রভূত উপঢৌকন দিয়া রাজা বিম্বিসারের নিকট পাঠাইলেন এবং বলিলেন “রাজা বিম্বিসারকে বলিয়া ভগবানকে লইয়া আস।” তাঁহারা রাজগৃহে যাইয়া, রাজা বিম্বিসারকে তাঁহাদের উপঢৌকন প্রদান পূর্বক মনোবাঞ্চা নিবেদন করিলেন। রাজা তাঁহাদের অনুরোধ রক্ষা করিতে অসমর্থ হইয়া কহিলেন- “ইহা তোমরাই বুঝিতে পার।”
তাঁহারা ভগবানের চরণে উপনীত হইয়া প্রার্থনা করিলেন- “ভন্তে, আমাদের নগরে ত্রিবিধ ভয় উৎপন্ন হইয়াছে, যদি করুনাধার ভগবান করুনা করিয়া একবার বৈশালীতে শুভপদার্পন করেন, আমাদের অশেষ কল্যাণ সাধিত হইবে।”
তখন ভগবান সর্বজ্ঞতা প্রভাবে চিন্তা করিয়া দেখিতে পাইলেন- “আমি যদি বৈশালীতে ‘রত্নসূত্র’ দেশনা করি, তাহা হইলে ইহা কোটি শত সহস্র চক্রবালের রক্ষাদ- সদৃশ হইবে এবং চুরাশী হাজার প্রাণীর ধর্মজ্ঞান উৎপন্ন হইবে।” এই চিন্তা করিয়া ভগবান তাঁহাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন।
রাজা বিম্বিসার ভগবান নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিয়াছেন জানিয়া যথোচিত উৎসব এবং ধুমধামের সহিত আগু বাড়াইয়া দিলেন। আর বৈশালীবাসীর ও রাস্তা-ঘাট সুসজ্জিত করিয়া স্তসম্মানে ভগবান বুদ্ধকে আগু বাড়াইয়া লইলেন। ভগবান বৈশালীর সীমায় পৌঁছিলে লিচ্ছবিগণ রাজা বিম্বিসারের চেয়ে দ্বিগুণ পূজা করিলেন।
সেই সময় আকাশ হঠাৎ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল এবং বিদ্যুৎ চমকিয়া গড় গড় শব্দে মেঘ গর্জ্জন করিতে করিতে বারিবর্ষণ আরম্ভ করিল। মূষলধারে বারিবর্ষণের ফলে যেই জলপস্নাবন হইয়া ছিল, তাহা দ্বারা বৈশালীর দুর্গন্ধ মৃতদেহ ভাসিয়া গিয়া ভূভাগ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়া গেল। ভগবান যখন বৈশালীতে উপনীত হইলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবপরিজন পরিবৃত হইয়া তথায় উপস্থিত হইয়াছিলেন। মহাপ্রভাবশালী দেবতাগণের আবির্ভাবে প্রেত-পিশাচাদি অমনুষ্যদের অনেকে অন্তর্হিত হইয়া গেল।
অতঃপর ভগবান বুদ্ধ, প্রিয় শিষ্য আনন্দ স্থবিরকে ডাকিয়া কহিলেন- “আনন্দ, এই ‘রত্নসূত্র’ শিক্ষা করিয়া ধর্মপূজার উপকরণ সমূহ গ্রহণ করাইয়া লিচ্ছবি কুমারগণসহ বৈশালী নগরে তিনটি প্রাকারের অন্তরে বিচরণ করিতে করিতে আবৃত্তি কর।” কোটিলক্ষ চক্রবালের দেবতাগণ সেই ‘রতন সূত্রের’ আদেশ পালনে বাধ্য হয়। তাহারই প্রভাবে বৈশালীর রোগভয়, অমনুষ্য ভয় ও দুর্ভিক্ষভয় শীঘ্রই অন্তর্হিত হইয়া যাইবে। স্থবির আনন্দ ভগবানের আদেশে পরিত্রাণ পাঠ করিতে করিতে ভগবানের ব্যবহৃত পাত্রে জল লইয়া সমস্ত নগরে ছিটাইয়া ছিটাইয়া বিচরণ করিয়াছিলেন। এই জন্য ভূমিকায় বলা হইয়াছে “বেসালিযা পুরে তিসু পাকারন্তরেসু …… আযস্মা আনন্দথোরো বিয কারুঞ্‌ঞচিত্তং উপট্‌ঠপেত্বা।”

👉রত্ন সূত্রের ভূমিকা:
পণিধানতো পট্‌ঠায তথাগতস্স দস পারমিযো, দস উপপারমিযো, দস পারমত্থ-পারমিযো’তি। সমতিংস পারমিযো পঞ্চ মহাপরিচ্চাগে লোকাত্থচরিযং ঞাতত্থচরিযং বুদ্ধত্থচরিযন্তি তিস্‌সো চরিযাযো, পচ্ছিমভবে গব্‌ভোক্কনিত্মং জাতিং অভনিক্‌খমনং পধানংচরিযং বোধিপল্লঙ্কে মার-বিজযং সব্বঞ্‌ঞূতা ঞানপটিবেধং ধম্মচক্কপবত্তনং নবলোকুত্তর ধম্মেতি, সব্বেপিমে বুদ্ধগুণে আবজ্জেত্বা বেসালিযা পুরে তিসু পাকারন্তরেসু তিযামরত্তিং পরিত্তং করোন্তো আযস্মা আনন্দ থোরো বিয কারুঞ্‌ঞচিত্তং উপট্‌ঠাপেত্বা;
কোটিসতসহস্‌সেসু চক্কবালেসু দেবতা,
যস্সনম্পাটিগ্গণ্‌হন্তি যঞ্চ বেসালিয়া পুরে।
রোগমনুস্স-দুব্‌িভক্‌খ-সম্ভুতং তিবিধং ভযং,
খিপ্পমন্তরধপেসি পরিত্তং তং ভণাম হে।

অনুবাদঃ- ভগবান গৌতম বুদ্ধ সুমেধ তাপস জন্মে অমরাবতী নগরে ভগবান দীপঙ্কর বুদ্ধের পদতলে পতিত হইয়া বুদ্ধত্ব লাভের যে প্রার্থনা করিয়াছিলেন, সেই প্রার্থনা হইতে আরম্ভ করিয়া তথাগতের দশ পারমিতা (দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, প্রজ্ঞা, বীর্য্য, ক্ষান্তি, সত্য, অধিষ্ঠান, মৈত্রী ও উপেক্ষা), দশ উপপারমিতা (অধম ভাবে পূর্ণ দশ পারমিতা), দশ পরমার্থ পারমিতা (উক্ত দশপারমিতা উত্তমরূপে পূর্ণ হইলে পরমার্থ পারমিতা হয়), মোট ত্রিশটি পারমিতা; পঞ্চ মহাদান, জগতের হিতাচরণ; জ্ঞাতিগণের হিতাচরণ, বুদ্ধ হওয়ার জন্য সদাচরণ, এই তিন প্রকার আচরণ, শেষ জন্মে অর্থাৎ যে জন্মে বুদ্ধ হইয়াছিলেন সে জন্মে মায়ের গর্ভে প্রবেশ, জন্ম, সংসার ত্যাগ, কঠোর তপস্যা, বোধিবৃক্ষের মূলে মার-বিজয়, সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ, ধর্মচক্রপ্রবর্তন ও নবলোকোত্তর ধর্ম প্রচার ইত্যাদি সকল প্রকার বুদ্ধগুণ স্মরণ করিয়া বৈশালী নগরের প্রাচীরত্রয়ের মধ্যে তিন প্রহর রাত্রি পরিত্রাণ পাঠকারী আয়ুষ্মান আনন্দ স্থবিরের মত করুনা পূর্ণ চিত্তে আমারা-
শত সহস্র কোটি চক্রবালবাসী দেবতাগণ যেই রত্নসূত্রের আদেশ প্রতিপালন করেন এবং সেই রত্নসূত্র পাঠে বৈশালী নগরীতে রোগ, অমনুষ্য ও দুর্ভিক্ষ এই তিন প্রকার ভয় শীঘ্রই দুরীভূত হইয়াছিল, সেই রত্নসূত্র (পরিত্রাণ) পাঠ করিতেছি।

সূত্রারম্ভ
————-
(১) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
সব্বে ভুতা সুমনা ভবন’
অথোপি সক্কচ্চ সুনন’ ভাসিতং।
অনুবাদঃ- ভূমিবাসী ও আকাশবাসী যে সকল প্রাণী এখানে সমাগত হইয়াছ, তোমরা সকলেই সন্তুষ্ট হও এবং আমার দেশিত বাক্য মনোযোগের সহিত শ্রবণ কর।
(২) তস্মাহি ভুতা নিসামেথ সব্বে
মেত্তং করোথ মানুসিযা পজায,
দিবা চ রত্তো চ হরন্তি যে বলিং
তস্মাহি নে রক্‌খথ অপ্পমত্তা।
অনুবাদঃ- (জগতে বুদ্ধবাক্য দুর্লভ) সেই হেতু তোমরা সকলে আমার উপদেশ মনোযোগ দিয়া শ্রবণ কর; মনুষ্যগণের প্রতি মৈত্রীচিত্ত পোষণ করিয়া তাহাদের হিত-সুখ কামনা কর; তাহারা দিবা-রাত্র তোমাদের উদ্দেশ্যে পুন্যদান করিয়া পূজা করে। এই কারণে তোমরা অপ্রমত্ত হইয়া তাহাদিগকে রক্ষা কর।
(৩) যং কিঞ্চি বিত্তং ইধ বা হুরং বা
সগ্‌গেসু বা যং রতনং পনীতং,
ননো সমং অত্থি তথাগতেন।
ইদম্পি বুদ্ধে রতনং পনীতং,
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- ইহলোক-পরলোকে অথবা স্বর্গ-ব্রহ্মাদিলোকে যাহা কিছু মূল্যবান মনি-রত্নাদি রত্ন আছে, তাহা তথাগত বুদ্ধের সমান নহে। সেই সকল রত্ন হইতে বুদ্ধরত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(৪) খযং বিরাগং অমতং পণীতং
যদজ্ঝগা সক্যমুনী সমাহিতো,
ন তেন ধম্মেন সমত্থি কিঞ্চি
ইদম্পি ধম্মে রতনং পণীতং,
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- সমাধিস্থ শাক্যমুনি বুদ্ধ যেই লোভ-দ্বেষ-মোহ ক্ষয় বিরাগ ও অনুপম নির্বাণামৃত পান করিয়াছেন, সেই নির্বাণ ধর্মের সমান কিছুই নাই। ত্রিলোকের সমস্ত মূল্যবান ধন বা রত্ন হইতে এই ধর্ম রত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের প্রভাবে স্বস্তি বা মঙ্গল হউক।
(৫) যং বুদ্ধসেট্‌ঠো পরিবন্নযী সুচিং
সমাধিমানন্তরিকঞ্‌ঞামাহু,
সমাধিনা তেন সমো ন বিজ্জতি।
ইদম্পি ধম্মে রতনং পণীতং,
অনুবাদঃ- ত্রিলোক শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ যেই শুচি (রাগ-দ্বেষাদি ময়লাহীন পবিত্র) লোকোত্তর মার্গ-সমাধির (মার্গচিত্তের) প্রশংসা করিয়াছেন এবং যেই মার্গ-চিত্ত-উৎপত্তির পরক্ষণেই বিনা অন্তরায়ে স্বাভাবিক নিয়মেই উহার ফল-চিত্ত উৎপন্ন হইয়া থাকে, এইরূপ পবিত্র আর্য্যমার্গ-সমাধির (মার্গ-চিত্তের) সমান অন্য কোনও সমাধি নাই অর্থাৎ আর্য্যমার্গ-জ্ঞান সদৃশ অন্য কোন জ্ঞান নাই। জাগতিক্‌ সমস্ত ধন বা রত্ন হইতে এই ধর্ম রত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের স্বস্তি বা শুভ হোক।
(৬) যে পুগ্গল অট্‌ঠসতং পসত্থা
চত্তারি এতানি যুগানি হোন্তি,
তে দক্‌খিনেয্যা সুগতস্স সাবকা
এতেসু দিন্নানি মহপ্‌ফলানি
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- যেই অষ্টবিধ আর্য্যপুদ্গলকে বুদ্ধাদি সৎপুরুষেরা প্রসংশা করিয়াছেন, যাঁহারা মার্গস’-ফলস্থ ভেদে চারিযুগ্ম ; যেই সুগত বুদ্ধের শ্রাবক বা শিষ্য দক্ষিণার উপযুক্ত পাত্র। সেই পুণ্যক্ষেত্র সংঘরত্নে দান করিলে মহাফল (মহৎপুণ্য) লাভ হয়। ইহা সংঘরত্নের শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা আমাদের শুভ বা কল্যাণ হউক।
(৭) যে সুপ্পযুত্তা মনসা দলহেন
নিক্কামিনো গোতম সাসনম্‌হি
তে পতিপত্তা অমতং বিগয্‌হ
লদ্ধা মুধা নিব্বুতিং ভূঞ্জমানা।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- বুদ্ধ শাসনে প্রব্রজিত হইয়া যাঁহারা শীলে সুপ্রতিষ্ঠিত সমাধিতে দৃঢ় (নিশ্চল) এবং বিদর্শন-ভাবনায় রাগ-দ্বেষ-মোহাদি ক্লেশমুক্ত হইয়াছেন, অথবা যাঁহারা শীল-সমাধি-বিদর্শনরূপ সাধন-পথে সাধন করিয়া অমৃতপথ (নির্বাণ) সাক্ষাৎকার করিয়াছেন। তাঁহারা এখন বিনামূল্যে লব্ধ নির্বাণ সুখ উপভোগ করিতেছেন অর্থাৎ তাঁহারা (অর্হৎগণ) ফল-সমাপত্তি (নির্বাণসমাধি) লাভ করিয়া নির্বাণ সুখ অনুভব করিতেছেন। ত্রিলোকের সমস্ত ধন বা রত্ন হইতে এই সংঘ রত্নই শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ বা মঙ্গল হউক।
(৮) যথিন্দখীলো পঠবিং সিতো সিযা
চতুব্‌িভ বাতেভি অসম্পকম্পিযো,
তথুপমং সপ্পুরিসং বদামি
যো অরিযসচ্চানি অবেচ্চ পস্সতি
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- ভূমিতে দৃঢ়রূপে প্রোথিত ইন্দ্রখীল (নগরদ্বারস্থ স্তম্ভবিশেষ) যেমন প্রবল বায়ুতেও কম্পিত হয় না। যিনি চতুরার্য্য সত্য প্রজ্ঞা-চক্ষুতে স্পষ্টরূপে দর্শন করিতেছেন, তেমন সেই সৎপুরুষকেও আমি উক্ত ইন্দ্রখীলের সহিত তুলনা করি (অর্থাৎ তিনিও ইন্দ্রখীলের ন্যায় অচল অটল)। ত্রিলোকের সমস্ত ধন বা রত্ন হইতে এই সঙ্ঘরত্ন ও শ্রেষ্ঠ। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের কল্যাণ বা মঙ্গল হউক।
(৯) যে অরিযসচ্চানি বিভাবযন্তি
গম্ভীর পঞ্‌ঞেন সুদেসিতানি,
কিঞ্চাপি তে হোন্তি ভুসপ্পমত্তা
ন তে ভবং অট্‌ঠমং আদিযন্তি।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- গভীর প্রাজ্ঞ বুদ্ধ কর্তৃক সুদেশিত চারি আর্য্যসত্যকে যাঁহারা জ্ঞানের গোচরীভূত করেন (জ্ঞান-চক্ষুতে দর্শন করেন) তাঁহারা প্রমাদবহুল হইলেও সংসারে আটবারের অধিক জন্মগ্রহণ করেন না- সপ্তম জন্মেই বিদর্শন ভাবনা করিয়া অরহত্ব-ফল লাভ করেন এবং আয়ুশেষে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন। সঙ্ঘরত্নের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদক এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের স্বস্তি বা কল্যাণ হউক।
(১০) সহাবস্স দস্সন সম্পদায
তযস্‌সু ধম্মা জহিতা ভবিন্ত,
সক্কাযদিট্‌ঠি বিচিকিচ্ছি তঞ্চ
সীলব্বতং বা’পি যদত্থি কিঞ্চি।
চতুহ’ পাযেহি চ বিপ্পমুত্তো
ছ চাভিট্‌ঠানানি অভব্বো কাতুং;
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- দর্শন সম্পদ অর্থাৎ স্রোতাপত্তি-মার্গ-জ্ঞান লাভের সঙ্গে সঙ্গেই সৎকায়দৃষ্টিসহ (অহং জ্ঞান) অপর যাহা কিছু মিথ্যাদৃষ্টি (৬২ প্রকার মিথ্যাদৃষ্টি), যাহা কিছু সংশয় (২৪ প্রকার সংশয়) এবং যাহা কিছু শীল-ব্রত (গোশীল গোব্রত, কুক্কুটশীল-কুক্কুটব্রতাদি নানাবিধ মিথ্যাশীল-মিথ্যাব্রত) এই তিন প্রকার মিথ্যা ধর্ম (সৎকায়-দৃষ্টি, সংশয় ও শীলব্রত) দূরীভূত হয়। তিনি চারি অপায় (নরক, তির্য্যক্‌যোনি, প্রেতলোক ও অসুরলোক) হইতে বিমুক্ত এবং ছয় প্রকার (মাতৃ-হত্যা, পিতৃহত্যা, অরহৎহত্যা, বুদ্ধের পাদ হইতে রক্তপাত, বুদ্ধের শরণ ব্যতীত অন্য শরণ গ্রহণ ও সঙ্ঘভেদ) মহাপাপ (গুরুতর পাপ) করা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। পার্থিব ধন বা রত্ন হইতে এই সঙ্ঘ রত্নও শ্রেষ্ঠ এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(১১) কিঞ্চাপি সো কম্মং করোতি পাপকং
কাযেন বাচা উদ চেতসা বা,
অভব্বো সো তস্স পটিচ্ছদায
অভব্বতা দিট্‌ঠপাদস্স বুত্তা।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- তিনি (স্রোতাপন্ন পুরুষ) কায়, বাক্য ও মনের দ্বারা পাপকর্মের অনুষ্ঠান করেন না; ভূলক্রমে ক্কচিৎ কোন ক্ষুদ্র পাপ করিলেও, তাহা গোপন করেন না। কারণ নির্বাণদর্শী স্রোতাপন্ন পুরুষের পক্ষে স্বভাবতঃ সামান্য পাপও গোপন করা সম্ভব নহে, ইহা সঙ্ঘ রত্নের শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের প্রভাবে তোমাদের শুভ হউক।
(১২) বনপ্পগুম্বে যথা ফুস্‌সিতগ্গে
গিম্‌হান মাসে পঠমস্মিং গিম্‌হে,
তথূপমং ধম্মবরং অদেসযী
নিব্বানগামিং পরমং হিতায।
ইদম্পি বুদ্ধে রতনং পণীতং,
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- গ্রীষ্মঋতুর প্রথম মাসে (চৈত্রমাসে, বসন্তকালে) বন-গুল্মে বৃক্ষ-লতাদির শাখা-প্রশাখাসমূহ যেমন প্রস্ফুটিত নানা ফুলে শোভিত হয়, সেইরূপ স্কন্ধ, আয়তন, ধাতু, ইন্দ্রিয়, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি নানাবিধ হিতকর ধর্মবিষয়ে পরিশোভিত ও নির্বাণগামী মার্গদীপক ত্রিপিটক ধর্মদেব, মনুষ্যাদি জীবগণের হিতের জন্য ভগবান বুদ্ধ প্রচার করিয়াছেন। বুদ্ধরত্নের ইহাই শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(১৩) বরো বরঞ্‌ঞু বরদো বরাহরো,
অনুত্তরো ধম্মবরং অদেসযী,
ইদম্পি বুদ্ধে রতনং পণীতং
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- বর (শ্রেষ্ঠ), বরজ্ঞ, (নির্বাণজ্ঞ), বরদ (বিমুক্তি শান্তি দাতা) বরাহর (উত্তম প্রতিপদা বা মার্গ আহরণকারী), অনুত্তর (শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ) শ্রেষ্ঠ ধর্ম প্রচার করিয়াছেন অর্থাৎ বহুকল্প দুষ্কর সাধনা করিয়া ভগবান বুদ্ধ যেই নির্বাণ ধর্ম লাভ করিয়াছেন, তাহা তিনি সর্বলোকের হিতের জন্য জগতে প্রচার করিয়াছেন বিশেষার্থ এইঃ- শ্রেষ্ঠ বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ নির্বাণ ও নির্বাণলাভের শ্রেষ্ঠ প্রতিপদা (মার্গ) দেশনা করিয়াছেন- প্রচার করিয়াছেন সর্বজীবের মুক্তির জন্য। ইহা বুদ্ধরত্নের শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের মঙ্গল হউক।
(১৪) খীণং পুরাণং নবং নত্থি সম্ভবং
বিরত্তচিত্তা আযাতিকে ভবস্মিং,
তেন খীনা বীজা অবিরূল্‌হিচ্ছন্দা
নিব্বন্তি ধীরা যথা’যং পদীপা।
ইদম্পি সঙ্ঘে রতনং পণীতং,
এতেন সচ্চেন সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- যাঁহারা অরহত্ব-ফল প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের পুরাতন কর্ম ক্ষীণ (বিনষ্ট) হইয়াছে, আর নূতন কর্মের উৎপত্তি নাই, পুনর্জন্মে তাঁহাদের আসক্তি নাই, তাঁহাদের পুনর্জন্মের কর্ম-বীজ বিনষ্ট এবং তৃষ্ণামূল উৎপাটিত হইয়াছে। সেই জ্ঞানবান অরহৎগণ এই প্রদীপের ন্যায় নির্বাপিত হইয়া থাকেন। সঙ্ঘরত্নের ইহাই শ্রেষ্ঠতা। এই সত্য বাক্যের দ্বারা তোমাদের শুভ হউক।
(১৫) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
তথাগতং দেবমনুস্স- পুজিতং
বুদ্ধ নমস্‌সাম সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- তৎপর দেবরাজ ইন্দ্র বলিলেন;- ভূমিবাসী বা আকাশবাসী যেই সমস্ত ভূত বা সত্ত্বগণ এখানে সমাগত হইয়াছে, আস সকলে সম্মিলিত হইয়া দেব-মনুষ্যাদি সকলের পূজনীয় তথাগত বুদ্ধকে নমস্কার করি। এই নমস্কারের প্রভাবে সকলের শুভ হউক।
(১৬) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
তথাগতং দেবমনুস্স-পুজিতং
বুদ্ধং নমস্সম সুবত্থি হোতু।
(১৭) যানীধ ভুতানি সমাগতানি
ভুম্মানি বা যানিব অন্তলিক্‌খে,
তথাগতং দেবমনুস্স-পুজিতং
সঙ্ঘং নমস্সম সুবত্থি হোতু।
অনুবাদঃ- ১৬ ও ১৭ নম্বর গাথা দুইটির অনুবাদও ১৫ নম্বর গাথার অনুবাদের মত। কেবল ‘বুদ্ধকে’ স্থলে ‘ধর্মকে’ ও ‘সঙ্ঘকে নমস্কার করি এই মাত্র প্রভেদ। শেষ গাথা তিনটি দেবরাজ ইন্দ্র বলিয়াছিলেন। এই সূত্র দেশনার ফলে বৈশালী নগরীতে সুবৃষ্টি হইয়াছিল। দুর্ভিক্ষভয়াদি যাবতীয় উপদ্রবের উপশম এবং নগরবাসী সকলের মঙ্গল হইয়াছিল।

সুত্রঃ প্রজ্ঞামিত্র বৌদ্ধ ভিক্ষু-শ্রামণ প্রশিক্ষন নামক ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত

বৌদ্ধ ইতিহাসের মহাউপাসিকা বিশাখা

বৌদ্ধ ইতিহাসের মহাউপাসিকা বিশাখা

বুদ্ধের সময় অঙ্গরাজ্যের ভদ্দিয় নগরে উচ্চবংশজাত ধনবান এক উপাসক ছিলেন।তাঁর নাম ছিল মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী। ধনঞ্জয় নামে তাঁর এক পুত্র ছিলেন।তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল সুমনাদেবী।তাঁরা অত্যন্ত ধার্মিক এবং দান ও সেবাপরায়ণ ছিলেন।তাঁদেরই কোন আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন বিশাখা।ছোটকাল থেকে বিশাখা অত্যন্ত উদার প্রকৃতির ছিলেন।দান ও বিবিধ কল্যাণকর্মের জন্য তাঁর খুবই সুখ্যাতি ছিল।দানকর্ম ও ভিক্ষুসঙ্ঘকে সেবা করার জন্য বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

এক সময় সেল নামক এক ব্রাহ্মণ ও তাঁর অনুগামী প্রায় তিন শতাধিক শিষ্যকে দীক্ষা প্রদানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বুদ্ধ সশিষ্য ভদ্দিয় নগরে এসেছিলেন।বুদ্ধের আগমন উপলক্ষে বিশাখার পিতামহ মেন্ডক শ্রেষ্ঠী বিশাখাকে নিয়ে বুদ্ধ দর্শনে গিয়েছিলেন।তখন বিশাখার বয়স ছিল সাত বছর।বিশাখার সাথে ছিল পাঁচশত সখী, পাঁচশত পরিচারিকা এবং পাঁচশত সুসজ্জিত রথ।বিশাখার সুযোগ হয় বুদ্ধকে কাছে গিয়ে বন্দনা করার।বুদ্ধ বিশাখার জন্মান্তরে অর্জিত পুণ্যরাশি অবগত হয়ে তাঁকে ধর্ম দেশনা করেন।উপস্থিত সকলে গভীর শ্রদ্ধাচিত্তে বুদ্ধের ধর্মোপদেশ শ্রবণ করেন।মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী শ্রদ্ধাবণত হয়ে ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বুদ্ধকে পরদিন তাঁর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন গ্রহণের জন্য নিমন্ত্রণ করেন।বুদ্ধ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং পরদিন যথাসময়ে তিনি সশিষ্য মেণ্ডক শ্রেষ্ঠীর গৃহে উপস্থিত হন।মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বুদ্ধকে উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য দ্বারা আপ্যায়ন করেন।বুদ্ধ তাঁদের ধর্ম দেশনা করেন।এতে বিশাখাসহ মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী পরিবারের সদস্যরা অপার আনন্দ মেণ্ডক শ্রেষ্ঠীর গৃহে উপস্থিত হন।মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বুদ্ধকে উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য দ্বারা আপ্যায়ন করেন।বুদ্ধ তাঁদের ধর্ম দেশনা করেন।এতে বিশাখাসহ মেণ্ডক শ্রেষ্ঠী পরিবারের সদস্যরা অপার আনন্দ অনুভব করেন।তাঁরা ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বুদ্ধকে আরও পনেরো দিনের জন্য নিমন্ত্রন করলেন।বুদ্ধ তাঁদের শ্রদ্ধা বক্তি দেখে সম্মতি প্রদান করেন।ফলে শৈশব কালেই বিশাখা বুদ্ধের ধর্ম দেশনা শ্রবণ এবং বুদ্ধকে সেবা করার এক অপূর্ব সুযোগ লাভ করেন।

কালক্রমে বিশাখা বিবাহযোগ্যা হয়ে ওঠেন।পিতামাতার তার বিয়ের জন্য তৎপর হলেন।সে সময় শ্রাবস্তীতে মিগার নামে এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন।তাঁর পূণ্যবর্ধন নামে এক পুত্র ছিল।পারিবারিক উদ্যোগে পুণ্যবর্ধনের সঙ্গে বিশাখার বিয়ে হয়্। বিশাখার বাবা বিশাখাকে বহু দাসদাসী, রথ ও মহামূল্য মণিমুক্তা উপহার উপহার দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পাঠান।শ্বশুরালয়ে পরস্পর শান্তি ও সম্প্রীতিতে বাসবাসের জন্য বিশাখার পিতা বিশাখাকে দশটি উপদেশ প্রদান করেন।এই দশটি উপদেশ সর্বজনীন উপদেশ হিসেবে উপদেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়।এ দশটি উপদেশ হলো :


১. ঘরের আগুন বাহিরে নিয়ো না।অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ির কারো দোষ দেখলে তা বাইরের কাউকে বলবে না।
২. বাইরের আগুন ঘরে এনো না।অর্থাৎ প্রতি্বেশী কেউ শ্বশুরবাড়ির কারো দোষের কথা বললে তা তোমার শ্বশুরবাড়ির কারো কাছে প্রকাশ করো না।
৩. যে দেয় তাকে দেবে।অর্থাৎ কেউ কিছু ধার নিয়ে ফেরত দিলে তাকে ধার দেবে।
৪. যে দেয় না তাকে দিয়ো না।অর্থাৎ যে-ব্যক্তি কোনকিছু ধার নিয়ে ফেরত দেয় না তাকে ধার দিয়ো না।
৫. যে দেয় অথবা না দেয় তাঁকে দেবে।অর্থাৎ কোনো আত্মীয় গরিব হলে, ধার নিয়ে ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে তাকেও ধার দিয়ো।
৬. সুখে আহার করবে।অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ির গুরুজনদের খাওয়া শেষ হলে এবং অন্যান্যদের খাওয়া সম্পর্কে খবর নিয়ে তারপর নিজের আহার গ্রহন করবে।
৭. সুখে উপবেশন করবে।অর্থাৎ এমন স্থানে বসবে যে স্থান থেকে গুরুজনদের দেখে উঠতে না হয়।
৮. সুখে শয়ন করবে।অর্থাৎ যাবতীয় গৃহকর্ম সমাধা করে গুরুজনদের শয়নের পর শয়ন কর।
৯. অগ্নির পরিচর্যা করবে।অর্থাৎ গুরুজন ও ছোটদের সচেতনার সাথে প্রয়োজনীয় সেবা শুশ্রূষা করবে।
১০. শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী প্রভৃতি গুরুজনদের দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে।
বিবাহ অনুষ্ঠানসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে আজও এই উপদেশসমূহ প্রদান করা হয়।পারিবারিক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে এ উপদেশগুলোর ভূমিকা অপরিসীম।

বিশাখার শ্বশুর মিগার শ্রেষ্ঠী এ বিয়েতে সাত দিনব্যাপী উৎসব পালন করেন।কোশলরাজ প্রজেনজিতসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এ বিয়েতে যোগদান করেছিলেন।


বিশাখা শ্বশুরালয়ে সমস্ত কাজ নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করার চেষ্টা করতেন।এতে শ্বশুর-শ্বাশুড়িও তাঁর প্রতি খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন।কিন্তু মিগার শ্রেষ্ঠী ছিলেন ‍কিছু ভ্রান্তধারার অনুসারী সন্ন্যাসীর ভক্ত।এ সন্ন্যাসীরা বিবস্ত্র থাকতেন।মিগার শ্রেষ্ঠীর গৃহে তারা প্রায় আসতেন।একদিন গুরুপূজা উপলক্ষে মিগার শ্রেষ্ঠী বিশাখাকে তাঁদের সামনে নিয়ে যান।বিশাখা দেখলেন গুরু সম্পূর্ণ বিবস্ত্র।বিশাখা এতে বিরক্তি প্রকাশ করেন।সন্ন্যাসীরা বিশাখার ভাব বুঝতে পারেন।তাঁরা শ্রেষ্ঠীকে বললেন, এই রমণী গৌতমের শিষ্যা, এক ঘর থেকে বের করে দাও।তা না হলে তোমার সর্বনাশ হবে।এতে শ্রেষ্ঠী খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েন।

একদিন মিগার শ্রেষ্ঠী মহাপালঙ্কে বসে মধুপায়েস খাচ্ছিলেন।এমন সময় এক পিণ্ডাচারী বৌদ্ধভিক্ষু মিগার শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে ভিক্ষার জন্য আসেন।শ্রেষ্ঠী তাঁকে দেখেও কোনোকিছু দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন না।শ্বশুরের অনুমতি ছাড়া বিশাখার পক্ষেও কোনোকিছু দেওয়া সম্ভব না।তখন বিশাখা আগন্তুক ভিক্ষুকে বললেন, ভন্তে, আপনি অন্যত্র যান।আমার শ্বশুর বাসি খাবার খাচ্ছেন।মিগার শ্রেষ্ঠী একথা শুনে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন।বিশাখাকে বললেন, তুমি এ বাড়ি থেকে চলে যাও।তিনি বিশাখাকে বের করে দিতে দাসদাসীদের আদেশ দিলেন।কিন্তু বাড়ির অন্তঃপুরের সকলেই ছিল বিশাখার ভক্ত।একথা শুনে বিশাখা বললেন, আমি ক্রীতদাসী নই, আমাকে ইচ্ছা করলে তাড়িয়ে দেয়া যায় না।আমার পিতা আটজন সম্ভ্রান্ত নীতিজ্ঞলোককে সাক্ষী করেই আমাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়েছেন।তাঁদের আহ্বান করুন।তাদের বিচারে দোষী হলে আমি চলে যাব।অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে আমি শ্বশুরালয় ত্যাগ করব না।ক্রোধগ্রস্ত মিগার শ্রেষ্ঠী সাক্ষীদের আহ্বান করলেন।তাঁরা বিশাখাকে কেন ঐরূপ ব্যবহার করলেন তা জানতে চান।উত্তরে বিশাখা বললেন, আমার শ্বশুর ‘বাসি’ খাবার খাচ্ছেন বলার অর্থ এই যে, তিনি পূর্বজন্মের পুণ্যফলের প্রভাবে অর্জন করা খাবার খাচ্ছেন।নীতিজ্ঞলোকদের বিচারে বিশাখার জয় হয়।


আর একদিন রাতে বিশাখা ঘরের বাতি হাতে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন।শ্রেষ্ঠী এর কারণ জানতে চাইলেন।বিশাখা বললেন, ঘোড়ার বাচ্চা প্রসবের খবর পেয়ে দাসীদের নিয়ে আলো হাতে তিনি অশ্বশালায় গিয়েছিলেন।তখন শ্রেষ্ঠী বললেন, তোমার পিতা তোমাকে ঘরের আগুন বাইরে নিতে নিষেধ করেছিলেন না?তাঁর উপদেশ তুমি অমান্য করলে কেন?বিশাখা বললেন, হ্যাঁ, নিষেধ করেছিলেন।কিন্তু তাঁর উপদেশ আমি অমান্য করিনি।সেই উপদেশ অনুসারেই আমি চলছি।ঘরের আগুন বাইরে না নেয়া বলতে তিনি বুছিয়েছেন, শ্বশুরবাড়ির কোনো কথা বাইরের লোকের কাছে প্রকাশ না করা।আমি নিজ গৃহের নিন্দা ও কুৎসা বাইরে প্রকাশ করি না।এসময় বিশাখা তাঁর বাবার অমান্য উপদেশগুলোও শ্বশুরকে ব্যাখ্যা করেন।মিগার শ্রেষ্ঠী তখন নিজের ভুল বুঝতে পানে।

এদিকে বিশাখা বারবার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ায়া পিত্রালয়ে চলে যাবার জন্য মনস্থির করলেন।বিশাখা শ্বশুরকে বললেন, এখন আমি পিতৃগৃহে চলে যেতে প্রস্তুত।তখন মিগার শ্রেষ্ঠী নিজের দোষ স্বীকার করেন এবং বিশাখাকে পিত্রালয়ে চলে যাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বারবার অনুরোধ করতে থকেন।শ্বশুরের এ বিনীতভাব দেখে বিশাখা বললেন, আপনি বিবস্ত্র সন্ন্যাসীদের ভক্ত।আমি ত্রিরত্নের উপাসিকা।বুদ্ধশাসনে গভীর শ্রদ্ধাসন্পন্ন কুলের কন্যা আমি।ভিক্ষুসঙ্ঘের সেবা না করে আমি থাকতে পারি না।যদি আমাকে নিজের অভিরুচি অনুযায়ী দান করতে এবং ধর্মকথা শুনতে অনুমিত দেন তাহলে আমি থাকতে পারি।মিগার শ্রেষ্ঠী তাঁর কথায় রাজি হলেন।

এর অল্পদিন পরে বিশাখা ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বুদ্ধকে তাঁর গৃহে নিমন্ত্রণ করেন।বুদ্ধ সশিষ্য মিগার শ্রেষ্ঠীর বাড়িতে যাচ্ছেন এ খবর পেয়ে বিবস্ত্র সন্ন্যাসীরও এসে বাড়ির বাইরে অবস্থান নেন।তাঁদের শঙ্কা মিগার শ্রেষ্ঠী বুদ্ধের দীক্ষা নিলে তাঁরা দান-দক্ষিণা থেকে বঞ্চিত হবেন।এ ভয়ে তাঁরা মিগার শ্রেষ্ঠীকে ভিক্ষুদের সাথে দেখা করতে নিষেধ করেন।তাঁদের উপদেশ মতো মিগার শ্রেষ্ঠী ভিক্ষুদের দেখে নিজের কক্ষে বসে রইলেন।বিশাখা যাবতীয় দান সাজিয়ে শ্বশুরকে ডাকলেন।কিন্তু শ্রেষ্ঠী বিবস্ত্র সন্ন্যাসীদের কথামতো দানকাজ শেষ করতে বলেন।বিশাখা সশ্রদ্ধ চিত্তে বুদ্ধসহ ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করেন।দানকর্ম সম্পন্ন হলে বিশাখা ধর্মকথা শুনতে শ্বশুরকে আহ্বান করেন।শ্রেষ্ঠী তখন ভাবলেন, এখন না হলে খুব অভদ্রতা হবে।এরূপ চিন্তা করে তিনি যেতে উদ্যত হলেন।এ সময় বিবস্ত্র সন্ন্যাসীরা বললেন, শ্রমন গৌতমের ধর্ম শুনলে পর্দার আড়াল থেকে শুনবে।কারণ এই সন্ন্যাসীরা মনে করতেন বুদ্ধের মায়াবী ক্ষমতা আছে।সেই মায়ার বলে মিগার শ্রেষ্ঠীকে মুগ্ধ করে তাঁর শিষ্য করে নেবেন।


সন্ন্যাসীদের নির্দেশমতো মিগার শ্রেষ্ঠী পর্দার আড়ালে গিয়ে বসলেন।বুদ্ধ বললেন, শ্রেষ্ঠী আপনি পর্দার অন্তরালে, প্রাচীরের অন্তরালে, পাহাড়ের অন্তরালে অথবা দিকচক্রবালের অন্তরালে যেখানেই বসুন না কেন, আমার শব্দ সর্বত্র ঘোষিত হবে।এই বলে মহাকারুণিক বুদ্ধ ধর্মদেশনা শুরু করলেন।প্রথমে শ্রেষ্ঠীর আগ্রহ না থাকলেও ক্রমে তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন।বুদ্ধের দেশনা শেষ হলে শ্রেষ্ঠী স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হন।তারপর তিনি বুদ্ধের সামনেই পুত্রবধূ বিশাখাকে জ্ঞানদায়িনী মাতা বলে সম্বোধন করে বললেন, মাতা তুমি এতদিনে এই সন্তানকে উদ্ধার করলে।সেই থেকে বিশাখাকে ‘মিগারমাতা’ নামে অভিহিত করা হয়।

এরপর হতে মিগার শ্রেষ্ঠীর গৃহে বিশাখার উদ্যোগে ভিক্ষুসঙ্ঘের নিত্য মধ্যাহ্ন আহারের ব্যবস্থা করা হয়।শ্রেষ্ঠী নিজেও বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন।বিশাখা আঠারো কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয়ে শ্রাবস্তীতে একটি বিশাল বিহার নির্মাণ করে বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করেছিলেন।এটিকে পূর্বারাম বিহার বলা হয়।এ বিহার নির্মাণ কাজে তদারকি করার জন্য বিশাখা বুদ্ধের অগ্রশ্রাবক মৌদগল্যায়নের সহযোগিতা প্রার্থনা করেছিলেন।মৌদগল্যায়ন পাঁচশত শিষ্যসহ বিহার নির্মাণে সহায়তা করেন।কথিত আছে যে, মৌদগল্যায়ন নিজের ঋদ্ধিশক্তির প্রভাবে মাত্র নয় মাসে বিহার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করান।দ্বিতলবিশিষ্ট এ বিহারের কক্ষের সংখ্যা ছিল এক হাজার।প্রত্যেকটি কক্ষ বিশাখা নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে দিয়েছেলেন।এ বিহার দান উপলক্ষে চারমাস ব্যাপী উৎসব হয়েছিল।এর জন্য বিশাখাকে আরও নয় কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যায় করতে হয়েছিল।বুদ্ধ পূর্বারাম বিহারে বিভিন্ন সময়ে ছয় বর্সাবাসব্রত পালন করেছিলেন।সে সময় বিশাখা নিত্যকর্মের মতো প্রতিদিন তিনবার খাদ্যভোজ্য, প্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য ও ধূপ ইত্যাদি নিয়ে বিহারে যেতেন।এক সময় বিশাখা বুদ্ধের কাছে আটটি বর প্রার্থনা করেন।বুদ্ধ তা অনুমোদন করেছিলেন, এ বর গুলো বিশাখার ত্যাগ মহিমার নুতন দিক উন্মাচিত করেছে।বরগুলো হলো :

১. বিশাখা আজীবন বুদ্ধের কাছে আগত যে কোনো অতিথি ভিক্ষুর আহার্য দান করবেন।
২. বিশাখা আজীবন ভিক্ষুসঙ্ঘকে স্নানবস্ত্র প্রদান করবেন।
৪.বিশাখা আজীবন অসুস্থ ভিক্ষুর যাবতীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৫.বিশাখা আজীবন অসুস্থ ভিক্ষুদের পরিচর্যাকারীদেরও আহার্য দান করবেন।
৬.বিশাখা আজীবন বিহারের অসুস্থ ভিক্ষুকদের জন্য প্রয়োজনীয় পথ্য সরবরাহ করবেন।
৭. বিশাখা আজীবন ভিক্ষুদের যাগু-অন্ন দান করবেন।
৮. বিশাখা আজীবন ভিক্ষুদের স্নানবস্ত্র প্রদান করবেন।
বিশাখার এ বরপ্রার্থনার মধ্যে তাঁর গভীর দানচেতনা ও উদারতার প্রকাশ ঘটেছে।এভাবে বিশাখা সানন্দে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসঙ্ঘের সেবায় নিয়োজিত হয়ে অপরিসীম পুণ্য সঞ্চয় করেন।বিশাখার বাড়িতে প্রত্যহ পাঁচশত ভিক্ষু আহার গ্রহণ করতেন।বিশাখার দশ পুত্র ও দশ কন্যা ছিল।তাঁদের প্রত্যেকেরও দশটি করে সন্তান ছিল।এভাবে তাঁরা সবাই বলশালী ও সম্পদশালী হয়ে সুখে বাস করতেন।বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে বিশাখা ‘মহা উপাসিকা’ নামে খ্যাত হন।এই মহাউপাসিকার জীবনী হতে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, ভোগ নয়, ত্যাগেই মানুষকে মহৎ ও মহান করে। তাই সকলের দান ও ত্যাগের আদর্শে উজ্জীবিত হওয়া উচিত।

সুত্রঃ ধর্ম বিশুদ্ধির ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত ।

বুদ্ধের দৃষ্টিতে সপ্ত আর্যধন, সংকলনে- মুদিতারত্ন ভিক্ষু

বুদ্ধের দৃষ্টিতে সপ্ত আর্যধন, সংকলনে- মুদিতারত্ন ভিক্ষু

বুদ্ধ সমকালীন যাঁরা ধনী বা শ্রেষ্ঠী ছিলেন, বুদ্ধ তাঁদেরকে প্রশংসা করেননি প্রকৃত ধনী বলে। দীন-দরিদ্র পথের ভিখারী হয়েও যাঁরা ‘শ্রদ্ধা, শীল, লজ্জা, ভয়, শ্রুতি, ত্যাগ ও প্রজ্ঞা’ এই সপ্ত আর্যধনে ধনী ছিলেন, তাঁদেরকেই তিনি যথার্থ ধনীপদে ভূষিত করতেন। যেমন উদাহরণ স্বরূপ-দীন-দরিদ্র কুষ্ঠরোগী সুপ্রবুদ্ধ। তার কারণ কি? যেহেতু এই সপ্ত আর্যধন ক্লেশ নিবারক, চিত্তশান্তি প্রদায়ক, জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর সংহারক ও নির্বাণ সংবর্তক। পরম শাশ্বত সুখের জন্যে মুক্তিকামী মানুষের যেই আয়াস, তা একমাত্র এই আর্যধনেই সুলভ্য। অপরদিকে স্থাবর জঙ্গম প্রভৃতি সম্পত্তির মালিক হয়ে শত ধনীশ্রেষ্ঠী হলেও তাতে দুঃখ বৈ সুখের আশা করা যায় না।
শ্রদ্ধার শ্রেনী বিন্যাস করতে গিয়ে একে ‘আগম, অধিগম, অকম্পন ও প্রসাদ’ ভেঙ্গে চারিধায় ভাগ করা হয়েছে। আগম শ্রদ্ধা বোধিসত্ত্বগণের নিকট বিদ্যমান থাকে। তাঁরা যেদিন প্রার্থনা স্থাপন করেন, সেদিনই অধিষ্ঠান করেন যে- আমাকে দানাদি সমত্রিংশ পারমী পূর্ণ করতে হবে। দানাদি পারমী পূর্ণ করা বোধিসত্ত্বগণের অবশ্যই কর্তব্য। পারমীর পূর্ণতা সাধন না হলে বোধিজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। তাই যতদিন পারমীর পূর্ণতা সাধন না হয়, ততদিন যাবৎ শ্রদ্ধাকে পুরোভাগে রেখে তাঁরা পারমী সকল পূর্ণ করেন। সুমেধ তাপস কালেও দেখা যায়-গৌতম বোধিসত্ব সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে অশীতি কোটি ধন-বিভব পরিত্যাগ করে ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর যদি ঐকান্তিক শ্রদ্ধা না থাকত, তবে এত ধন ত্যাগ করে ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। সুতরাং বোধিসত্ত্বগণের বোধিজ্ঞান লাভের জন্য যেই শ্রদ্ধা বলবৎ থাকে, উহা আগম শ্রদ্ধা নামে অভিহিত। সাধনাকালীন যতদিন সাধকের লোকোত্তর মার্গফল বা নির্বাণ সাক্ষাৎ না হয়, তাবৎ অচল অটলভাবে শ্রদ্ধা সহকারে ধ্যানের অনুশীলন করার নাম- অধিগম শ্রদ্ধা। বুদ্ধাদি শ্রদ্ধেয় বস্তুর প্রতি বা গুণের প্রতি প্রসন্ন হয়ে যে অচঞ্চল শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়, উহাকে বলে- অকম্পন শ্রদ্ধা। সাধারণতঃ ত্রিরত্নের নাম শ্রবণের সাথে সাথে যে চিত্ত প্রসন্নতা উৎপন্ন হয়, উহাকে বলে- প্রসাদ শ্রদ্ধা।
নির্বাণ ধর্মে যাঁর একান্ত বিশ্বাস আছে, তিনি নিশ্চিত নির্বাণ সমীপেই অবস্থান করেন। নির্বাণ তো আর এত সুখলভ্য নয়। নির্বাণকে সহজ লভ্যের কারণে সাধক আত্মসংযম অবলম্বন করেন। শীলের মাধ্যমেই আত্মসংযম সম্ভব। মানবের চরিত্রকে দৃঢ়তর করবার শীলই একমাত্র উপায়। শীলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ত্যাগ ধর্মের মাধ্যমে তাঁরা দেবত্ব গুণ অর্জন করেন। তাঁরা তখন যাবতীয় পাপকাজ সম্পাদনে লজ্জা ও ভয় উৎপাদন করেন। উৎপন্ন অকুশল বর্জনের জন্য সতত চেষ্টিত থাকেন। তারপর বুদ্ধ দেশিত বাণী সমূহ হৃদয় প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেন। শ্রুত বিষয়ে জ্ঞান উৎপন্ন হলেই তখন চারি আর্যসত্যে বোধ জন্মে। চারি আর্যসত্যের যখন সমাধান হয়, তখনই জন্ম জরা ব্যাধি ও মরণ দুঃখের চির অবসান হয়। সুতরাং একটি মাত্র শ্রদ্ধাকে ভিত্তি করলে অপরাপর ছয়টিধর্ম- শীল লজ্জা ভয় শ্রুতি ত্যাগ প্রজ্ঞা অবলীলাক্রমে এসে পড়ে। তাই বুদ্ধ বলেন- যাদের নিকট এই সাতটি ধন বিদ্যমান- তারা অবশ্যই আর্যধনে ধনী এবং তারাই নির্বাণ লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। একদা শারিপুত্র স্থবির দেশনাচ্ছলে শ্রেষ্ঠী অনাথপিন্ডিককে বলেছিলেন-
হে গৃহপতি, অশ্রুতবান পৃথগ্‌জনের কাছে সপ্ত আর্যধন নাই। তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না। এই সপ্ত আর্যধনের প্রতি তারা তেমন বিশ্বাসও রাখে না। তাই তারা এই জীবনে ধনী আখ্যা লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং মরণান্তে তাদের দুর্গতিই আশা করা যায়। দুর্গতি বলতে বুঝায়- চারি অপায়। পক্ষান্তরে সপ্ত আার্যধনে ধনী শ্রুতবান আর্যশ্রাবক কল্যাণ পৃথকজন ধনী আখ্যা লাভের গৌরব অর্জন করেন এবং মরণান্তে তাঁদের গতি একান্তই সুগতিমূখী। তাঁদের জন্য অপায় দ্বার চিররুদ্ধ। এই প্রসঙ্গে অঙ্গুত্তর নিকায়ে আরও উল্লেখ আছে- এই সংসারে যাঁরা পরমার্থ মানবরূপে ভূষিত তাঁরা উপরোক্ত সাতটি ধনে অধিষ্ঠিত থাকেন। এই সাতটি ধন মহামানবতা অর্জনের পরম সহায়ক। মরণের পর যাঁরা ঊর্ধ্বতন দেবলোকে জন্ম নিয়ে অপরিসীম দিব্যসুখ ভোগ করছেন, মর্তধামে তাঁরা নিশ্চিত এই সাতটি আর্যধন থাকে, তাঁরা অবশ্যই ধনী এবং তাঁদের জন্ম ধারণই সার্থক। আমি এক্ষেত্রে সকলের অবগতির জন্য সপ্ত আর্যধনের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করবো-
(ক) শ্রদ্ধাধনঃ- শ্রদ্ধা মানে একান্ত বিশ্বাস। কিসে বিশ্বাস? এই জীবন অনিত্য দুঃখ অনাত্মময়। জীবন মুক্তির শ্রেষ্ঠতর অয়ন-মার্গ আছে। মুক্তি আছে, নির্বাণ আছে। দান-যজ্ঞ আছে, মাতা-পিতার সেবা আছে, সেবার ফল আছে, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল-বিপাক আছে, ইহলোক-পরলোক আছে, স্বর্গ-নরক আছে, অনন্ত গুণ সম্পন্ন বুদ্ধ ও তাঁর দেশিত নির্বাণ ধর্ম এবং ধর্মের অনুসারী ভিক্ষু-সংঘ আছেন। শীল-সমাধি-প্রজ্ঞার উদ্বোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে ইত্যাদি। এই কয়টি বিষয়ে যাঁদের একান্ত বিশ্বাস আছে, তাঁদের পক্ষে সম্যকভাবে জীবন পরিচালনার তেমন কোন অসুবিধা হয় না। এর ফলে তাঁদের সৎদৃষ্টি ফিরে আসে, মিথ্যাদৃষ্টির অবসান হয়। জীবন সুন্দর পবিত্র ও উজ্জ্বল হয় এবং নির্বাণ মার্গের সন্ধান লাভ করে।
(খ) শীলধনঃ- শীল মানবের অমূল্য সম্পদ। শীল পালনে আনন্দ এবং লংঘনে অনুতাপ উৎপন্ন হয়। শীল সম্পদে মানুষকে পবিত্র মহান ও শ্রেষ্ঠতর করে। আর্য প্রশংসিত শীলের প্রতি যাদের একান্ত অনুরাগ বা বিশ্বাস বিদ্যমান থাকে, তারা অতি গৌরবের সাথে শীল সমূহ পালন করেন। শীল লংঘন জনিত অনুতাপ তাদের ভোগ করতে হয় না। সাধারণতঃ গৃহী জীবনে পঞ্চশীল ও অষ্টশীল পালনের নির্দেশ আছে। আর্য গৃহীরা ঐ শীল সমূহ জীবন-প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেন। শীলবানেরা মরণান্তে সুগতি স্বর্গলোকে জন্ম নেন আর দুঃশীল মানব চারি অপায়ে বা গরু ছাগল কুকুররূপে জন্ম নিয়ে অসীম দুঃখ ভোগ করে।
(গ-ঘ) লজ্জা ও ভয়ধনঃ- ‘হিরোত্তপ্পং লোকং পালেতি’ লজ্জা ও ভয় এই দু’টি ধর্ম পৃথিবী রক্ষা করে। পাপের প্রতি লজ্জা-ভয়, পুণ্যে শ্রদ্ধা ও উৎসাহ মানুষকে উর্ধ্বদিকে নিয়ে যায়। যারা দানাদি সুকর্মকে কুকর্ম এবং প্রাণী হত্যাদি কুকর্মকে সুকর্ম বলে বিবেচনা করে, তখন বুঝতে হবে যে- তাদের মানবতা বোধের অভাব ঘটেছে। লজ্জা-ভয়হীন মানুষ পশু সমতুল্য। শাস্ত্রে ছোট-বড় যে কোন পাপকাজে লজ্জা ও ভয় করবার আদেশ-নির্দেশ আছে কিন্তু পুণ্য কাজে তেমন নিষেধাজ্ঞা নাই বরং প্রীতমনে তা সম্পাদনের আবেদন আছে। যেহেতু পুণ্যই সুখের উৎস। আমরা অনেক ক্ষেত্রে মোহের তাড়নায় আসল সত্যকে ভুলে যাই। ফলে লজ্জা-ভয় না করবার বিষয়টিকে লজ্জা-ভয় করি আর লজ্জা-ভয় করবার বিষয়টিকে লজ্জা-ভয় করি না। পাপ কাজে বাধা দেওয়া এবং পুণ্যকাজে উৎসাহিত করা জ্ঞানীর লক্ষণ। যদি নিজের বিবেক দিয়ে বুঝতে পারে যে- ‘ইহা পাপ জনক, নিন্দা-জনক, ইহা সম্পাদনে ভয়ের কারণ আছে, ইহা সুগতি সংবর্তক, ইহা নিরয় সংবর্তক ও দুঃখ দায়ক।’ এভাবে উভয়টির ভাল-মন্দ বুঝতে পারলে উন্নত মানব জীবন সংগঠনের উপায় সহজতর হয়। লজ্জা ও ভয়শীল মানুষ কখনো পাপকাজ করতে পারেনা। তারা সর্বদা পবিত্রভাবেই জীবন যাপন করে।
(ঙ) শ্রুতধনঃ- শ্রুতধন মানবের এক বিরাট সম্পদ। শ্রুত বলতে বুঝায়-বুদ্ধের মুখ নিঃসৃত বাণী সমূহ হৃদয়-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করা। তিনি যে সর্বপ্রাণীর হিতার্থে ৮৪ হাজার বাণী প্রচার করেছেন, তার সদর্থ জ্ঞাত হয়ে জীবনে অনুশীলন করা। যাবতীয় অকুশল বর্জন এবং কুশল অর্জন করা শ্রুতশীল ব্যক্তির প্রধানতম লক্ষণ। পাপকে বর্জন করা, সদ্‌কাজের অনুষ্ঠান করা শ্রুতশীল ব্যক্তিরই একমাত্র সম্ভব। বুদ্ধের প্রত্যেক বাণী নির্বাণ রস যুক্ত। বিমুক্তিবাণী যাদের বহুলভাবে আয়ত্ব বা অধিগত, তারা অবশ্যই শ্রুতধনে ধনী। ভগবান তথাগত তাদেরকে প্রশংসা করেছেন- যেই ভিক্ষু বা ভিক্ষুণী উপাসক বা উপসিকা বুদ্ধোপদিষ্ট বাণী সমূহ শ্রবণ করে হৃদয় কোষে সঞ্চিত করে রাখেন এবং তা জীবনে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হন। শ্রুতশীল মানবের কাছে বুদ্ধ-দেশিত জটিল বিষয়- চারি আর্যসত্য, প্রতীত্য সমুৎপাদ, ত্রিলক্ষণ, সপ্তবোধ্যঙ্গ, পঞ্চেন্দ্রিয়, পঞ্চবল, আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সমূহ দুর্বোধ্য বলে বোধ হয় না। উহা অতি সহজতরভাবে গ্রহণ করতে তারা সমর্থ হন। শ্রুতশীল মানবকে তিনি আর্যশ্রাবক নামে অভিহিত করেছেন। যেহেতু আর্যশ্রাবক বিনা বুদ্ধের ধর্ম উপলব্ধি করা বড়ো কঠিন। বুদ্ধ সেবক আনন্দ স্থবির এই মহান গুণের অধিকারী ছিলেন।
(চ) ত্যাগধনঃ- ত্যাগ মানে স্বত্ত্ব বা স্বার্থ ত্যাগ। এই সংসারে আপন স্বার্থ ত্যাগ করা বা স্বার্থ ত্যাগে প্রণোদিত হয়ে জীবন গঠন করা কম সহজ কথা নয়। ত্যাগশীলতা অর্জন করতে হলে তাকে সর্বপ্রথম মৈত্রীধর্মে অধিষ্ঠিত থাকতে হয়। সর্বপ্রাণীর প্রতি মৈত্রীধর্ম থাকলেই ত্যাগধর্ম পরিপূর্ণ করা যায়। মৈত্রীহীন হৃদয়ে কখনো ত্যাগ মানসিকতা আসতে পারে না। যেমন পুত্রের প্রতি মাতার অপরিসীম স্নেহ-মমতা ও দয়া-দাক্ষিণ্য বিধায় মাতা পুত্রের জন্য সবকিছু ত্যাগ স্বীকার করতে বাধ্য থাকে। তেমন অন্যসব প্রাণীর প্রতি যাদের প্রেম-মৈত্রী আছে তারা দান বা স্বার্থত্যাগে কখনো কুণ্ঠিত হয় না।
ত্যাগের অন্য অর্থ- কিছু দিয়ে মনের পবিত্রতা সাধন করা। ত্যাগ বিনা কেহ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না। আপন স্বার্থ পরের সুখের জন্য বিলিয়ে দেওয়া কম সহজ কথা নয়। মহৎ হৃদয়ে সবকিছু ত্যাগ করা যায়। কিন্তু সংকীর্ণ হৃদয়ে তা কখনো সম্ভব নয়। সর্বদা তাদের হৃদয়ে সংকোচতার প্রাবল্যই বিদ্যমান থাকে। তাই তারা মহত্বের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। উদার হৃদয় ত্যাগ পরায়ণ মানুষ সর্বজনের নন্দিত ও পুজিত হন। অপরদিকে দাতার নাম দেবতা। তাই ত্যাগধনে ধনী হওয়া সকল মানবের একান্তই কর্তব্য।
(ছ) প্রজ্ঞাধনঃ- বৌদ্ধ সাহিত্যে বা দর্শনে প্রজ্ঞার স্থান অতি উচ্চে। প্রজ্ঞার উদ্বোধন হলেই মানুষ নির্বাণ-মুক্তি লাভ করতে পারে। অন্ধ মানুষ যেমন পৃথিবীর কোন স্বরূপ বুঝতে পারে না তেমন প্রজ্ঞাহীনের পক্ষে বুদ্ধের ধর্ম বা দর্শন উপলব্ধি করা অথবা দেহতত্ত্ব মনস্তত্ব বা কার্যকারণ নীতি হৃদয়ঙ্গম করা সহজ বোধ হয় না। এই পঞ্চস্কন্ধ দেহের উৎপত্তি স্থিতি ও ব্যয় সম্বন্ধে যথাযথ জানাই প্রজ্ঞার লক্ষণ। দেহতত্ত্ব সম্বন্ধে জানতে হলে ভাবিত চিত্তের প্রয়োজন। চিত্তকে একমাত্র ভাবিত করতে পারে শমথ ও বিদর্শন ভাবনার মাধ্যমে। এই দু’টি বিদ্যাভাগীর বিষয়। অবিদ্যায় ঢাকা মানুষ সত্যাসত্য ভাল-মন্দ বুঝতে পারে না। যতদিন মানবের চারি আর্যসত্যে বোধ না জন্মে, ততদিন মানুষকে এই ভব সংসারে পরিভ্রমণ করতে হয়। যথাযথ প্রজ্ঞা উৎপন্ন হলেই চারি আর্যসত্যে বোধ জন্মে এবং সেই বোধের কারণেই জন্মের চির অবসান হয়। সুতরাং প্রজ্ঞাধন আযত্ব করা মুক্তিকামী মানুষের অবশ্যই কর্তব্য।
নিজের আলোকে আলোকিত হতে
জ্বালাও প্রজ্ঞাজ্যোতি
তোমারি সাধনা মুক্তির পথে
আনিবে পরম গতি।

সুত্রঃ নির্বাণকামী

ড.ধর্মসেন মহাথেরো

ড.ধর্মসেন মহাথেরো

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের ঊনাইনপূরা গ্রামের সদ্ধর্মপ্রাণ উপাসক মহীরাজ বড়ুয়ার ঔরসে পুণ্যবতী উপাসিকা সুরবালা (বড়ুয়া) দেবীর কোল আলোকিত করে ১৯২৮ সালের ১৭ জুন রবিবার ভূমিষ্ট হয়েছিল এক নবজাতক পুত্র সন্তান। শুভক্ষণে তার নাম রাখা হয় রসধর বড়ুয়া। কালের ধারাবাহিকতায় রসধর বড় হতে থাকে। কিন্তু কিশোর বয়সে হঠাৎ জটিল রোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসার পরও সুস্থ না হলে একপর্যায়ে মা বুদ্ধের প্রতিবিম্বের সামনে একাগ্রমনে ছেলের রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনায় ইচ্ছে পোষণ করলেন যে, ছেলে রসধর রোগ থেকে মুক্তি পেলে শাসন সদ্ধর্মে দান করবেন। অতঃপর রসধর সুস্থ হলে ১৪ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমায় জ্ঞানতাপস আর্যশ্রাবক ভদন্ত জ্ঞানীশ্বর মহাথেরো মহোদয়ের নিকট প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে ধর্মসেন শ্রামণ নাম ধারণ করেন। গুরুর স্বানিধ্যে শ্রামণ ধর্মসেন ধর্মীয় শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। অতঃপর ১৯৪৭ সালে ঊনাইনপূরা লংকারামে (বিহার) দানোত্তম কঠিন চীরব দানানুষ্ঠানে আচারিয়া পূর্ণাচার সীমালয়ে জ্ঞানীশ্বর মহাথেরোর উপাধ্যায়ত্বে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপসম্পদা ( ভিক্ষু ) গ্রহণ করেন। ভিক্ষুত্ব জীবনে বুদ্ধের সদ্ধর্ম জানার লক্ষ্যে ধর্ম-বিনয় সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত রেখে ১৯৫৩ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বৌদ্ধের পবিত্র ধর্মীয় গন্থ ত্রিপিটকের সর্বোচ্চ উপাধি ‘ত্রিপিটক বিশারদ’ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে তাঁর অর্জিত জ্ঞান সমাজ ও সদ্ধর্মে প্রচার ও প্রসারিত করার মানসে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মদেশনার মাধ্যমে বিকশিত করেছেন। মহামান্য দ্বাদশ সংঘরাজের লিখিত পুস্তক/গ্রন্থ গুলো সমূহ – ত্রিরত্ন বন্দনা ( ১৯৬২ ), বিনয় সংগ্রহ ( ১৯৭৮ ), বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা ( ১৯৮১ ), ত্রি-মহাজীবন (১৯৯০ ) উল্লেখযোগ্য। মহামান্য দ্বাদশ সংঘরাজ কর্ম জীবনে বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সভাপতি সহ বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। একাদশ সংঘরাজ ভদন্ত শাসনশ্রী মহাথেরো মহোদয়ের প্রয়াণের পর ২০০৪ সালে ২৯ শে জানুয়ারি বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সাধারণ সভার ভিক্ষুসংঘের উপস্থিতিদের সর্বসম্মতত্রুমে উপ-সংঘরাজ ভদন্ত ধর্মসেন মহাথেরো মহোদয়কে বাংলাদেশি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুরু “সংঘরাজ” পদে অভিসিক্ত করেন। তখন থেকে এখনো তিনি দ্বাদশ সংঘরাজ হিসেবে তাঁর সাধনপীঠ চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ঊনাইনপূরা লংকারামে অবস্থান করে পুরো বৌদ্ধ জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।মহামান্য দ্বাদশ সংঘরাজ ভদন্ত ধর্মসেন মহাথেরো দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশি বৌদ্ধদের অবস্থান সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তুলে ধরেছেন। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও ধর্মীয় গুনাবলীর স্বীকৃতি স্বরূপ ‘অগ্গমহাসদ্ধর্মজ্যোতিকাধ্বজক'( মিয়ানমার ), ত্রিপিটক সাহিত্য চক্রবর্তী ( শ্রীলংকা ), ওয়ার্ল্ড পিস মডেল ( থাইল্যান্ড ), সুপ্রিম বুড্ডিস্ট লিডার ( জাপান ), এ্যাওয়ার্ড সহ ‘অতীশ দীপংকর ও বিশুদ্ধানন্দ’ স্বর্ণপদক অর্জন করেন।

অরহৎ উপগুপ্ত মহাথের এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

অরহৎ উপগুপ্ত মহাথের এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

অরহৎ উপগুপ্ত মহাথেরর সংক্ষিপ্ত জীবনী

লিখেছেন – শ্রীমৎ প্রিয়বংশ স্থবির

সে বহুকাল আগের কথা ।একদা একদল জেলে সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরার জন্য । সে জালে একটি সুন্দর মাছ ধরা পরল যা দেখে জেলেরা খুব খুশি হল । কিন্তু তারা দেখল মাছের পেটে কি যেন নড়া চড়া করছে ।তা দেখে সকলে চিন্তিত হয়ে গেল । অবশেষে মাছটি বিক্রি করার জন্য রাজার কাছে নিয়ে গেল । সব শুনে রাজা জেলেদের প্রাপ্য টাকা দিয়ে মাছটি কিনে নিলেন । তারপর জেলেদের বললেন খুব সাবধানে মাছটির পেট কেটে দেখ সেখানে কি পাওয়া যায় ।রাজার আদেশ পেয়ে জেলেরা আস্তে আস্তে মাছের পেট কাটল । তাতে জীবিত একটি মানব কন্যা শিশু দেখা গেল । তা দেখে সকলে অবাক হয় রইল । রাজার আদেশে তাঁকে স্নান করিয়ে ঘরে নিয়ে আসল । সেই শিশু কন্যাটি রাজ বাড়ীতে লালিত পালিত হতে লাগল । মেয়েটি যতই বড় হতে লাগল ততই তার গা থেকে মাছের গন্ধ বের হতে লাগল যা রাজাকে ভাবিয়ে তুলল । একদিন রাজা এক কাঠের মিস্ত্রি ডেকে একটা বড় নৌকা তৈরী করালেন । সে নৌকায় নানা রকম খাদ্য পানীয় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে মেয়েটিকে নৌকায় তুলে সাগরে ভাসিয়ে দিলেন । নৌকাটি ভাসতে ভাসতে সাগরের তীরে পৌঁছল । সে জায়গায় এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ধ্যান করতেন । নৌকাটি ভান্তের চোখে পরল । ভান্তে মেয়েটিকে দেখে করুণা বশতঃ উদ্ধার করলেন এবং নিজ আশ্রমে নিয়ে গিয়ে লালন পালন করতে লাগলেন । এভাবে মেয়েটির যখন ১৮ বছর হল তখন একদিন সে স্বপ্নযোগে অন্তঃসত্ত্বা হল । সে সবকিছু ভান্তেকে খুলে বলল এবং অনুতাপ করতে লাগল , ‘আমি তো কোন পুরুষ সংসর্গ লাভ করি নি তাইলে কেন আমার এ দশা হল ?’ ভান্তে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন ‘ভয় পেও না । তোমার উদর হতে এক মহাপুরুষের জন্ম হবে ‘ এ বলে ভান্তে তাকে আশীর্বাদ করলেন । ভান্তের অভয় বাণী শুনে মেয়েটি আশ্বস্ত হল । ভান্তের কাছে নানা ধর্ম কথা শুনে তার দিন যেতে লাগল । ভান্তে তাকে সর্বদা সৎ উপদেশ দিতেন । এক বছর পর এক উষালগ্নে মেয়েটির এক সোনার বরণ পুত্র ভুমিষ্ঠ হল । ছেলেটিকে দেখে ভিক্ষুও আনন্দিত হলেন । কর্মের বিপাক , কর্মের বন্ধন , কর্মের ফল , কর্মের গুরুত্ব রহস্য একমাত্র ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ ছাড়া কেউ জানেন না । এ ঘটনাটি ঘটে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের প্রায় ২৩০ বছর পর ।তখন সম্রাট আশোকের রাজত্ব ছিল । ভন্তে এবং তার মায়ের লালন পালনে ছেলেটি রাজপুত্রের ন্যায় সৌন্দর্য বিকশিত হয়ে বড় হতে লাগল । ছেলেটি যতই বড় হতে লাগল ভন্তে তাকে ধর্ম শিক্ষা দিতে লাগলেন । বৌদ্ধ ধর্মের গ্রহণীয় আদর্শগুলো গ্রহণ করা এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো বর্জন করা সমস্তই ছেলেটিকে শিক্ষা দিতে লাগলেন । ভন্তে মহোদয়ের কথা মত ছেলেটিও শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগল । এভাবে ছেলেটি বড় হতে লাগল । ছেলেটির বয়স যখন ৭ বৎসর হয় , এমনি এক সময় শুভ লগ্নে ছেলেটি ধ্যান করতে করতে সকল তৃষ্ণা ক্ষয় করে অরহত্ত্ব ফল লাভ করলেন এবং আকাশ মার্গে উপনীত হলেন । অর্হৎলাভীরা জানেন তৃষ্ণা ক্ষয় হলেও প্রবজ্যা গ্রহণ করতে হয় অথবা নির্বাণ লাভ করতে হয় । বিবেচনা করে তিনি প্রবজ্যাই গ্রহণ করলেন । কিছুদিন পর একদিন তিনি ভন্তে এবং মাতা থেকে বিদায় নিয়ে অন্য একটি বিহারে চলে গেলেন । সেখানে কয়েকদিন থাকার পর অন্যান্য ভিক্ষুরা বলাবলি করতে লাগলেন ‘এই শ্রমণের গা থেকে মাছের গন্ধ বের হচ্ছে কেন ? ‘ এভাবে সবাই বলাবলি করে আর থু থু ফেলতে থাকে । শ্রমণ এ কথা জানতে পেরে একদিন চিন্তা করলেন কি করা যায় । কোথায় যাই ? পরের দিন ভ্রমণ করতে করতে এক সাগরের পাড়ে গেলেন এবং চিন্তা করতে লাগলেন । সেই সমুদ্রের তলদেশে বাস করতেন এক নাগরাজ ।সেই নাগরাজ শ্রমণের চিন্তিত বিষয় জ্ঞানবলে ধরতে পারলেন এবং সাথে সাথে মানবের বেশ ধরে তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন । শ্রমণও তাঁকে চিনতে পারলেন কারণ তিনি তো অর্হৎ । তাঁদের দুজনের ভিতর নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনার পর নাগরাজ তাঁকে যাবজ্জীবন নাগভবনে থাকার জন্য প্রার্থনা করলেন ।তখন সেই শ্রমণ তাঁর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে নাগরাজের সাথে নাগলোকে চলে গেলেন ৷

 

 

মৃত্যুর প্রকারন্তর

মৃত্যুর প্রকারন্তর

মৃত্যুর প্রকারন্তর

 – সুলেখা বড়ুয়া

 
পঞ্চস্কন্ধের ভেদই মৃত্যু| মৃত্যুকে চ্যুতি চিত্ত ও বলে| এ মরন সর্ব প্রকার কর্মজ গুণানুসারে কেউ দীর্ঘায়ু,কেউ অল্পায়ু হয়ে থাকে| মানবদ্বয় নিজ নিজ কর্মের দ্বারা দু:খ এবং সুখ ভোগ করে|
মানবের মৃত্যু প্রধানত: দুই প্রকার| ১) লোকীয় মৃত্যু এবং ২) লোকোত্তর মৃত্যু|
লোকীয় মৃত্যু তিন প্রকার| ক) ক্ষনিক মৃত্যু, খ)সম্মতি মৃত্যু এবং গ) সমুচ্ছেদ মৃত্যু|
ক্ষনিক মৃত্যুঃ মাতৃগর্ভ হতে যে মুহুর্তে জন্ম হয় আমাদের, সেই ক্ষন থেকে প্রতি মুহুর্তে মরন সংঘঠিত হচ্ছে| আপাতত: আমাদের মোহবৃত চক্ষে তা ধরা না পড়লে ও প্রজ্ঞানেত্রে কিন্তূ তা দেখা যায়|যেমন- জন্মের মুহুর্ত থেকে ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তনের ধারাবাহিক নিয়মানুসারে ‘শিশুকালের’ পর কৈশোরকাল,উপনীত হয়ে থাকে|একই নিয়মে নিয়ত: পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘কৈশোরকাল’ এর পর ‘যৌবনকাল’ গত হলে পৌঢকাল উপস্হিত হয়|ক্রমশ: পৌঢকাল নিয়ত পরিবর্তনের পর ‘বৃদ্ধকালে’ পদার্পন করে| মানুষ কিন্তূ শিশুকাল পার করে যখন কৈশোরে পদার্পন করে,তখন শত চেষ্ঠা করে ও কেউ শিশুকালে ফিরে যেতে পারে না|এভাবে এক একটা কালের মৃত্যু হয়| অবশেষে ক্ষনে ক্ষনে নিয়ত ক্ষয় হয়ে কর্মের নিবন্ধ আয়ুষ্কাল নি:শেষ হওয়ার পর চ্যুতি-চিত্ত বা মরন সংঘঠিত হয়, তাহাই ক্ষনিক মৃত্যু|
সম্মতি মৃত্যুঃ ইহা বলতে বুঝায় সকলের সম্মতিতে মৃত ব্যাক্তি কারো ছেলে, মামা, দাদা, ভগ্নিপতি, পিতা, ভাগিনা, জামাতা অথবা শ্বশুর ইত্যাদি আত্নীয় ও আত্নীয়াদের সন্মতিতে প্রয়াত অমুক বাবু দিবাগত ৭ ঘটিকায় পরলোক গমন করেন| ইহাই সন্মতি মৃত্যু|
সমুচ্ছেদ মৃত্যুঃ মৃত ব্যক্তি এ ভব সংসারে যে নাম বা গোত্র পরিচয়ে দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন| যে আত্মীয়তার আবদ্ধ ও পরিচয় ছিল, যে পেশায় সংসার নির্বাহ করতেন, যে প্রশংসায় ও সম্মানে ভূষিত তথা গৌরবে গৌরবান্বিত! মৃত্যুর পর দেখা যায় তিনি আর পূর্বের সে নাম, গোত্র বা আত্মীয় পরিচয়ে ফিরে আসে না| পুনরায় ফিরে আসতে কেউ দেখে নাই, দেখবে ও না, ইহা অসম্ভব, কারণ তার তিরোধান চিরকালের জন্য।এজন্য ইহাকে সমুচ্ছেদ মৃত্যু বলে।
লোকোত্তর মৃত্যু চার প্রকার। ক) আয়ুক্ষয়ে মৃত্যু, খ) পূন্যক্ষয়ে অথবা কর্মক্ষয়ে মৃত্যু, গ)আয়ু-পূণ্য উভয়ক্ষয়ে মৃত্যু ঘ)উপচ্ছেদক মৃত্যু।
আয়ুক্ষয়ে মৃত্যুঃ সত্ত্বগন যে ভবে উৎপন্ন হয়; সে ভবে প্রতিসন্ধি নেওয়ার সময় যে কর্ম বলে আয়ু নির্ধারিত থাকে।সে দীর্ঘতম আয়ুর সুপরিমিত আয়ু ক্ষয় হয়ে গেলে,যখন কোন সত্ত্ব দেহ ত্যাগ করে তখন তাকে আয়ুক্ষয়ে মৃত্যু বলে।
পূণ্যক্ষয়ে মৃত্যুঃ জনক কর্ম প্রদত্ত পূণ্যক্ষয় হলে মৃত্যু হয়।তা কিরূপ? যেমন- কোন ব্যক্তি মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব হতে আহার করার ইচ্ছা হয় না। অথবা পথ্য বা আহারের অভাব ঘটে। তার জন্য নির্বাচিত ঔষধ পাওয়া যায় না। অনেক সময় মরণাপন্ন কালে ডাক্তার পাওয়া যায় না কিংবা অতিকষ্টে সন্ধান পেলে ও প্রয়োজনীয় ঔষধ মিলানো সংকট হয়। কষ্ট সন্ধানে পাওয়া গেলে ও মুমুর্ষ ব্যাক্তি গলাধ: করন করতে সক্ষম হয় না। এমন কি অনেক সময় দেখা যায়, কোন মুমুর্ষ ব্যক্তি গ্লুকোজের জল, আঙ্গুরের রস,মধু ইত্যাদি পানীয় দ্রব্য মুখে দিলে তা জিহ্বা দ্বারা ঠেলে ফেরে দেয়। ইহাকে পূন্যক্ষয়ে বা কর্মক্ষয়ে মৃত্যু বলে।
আয়ু-পূন্য উভয় ক্ষয়ে মৃত্যুঃ সাধারণত: শীলবান, দানাদি পূন্যকর্ম ও ভাবনাদি কুশল কর্মে শ্রদ্ধা সম্পন্ন ব্যাক্তিগন কথা বলতে বলতে স্বজ্ঞানে সদ্ধর্ম সুত্রাদি শ্রবন করতে করতে মৃত্যুবরণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বুদ্ধের জীবিত কালে শ্রাবস্তীর এক ধনাঢ্য উপাসক ভগবান বুদ্ধের নিকট প্রাথর্না করে নিমন্ত্রিত ভিক্ষু সংঘ দ্বারা সুত্র শ্রবন করতে করতে যখন মরণাসন্ন কাল উপস্হিত হল, তখন ছয়টি দেবলোক হতে ছয়খানা দিব্যরথ উপস্হিত হয়েছিল।রথের সারথিরা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ রথে উঠবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। তাতে গন্ডগোল হওয়াতে ধার্মিক উপাসক তাঁদের থামতে বললে্’ ভিক্ষু সংঘ মনে করলেন, বোধহয় তাদেরকেই সূত্র পাঠ বন্ধ করতে বলেছেন। তাই ভিক্ষু সংঘ সুত্র পাঠ বন্ধ করে বিহারে চলে গেলেন। অত:পর বুদ্ধ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- তোমরা চলে এসেছ কেন? উনারা আদ্য-পান্ত সব কথা বুদ্ধক নিবেদন করলেন। উত্তরে বুদ্ধ বললেন্ উপাসক তোমাদেরকে নিষেধ করেন নাই।ছয় দেবলোকের সারথিকে নিষেধ করেছেন। ভিক্ষু সংঘ বললে্ন- পুনরায় আমরা কি যাব? তখন বুদ্ধ বললে্ন, এখন গিয়ে কোন ফল হবে না।
এদিকে উপাসকের সংজ্ঞা ফিরে আসলে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভিক্ষু সংঘ কেন সুত্র পাঠ করছেন না? উত্তরে সবাই বললে্ন, আপনি নিষেধ করেছেন, এজন্য ভন্তেরা বিহারে চলে গেছেন। তখন উপাসক বললে্ন, আমি ভিক্ষু সংঘকে কিছু বলি নাই, বলেছি দেবলোক হতে আগত দেব সারথিদেরকে। তখন উপস্হিত সকলেই বললে্ন, আমরা সেই দেবরথ দেখতে পাচ্ছি না! উপাসক বললে্ন, তোমরা যখন দেখবার উপযুক্ত হবে তখন দেখবে। অত:পর উপাসক বললে্ন, তোমরা সকলে কোন দেবলোক পছন্দ কর? সবাই বললে্ন, তুষিত দেবলোক! তবে একটি ফুলের মালা রচনা করে পছন্দ দেবলোকের উদ্দেশ্যে উপর দিকে ছুরে দাও। তা করা হল। তখন সে ফুলের মালা তুষিত দেবলোকের খুঁটিত আটকে শূন্যে ঝুলে রহিল। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে উপাসক সে রথে করে দেবলোকে চলে গেলেন। সুতরাং ইহাতে বুঝা যায়, যাঁরা ধার্মিক পরায়ন, তারা আয়ু পূন্য উভয়ক্ষয়ে সদজ্ঞানে কালগত হন।
উপচ্ছেদক মৃত্যু বা অকাল মৃত্যুঃ আয়ু ও কর্ম উভয় শক্তি বিদ্যমান থাকাকালীন কোন বিরুদ্ধ শক্তির প্রভাবে কেউ মৃত্যু মুখে পতিত হলে, তাকে উপচ্ছেদক মৃত্যু বলা হয়। উপচ্ছেদক কর্মের দ্বারা উপচ্ছেদকে মৃত্যু ঘটে। যেমনঃ কেউ যদি কোন প্রাণীকে তার আয়ু বর্তমান থাকাকালীন অকালে মৃত্যু ঘটায়। সে অসময়ে মৃত্যু ঘটানোই অকাল মৃত্যু বা উপচ্ছেদক মৃত্যু। সে কর্ম বর্তমান জীবনে অনুরূপ উপচ্ছেদক কর্ম কারো দ্বারা সম্পাদিত হলে, যদি সে মুহূর্তে অতীত বিপাক সংযোগ সাধন হয় অথবা প্রতিঘ চিত্ত উপচিত হয়। তবে কেউ কেউ বৃক্ষ হতে পরে, নৌকা ডুবে, স্টীমার বা উড়োজাহাজ তথা সড়ক দূর্ঘটনায়, ট্রেনের লাইনচ্যুত হয়ে, কাটাকাটি, মারামারি, গোলা-গুলি, ইদানীং মানুষ মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ঠ হয়ে ইত্যাদি দুর্ঘটনার দ্বারা অকাল মরন হয়। তদুপরি সন্নিপাত রোগ যেমন- ক্যান্সার, রক্তচাপ, ব্রেইন টিউমার ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা যে অকাল মৃত্যু হয়, তা উপচ্ছেদক মৃত্যু।
সাধারণত: মৃত্যুর সময় যা করা উচিত এবং উচিত না। মৃত্যুর পূর্বে সকল প্রাণীর শরীরের শক্তি হ্রাস পায়, তাই সব প্রাণীই দূর্বল হয়ে পরে। মানুষ যখন মৃত্যু সমীপবর্তী হয় তখন নাকের আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে শ্বাস- প্রশ্বাস গ্রহন করতে পারে না বিধায় অনেক সময় হা করে মুখ দিয়ে সহজ পথে নিশ্বাস নেয়। তখন প্রকৃতপক্ষে যেটা করা উচিত না, আমরা সেটাই করে থাকি। যেমন- মৃত্যু পথযাত্রীর ছেলে বা মেয়ে বিদেশে থাকে, তার নামে একটু ঢাবের পানি, মধু অথবা মিছিরির পানি খাও বলে মৃত্যু যাত্রীর মুখে ঢুকিয়ে দিই। ঐ ব্যাক্তি যখন নিশ্বাস নেওয়ার জন্য হা করে থাকে, সেই দিকে যদি পানি দেওয়া হয় তখন তার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে? তখন কিন্তূ তাঁহার মনের ভেতরে রাগচিত্ত উৎপন্ন হতে পারে। এ রাগ চিত্ত মৃত ব্যাক্তির চরম ক্ষতি হয়। মৃত্যুর সময় যদি মৃত্যু পথযাত্রী রাগ চিত্ত উৎপন্ন হয়ে মারা যায়, মৃত্যুর পর সর্প যোনিতে জন্ম হয়। সম্রাট অশোক এবং এরকাপত্র এর প্রকৃত উদাহরণ।
সম্রাট অশোক, যিনি এতো দান করার পর মৃত্যুর সময় রাগচিত্তের কারণে মৃত্যুর পর সর্প যোনিতে জম্ম নিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধের সময় এরকাপত্র নামক জনৈক দিব্য নাগরাজ, যিনি কাস্যপ বুদ্ধের সময় এক ধ্যানী ভিক্ষু ছিলেন। তা হলে আমাদের মৃত্যুর সময় কি করা উচিত? ঘরের দরজা-জানলা খুলে দিয়ে, একজন ভন্তের মাধ্যমে সূত্র পাঠ করলে ভাল হয়। যদি ভন্তে পাওয়া না যায় সূত্র কেসেট চালালে ও কাজ হয়। তাও যদি সম্ভব না হয় তা হলে যে কেউ একজন পালিতে সূত্র পাঠ করতে পারলে মঙ্গল হয়। কারণ মানুষ মারা যাওয়ার সময় অনেক ভাল এবং খারাপ দেবতা নিতে আসে। সূত্র পাঠ করলে সেখানে খারাপ দেবতারা থাকতে পারে না, তাই ভাল দেবতারা থেকে ভাল জায়গায় নিয়ে যায়। কি কি পূন্য কাজ করেছে তা মনে করিয়ে দিতে হবে মৃত্যু পথযাত্রীকে। বুদ্ধের ছবি দেখাতে হবে, যেন- বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের স্মরণ নিতে পারে মনে মনে। আর যদি উনি ভাবনাকারী হন, তাহলে কানে কানে বলতে হবে তোমার যেমন লাগে মনে মনে তেমন স্মৃতি করেন। যদি স্মৃতি করতে করতে মৃত্যু হয়, তাহলে সকল মৃত্যর থেকে এ মৃত্যু শ্রেয়! এ বিদর্শন ভাবনা সবসময় চর্চা করলে মৃত্যুর সময় ও ভাবনা অনেক সাহায্য করে।
“জগতের সকল প্রাণী দু:খ থেকে মুক্তি লাভ করুক”।
বি:দ্র:- উৎস গ্রন্হ আর্যশ্রাবক প্রয়াতঃ বোধিপাল শ্রামণের “লোকোত্তর প্রদীপ”এবং বির্দশন ভাবনা চলাকালীন দেশনালব্দ জ্ঞানের আলোকে এ লেখা।
error: Content is protected !!