কালী যক্ষিণী ও গৌতম বুদ্ধ – ত্রিরত্ন ডট কম

কালী যক্ষিণী ও গৌতম বুদ্ধ – ত্রিরত্ন ডট কম

বুদ্ধের সময়ে শ্রাবস্তী নগরে এক ব্যাক্তি পিতার মৃত্যুর পর সংসারের যাবতীয় কার্য ভার বহন করে তার মায়ের সেবা করতে লাগলো। তার মা একটি বড় পরিবার থেকে তার ছেলেকে বিয়ে করাল। বেশ ধুমদাম করে ছেলের বিয়ে করাল মা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তাদের সংসারে কোন সন্তনাদি না হওয়ায় মা তার ছেলেকে আরেকটি বিবাহ করাল। কিন্তু ছেলেটির প্রথমা স্ত্রী এ বিয়েতে রাজি ছিল না। এদিকে নতুন ছেলেটির নতুন বউ অন্তঃসত্বা হল। ফলে তাদের পরিবারে আনন্দের মাখামাখি হতে লাগলো। কিন্তু প্রথমা স্ত্রী সেটা সহ্য করতে পারছিল না, তখন প্রথমা স্ত্রী কৌশলে ঔষধ প্রয়োগ করে গর্ভপাত ঘটালো। এভাবে দ্বিতীয় বারও এরূপ ভাবে গর্ভপাত ঘটালো। তৃতীয় বার গর্ভপাত ঘটানোর সময় দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেল। আর মারা যাবার সময় সে সতিনীর প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণা হয়ে মারা গেল। এবং সেই গৃহে বিড়ালী হয়ে জন্ম গ্রহন করল। তখন ঐ বাড়িতে মুরগী ডিম পারলেই বিড়ালী এসে খেয়ে ফেলত। এভাবে কয়েকবার ডিম খেয়ে ফেলাতে মুরগী মরবার সময় ঐ বিড়ালীকে তার সন্তানাদি সহ খাওয়ার সংকল্প নিয়ে প্রাণ ত্যাগ করে পরের জন্মে এক চিতা বাঘিনী হয়ে জন্মগ্রহন করল। এদিকে বিড়ালী যতাসময়ে মরার পর হরিণী হয়ে জন্মলাভ করে। তারা দুইজনে একি বনে বাস করতে লাগলো।
হরিণী হয়ে জন্মলাভ করে। তারা দুইজনে একি বনে বাস করতে লাগলো।
অতঃপর হরিণী বাচ্চা প্রসব করলেই বাঘিনী এসে খেয়ে ফেলে। এভাবে বাচ্চা দুইয়েকবার খাওয়াতে হরিণী মৃত্যুর সময় একি সংকল্প বদ্ধ হয়ে মারা গেলে এক যক্ষিণী রূপে জন্মগ্রহন করল। এবং একি সাথে বাঘিনী মারা গিয়ে শ্রাবস্তীর একই গ্রামে জন্মগ্রহন করে। বাঘিনী এ জন্মে একটি পরিবারে কন্যা হিসেবে জন্মগ্রহন করে। যথাসময়ে কন্যার বিবাহ হল। বিবাহের পর তার ঘরে সন্তান জন্মগ্রহন করলে, যক্ষিণী প্রিয় সখীরূপে এসে শিশুকে খেয়ে ফেলে। দ্বিতীয় বারও ঠিক এরূপ ঘটনা। তৃতীয়বার অন্তসত্বা হবার পর তার স্বামীকে যক্ষিনীর ভয়ে বলতে লাগলো- এবার আমি চাই আমার নতুন সন্তান আমার বাপের বাড়ীতে জন্মহোক। এখানে থাকলে ঐ যক্ষিণী আামার ছেলেকে খেয়ে ফেলবে। স্ত্রী ও সন্তানের কথা চিন্তা করে তার স্বামী যথাসময়ে তার স্ত্রীকে বাপের বাড়ীতে যাওয়ার ব্যাবস্তা করল।
বাপের বাড়ীতে গিয়ে যথাসময়ে নিরাপদে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল। নিরাপদে সন্তান প্রসব হওয়াতে খুব ধুমদাম ভাবে ছেলে শিশুর নামকরন সম্পাদন করল। অতঃপর একদিন স্বামী স্ত্রী সন্তান নিয়ে তাদের বাড়ীতে ফিলতে ছিল। এই দিকে যক্ষিণী পূর্বস্থানে স্ত্রীলোককে দেখতে না পেয়ে তার সন্ধানে পাগলের মত খুঁজতে লাগল। হঠাৎ পথের মাঝখানে তাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। যক্ষিণীকে দেখে স্ত্রী লোকটি ভয়ে চীৎকার করে উঠল এবং পুত্রের প্রাণ রক্ষাত্বে বক্ষে ধারণ করে দৌড়াতে লাগলো। দৌড়াতে দৌড়াতে নিকটবর্তী শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে প্রবেশ করল। ভগবান তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ তখন ধর্ম সভায় মানুষকে ধর্ম দেশনা করতে ছিলেন। স্ত্রী লোকটি দেরি না করে তার কোলের অবুজ সন্তানটিকে বুদ্ধের চরণ তলে স্থাপন করে যক্ষিণীর হাত থেকে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন যক্ষিণীও পিছনে পিছনে এসে জেতবনে উপস্থিত হল। ভগবান বুদ্ধকে দেখে কিছুটা সংযত পুর্বক দাড়িয়ে রইলো। যক্ষিণীর মনোভাব বুঝতে পেরে ভগবান বুদ্ধ দুইজনকে তাদের অতীত জন্মের শক্রতার কথা বর্ণনা করতে লাগলেন। এবং দেশনার এক পর্যায়ে উভয়ের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন-

” নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তী’ধ কুদাচনং,
অবেরেণ চ সম্মন্তি, এস ধম্মো সনন্তনো”। ৫ (ধম্মপদ)

” এ জগতে শক্রতার দ্বারা কখনো শক্রতার উপশন হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শক্রতার উপশম হয় “

বুদ্ধের এই চিত্ত বিধারিত বাণী শুনার পর যক্ষিনী ও স্ত্রীলোকটি সৎ জ্ঞান লাভ করে। এবং চিরতরে পরস্পর পরস্পরের শক্রতার উপশম ঘটাল।

সুত্রঃ সংগৃহীত

শ্রীমৎ উপঞঞাজোত মহাথেরো’র স্মৃতিচারণ

শ্রীমৎ উপঞঞাজোত মহাথেরো’র স্মৃতিচারণ

দুল্লভো পরিসাজঞঞো নসো সব্বত্থ জায়তি,

য়ত্থ সো জায়তি ধীরো তং কুলং সুখমেধতি।।

জগতে পুরুষ রত্নের আবির্ভাব বড়ই দুর্লভ।

সেরূপ রত্ন সর্বত্র জন্মগ্রহণ করেন না। সে বিরল ক্ষণজন্মা পুরুষ যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন একটি আলোক শিখার মত তাঁর মহিমা চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়। এরকম পুরুষের আগমনে জ্ঞাতি, সমাজ, দেশ হয় ধন্য, কুল হয় পবিত্র। সেরূপ ধর্মের এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা ছিলেন শ্রীমৎ উ পঞঞা জোত মহা‌থের (গুরুভন্তে) । বলছি না ফেরার দেশে চলে যাওয়া উছলা ভান্তে তথা গুরু ভান্তের কথা । উল্লেখ্য, উপঞঞাজোত মহাথেরো ১৯৫৫ সালের ২২ ডিসেম্বর বান্দরবান পার্বত্য জেলার রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি, ১৯৮২ সালে এলএলএম এবং ১৯৮৩ সালে বিসিএস পাস করেন। বিসিএস ক্যাডার হিসেবে তিনি সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ শুরু করেন। মাত্র ১২ বছর তিনি কর্মজীবনে ছিলেন। তিনি যদি চাইতেন এতদিন রাজ সিংহাসনে বসে রাজা হতেন কিংবা বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ বিচারপতি হতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতার এই লোভ,মোহ তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। এই লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের ৭ জুন চিংম্রং বৌদ্ধ বিহারের বিহারাধ্যক্ষ উপন্ডিত মহাথের কাছে প্রব্রজ্যা গ্রহণ (গৃহজীবন ত্যাগ) করে সমাজ ও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হন। এর ছয় মাস পরই পবিত্র মাঘী পূর্ণিমার দিনে তিনি উপসম্পদা (ভিক্ষুত্ব) গ্রহণ করেন । অধপতিত অসহায় দুঃখী বৌদ্ধদের উদ্ধারকল্পে এই অপ্রতিরুপ দেশে তিনি বুদ্ধের ধ্বজা উত্তোলন করে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরন করেন। ২০০২ সালে জুলাই মাসে অনাথ ও দরিদ্রদের জন্য বি হ্যাপি লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। যেইখানে রীব দুঃখি পাহাড়ি ছেলেদেরকে বিনামূল্য থাকা খাওয়াসহ পড়াশুনা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। চাকমা, মারমা ত্রিপুরা, ম্রো, খিয়াং, বম সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আদিবাসী ছেলেরা এই খানে পড়ালেখা করছে। বান্দরবানে তিনি ছয়টির অধিক জাদী প্রতিষ্ঠা করেছেন তার মধ্য বুদ্ধ ধাতু জাদী(স্বর্ণজাদী), রামা জাদী, ক্যমলং জাদী, নন্দগ্রী জাদী, জীনমার জয়ী জাদী উল্লেখযোগ্য । গ্রন্থে লেখা আছে একবার মনে প্রাণে জীবিত বুদ্ধকে পূজা দিচ্ছি মনে করে যদি জাদীতে পূজা দেওয়া তাহলে ৮৪ কল্পকাল সুখ লাভ হয় অর্থাৎ অপায়মুক্ত হয়। অবশেষে বৌদ্ধ সমাজকে কাঁদিয়ে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল রোজ সোমবার না ফেরার দেশে চলে যান পরম কল্যাণ মিত্র উপাঞঞাজোতা মহাথেরো (গুরু ভন্তে) ।

তথ্যসুত্রঃ নিকোলাস চাকমার ও U Pannya Cakka Thera কর্তৃক ফেইসবুক শেয়ার

দীর্ঘ জীবন, সুখ ও সম্মান

দীর্ঘ জীবন, সুখ ও সম্মান

চীনদেশে চেং নামে একজন নিম্নপদস্থ সরকারী লােক ছিলেন। তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ এবং দয়ালু ছিলেন। যদিও তিনি সামান্য বেতনের চাকুরী করতেন, মাঝে মাঝে বাজার থেকে জীবিত মাছ ও মুরগী কিনে ছেড়ে দিতেন।

তার অনেক ছেলেমেয়ে এবং নাতি-নাতনি ছিলেন। চীনদেশের পরিবারে সন্তানাদি বেশী থাকলে তাদেরকে সৌভাগ্যবান পারিবার নামে অভিহিত করা হয়। চেং কোন সময় আজে বাজে খরচ করতে পছন্দ করতেন না।

চেং এর অনেক বয়স হয়েছে, তাই সরকারী অফিস থেকে অবসর নিয়েছেন। বাড়ীতে ছেলে-মেয়ে এবং নাতি-নাতিনীদের নিয়ে তার সময় কাটে । পরিবারের কেউ প্রাণী হত্যা করেন না। বাড়ীর সবাই নিরামিষাশী ছিলেন। এর ফলে চেং এবং তার পরিবারের সবাই ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। চেং এর বয়স এখন প্রায় একশত বছর। তিনি এখনও একজন পূর্ণ যুবকের মত চলাফেরা করেন। তার চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, গায়ের চামড়া টান টান, চুলগুলি কালাে। এমনকি তার শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়েনি।

একদিন চেং বাড়ীর সবাইকে ডাকেন। চেং বলেন, আমার বিগত জীবনে, আমি অনেক প্রাণীর জীবন রক্ষা করেছি। ভগবানের কৃপায় আমরা সবাই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। জীবনে, আমি কোনদিন জীবহত্যা করি নাই, এজন্য তােমাদের সবাইকে নিয়ে আমি সুখী আছি। আমার কৃতকর্মের জন্য স্বর্গের রাজপ্রাসাদ হতে আমার ডাক এসেছে। তােমাদের সবাইকে | আশীর্বাদ করছি। আমার উপদেশ মতাে তােমরা জীবন-যাপন করবে। এতে তােমরা। | অনেক উন্নতি করবে। আমার মৃত্যুর পর তােমরা আমার উপদেশ মনে রাখবে এবং অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। জীবনে কখনও প্রাণীহত্যা করবেনা। অন্য কাউকে হত্যা করতে দেখলে তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করবে।

চেং এর কথা শেষ হলে, পরিবারের সকলেই এক মধুর সঙ্গীত শুনতে পায়। তারা কোনদিন এরকম সঙ্গীত শুনেনি। মধুর সংগীতের শব্দটি আকাশ হতে শােনা যায়। কিন্তু আকাশে কিছুই দেখা যায় না। পরিবারের লােকজন উপরে তাকিয়ে আছেন এবং হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে দেখেন, স্বর্গ হতে পাঠানাে এক স্বর্ণকারুকার্যময় চেয়ারে চেং বসে আছেন। ঘরের মধ্যে চেৎ নেই। তার সমস্ত শরীর স্বর্গীয় আভায় দিপ্তমান। তিনি অর্হৎ প্রাপ্ত হয়ে তুষিত স্বর্গে চলে যান। পরিবারের লােকেরা অহং চেং এর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন। করেন এবং সবাই দীর্ঘজীবন লাভ করে সুখে ও শান্তিতে বাস করতে থাকেন।

সুত্রঃ সজল কান্তি বড়ুয়ার লিখা প্রানির প্রতি দয়া বই থেকে সংগৃহীত

হরিণ ও ছোট্ট ছেলে

হরিণ ও ছোট্ট ছেলে

ঘন সবুজ এবং চমৎকার বুনােফুল দ্বারা আচ্ছাদিত নদীর পাশে একটি ছােট্ট ঘর। মা তার ছেলেকে নিয়ে কুড়ে ঘরে বসবাস করেন। সেদিন আকাশে চমৎকার সূর্য উঠেছে। হঠাৎ একটি শিংওয়ালা হরিণ তাদের বাড়ীর আঙ্গিনায় ঢুকে পড়ে। ছােট ছেলেটি বাড়ী সংলগ্ন উঠানে খেলা করছিল। হরিণ ছেলেটির একেবারে কাছে গিয়ে আংটার মতাে করে ছেলেটির গায়ে জড়ানাে কাপড়ে তার শিং দিয়ে জড়িয়ে নেয়। এটি করতে দেখে ছেলেটি ভয়ে চীৎকার দেয়। ছেলের চীৎকার শুনে তার মা ঘর থেকে ছুটে এসে দেখেন, একটি হরিণ দৌড়ে পালাচ্ছে এবং হরিণটির শিঙ্গের সঙ্গে শাট আটকানাে অবস্থায় তার ছেলেও হরিণের সঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ছেলের এরকম পরিণতিতে মা অত্যন্ত আতংকিত হয়ে পড়েন। ছেলেকে রক্ষার জন্য তিনি হরিণের পিছু পিছু দৌড় দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর মা দেখেন তার ছেলে মাঠের এক জায়গায় পড়ে আছে এবং হরিণের শিংয়ের সঙ্গে আটকানাে শার্ট খুলে গেছে। মাকে আসতে দেখে ছেলে মায়ের বুকে মুখ লুকায়। ছেলেকে পেয়ে আনন্দে মা কেঁদে ফেলেন।

মা ছেলেকে নিয়ে দ্রুত বাড়ীর দিকে রওনা দেন। বাড়ী ফিরে আশ্চর্য হয়ে দেখেন পাশের বড় গাছটি ভেঙ্গে তার বাড়ীর উপর পড়ে আছে। অতবড় গাছের নীচে পড়ে বাড়ীটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মােরগ এবং কুকুরটি ও গাছের নীচে পড়ে মরে আছে। এ দৃশ্য দেখে মা শিউরিয়ে উঠেন। সে সময় হরিণটির শিংগে তার ছেলের শাট আটকানাে অবস্থায় বাইরে টেনে না নিলে, আজ গাছের নীচে পড়ে তাদের সবাইর মৃত্যু ঘটত।

এসময় ছেলেটির মায়ের এক বছর পূর্বের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। একটি হরিণ শিকারির তাড়া খেয়ে তার ঘরে ঢুকে পড়েছিল। মা তখন রান্নার কাজেই ব্যস্ত। হঠাৎ হরিণটিকে তার ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে ছেলেটির মা ভয় পান। এসময় ঘরের বাইরে তীর ধনুক হাতে একজন লােক দেখেন। সেই লােকটিকে দেখে মার মনে সন্দেহ জাগে, তবে লােকটি কি হরিণকে খুঁজছে। এই কথা ভেবে মা হরিণটিকে শিকারির চোখ থেকে আড়াল করার জন্য তার পরনের কাপড় দিয়ে হরিণের শরীর ঢেকে রাখেন।

শিকারি বাড়ীর এদিক ওদিক তাকিয়ে হরিণটির কোন চিহ্ন দেখতে না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। শিকারিকে চলে যেতে দেখে, ছেলেটির মা হরিণের গা থেকে কাপড়টি সরিয়ে নেয়। হরিণ সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। হরিণ বুঝতে পারে ছেলেটির মা শিকারীর হাত থেকে তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। চলে যাওয়ার সময় হরিণ মাথা নত করে ছেলেটির মাকে কৃতজ্ঞতা জানায়।

মা এখন বুঝতে পারে হরিণ কেমন করে যেন বুঝতে পেরেছিল বাড়ীর পাশের গাছটি পড়ে । গিয়ে মা এবং ছেলের ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রতিদানে হরিণ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। মা ও ছেলেকে রক্ষা করেছে।

মা একটি প্রবাদ বাক্য স্মরণ করেন,

“কারও বিপদে যদি কেউ তার জীবন রক্ষা করে,

নিজের বিপদে ও দেবতারা তাকে রক্ষা করেন।”

সুত্রঃ সজল কান্তি বড়ুয়ার লিখা প্রানির প্রতি দয়া বই থেকে সংগৃহীত


কচ্ছপের কৃতজ্ঞতা

কচ্ছপের কৃতজ্ঞতা

 ৪র্থ শতাব্দীর চান রাজত্বে কুং ইউ নামে এক বৃদ্ধ লােক শহরে বাস করেন। তিনি

রাজপ্রাসাদে স্বল্প বেতনের নিম্নপদে চাকরি করতেন এবং অনেক দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপন করতেন।

একদিন ভােরে তিনি লক্ষ্য করেন, এক লােক একটি কচ্ছপ বাজার থেকে কিনে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। কচ্ছপের পরিণতির কথা ভেবে কুং ইউ খুবই ব্যথিত হন। কুং ইউ কচ্ছপের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন। কচ্ছপটি নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষার জন্য লােকটির নিকট কুং ইউ বেশী দামে কচ্ছপটি ক্রয় করার প্রস্তাব দেন। বেশী দাম পাওয়ার লােভে, লােকটি কুং ইউর কাছে কচ্ছপটি বিক্রী করেন। কুং ইউ কচ্ছপটি কিনে নিয়ে নদীতে ছেড়ে দেন।

কচ্ছপটি বুঝতে পারে কুং ইউ তার জীবন রক্ষা করেছেন। এজন্য কচ্ছপটি নদীর গভীর পানিতে যাওয়ার সময় কুং ইউর দিকে কৃতজ্ঞতাভরে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকায়। কুং ইউ এই অভাবনীয় দৃশ্য লক্ষ্য করেন এবং কচ্ছপটি গভীর জলে ডুব দেয়া পর্যন্ত তার গমনপথের দিকে কুং ইউ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন।

এ ঘটনার কয়েক বছর পর, কুং ইউর চাকুরীতে পদোন্নতি হয়। ইতিমধ্যে রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে সেই দেশের রাজা চিন্তিত হয়ে পড়েন। রাজ্যের এই সংকটময় মুহুর্তে কুং ইউর পরামর্শে রাজা সেই বিদ্রোহ দমন করেন। রাজা এতে খুশী হয়ে রাজ্যের খুব উচু এবং সম্মানী পদে কুং ইউকে অধিষ্ঠিত করেন।

কুং ইউ যখন উচ্চ পদে আসীন হন, তাকে লর্ড সম্মান সূচক উপাধি প্রদান করার জন্য একটি ধাতুনির্মিত সীলমােহর তৈরি করতে রাজকীয় কারিগরকে আদেশ দেয়া হয়। রাজার আদেশ পেয়ে কারিগর সীলমােহর তৈরির কাজে লেগে যায়। সীলমােহরটি তৈরির জন্য কারিগর যখন ছাচে ঢালাই দিতে যায়, তখন এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখা যায় । পিছনে ঘাড় বাঁকা তাকানাে অবস্থায় একটি কচ্ছপের ছবি সীলমােহরে ফুটে উঠে। এই দৃশ্য দেখে কারিগর বিস্মিত হয়। কারিগর পুনরায় সীলমােহর তৈরির কাজে হাত দিতেই একই ঘটনার দৃশ্য দেখা যায়। যখনই সীলমােহর তৈরির জন্য কারিগর চেষ্টা করেন, ততবার কচ্ছপের ছবি ভেসে উঠে। কারিগর এই ঘটনায় খুব হতচকিয়ে যান। কি ভুতুরে কান্ড! কারিগর মহামান্য লর্ড কুং ইউকে নতজানু হয়ে এই আশ্বর্য ঘটনা সর্ম্পকে বলেন,

“মহামান্য লর্ড, আমাদের মহামান্য রাজার নির্দেশে আপনাকে নতুন পদমর্যাদার সম্মান সূচক উপাধি প্রদানের জন্য একটি সীলমােহর তৈরির আদেশ পাই। কিন্তু যতবার সীল তৈরির প্রস্তুতি নিতে যাই, ঘাড় বাঁকিয়ে তাকানাে একটি কচ্ছপের ছবি পুনঃ পুনঃ সীলমােহরে ভেসে উঠে।” এ ঘটনা শােনার পর নতুন মহামান্য লর্ড কুং ইউ সীলমােহর করতে গিয়ে ঘাড় বাঁকানাে একটি কচ্ছপের ছবি দেখতে পান। নতুন লর্ড কুং ইউ এ ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। ক্রমে ক্রমে এই অদ্ভুত ঘটনা মহামান্য রাজা জানাতে পারেন। মহামান্য রাজা নতুন লর্ড কুং ইউকে এই আশ্চর্য ঘটনা সর্ম্পকে জানতে চান। তার জন্য সীলমােহর তৈরি করতে কেন কচছপের ছবি ভেসে উঠে। রাজার এই প্রশ্নে নতুন লর্ড কুং ইউ হতবিহ্বল হয়ে চুপ করে থাকেন। একদিন কুং ইউ রাজপ্রাসাদ থেকে কাজ শেষে বাড়ীতে রওনা হতেই হঠাৎ পূর্বের ঘটনাটি মনে পড়ে। পরদিন মহামান্য রাজদরবারে লর্ড কুং ইউ পূর্বের ঘটনার কথা রাজাকে জানান।

“অনেক বছর পূর্বে আপনার দরবারে যখন নিম্নপদে কাজ করতাম, তখন এক লােক বাজার থেকে একটি কচ্ছপ কিনেন, বাড়ীতে নিয়ে রান্না করার উদ্দেশ্য। কচ্ছপটির নিশ্চিত মৃত্যু হবে – এই কথা ভেবে – আমি টাকা দিয়ে লােকটির কাছ থেকে কচ্ছপটি কিনে নিই এবং পানিতে ছেড়ে দেই। কচ্ছপটি কেন জানি বুঝতে পেরেছিল আমি তার জীবন রক্ষা করেছি এবং পানিতে ছেড়ে দেয়ার পর কচ্ছপটি ঘাড় বাঁকা করে আমার দিকে তাকিয়ে যেন বারবার আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিল।”

“মাননীয় ধর্মাবতার, বর্তমানে আমাকে লর্ড উপাধিতে ভূষিত করেছেন। সীল তৈরির সময় যে কচ্ছপের ছবি বারবার ভেসে উঠে, আমার মনে হয়, আমার বর্তমান উন্নতির প্রধান কারণ উক্ত কচ্ছপের হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষার কারণে স্বর্গের দেবতাগণ খুশী হয়ে আমার জন্য আশীর্বাদ করছেন।”

মহামান্য সম্রাট রাজসভাসদগনের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “যারা ভাল কাজ করেন, স্বর্গের দেবতাগণ তাদের পুরস্কার এবং উন্নতির জন্য আশীর্বাদ করেন। লর্ড কুং ইউ এর ঘটনা একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন।”

সুত্রঃ সজল কান্তি বড়ুয়ার লিখা প্রানির প্রতি দয়া বই থেকে সংগৃহীত


কোশলরাজের ষোলটি দুঃস্বপ্ন

কোশলরাজের ষোলটি দুঃস্বপ্ন

একদা কোশলরাজ সমস্ত রাত্রি নিদ্রাভোগ করিয়া শেষ প্রহরে ষোলটী মহাস্বপ্নদর্শনে এরূপ ভীত হইয়াছিলেন যে, তাহাতেই তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হয়। এরূপ দুঃস্বপ্নের না জানি কি কুফলই ঘটিবে এই ভাবিয়া তিনি মরণভয়ে নিতান্ত অভিভূত হইয়াছিলেন, এবং চলচ্ছক্তিরহিত হইয়া শয্যার উপরই জড়সড়ভাবে পড়িয়া রহিয়াছিলেন। অনন্তর রাত্রি প্রভাত হইলে পুরোহিত ও অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহারাজের সুষুপ্তি হইয়াছিল ত?’ রাজা কহিলেন, ‘আচার্য্যগণ, কিরূপে সুষুপ্তি ভোগ করিব বলুন? আমি অদ্য ষোলটী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখিয়া তদবধি নিতান্ত ভয়ব্যাকুল হইয়াছি। আপনারা দয়া করিয়া এই স্বপ্নগুলির ব্যাখ্যা করুন।’ ব্রাহ্মণেরা বলিলেন, ‘আপনি কি কি স্বপ্ন দেখিয়াছেন শুনিতে পাইলে আমরা তাহাদের ফল নির্ণয় করিয়া দিতেছি।’

রাজা একে একে স্বপ্নবৃত্তান্তগুলি নিবেদন করিয়া তাহাদের ফল জিজ্ঞাসা করিলেন। ব্রাহ্মণেরা স্বপ্ন শুনিয়া হস্ত নিপীড়ন করিতে লাগিলেন। রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বিপ্রগণ! আপনারা হস্ত নিপীড়ন করিতেছেন কেন? তাঁহারা বলিলেন, ‘মহারাজ! এগুলি অতীত দুঃস্বপ্ন।’ ‘এরূপ দুঃস্বপ্নের ফল কি?’ হয় রাজ্যনাশ, নয় প্রাণনাশ, নয় অর্থনাশ, এই তিনটীর একটী না একটী।’ ‘এ ফল প্রতিবিধেয়, না অপ্রতিবিধেয়?’ ‘এমন দুঃস্বপ্ন অপ্রতিবিধেয় হইবারই কথা; তথাপি আমরা প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করিব; ইহার যদি প্রতিবিধান করিতে না পারিলাম, তবে আমাদের শাস্ত্রজ্ঞানের কি ফল?’ ‘আপনারা তবে কি প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করিতেছেন অনুমতি করুন।’ ‘মহারাজ! আমরা চতুষ্ক যজ্ঞ করিব।’ ভয়বিহ্বল রাজা নিতান্ত ব্যগ্রতার সহিত বলিলেন, ‘আচার্য্যগণ! দেখিবেন, আমার প্রাণ আপনাদের হাতে; আমি যাহাতে অচিরে নিরাময় হইতে পারি তাহার উপায় করুন।’ রাজার কথা শুনিয়া ব্রাহ্মণদিগের আনন্দের সীমা-পরিসীমা রহিল না। তাঁহারা ভাবিলেন, ‘এই উপলক্ষ্যে আমরা বহু ধন ও চর্ব্ব্যচূষ্য প্রচুর খাদ্য লাভ করিব।’ তাঁহারা ‘কোন চিন্তা নাই, মহারাজ!’ এই আশ্বাস দিয়া প্রাসাদ হইতে চলিয়া গেলেন; নগরের বহির্ভাগে যজ্ঞকু- খনন করিয়া সেখানে বহুসংখ্যক সর্ব্বাঙ্গসুন্দর চতুষ্পদ জন্তু এবং শত শত পক্ষী আনয়ন করাইলেন এবং তাহার পরেও ইহা চাই, তাহা চাই বলিয়া পুনঃ পুনঃ রাজার নিকট যাইতে আরম্ভ করিলেন। রাজমহিষী মল্লিকাদেবী ব্রাহ্মণদিগের গতিবিধি দেখিয়া রাজার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ব্রাহ্মণেরা আজ এত ঘন ঘন যাতায়াত করিতেছেন কেন?’

রাজা কহিলেন, ‘তুমি কি সুখেই আছ! কর্ণমূলে আশীবিষ বিচরণ করিতেছে, অথচ তুমি কিছুই জানিতে পারিতেছ না।’ ‘মহারাজ! আপনি কি বলিতেছেন, বুঝিতে পারিতেছি না।’ ‘আমি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছি,—ব্রাহ্মণেরা বলিতেছেন যে, তজ্জন্য হয় রাজ্যনাশ, নয় প্রাণনাশ, নয় অর্থনাশের আশঙ্কা আছে। ইহার প্রতিবিধানার্থ যজ্ঞ করিবেন বলিয়া তাঁহারা উপকরণ সংগ্রহের জন্য বার বার যাতায়াত করিতেছেন।’ ‘যিনি নরলোকের ও দেবলোকের ব্রাহ্মণাগ্রগণ্য, তাঁহাকে স্বপ্নের প্রতিকারার্থ কিছু জিজ্ঞাসা করিয়াছেন কি?’ ‘ভদ্রে! নরলোকে ও দেবলোকে ব্রাহ্মণাগ্রগণ্য বলিয়া কাহাকে মনে করিয়াছ?’ ‘সে কি মহারাজ! যিনি ত্রিলোকশ্রেষ্ঠ, সর্ব্বজ্ঞ, বিশুদ্ধ ও নিষ্কলঙ্ক, আপনি কি সেই ব্রাহ্মণাগ্রগণ্য মহাপুরুষকে জানেন না? সেই ত্রিকালজ্ঞ ভগবান নিশ্চয় আপনার স্বপ্ন ব্যাখ্যা করিবেন। আপনি গিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করুন।’ রাজা বলিলেন, ‘দেবি! এ অতি উত্তম পরামর্শ’ এবং তখনই বিহারে গিয়া শাস্তাকে প্রণিপাতপূর্ব্বক আসন গ্রহণ করিলেন। শাস্তা মধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহারাজ যে এত ভোরে আসিয়াছেন ইহার কারণ কি?’ ‘প্রভাত ইহবার প্রাক্কালে ষোলটী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখিয়া এমন ভীত হইয়াছিলাম যে, ব্রাহ্মণদিগের নিকট তাহার প্রতিবিধানের প্রার্থনা জানাইয়াছিলাম। তাঁহারা বলিলেন যে, স্বপ্নগুলি নিতান্ত অমঙ্গলসূচক এবং স্বস্ত্যয়নের জন্য সমস্ত চতুষ্পদ-সঙ্গমে যজ্ঞ সম্পাদন করিতে হইবে। তাঁহারা এখন যজ্ঞের আয়োজন করিতেছেন; তদুপলক্ষে বহু প্রাণী মরণভয়ে ব্যাকুল হইয়াছে। সেই জন্য আপনার শরণ লইলাম। আপনি ত্রিলোকশ্রেষ্ঠ; ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয় আপনার জ্ঞানগোচর। দয়া করিয়া আমার স্বপ্নফল ব্যাখ্যা করিতে আজ্ঞা হয়।’ ‘মহারাজ! ত্রিভুবনে আমি ব্যতীত আর কেহ যে এই সকল স্বপ্নের ধর্ম্ম বুঝিতে ও ফল বলিতে পারিবে না, ইহা সত্য। আমি আপনাকে সমগ্র বিষয় বুঝাইয়া দিতেছি। আপনি যে যে স্বপ্ন দেখিয়াছেন, যথাক্রমে বলুন।’ ‘যে আজ্ঞা, প্রভো’ বলিয়া রাজা স্বপ্নসমূহের এই তালিকা[277] দিলেন :

‘বৃষ, বৃক্ষ, ধেনু, বৎস, তুরগ, কাংস্যেও পাত্র[278], একে একে করি দরশন;

শৃগাল, লসী, পুনঃ পুষ্করণী শোভাময়ী, তার পর তণ্ডুল চন্দন;

অলাবু ডুবিল জলে, কিন্তু ভাসে শিলা তথা, ভেকে কওে কৃষ্ণসর্প গ্রাস;

সুবর্ণ-পালকে শোভে যত কাক-পরিজন, ছাগভয়ে বৃক পায় ত্রাস।’

১. প্রথম স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘প্রথম স্বপ্ন এইরূপ : বোধ হইল যেন চারিটা কজ্জলকৃষ্ণ বৃষ চারিদিক হইতে যুদ্ধার্থ রাজপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করিল; বৃষ-যুদ্ধ দেখিবে বলিয়া সেখানে বহুলোক সমবেত হইল; বৃষগণ যুদ্ধের ভাব দেখাইল বটে কিন্তু কেবল নিনাদ ও গর্জ্জন করিতে লাগিল এবং শেষে যুদ্ধ না করিয়াই চলিয়া গেল। এই আমার প্রথম স্বপ্ন। বলুন ত, প্রভু, এমন স্বপ্ন কেন দেখিলাম এবং ইহার ফলই বা কি।’

শাস্তা কহিলেন, ‘মহারাজ, এই স্বপ্নের ফল আপনার বা আমার জীবদ্দশায় ফলিবে না, কিন্তু অতঃপর দেখা যাইবে। তখন রাজারা অধার্ম্মিক ও কৃপণস্বভাব হইবেন, মনুষ্য অসৎপথে বিচরণ করিবে, জগতের অধোগতি হইতে থাকিবে; তখন কুশলের ক্ষয়, অকুশলের উপচয় ঘটিবে। জগতের সেই অধঃপতন-সময়ে আকাশ হইতে পর্য্যাপ্ত বারিবর্ষণ হইবে না, মেঘের পা খঞ্জ হইয়া যাইবে, শস্য শুষ্ক হইবে, দুর্ভিক্ষের হাহাকার উঠিবে। তখন চারিদিক হইতে মেঘ উঠিবে বটে, লোকে মনে করিবে কতই যেন বৃষ্টি হইবে; গৃহিণীগণ যে ধান্যাদি রৌদ্রে দিয়াছেন তাহা আর্দ্র হইবে আশঙ্কায় গৃহের অভ্যন্তরে লইয়া যাইবেন; পুরুষেরা কোদাল ও ঝুড়ি হাতে লইয়া আলি বান্ধিবার জন্য বাহির হইবে; কিন্তু সে মেঘ বর্ষণের ভাবমাত্র দেখাইবে; তাহাতে গর্জ্জন হইবে, বিদ্যুৎ খেলিবে; কিন্তু আপনার স্বপ্নদৃষ্ট বৃষগণ যেমন যুদ্ধ না করিয়া প্রস্থান করিয়াছে, উহাও সেইরূপ বর্ষণ না করিয়া পলাইয়া যাইবে। আপনার স্বপ্নের এই ফল জানিবেন; কিন্তু ইহাতে আপনার কোন ভয়ের কারণ নাই; ইহা সুদূর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রযোজ্য বুঝিতে হইবে। ব্রাহ্মণেরা কেবল নিজেদের উপজীবিকার অনুরোধেই আপনাকে ভয় প্রদর্শন করিয়াছেন।’ এইরূপে প্রথম স্বপ্নের নিষ্পত্তি করিয়া শাস্তা জিজ্ঞাসিলেন, ‘বলুন মহারাজ, আপনার দ্বিতীয় স্বপ্ন কি?’

২. দ্বিতীয় স্বপ্ন ও তাহার ফল :

রাজা কহিলেন, ‘ভগবন, আমার দ্বিতীয় স্বপ্ন বলিতেছি, শ্রবণ করুন। আমার বোধ হইল পৃথিবী ভেদ করিয়া শত শত ক্ষুদ্র বৃক্ষ ও গুল্ম উত্থিত হইল এবং কোন কোনটী বিতস্তি প্রমাণ, কোন কোনটী বা হস্তপ্রমাণ হইয়াই পুষ্পিত ও ফলিত হইল! এ স্বপ্নের ফল কি বলুন।’

শাস্তা কহিলেন, মহারাজ, যখন জগতের অবনতির সময়ে মনুষ্যেরা স্বল্পায়ু হইবে, তখনই এ স্বপ্নের ফল দেখা যাইবে। সেই অনাগতকালে প্রাণিগণ তীব্র রিপুপরবশ হইবে, অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যাগণ পুরুষ-সংসর্গে ঋতুমতী পূর্ণবয়স্কাদিগের ন্যায় গর্ভধারণপূর্ব্বক পুত্রকন্যা প্রসব করিবে। আপনি যে ক্ষুদ্র বৃক্ষগুল্মাদির পুষ্প দেখিয়াছেন তাহা অকালজাত-রজস্বলা-ভাবসূচক এবং যে ফল দেখিয়াছেন তাহা বালদম্পতীজাত-পুত্রকন্যা-সূচক। কিন্তু মহারাজ, স্বপ্নের এ ফলে আপনার কোন ভয়ের কারণ দেখা যায় না। এখন বলুন, আপনার তৃতীয় স্বপ্ন কি?’

৩. তৃতীয় স্বপ্ন ও তাহার ফল :

রাজা কহিলেন, ‘আমি দেখিলাম ধেনুগণ সদ্যোজাত বৎসগণের ক্ষীর পান করিতেছে। ইহার কি ফল হইবে?’

‘ইহারও ফল অনাগতকালগর্ভে; তখন মনুষ্যেরা বয়োজ্যেষ্ঠদিগের প্রতি সম্মান দেখাইতে বিরত হইবে। মাতা, পিতা, শ্বশ্রূ, শ্বশুর প্রভৃতিকে উপেক্ষা করিয়া নিজেরাই সংসারে কর্ত্তৃত্ব করিবে, বৃদ্ধদিগকে ইচ্ছা হইলে গ্রাসাচ্ছাদন দিবে, ইচ্ছা না হইলে দিবে না। তখন অনাথ ও অসহায় বৃদ্ধগণ সদ্যোজাত বৎসক্ষীরপায়িনী ধেনুর ন্যায় সর্ব্বতোভাবে স্ব স্ব সন্তানসন্ততির অনুগ্রহান্নভোজী হইবে। তবে ইহাতে আপনার ভীত হইবার কি আছে? আপনার চতুর্থ স্বপ্ন কি বলুন।’

৪. চতুর্থ স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম লোকে ভার-বহনক্ষম বলিষ্ঠ বলীবর্দ্দদিগকে খুলিয়া দিয়া তাহাদের স্থানে তরুণ বলীবর্দ্দ যুগবদ্ধ করিল; কিন্তু তাহারা ভার বহন করিতে অসমর্থ হইয়া পাদমাত্রও চলিল না, এক স্থানেই স্থির হইয়া রহিল, কাজেই শকটগুলি যেখানে ছিল, সেখানে পড়িয়া থাকিল। এ স্বপ্নের কি ফল, প্রভো?’

‘ইহারও ফল অনাগতকালে দেখা যাইবে। তখন রাজারা অধর্ম্মপরায়ণ হইয়া প্রবীণ, সুপণ্ডিত, কার্য্যকুশল এবং রাজ্যপরিচালনক্ষম মহামাত্যদিগের মর্য্যাদা রক্ষা করিবেন না। ধর্ম্মাধিকরণে এবং মন্ত্রভবনেও বিচক্ষণ, ব্যবহারজ্ঞ বয়োবৃদ্ধদিগকে নিযুক্ত করিবেন না; পক্ষান্তরে ইঁহাদের বিপরীতলক্ষণযুক্ত তরুণবয়স্ক ব্যক্তিদিগেরই আদর বৃদ্ধি হইবে; এইরূপ অর্ব্বাচীনেরাই ধর্ম্মাধিকরণে উচ্চাসন পাইবে, কিন্তু বহুদর্শিতার অভাবে এবং রাজকর্ম্মে অনভিজ্ঞতাবশত তাহারা পদগৌরব রক্ষা করিতে পারিবে না, রাজকর্ম্মও সম্পন্ন করিতে পারিবে না; তাহারা কর্ম্মভার পরিহার করিবে। বয়োবৃদ্ধ বিচক্ষণ মহামাত্যগণ সর্ব্ববিধ কার্য্যনির্ব্বাহসমর্থ হইলেও পূর্ব্বকৃত অপমান স্মরণ করিয়া রাজার সাহায্যে পরান্মুখ হইবেন, তাঁহারা ভাবিবেন, আমাদের ইহাতে ক্ষতি বৃদ্ধি কি? আমরা ত এখন বাহিরের লোক; ছেলে ছোকরারা ক্ষমতা লাভ করিয়াছে; কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য তাহারাই জানে।’ এইরূপে অধার্ম্মিক রাজাদিগের সর্ব্বতোভাবে অনিষ্ট ঘটিবে। ধুর-বহনক্ষম বলিষ্ঠ বলীবর্দ্দদিগের স্কন্ধ হইতে যুগ অপসারিত করিয়া ধুরবহনে অসমর্থ তরুণ বলীবর্দ্দদিগের স্কন্ধে স্থাপিত করাতে যাহা হয়, তখনও তাহাই হইবে-রাজ্যরূপ শকট অচল হইয়া থাকিবে। কিন্তু ইহাতে আপনার কোন ভয়ের সম্ভাবনা নাই। আপনার পঞ্চম স্বপ্ন বলুন।’

৫. পঞ্চম স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম, একটা অশ্বের দুই দিকে দুই মুখ; লোকে দুই মুখেই ঘাস ও দানা দিতেছে এবং অশ্ব দুই মুখেই তাহা আহার করিতেছে। এই আমার পঞ্চম স্বপ্ন। ইহার ফল কি বলুন।’

‘ইহারও ফল অনাগতকালে, অধার্ম্মিক রাজাদিগের রাজ্যে সংঘটিত হইবে। তখন অবোধ ও অধার্ম্মিক রাজাগণ অধার্ম্মিক ও লোভী ব্যক্তিদিগকে বিচারকের পদে নিযুক্ত করিবেন। আপনার স্বপ্নদৃষ্ট অশ্ব যেমন উভয় মুখদ্বারাই আহার গ্রহণ করিয়াছে, পাপপুণ্যজ্ঞানশূন্য মূর্খ বিচারকগণ ধর্ম্মাধিকরণে উপবেশন করিয়া বিচার করিবার সময় সেইরূপে অর্থী প্রত্যর্থী উভয় পক্ষের হস্ত হইতেই উৎকোচ গ্রহণ করিবে। কিন্তু মহারাজ, ইহাতেও আপনার কোন ভয়হেতু দেখা যায় না। আপনার ষষ্ঠ স্বপ্ন কি বলুন।’

৬. ষষ্ঠ স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম লোকে লক্ষ মুদ্রা মূল্যের একটা সুমার্জ্জিত সুবর্ণ পাত্র লইয়া একটি বৃদ্ধ শৃগালকে তাহাতে মূত্র ত্যাগ করিতে অনুরোধ করিল এবং শৃগাল তাহাই করিল। এ স্বপ্নের কি ফল বলুন।’

‘ইহারও ফল বহুকাল পরে ফলিবে। তখন রাজকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াও রাজারা অধার্ম্মিক হইবেন; অভিজাতদিগকে অবিশ্বাস করিবেন, তাঁহাদের প্রতি অসম্মান দেখাইবেন; এবং অকুলীনদিগকে উচ্চপদ দিবেন। এইরূপে সদ্‌বংশীয়দিগের দুর্গতি এবং নীচকুলোদ্ভদিগের উন্নতি হইবে। কুলীনেরা তখন জীবিকানির্ব্বাহের উপায়ন্তর না দেখিয়া অকুলীনদিগের আশ্রয় লইবেন এবং তাহাদিগকে কন্যাদান করিবেন। বৃদ্ধ শৃগালের মূত্র-স্পর্শে সুবর্ণ পাত্রের অপবিত্রীভাবও যে কথা, অকুলীনের সংসর্গে কুলকন্যার বাসও সেই কথা। কিন্তু ইহাতেও আপনার কোন ভয় নাই। এখন আপনার সপ্তম স্বপ্ন বলুন।’

৭. সপ্তম স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম এক ব্যক্তি চৌকীর উপর বসিয়া রজ্জু প্রস্তুত করিতেছে এবং যতটুকু পাকান হইতেছে তাহা নীচে ছাড়িয়া দিতেছে; চৌকীর তলদেশে এক ক্ষুধার্ত্তা শৃগালী বসিয়া ঐ রজ্জু খাইতেছে; লোকটা তাহার কিছুই জানিতে পারিতেছে না। এই আমার সপ্তম স্বপ্ন; ইহার কি ফল বলুন।’

‘ইহারও ফল সুদূর ভবিষ্যতে দেখা যাইবে। তখন রমণীগণ পুরুষ-লোলুপ, সুরা-লোলুপ, অলঙ্কার-লোলুপ, পরিভ্রমণ-লোলুপ এবং প্রমোদপরায়ণা হইবে; পুরুষেরা কৃষি, গোরক্ষা প্রভৃতি দ্বারা অতিকষ্টে যে ধন উপার্জ্জন করিবে, এই দুঃশীলা ও দুশ্চরিত্রা রমণীরা তাহা জারের সহিত সুরাপানে এবং মাল্যগন্ধানুলেপ-সংগ্রহে উড়াইয়া দিবে; গৃহে নিতান্ত অনটন হইলেও তাহারা সে দিকে ভ্রূক্ষেপ করিবে না; বহিঃপ্রাচীরের উপরিভাগে যে সকল ছিদ্র আছে, তাহার ভিতর দিয়াও তাহারা উদ্‌গ্রীব হইয়া নিয়ত জারাগমন প্রতীক্ষায় দৃষ্টিপাত করিতে থাকিবে; পরদিন যে বীজশস্য বপন করিতে হইবে তাহা পর্য্যন্ত চূর্ণ করিয়া অন্ন ও কাঞ্জিক প্রস্তুত করিবে। ফলত শৃগালী যেমন চৌকীর তলে বসিয়া স্বপ্নদৃষ্ট ব্যক্তির অগোচরে তাহার প্রস্তুত রজ্জু উদরসাৎ করিতেছিল, এই সকল স্ত্রীও সেইরূপ ভর্ত্তাদিগের অগোচরে তাহাদের বহুকষ্ট-লব্ধ ধনের অপচয় করিবে। কিন্তু ইহাতে আপনার ভীত হইবার কোন কারণ নাই। আপনার অষ্টম স্বপ্ন বলুন।’

৮. অষ্টম স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম রাজদ্বারে একটী বৃহৎ পূর্ণ কলসের চারিদিকে অনেকগুলি শূন্য কলস সজ্জিত রহিয়াছে; চারিদিক্‌ এবং চারি অনুদিক হইতে চতুর্ব্বর্ণের জনস্রোত ঘটে ঘটে জল আনিয়া সেই পূর্ণ কলসে ঢালিতেছে; উপশ্রুত জল স্রোতের আকারে চলিয়া যাইতেছে, তথাপি তাহারা পুনঃপুন ঐ কলসীতেই জল ঢালিতেছে, ভ্রমেও একবার শূন্য কলসীগুলির দিকে তাকাইতেছে না। বলুন, প্রভো, এ স্বপ্নের কি ফল।’

‘এ স্বপ্নের ফলও বহুদিন পরে দেখা যাইবে। তখন পৃথিবীর বিনাশকাল আসন্ন হইবে, রাজারা দুর্গত ও কৃপণ হইবেন; তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা সর্ব্বাপেক্ষা ঐশ্বর্য্যশালী হইবেন, তাঁহাদেরও ভাণ্ডারে লক্ষাধিক মুদ্রা সঞ্চিত থাকিবে না। এই অভাবগ্রস্ত নৃপতিগণ জনপদবাসীদিগকে আপনাদের বপনকার্য্যে নিয়োজিত করিবেন; উপদ্র্বত প্রজারা নিজ নিজ কাজ ছাড়িয়া রাজাদেরই কাজ করিবে; তাঁহাদের জন্য ধান্য, যব, গোধূম, মুদ্‌গমাষাদি বপন করিবে, তৎসমস্ত রক্ষা করিবে, ক্ষেত্র হইতে কাটিয়া আনিবে, মর্দ্দন করিবে, এবং রাজভাণ্ডারে তুলিয়া রাখিবে। তাহারা ইক্ষুক্ষেত্র প্রস্তুত করিবে, যন্ত্র প্রস্তুত করিবে ও চালাইবে, রস পাক করিয়া গুড় প্রস্তুত করিবে; তাহারা পুষ্পোদ্যান ও ফলোদ্যান রচনা করিবে। এই সকল উৎপন্ন দ্রব্যদ্বারা তাহারা রাজাদিগের কোষ্ঠাগারই পুনঃপুন পূর্ণ করিবে; কিন্তু নিজেদের কোষ্ঠাগারগুলি যে শূন্য রহিয়াছে সেদিকে একবারও দৃষ্টিপাত করিবে না-শূন্য কুম্ভের দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া পূর্ণকুম্ভেই পুনঃ পুনঃ জল ঢালিবে। কিন্তু মহারাজ, ইহাতেও আপনার কোন ভয় নাই। এখন আপনার নবম স্বপ্ন বলুন।’

৯. নবম স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম একটী পঞ্চবিধ পদ্মসম্পন্ন গভীর পুষ্করিণীর চারিধারেই স্নানের ঘাট; তাহাতে জলপান করিবার জন্য চতুর্দ্দিক হইতে দ্বিপদ ও চতুষ্পদগণ অবতরণ করিতেছে, কিন্তু এই পুষ্করিণীর জল সুগভীর মধ্যভাগে পঙ্কিল, অথচ তীরসমীপে দ্বিপদ, চতুষ্পদাদির অবতরণ-স্থানে স্ফটিকবৎ স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল। এ স্বপ্নের পরিণাম কি?’

‘ইহারও পরিণাম সুদূর ভবিষ্যদ্‌গর্ভে। তখন রাজারা অধর্ম্মপরায়ণ হইবেন; যথেচ্ছভাবে অন্যায়রূপে রাজ্যশাসন করিবেন; বিচার করিবার সময় ধর্ম্মের মর্য্যাদা রাখিবেন না। তাঁহারা অর্থলালসায় উৎকোচ গ্রহণ করিবেন, প্রজাদিগের প্রতি দয়া, ক্ষান্তি ও প্রীতি প্রদর্শনে বিমুখ হইবেন; লোকে যেমন ইক্ষুযন্ত্রে ফেলিয়া ইক্ষু নিষ্পেষণ করে, তাঁহারও সেইরূপ অতি নিষ্ঠুর ও ভীষণভাবে প্রজাদিগের পীড়নপূর্ব্বক নানা প্রকার কর গ্রহণ করিয়া ধনসংগ্রহ করিবেন। করভার-প্রপীড়িত প্রজাগণ অবশেষে করদানে অসমর্থ হইয়া গ্রাম নগরাদি পরিত্যাগপূর্ব্বক রাজ্যের প্রত্যন্ত প্রদেশে আশ্রয় লইবে। এইরূপে রাজ্যের মধ্যম জনপদসমূহ জনশূন্য এবং প্রত্যন্ত ভাগ বহুজন-সমৃদ্ধ হইবে, অর্থাৎ রাজরূপ পুষ্করিণীর মধ্যভাগ আবিল এবং তীরসন্নিহিত ভাগ অনাবিল হইবে। তবে ইহাতেও আপনার কোন ভয়ের কারণ নাই। আপনার দশম স্বপ্ন কি বলুন।’

১০. দশম স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম একটী পাত্রে তণ্ডুল পাক হইতেছে; কিন্তু তাহা সুসিদ্ধ হইতেছে না। সুসিদ্ধ হইতেছে না বলিবার তাৎপর্য্য এই যে তণ্ডুলগুলি যে পরস্পর সম্পূর্ণরূপে পৃথক্‌ থাকিয়া যাইতেছে-একই পাত্রে একসঙ্গে তিন প্রকার পাক হইতেছে-কতকগুলি তণ্ডুল গলিয়া গিয়াছে, কতকগুলি তণ্ডুলই রহিয়াছে, কতকগুলি সুপক্ব রহিয়াছে। এ স্বপ্নের ফল বলিতে আজ্ঞা হয়।’

‘ইহারও ফল বহুকাল পরে ভবিতব্য। তখন রাজারা অধার্ম্মিক হইবেন, তাঁহাদের পারিপার্শ্বিকগণ, এবং ব্রাহ্মণ, গৃহপতি, পৌর ও জানপদবর্গও অধার্ম্মিক হইবে। ফলত তখন সকল মনুষ্যই অধার্ম্মিক হইবে। শ্রমণ, ব্রাহ্মণ পর্য্যন্ত ধর্ম্মপথে চলিবে না। তদনন্তর তাহাদের বলিপ্রতিগ্রাহী বৃক্ষদেবতা, আকাশ-দেবতা প্রভৃতি উপাস্য দেবদেবীগণ পর্য্যন্ত অধর্ম্মমার্গে বিচরণ করিবেন। অধার্ম্মিক রাজার রাজ্যে বায়ু খর ও বিষম বেগে প্রবাহিত হইবে এবং আকাশস্থ বিমানকে কম্পিত করিবে; বিমান-প্রকম্পন হেতু দেবতারা কুপিত হইয়া বারিবর্ষণে বাধা দিবেন, বর্ষণ হইলেও সমস্ত রাজ্যে এক সময়ে হইবে না, তদ্দারা ক্ষেত্র-কর্ষণ ও বীজবপনেরও সুবিধা ঘটিবে না। রাজ্যের ন্যায় নগরের ও জনপদের সর্ব্বত্র এক সময়ে বৃষ্টিপাত হইবে না; তড়াগাদির উপরিভাগে বৃষ্টি হইবে ত নিম্নভাগে হইবে না, নিম্নভাগে বৃষ্টি হইবে ত উপরিভাগে হইবে না। রাজ্যের এক অংশে অতিবৃষ্টি-নিবন্ধন শস্যহানি হইবে, অংশান্তরে অনাবৃষ্টিতে শস্য শুকাইয়া যাইবে; ক্কচিৎ ক্কচিৎ বা সুবৃষ্টিবশত শস্যেৎপত্তি হইবে। এইরূপ একই রাজ্যের উপ্ত শস্য একপাত্রে পচ্যমান স্বপ্নদৃষ্ট ত-ুলের ন্যায় ভিন্ন ভিন্ন দশা প্রাপ্ত হইবে। কিন্তু ইহাতেও আপনার কোন শঙ্কার কারণ নাই। আপনার একাদশ স্বপ্ন কি বলুন।’
১১. একাদশ স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম পূতি-তক্রের[279] বিনিময়ে লক্ষ মুদ্রা মূল্যের চন্দন বিক্রীত হইতেছে। ইহার কি ফল বলুন।’

‘যখন সৎপ্রতিষ্ঠিত শাসনের অবনতি ঘটিবে, সেই সুদূর ভবিষ্যতে ইহার ফল পরিদৃষ্ট হইবে। তখন ভিক্ষুগণ নির্লজ্জ ও লোভপরায়ণ হইবে; আমি লোভের নিন্দা করিয়া যে সকল কথা বলিয়াছি, তাহারা চীবরাদি পাইবার লোভে লোকের নিকট সেই সকল কথাই বলিবে; তাহারা লোভবশে বুদ্ধশাসন পরিহারপূর্ব্বক বিরুদ্ধমতাবলম্বীদিগের সম্প্রদায়-ভুক্ত হইবে; কাজেই মনুষ্যদিগকে নির্ব্বাণাভিমুখে লইতে পারিবে না। কিরূপে মধুরস্বরে ও মিষ্টবাক্যে লোকের নিকট হইতে চীবরাদি লাভ করা যাইতে পারে, এবং ঐ সকল দান করিবার জন্য লোকের মতি উৎপাদন করিতে পারা যায়, ধর্ম্মোপদেশ দিবার সময় তাহারা কেবল ইহাই চিন্তা করিবে। অনেকে হাটে, বাজারে ও রাজদ্বারে বসিয়া কার্যাপণ, অর্দ্ধকার্ষাপণ প্রভৃতি মুদ্রাপ্রাপ্তির অশাতেও ধর্ম্মকথা শুনাইতে কুন্ঠিত হইবে না। ফলত যে ধর্ম্মের মূল্য নির্ব্বাণরূপ মহারত্ন, এই সকল ব্যক্তি তাহা চীবরাদি উপকরণ, কিংবা কার্ষাপণাদি মুদ্রারূপ অকিঞ্চিৎকর পদার্থের বিনিময়ে বিক্রয় করিতে প্রবৃত্ত হইবে-পূতি-তক্রের বিনময়ে লক্ষমুদ্রা মূল্যের চন্দন দান করিবে। কিন্তু ইহাতেও আপনার কোন ভয়ের কারণ নাই। আপনার দ্বাদশ স্বপ্ন কি বলুন।’

১২. দ্বাদশ স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম যেন একটী শূন্যগর্ভ অলাবুপাত্র জলে ডুবিয়া গেল। ইহার ফল কি হইবে, প্রভো?’

‘ইহারও ফল বহুকাল পরে দেখা দিবে। তখন রাজারা অধার্ম্মিক হইবেন, পৃথিবী বিপথে চলিবে। তখন রাজারা সদ্‌বংশজাত কুলপুত্রদিগের প্রতি অবজ্ঞা দেখাইবেন এবং অকুলীনদিগের সম্মান করিবেন। অকুলীনেরা প্রভুত্ব লাভ করিবে; কুলীনেরা দরিদ্র হইবেন। রাজসম্মুখে, রাজদ্বারে, মন্ত্রভবনে ও বিচারস্থানে সর্ব্বত্রই অলাবু-পাত্র-সদৃশ অকুলীনদিগের কথা প্রবল হইবে-যেন তাহারাই কেবল সর্ব্ববিষয়ে তলস্পর্শী হইয়া সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে! ভিক্ষুসঙ্ঘেও পাত্র, চীবর, বাসস্থানাদির সম্বন্ধে কোন মীমাংসার প্রয়োজন হইলে দুঃশীল ও পাপিষ্ঠ ভিক্ষুদিগের বাক্যই বলবৎ বলিয়া পরিগণিত হইবে, সুশীল ও বিনয়ী ভিক্ষুদিগের কথায় কর্ণপাত করিবে না। ফলত সমস্ত বিষয়েই অলাবু-পাত্রসদৃশ অন্তঃসারহীন ব্যক্তিদিগের সারবত্তা প্রতিপন্ন হইবে। তবে ইহাতেও আপনার কোন ভয় নাই। আপনি ত্রয়োদশ স্বপ্ন কি বলুন।’

১৩. ত্রয়োদশ স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম, গৃহপ্রমাণ প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শিলাখণ্ডসমূহ নৌকার ন্যায় ভাসিয়া যাইতেছে। ইহার ফল কি বলুন।’

‘ইহারও ফল পূর্ব্বোক্ত সময়ে দেখা যাইবে। তখন অধার্ম্মিক নৃপতিগণ অকুলীনদিগের সম্মান করিবেন, অকুলীনেরা প্রভুত্ব লাভ করিবে, কুলীনদিগের দুর্দ্দশার সীমা-পরিসীমা থাকিবে না। তখন লোকে কুলীনদিগকে তুচ্ছ জ্ঞান করিবে, অকুলীনদিগের সম্মান করিবে। রাজসম্মুখে, মন্ত্রভবনে, বিচারস্থানে, কুত্রাপি শিলাখণ্ডসদৃশ সারবান, বিচারকুশল কুলপুত্রদিগের কথা লোকের হৃদয় স্পর্শ করিতে পারিবে না; তাহা বৃথা ভাসিয়া যাইবে; তাহারা কোন কথা বলিতে চাহিলে অকুলীনেরা পরিহাস-সহকারে বলিবে, ‘এরা আবার কি বলে?’ ভিক্ষু সঙ্ঘেও এইরূপে শ্রদ্ধার্হ ভিক্ষুর কথার
আদর থাকিবে না; উহা কাহারও হৃদয়ের তলদেশ স্পর্শ করিবে না; আবর্জ্জনার ন্যায় ভাসিয়া যাইবে। কিন্তু ইহাতেও আপনার কোন ভয় নাই। এখন আপনার চতুর্দ্দশ স্বপ্ন বলুন।’

১৪. চতুর্দ্দশ স্বপ্ন ও তাহার ফল :

দেখিলাম মধুকপুষ্প-প্রমাণ[280] ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মণ্ডুকেরা মহাবেগে একটী প্রকাণ্ড কৃষ্ণ সর্পের অনুধাবন করিয়া তাহাকে উৎপলনালের ন্যায় খণ্ড খণ্ড করিয়া খাইয়া ফেলিল। এ স্বপ্নের কি ফল হইবে বলুন।’

‘ইহার ফল বহুকাল পরে ঘটিবে। তখন লোকক্ষয় আরব্ধ হইবে; লোকে প্রবল রিপুর তাড়নায় তরুণী ভার্য্যাদিগের বশীভূত হইয়া পড়িবে, গৃহের ভৃত্য ও দাসদাসী, গোমহিষাদি প্রাণী এবং সুবর্ণরজতাদি ধন, সমস্তই এই সকল রমণীদিগের আয়ত্ত হইবে; স্বামীরা যখন জিজ্ঞাসা করিবেন, ‘অমুক পরিচ্ছদ বা অমুক স্বর্ণ রৌপ্য কোথায় আছে’, তখন তাহারা উত্তর দিবে ‘যেখানে খুশি সেখানে থাকুক; তোমরা তোমাদের আপন কাজ কর; আমাদের ঘরে কি আছে না আছে, তাহা তোমরা জানিতে চাও কেন?’ ফলত রমণীগণ নানা প্রকারে ভর্ত্তাদিগকে ভর্ৎসনা করিবে, বাক্যবাণে জর্জরিত করিবে এবং ক্রীতদাসের ন্যায় আয়ত্ত করিয়া আপনাদের আধিপত্য স্থাপন করিবে। এরূপ হওয়াও যে কথা, মধুকপুষ্পপ্রমাণ-ম-ুককর্ত্তৃক কৃষ্ণসর্পভক্ষণও সেই কথা।
কিন্তু ইহাতেও আপনার কোন আশঙ্কা নাই। আপনার পঞ্চদশ স্বপ্ন কি বলুন।’

১৫. পঞ্চদশ স্বপ্ন ও তাহার ফল :

‘দেখিলাম দশবিধ অসদ্ধর্ম্মবিশিষ্ট[281] এক গ্রাম্য কাক কাঞ্চনবর্ণপক্ষযুক্ত সুবর্ণ রাজহংসপরিবৃত হইয়া বিচরণ করিতেছে। ইহার ফল কি হইবে?’

‘ইহারও ফল বহুদিন পরে হইবে। তখন রাজারা নিতান্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িবেন, এবং গজশাস্ত্রাদিতে ও যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ হইবেন। তাঁহারা রাজ্যভ্রষ্ট হইবার আশঙ্কায় স্বজাতীয় কুলপুত্রদিগের হস্ত কোনরূপ প্রভুত্ব রাখিবেন না; পরন্তু নীচ জাতীয় দাস, নাপিত প্রভৃতিকে উচ্চ উচ্চ পদে নিযুক্ত করিবেন। এইরূপে জাতিগোত্রসম্পন্ন কুলপুত্রগণ রাজপ্রাসাদে বঞ্চিত হইয়া জীবিকানির্ব্বাহের নিমিত্ত কাক-পরিচর্য্যা-নিরত সুবর্ণ রাজহংসদিগের ন্যায় জাতিগোত্রহীন অকুলীনদিগের উপাসনা করিবেন। কিন্তু ইহাতেও আপনার কোন আশঙ্কা নাই। আপনার ষোড়শ স্বপ্ন কি বলুন।’

১৬. ষোড়শ স্বপ্ন ও তাহার ফল :
এতকাল দেখিয়াছি বৃকেরাই ছাগ বধ করিয়া আহার করিয়াছে; কিন্তু স্বপ্নে দেখিলাম ছাগে বৃকদিগের অনুধাবন করিতেছে এবং তাহাদিগকে ধরিয়া মুর্মুর করিয়া খাইতেছে। বৃকগণ দূর হইতে ছাগ দেখিবামাত্র নিতান্ত ভীত হইয়া পলায়ন করিতেছে এবং গুল্মগহনে আশ্রয় লইতেছে। এ স্বপ্নের ফল কি বলুন।’

‘ইহারও ফল সুদূর ভবিষ্যতে অধার্ম্মিক রাজাদিগের সময়ে দেখা যাইবে। তখন অকুলীনগণ রাজানুগ্রহ প্রভুত্বভোগ করিবে এবং কুলীনেরা অবজ্ঞাত ও দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইবেন। রাজার প্রিয়পাত্রগণ ধর্ম্মাধিকরণেও ক্ষমতাশালী হইবে, এবং প্রাচীন কুলীনদিগের ভূমি ও পরিচ্ছদাদি সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করিবে। কুলীনেরা ইহার প্রতিবাদ করিলে তাহারা তাঁহাদিগকে বেত্রদ্বারা প্রহার করিবে এবং গ্রীবা ধরিয়া বহিষ্কৃত করিয়া বলিবে, ‘তোমরা নিজেদের পরিমাণ বুঝনা যে আমাদের সহিত বিবাদে প্রবৃত্ত হইয়াছ! রাজাকে বলিয়া তোমাদের হস্তপদাদি ছেদন করাইয়া দুর্দ্দশার চূড়ান্ত ঘটাইব।’ ইহাতে ভয় পাইয়া কুলীনগণ বলিবেন, ‘এ সকল দ্রব্য আমাদের নহে, আপনাদের; আপনারাই এ সমস্ত গ্রহণ করুন। অনন্তর তাঁহারা স্ব স্ব গৃহে গমন করিয়া প্রাণভয়ে লুকাইয়া থাকিবেন।
ভিক্ষুসমাজেও এইরূপ বিশৃঙ্খলতা ঘটিবে; ক্রুরমতি ভিক্ষুগণ-ধার্ম্মিক ভিক্ষুদিগকে যথারুচি উপদ্র্বত করিবে; ধার্ম্মিক ভিক্ষুগণ অশরণ হইয়া বনে পলায়ন করিবেন। ফলত স্বপ্নদৃষ্ট-ছাগভয়ে বৃকগণ যেমন পলায়ন করিয়াছে, সেইরূপ অভিজাতগণ নীচবংশীয় লোকের ভয়ে এবং ধার্মিক ভিক্ষুগণ অধার্ম্মিক ভিক্ষুদিগের ভয়ে পলায়নপর হইবেন। কিন্তু ইহাতেও আপনার কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা নাই; কারণ এ স্বপ্নের লক্ষ ভবিষ্যৎ। ব্রাহ্মণেরা যে বহু বিপত্তি ঘটিবে বলিয়া আপনাকে ভয় দেখাইয়াছেন তাহা শাস্ত্রসঙ্গত নহে, আপনার প্রতি স্নেহসম্ভুতও নহে; অত্যন্ত অর্থলালসাবশতঃই তাঁহারা এইরূপ বলিয়াছেন।’

শাস্তা উক্তরূপে ষোড়শ মহাস্বপ্নের ব্যাখ্যা করিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ, আপনিই যে প্রথম এই সকল স্বপ্ন দেখিলেন তাহা নহে, অতীত কালের রাজারাও এইরূপ স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন এবং তখনও ব্রাহ্মণেরা তদুপলক্ষে যজ্ঞানুষ্ঠানের ছল পাইয়াছিলেন। কিন্তু শেষে পণ্ডিতদিগের পরামর্শে রাজারা বোধিসত্ত্বের নিকট গিয়া স্বপ্নবৃত্তান্ত বলিয়াছিলেন এবং আমি যেমন ব্যাখ্যা করিলাম, বোধিসত্ত্বও তখন সেইরূপ ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন।’অনন্তর শাস্তা রাজার অনুরোধে সেই অতীত কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন :—]

অতীতকালে বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের সময়ে বোধিসত্ত্ব উদীচ্য ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। বয়ঃপ্রাপ্তির পর তিনি ঋষিপ্রব্রজ্যা অবলম্বনপূর্ব্বক অভিজ্ঞা ও সমাপত্তি লাভ করিলেন এবং হিমালয়ে অবস্থান করিয়া ধ্যানসুখ ভোগ করিতে লাগিলেন।

আপনি যেমন স্বপ্ন দেখিয়াছেন, রাজা ব্রহ্মদত্তও একদিন সেইরূপ স্বপ্ন দেখিয়া ব্রাহ্মণদিগের নিকট তাহার ফল জিজ্ঞাসা করিলেন। ব্রাহ্মণেরা স্বস্ত্যয়নার্থ যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করিলেন। এই সকল ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে একজন তরুণবয়স্ক মেধাবী অন্তেবাসিক ছিলেন। তিনি আচার্য্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি আমাকে বেদত্রয় শিক্ষা দিয়াছেন। একের প্রাণসংহার দ্বারা অপরের মঙ্গল সম্পাদন অসম্ভব, বেদে এই মর্ম্মের একটী বচন আছে বলিয়া মনে হয় না কি? আচার্য্য বলিলেন, ‘বৎস, এই উপায়ে আমাদের বহু ধনপ্রাপ্তি ঘটিবে। তুমি দেখিতেছি রাজার ধন রক্ষার জন্য ব্যস্ত হইয়াছ!’ অন্তেবাসিক বলিলেন, ‘আচার্য্য, আপনাদের যেরূপ অভিপ্রায় হয় করুন; আমার এখানে থাকিয়া ফল কি?’ এই বলিয়া তিনি সেই স্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক রাজার উদ্যানে চলিয়া গেলেন।

সেইদিন বোধিসত্ত্ব ধ্যানযোগে সমস্ত বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া ভাবিতে লাগিলেন, ‘আমি অদ্য লোকালয়ে গেলে অনেককে বন্ধনমুক্ত করিতে পারিব।’ অনন্তর তিনি আকাশপথে বিচরণ করিয়া রাজ্যোদ্যানে অবতরণ করিলেন এবং মঙ্গলশিলাতলে উপবিষ্ট হইলেন, সেখানে তাঁহার দেহ হিরণ্ময়ী প্রতিমার ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অন্তেবাসিক বোধিসত্ত্বের নিকট গিয়া প্রণিপাতপূর্ব্বক একান্তে বিশ্রদ্ধভাবে উপবেশন করিলেন। অনন্তর উভয়ে মধুরালাপ আরম্ভ করিলেন। বোধিসত্ত্ব জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘রাজা যধাধর্ম্ম রাজ্যপালন করিতেছেন কি?’ অন্তেবাসিক উত্তর দিলেন, ‘রাজা নিজে ধার্ম্মিক; কিন্তু ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে বিপথে লইয়া যাইতেছেন। তিনি ষোলটী স্বপ্ন দেখিয়া ব্রাহ্মণদিগের উপদেশ প্রার্থনা করিয়াছিলেন; ব্রাহ্মণেরা এই সুযোগে যজ্ঞের ঘটা আরম্ভ করিয়াছেন। আপনি যদি দয়া করিয়া রাজাকে প্রকৃত স্বপ্নফল বুঝাইয়া দেন, তাহা হইলে বহু প্রাণীর ভয় বিমোচন হইতে পারে।’ বোধিসত্ত্ব বলিলেন ‘তাহা সত্য বটে; কিন্তু আমি রাজাকে চিনি না, রাজাও আমাকে চিনেন না। তবে রাজা যদি এখানে আসিয়া আমায় জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে স্বপ্নফল ব্যাখ্যা করিতে পারি।’ অন্তেবাসিক বলিলেন, ‘আমি এখনই গিয়া রাজাকে আনয়ন করিতেছি; আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার প্রত্যাবর্ত্তন পর্য্যন্ত মুহূর্ত্তকাল অপেক্ষা করুন।’ বোধিসত্ত্ব এই প্রস্তাবে সম্মত হইলে অন্তেবাসিক রাজসমীপে গিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ, এক ব্যোমচারী তপস্বী আসিয়া উদ্যানে অবস্থিতি করিতেছেন। তিনি আপনার স্বপ্নফল ব্যাখ্যা করিতে সম্মত হইয়া আপনাকে সেখানে যাইতে বলিয়াছেন।’

এই কথা শুনিয়া রাজা তৎক্ষণাৎ বহু অনুচরের সহিত সেই উদ্যানে গিয়া তপস্বীর চরণ বন্দনা করিলেন এবং একান্তে উপবেশনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ভগবন, আপনি আমার স্বপ্নফল বলিতে পারিবেন এ কথা সত্য কি?’ ‘পারিব বৈকি, মহারাজ! আপনি কি কি স্বপ্ন দেখিয়াছেন বলুন।’ রাজা ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া স্বপ্ন বর্ণন আরম্ভ করিলেন :

বৃষ, বৃক্ষ, ধেনু, বৎস … ইত্যাদি।

‘ফলত আপনি এখন যে পর্য্যায়ে স্বপ্নগুলি বলিলেন, ব্রহ্মদত্তও ঠিক সেই পর্য্যায়ে বলিয়াছিলেন।’

স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনিয়া বোধিসত্ত্ব বলিলেন, ‘মহারাজ, আর বলিবার প্রয়োজন নাই। ইহার কোন স্বপ্ন হইতেই আপনার কোন আশঙ্কার কারণ নাই।’ এইরূপে রাজাকে আশ্বস্ত করিয়া সেই মহাপুরুষ পুনর্ব্বার আকাশে উত্থিত হইলেন এবং সেখানে আসীন হইয়া ধর্ম্মোপদেশ দিতে দিতে রাজাকে পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠাপিত করিলেন।
তিনি উপসংহার কালে বলিলেন, ‘মহারাজ, অতঃপর ব্রাহ্মণদিগের সহিত মিলিয়া কখনও পশু ঘাতকর্ম্মে লিপ্ত হইবেন না।’ ইহার পর বোধিসত্ত্ব আকাশপথেই নিজ বাসস্থানে ফিরিয়া গেলেন। ব্রহ্মদত্ত তদীয় উপদেশানুসারে চলিলেন এবং দানাদি পুণ্যকর্ম্ম সম্পাদনপূর্ব্বক কর্ম্মানুরূপ ফলভোগার্থ করলেন।

সুত্রঃধর্মরস নামক ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত

error: Content is protected !!