by admin | May 26, 2020 | blog
বৌদ্ধ ধর্ম দাহক্রিয়া সম্পর্কে কি বলে?
—অাশিন ধর্মপাল
বুদ্ধের সময়কালে দাহক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তথাগতের জীবনী বইটি পড়তে পারেন৷ বা বিভিন্ন কাহিনী পড়লেও পেতে পারেন৷
এর অনেক অাগে অামার টাইম লাইনে একটা পোষ্ট করেছিলাম৷ সেখানে প্রশ্ন করা
হয়েছিল “পরিক্ষার দিনে যদি জানতে পার যে তোমার মা কিংবা বাবা কালগত হয়েছে
তাহলে তুমি পরীক্ষা দিতে যাবে নাকি তাদের অন্তেষ্ঠি ক্রিয়ায় যাবে?” উত্তরটা
ছিল এই রকম, ” মা বাবার প্রতি সন্তানের যে দায়ভার রয়েছে সেগুলি প্রত্যেক
সন্তানের তার মাতাপিতার মৃত্যুর পূর্বেই পূরণ করা বাঞ্ছনীয়৷ অার যদি মাতা
পিতার প্রতি পূর্ব হতেই করণীয় কর্মগুলি সম্পাদন করা হয়ে থাকে তাহলে মৃত্যুর
পর সন্তানের ঐ মুহূর্তে উপস্থিত থাকা বা না থাকা দুটোই সমান৷ তাই অবশ্যই
পরীক্ষা দিতে যাওয়া উচিত৷ ফিরে এসেও পূণ্য কর্ম সম্পাদন করতে পারে”
অভিধর্মের দৃষ্টিতে দাহক্রিয়া কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?
————————————————————————————————
এর অাগে জানা উচিত সত্বর গতি কিসের উপর নির্ভর করে৷
জানি, উত্তরটি সকলেই জানেন৷ তারপরও সামান্য বলছি৷ মরণাসন্নে সত্বার
জবনচিত্ত সমূহের উপরই নির্ভর করে তার গতি৷ অার যেই মুহূর্তে তার চ্যুতি ঘটে
কষ্মিন কালের ব্যবধানেই অর্থাৎ এক অন্তরকালেরও কম সময়ে অপর এক যোনিতে
প্রতিসন্ধি গ্রহন করে ফেলে(এখানে জানা উচিত, প্রতিসন্ধি মানে ভূমিষ্ঠ হওয়া
নয়৷ কেবল অালম্বন হওয়া৷ পালিতে যাকে ‘উপপজ্জন্তি’ বলা হয়) অার এইদিকে এই
চ্যুতি চিত্ত ও ঐদিকে প্রতিসন্ধি চিত্ত এই দুই চিত্তের অন্তরকাল এতই
সূক্ষ্ম যে তথাগতের পঞ্চচক্ষুতেও ঐ অন্তরকালকে নির্ধারন করা কঠিন৷ অর্থাৎ,
চ্যুতি চিত্ত হওয়ার সাথে সাথেই পূর্ব জবন চিত্তের কর্মের শক্তিতে সত্বা অপর
এক যোনিতে প্রতিসন্ধি গ্রহন করে ফেলে৷ যেটাকে প্রত্যেয় অনুসারে অনন্তর
প্রত্যেয় বলা হয়৷
অার এই প্রতিসন্ধি চিত্ত যাতে মহা কুশল বিপাক
জ্ঞাণ সম্প্রযুক্ত হয় সেকারণে পূর্ব হতেই মরণাসন্ন ব্যক্তির নিকট কোন বিজ্ঞ
ভিক্ষু, অভিজ্ঞ উপাসককে ডেকে পাশে বসিয়ে সূত্র দেশনা, পরিত্রান পাঠ, বা
ধর্ম দেশনা করাতে হয়৷ মরণাসন্ন ব্যক্তির জন্যে ঐ চিত্তই নির্ধারণ করবে তার
অপর যোনির প্রতিসন্ধি৷ তাই চ্যুতি চিত্তের পূর্ব জবন চিত্তসমূহ যাতে মহা
কুশল বা তার সাথে জ্ঞাণসম্প্রযুক্ত হয় তার ব্যবস্থা করাটাই অধিক
গুরুত্বপূর্ণ৷
অার তাই, তথাগতের সময়কালে ঘটে যাওয়া এমন অনেক উপমা
অাছে, যারা মৃত্যুর পূর্বে অগ্রশ্রাবক সারিপুত্রের নিকট বা মহাশ্রাবকগণদের
নিকট ধর্ম শ্রবণ করে মার্গত্ব ও ফলত্ব লাভ করেন৷ এক উপাসক যিনি মৃত্যুর
পূর্বে ভিক্ষুর সংঘের নিকট হতে সূত্র শ্রবণের একপর্যায়ে দেবতার উদ্দেশ্যে
কোলাহল না করার জন্যে বলেন৷ জল্লাদের ধারাল খর্গের সামনে মৃত্যুর প্রহর
গুনা মরণাসন্ন ব্যক্তিকে অায়ুষ্মান সারিপুত্র সয়ং গিয়ে ধর্ম দেশনা করেন৷
অার এই প্রত্যেকটি ঘটনাগুলি দেখলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে সত্বার চ্যুতির
পূর্বে তাকে তার কৃত পূণ্যকর্মগুলিকে সরণ করিয়ে দেয়া, নির্ভয়তা দেয়াটাই
অধিক মহত্ব৷ অার তাই তথাগতের সময়কালে জ্ঞাণী উপাসক উপাসিকাগণ তেমনটাই করত৷
(খুদ্দক নিকায়)
অর্থাৎ, চ্যুতি চিত্ত হওয়ার সাথে সাথেই কষ্মিনকালের ব্যবধানে অপর এক
যোনিতে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করায় থেকে যাওয়া চতূর্মহাভূতের এই শবদেহটিকে যে যত
যা কিছুই করুক না কেন অপর যোনিতে প্রতিসন্ধি নিয়ে ফেলা সত্বার উপর কোন
প্রভাব পরে না(অভিধর্মের দৃষ্টিকোণে)৷
(একটি কাহিনী মনে পরল৷
সাগাইং’এ ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা৷ মেডিকেলে পড়া এক ছাত্র এক সময় দাহক্রিয়ায়
অংশগ্রহণ করে৷ ফেরার সময় শ্মসান হতে একটি পূরাতণ অস্থি নিয়ে অাসে৷ এসে পড়ার
টেবিলের উপরেই রেখে দেয়৷ পড়তে বসে হাতে নিয়ে দেখতে থাকে৷ হঠাৎ নিয়ে পরে
গেল সেটি৷ হাত দিয়ে না নিয়ে পা দিয়েই কুড়ে নিল সেই৷ ঐদিন রাতেই স্বপ্নে কাল
অার কুৎসিৎ এক লোক এসে বলল “অামার এতো পছন্দের অস্থিকে তুমি অবমাননা করলে?
সাবধান” এই বলেই চলে গেল৷ অাধুনিক যুগের ছেলে, পাত্তাই দিল না৷ পরের দিনও
নিচে পরে গেলে একইভাবেই পা দিয়ে তুলে নেয়৷ স্বপ্নে দেখল, গতকালকের লৌকটাই
অাসছে৷ এসেই তার গলা ধরে চাপতে শুরু করেছে৷ এমনভাবে চাপছে যেন প্রাণবায়ুটাই
বের হয়ে যাবে৷ চোখদুটিও যেন বাইরে এসে যাচ্ছে৷ এমন সময় ত্রিশরণের কথা মনে
পরে গেল৷ সেগুলি অাবৃতি করতে ঘর্মাক্ত শরীরে জেগে গেল৷ “অাসলেই কি বাস্তব
নাকি স্বপ্ন!” ভেবে গলায় হাত দিয়ে দেখল অাসলেই সত্য৷ গলায় প্রচন্ড ব্যাথা,
অার অায়নায় গিয়ে যখন দেখল তখন অারো ভয়ঙ্কর৷)
অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে
যদি শরীরের উপর মায়া থাকে তাহলে ঐ শরীরকে কেন্দ্র করেই প্রেতযোনিতে গিয়ে
প্রতিসন্ধি নেয়৷) যে চলে যাওয়ার সে কতো অাগেই চলে গেছে৷
(তথাগতের সময়কালে তথাগত সয়ং কিংবা তাঁর মহাশ্রাবকগণ উপাসকদের দাহক্রিয়া সম্পন্ন করাতেন কি?)
একদিন শাসনা দায়িকা বিশাখা বিহারে এসে তথাগতে সম্মুখে ক্রন্দন করছিল৷
তথাগত প্রশ্ন করলে উত্তরে বলেন তার এক নাতনীর দাহক্রিয়া করে অাসছে৷ অার এই
উপমাটি যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করেন তাহলেও বুঝতে পারবেন যে, যিনি শাসনের
মাতা, সয়ং বিশাখাও তার নাতনীর দাহক্রিয়ায় তথাগত বা তাঁর কোন শ্রাবকগণকে
অামন্ত্রন করেননি৷
অার যদি দাহক্রিয়া সম্পর্কে বলতে হয়, তাহলে মহাবগ্গের চীবর খন্ধকটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ার অনুরোধ রইল৷
অার তাছাড়া বিশুদ্ধি মার্গের পাংশুকুলিক স্কন্দকেও পড়ার অনুরোধ রইল৷
তথাগত সয়ং বা তাঁর সময়কালে ভিক্ষুগণ উৎকৃষ্ট ধূতাঙ্গের জন্যে শ্মসানেই
বেশি যেতেন৷ সেখানের মৃত শব দেহ হতেই শেত বস্ত্র সংগ্রহ করে তা বৃক্ষের ছাল
হতে রং তৈরী করেই চীবরের কপ্পিয় রংকে গ্রহণ করে চীবর তৈরী করতো৷ অার এই
দিক দিয়ে বিবেচনা করলে তথাগতের সময়কালে দাহক্রিয়া করা তেমনটা ছিল না৷ যে
যেমনটা পারত তেমনটাই করত৷
দাহক্রিয়ায় কেন ভিক্ষুগণদের যাওয়া উচিত?
দাহক্রিয়ায় ভিক্ষুগণকে এইজন্যে অামন্ত্রন করা হয়, যাতে অনুত্তর
পূণ্যক্ষেত্র তথা অনুত্তর ভিক্ষুসংঘকে দানের মাধ্যমে যেই অপরিমেয় কুশল ফল
পাওয়া যায় তার ভাগটিকে পরলোকগত সত্বার উদ্দেশ্যে দান করা৷ অার অনুত্তর
ভিক্ষুসংঘ পদার্পণ না করা মানে ঐ মহাপূণ্য কর্ম সম্পাদন করতে না পারা৷
ভিক্ষুগণদের কি অবশ্যই যেতে হবে দাহক্রিয়ায়?
যদি গ্রামের কোন শীলবান উপাসক বা উপাসিকা না থাকে তাহলে ভিক্ষুগণকে অবশ্যই
যাওয়া উচিত৷ যেহেতু পূণ্যদানের ক্ষেত্রে ছয়টি অঙ্গ অাছে৷ তার মধ্যে একটি
হল দুঃশীলদের দ্ধারা দান করা পূণ্যরাশি পরলোকগত সত্বা কখনোই লাভ করতে পারে
না৷ এই অঙ্গটি কেবল উপাসক বা উপাসিকাদের জন্য নয়৷ যদি পূন্যরাশি দান করা
ভিক্ষুটিও সয়ং দুঃশীল হন তাহলেও পরলোকগত সত্বা এই পূণ্যরাশি লাভে অক্ষম
হবেন৷ যদি কোন শীলবান উপাসক বা উপাসিকা থাকে তিনি সয়ং বিহারে এসে সংঘ কর্ম
সম্পাদন করে সেই পূণ্যফল দাহক্রিয়ায় গিয়ে দান করতে পারেন৷ অারেকটি হলো
পরলোকগত সেই সত্বাকে অামন্ত্রন জানানো৷ অনেকে ভুলবশত অামন্ত্র না জানিয়েই
পূণ্যরাশি দান করেন৷ অামন্ত্রন না জানিয়ে যতবারই পূণ্যরাশি দান করা হোক না
কেন সে তা লাভ করতে পারে না৷
মায়নমারের কোন কোন জায়গায় দেখা যায়,
মৃত ব্যক্তিকে বিহারে নিয়ে অাসেন৷ অতপর সংঘকর্ম বিহারেই সম্পাদন করে ভিক্ষু
সয়ং পূণ্যরাশি দান করেন৷ অতপর উপাসকগণ সেই শবদেহ শ্মসানে নিয়ে নিজেরাই দাহ
করেন(এই নিয়মটি মন্দ নয়)৷
তাই পুনঃ বলছি, যদি শীলবান কেউ না থাকে তাহলে অবশ্যই ভিক্ষুসংঘকে সেখানে গিয়ে পরলোকগত সত্বাকে পূণ্যরাশির ভাগিদার করা উচিত৷
দাহক্রিয়া অার ভূগর্ভস্থ করার মধ্যে কি পার্থক্য?
এই প্রশ্নের উত্তর মায়ানমারের এক সেয়াড’র কথাই বলব৷ যিনি বিনয়াগুরুকা যিনি
বিনয়ে সুদক্ষ, সদাচারী এবং শীলবান তিনি মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন “অামার
মৃত্যুর পর বেশি কিছু লাগবে না৷ দূরে কোন এক জঙ্গলে মাটি চাপা দিলেই হলো৷
এতে অন্তত ভূগর্বে থাকা ছোট কীটের জন্যে কাজেতো অাসবে৷ পুড়িয়ে ফেললে অযথা
কাজের বোঝা, লাভও হয় না”
মায়ানমারে এখনো অনেকে ইটের গুহায় রেখে দেয়, কেউ বা পুড়িয়ে ফেলে৷
অার তথাগতের সময়কালে এক ব্রাক্ষ্মণ ছিলেন৷ মৃত্যুর পূর্বে তার ছেলেকে বলে
রাখল যাতে মৃত্যুর পর তার শব দেহটি অমুক পাহাড়ে সলিল সমাধিস্থ করে৷
ব্রাক্ষ্মণের মৃত্যুর পর তার ছেলে তাই করতে গেল৷ তথাগতের সম্মুখুন হলে তার
পিতার ইচ্ছার বর্ণনা দেয়৷ তথাগত বলেন “এই একই জায়গায় তোমার পিতা পাঁচশতবার
সমাধিস্থ হয়েছে৷ তাই পূর্বের কারণে জায়গাটার প্রতি এখনো ইহ জন্মেও অাসক্ত”
অর্থাৎ বুঝাই যায়, কবর দেয়া হয়েছিল৷ অারকেটি হলো কতো জন্ম জন্মান্তর অাপনি
কখনো অগ্নির দ্ধারা দাহিত হয়েছে, কখনো বা পাথবীর নিচে সমাধিস্থ হয়েছেন তার
কি কোন ইয়ত্বা অাছে?
“পৃথকজন” অর্থ কি?
“নানাসত্থারানং মুখং উল্লোকেন্তীতি পুথুজ্জনা”
—(পতিসম্ভিদামগ্গ পালি)
অর্থাৎ অনন্তর এই সংসারচক্রে নির্দিষ্ট কোন শরণ নেই৷ এই জন্মে এই সৃষ্টি
কর্তার শরণ নিল, তো অন্য জন্মে অন্য এক সৃষ্টি কর্তার শরণ নিল৷ কখনো
ইন্দ্রকে, কখন ব্রক্ষ্মাকে, কখনো ভূদেবকে, কখনো অগ্নিকে৷
ধর্মপদে
তথাগতের একটি গাথার ন্যায়, শত বছর যেই অগ্নির পূজা করেও তিল পরিমান কোন ফল
পাওয়া যায় না, তেমনি অসার, চতুর্মহাভূতে তৈরী এই দেহ, যেই দেহ
জীবিতিন্দ্রিয়ের চ্যুতির পর অকেজো এক শবদেহ ছাড়া কিছুই নয়, তাকে পুড়ালে
মঙ্গল হবে নাকি ভূর্গবস্থ করলে মঙ্গল হবে এমন তর্কে অাছেন৷ তথাগতের ভাষিত
দেশিত ৩৮প্রকার মঙ্গল ছাড়া অার কত প্রকার মঙ্গল থাকতে পারে৷
সুতরাং এই পুড়িয়া ফেলা বা কবর দেয়া যার যার ব্যক্তিসত্বার মনের উপরেই নির্ভর করে৷
(বিঃদ্রঃ—তথাগতের সময়কালে মহাপ্রজাপতি গৌতমীসহ অারো অনেককেই অগ্নিদাহ করা হয়েছিল৷ এমনকি তথাগতের পবিত্র দেহকেও)
(দাহক্রিয়ার কারণ যা হতে পারে)
১/তথাগতের বা তাঁর অর্হত শ্রাবকদয়ের দাহক্রিয়া এই জন্যে করা হয় যাতে পবিত্র অস্থিসমূহকে পূণ্যার্থীগণ পূজা সৎকার করে পূণ্যের ভাগিদার হতে পারে৷ অভিধর্মের দৃষ্টিকে চতূর্মহাভূতের তৈরী এই শরীর তূচ্ছ, কিন্তু লৌকিক দৃষ্টিতে এই নশ্বর দেহের উপর অালম্বন করেই পাতিমোক্ষ, ইন্দ্রীয় সংবরনসহ চতুর্পারিশুদ্ধি শীল, উৎকৃষ্ট ধূতাঙ্গশীল পালন করা এই দেহটি দেব মনুষ্যের সকলে পূজ্য হয়ে যায়৷ অার তাইতো পরিনির্বাপিতের পরেও তথাগতের মৃত দেহকে ঘিরে শতকোটি দেবতা ক্রন্দন করেছিলেন৷ অার তাই উত্তম অাচরণকারীদের অগ্নিদাহ করে তাদের অস্থি নেয়া হয়৷ সেই অনুসারে দাহক্রিয়া বৌদ্ধদের পরম্পরা বললেও ভুল হয় না৷ বিমুক্ত সত্বার জন্যে সকল অবস্থাই এক৷ অার তাছাড়া অগ্নিদাহ না করে ভূগর্ভস্থ করা এমনও অনেক ভিক্ষু অাছেন৷ সুতরাং দাহ করা বা সমাধি দেয়া উভয়ই করা যায়৷
২/যশ ও তার বন্ধুদের সম্পর্কে পড়ে থাকবেন সকলে৷ পূর্বকালে শবদেহ পুড়িয়ে যেই অনিত্য জ্ঞাণ লাভ করেছিল ইহজন্মে তার ফলস্বরূপ মোক্ষম লাভ করে৷ অর্থাৎ শব দেহকে ভূগর্বস্থ করার চাইতে অগ্নিদাহ করলে অনিত্য ভাবনার জন্যে অধিক সহায়ক হয়৷ অার একারণেই সম্ভবত তথাগত সকল ভিক্ষুসংঘের অশুভ ভাবনার জ্ঞাণ দেওয়ার জন্যে সিরিমার দেহের দাহক্রিয়া উপস্থিত ছিলেন৷
শেষ কথা এই যে, দাহক্রিয়ায় যদি ভিক্ষুগণ
উপস্থিত থাকেন তাহলে ভাল হয়৷ অার যদি না থাকেন তাহলে বিহারে গিয়ে সংঘ কর্ম
সম্পাদন করে সেই পূন্যরাশি কোন এক শীলবান উপাসক বা উপাসিকাও সম্পাদন করতে
পারেন৷ এই কাজটি অবশ্য করা যায়৷ যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশে শীলবান ও পণ্ডিত
উপাসক উপাসিকাগণ গণনাতীত রয়েছেন৷
অার অন্যটি হলো, ভূগর্ভস্থ করার
চাইতে অগ্নিদাহ করাটাই অনিত্য ভাবনার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হওয়ায় সমাধি না
দিয়ে অগ্নিদাহ করলে উত্তম হয়৷ এছাড়া বিশেষ কোন কারণ নেই৷
by admin | May 25, 2020 | blog
লক্ষ শহীদের মাঝে বৌদ্ধ যারা
ধর্মবিরীয় ভিক্ষু
স্বাধীনতা
সংগ্রামে অনেক বৌদ্ধ যুবক অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছে, অনেকে শহীদ হয়েছে, অনেকে
নিখোঁজ হয়েছে; লুন্ঠিত হয়েছে বৌদ্ধদের ধন সম্পদ, অগ্নিদগ্ধ হয়েছে হাজার হাজার
ঘর-বাড়ী; নিগৃহীত হয়েছে, লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হয়েছে শত শত বৌদ্ধ তরুণী। এসব অত্যাচার
নিপীড়ন থেকে গৈরিক বসনধারী বৌ্দ্ধ ভিক্ষুরাও রেহাই পাননি। অনেক বিহার লুণ্ঠিত
হয়েছে, অপহৃত হয়েছে বহু মূল্যবান বৌদ্ধ মূর্তি। অনেক বৌদ্ধ জনসাধারণ আত্ম রক্ষার
জন্য আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশে।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে বৌদ্ধদের গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস এখনো রচিত হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে বৌদ্ধদের বীরত্বপূর্ণ ভুমিকা ও আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস প্রকাশিত হলে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবাং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিঃসন্দেহে আত্মশ্লাঘা বোধ করবে।মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কিংবা পাক-সেনা ও রাজাকার-আলবদর কর্তৃক নিহত শহীদ বৌদ্ধদের সংক্ষিপ্ত তালিকা ড. দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুযা রচিত “বাঙালি বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, পৃ: ২০৭-২০৯ অবলম্বনে সকল যোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে উপস্থাপন করছে দি বুড্ডিস্ট টাইমস ।
জিনানন্দ
ভিক্ষু গ্রাম- আঁধারমানিক, রাউজান, চট্টগ্রাম। (তিনি পটিয়া থানার পাঁচরিয়া গন্ধকুট
বুদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন)। সুধীর বড়ুয়া, পিতা-মৃত নীরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, গ্রাম-
আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।(ইপআর বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন
এবং শহীদ হন)। পংকজ বড়ুয়া, পিতা-সুরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, গ্রাম- হিংগলা, রাউজান,
চট্টগ্রাম। (সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন)। বিকাশ বড়ুয়া, পিতা- দ্রোন কুমার বড়ুয়া,
গ্রাম- খৈয়াখালী, রাউজান, চট্টগ্রাম। শুক্লধর বড়ুয়া, গ্রাম- দমদমা, মিরশ্বরাই,
চট্টগ্রাম। মৃনাল কান্তি বড়ুয়া, গ্রাম- জোরাল গঞ্জ, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। দুলাল
কান্তি বড়ুয়া, গ্রাম- হিংগলা, রাউজান, চট্টগ্রাম। ঝুন্টু বড়ুয়া, পিতা- অর্জুন
বড়ুয়া, গ্রাম- আঁধারমানিক, রাউজান, চট্টগ্রাম।।আনন্দ প্রসাদ বড়ুয়া, গ্রাম-
আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম। বাগীশ্বর বড়ুয়া, গ্রাম- আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।
( তিনি কাপ্তাই পরিকল্পনা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহ-প্রধান শিক্ষক ছিলেন)। আনন্দ বড়ুয়া,
গ্রাম- পারুয়া, রাঙ্গুনীয়া, চট্টগ্রাম। মৃনাল কান্তি বড়ুয়া, পিতা- সতীশ চন্দ্র
বড়ুয়া, সোনাপাহাড়, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। দীপক বড়ুয়া, পিতা- মৃত বিজয়শ্রী বড়ুয়া,
এনায়েত বাজার, চট্টগ্রাম। (প্রথম বৌদ্ধ শহীদ) রমেশ বড়ুয়া, গ্রাম- গহিরা, রাউজান,
চট্টগ্রাম। উমেশ বড়ুয়া, গ্রাম- গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম। বীরবাহু বড়ুয়া, গ্রাম-
করলডাঙ্গা, পটিয়া, চট্টগ্রাম। সুমতি রঞ্জন বড়ুয়া, গ্রাম- শাকপুরা, বোয়লখালী,
চট্টগ্রাম। ধূর্জটি প্রসাদ বড়ুয়া, গ্রাম- শাকপুরা, বোয়লখালী, চট্টগ্রাম। রমেশ
চন্দ্র বড়ুয়া, গ্রাম- শাকপুরা, বোয়লখালী, চট্টগ্রাম। সুনীল বড়ুয়া, গ্রাম-
বৈদ্যপাড়া, বোয়ালখালী চট্টগ্রাম।বিভূতি বড়ুয়া, গ্রাম- বেতাগী, রাঙ্গুনিয়া,
চট্টগ্রাম।।শশাংক বড়ুয়া, গ্রাম- রামু মেরেংলোয়া, রামু, কক্সবাজার, মনোরঞ্জন বড়ুয়া,
পিতা-বিপিন সিংহ, গ্রাম- আলিশ্বর লাকসাম, কুমিল্লা, মিলন বড়ুয়া, মোগলটুলি বড়ুয়া
পাড়া, চট্টগ্রাম, মনীন্দ্র লাল বড়ুয়া, গ্রাম- হলদিয়া পালং, উখিয়া, কক্সবাজার, শশী
কুমার বড়ুয়া পিতা-মৃত সীননাথ বড়ুয়া, কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র,
ক্ষীরোধ মোহন বড়ুয়া, গ্রাম- মানিকপুর, চকরিয়া, কক্সবাজার,সুশীল বড়ুয়া, গ্রাম-
বৈদ্যপাড়া, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম। বিজয় রতন বড়ুয়া, গ্রাম- দমদমা, মিরশ্বরাই,
চট্টগ্রাম। মনোহরি বড়ুয়া, গ্রাম- মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। রাসবিহারী বড়ুয়া,
গ্রাম- মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। যোগেশ চন্দ্র বড়ুয়া, গ্রাম- মায়ানী,
মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। সুধাংশু বড়ুয়া, গ্রাম- মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
নাইদাবাসী বড়ুয়া, গ্রাম- মায়ানী, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। বেনীমাধব বড়ুয়া, গ্রাম-
জোবরা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। দেবাশোক বড়ুয়া, গ্রাম- মোগলটুলী, চট্টগ্রাম। মিলন
বড়ুয়া, গ্রাম- পাহাড়তলী, রাউজান, চট্টগ্রাম। নীরদ বরন বড়ুয়া, গ্রাম- পাহাড়তলী,
রাউজান, চট্টগ্রাম। রুপায়ন বড়ুয়া, গ্রাম- নোয়াপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম। বাদল
বড়ুয়া, গ্রাম- পাহাড়তলী, রাউজান, চট্টগ্রাম। ভট্ট বড়ুয়া, পিতা-কালীধন বড়ুয়া,
উখিয়া, কক্সবাজার। দীপক বড়ুয়া, গ্রাম- আবদুল্লাপুর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
জ্ঞানেন্দ্র বড়ুয়া (সদরঘাট), গ্রাম- রাউজান, চট্টগ্রাম। সুধাংশু বড়ুয়া, গ্রাম-
হাইদচকিয়া, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। কামিনী বড়ুয়া, গ্রাম- রামু, কক্সবাজার। জীবন
বড়ুয়া, গ্রাম- কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী। টুনু বড়ুয়া, গ্রাম- কৌশল্যার
বাগ, কোমলগঞ্জ, নোয়াখালী। বীরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, গ্রাম- কৌশল্যার বাগ, কোমলগঞ্জ,
নোয়াখালী। চারুবালা বড়ুয়া, গ্রাম- আবুরখীল, রাউজান, চট্টগ্রাম।সারদা বড়ুয়া, গ্রাম-
গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম। ভবেশ চন্দ্র বড়ুয়া, পিতা- মৃত বিপিন চন্দ্র বড়ুয়া,
গ্রাম- ছাদেকনগর, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম। বুদ্ধ কিঙ্কর বড়ুয়া, গ্রাম- দমদমা,
মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। সুকোমল বড়ুয়া, রাঙ্গামাটি। রূপায়ন বড়ুয়া ( ৮ বছরের বালক)
গ্রাম- গুজরা নোয়াপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম। সুধীর রঞ্জন বড়ুয়া, কর্ণফুলী পেপার
মিল, চন্দ্রঘোনা।
যারা নিখোঁজ হয়ে আর ফিরে আসেনি
সুপতি
রঞ্জন বড়ুয়া, গ্রাম- রাউজান, চট্টগ্রাম। সঞ্চয় বড়ুয়া, গ্রাম- রাউজান, চট্টগ্রাম।
প্রভাস কুসুম বড়ুয়া (চ,বি, এর প্রকৌশলী) গ্রাম- ইছামতি, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম। চিত্তরঞ্জন
বড়ুয়া, গ্রাম- জোয়ারা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। তড়িৎ কান্তি বড়ুয়া, গ্রাম- রাউজান,
চট্টগ্রাম। হীরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, চন্দ্রঘোনা কাগজের মিলে কর্মরত ছিলেন। পরাগ
বড়ুয়া, গ্রাম- সাতবাড়িয়া, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। ধর্মদর্শী বড়ুয়া, টি এন্ড টিতে
চাকুরীরত ছিলেন। সুবিমল বড়ুয়া, টি এন্ড টিতে চাকুরীরত ছিলেন। সুনীল মুৎসুদ্দী,
আওয়ামী লীগের রাঙ্গামটি থানা কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। চিত্ত রঞ্জন বড়ুয়া,
গ্রাম- রাউজান, চট্টগ্রাম। ভবেশ বড়ুয়া, গ্রাম- জানারখীল, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
নিপুল কান্তি বড়ুয়া, ইলিয়াস বিল্ডিং, চকবাজার, চট্টগ্রাম। সত্যরঞ্জন বড়ুয়া, গ্রাম-
রাউজান, চট্টগ্রাম। বিধূভূষণ বড়ুয়া, গ্রাম- মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। রমেশ
চন্দ্র বড়ুয়া, গ্রাম- মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। সুভাষ বড়ুয়া, গ্রাম-
মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।বঙ্কিম বড়ুয়া, গ্রাম- মাদার্শা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
ননীগোপাল বড়ুয়া, গ্রাম- লাখেরা, পটিয়া, চট্টগ্রাম। নীলকমল বড়ুয়া, গ্রাম- কধুরখীল,
বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম। মৃনাল বড়ুয়া, গ্রাম- দমদমা, মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম।
ভূপেন্দ্র লাল বড়ুয়া, গ্রাম- চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম। সুরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, গ্রাম-
চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম। তপন কুমার বড়ুয়া, গ্রাম- চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম। মনীন্দ্র
লাল বড়ুয়া, গ্রাম- চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম। সমীরণ বড়ুয়া, গ্রাম- পান্থশালা,
মিরশ্বরাই, চট্টগ্রাম। হিমাংশু বড়ুয়া, গ্রাম- বরমা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম। সঞ্চয়
ভূষণ বড়ুয়া, বন্দরে চাকুরীরত ছিলেন। হীরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, বন্দরে চাকুরীরত ছিলেন।
এস. আর. বড়ুয়া, বন্দরে চাকুরীরত ছিলেন। ভি, পি বড়ুয়া, বন্দরে চাকুরীরত ছিলেন। বি,
এস বড়ুয়া, বন্দরে চাকুরীরত ছিলেন।
এছাড়া
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ প্রধানত দুইভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন
করেছেন। প্রথমত দেশের অভ্যত্বরে বৌদ্ধদের জান মাল রক্ষায় প্রয়াত মহাসংঘনায়ক
বিশুদ্ধানন্দ মহাথের নেতৃত্বে আভ্যন্তরীণ মিশনারী কাজ, দ্বিতীয়ত মুক্তিযুদ্ধের
স্বপক্ষে জনমত গঠনে সংঘরাজ পণ্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথেরর বৌদ্ধদেশ পরিভ্রমণ।
লক্ষ
প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ বিজয়, এ স্বাধীনতা। বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
হবে- এমন ¯স্বপ্ন নিয়েই আজ বিজয় দিবস পালন করতে যাচ্ছে গোটা জাতি। বিজয়ের এ দিনে
সবার অঙ্গীকার সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার। যেসব বৈষম্য থেকে স্বাধীনতার জন্ম
সেই বৈষম্যগুলো থেকে এ জাতি বেরিয়ে আসতে আবার দৃঢ় প্রত্যয় নেবে আজ।
[বিদ্রঃ আমরা অকপটে স্বীকার করছি যে, এ তালিকা বা বিবরণ কোনক্রমেই পূর্ণাঙ্গ নয়, আরো বহু বৌদ্ধ শহীদ আছে যাদের তথ্য আমাদের জানা নেই। এ জন্যে আরো বহু তথ্য সংগ্রহের যেমন অবকাশ রয়েছে তেমনি বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ইতিহাস রচনারও প্রয়োজননীয়তা রয়েছে।]
তথ্যসুত্রঃ দি বুড্ডিষ্ট টাইমস
by admin | May 18, 2020 | blog
বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিসত্তা হিসেবে বৌদ্ধরা অতি প্রাচীন। ভারত-বাংলা
উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে বৌদ্ধদের অসামান্য অবদান
রয়েছে। এদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রতিটি প্রগতিশীল
আন্দোলন-সংগ্রামে বৌদ্ধদের গৌরবময় ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। এদেশের বৌদ্ধ
স¤প্রদায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের
মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সাহসী কর্মনির্মিতি ছিল অনন্য অসাধারণ। বাংলার ভূমিজ
সন্তান হিসেবে বৌদ্ধরা দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তি
সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায় বলতে বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ,
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকমা, মারমা, রাখাইন,
¤্রাে, চাক, তনচঙ্গ্যা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। বৌদ্ধরা জাতি ধর্ম বর্ণ
নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং
বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাদের অনেকেই জীবন দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকবাহিনীর অতর্কিত বর্বরোচিত আক্রমণে এদশের
মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই অত্যাচার, নির্যাতিত, নিপীড়িত,
ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান :
চট্টগ্রামের অঞ্চল’ আলোচ্য প্রবন্ধে স্বাধীনতাকালীন বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধদের
অবদান, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম,
বীরাঙ্গনাদের নাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা
হয়েছে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের অংশগ্রহণ ও অবদান
বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অত্যন্ত গৌরবময়। সাধারণভাবে
ব্রিটিশ আমল থেকে বৌদ্ধরা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে যোগদান
করে আসছে। অতীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের সক্রিয় ভূমিকা
রয়েছে। এতে উদীয়মান তরুণ ভূপেন্দ্রনাথ বডুয়া ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া
প্রমুখ নেতৃবৃন্দ নির্যাতন ও কারাদÐ ভোগ করেছেন। বিপ্লবী আন্দোলনে বৌদ্ধ
যুবক স¤প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিপ্লবী মহেশ বডুয়া, বিহারী বডুয়া, প্রকৃতি
বডুয়া প্রমুখ অনেকে ব্রিটিশের কারাগারে তিলে তিলে আত্মদান করেছেন। তেজস্বী
রোহিনী বডুয়া ফাঁসির কাষ্টে জীবনের জয়গান গেয়ে যান।
বৌদ্ধদের ইতিহাস বহু বলিষ্ট। বিশেষত বিপ্লব বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ ও
বিপ্লবে বৌদ্ধরা অংশ নিয়েছিল। সামরিক বাহিনীতে বৌদ্ধরা বিশেষ দক্ষতা
দেখিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে বৌদ্ধরা দলে দলে সামরিক বাহিনীতে যোগ
দিয়েছিলেন। মগ প্লটনের সদস্যরা সমর কর্মকাÐে প্রশংসা কুঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে
বৌদ্ধরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগিতার মনোভাব দেখালেও পরে, তারা স্বাভাবিক হয়ে
ওঠে। হিন্দুদের সাথে সাথে বৌদ্ধরাও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজদের নজরে
আসে। ইংরেজরা বৌদ্ধদের শৌর্যবীর্যের কথা অবহিত হয়ে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে
চাকরি দেয়। বৌদ্ধ সৈনিকদের সমন্বয়ে ‘মগ পল্টন’ নামে পৃথক একটি সেনা দল
সৃষ্টি করেন। মগ পল্টনের কয়েকজন বডুয়া সৈনিকের নাম ও পরিচয় হল: নারায়ণ সিং
সুবেদার, পাহাড়তলী, মোহন সিং সুবেদার, পাহাড়তলী, কালাচান সুবেদার,
পাহাড়তলী, দীপচান সুবেদার, জ্যৈষ্টপুরা, জয় সিং সুবেদার, আধাঁরমানিক,
উদয়চান জমাদার বাহাদুর, বাঘখালি। ১৯৩০ সালে ভারতে সে সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয়
তাতে বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ড. প্রণব কুমার বডুয়ার
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ স¤প্রদায়’
গ্রন্থের প্রথম অনুচ্ছেদে লিখেছেন, সে সময় বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত ৫৫ জন
বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্রদের ঠিকানাসহ একটি তালিকা প্রদান করেছেন।
অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন
করেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার ছতরপুটিয়া গ্রামের এই ব্যক্তিত্ব কংগ্রেসের
প্রথমসারীর নেতা ছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রাম পটিয়ার মৈতলা গ্রামের মহেন্দ্র লাল
(চন্দ্র) বডুয়া, ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া, তরনী বডুয়া, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান
থানার ভুপেন্দ্রনাথ মুৎসুদ্দী (ভুপেন গান্ধী), আবুরখীলের পুলিন বিহারী
বডুয়া, এডভোকেট সারদা প্রসাদ বডুয়া, বাঁশখালীর রাস বিহারী বডুয়া, রাউজান
গহিরার নগেন্দ্র লাল বডুয়া, রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামের প্রবীণ বডুয়া ও
রাঙ্গুনিয়ার নীরদবরণ তালুকদার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অসহযোগ আন্দোলনের সাথে
যুক্ত ছিলেন।
নীরদ বরণ তালুকদার ও ভুপেন্দ্র নাথ বডুয়া তিন মাস কারাবরণ করেন। নীরদ বরণ
তালুকদার পÐিচেরীতে ঋষি অরবিন্দের আশ্রমে যোগ দিয়ে শেষ জীবন মানবতার সেবায়
উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী কর্মধারায় প্রথম অংশ নেন আবুখীলের মতান্তরে নোয়াপাড়ার
প্রবীন বডুয়া তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেন, শেষে বার্মায় গমন করেন। জানা যায়
নেতাজীর সাথেও তার যোগাযোগ ছিল। পটিয়া থানার মৈতলা গ্রামের সন্তান
মহেন্দ্র লাল বডুয়া ছিলেন অন্যতম সাহসী বিপ্লবী সন্তান। অন্যান্য
বিপ্লবীদের মধ্যে রোহিনী বডুয়া, জ্যেষ্ঠপুরার ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া,
সাতবাড়িয়ার মহেশ বডুয়া, পান্থশালার নীরেন্দ্র বডুয়া, বৈদ্যপাড়ার জীবক
বডুয়া, মিস নিরুপমা বডুয়া, ফটিকছড়ির বডুয়া, নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি মঞ্চে
আত্মহুতি দেন। মহেশ বডুয়া ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।
মাদ্রাজে নৌ বিদ্রোহ অংশগ্রহণকারীর বিপ্লবী নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি হয়। মহেশ
বডুয়া ও নীরেন্দ্র চৌধুরীর দীপান্তর হয়। উল্লেখ্য যে, মহামুনির তালতলা
পাহাড়, আবুরখীলের জেতবন বিহার, শাকপুরার ধর্মানন্দ বিহার ছিল বিপ্লবীদের
গোপন মিলন কেন্দ্র। অনেক বিপ্লবী আবুরখীলের আশ্রয় নিয়েছিল। সত্যাগ্রহ
আন্দোলনে অনেকে যোগদান করেন। তন্মোধ্যে বৈদ্যপাড়ার প্রেম প্রসাদ বডুয়া,
কর্তালার প্রেমানন্দ চৌধুরী (গ্রামের পরিচয় জানা যায়নি) ছয়মাস কারাদÐ হয়।
অন্যান্যদের মধ্যে হাশিমপুরের অধ্যাপক প্রকৃতি রঞ্জন বডুয়া, পূর্ণেন্দু
তালুকদার, আবুরখীলের ড. বিনয় বডুয়া, রাউজানের ভূপেন্দ্র লাল বডুয়া,
রাঙ্গুনিয়ার ড. অরুণ চন্দ্র বডুয়া। অধিকন্তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ
হিন্দ ফৌজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন আবুরখীলের খগেন্দ্র লাল বডুয়া, অজিত বডুয়া
(শ্রদ্ধানন্দ ভিক্ষু)। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী কর্মধারার
সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তন্মোধ্যে সংঘনায়ক শ্রীমৎ আনন্দ মিত্র মহাথের,
মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং শ্রীমৎ বঙ্গীশ ভিক্ষুর নাম
উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধদের মধ্যে স্বদেশে সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং
বিদেশে পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ রাষ্ট্র জাপান, থাইল্যাÐ, কোরিয়া, শ্রীলংকা,
কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশসমূহ সফরপূর্বক মুক্তিযুদ্ধের
স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন।
বাংলাদেশের বিভাগের ফলে বৌদ্ধদের বিরাট অংশ পূর্ববঙ্গে রয়ে গেল। তাঁরা মাতৃভূমির সর্ববিধ উন্নতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন। দেশের প্রশাসনিক ব্যাপারেও তাঁদের যোগ্য স্থান ছিল। কেউ কেউ রাজ্যসভা ও বিধানসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশের সুখ দুঃখ সম্পদে বিপদে বৌদ্ধরা সমান অংশগ্রহণ করে যান। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে বহু কৃতি ছাত্র ছাত্রী ও বুদ্ধিজীবি সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দিয়ে ইহাকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে প্রতিদ্বদ্বিতা করে এই দাবীগুলিতে অন্ধ সামপ্রদায়িকতা ছিল না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। সেই কারণে দেশের প্রগতিশীল বিরাট অংশ আওয়াগী লীগকে সমর্থন করেন। বাংলার বৌদ্ধেরাও এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের রাউজান থানা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এখানে মুসলিম লীগের কিছু ব্যক্তিও আছেন তাঁরা মুসলীম লীগ সমর্থনের জন্য বৌদ্ধদেরকে নানাভাবে পরোচিত ও ভয় প্রদর্শন করতে থাকে। বৌদ্ধেরা দৃঢ়তার সাথে ইহার প্রতিবাদ করেন এবং প্রতি আওয়ামীলীগ সমর্থন করেন। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে গুজরা নয়াপাড়ার কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রাম আক্রান্ত হয়। এই সংঘর্ষের ফলে দুইজন বৌদ্ধ নিহত ও কয়েকজন আহত হন। অপর পক্ষেও কিছু হতাহত হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং নয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি স্কুল মাঠে বিরাট জনসভায় ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানেরও নয়; বাংলাদেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালির। নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে আওয়ামী লীগপন্থীরা সর্বত্র জয় লাভ করেছেন। আর মুসলীম লীগপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ইহাতে মুসলীম লীগপন্থীদের অমুসলিম বিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পায়।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ সন হতে বাঙালিদের উপর যে জঙ্গীশাহী আক্রমণ হয়েছে, তাতে প্রথম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নিধন কার্য চালায়। পরে সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু বৌদ্ধ ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের ধ্বংস করা হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় বহু সংখ্যক বাঙালি এই আক্রমণে হতাহত হয়েছে। মা বোন মাতৃজাতিরা ধর্ষিত ও লুন্ঠিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে বাঙালিরা আত্মরক্ষার্থে মুক্তিবাহিনী গঠন করে পাক সৈন্যদের অগ্রগতি রোধ করেন। এই বাহিনীতে বৌদ্ধ তরুণ-তরুণীরা প্রচুর পরিমাণে যোগদান করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচÐ আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশ এখন শত্রুর কবল মুক্ত হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করার নিমিত্ত জঙ্গী নেতারা নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের সহায়তায় সমাজ বিরোধী লোকদেরকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন। তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছে। এই রূপে বাঙালিদের মধ্যে পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করেছে জঙ্গীশাহীরা শাসন ও শোষণ অক্ষুণ্য রাখার পরিকল্পনা করেছেন। ফলে সাত মাসে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি হতাহত ও শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রিত হয়েছেন। তথাকার সংখ্যালঘু স¤প্রদায়সমূহ একেবারে নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়েছে। বহু গ্রামে ও মন্দিরের বিপন্ন হিন্দু মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং সুযোগ মত নিরাপদ স্থানে প্রেরিত হয়েছে সেজন্য রাজাকার ও পাক সৈন্যের সম্মিলিত আক্রমণে বহু বৌদ্ধ গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। চট্টগ্রাম পটিয়া থানার সাতবাড়িয়া গ্রাম ও শান্তি বিহার আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। জোয়ারা, সুচিয়া প্রভৃতি গ্রামও লুণ্ঠিত হয়েছে। এই রূপে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড ও মিরেরশ্বরাই থানার বৌদ্ধ বিহার ও গ্রাম বিধ্বস্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়া, চকরিয়া হারবাং, মহেশখালির বিহারও আক্রাস্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তি ভগ্ন করা হয়েছে। অষ্টধাতুর বড় বড় বুদ্ধমূর্তি চুর্ণ-বিচুর্ণ করে লুন্ঠিত হয়েছে। বহুধর্মগুরু ও নর-নারী হতাহত হয়েছেন। এই সংগ্রামে অন্তত পঁচিশ সহস্র বৌদ্ধ নিহত ও লক্ষাধিক প্রতিবেশি রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। যতই সময় যাচ্ছে সংখ্যালঘু বৌদ্ধরা প্রায় নিশ্চহ্ন হতে চলেছে। তথাপি বৌদ্ধ তরুণগণ দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে মাতৃভূমিকে শ্ত্রমুক্ত করার নিমিত্ত আত্মনিয়োগ করছেন। শরণার্থী রূপে ভারতে গিয়ে বহু বৌদ্ধ তরুণ পুন মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছেন। বহু তরুণের সম্মুখ সংগ্রামে শত্রু নিধন করে শহীদের গৌরব অর্জনের করেছেন। তথাপি বহু যোদ্ধা সংগ্রাম চালিয়েছেন অসীম সাহসে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী তরুণ বীর সৈনিক রূপে মুক্তি সংগ্রামে প্রবেশ করেছেন।
ধর্মাধার মহাস্থবির উল্লেখ করেছেন, ‘চট্টগ্রামের সাতবাড়িয়া গ্রামের শান্তি বিহার পাক সৈন্যরা গত আগস্ট মাসে লুঠ করে বিহারের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং বৌদ্ধদের ধর্মগুরু সংঘনায়ক শ্রদ্ধেয় অভয়তিষ্য মহাস্থবিরের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এই রকম ঘটনা বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর আমলে শত শত ঘটিয়াছে।’ মুক্তিযুদ্ধ কালীন পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, বাংলাদেশের বিজয়ে বাঙালি হিসাবে আজ আমরাও গর্বিত এবং সেই দেশের আনন্দযজ্ঞে আমরাও অংশীদার কারণ i যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ জয় কিংবা রাজনৈতিক জয় না, ইহা জয় নয়; মানবিকতার জয়, গণতন্ত্রের জয়, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের জয়। তাই আমরা আনন্দিত। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে পূর্ববঙ্গে অসহায় নিরীহ জনসাধারণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য শোষণ আমাদের বার বার ব্যথিত করেছে। অসহায়ের মতো আমরা লক্ষ্য করেছি কেমন করে একটি প্রাণবন্ত জাতিকে নির্দয়ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই ২৫শে মার্চ পাঁচ জঙ্গী শাসনের নৃশংস অত্যাচারের পর বৌদ্ধরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিল।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে। কলকাতায় বৌদ্ধদের মুখপত্র নালন্দার মাধ্যমে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা এবং পূর্ববঙ্গের অসহায় নরনারীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। নালন্দা পত্রিকার পঞ্চম বর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের ইয়াহিয়া সরকার যে ধ্বংসলীলা চালায়া তার তীব্র নিন্দা করে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্টকে ঐ নরমেধ যজ্ঞের অবসান ঘটাতে অনুরোধ করা হয় এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ ও মিত্র রাষ্ট্রের প্রধানদের পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া আগস্ট মাসে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের সমস্যাসমূহ আলোচনা করার জন্য নিখিল ভারত বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হতে প্রায় ৩০০জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী সংগ্রামরত জনসাধারণের সমর্থনে এবং ইয়াহিয়া সরকারের জঘন্য বর্বরতার নিন্দা জ্ঞাপক পাঁচটি প্রস্তাব সভা সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এপারের অগণিত বৌদ্ধদের প্রচন্ডভাবে উদ্দীপিত করেছে। তাই ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদে এখানকার বৌদ্ধরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেন। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ যুব সংঘের সমগ্র এশিয়ার বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের বিরুদ্ধে একটি নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও বাঙালি বৌদ্ধদের পক্ষ হতে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
বাংলার মুক্তি সংগ্রামে হিন্দু মুসলমানের ন্যায়স্থানীয় বৌদ্ধদের ভূমিকা খুবই গৌরবজনক। গোড়ার দিকে প্রাক ফৌজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গণহত্যা চালিয়ে যায়। বৌদ্ধদেশ চীন পাকিস্তানের বন্ধু। চীন ও অপর বৌদ্ধদেশগুলো সৌহার্দ্য লাভের মানসে মাঝখানে পাক সৈন্যেরা বৌদ্ধদের ‘চাইনিস বুদ্ধিস্ট’ আখ্যা দিয়ে অত্যাচার হতে রেহাই দিতে চাইলে বৌদ্ধরা তার পুন সুযোগ গ্রহণ করলেন। প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম বিপন্ন হিন্দু মুসলমানের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল। এই সকল আশ্রয়স্থান হতে শরণার্থীদের সন্তর্পণে ভারতের দিকে প্রেরণ করা হয়। তাদের যাত্রাপথে মানিকছড়ির মানরাজ বাহাদুর সহস্র সহস্র শরণার্থী ও মুক্তিবাহনীর সেবার নিমিত্ত তার রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন। শরণার্থীরা নিরাপদে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ গ্রামগুলি মুক্তিবাহিনীর দুর্গে পরিণত হয়। এসব গ্রামে আত্মগোপন করে মুক্তিবাহিনী তাদের সংগ্রাম চালাতে থাকেন। দলে দলে বৌদ্ধ যুবক যুবতী মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে সংগ্রাম করেন। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার পর্বতবেষ্টিত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা প্রত্যেক বৌদ্ধকে পরিচয় পত্র দেবার নির্দেশ দিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে লোককে সম্ভাব্য মৃত্যু হতে রক্ষার নিমিত্ত পরিচয়পত্র দিতে থাকেন। এই সুযোগে অনেক বৌদ্ধ পাক ফৌজের কোপ দৃষ্টি এড়িয়ে ভারতে চলে আসেন। দেশ দ্রোহীদের মাধ্যমে এই সংবাদ পাক সৈন্যদের নিকট পৌঁছলে আবার বৌদ্ধ গ্রামের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চলতে থাকে। বহু ঘরবাড়ী ভস্মীভূত হয়, বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়। বহু বৌদ্ধ ও ধর্মগুরু হতাহত ও নিখোঁজ হন। কিন্তু এই অত্যাচার বেশিদিন চলতে পারেনি ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানে পতন ঘটেছে।
শরণার্থী ও ভারতীয় বৌদ্ধদের পক্ষ হতে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি ও সাহায্যের নিমিত্ত ব্যাপক আন্দোলন চালায়। ভারতে অবস্থিত বৌদ্ধদেশগুলির কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্বের বৌদ্ধদেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘে দাবী করা হয়েছে। শরণার্থী বৌদ্ধ নেতা জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সিংহল, থাইল্যাÐ, জাপান, হংকং প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধদেশগুলোতে প্রচার কার্য চালিয়েছেন। এই প্রচারের ফলে সেই সকল দেশবাসীর মানবীয় বিবেক জাগ্রত হয়েছে। বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকান্ডের নিমিত্ত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। মুক্তি সংগ্রামের সকল বিভাগে বৌদ্ধরা সক্রিয় ছিলেন। দীপ্ত শপথ নেন জন্মভূমি শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম করবেন। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলা অচিরেই শত্রু মুক্ত হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল পাকসেনাদের দ্বারা অধিক আক্রান্ত। বিশেষ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট, কর্ণফুলি, চট্টগ্রাম সদর, হাটহাজারী, রাউজান, কাপ্তাই, পটিয়া, আজিজনগর, চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার, টেকনাফ প্রভৃতি স্থানে পাকসেনারা বোমা নিক্ষেপ করে। বিভিন্ন জেলায় পাক বাহিনীর অতর্কিত নৃশংস আক্রমণে বৌদ্ধরা ব্যাপক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিহত হয়েছেন। কোন কোন জেলায় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের লোকেরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে ছিল। বৌদ্ধরাও পূর্ববঙ্গের বাংলাদেশের একটি সংখ্যালঘু সমপ্রদায়। তাঁরা প্রধানত বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় বসবাস করেন।
পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি ও ভয়াবহতা বিষয়ে ভারতের আগরতলায় ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল সকাল ১০ টায় একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ, ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা- শ্রী গোপাল ভূষণ চাকমাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আকাশবাণী, আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং অন্যান্য আঞ্চলিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি বৌদ্ধদের উপর নৃশংস অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা পরিচালিত হয়। … পরবর্তীতে তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, অর্থমন্ত্রী শ্রী কৃষ্ণ দাস ভট্টাচার্য এবং মুখ্যসচিব ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে স্বাক্ষাৎকারে মক্তিযুদ্ধের দুঃখজনক ইতিহাস তুলে ধরেন। … এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রতুত্ব সংস্থা-ব্যাংককের সভাপতি রাজপুত্র পুন-পিসমাই-দিসকুল এবং মহাসচিব মি. ইয়েম সংঘবাসী, শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি শ্রীমাভো বন্দর নায়েক, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত সংস্থার সকল আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ পরিষদে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের রিপোর্ট প্রেরণ করেন।”
পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের উল্লেখ করেন যে, Moveover, the last day I and Mr. K M Shahabuddin went to Parliament house to meet with Ministers and Members of the Parliament presented the exact scene about the success in freedom of occupied Bangladesh and made an application to stop the landing of Pakistani flight in Sinhala Airport. As a result, Srilankan Prime Minister Mrs. Bander Nayek to stop the landing of Pakistani flight in Colombo Airport. All directions such as north south, east west, and water-land-air were closed for Pak occupied force.
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পাক সৈন্যের আক্রমণে বৌদ্ধদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে জীবিকার নিমিত্তে অনেক বৌদ্ধ বাস করতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবী, শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ি প্রভৃতি ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পাক সেনার প্রথম আক্রমণে নিহত, আহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকার বৌদ্ধ বিহার লুন্ঠিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৌদ্ধদের অনেকের বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল। অনেকে পুরুষানুক্রমে শহরবাসী। তাঁদের বাড়ি-ঘর, দোকান-কারখানা লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। চট্টগ্রামের অনাথবাজার বৌদ্ধ বিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, একজন প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু বোমার আঘাতে আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী চাঁনগাঁও গ্রাম সুপ্রাচীন বৌদ্ধগ্রাম। এতে অনেক বৌদ্ধদের বাড়ি দুইটি বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে, অনেকে নিহত হয়েছেন। ঐ গ্রাম জনশূন্য শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পÐিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রাম পাক সেনাদের আক্রমণে বিপন্ন হয়েছে, বাড়ী ঘর লুণ্ঠিত ও এখানকার বিহারটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গোলার আঘাতে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। অবশিষ্টেরা পলাতক। এর দুই মাইল দূর মিরথীন গ্রামেও একই অবস্থা। মির্জাপুর এক বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধগ্রাম। একদিন অবাঙালি একদল লোক তথাকার হিন্দুদের বাড়ী ঘর লুট করে বৌদ্ধদের বাড়ীঘর লুট করতে থাকে। তারা পুরাতন শান্তিধাম বিহারের শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। তরুণগণ প্রবল বাধা দিলে দুবৃত্তরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে তারা হাটহাজারী হতে পাক সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করে। সৈন্যরা বিহারের একটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় একজন প্রৌঢ় তথায় এসে তাদেরকে অনুরোধ করেন যে, তাঁরা পাকিস্তানের অনুগত প্রজা, তাঁদের উপর এই অত্যাচার কেন? বার্মার প্রধানমন্ত্রী উ. নূর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের এক বাঁধানো ছবি প্রদর্শন করেন। ইহাতে সৈন্যরা সন্তুষ্ট হন এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার না করার জন্য অবাঙালিদের নির্দেশ দেন। তখন হতে বৌদ্ধদের নিরাতঙ্কে থাকার আশ্বাস দিয়ে যান কিন্তু তার চার দিন পরে একদিন হঠাৎ সৈন্যসহ তারা গ্রামে লুঠতরাজ রাউজান থানার গহিরা গ্রামের লুম্বিনী কানন বিহার পাক বোমায় ধ্বংস হয়েছে। রাঙ্গামাটি রোডের দুই পার্শ্বে বৌদ্ধদের বহু বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। কয়েকজন লোক মেশিন গানের গোলায় আহত ও নিহত হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী বরজ্ঞান বিহার আক্রান্ত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তিভগ্ন ও ভিক্ষুর উপর আঘাত করেছে, ভিক্ষু ও গৃহীগণ গ্রাম ত্যাগ করেছেন। এই সুযোগে মুসলিমলীগপন্থীরা বৌদ্ধদের গৃহপালিত পশুপাক্ষী ধান চাউল তৈজস পত্র লুঠ করেছেন, অনেক গৃহ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বিনাজুরী বিশিষ্ট বৌদ্ধ গ্রাম। নিঃস্ব হিন্দুদেরকে আশ্রয় দেওয়ায় তারা মুসলিমলীগপন্থীদের বিদ্বেষভাজন হন। তথাকার বিহার ও গৃহ আক্রান্ত হয়। রাউজানের আবুরখীলেরও একই অবস্থা।
হোয়ারাপাড়া সুদর্শন বিহার লুণ্ঠিত বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়। বুদ্ধের পুতাস্থি অপহৃত হয়েছে। মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের পার্শ্বে কলেজে পাক সেনারা ঘাটি করেছে। গ্রামবাসী নির্যাতিত সতত সন্ত্রস্ত। একজন শিক্ষিত তরুণ ভিক্ষু পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। অনেক শিক্ষিত তরুণ ও বুদ্ধিজীবী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি, ইছামতি ও নজরের টিলার অনেক ঘর লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। লোকজন পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। বোয়ালখালি থানার শাকপুরা গ্রামে দুইজন শিক্ষিত বৌদ্ধকে বিহারের বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে হত্যা করা হয়। লোকের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পটিয়া, সাতকানিয়া থানার বহু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত লোক হতাহত ও নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রামু ও উখিয়া পালং অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ নিহত, গ্রাম লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। প্রায় বিশ হাজার বাঙালি বৌদ্ধ আরাকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তথায় মানবোচিত সৌজন্য অভাবে কিছু সংখ্যক ফিরে আসতে বাধ্য হন, কিন্তু স্থানীয় মুসলিম লীগের অত্যাচারে আবার তারা বাস্তুচ্যুত হন।
পÐিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পার্শ্বে সীতাকুÐ, বারবকুÐ, কাঠগড় ও পান্থশালা গ্রাম আক্রান্ত ও ভস্মীভূত হয়। গ্রাম ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যান। মিরেরশ্বরাই থানার জোরারগঞ্জ ধ্বংস হয়। এখানে নারী নির্যাতনে অসম্মত বালুচ সৈন্যের সাথে পাঞ্জাবিদের সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার ১৮/২০ টি গ্রাম বিহারসহ আক্রান্ত হয়েছে। বহুলোক হতাহত, ভিক্ষুরা নির্যাতিত। অবশিষ্ট সহস্র লোক কোন প্রকারে প্রাণ নিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ঐ দুই জেলা একেবারে বৌদ্ধশূন্য হয়েছে। বরিশালে আদিবাসী রাখাইন বৌদ্ধদের উপর ভীষণ অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এর শতকরা ৯৭ ভাগ বৌদ্ধ ছিল। ইহার তিন পার্বত্য জেলায় তিনজন বৌদ্ধ রাজা রাজত্ব করেন। উত্তরে রামগড়ের মানরাজা পাকসেনার আক্রমণে ৬/৭ সহস্র উপজাতীয় প্রজাসহ ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়েছেন। তাঁর রাজধানী মানিকছড়ি পাক সৈন্য অধিকার করেছেন। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ চাকমা রাজা
লেখকঃ
ড. জগন্নাথ বডুয়া
সহকারী অধ্যাপক, পালি বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ।
তথ্যসুত্রঃ দি বুড্ডিস্ট টাইমস
by admin | May 16, 2020 | blog
বড়ুয়া’দের উৎপত্তি ও ইতিহাস
লিখেছেনঃ
বিপ্লব বড়ুয়া (M.S.S)
শিক্ষকঃ রেজু বরইতলী উচ্চ বিদ্যালয়।
“বড়ুয়া” বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার একটি সুপরিচিত নাম। এদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ বৌদ্ধরাই ‘বড়ুয়া’ নামে অভিহিত। ইতিহাস সূত্রে এটা সুনির্দিষ্টরূপে প্রমাণিত যে, বাঙ্গালী বড়ুয়া বৌদ্ধরা এদেশের আদি বাসিন্দা। এই বড়ুয়া বৌদ্ধরা ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বায় বর্তমানে বিদ্যমান থাকলেও তাদের রয়েছে অতি সমৃদ্ধ গৌরবনীয় ইতিহাস ও প্রসিদ্ধ পরিচয়।প্রথমে ‘বড়ুয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ জানার চেষ্টা করি- “বড়– ধাতুর সাথে ‘উয়া’ প্রত্যয় যোগে ‘বড়ুয়া’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে, অর্থাৎ বড়+উয়া=বড়ুয়া। বিশ্ব কোষ অভিধানে বড়ুয়া সম্বন্ধে লিখিত আছে- ‘একটি আখ্যায়িকা হতে জানা যায় বড়ুয়াগণ একটি প্রতিভাবান বৌদ্ধ রাজবংশের বংশধর’। সংস্কৃত ভাষায় ‘বটুক’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে বড়ুয়া বা শ্রেষ্ঠ”।
‘বড়ুয়া’ শব্দটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিকেই বোঝায়। মগধ বা বিহার হতে আগত লোকেরা চট্টগ্রামে বর্তমানে ‘বড়ুয়া’ নামে পরিচিত।বাংলা একাডেমীর অভিধানে ‘বড়ুয়া’র অর্থ দেখানো হয়েছে -(১) পদস্থ বা সম্মানিত ব্যক্তি; ধনী।(২) চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের ও অহমিয়া হিন্দুদের পদবি; আসামের কোনো কোনো মুসলমানের পদবি (সংস্কৃত উৎস নির্দেশ করা হয়েছে- বড্র >বড় +উয়া (বড় ঘর অর্থে)। “জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস কৃত অভিধানে এর অর্থ লিখা হয়েছে- ‘বড়ুয়া’= (বোড়–আ) বি বটু, ব্রাহ্মণ- কুমার, যুবক, ব্রাহ্মণ”।‘শব্দবোধ অভিধান’বলে- “বড়ুয়া’=(১) আসাম প্রদেশবাসী ব্রাহ্মণদের উপাধি বিশেষ, দেশজ।(২) মহান,অর্থশালী”আসাম প্রদেশে বৈদ্য বড়ুয়া, কায়স্থবড়ুয়ারূপে বিভিন্ন বড়ুয়ার সন্ধান পাওয়া যায়।
’চন্দ্রকান্ত অভিধান’ এ আছে- “বড়ুয়া”= (অং-বর=প্রধান) বি, অহোম রাজার দিনত কোন এক খেলর প্রধান বিষয়া; এই বিলাক বিষয়ার প্রধান কাম আছিল শোধশোধা আরু দেশর শান্তিরক্ষা করা”। গৌহাটির বড়ুয়ারা সিংহ রাজার বংশধর। ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস ‘রাজমালা’তে বড়ুয়া জাতির উল্লেখ আছে। ‘সেকালে পাবর্ত্য প্রধাণগণ তাঁহাদের অধীনস্থ প্রজাগণের নায়করূপ নির্বাচিত হইতেন এবং তাঁহাদিগকে সর্দার, হাজারী ও বড়ুয়া উপাধিতে ভূষিত করিতেন।“বিজয়মাণিক্য রাজারজমিদার আমি,সে রাজার ‘বড়ুয়া’হৈয়া রাজা হৈলা তুমি।” (রাজমালা, পৃ: ১২০)”
এমনকি আরাকান ক্রোণোলজিতেও লেখা আছে যে বাংলাদেশী বৌদ্ধরা আর্যভারত তথা মজ্ঝিমাদেশ বা মধ্যপ্রদেশ থেকে এসেছে।
”Barua” is the last name of a distinct Bengali – speaking ethnic religious minority clan representing the plain area Buddhist community in Bangladesh. They mainly live in the Chittagong region. Many moved to Kolkata, India after partition of India in 1947; many also moved to England in the 1950s and 1960s. The plain Buddhists of Bangladesh known as the Burua-Buddhist are the ancient peoples of Bangladesh who have lived here for five thousand years according to Arakanese chronology. They insist that they came from the Aryavarta or the country of the Aryans which is practically identical to the country later known as the Majjhimadesh or Madhyadesh in Pali literature.Bengali speaking Barua people of Chittagong are all Buddhist by religion, unlike Hindu Barua of Assam who are generally Brahmins or Ahom or may belong to any other general caste in India. The word ‘Barua’ came from ‘Baru’ meaning great and ‘Arya ‘ meaning Noble ones.
“বড়ুয়া’ শব্দের উদ্ভব সম্পর্কে দু’টি মত প্রচলিত আছে। একটি হচ্ছে বড় আর্য (বর অরিয়) থেকে ‘বউড়গ্যা’ বা বড়ুয়া শব্দটি এসেছে। এর সমর্থনে বলা যায়, বৌদ্ধ সমাজে পুত্রবধুগণ শ্বশুড়কে বউড়গ্যা এবং শাশুড়ীকে আযোয়্যাঁ সম্বোধন করত। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় এখানো এ শব্দ দুটির ব্যবহার দৃষ্ট হয়। বউড়গ্যা বড় আর্য এবং আযোয়্যাঁ- আর্যমা শব্দের বিকৃত ব্যবহারিক শব্দ। এখানো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বড়ুয়াকে বউড়গ্যা বলা হয়। যেমন – বউড়গ্যা পাড়া, বউড়গ্যার টেক ইত্যাদি। অতএব, বড় আর্য (বর অরিয়)>বউড়গ্যা> বড়ুয়া এভাবে উদ্ভব হওয়া সম্ভব। আবার সেকালের পরিবার ও সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের বড়িয়া সম্বোধন করা হত বলে জানা যায়। এই বড়িয়া শব্দটি কালক্রমে বড়ুয়া হয়েছে বলে কারো কারো ধারণা।
“বৌদ্ধদের বিশ্বাস বড়ুয়ারা শ্রেষ্ঠ জাতি, তাদের মতে ‘বড়ুয়া’ শব্দটি বড় আর্য (বড়+অরিয়) থেকে এসেছে, এর অর্থ বড় বা উৎকৃষ্ট। ‘বড়ুয়া’ উপাধির অর্থ হল বড় আর্য এবং বড় সৈন্যধ্যক্ষ। “বড়ুয়া’ শব্দের উৎপত্তি সম্বন্ধে কোন কোন পণ্ডিত বলেন- ভগবান বুদ্ধ মানব সমাজের ভব-দুঃখ মুক্তির উদ্দেশ্যে যে সত্যপথ আবিস্কার করেছিলেন, তা পালি ভাষায় ‘অরিয় সচ্চং’ (আর্যসত্য) নামে অভিহিত। যারা বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম তথা আর্যসত্য গ্রহণ করতেন, তারাই বড় আর্য (বুদ্ধের উপাসক বা শিষ্য) নামে অভিহিত হতেন। এই ‘বড় আর্য (বড়+অরিয়) হতে ‘বড়ুয়া’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, ইহার সমর্থনও যুক্তিপূর্ণ।
“ভারতে প্রকাশ্যে বৌদ্ধ নির্যাতনের ফলে টিকে থাকা অসম্ভব হলে বৃজি বা বজ্জিাকাপুত্ত উপজাতির এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র সাতশত অনুচরসহ মগধ (পাটনা) হতে পালায়ন করে পঁগার পথে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও আধুনিক নোয়াখালীতে এসে উপস্থিত হন। (চট্টগ্রামের ইতিহাস, পুরানা আমল, পৃ.৩৯)। মগধের বৈশালীর বৃজিগণ চট্টগ্রাম আগমন করায় ‘বজ্জি’ হতে ‘বড়ুয়া’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। ‘বড়-য়া’ শব্দটি বৃজি বা বজ্জি কথারই রূপান্তর বলে অনুমান করা হয়েছে। ড. বেনীমাধব বড়ুয়াও বজ্জি হতে ‘বড়ুয়া’ উপাধি এসেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়াও এই মতে বিশ্বাসী।” মগধের বৃজি জাতিরা রাজবংশের বংশধর সেহেতু শ্রেষ্ঠতে ‘বজ্জি’ থেকে অপভ্রংশে ‘বড়ুয়া’ শব্দ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
“বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে জানা যায়, ভগবানের পরিনির্বাণের পর বৈশালীর লিচ্ছবীগণ কুশীনারার মল্লগণের নিকট দূত প্রেরণ করে জানালেন- ভগবান ক্ষত্রিয় আমারও ক্ষত্রিয়, আমরাও ভগবানের পবিত্র অস্থির অংশ পাওয়ার যোগ্য। বৈশালীর লিচ্ছবীর মত বৃজিরাও ছিল উন্নত জাতি এবং সংস্কৃতিবান- কাজেই বৃজিরাও ক্ষত্রিয় ছিল। বজ্জি ও লিচ্ছবী নাম কখনও কখনও একই অর্থে ব্যবহৃত হত। বজ্জি রাজ্যের মধ্যেই লিচ্ছবীরা অর্ন্তভূক্ত ছিল। বি.সি লাহাও বলেছেনে, বজ্জি ও লিচ্ছবী সমার্থক। লিচ্ছবীদের সম্পর্কে সমস্ত ভারতীয় ঐতিহ্য একমত যে লিচ্ছবীরা ক্ষত্রিয় ছিলেন। বেশী দিনের কথা নয়, বড়ুয়া বধুরা শাশ্বুড়ীকে ‘হাযমা’ বলে সম্বোধন করত। এখনও কোথাও কোথাও এর প্রচলন দেখা যায়। ‘হাযমা’ পালি শব্দ ‘অরিযমা’র অপভ্রংশ, শুদ্ধ বাংলা আর্যমা।স্বামী আর্যপুত্র, শ্বশুর আর্যপিতা, শাশুড়ি আর্যমাতা, এগুলি উন্নত সমাজেরই ভাষা। এতএব, বড়ুয়ার যে উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী তা সহজেই অনুমেয়’।
’বড়ুয়া’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব সম্পর্কে একটি প্রচলিত জনশ্রুতি রয়েছে। তা হল, ত্রয়োদশ শতকে তুর্কী আক্রমণ শুরু হলে মগধের বৃজি গোত্রের বৌদ্ধগণ পলায়ন পূর্বক আত্মরক্ষার জন্য পূর্বাঞ্চলের স্বর্ধমীদের নিকট আশ্রয় নিয়েছিল। তারা ক্রমশ দক্ষিণ পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে হতে চট্টগ্রাম বিভাগে উপনীত হয়। চট্টগ্রাম তখন আরাকানের বৌদ্ধ রাজার অধীন ছিল। এখানে আর ধর্মলোপের ভয় ছিল না। তারা ইতিপূর্বে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে মগধ থেকে আগত চন্দ্রসূর্যের সঙ্গীদের উত্তর পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হয়। পরবর্তীতে তারা ‘বড়ুয়া’ বৌদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করে। নতুন চন্দ্র বড়ুয়াও প্রায় একই মতে বিশ্বাসী। তাঁর মতে- দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভারতে বৌদ্ধদের উপর উপর্যোপরি মর্মান্তিক নির্যাতন ও বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান গুলো সমূলে ধ্বংস করার ফলে সেখানে বৌদ্ধগণ ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ তিব্বত ও নেপালে চলে যায়।
”বড়ুয়া” উপাধি কবে কখন প্রচলিত হয় তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। একটা ধারণা আছে ত্রয়োদশ শতকে মগধের বৈশালী থেকে আগত চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণকারী বজ্জিবংশীয় লোকেরা নিজেদের নামে শেষে সম্ভ্রান্ত সূচক বজ্জি পদবি ব্যবহার করত। আর স্থানীয় বৌদ্ধরা আদিকাল থেকে নিজেদের গোত্রীয় পদবি ব্যবহার করত। কালক্রমে বৌদ্ধরা সংখ্যায় সংকোচিত হতে থাকলে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য স্থানীয় বৌদ্ধরাও বজ্জিদের অনুকরণে বজ্জি পদবী ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে বজ্জি শব্দ থেকে বড়ুয়া শব্দের উদ্ভব হয়। তবে পঞ্চদশ শতকের শেষ অথবা ষোড়শ শতকের প্রারম্ভ থেকে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা বড়ুয়া পদবি ব্যবহার শুরু করে বলে অনুমিত হয়। এ সময়ে অন্যান্য পদবীরও ব্যবহার ছিল; যেমন-হাজারী, সিং, বিহারী, রাজবংশী, পাল, সিকদার ইত্যাদি। ড. প্রণব কুমার বড়ুয়ার মতে, ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে ঐ সকল পদবী বিলুপ্ত হয়ে একমাত্র বড়ুয়া পদবী প্রচলিত থাকে। বর্তমানে বাঙ্গালী বৌদ্ধদের সম্প্রদায়গত উপাধি হল বড়ুয়া, এরাই বাংলাদেশের বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়। ষোড়শ শতকের প্রথম পাদের কবি চন্ডীদাসের কবিতার একটি পদে বড়ুয়া শব্দের ব্যবহার দৃষ্ট হয়। তাঁর কবিতার পদটি নিম্নরূপঃ”একে তুমি কুলনারী,কুলে আছে তোমার বৈরী,আর তাহে বড়ুয়ার বধু।”
”বাংলাদেশের বড়ুয়া বৌদ্ধরা মূলত দক্ষিণ পূর্ব বাংলার ষষ্ঠ হতে একাদশ শতাব্দীর প্রাচীন সমতটের সিংহ বংশ, বর্ম বংশ, খড়গ বংশ, ভদ্র বংশ, দেব বংশ, চন্দ্র বংশ, উত্তর বঙ্গের প্রাচীন বাংলার সপ্তম শতাব্দীর বরেন্দ্র ভূমির পাল বংশীয়, চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমান্ত রাজা মনিভদ্র, রাকাই, জয়চন্দ্র ও মুকুট রায়ের পরবর্তী বংশধর। উপরোক্ত বৌদ্ধ রাজন্যবর্গের পরবর্তী বংশধরই বড়ুয়া এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ– প্রাচীন সমতট, বর্তমান কুমিল্লার ময়নামতী, শালবন বিহার, রাজ বিহার (ইট খোলা বিহার), দেব পর্বত, রাজশাহীর পাহাড় পুরের রাজা ধর্মপাল কর্তৃক নির্মিত সোমপুর বিহার, বগুড়ার গোফুল গ্রামের বাসু বিহার, দিনাজপুরের গঙ্গা ও করতোয়া নদীর সঙ্গমস্থলে রামাবতী নগরে রাজা রাম পাল কর্তৃক নির্মিত ‘জগদ্দল বিহার’, ময়নামতী পাহাড়ের দক্ষিণে দেব রাজ কর্তৃক নির্মিত আনন্দ বিহার, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পতি বিহার, চট্টগ্রাম শহরের দেব রাজাদের দেব পাহাড়, পটিয়ার চক্রশালা ইত্যাদি। এসব বিহারের অনুকুল্যেই পুরুষ পরম্পরা বাঙ্গালী বড়ুয়ারা বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা ও অনুশীলন করে আসছেন। যাদের ধর্মচর্চায় বৌদ্ধ বিশ্বের অন্যতম নিকায় থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম নিখূতভাবে বিদ্যমান।
বড়ুয়ারা শত শত বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে (মানছি শুধু চট্টগ্রাম অংশ আরাকান রাজার অধীনে চট্টগ্রামে ছিলো তাও মাত্র ১৪৫৯- ১৬৬৬ পর্যন্ত দুই শত সাত বছরের জন্য, ইংরেজরাও আমাদের প্রায় ২০০ বছর শাসন করেছে। তবে আমরা কি ইংরেজ?)। শত শত বছর ধরে বাংলাদেশে (মাত্র ২০৭ বছর বার্মার অধীনে এবং ১৯০ বছর ইংরেজদের অধীনে) বসবাস করে আসা জাতটার আদি পিতা ভারতের হলেও এখন অবশ্যই তারা বাঙালী। আমরা বাঙালী বড়ুয়া বৌদ্ধ জাতি। ইতিহাসকে কখনোই মিথ্যা বানানো যায় না।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের ‘বড়ুয়া’ জনগোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী, স্বতন্ত্র জাতি, এদেশের ভূমিজ ও দেশজ সন্তান। দীর্ঘকালে ঘাত-প্রতিঘাতের পর রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বড়ুয়াদের আচার- অনুষ্ঠানে, কৃষ্টিতে ও সামাজিক জীবনে হিন্দু- মুসলমান প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও তাদের নিজস্ব যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে এগুলি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। বড়ুয়ারা এখন বাংলাদেশের এক উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়। বাংলাদেশের বড়ুয়ারা আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বড়ুয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, দিল্লী ও মুম্বাইতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে, বার্মাতেও প্রচুর বড়ুয়া রয়েছে। এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বহু শহরেও বহু বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায় অনেক অগ্রসর এবং বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সামগ্রিক অগ্রগতিতে বড়ুয়া বৌদ্ধদের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত ও ক্রীড়ায় বড়ুয়াদের কৃতিত্ব সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গর্ব। বড়ুয়াদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হল সরলতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বাস, একতা, আতিথেয়তা ও দানশীলতা। এরা সাধারণত সমবেত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং দুর্যোগ ও বিপদের সময় ঐক্যবদ্ধ থাকে। বড়ুয়ারা আচরণে, কথাবার্তায় অত্যন্ত বিনয়ী এবং সংযমী। এদিক থেকে তারা সার্থক বৌদ্ধ। তারা অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, একে অপরের যে কোন সাহায্যে এগিয়ে আসে।
বাংলাদেশের বড়ুয়া সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা এবং যুবক-যুবতীরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও নিজ ধর্ম, কৃষ্টি ও এতিহ্যের প্রতি কখনো আস্থা হারায়নি এটা অতীব গৌরবনীয় বিষয়। বড়ুয়ারা আজ উন্নত সম্প্রদায়, প্রকৃত বৌদ্ধাদর্শে প্রতিষ্ঠিত, সুমহান ঐতিহ্যের অধিকারী এবং উন্নতির পথে অগ্রসরমান। বৌদ্ধ পুরাকীর্তি, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ এ দেশের ঐতিহ্য ও গর্ব । ইহা প্রাচীন বাংলার নিদর্শন। আর এসব প্রাচীন পুরাকীর্তির পুরুষ পরম্পরা উত্তরসূরী হচ্ছে বাঙ্গালী বড়ুয়া বৌদ্ধ, যা এতক্ষণের আংশিক আলোচনায় আমরা নিঃসন্দেহে অবগত হয়েছি। তবে বর্তমানে কালের প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই বড়ুয়া জাতি, তাদের পূর্বের ঐতিহ্য কতটুকু ধারণ করতে পাচ্ছে – তা বস্তুত প্রশ্নের সম্মুখীন। ইতিহাস জাতির সম্পদ। যে জাতির ইতিহাস নেই, সেই জাতির ঐহিত্য নেই। যে জাতি ইতিহাস জানে না সে জাতি আত্মভোলা জাতি। তাই কালের প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধদের ইতিহাস সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান থাকা অতীব জরুরী।
পরিশেষে, এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে সকলের প্রতি বিশেষকরে আধুনিকতায় শিক্ষিত তরুণ বৌদ্ধ ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সেই ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর সজাগদৃষ্টি ও আত্ম সচেতনতা সৃষ্টির উদাত্ত আহবান জানাই।
তথ্য সংগ্রহ
বড়ুয়া বৌদ্ধদের আদিকথা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট,বোধিমিত্র বড়ুয়া, ২০১০; পৃ:০৬২। বড়ুয়া জাতি, উমেশচন্দ্র মুৎসুদ্দি, ১৯৫৯; পৃ: ০৫৩। বাংলা একাডেমী অভিধান, পৃ:৮২৪৪। সদ্ধর্মের পুনরুত্থান, পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির, ১৯৬৪; পৃ: ১৫-১৬৫। বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, ড.দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া, ২০০৭; পৃ: ১১৯৬। বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া, পৃ :১৪৫ ও সদ্ধর্ম রত্নাকর, পণ্ডিত ধর্মতিলক স্থবির, পৃ:৪৩৯৭। চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জাতির ইতিহাস, নতুন চন্দ্র বড়ুয়া, ১৯৮৬; পৃ: ৩৫৮। বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া, প্রাগুক্ত, পৃ : ১৪৫৯। বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ : ১১৭১০। বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ : ১২০।১১। বাংলাদেশের বড়ুয়া জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সুনীতি রঞ্জন বড়ুয়া, ১৯৯৬; পৃ: ১৮-১৯ ।১২। বাংলাপিডিয়া http://bn.banglapedia.org/index.php১৩। এবং বিশেষ কৃতজ্ঞতা পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের কাছে।
by admin | May 12, 2020 | blog
নিন্দা ও কুৎসা সর্ম্পকে বৌদ্ধ ধ্যান-ধারণা (The Buddhist Concept On animadversion and calumny)
———–ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়
মানুষ স্বভাবত অষ্ট লোকধর্মের অধীন।বৌদ্ধধর্মে অষ্টলোক ধর্ম বলতে লাভ-অলাভ, যশ-অযশ, সুখ- দু:খ, নিন্দা- প্রশংসা।যেহেতু এ অষ্ট লোকধর্মের অধীন মানব জীবন বুদ্ধ তাতে চিত্তকে কম্পি না করে অপ্রমাদের সাথে জীবন অতিবাহিত করতে বলেছেন।অনেক সময় মানুষ অতি প্রশংসায় যেমন খেল হারিয়ে ফেলে আবার নিন্দা, কুৎসা শুনেও ধৈর্য্য হারিয়ে জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। বুদ্ধ ত্রিপিটকের অনেক জায়গায় এ বিষয়ে মানুষকে সৎ ধারণা দিয়েছেন।অনেক মহাপুরুষেরাও এ বিষয়টি নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একবার জানানো হয়েছিল, একটা লোক তাঁর খুব নিন্দা করছে, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছে। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন‘লোকটার কখনো কোন উপকার করেছি বলে তেমনে হচ্ছে না।’ অর্থ্যাৎ কারো উপকার করলে তার কাছ থেকে নিন্দা ও কুৎসা শোনাই হচ্ছে যিনি উপকার করেন তার বিধিলিপি।
পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দেওয়ার লোক নেই! সামনে দাঁড়িয়ে পথ দেখানোর লোক নেই! কিন্তু পিছনে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করার অনেক লোক আছে।-এ কথা বলেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি -এ.পি.জে আব্দুল কালাম।
‘নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়’ -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(গোরা)।মহামানবেরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়েই উক্ত বাণী গুলো লিপিবদ্ধ করেছেন।ভগবান বুদ্ধও মুক্ত পুরুষ হতে এর থেকে রক্ষা পায়নি।
এক দিন বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীর জেতবনে ধর্মোপদেশ দিচ্ছিলেন চিঞ্চা নামে অপরূপরূপবতী এক নারী সেখানে এসে সোজা বুদ্ধের কাছে গিয়ে বললÑআপনার দ্বারাই আমি গর্ভবতী হয়েছি, এবার আপনি আমার ভার নিন। চিঞ্চাকে সেখানে পাঠিয়েছিল বুদ্ধ বিরোধী কিছু সন্ন্যাসী, উদ্দেশ্য বুদ্ধের নামে মিথ্যা কুৎসা আর অপবাদের প্রচার। চিঞ্চার আকস্মিক আবির্ভাব আর তার চাঞ্চল্যকর উক্তিতে সভাস্থ সবাই যখন হতবাক, দেবরাজ ইন্দ্র তখন তাঁর চারজন অনুচর নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। অনুচরদের একজন ইন্দ্রের আদেমে ইদুর হয়ে চিঞ্চার বস্ত্রের অভ্যন্তরে ঢুকে একটা রজ্জু বন্ধন কেটে দিতেই তার নকল গর্ভ খসে পড়ল, মুহূর্তে তার ঐ হীন চাতুরী প্রকাশ হয়ে পড়তেই ক্রুদ্ধ জনসাধারণ তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর যথোচিত প্রহার করে সেখান থেকে বিদায় করল তাকে। চিঞ্চা কোন রকম সভা প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসতেই ধরিত্রী মুখব্যাদান করে তাকে অবিচী নরকে গ্রাস করল। ছলনাময়ী নারীর এই ভীষণ পরিণতি সম্বন্ধে ভিক্ষুরা যখন আলোচনা করছিলেন, বুদ্ধ তাদের বললেন
“একং ধম্মং অতীতস্স মুসাবাস্সি জন্তনো
বিতিন্ন পরলোকস্স নত্থি পাপং অকারিয়ং। ধম্মপদ-১৭৬
অর্থ্যাৎ-ধর্ম লঙনকারী, মিথ্যাবাদী এবং পরলোকে আস্থাহীন লোকের অকরণীয় পাপ নেই।
সত্যের থেকে বড় আশ্রয় আর কিছু নেই মানুষের। তাকে ছেড়ে যে মিথ্যাকে অবলম্বন করে সে স্বেচ্ছায় দুঃখকে বরণ করে নেয়। কেননা মিথ্যা থেকে সহ¯্র পাপের উৎপত্তি, তাই মিথ্যাশ্রয়ী ক্রমেই অধঃপতনের অতলে তলায়/ আর এমন পাপ কাজ নেই যা সে করতে পারেনা।বুদ্ধবাণীতে দেখা যায়—-
‘পোরাণমেতং অতুল নেতং অজ্জতনামিব।
নিন্দন্তি তুণহিমাসীণং নিন্দন্তি বহুভাণিনং
মিতভাণিনম্পি নিন্দন্তি নত্থি লোকে অনিন্দিতো ॥
ন চাহু ন চ ভবিস্সতি ন চেতরহি বিজ্জতি
একন্তং নিন্দিতো পোসো একন্তং বা পসংসিতো ॥’ধর্মপদ/২২৭
“হে অতুল, ইহা চিরকালেরই কথা একান্ত নিন্দিত কিংবা একান্ত প্রশংসিত ব্যক্তি অতীতে ছিল না, ভবিষ্যতে হবেনা, এখনও বিদ্যামান নেই।”
নিন্দুকের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা কোনভাবে সম্ভব নয়।অতিভাষী,মিতভাষী, মৌনি প্রক্যেকের কিছু না কিছু দোষ সে খুঁজে বের করবে।হেন ব্যক্তি নেই যে তার সমালোচনার অতীত।তবে নিন্দার হাত থেকেও যেমন মানুষের নিষ্কৃতি নেই তেমনি এমনও কেউ নেই যে শুধু নিন্দাই লাভ করেছে।নিছক প্রশংসার পাত্র যে কেউ নেই তা তো বলাই বাহুল্য।এই যখন জগতের রীতি তখন লোকের নিন্দা -প্রশংসার প্রতি অযথা মূল্য আরোপ করা অবশ্যই অর্থহীন। সত্যের বা ধর্মের পথ লোকের নিন্দা-প্রশংসার দ্বারা নির্ধারিত হয়না।একমাত্র জ্ঞানীরাই তার সন্ধান জানেন।তাই তারা সব কিছু দেখে সমস্ত দিক বিবেচনা করে যাঁকে প্রশংসার যোগ্য মনে করেন তিনি কষ্টিপাথরে যাচাই করা সোনার মতই খাঁটি।সত্যে, শীলে, জ্ঞানে,ধর্মে প্রতিষ্ঠিত সেই পুরুষোত্তম বাস্তবিক সর্বজনীন প্রশংসার যোগ্য।
বুদ্ধ বলেছেনÑ‘অন্যের কৃত বা অকৃত ত্রুটি বিচ্যুতির ও কার্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত নয়। যে সর্বদা অন্যের ছিদ্রান্বেষণ বা ভৎসনা করে তার দোষ সমূহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে আসবক্ষয় হতে দূরবর্তী হয়। অপরের দোষ সহজেই চোখে পড়ে, নিজের দোষ দেখা কঠিন। বাতাসে শস্যের ভূষি উড়িয়ে দেওয়ার মত করে মানুষ পরের দোষ গুলো প্রকাশ করে। কিন্তু ধূর্ত ব্যাধের আত্ম গোপনের ন্যায় নিজের দোষ গোপন করে।’
বুদ্ধ বলেছেন- লোকে নীরবে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে নিন্দা করে, তেমনি বহু ভাষীকে এবং মিতভাষীকেও নিন্দা করে। তাই পৃথিবীতে কোনো অনিন্দনীয় ব্যক্তি নেই। একান্ত নিন্দিত কিংবা একান্ত প্রশংসিত ব্যক্তি নেই। একান্ত নিন্দিত কিংবা একান্ত প্রশংসিত ব্যক্তি অতীতেও ছিলনা, ভবিষ্যতেও হবেনা, এখনও বিদ্যমান নেই।
যার দ্বারা স্বর্গ মোক্ষের অন্তরায় হয়, তাকে অন্তারায়িক কর্ম বলে। তা আবার কর্ম, ক্লেশ, বিপাক, অপবাদ ও আদেশ অতিক্রম ভেদে পাঁচপ্রকার। পঞ্চ অন্তারায়িক কর্ম সমূহকে কর্ম-অন্তারায়িক বলে। ভিক্ষুণী দূষন কর্মও সেরূপ কর্ম-অন্তারায়িক মধ্যে গণ্য। তদ্বারা মাত্র মোক্ষ লাভের অন্তরায় হয়। কিন্তু স্বর্গ সম্পদ লাভের অন্তরায় ঘটেনা। নিয়ত মিথ্যা দৃষ্টি, ক্লেশ অন্তরায়িকা অর্থ্যাৎ ক্লেশ ধ্বংসের অন্তরায় করে। নপুংসক ও তির্যক যোনিতে জন্মগ্রহণ বিপাক অন্তরায়।
যারা আর্য অপবাদ করে, নানা রকম কুৎসারটায় তা আর্য অপবাদ বলে কথিত। আর্য অপবাদ করলে বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ ও বুদ্ধের শ্রাবকদের প্রতি এমনকি গৃহী আর্য শ্রাবকের পর্যন্ত অনিষ্ট কামী হয়ে অন্তিম বস্তু(পারাজিকা আপত্তি অথবা সদগুণ ক্ষয় কর কোন বিষয়ের দ্বারা উপবাদ, আক্রোশ ও নিন্দাকারী বুঝায়। এদের শ্রমণধর্ম নেই, এরা অশ্রমণ ইত্যাদি অপবাদ করলে তাকে‘অন্তিমবস্তু’ দ্বারা উপবাদক বলে। এদের জ্ঞান নেই, মার্গ নেই, ফলও নেই অর্থ্যাৎ লাভ হবে না ইত্যাদি গুণ ক্ষয় কর অপবাদ বাক্যে আর্য পুদ্গলের অপবাদ করলে, জেনে করুক আর না জেনে করুক আর্য অপবাদের মধ্যে পরিগণিত হয়। এ অপবাদের কর্মও অতি গুরুতর আনন্তরিক কর্মের মতোÑ স্বর্গ মোক্ষ লাভের অন্তরায়কর। তাসচেতননা হলে কর্ম বিস্তৃতি হয়ে ফল প্রদান করে।
চিঞ্চা মানবিকা বুদ্ধ নিন্দা করে অবিচি নরকে পতিত হয়েছিলেন। কবিগুরু রবন্দ্রিনাথ ঠাকুর বলেছেন
‘মরে না মরে না কভু সত্য যাহা
শত শতাব্দীর বিস্মৃতির তলে;
নাহি করে উপেক্ষায় অপমানে
না হয় অস্থির আঘাতে না টলে’।
পুণ্যত্মা সমাজের দ্বারা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে বিদ্বেষ-বুদ্ধি এবং বৃথাগর্ব ও স্বার্থন্বেষী অহংকার তুষ্টির নিমিত্ত ঘৃণা দোষ সমূহ হতে ঝগড়া বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
বুদ্ধ বলেছেন -যদি কেউ মূর্খতাবশত আমার প্রতি অন্যায় করে, আমি প্রতিদানে অকাতরে তার উপর প্রীতি বর্ষণ করব, অমঙ্গলের প্রতিদানে আমি মঙ্গল বিতরণ করব, সাধুতার সৌরভ সর্বক্ষণ আমি অনুভব করব, অমঙ্গলের অনিষ্টকর বায়ু তাকে স্পর্শ করবে।
বুদ্ধ অমঙ্গলের প্রতিদানে মঙ্গল বিতরণ করেন শুনে এক নির্বোধ বুদ্ধের নিকট এসে বুদ্ধের নিন্দা করল। বুদ্ধ তার নির্বুদ্ধিতার করুণাবশত হয়ে নীরব রইলেন। নির্বোধ তার নিন্দাবাদ সমাপ্ত হলে বুদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করলেন বৎস, যদি কোনো ব্যক্তি উপহার দ্রব্য নিতে অস্বীকার করে তাহলে ঐ দ্রব্য কার হবে? সে উত্তরে বললেন তাহলে সেটা প্রদান কারীর হবে।
বুদ্ধ বললেন-বৎস, তুমি আমাকে দুর্বাক্য আমি নেব না, তুমি নিজের জন্য রেখে দাও। যাকি তোমার যাতনার কারণ হবে না? প্রতিধ্বনি যেরূপ শব্দের অনুগামি, ছায়া যেরূপ দ্রব্যের অনুগামি, সেরূপ যাতনাও দুষ্কৃতের অনুগমন করবেই।
নিন্দুক কোনো উত্তর করলো না। বুদ্ধ তথাপি আবার বললেন দুষ্টের পক্ষে সাধুকে ভৎসনা করা এবং উর্দ্ধে আকাশে নিবিষ্টা নিক্ষেপ করা একই প্রকার। নিষ্টীবন আকাশকে মলিন করেনা, উহা ফিরে এসে নিক্ষেপকারীকে অপবিত্র করে।
নিন্দুক এবং প্রতিকূল বায়ুতে অপরের প্রতি ধুলি নিক্ষেপকারী একই, ধুলি ফিরে এসে নিক্ষেপকারীর উপর পতিত হয়। ধার্মিকের কোন অনিষ্ট হয়না কিন্তু নিন্দুক যে অনিষ্ট করার কল্পনা করে উহা তার নিজের উপর পতিত হয়। নিন্দুক লজ্জিত হয়ে চলে গেল, সে পুনরায় বুদ্ধের শরণ নিলেন।যারা প্রব্রজিৎতের বিরুদ্ধাচরণ কিংবা নিন্দা অপবাদ দিয়ে থাকে তারা জন্মান্তরে অনেক দু:খ ভোগ করে থাকে।তাদের কিছুতেই সুখ শান্তি হয়েছে তার কোন নজির নেই।
বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী বলা যায়
যেমন করিবে কর্ম সেই রূপ ফল
পাবে সবে এ জগতে না হবে বিফল।
বেশীর ভাগই যে ছেলে-মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে অর্থ্যাৎ সদ্ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মের সাথে গেছে তাদের প্রেমের টানটাই বেশী পরিলক্ষিত হয়।কোন নিন্দা বা কুৎসার কারণে নয়।নিন্দা-কুৎসা কারা রটনা করে, যারা কারো প্রতিভার সাথে পেরে উঠতে পারেনা।সর্বশেষ নিন্দা-কুৎসা রটনা কারীর পরাজয় হয়।সত্য-ন্যায়ের জয় সব সময়। সাময়িক কষ্ট পায় হয়তো। মনকে শক্ত করে ন্যায় এর পথে থাকলে তাদের সাথে কেউ পেরে উঠে না।
জৈনিক কবি লেখেছিলেন—
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরে আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধ ুযারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মত থাকবে পাছে পাছে।
নিন্দুক সে বেঁচে থাকুক বিশ্ব হিতের তরে
আমার আশাপূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে।
*ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়: সম্পাদক ॥সৌগত, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন