কোথা হতে দুঃখের সৃষ্টি হয়?

কোথা হতে দুঃখের সৃষ্টি হয়?

৩০শে জুলাই ১৯৯৬ ইংরেজী সোমবার। শ্রদ্ধেয় বনভান্তের সাধনা কুঠিরের উপরের তলা। সময় ভোর বেলা। তাঁর শিষ্যদেরকে দেশনা দিচ্ছিলেন। তিনি যে লোকোত্তর দেশনা প্রদান করেন তা আমার (সংকলক) শারীরিক অসুস্থতা ও জ্ঞান পরিধির অভাবে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারিনি। তবুও যৎ সামান্য ধারণ করেছি তা আপনাদের নিকট প্রকাশ করছি। তাঁর দেশনার প্রধান সারমর্ম হল কোথা হতে দুঃখের সৃষ্টি হয়? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন- অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও উপাদান হতে এ দুঃখ গুলির সৃষ্টি হয়। অবিদ্যা অর্থ না জানা। কি না জানা? দুঃখ কি না জানা। দুঃখ সমুদয় কি না জানা। দুঃখের নিরোধ কিসে হয় না জানা। দুঃখ নিরোধের পথ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্বন্ধে না জানা। অর্থাৎ কোন কিছু সম্বন্ধে না জানা বা অজ্ঞানতাই অবিদ্যা।

তিনি বলেন- তৃষ্ণা হল দুঃখের কারণ। কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে অসার সুখ ভোগ করাকে কাম তৃষ্ণা বলে। ভব তৃষ্ণা অর্থ হল ভবে ভবে অর্থাৎ কামলোকে ও রূপলোকে ঘুরে ঘুরে জন্মগ্রহণ করে সুখ ভোগ করা। বিভব তৃষ্ণা হল উচ্ছেদ জনিত বীত তৃষ্ণা।

উপাদান অর্থ উৎস, উৎপত্তি মূল বুঝায়। উপাদান চার প্রকার। কাম উপাদান, আত্ম উপাদান, দৃষ্টি উপাদান ও শীলব্রত উপাদান।

কাম উপাদানঃ- পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক ইন্দ্রিয়ে সব সময় দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে। কি গ্রহণ করে? গ্রহণ করে লোভ মোহ, দ্বেষ মোহ অর্থাৎ লোভ, দ্বেষ মোহ গ্রহণ করে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ সাপ সব সময় ব্যাঙ তালাশ করে। ঠিক সেরূপ পঞ্চ ইন্দ্রিয়, রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শকে সব সময় তালাশ করে ও পিছনে পিছনে ধরার জন্য ধাওয়া করে। তাতে সুখের পরিবর্তে দুঃখের ভাগী হয়।

আত্ম উপাদানঃ- অর্থ হল দেহের মধ্যে আত্মা নামে এক জীব আছে। সেটা অজর অমর, শাশ্বত বলে মনে করে। তাতে ভীষণ অজ্ঞানতার সৃষ্টি হয়ে দুঃখ মুক্তির পথ খুঁজে পায়না। তাতে অনন্তকাল পর্যন্ত দুঃখে কালাতিপাত করে। আত্মা যে অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা ও ক্ষয় ব্যয় শীল বুঝতে সক্ষম নয়।

দৃষ্টি উপাদানঃ- দৃষ্টি উপাদান হল মিথ্যাদৃষ্টি উপাদান অর্থাৎ কোন বিষয় বা জিনিস ভাল মন্দ বিবেচনা করে মন্দটা বাদ দিয়ে ভালটা গ্রহণ করতে পারে না। যেমন অন্ধ ব্যক্তি যে কোন জিনিস ভাল মন্দ বিচার করতে সক্ষম নয়। ঠিক দৃষ্টি উপাদান গৃহীত ব্যক্তি ও সেরূপ সব সময় সুখ মনে করে দুঃখে পতিত হয়।

শীলব্রত উপাদানঃ- কেউ কেউ নির্বাণ ধর্ম বুঝতে না পেরে অন্য ধর্ম, পর ধর্ম, হীন ধর্ম ও মিথ্যা ধর্ম আচরণ করতে থাকে। তারা মনে করে এ ধর্মে সুখ আছে, মুক্তি আছে ও শান্তি আছে। তাতে তারা সুখের পিছনে, মুক্তির পিছনে ও শান্তির পিছনে ধাবিত হয়ে বিপরীতে ফল লাভ করে থাকে। যেমন গরুর মত কচি ঘাস ও পাতা খাওয়াকে গোব্রত বলে। কুকুরের মত মাটি হতে জিহ্বা বা মুখ দিয়ে আহার করা। এটাকে কুকুর ব্রত বলে।

সকল দুঃখের মূল অবিদ্যা, তৃষ্ণা, কাম উপাদান, আত্ম উপাদান, দৃষ্টি উপাদান ও শীলব্রত উপাদান আছে বলে মানুষ সহজে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না। এ সমস্ত উপাদান ধ্বংস হলে কি হয় জান? সত্ত্ব মরে, আত্মা মরে ও মার মরে। যেমন চারি আর্য্যসত্যের মধ্যে দুঃখ সত্য হৃদয়ঙ্গম হলে সৎকায় দৃষ্টি বা আত্মবাদ সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়। দুঃখ সমুদয় নিরোধে উচ্ছেদ দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়। নিরোধ সত্য দর্শনে শাশ্বত দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়। মার্গ সত্য দর্শনে অক্রিয় দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়।

যারা উচ্ছেদ দৃষ্টি বাদী তারা এক গুয়ে। পুনঃ জন্ম নেই বলে, মরণের পরও দুঃখ নেই, মরণের পর সব শেষ হয়ে যায়, এ রকম তারা বলে থাকে। তাদের মধ্যে বহু দোষ থাকে।

সৎকায় দৃষ্টি বাদীরা পঞ্চ স্কন্ধে আমি আছি বা আমার ধারণা করে। পঞ্চ স্কন্ধ বলতে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে বুঝায়।

অক্রিয়াদৃষ্টি বাদীরা দান, শীল, ভাবনা ও পাপ পূণ্যের বিশ্বাস করেনা। এগুলির কোন ফলও নেই এ ধারণা তাদের বদ্ধমূল।

শ্বাশ্বত দৃষ্টি বাদীরা কিছু মাত্র ধার্মিক থাকে, পরকালও বিশ্বাস করে, কিন্তু তাদেরকে বুঝানো খুবই কঠিন। তারা সব সময় নিজকে ভাল, উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে।

উপসংহারে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে তাঁর শিষ্যদেরকে উদাত্ত কণ্ঠে বলেন- তোমরা জ্ঞান আহরন কর। কিসের জ্ঞান জান? শুধু লোকোত্তর জ্ঞান। লোকোত্তর জ্ঞানে সব দুঃখের অবসান ঘটে। সুতরাং তোমরা অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও উপাদান ধ্বংস করে পরম সুখ নির্বাণ প্রত্যক্ষ কর। নির্বাণ এমন অবস্থা, তা অন্য কেউ দেখিয়ে দিতে পারবে না। যেমন মিলিন্দ রাজা নাগসেন স্থবিরকে বলেছিলেন- নির্বাণ কোথায়? দেখায়ে দিন। তিনি বলেছিলেন- মহারাজ, বাতাস আছে? রাজা বললেন- হ্যাঁ আছে। স্থবির বললেন- তাহলে বাতাস দেখিয়ে দিন। রাজা বললেন- বাতাস দেখিয়ে দেয়া যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। স্থবির তখন বললেন- তাহলে নির্বাণও দেখিয়ে দেয়া যায় না। শুধু নিজে নিজে অনুভব করা যায়। এ বলে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সবাইকে নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্যে উৎসাহিত করে তাঁর দেশনার ইতি টানলেন।

#লেখাটি  Subrata Barua  কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে 

মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ

মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ

১৯৮৫ সাল। মে মাসের শুরু। বনভান্তের গৃহীকালীন মা পুণ্যশীলা বীরপুদি চাকমা ভীষণ অসুস্থ। বিশ/একুশ দিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন। সেই অসুখের মাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে দু’য়েকদিন হতে। মেঝ ছেলে (৩য় পুত্র) জহর লাল চাকমার বঙ্গলতুলিস্থ বাড়ীতে শয্যাশায়ী হয়ে মরণাপন্ন প্রায়। চিকিৎসায় কোন ফল হচ্ছে না দেখে জহর লাল, ভূপেন্দ্র লাল (৪র্থ পুত্র) ও বাবুল (৫ম পুত্র) চাকমারা মায়ের বেঁচে থাকার আশা এক প্রকার ছেড়েই নিলেন। জহর লাল চাকমার মনে পড়ল—“মায়ের এই শেষ অবস্থার খবর তো শ্রদ্ধেয় বনভান্তেকে জানানো দরকার। ভান্তে হলেও তিনি যে আমাদের বড় ভাই, মায়ের প্রথম পুত্র”। কিন্তু, পরক্ষণে সেই চিন্তা বাদ দিতে হল—মন থেকে। ভাবতে লাগলেন—কিভাবে এ’খবর জানাবেন! রাঙামাটি তো বহুদূরে। লঞ্চ যোগে রাঙামাটি গিয়ে ফিরে আসতে কম হলেও তিনদিন হাতে রাখতে হবে। মায়ের এই গুরুতর অসুস্থের সময় তিনদিন বাড়ীর বাইরে থাকা কী করে সম্ভব। অন্যদিকে লঞ্চ করে রাঙামাটি যেতে কতো জায়গায়ই-না আর্মির চেকপোষ্টের ভোগাক্তিতে পড়তে হয়, তার হিসেব নেই। আর সেসময় উল্টোপাল্টা কিছু ঘটলে তো সব-ই শেষ হয়ে যাবে। এসব ভেবে জহর লাল চাকমা রাঙামাটিতে আসতে সাহস করলেন না। ফলে বনভান্তেকে মায়ের মরণাপন্না অবস্থায় কথা জানাতে পারলেন না।

মৃত্যুর তিনদিন আগে মাতৃদেবী বীরপুদি চাকমা পুত্র জহর লালকে বললেন—“আমাকে মূল বাড়ির অমুক কামড়ায় স্থানান্তর কর”। মায়ের নির্দেশ পেয়ে জহর লাল চাকমাও তা-ই করলেন। উল্লেখ্য যে, এই কামড়াটিতে কোন এক অসুস্থতার সময় বনভান্তে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। একজন, দু’জন করে করে পাড়ার লোকজনেরা বীরপুদি চাকমার এ’গুরুতর অসুস্থের অবস্থা দেখে যেতে লাগলেন। মৃত্যুর একদিন আগে বিকেল বেলায় হঠাৎ শয্যাশায়ী বীরপুদি চাকমা বলে উঠলেন—“ভান্তে, তুমি আজ বিকালে এসেছ। সকালে আসলে তো সিয়্যং-এর ব্যবস্থা করতাম”। মায়ের একথা শুনে জহর লাল চাকমারা ভাবলেন, মা অসুখের ঘোরে এসব বলছেন নিশ্চয়। তা না হলে ভান্তেকে দেখলেন কোথায়! ভান্তেকে তো আমরা খবরটুকুও দিতে পারি নি। ভান্তে আসবেন কীভাবে। আর ভান্তে যদি সত্যি সত্যিই আসতেন, তাহলে আমরা সবাই দেখতাম। মা একাই দেখবেন কেন! তবে পরক্ষণে লালের মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। চিন্তা আসলো, আহা-রে! মা তাঁর বড়ো ছেলেকে কতো-ই ভালোবাসেন। এসময়ও তাঁর কথা স্মরণ করছেন। নিশ্চয় খুব দেখতে ইচ্ছা করছে বড়ো ছেলেকে। কিন্তু, আমি তো তাঁকে খবরই দিতে পারি নি। হয়ত মা-এর এটা-ই শেষ ইচ্ছা। মার এ’ইচ্ছাটুকু পূরণ করে দিতে পারছি না, পারলাম না। এভেবে নিজকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল তার। পরদিন ভোরে বীরপুদি চাকমা পুত্রবধুকে “বৌমা, বৌমা” বলে ডেকে উঠলেন। আর নির্দেশের স্বরে বললেন—“তাড়াতাড়ি সিয়্যং রান্না কর। আজ বনভান্তে এখানে এসে সিয়্যং খাবেন”। শ্বাশুড়ির কথায় তেমন বিশ্বাস না জন্মালেও সিয়্যং রান্না করলেন পুত্রবধু। সকাল সাড়ে দশটার দিকে বীরপুদি চাকমা বেশ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন “বৌমা, বনভান্তে আসতেছেন। তাড়াতাড়ি ঐ পালংকের উপর একটা পাটি বিছায়ে দাও, নতুন একটা চাদর বিছায়ে দাও। সিয়্যং রান্না হলে ভান্তেকে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা কর।” তবে কোথায় ভান্তে! পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউ-ই তো দেখতে পাচ্ছেন না। তারপরও তারা পালংকের উপর পাটি বিছায়ে দিলেন, নতুন একটা ছাদর বিছায়ে দিলেন। অল্পক্ষণ পর সেখানে ভান্তের উদ্দেশ্যে সিয়্যং দিলেন যত্নসহকারে। সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে বীরপুদি চাকমা মৃদুস্বরে বলে উঠলেন—“ঐ তো, ঐ তো বনভান্তে আবার আসতেছেন”। একথা বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দিনটি ৬ই মে ১৯৮৫ ইং, ২৩শে বৈশাখ ১৩৯২ বাংলা, ২৫২৮ বুদ্ধাব্দ, রোজ সোমবার। দীর্ঘ ২৬ দিন পর্যন্ত অসুখে ভোগার পর তাঁর মৃত্যু হল।

এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বনভান্তের একনিষ্ঠ উপাসক ও প্রতিদিন বিহারে এসে ভান্তেকে সেবা প্রদানকারী, রাজমাতা আরতি রায়ের ছোট ভগ্নিপতি বাবু সমর বিজয় চাকমা বলেন, “সেদিন বনভান্তে রাজবন বিহারে সিয়্যং গ্রহণ করেন নি। প্রায় সারাদিন তাঁর রুমের ভেতর অবস্থান করেছিলেন। রুমের জানলাও বন্ধ রেখেছিলেন। শ্রামণদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন—তাঁকে যেন ডাকা না হয়। সময় হলে তিনি নিজে রুমের দরজা খুঁলেবেন। সন্ধ্যার দিকে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।” এসব ঘটনা থেকে এটা বলা যায়, বনভান্তে সেদিন মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। উল্লেখ্য যে, তাঁকে প্রব্রজ্যা গ্রহণের অনুমতি প্রদানকালে মাতৃদেবী বীরপুদি চাকমা অনুরোধ করেছিলেন—মৃত্যুর সময় যেন তোমারে দেখতে পাই। সেসময় তুমি যেখানে, যে অবস্থায় থাকেন না কেন। আর তিনিও মায়ের অনুরোধ রক্ষা করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। তাই এ’দিন অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে মায়ের সেই অনুরোধটুকু রক্ষা করলেন।

সাধু সাধু সাধু

(তথ্যসূত্র: বনভান্তের দেশনা (২য় খন্ড)—ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়া)।

নিভৃতচারী ধুতাঙ্গ সাধক ভাবনানন্দ মহাস্থবিরের কথা

নিভৃতচারী ধুতাঙ্গ সাধক ভাবনানন্দ মহাস্থবিরের কথা

নিভৃতচারী ধুতাঙ্গ সাধক ভাবনানন্দ মহাস্থবিরের কথা

লিখেছেন- উজ্জ্বল বড়ুয়া বাসু

কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়েই ভান্তের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক কী কারণে ভান্তের কাছে প্রথমবার গিয়েছিলাম মনে পড়ে না…. তবে যে কারণেই যাই না কেনো ভান্তের সৌম্য দেহ, সুন্দর বাচনভঙ্গী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কিছু এত বেশি আকর্ষণ করতো যে যখনই একটু ফ্রি সময় পেতাম, কিংবা মনটা বিষন্নতায় ভরে যেত তখনি ভান্তের কাছে ছুটে যেতাম। অন্যরকম এক প্রশান্তিতে ভরে যেত জোয়ারা খানখানাবাদের ভাবনানন্দ বিদর্শন আরামে গেলে। যেতে কিন্তু খুব কষ্টই পেতে হতো। কাঞ্চননগর বাদামতলের আগের স্টেশনে নেমে ফতেনগর মহাবোধি পর্যন্ত কোনো রকমে রিক্সায় যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তারপর হাঁটা শুরু। দুরত্ব যত না বেশি তার চেয়ে বেশি বিপদজনক ছিল রাস্তার কাঁদাগুলো। তারপরও কিসের টানে এই কাঁদা অতিক্রম করে ভান্তের জন্য অল্প ছোয়াইং নিয়ে চলে যেতাম বুঝতাম না। তবে হ্যাঁ তৎকালীন সময়ের প্রচলিত একটি কথাও বেশ নাড়া দিত। জোয়ারারই আশে পাশের কিছু লোকজন একসময পূজ্য বনভান্তের কাছে গিয়েছিলেন। আর সেসময় পূজ্য বনভান্তে নাকি বলেছিলেন আমার কাছে এত কষ্ট করে আসার দরকার কি তোমাদের পাশের গুণীভান্তে ভাবনানন্দ এর সেবা করো। সেই থেকে পূজ্য ভাবনানন্দ ভান্তের কিছুটা প্রচার বেড়ে যায়। ভান্তের ওখানে একটি বিষয় আমাকে বেশ নাড়া দিত। সেটা হচ্ছে ভান্তের ছোয়াইং খাওয়া। ভান্তের শিষ্য পরমানন্দ ভান্তে এবং তিলোকানন্দ ভান্তের কথা মনে আছে উনারা ভান্তের জন্য পাত্র তে করে ছোয়াইং নিয়ে আসতেন। পাত্রের ভিতরে কি আছে তা দূর থেকে দেখা যায়। সেখানে কিছু খাবারের মিশ্রণ। সেগুলো কি ভাত, নাকি তরকারী তা বুঝা যেত না। বলা যায় এই মিশ্রণটা দেখলেই কেমন জানি লাগতো। মনে মনে ভাবতাম যে খাদ্যগুলো দেখতেই ঘৃণা লাগে সেগুলো ভান্তে খায় কিভাবে? ছাবাইকে সবধরণের খাবারগুলো কে একত্রে এমনভাবে মিশ্রিত করতেন যে, কোন সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন ব্যক্তির ওই খাবারের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ জন্মাবে না, খেতে দিলেও মনে হয় ওগুলো কেউ খাবেনা। ভাত এবং তরকারী একত্রে মিশানোর ফলে মিশ্রণটার রংটা কেমন জানি বিদগুটে হয়ে যেত। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করতাম ভান্তে কেনো এভাবে খায়? আবার নিজে নিজেকে উত্তর দিতাম মনে হয় কোন তরকারীর কি মজা তা না বুঝার জন্য এমনটা করেন। তখন বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি না বুঝলেও এখন পিটকীয় নানা বই পড়ে মিলিয়ে দেখলে বুঝতে পারি ভান্তে মূলত পাত্রপিণ্ডিক ধুতাঙ্গ পালন করতেন। আর তাই তো সবকিছু একবারে নিয়ে মিশ্রণ তৈরী করেই তিনি পিণ্ড গ্রহণ করতেন। বিভূষণের জন্য নয়, ক্রীড়ার জন্য নয়, শক্তিপ্রদর্শনের জন্য নয়…….. ক্ষুধারোগ নিবারণের জন্য, ব্রহ্মচর্য অনুগ্রহের জন্য যেভাবে পিটকে পিন্ডগ্রহণের কথা আছে ঠিক যেন তিনি তেমনটাই পালন করতে চাইতেন। পূজ্য ভাবনানন্দ মহাস্থবিরের গৃহী নাম ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বড়ুয়া। পিতা ঊমা কিশোর তালুকদার এবং মাতা ধীরমনি তালুকদার এর কোল আলোকিত করে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেন ১৯০৬ইং সনের ২৫জুন । মা-বাবার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ঈশ্বর চন্দ্র বড়ুয়া যৌবনে চাকুরীর সন্ধানে প্রথমে কলকাতায় যান পরবর্তীতে সেখান থেকে বার্মায়(বর্তমান মায়ানমার) যান। বার্মায় চাকুরীর ফাঁকে ফাঁকে ভিক্ষুসংঘের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। আর এই সেবার ব্রতই তাকে ষষ্ঠ সঙ্গায়নে অংশগ্রহণকারীদের ভিক্ষুদের সেবার সুযোগ করে দেয়। সেই সঙ্গায়নেই তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন ১৯৫৬ইং তে প্রখ্যাত বিদর্শন সাধক ঊনু উত্তরা ছেয়াদ এর নিকট। পরবর্তীতে ১৯৬০ইং তে রেঙ্গুনের খ্যাতিমান সাধক কামাইউট মেধাবী ছেয়াদ এর অধীনে তিনি বিদর্শন ধ্যান অনুশীলন করেন। ১৯৬৩ইং তে তিনি বার্মা থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ১৯৬৬ইং তে তিনি বিদর্শন সাধক ভদন্ত ধর্মবিহারী মহাথের (প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া) এর অধীনে উপসম্পদা লাভ করেন। উপসম্পদা লাভের পর তিনি জোয়ারা খানখানাবাদ পঞ্চরত্ন বিহার ও মধ্যম জোয়ারা সুখরঞ্জন বিহারে বর্ষাবাস যাপন করেন। এসময় তিনি মুকুটনাইট বৌদ্ধ সেবাসদনে তিন কক্ষবিশিষ্ট পাকা বিহার নির্মাণ, ফতেনগর বেনুবন বিহারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন, নিজ গ্রামে শ্মশানে ধ্বংস প্রাপ্ত স্মৃতি মন্দির গুলোর পুনঃনির্মাণ করেন। “গৃহীদের মুক্তির সন্ধান’ নামে একটি বইও লিখেন তিনি। পরবর্তীতে নিজের পৈত্রিক ভিটায় “ভাবনানন্দ আরাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। পুজ্যভান্তের নিভৃতে বিনয়োচিত জীবন চলা যখন প্রচার পেয়ে যায় তখন দূরদুরান্ত থেকে অনেক মানুষ যেতেন তাকে দর্শনের উদ্দেশ্যে। ভান্তে ছাবাইক হাতে নিয়েই শিষ্যদের প্রথমে জিজ্ঞেস করতেন যে, উপাসক-উপাসিকাদের জন্য খাবার আছে কিনা। শিষ্য হ্যাঁ বোধক উত্তর দেওয়ার পরই তিনি ছোয়াইং খাওয়া শুরু করতেন। ভান্তের সান্নিধ্যে যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যতজন ব্যক্তিই সেখানে আসুক না কেন কেউই না খেয়ে ফিরতেন না। মনে হত যেন সেখানকার খাদ্যগুলো বেড়েই যেত। আর অল্পতেই খুব তৃপ্তি ভরে খাওয়া যেত সেখানে। ভান্তে গতানুগতিক দেশনা খুব কমই দিতেন, বেশীরভাগ সময় ধর্মালোচনার মত করেই দেশনা দিতেন। যাই হোক, আমার মতো অধমের পরম সৌভাগ্য হয়েছিল যে, এই নিরব সাধকের সান্নিধ্যে প্রায় পনের বারের মত যাওয়া, সেবা করা এমনকি ভান্তের শিষ্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুবাদে আমি এবং আমার কয়েক বন্ধুর ভান্তের মরদেহ কে যেই মঞ্চে রাখা হয়েছিল সেই মঞ্চ পুষ্প দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব পাওয়া,ভান্তেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় বিউগলে যে করুণ সুর বাজানো হয়েছিল তার নির্দেশনারও দায়িত্ব পাওয়ার। আলোকিত এই সংঘমনীষা ২০০৬ইং সনের ১১এপ্রিল, মঙ্গলবার ৭.৪৫মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন।

কৃশা গৌতমী

কৃশা গৌতমী

কৃশা গৌতমী

লেখেছেন- ভদন্ত সুপ্রিয় মহাথেরো

শ্রাবস্তীর এক দরিদ্র পরিবারে এক দুঃখী মেয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তাঁর দেহ ছিল অতিশয় কৃশকায় । তিনি জীর্ণ শীর্ণ কৃশকায় ছিলেন বলে কৃশা গৌতমী নামে পরিচিত ছিলেন । বিবাহিতা জীবনেও তিনি অনাদর ও অবহেলায় ছিলেন ।

লোকে তাঁকে অনাথা বলত । সংসার জীবনে তিনি এক পুত্র সন্তান প্রসব করেছিলেন । তাতেই তিনি মানুষের কাছে সম্মান লাভ করতে শুরু করলেন ।পুত্রটি যখনই শিশুকাল অতিক্রম করে শৈশবে পদার্পন করল তখন তাঁর মৃত্যু হয় ।

পুত্রের এমন মৃত্যুতে মাতা কৃশা গৌতমী শোকে উদভ্রান্ত হয়ে গেলেন ।
উন্মাদিনী হয়ে মৃত পুত্রটি কোলে নিয়ে দ্বারে দ্বারে গিয়ে বললেন – “সন্তানের জন্য ঔষধ দাও ।”
নগরবাসী বলল, ‘ঔষধ কি জন্য, ঔষধ দিয়ে কি হবে ?
মৃত সন্তান তো ঔষধে প্রাণ ফিরে পাবে না ।
কিন্তু পুত্র শোকে পাগলিনী, শোকাতুরা জননী তাদের কথা বুঝতে পারলো না ।

অবশেষে এক ব্যক্তি তাঁর বেদনা ও সম্যক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরে তাঁকে মহামানব বুদ্ধের নিকট গিয়ে ঔষধ প্রার্থনা করতে বললেন ।

কৃশা গৌতমী জেতবন বিহারে গিয়ে বুদ্ধের নিকট ঔষধ প্রার্থনা করলেন ।
গৌতমী বললেন – “ভগবান আমার সন্তানের জন্য ঔষধ দিন ।”
বুদ্ধ বললেন, “মানুষ মারা যায়নি এমন ঘর থেকে এক মুঠো সরিষা নিয়ে এস ।”
কৃশা গৌতমী সরিষার জন্য প্রতি ঘরে ঘরে গেলেন । কিন্তু মানুষ মারা যায়নি এমন একটিও পরিবার খুঁজে পেলেন না ।

তিনি দেখলেন জীবিতের চেয়ে মৃতের সংখ্যাই বেশী । একথা চিন্তা করতে
করতে তাঁর মনে জ্ঞান চক্ষু খুলে যায় ।
ফলে সে আসল সত্য উপলব্দি করতে সক্ষম হল । তাঁর মনের দুঃখ অনেকটা লাঘব হল ।

তিনি শশ্মানে গিয়ে মৃত পুত্রের দেহ সৎকার করলেন । তারপর তিনি বুদ্ধের নিকট আবার উপস্থিত হলেন ।

বুদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন – তোমার মৃত ছেলের জন্য সরিষা পেয়েছ ?
কৃশা গৌতমী বললেন – ভগবান ! শস্যবীজের আর প্রয়োজন নেই । আমাকে দীক্ষাদান করুন ।
বুদ্ধ বললেন – মানুষ মরণশীল । জন্ম নিলে মৃত্যু হবে ।
বুদ্ধ একটি উদাহরণ দিয়ে উপদেশ দিলেন, “প্রবল বন্যা যেমন
ঘুমন্ত গ্রাম ভাসিয়ে নেয় তেমনি মৃত্যুও সকলকে হরণ করে ।”

বুদ্ধের উপদেশ শুনে কৃশা গৌতমী স্রোতাপন্ন হয়ে ভিক্ষুণীধর্ম পালনের প্রার্থনা করলেন ।
তাঁর প্রার্থনা পূর্ণ হল । তিনি অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে অর্হত্ব প্রাপ্ত হন । তিনি
ভিক্ষুণীধর্মের নিয়ম যথাযথ পালন করে খ্যাতি লাভ করেন । তাঁকে জেতবনের ভিক্ষুণীসংঘে যথার্থ ও সম্মানের আসন দেওয়া হয়েছিল ।

“মাতা-পিতাই হলেন সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মা সদৃশ”

“মাতা-পিতাই হলেন সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মা সদৃশ”

শাসন রক্ষিত ভান্তের দেশনা:

উপাসক উপাসিকগণ, যে মা তার বুকের দুগ্ধ পান করিয়ে সন্তানকে পালন করেছেন, যে বাবা রোদে পুড়ে ঝড়ে ভিজে কঠোর পরিশ্রম করে আহার যুগিয়ে সন্তানকে মানুষ করেছেন, সেই সন্তানের কাছে মা-বাবার চেয়ে অন্য কোন কিছুই বড় হতে পারে না। আজ তাদের কারণেই আমরা নিজেকে পুণ্যময় কাৰ্য্যের মধ্য দিয়ে মানব জীবনকে সার্থক করে তোলার সুযোগ লাভ করেছি, সেই জীবনের জন্য হলেও আমরা মা-বাবার কাছে ঋণী । মা-বাবা ধনী হোক কিংবা গরীব হোক, শিক্ষিত হোক কিংবা অশিক্ষিত হোক, জ্ঞানী হোক কিংবা অজ্ঞানী হোক, যেই হোক না কেন তাদের স্নেহ, করুণার দানকে অস্বীকার করার সাধ্য কোন সন্তানের নেই। যে ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা দিয়ে মা-বাবা আমাদেরকে লালন-পালন করেছেন, হাজার হাজার টাকা ব্যয় কলে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করেছেন তা বর্ণনাতীত ও অতুলনীয়। বলতে গেলে মা-বাবার কৃত উপকারের ঋণ অপরিশোধ্য। মা-বাবার সেই কৃত উপকার স্মরণ করে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা মানবীয়তার মহৎ গুণ।

মা-বাবাই হলেন সন্তানের কাছে দেবোত্তম ব্ৰহ্মাস্বরূপ। এক সময় ভগবান বুদ্ধ বলেছিলেন—“তোমরা সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মাকে দেখতে ইচ্ছা কর কি? যদি সাক্ষাৎ ব্ৰহ্মাকে দেখতে চাও তাহলে তোমরা সাক্ষাৎ মা-বাবাকে দেখ।” কারণ মা-বাবা সন্তানের প্রতি ব্ৰহ্মবিহারী হয়ে জীবন যাপন করেন। ব্ৰহ্মবিহারী বলতে বুঝায়—যারা মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা এই চারিগুণের অনুশীলন করেন। মা-বাবাগণ সন্তানদেরকে সর্বদাই সর্বক্ষেত্রে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসেন। তাদের ভালোবাসা ও মায়া-মমতার কোন তুলনা নেই। পশু-পাখি জীব জন্তুর বাচ্চারা জন্মলগ্ন থেকে কিংবা জন্মের অল্পকাল পর হতেই আতনির্ভরশীল হয়ে উঠে। কিন্তু মানব শিশু আত্মনির্ভরশীল হতে সময় লাগে অনেক বছর । এ সময় মা-বাবাই হয় তার একমাত্র ভরসা । তারা আদরে-সোহাগে, স্নেহ-মমতা দিয়ে ধীরে ধীরে সন্তানকে বড় করে তোলেন। সন্তানের সুখ-সাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা নিজেদের সুখ-সাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে উপরন্তু সন্তানদের সুখ-শান্তি কামনা করেন। সন্তানের প্রতি মা-বাবার এই অকৃত্রিম ভালোবাসাই হলো মৈত্রগুণ।

সন্তানের জন্য মা-বাবার চেয়ে বেশি আপন ও মঙ্গলাকাঙ্খী জগতে আর কেউ হতে পারে না । মা-বাবাই সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন। সন্তানের কোন দুঃখ-বেদনা, কিংবা, অমঙ্গল কোন মা-বাবাই কামনা করেন না। তাদের অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি হতে দেখলে মা-বাবাগণ অতীব দুঃখিত হন। সন্তানের দুঃখের জন্য মা-বাবার যে আবেগ-উৎকণ্ঠা পৃথিবীতে বিরল। সন্তানের সুখ-শান্তির জন্য তারা নিজেদের জীবন বলি দিতে রাজী থাকেন এবং তাদের দুঃখ-দুৰ্দশা থেকে কিভাবে মুক্ত করা যায় সেই কামনা ও প্রচেষ্টায় থাকেন। সন্তানের দুঃখে দুঃখিত হয়ে তাদের দুঃখ-মুক্তির জন্য তাদের অন্তরে যে করুণা জাগ্রত হয় যা অতুলনীয়। ইহা সন্তানের প্রতি মা-বাবার করুণাগুণ ।

বলতে গেলে মা-বাবার সমস্ত জীবনই সন্তানের জন্য উৎসর্গীত। তাই তারা বহু কষ্টে উপার্জিত অৰ্থ-সম্পদ সন্তানের ভরণ পোষণার্থে ব্যয় করেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মা-বাবার দু’চোখের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। সন্তান যখন লেখা-পড়ায় ভাল করে জীবনে সফল হয় এবং তাদের নাম-যশ কীর্তি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, তা দেখে মা-বাবারা অত্যন্ত আনন্দিত হন। সন্তানের এই সাফল্য উন্নতি ও সুখ-সমৃদ্ধি দর্শনে জগতের মানুষেরা হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরলেও মা-বাবা আনন্দিত ও পরিতৃপ্ত হন। ইহা সন্তানের প্রতি মা-বাবার মুদিতাগুণ।

মা-বাবার যদি একাধিক সন্তান থাকে, তন্মধ্যে সুস্থ-সবল, সুদৰ্শন জ্ঞানী সন্তানকে যেমন ভালোবাসেন তেমনি ভালোবাসেন রোগী-পঙ্গু, জ্ঞানহীন অন্ধ সন্তানকেও। তারা সকল সন্তানকে সমানভাবে ভালোবাসেন এবং সকল সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। সন্তানেরা যদি মা-বাবার প্রতি অন্যায় অপরাধ করে থাকে, তাঁরা ইহা সন্তানের অজ্ঞানতা বলে উপেক্ষা করে থাকেন। অর্থাৎ সন্তানের দোষ-ত্রুটি মা-বাবারা ক্ষমা করে থাকেন। ইহা সন্তানের প্রতি মা-বাবার উপেক্ষাগুণ । স্বীয় সন্তানের প্রতি মা-বাবা এই চারিটি গুণের অনুশীলনকারী বলে ভগবান বুদ্ধ মা-বাবাকে সাক্ষাৎ ব্রহ্মারর সাথে তুলনা করেছেন। তাই যে সন্তান সেবা পূজা শ্রদ্ধা-ভক্তি ইত্যাদি আচরণে মা-বাবাকে সন্তুষ্ট করে দেবতারাও তার প্রতি সম্ভষ্ট হন। তিনি দেবগণের প্রিয় হন বলে আপদে-বিপদেও দেবগণ তার সহায় হন । অপরদিকে যে সন্তানের প্রতি মা-বাবা রুষ্ট হন দেবগণও তাদের প্রতি রুষ্ট হন। সেজন্য তার পদে পদে বিপদ অবশ্যম্ভাবী । তিনি জীবনেও সাফল্য লাভ করতে পারে না।

[সংকলনে : শ্রীমৎ অজিত কীর্তি ভিক্ষু]

তথ্যসুত্র ঃ ধর্ম টেক্সট

 

শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী

শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী

পূজ্য বনভান্তের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
[ জন্ম : ১৯২০-পরিনির্বাণলাভ : ২০১২ ]
১৯২০ : জন্ম ১৯২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি শৈলশহর রাঙামাটির ৬ মাইল দক্ষিণে ১১৫ নং মগবান মৌজার মোরঘোনা নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত চাকমা বৌদ্ধ পরিবারে। তাঁর পিতার নাম শ্রী হারুমোহন চাকমা, মাতার নাম শ্রীমতি বীরপুদি চাকমা। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় ‘রথীন্দ্র লাল চাকমা’। পিতামাতার ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন।
তাঁর (রথীন্দ্র) শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যতদূর জানা যায়-তিনি তৎকালীন ব্রিট্রিশ আমলে মিডল ইংলিশ (গঊ) স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে জীবনের তাগিদে ব্যবসায় আত্মনিয়োজিত হন।
১৯৪৩ : রথীন্দ্র যখন ২৩ বছরের যুবক তখন হঠাৎ তাঁর পিতা হারুমোহন চাকমার অকালমৃত্যু ঘটে। ফলে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বভার তাঁর উপর এসে পড়ে।
১৯৪৯ : ১৯৪৯ সালে পটিয়ার নাইখাইন গ্রামের অধিবাসী বাবু গজেন্দ্র লাল বড়ুয়ার ঐকান্তিক সহযোগিতায় ২৯ বছর বয়সে ভরা যৌবনে শুভ ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি চট্টগ্রামস’ নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারের তৎকালীন অধ্যক্ষ শ্রীমৎ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির (বিএ) মহোদয়ের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তখন গৃহী নামের সাথে মিল রেখে তাঁর নাম ‘রথীন্দ্র শ্রামণ’ রাখা হয়।
১৯৪৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুঃখমুক্তির অন্বেষায় গুরুভান্তের অনুমতি নিয়ে জন্মভূমি রাঙামাটির উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামস’ নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার ত্যাগ করেন। পথিমধ্যে বেতাগী বনাশ্রমে সাধকপ্রবর ত্রিপিটক বাগ্মীশ্বর ভদন্ত আনন্দমিত্র মহাস্থবির মহোদয়ের নিকট সপ্তাহকাল অবস্থান করেন। অতঃপর পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক পুণ্যতীর্থ চিৎমরম বৌদ্ধ বিহারে এসে তিনি পক্ষ্কাল অবস্থান করেন।
১৯৪৯-১৯৬০ : চিৎমরম ত্যাগ করে ১৯৪৯ সালের শেষের দিক থেকে ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর শ্রামণ অবস্থায় ‘ধনপাতা’ নামক শ্বাপদসংকুল গহীন অরণ্যে একাকী ধ্যান-সাধনায় রত ছিলেন। ধনপাতা অরণ্যে অবস্থানকালে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে প্রকাশ পায়। বনে সাধনা করতেন বলে লোকে তাঁকে ‘বন শ্রামণ’ হিসেবে সম্বোধন করতে থাকে।
১৯৬০ : ১৯৬০ সালে কাপ্তাই-বাঁধ দেওয়ার ফলে রাঙামাটির বিশাল এলাকা (প্রায় ৪৫০ বর্গ কিমি) জলমগ্ন হয়। এতে বন শ্রামণের সাধনাস্থল ধনপাতার আশপাশের এলাকাও জলমগ্ন হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরাও উদ্বাস’ হয়। এমতাবস্থায় তাঁর ধ্যান-সাধনা ও পিণ্ডচারণের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। শেষে অনন্যোপায় হয়ে তাঁর পরমভক্ত সেবক নিশিমনি চাকমার আমন্ত্রণে দীঘিনালা গমন করেন। তথায় বোয়ালখালী রাজবিহারে অল্প কিছুদিন অবস্থান করেন। পরবর্তী সময়ে বর্তমান দীঘিনালা থানার দক্ষিণ পশ্চিমে লোকালয় থেকে প্রায় এক মাইল দূরে তাঁর থাকার জন্য এলাকাবাসী এক পর্ণকুটির নির্মাণ করে দিলে পুনরায় আরণ্যিক সাধন জীবন শুরু করেন।
১৯৬১ : বার্মাফেরত চাকমা রাজগুরু শ্রীমৎ অগ্রবংশ স্থবির ও শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী ভিক্ষু মহোদয়ের ঐকান্তিক অনুপ্রেরণায় ও সার্বিক সহযোগিতায় ২৭ জুন ১৯৬১ সালে ২৫০৫ বুদ্ধবর্ষের জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিতে বোয়ালখালী মাইনী (নদীর) উদক সীমায় ২য় সংঘরাজ ভদন্ত গুণালংকার মহাথের মহোদয়ের উপাধ্যায়ত্বে শুভ উপসম্পদা লাভ করেন।
তিনি ধ্যান-সাধনায় সর্বদা নিরত থাকতে আনন্দ পেতেন বিধায় ভিক্ষু-উপসম্পদা লাভ করার পর তাঁর উপাধ্যায় তাঁর নাম রাখলেন ‘সাধনানন্দ’। তবে তিনি (প্রায় ২৫ বছর) বনে-জঙ্গলে ধ্যান-সাধনা করতেন বিধায় ভক্তবৃন্দের কাছে ‘বনভান্তে’ নামেই সমধিক পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯৬০-১৯৭০ : ১৯৬০ সালের শেষের দিক হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ বছরের মতো দীঘিনালার নির্জন অরণ্যে খুব কষ্টসাধ্য জীবনযাপন করেন। জ্বরাক্রান্ত হয়ে অর্ধাহারে অনাহারে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে মরণাপন্ন দশায় উপনীত হয়েছিলেন। তখন জনৈক বড়ুয়া দায়কের প্রদত্ত গরুর দুধ খেয়ে কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যান। এই কথা অনেক বার পূজ্য ভান্তে তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রাত্যহিক দেশনায় বলেছিলেন।
দীঘিনালা অবস্থানকালে জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, শ্রী ভবতোষ দেওয়ান, শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাসহ (সন্তু লারমা) বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পূজ্য বনভান্তের উপদেশ শুনতে এবং পরামর্শ নিতে যেতেন।
১৯৭০ : ১৯৭০ সালে পূজ্য বনভান্তে দীঘিনালা (মাইনী এলাকা) ত্যাগ করে লংগদুস্থ তিনটিলা বৌদ্ধ বিহারের কঠিন চীবরদানানুষ্ঠানের ফাঙে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেন। আর লংগদুর হেডম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বাবু অনিল বিহারী চাকমাসহ বিশিষ্ট দায়ক-দায়িকাগণ পূজ্য বনভান্তেকে স্থায়ীভাবে লংগদুতে থাকার জন্য প্রার্থনা জানালে ভান্তে তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। দানানুষ্ঠান শেষে ভদন্ত ইন্দাচারা ভিক্ষুর (সুরেন্দ্র মাস্টার) প্রার্থনায় বাঘাইছড়িস’ দূরছড়ি গ্রামে চলে যান। আর তিনটিলায় কুটির নির্মাণের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তথায় অবস্থান করেন। অতঃপর পর লংগদুস্থ তিনটিলা বন বিহারে চলে আসেন।
এ বছরই পূজ্য বনভান্তের ভিক্ষুত্ব জীবনের ১০ বর্ষা পূর্ণ হলে শ্রদ্ধেয় ইন্দাচারা ভিক্ষু খেদারমারা গ্রাম নিবাসী জনৈক যুবককে এনে পূজ্য ভান্তের নিকট প্রব্রজ্যা দেন। প্রব্রজ্যা প্রদান করার পর পূজ্য বনভান্তে তাঁর শিষ্যের নাম রাখলেন শ্রীমান আর্যপাল শ্রামণ। আর্যপাল শ্রামণই বনভান্তের প্রথম শিষ্য।
১৯৭৩ : ১৯৭৩ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর তারিখে লংগদুর তিনটিলায় পূজ্য বনভান্তে এদেশে প্রথম চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে রং করে কাপড় বুনে সেলাই করে ‘দানোত্তম কঠিন চীবরদান’ করার রীতি প্রবর্তন করেন। কঠিন চীবরদানোৎসব বনভান্তেরই অনন্য শ্রেষ্ঠ অবদান।
১৯৭৪ : চাকমা রাজ পরিবার ও রাঙামাটির গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাদর আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর রাজ বিহারে অনুষ্ঠিত দানোত্তম কঠিন চীবরদানে পূজ্য বনভান্তে যোগদান করেন।
এ সালে চাকমা রাজ পরিবার ও রাঙামাটির বিশিষ্ট উপাসক-উপাসিকাদের আকুল প্রার্থনায় তিনি তিনটিলা থেকে রাঙামাটিতে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করলে রাজবাড়ির অনতিদূরে রাজ পরিবারের দানকৃত ভূমিতে ‘রাঙামাটি রাজবন বিহার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৭৫ : ১৯৭৪ সালের দানোত্তম কঠিন চীবরদানানুষ্ঠানে যোগদানের লক্ষে আগমনরত পুণ্যার্থীগণের (মারের অশুভ প্রভাবে) লঞ্চডুবিতে কিছু পুণ্যার্থী নিহত হওয়ায় পূজ্য বনভান্তের নির্দেশক্রমে প্রথমবারের মতো মারবিজয়ী অর্হৎ উপগুপ্ত মহাথের মহোদয়কে আমন্ত্রণ করার মাধ্যমে এদেশে উপগুপ্ত ভান্তেকে পূজা করার রীতি প্রবর্তিত হয়।
১৯৭৬ : পূজ্য বনভান্তে প্রথমবারের মতো রাঙামাটি রাজবন বিহারে বর্ষাবাস যাপন করেন। বর্ষাবাস সমাপনান্তে তিনি পুনরায় তিনটিলায় গমন করেন।
১৯৭৭ : প্রায় ছয় বছর লংগদুর তিনটিলায় অবস্থান করার পর ১৯৭৭ সালে সশিষ্যে রাঙামাটির রাজবন বিহারে এসে স্থায়ীভাবে অবস্থান করেন। মূলত পূজ্য বনভান্তে রাঙামাটি আসার পর থেকে তাঁর শিষ্যসংঘ গঠনে মনোনিবেশ করেন। ইতিপূর্বে পূজ্য বনভান্তের কাছে শ্রামণ্য-ধর্মে দীক্ষা নেওয়া শিষ্যদের মধ্য থেকে কেউ কেউ শ্রামণত্ব ত্যাগ করে গৃহীজীবনে ফিরে যান এবং কেউ কেউ শিষ্যত্ব ত্যাগ করে বার্মায় চলে যান।
১৯৭৭ সালের ২৮ নভেম্বর পূজ্য বনভান্তের কাছে শ্রীমান প্রজ্ঞালংকার শ্রামণ (বর্তমানে মহাস্থবির) প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং ১৯৭৯ সালের ২১ জানুয়ারি পূজ্য বনভান্তের উপাধ্যায়ত্বে শুভ উপসম্পদা লাভ করেন। অতএব বর্তমানে তিনিই পূজ্য বনভান্তের কাছে উপসম্পদাপ্রাপ্ত প্রথম ও প্রধান শিষ্য।
১৯৭৮ : রাজমাতা বিনীতা রায় (বুড়াবাণী) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা থাকাকালীন সরকারি অনুদানে ও সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাদানে পুরাতন টিনশেড দেশনালয় নির্মিত হয়। বর্তমান পাকা দেশনালয়টি নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পূজ্য বনভান্তে পুরাতন টিনশেড দেশনালয়ে বসে দীর্ঘদিন ভক্তদের উদ্দেশ্যে সদ্ধর্ম দেশনা করেন।
১৯৭৯ : ভান্তের একনিষ্ঠ ভক্ত ডা. হিমাংশু বিমল দেওয়ান পাঁচ কক্ষ্বিশিষ্ট একটি মাটির ঘর (উত্তর গুদাম) ও তৎসংলগ্ন চংক্রমণ ঘর দান করেন। পূজ্য ভান্তে এই উত্তর গুদামে বেশ কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন।
১৯৮১ : এ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে রাজবন বিহারে ভিক্ষুসীমা ঘর (ঘ্যাং ঘর) স্থাপন করা হয়। উক্ত তারিখে নবপ্রতিষ্ঠিত সেই ঘ্যাং ঘরে পূজ্য বনভান্তেকে ‘মহাস্থবিরবরণ’ করা হয়।
পূজ্য বনভান্তের ‘মহাস্থবিরবরণ’ অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কা সরকার কর্তৃক (উপহার হিসেবে) প্রদত্ত বোধিবৃক্ষ চারা উক্ত ঘ্যাং ঘরের পাশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী নিজ হাতে রোপণ করেন। এ অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনার চরিতা রানা সিংহা (সস্ত্রীক), বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) রাষ্ট্রদূত (সস্ত্রীক), এবং ভারতের হাই কমিশনার মুচকুন্দ দুবে।
সদ্ধর্মপ্রাণ উপাসক ম্যাজিস্ট্রেট প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা কর্তৃক ভারতের বুদ্ধগয়া হতে সংগৃহীত ‘বোধিবৃক্ষ চারা’ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে পূজ্য ভান্তে নিজ হাতে রোপন করেন।
১৯৮৩ : শ্রদ্ধাবান উপাসক পূজ্য ভান্তের বাল্যবন্ধু বাবু অজিত কুমার দেওয়ান পূজ্য ভান্তের বসবাসের জন্য একটি বাংলো টাইপের মাটির ঘর (মাট্যা গুদাম) দান করেন। পূজ্য ভান্তে দীর্ঘ প্রায় এগার বছর এই গুদামে অবস্থান করেন।
১৯৮৬ : তৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের গোলযোগপূর্ণ সময়ে বহু লোকের অকালমৃত্যু ঘটায় তাদের পারলৌকিক সদ্গতি কামনায় পূজ্য ভান্তের নির্দেশে উপাসিকা স্বর্ণলতা দেওয়ান, সমীরা দেওয়ান ও কনকলতা খীসার নেতৃত্বে সর্বজনীন সংঘদান করা হয়। তার পর থেকে ইহা ‘মহাসংঘদান’ আকারে উপাসিকাদের উদ্যোগে প্রতিবছর উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে।
১৯৮৭ : বুদ্ধশাসনে পূজ্য বনভান্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান সুত্তপিটকের অন্তর্গত খুদ্দক নিকায়ের সুত্ত নিপাত গ্রন্থটির অনুবাদ। এটি ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি বিজ্ঞমহলে যথেষ্ট সমাদর লাভ করে। পরবর্তীকালে উক্ত গ্রন্থটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলিয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ শ্রেণীর পাঠ্য-তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৮৮ : ২২ এপ্রিল রাজবন বিহারে ১৩,৭৯,২৫১ টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত দ্বিতল বিহার ভবনটি সাড়ম্বরে দানোৎসর্গ করা হয়। উক্ত বিহার ভবন উদ্বোধনকালে সস্ত্রীক ভারতীয় হাই কমিশনার, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা বাবু বিনয় কুমার দেওয়ান, চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ উচ্চপদস’ সরকারি কর্মকর্তা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
২১ অক্টোবর উপাসিকাদের উদ্যোগেও সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাদানে পূজ্য বনভান্তের জন্য নির্মিত পাকা ‘ভোজনশালা’ দানোৎসর্গ করা হয়।
১৯৮৯ : এ বছর সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাদানে পরমপূজ্য বনভান্তের জন্য একটি রাশিয়ান জীপ গাড়ি আনুমানিক ৬ লক্ষ টাকায় ক্রয় করে দান করা হয়।
১৯৯১ : পূজ্য বনভান্তে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার যোগে রাঙামাটি পার্বত্য জেলাস’ যমচুগ ও বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মহাজন পাড়াস’ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন। এদেশে ইতিপূর্বে কোনো ভিক্ষুর হেলিকপ্টার যোগে ধর্মীয় সফর করার সৌভাগ্য হয়নি। পূজ্য বনভান্তের এটা একটা ইতিহাস সৃষ্টি করা ঘটনা।
এ বছরে দানোত্তম কঠিন চীবরদানানুষ্ঠান উপলক্ষে রাঙামাটির রিজিয়ন কমান্ডার জনাব আহসান নাজমুল আমীন সস্ত্রীক ‘বেইন (চীবর) বুনা’ দেখতে আসেন।
রাঙামাটি জেলার সবচেয়ে উঁচু পাহাড় ফুরামোন চূড়ায় ‘ফুরামোন শাখা বন বিহার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ইহার নামকরণ করা হয় ‘ফুরামোন আন্তর্জাতিক সাধনাতীর্থ বন ভাবনা কেন্দ্র’ ।
১৯৯২ : ২৪ জানুয়ারী রাজবন বিহারের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। পূজ্য ভান্তের নির্দেশে এদিনটিতে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম দেশিয় প্রযুক্তিতে অষ্টধাতুর বৃহৎ দুটি বুদ্ধমূর্তি নির্মাণকাজ শুরু করা হয়-রাজবন বিহারে।
১২ মার্চ সার্বজনীন উপোসনা বিহার দানোৎসর্গ করা হয়। পূজ্য বনভান্তে কর্তৃক লিখিত ধুতাঙ্গবিষয়ক গ্রন্থ সুদৃষ্টি এ বছর প্রবারণা পূর্ণিমায় প্রকাশিত হয়।
এ বছর ২০ নভেম্বর পূজ্য বনভান্তে জুরাছড়িতে সশরীরে উপস্থিত থেকে সুবলং জুরাছড়ি শাখা বনবিহারের লিখিত অনুমোদন প্রদান করেন।
১৯৯৩ : ৫ মার্চ রাজবন বিহারের ইতিহাসে একটি চিরস্মরণীয় দিন। এদিনে পূজ্য ভান্তের নির্দেশনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দেশিয় প্রযুক্তিতে অষ্টধাতুর দুটি বুদ্ধমূর্তি রাজবন বিহারে করা হয়। বুদ্ধমূর্তি দুটির নাম যথাক্রমে গৌতমমুনি বুদ্ধমূর্তি ও শাক্যমুনি বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধমূর্তি দুটির উচ্চতা ও ওজন যথাক্রমে ৫ ফিট, ১০ মণ ১১ কেজি এবং ৫ ফিট, ১০ মণ ১০ কেজি। সেই সাথে দেড় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি উপগুপ্ত মহাথের মূর্তি নির্মাণ করা হয়। ইহার ওজন ৩৫ কেজি।
শ্রদ্ধাবতী উপাসিকা লাকী চাকমার অর্থায়নে ও উদ্যোগে বনভান্তের বাসোপযোগী ভবন-এর নির্মিত কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
৬ মে বুদ্ধপুর্ণিমায় ডা. অরবিন্দ বড়ুয়া কর্তৃক সংকলিত বনভান্তে দেশনা ১ম খণ্ড প্রকাশিত হয়। এ বছর পূজ্য বনভান্তে তাঁর জলমগ্ন জন্মস্থান চিহ্নিত করেন।
১৯৯৪ : ১৫ মার্চ শ্রদ্ধাবতী উপাসিকা লাকী চাকমার অর্থায়নে ও সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে প্রায় ১৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বনভান্তের বাসভবন ‘সাধনা কুটির’ আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসর্গ করা হয়।
লংগদু তিনটিলা শাখা বনবিহার দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর ১৯৯৪ সালে বনভান্তের অন্যতম শিষ্য শ্রীমৎ ভৃগু মহাস্থবিরের উদ্যোগে পুনঃসংস্কার কাজ শুরু হয়।
এ বছর রাঙামাটি রাজবন বিহারে রাজমাতা আরতি রায়, বাবু ইন্দ্রনাথ চাকমা ও মিসেস লাকী চাকমাপ্রমুখ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্যোগে পূজ্য বনভান্তের জন্য বনভান্তে চংক্রমণ-ঘর নামক পাকা ও লম্বা চংক্রমণ-ঘরটি নির্মাণ করা হয়। এটি ২১ আশ্বিন ১৪০২ বাংলায় উদ্বোধন করেন মহামান্য সংঘরাজ ভদন্ত শীলালঙ্কার মহাস্থবির।
১৯৯৫ : ২৭ জানুয়ারী খাগড়াছড়ি জেলা সদরের পেরাছড়া এলাকায় ধর্মপুর আর্যবন বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাঙামাটি আসার পর পূজ্য ভান্তে একমাত্র এ শাখা বনবিহারেই একবর্ষা যাপন করেন।
এবছর মহামান্য অষ্টম সংঘরাজ ভদন্ত শীলালঙ্কার মহাস্থবির মহোদয় পূজ্য বনভান্তের সান্নিধ্যে রাঙামাটি রাজবন বিহারে একবর্ষা অবস্থান করেন।
১৯৯৬ : এই বছর হতে পূজ্য বনভান্তের জন্মদিন (৮ জানুয়ারি) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে।
ভগবান বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গ হতে মর্ত্যের সাংকাশ্য নগরে অবতরণের স্মৃতির স্মরণে এদেশে প্রথমবারের মতো পূজ্য বনভান্তের দিকনির্দেশনায় ‘ছিমিতং’ (দ্বীপমেরু) পূজা প্রবর্তিত হয়।
এ বছর পূজ্য বনভান্তে চুলামনি চৈত্যের উদ্দেশে কার্তিকী পূর্ণিমা হতে অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা পর্যন্ত মাসব্যাপী আকাশ-প্রদীপ প্রজ্বলন প্রবর্তন করেন।
১৯৯৭ : এবছর ১৯ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বনভান্তের সাথে সৌজন্যসাক্ষাৎ করে তাঁর উপদেশ-পরামর্শ নেন। পূজ্য ভান্তে প্রধানমন্ত্রীকে জ্ঞান, বুদ্ধি, কৌশল নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার পরামর্শ দেন।
ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরী (ঝধহশধৎ জড়ু ঈযড়ফিযঁৎ) রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন এবং পূজ্য ভান্তের সাথে তাঁর বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করেন।
১৯৯৮ : নানিয়ারচর উপজেলায় রত্নাঙ্কুর শাখা বনবিহার ও খাগড়াছড়ি পানছড়ি উপজেলায় মণিপুর শাখা বনবিহার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ বছর দীঘিনালা এলাকাবাসীর উদ্যোগে ও শ্রীমৎ আনন্দ ভিক্ষুর (বর্তমানে স্থবির) সার্বিক সহায়তায় পূজ্য বনভান্তের স্মৃতিধন্য ও দীর্ঘকালীন সাধনাপীঠ দীঘিনালায় ‘দীঘিনালা শাখা বনবিহার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, পূজ্য বনভান্তে এখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বৎসর সাধনা করেন।
১৯৯৯ : আর্যবন বিহার, ধর্মপুর (পেরাছড়া), খাগড়াছড়িতে এক বর্ষাবাস যাপন করেন। এরপর তিনি রাজবন বিহারে প্রত্যাবর্তন করেন। উল্লেখ্য যে, চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের নেতৃত্বে পরমপূজ্য বনভান্তে মহোদয়কে সসম্মানে ও সগৌরবে ২০০টির মতে গাড়ির বিশাল শোভাযাত্রা-সহকারে খাগড়াছড়ি হতে তাঁর আজীবন সাধনপীঠ রাঙামাটি রাজবন বিহারে আনা হয়।
 
২০০০ : মন্ত্রী কল্পরঞ্জন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালীন সরকারি অনুদানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নে রাজবন বিহারের ‘অতিথিশালা’ নির্মিত হয়।
তৎকালীন মন্ত্রী বাবু কল্পরঞ্জন চাকমা এবং রাঙামাটি শহরতলীর রাঙাপানি গ্রাম নিবাসী ডা. রবিন চাকমা ও তন’মনি চাকমার আন্তরিক প্রচেষ্টায় সরকারি অনুদানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নে রাঙামাটি রাজবন বিহারে ১০ শয্যাবিশিষ্ট ‘রাজবন হাসপাতাল’ নির্মিত হয়।
এবছর ২৬ অক্টোবর পূজ্য বনভান্তের অনুমোদনক্রমে দেশের বাইরে প্রথম ভারতের ত্রিপুরাস’ মায়নামায় ‘মনুগাঙ শাখা বনবিহার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উক্ত বিহারের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন শ্রীমৎ মধ্যকল্যাণ ভিক্ষু।
২৬ অক্টোবর কঠিন চীবরদান উপলক্ষে সফরকালে মহালছড়ি উপজেলাস’ মিলনপুর শাখা বনবিহারে পূজ্য বনভান্তে জঙ্গলি বিষকচু খেয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পর থেকে পূজ্য বনভান্তে শারীরিক বার্ধক্যজনিত কারণে বাইরে ফাঙে যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করেন।
২০০২ : সাত তলাবিশিষ্ট প্রতীকী পাকা ‘স্বর্গঘর’ নির্মিত হয়।
২০০৩ : ১১ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন এবং বনভান্তের উপদেশ ও পরামর্শ নেন।
২০ জুন বনভান্তের দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দেশনালয় রাজবন বিহার রাঙামাটিতে দানোৎসর্গ করা হয়।
২১ অক্টোবর মায়ানমারের সামরিক চীফ অফ স্টাফ লে. জেনারেল অংথুই-এর নেতৃত্বে একদল ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূজ্য বনভান্তের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পূজ্য ভান্তের বাসভবনে। একই সাথে ভান্তের উপদেশও শ্রবণ করেন।
২০০৪ : বনভান্তের জন্মদিনকে (৮ জানুয়ারি) চিরস্মরণীয় করে রাখার মানসে তাঁরই শিষ্যসংঘ কর্তৃক ৭ জানুয়ারি ২০০৩ সালের সাধারণ সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী পূজ্য ভান্তের জন্মদিন উপলক্ষে ‘বনভান্তে জন্মস্মারক’ নামক বার্ষিক প্রকাশনা ২০০৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে উক্ত স্মরণিকাটি ফি-বছর প্রকাশিত হয়ে আসছে।
এ বছর ২৯ জুলাই পূজ্য বনভান্তের উৎসাহে ও পরামর্শে তাঁরই শিষ্যসংঘ কর্তৃক রাজবন বিহারে একটি ‘আধুনিক অফসেট প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি প্রায় শতাধিক মূল পিটকীয় গ্রন্থসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যা এদেশে বুদ্ধধর্ম প্রচার-প্রসার ও স্থিতিকল্পে এক যুগান্তকারী অবদান রাখে।
পূজ্য বনভান্তের চোখে ছানি পড়লে ৩০ নভেম্বর ২০০৪ সালে ভারতের মাদ্রাজ (ভেল্যুর) থেকে আগত বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এন্ড্রু ব্রাগেন পূজ্য ভান্তের বামচক্ষু অপারেশন করেন।
রাজবন বিহারস’ দেশনালয়ে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপমন্ত্রী বাবু মনিস্বপন দেওয়ানের উপস্থিতিতে মায়ানমারের রাষ্ট্রদূত সস্ত্রীক সংঘদানের মাধ্যমে পূজ্য বনভান্তেকে ত্রিপিটক দান করেন।
২০০৫ : ২১ মার্চ ভারতের হাই কমিশনার মিস বীণা সিক্রী ও ডেপুটি হাই কমিশনার মি. অশোক দাশ পূজ্য বনভান্তের সাথে সাক্ষাৎপূর্বক আশীর্বাদ নিতে রাজবন বিহারে আগমন করেন।
২২ এপ্রিল জাপানের রাষ্ট্রদূত গৎ. গধঃংঁংযরহড় ঐড়ৎরমঁপয (মাৎসুশিনো হরিগুচ) রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন ও পূজ্য ভান্তের সাথে সাক্ষাৎপূর্বক উপদেশ-পরামর্শ গ্রহণ করেন।
২৫ মে মি. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিজ জুডিথ চামাস পূজ্য বনভান্তের সাথে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করেন ও রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন।
২ আগষ্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার ব্রিগেডিয়ার ইয়ান ডেভিড ওকলে রীজ বনভান্তের সাথে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করেন এবং রাজবন বিহার পরিদর্শনপূর্বক পরিদর্শন বহিতে স্বাক্ষ্র করেন।
এ বছর ৯ ডিসেম্বর মাসে পূজ্য বনভান্তের উপদেশ ও পরামর্শে এবং বাবু অশ্বিনী কুমার চাকমা, বাবু প্রবীর চন্দ্র চাকমা ও বাবু সমীরণ চাকমার উদ্যোগে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সারারাতব্যাপী পরিত্রাণ সূত্র শবণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বৌদ্ধ নরনারীসহ সমগ্র বাংলাদেশের অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
২০০৬ : ১০ মে পূজ্য বনভান্তে সশিষ্যে তাঁর জন্মভূমি মোরঘোনা পরিদর্শন করেন।
১১ নভেম্বর বৌদ্ধরাষ্ট্র থাইল্যান্ড থেকে আগত ৫১ জন বিশিষ্ট দায়ক-দায়িকা রাজবন বিহারে আগমন করেন ও ২০০ জোড়া চীবর ও পাত্র পূজ্য বনভান্তেকে দান দিয়ে পূজা করে কৃতার্থ হন।
২৩ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জনাব মাশুক হোসেন আহমদ পূজ্য বনভান্তের উপদেশ গ্রহণ করেন ও বনবিহার পরিদর্শন করেন।
২০০৭ : ০২ মার্চ ভারতের সহকারি হাই কমিশনার মি. সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য পূজ্য বনভান্তের সাথে তাঁর বাসভবনে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন ও পূজ্য বনভান্তের আশীর্বাদ নেন।
৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার (জিওসি) বর্তমানে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল জনাব আবদুল মুবিন পূজ্য বনভান্তের সাথে সাক্ষাৎ করেন ও বনভান্তের সদুপদেশ শুনে কৃতার্থ হন।
শ্রীলঙ্কান হাই কমিশনার মি. ভি. কৃষ্ণামূর্তি সস্ত্রীক রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন এবং পূজ্য বনভান্তের উপদেশ নেন।
২০০৮ : ৮ জানুয়ারি তাঁর শিষ্যসংঘ ও উপাসক-উপাসিকাগণ কর্তৃক পূজ্য ভান্তেকে একটি অত্যাধুনিক প্রাডো ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি দান করা হয়। সর্বসাধারণের পক্ষে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় পূজ্য বনভান্তের হাতে গাড়ির চাবি প্রদান করেন।
৮ ফেব্রুয়ারি ভুটানের হাই কমিশনার মি. শেরিন দর্জি সস্ত্রীক বনভান্তেকে চীবরদানপূর্বক বনভান্তের আশীর্বাদ নেন।
৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের হাই কমিশনার মি. পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বনভান্তের সাথে সাক্ষাৎপূর্বক উপদেশ-পরামর্শ গ্রহণ করেন।
২৭ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জনাব ড. ফখরুদ্দিন আহমদ ও সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ পূজ্য বনভান্তের সাথে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করেন এবং ভান্তের সদুপদেশ ও সুপরামর্শ নেন।
১৩ জুলাই ভারতের অরুণাচল প্রদেশের এমএলএ (খামতি রাজা) মি. চৌ পিংটিকা নামচুম সপরিবারে পূজ্য বনভান্তের সাথে সাক্ষাৎ করেন ও ভান্তের আশীর্বাদ লাভে কৃতার্থ হন।
২৩ সেপ্টেম্বর থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মি. চালেরম্পুল থানচিতের নেতৃত্বে মি. পিসানু চানবিতান, ডাইরেক্টর জেনারেল ডিপার্টমেন্ট অফ সাউথ এশিয়া, মিডল ইস্ট অ্যান্ড আফ্রিকান অ্যাফেয়ার্স, মিনিস্ট্রি অফ ফরেন অ্যাফেয়ার্স থাইল্যান্ডসহ একদল থাই ডেলিগেট বনভান্তেকে ৪০০ জোড়া চীবর ও পাত্র দান করেন এবং পূজ্য ভান্তের আশীর্বাদ লাভে ধন্য হন।
৬ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী পরমপূজ্য বনভান্তের সাথে তাঁর বাসভবনে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করেন এবং রাজবন বিহারে অনুষ্ঠিত ৩৫তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানে চরকায় সুতা কেটে বেইন বুনা উদ্বোধন করেন।
সিঙ্গাপুরের হাই কমিশনার মি. ভার্ঘিজ ম্যাথ্যুজ (ঠবৎমযরং গধঃযবংি) রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন এবং পূজ্য ভান্তের আশীর্বাদ গ্রহণ করেন।
১১ নভেম্বর থাইল্যান্ডের অর্হৎ ভিক্ষু আঝান্‌ চাহ্‌ -এর ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত শিষ্য আঝান জয়াসারো মহাথের পরমপূজ্য ভান্তেকে চীবর দান করে আশীর্বাদ নেন।
১৮ নভেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জন. এফ মরিয়ার্টি বনভান্তের সাথে সৌজন্য-সাক্ষাতে তাঁর বাসভবনে মিলিত হন ও বনবিহার পরিদর্শনপূর্বক পরিদর্শন বহিতে স্বাক্ষ্র করেন।
২৮ নভেম্বর বার্মার (মায়ানমার) রাষ্ট্রদূত মি. ফায়ে থান উঃ সস্ত্রীক বনভান্তের সাথে সাক্ষাৎ করেন ও চীবর দান করেন।
২০০৯ : ২৯ ও ৩০ অক্টোবরে রাজবন বিহারে কঠিন চীবরদানানুষ্ঠানে আগত ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ভিক্ষু আঝান্‌ জয়াসারো মহাথেরর উদ্যোগে থাইল্যান্ডের উপাসক-উপাসিকাগণ কর্তৃক ১১টি (দণ্ডায়মান) বুদ্ধমূর্তি দান করা হয়। একই সাথে থাই রাষ্ট্রদূত মি. চালেরম্পুল থানচিতের নেতৃত্বে থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবল কর্তৃক প্রেরিত থাই প্রতিনিধি দল উক্ত অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মিজ থুনয়িং সুপত্রা মসদি ও আইএলও-এর বাংলাদেশের কান্ট্রি ডাইরেক্টর মিজ পানুড্ডা বোনপালা। পূজ্য বনভান্তের জন্য প্রেরিত রাজা ভূমিবলের চীবর রাজার পক্ষে রাষ্ট্রদূত চালেরম্পুল থানচিত ভান্তেকে প্রদান করেন।
২০১০:
২৫ ফেব্রুয়ারী সকাল নয় ঘটিকায় এক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পূজ্য বনভান্তে তাঁর বহুদিনের ইচ্ছা লাইব্রেরী ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবেন
২০১১ : ১২ মার্চ ব্রিটিশ হাই কমিশনার রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন ও পূজ্য ভান্তের সাথে এক সৌজন্য-সাক্ষাতে মিলিত হন।
১৫ মার্চ চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীয় রায় জ্ঞাতি-পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে রাজকীয়ভাবে পূজ্য বনভান্তের নিকট সাময়িক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে সপ্তাহকাল অবধি অবস্থান করেন। তখন পূজ্য বনভান্তে তাঁর নাম দেন ‘রাষ্ট্রপাল শ্রামণ’।
২৪ নভেম্বর মায়ানমারের সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সোয়ে উইন , তাঁর স্ত্রী মিসেস ড. থান থান নউয়ি ও তিন বাহিনীর উচ্চপদস’ কর্মকর্তারা পরমপূজ্য বনভান্তের সাক্ষাৎ পেতে ও আশীর্বাদ নিতে রাজবন বিহারে আসেন।
২৭ ডিসেম্বর ড. অমিত চাকমা, ভাইস চ্যান্সেলর ওয়েস্টার্ন অন্টেরিও ইউনিভার্সিটি, কানাডা, বনভান্তের সম্মুখে বুদ্ধমূর্তি দান, সংঘদান ও অষ্ট পরিষ্কার দান করেন এবং পরমপূজ্য বনভান্তের উপদেশ শ্রবণ করেন।
২০১২ : ৮ জানুয়ারি অন্যান্যবারের মতো এ’বছরও পূজ্য বনভান্তের ৯৩তম জন্মদিন জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্‌যাপিত হয়। এবছর বনভান্তের জন্মদিন উপলক্ষে থাইল্যান্ডের ধম্মকায়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এবং বনভান্তের শিষ্যসংঘের সার্বিক সহযোগিতায় ২৯৪ জন কুলপুত্রকে প্রব্রজ্যা প্রদান করা হয়।
১১ জানুয়ারি ভোরে পূজ্য ভান্তে তাঁর শিষ্যসংঘকে প্রাত্যহিক ধর্মদেশনা প্রদান করেন। বলা বাহূল্য, এটি ছিল তাঁর শিষ্যসংঘের উদ্দেশে সর্বশেষ ধর্মদেশনা।
১৩ জানুয়ারি লে. জেনারেল জগৎ জয়সুরিয়া, কমান্ডার অব দ্য শ্রীলঙ্কান আর্মি, রাজবন বিহার পরিদর্শন করেন এবং ভিজিটরস বইয়ে স্বাক্ষ্র করেন।
১৫/১৬ জানুয়ারি পূজ্য ভান্তে ঠাণ্ডাজনিত কারণে সামান্য অসুস্থ হয়ে পড়েন।
১৮ ও ১৯ জানুয়ারি পূজ্য বনভান্তের জ্ঞাতিবর্গ ভান্তের উপস্থিতিতে ‘বনভান্তের বিশ্রামাগার’-এ সংঘদান করেন। এবং তাঁর কনিষ্ট ভ্রাতা জহর লাল-প্রদত্ত সর্বশেষ আহার গ্রহণ করেন। পরদিন হতে পূজ্য ভান্তে সম্পূর্ণ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেন—শুধুমাত্র কখনও কখনও সামান্য পরিমাণ কোকাকোলা পানীয় পান করেন। এরপর থেকে ক্রমেই তাঁর অসুস্থতা বাড়তে থাকে।
২৩ জানুয়ারি পূজ্য ভান্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জওহর লাল চাকমা রাঙামাটি সদর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
২৬ জানুয়ারি পূজ্য ভান্তের শারীরিক অবস্থা ভীষণভাবে অবনতি হওয়ায় এক জরুরি আলোচনা আহ্বান করা হয়। উক্ত সভায় পূজ্য ভান্তের শিষ্যসংঘ, মেডিকেল বোর্ডের ডাক্তাররা ও চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
২৭ জানুয়ারি বেলা ১২:০৮ মিনিটের দিকে পূজ্য ভান্তের শত শত শিষ্য ও হাজারো ভক্ত-অনুরাগী মিলিত হয়ে পূজ্য ভান্তের আশু রোগমুক্তি কামনায় রাঙামাটি সার্কিট হাউসের মাঠে শ্রদ্ধেয় ভান্তেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হয়। তার পর ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে সর্বাধুনিক উন্নত চিকিৎসা চলতে থাকে। উল্লেখ্য, তিনি বিগত বেশ কিছুদিন ধরে ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া, কিডনী ও লিভারের জটিল সমস্যায় ভুগছিলেন।
৩০ জানুয়ারি পরমপূজ্য অর্হৎ বনভান্তে শত শত শিষ্য ও লাখো লাখো ভক্ত-অনুরাগীর সনির্বন্ধ প্রার্থনা উপেক্ষা করে ঢাকাস’ স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩:৫৬ মিনিটে পড়ন্ত বিকেলে সর্বাসব ক্ষয়জনিত পরম সুখ নির্বাণে পরিনির্বাপিত হন।
error: Content is protected !!