অশাতমন্ত্র জাতক । ত্রিরত্ন ডট কম

অশাতমন্ত্র জাতক । ত্রিরত্ন ডট কম

অশাতমন্ত্র-জাতক (অশাত = অমঙ্গল)। এর শুরু হচ্ছে এইভাবে, “শাস্তা জেতবনে জনৈক উৎকন্ঠিত ভিক্ষুকে … বলিলেন,

পুরাকালে বারাণসীতে বোধিসত্ত্ব এক বিখ্যাত গুরু হিসাবে জন্মেছিলেন। এক ব্রাহ্মণসন্তান তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়ে বাড়ি ফিরে সংসারধর্ম শুরু করতে গেলে তার মা-বাবার মনে হয়, সংসার অনর্থের মূল, ছেলেকে সন্ন্যাস নেওয়াতে হবে। এবং তার মনে বৈরাগ্য জন্মাতে হবে স্ত্রীচরিত্রের দোষ দেখিয়ে। তখন তার মা তাকে বলে, ‘বাছা, তুমি অনেক বিদ্যা শিখলেও অশাতমন্ত্র নিশ্চয়ই শেখ নি। যাও, গুরুর কাছে ফিরে তা শিখে এস।’

বোধিসত্ত্ব শুনে বুঝলেন, অশাতমন্ত্র নামে বাস্তবে তো কোনো মন্ত্র নেই, নিশ্চয়ই এর মা তাকে স্ত্রীচরিত্রের দোষ শেখাতে চান। তা তখন তাঁর ১২০ বছর বয়সী বিধবা মা তাঁর কুটিরেই বাস করতেন, বৃদ্ধা জরাগ্রস্তা দৃষ্টিশক্তিহীনা মাকে তিনি নিজে হাতেই সেবাযত্ন করতেন। তখন শিষ্যকে তাঁর সেবার ভার দিলেন, আর বললেন, নিয়মিত তাঁকে সেবা করার সময় তাঁর রূপের প্রশংসা করবে। মা যা বলেন, শুনে এসে আমাকে বলবে।

“স্ত্রীজাতি এতই অসতী, হেয়া ও নীচাশয়া যে এত অধিকবয়স্কা বৃদ্ধাও কামভাবের বশবর্তী হইয়া” সেই তরুণের প্রতি ঢলে পড়লেন, এবং বললেন, যে আমিও তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছি, কিন্তু আমার ছেলে খুব কঠোর স্বভাবের, তাই তাকে আমার ভয় হয় – তুমি তাকে মেরে ফেল, তাহলেই আমাদের মিলন হবে। শিষ্য গুরুকে হত্যা করতে অস্বীকার করলে তিনি বললেন, তুমি ব্যবস্থা কর, আমি নিজে হাতেই তাকে বধ করব।

এরপর বোধিসত্ত্ব নিজের বিছানায় নিজের এক কাঠের মূর্তি শুইয়ে শিষ্যকে বললেন, সে বৃদ্ধাকে গিয়ে খবর দিল। বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতেই কুঠার হাতে গিয়ে তাতে আঘাত করলেন, কিন্তু কাঠের শব্দে বুঝতে পারলেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তখনই তাঁর মৃত্যু হল। এই ঘটনা দেখিয়ে বোধিসত্ত্ব শিষ্যকে ব্যাখ্যা করলেন, যে নারীজাতির অসতীত্বই অশাতমন্ত্র।

তথ্যসুত্রঃ মুক্ত মনা

বি.দ্রঃ সদ্ধর্ম প্রচারে আমাদের সাথে থাকুন । আপনার বৌদ্ধ ধর্মীয় লেখা প্রচার করতে যোগাযোগ করুন আমাদের হটলাইন নাম্বার এ । ধন্যবাদ ।

তক্ক জাতক । ত্রিরত্ন ডট কম

তক্ক জাতক । ত্রিরত্ন ডট কম

 তক্ক-জাতক এর মরাল হল, “স্ত্রীজাতি অকৃতজ্ঞ ও মিত্রদ্রোহী”। –

বারাণসীতে এক ব্যবসায়ীর এক বদমেজাজি মেয়ে ছিল, নাম দুষ্টকুমারী। সে তার দাসীদের খুব অত্যাচার করত। তাই একদিন গঙ্গায় নৌকা করে বেড়াবার সময় দারুণ ঝড় উঠলে দাসীরা তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ফিরে এসে বলে, কুমারী ডুবে গেছেন।

এদিকে বোধিসত্ত্ব নদীতীরে কুটির বানিয়ে তপস্যা করতেন, তিনি মেয়ের চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধার করে আনলেন। মেয়েটি তাঁকে দেখে ভাবল, “প্রণয়পাশে আবদ্ধ করিয়া এই তপস্বীর চরিত্রভ্রংশ ঘটাইতে হইবে।” তার প্রেম-ছলনায় ভুলে তিনি সত্যিই সাধনা ছেড়েছুড়ে তাকে বিয়ে করে এক গ্রামে গিয়ে বসত করলেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর অনুপস্থিতিতে গ্রামে ডাকাত পড়ল, ডাকাতসর্দার মেয়েটিকে লুঠ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করল। কুমারী ভাবল, আমি এখানে খুবই সুখে আছি, কিন্তু আমার আগের স্বামী আমায় খুঁজতে এখানে চলে এলে গণ্ডগোলের সম্ভাবনা। তাই তাঁকে এখানে আনিয়ে খুন করাতে হবে। সে একজনকে দিয়ে খবর পাঠাল, বোধিসত্ত্ব সেখানে এলে তাঁকে খাইয়েদাইয়ে লুকিয়ে রাখল, বলল আমরা রাত্রে পালাব। এদিকে সন্ধ্যায় ডাকাতসর্দার এলে সে তাঁকে ধরিয়ে দিল, অনেক মেরেধরে সর্দার তাঁকে ঝুলিয়ে রাখল। সারারাত তিনি “অহো! কি নিষ্ঠুরা, কি অকৃতজ্ঞা, …” বলে আর্তনাদ করতে লাগলেন। সেই শুনে সকালে সর্দার ভাবল, এ লোক “মাগো বাবাগো” না বলে এইসব বলে কেন? ঘটনা জিজ্ঞাসা করলে তিনি সব শোনালেন। তাতে সেও নারীজাতির সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করে কুমারীকে দুটুকরো করে ফেলল, আর বোধিসত্ত্বের সাথে মিলে তপস্যা করতে চলে গেল।

জাতকসুত্রঃমুক্ত মনা

বি.দ্রঃ সদ্ধর্ম প্রচারে আমাদের সাথে থাকুন । আপনার বৌদ্ধ ধর্মীয় লেখা প্রচার করতে যোগাযোগ করুন আমাদের হটলাইন নাম্বার এ । ধন্যবাদ ।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে জ্বালিয়েছিলেন এবং কেন?  । ত্রিরত্ন ডট কম

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে জ্বালিয়েছিলেন এবং কেন? । ত্রিরত্ন ডট কম

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কে জ্বালিয়েছিলেন এবং কেন?

লিখেছেন- ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু

আমরা জানি যে, যে কোন দেশের উন্নতি ও বিকাশ সে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির উপর নির্ভর করে। দেশের শিক্ষার্থীরাই পরবর্তীতে এসে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়, দেশের জন্য নিয়ম কানুন বানিয়ে থাকে। এরকমভাবে আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সত্তরটিরও অধিক বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমান পেয়েছি। এগুলির মধ্যে নালন্দা, তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা, সোমপুর, পণ্ডিত বিহার, জগদ্দল, ওদন্তপুরী ইত্যাদি ছিল সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।

আমরা ইতিহাসে পড়েছি যে, দ্বাদশ শতাব্দীতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন্ বখতিয়ার খিলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত আমরা ইহাই জানি এবং এরূপই প্রচার করা হয়েছে। কেন জ্বালিয়েছিলেন সে সম্পর্কে কোন উত্তর পাওয়া যায়না। ইহাতে ঐতিহাসিকগণ মৌনতা ধারণ করে থাকেন।

এখন প্রশ্ন উঠে আসে যে, বখতিয়ার খিলজী ছিলেন তুর্কী। তিনি আফগানিস্তান হয়ে খাইবার গিরি পার করে পান্জাব-গুজরাত- দিল্লী পর্যন্ত পৌঁছে আবার সেখান হতে উত্তর প্রদেশ হয়ে বিহারের নালন্দায় পৌছলেন এবং সে সময় নালন্দা ছিল ব্রাহ্মণ আনুগত্য সেন বংশের রাজাদের অধীনে। একজন তুর্কী এতদূর দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে সেন বংশের রাজ্য নালন্দায় আসেন এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্বালিয়ে ভস্ম করে আবার চলেও গিয়েছেন, একথা ভাবতেই কেমন লাগে! কি করে তা সম্ভব হল? এ অসম্ভব কার্য তিনি কিভাবে করতে পেরেছিলেন তা তো ভাববার বিষয়।

যখন কোন লুঠেরা ভারতবর্ষে আসত, তারা মন্দির সমূহকে এজন্য লুঠ করত, কেননা সেখানে স্বর্ণের ভাণ্ডার মওজুদ থাকত এবং সেগুলি তারা লুঠ করে নিয়ে যেত। আমাদের কাছে সে রকম কোন প্রমাণ নাই যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোনা মওজুদ ছিল, যা তারা লুঠ করে নিয়ে যাবে। কেবল এতটুকু বলা হয় যে, বখতিয়ার খিলজী জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তবে কেন জ্বালিয়ে দিয়েছেন, সে সম্পর্কে আজ আমরা আলোচ্য নিবন্ধে আলোচনা করব। এখানে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র এবং সে ষড়যন্ত্র কি ছিল, তা আমরা আজ জানতে পারব।

মহাযান বৌদ্ধরা অবলোকিতেশ্বর ত্রিলোকনাথ বোধিসত্বের পূজা করে থাকেন। অবলোকিতেশ্বরের মুর্তির মাথার উপরে স্থাপিত থাকে বুদ্ধের ছোট মুর্তি। হিমাচল প্রদেশের লাহোল স্পিতি জিলা হতে ৩৭ কিলোমিটার দূরে ত্রিলোকীনাথ নামে এক গ্রাম রয়েছে। সে গ্রামের পূর্ব নাম ছিল তুন্দা। সেখানে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্বের মুর্তি এখনও বিরাজমান রয়েছে। দশম শতাব্দীতে সেখানকার ‘দিবন্জ রাণা’ নামে এক স্থানীয় শাসক এ মন্দিরের স্থাপনা করেছিলেন। সে মন্দিরে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্বের যে মুর্তি রয়েছে, তাঁর মস্তক হতে যদি বুদ্ধের মুর্তি হটিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা কোন হিন্দু দেব-দেবীর মুর্তি বলে মনে হবে। এখন আরেকটি মুর্তির কথা বলব। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দণ্ডায়মান কালো পাথরের বোধিসত্বের মুর্তি পাওয়া গিয়েছিল। যা এখন নালন্দা সংগ্রহালয়ে বা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। সে মুর্তিতে রয়েছে চার হাত। যে কেউ দেখে মনে করবে ইহা কোন হিন্দু দেবী-দেবতার মুর্তি হবে। কিন্তু মুর্তির নীচে লিখা আছে তা অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্বের মুর্তি। আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, বোধিসত্বের চার হাত কি করে হতে পারে?

আপনাদের আরো প্রমাণ দেখাব, মহাযানীদের অনেক বিহার রয়েছে, সেখানে বুদ্ধের আসনে বড় বড় তিনটি মুর্তি দেখা যায়। মাঝখানে থাকে তথাগত শাক্যমুণি বুদ্ধের মুর্তি, ডান দিকে থাকে গুরু পদ্ম সম্ভবের মুর্তি এবং বাম দিকে থাকে অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্বের মুর্তি। বাম দিকের অবলোকিতেশ্বর মুর্তির দিকে যখন আপনারা থাকাবেন, তাহলে দেখবেন, সে মুর্তির মস্তকোপরি থাকে আরো তিন তিনটি মুর্তি। সেগুলো সবই হল বুদ্ধের মুর্তি । সে অবলোকিতেশ্বর মুর্তির মধ্যে থাকে অনেকগুলো হাত। এরকম বহু হাত বিশিষ্ট মুর্তি হিন্দুদের মধ্যেও দেখা যায়। এ মু্র্তি সমূহ হল দশম শতাব্দীর। সেসময় কালের কি ব্রহ্মার, কি বিষ্ণুর , কি মহেশের বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্য কোন দেবী-দেবতার একটি মুর্তিও এখনও পাওয়া যায়নি।

আপনারা হয়তো ভাবছেন যে, আমি এখানে মুর্তির কথা কেন বলছি? এখন আরও একটি মুর্তি আপনারা দেখুন। তাহচ্ছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশের পাশে কাল পাথরে নির্মিত বুদ্ধের মুর্তি। কিন্তু মুর্তির পাশে পাথরে খোদাই করে লিখে দিয়েছে শ্রী ভৈঁরো বাবা তেলিয়া ভাণ্ডার, বরগাঁও, নালন্দা। ইহা হল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাস সন্নিকটেই অবস্থিত। এবার আমরা সোজা বের হয়ে দেখব যে, এসব বলে লোকদের কারা বিভ্রান্ত করছে? তাঁরা অন্য কেহ নয়। যাঁরা শতাব্দীর পর শতাব্দী হতে নিজেদের পেট পালন-পোষণের জন্য ষড়যন্ত্র করে কুণ্ডল পাকিয়ে বসে থাকা ব্রাহ্মণেরা।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশ পুরাতত্ববিদ স্যার আলেক্সজান্ডার কানিংহাম প্রথমবারের মত অনুসন্ধান করে বের করেন। ইতিপূর্বে ব্রাহ্মণেরা বলে থাকত যে, এ স্থান আমাদের ধর্মগ্রন্থানুসারে হল গুরু খন্দহার। তাঁদের গুরুদের স্থান বলে পরিচয় দিত। যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে আসতেন বলে সমাজে জাহির করতেন, তাঁদের ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পরিচয়ই ছিলনা এ স্থান কিসের।কেন এ স্থান প্রসিদ্ধ তা তাঁদের কোন ধারণাই ছিলনা। যখন এক ইংরেজ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইহা আবিস্কার করে বের করলেন, তখন সেখানে বুদ্ধের মুর্তিকে সাজিয়ে সে স্থানকে ভৈঁরো বাবার স্থান বলে পরিচয় দিচ্ছে। এখন আপনারা ভাবতে পারেন যে, ইহা কি ষড়যন্ত্র নয়? ইহাকে ষড়যন্ত্র না বলে আর কি বলা যায়। আমরা কি করে ইতিহাসকে জানব এবং কিভাবে নিজেদের ইতিহাসের পরিচয় পাব? এ প্রসঙ্গে বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর বলেছেন-‘ যারা নিজেদের ইতিহাস জানেনা, তারা কখনও ইতিহাস রচনা করতে পারেনা।’ তবে ইতিহাসের পরিচয় কিভাবে জানা যাবে? যারা ইতিহাস বলার জন্য বসে আছে, তারা তো অন্য কিছু বলে থাকে। তাতে কি করে আমাদের নিকট সত্য উদ্ভাসিত হবে? সত্যিকার ইতিহাস জানতে গেলে আমাদেরকে তিন স্তরে বিভক্ত করে দেখতে হবে।

প্রথম ভাগে হল মান্যতাবাদী লোকের অভিমত বা বক্তব্য। এরা হলেন সে ধার্মিক সম্প্রদায় যারা বিভিন্ন প্রকার মিথ্যা কথা ও কাহিনী বানিয়ে ধার্মিক ঠিকাদারটার দোকান চালিয়ে থাকে। এবং নিজেদের মনগডা কাহিনী সমূহকে ইতিহাস বলে প্রচার করতে ভ্রম তৈরী করে।

দ্বিতীয় স্তর হল পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাস। যেগুলি সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত,প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। সেগুলির ইতিহাস তো রাজনীতির শিকার। যে সরকার আসবে সে সরকার নিজেদের সুবিধামত মনগডা ইতিহাস রচনা করে থাকে। তাতে ভরসা কোথায়।

তৃতীয় পর্যায়ে আসে পুরাতত্ব ইতিহাস। পুরাতাত্বিক যে ইতিহাস রচিত হয়, তা হল খোদাই কার্যে যে বস্তু যেভাবে প্রাপ্ত হয়, তাতে যে প্রমাণ পাওয়া যায় বা সে সময়কালের যে নোটস উপলব্দ হয়, সে সব মিলিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে ইতিহাস তৈরী হয়, তাই পূর্বের দু’রকমের ইতিহাসের তুলনায় সবচেয়ে প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য ইতিহাস হয়ে থাকে। এখন আপনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপনি প্রমাণিত ইতিহাস পড়বেন, না কপট গুরুদের দ্বারা কপোল ও ছলনা মূলক কাহিনীর ইতিহাসকে সত্যি মনে করে বাস্তবিক ইতিহাস হতে দূরে থাকবেন।

এরকম পুরাতাত্বিক ইতিহাসকারদের মধ্যে এক স্বনামধন্য ইতিহাসকার হলেন রাজীব পটেল। তাঁর এক বহুল চর্চিত ইতিহাস পুস্তক আমাদের সামনে এসেছে। পুস্তকটি তিনি লিখেছেন হিন্দিতে। নাম হল ‘ বৈদিক যুগ কা ঘাসমেল’। এ পুস্তকটি খুবই একটি গুরুত্বপূর্ণ বই সত্যিকার ইতিহাসকে জানার জন্য। ইতিহাস প্রেমীদের এ পুস্তকটি পড়া উচিত। এ পুস্তকের আলোকে আমি আজ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালানোর বাস্তবিক কারণ কি ছিল তা বর্ণনা করব।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমান বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা হতে ৮৮.৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং প্রাচীন মগধের রাজধানী রাজগীর হতে ১১.৫ কিলোমিটার উত্তরে এক গ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থিত রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আলেক্সজান্ডার কানিংহাম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিস্কার করেন। এখানে দশ হাজার ছাত্রদের পড়ানোর জন্য দু’ হাজার বিদ্বান শিক্ষক বা আচার্য ছিলেন। এখানে অনেক বিদেশী ছাত্র পড়ার জন্য আসতেন। যাঁদের মধ্য হিউয়েন সাং এবং ইৎ সিং চীন হতে এসে কয়েক বছর পর্যন্ত পড়া লেখা করেছিলেন। তাঁরা নিজেদের যাত্রা বিবরণীতে অনেক কিছু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে লিখেছিলেন। হিউয়েন সাং লিখেছেন যে, দেশ-বিদেশ হতে সহস্র সহস্র বিদ্যার্থী নালন্দায় এসে জ্ঞানার্জন করতেন বলে এ বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে বেশী খ্যাতি লাভ করেছিল। ছাত্রদের পুরা দিন অতিবাহিত হত অধ্যয়নে। বিদেশী বিদ্যার্থীরাও নিজেদের মনে উদিত শঙ্কা সমূহের সমাধান করতেন বিদ্বান আচার্যদের জ্ঞানের ঝলকের সাহায্যে।

ইৎ সিং লিখেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যদের নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য দ্বারে খোদাই অক্ষরে লিখা হত। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের বিভিন্ন অন্চল হতে তো বিদ্যার্থীগণ আসতেনই, ইহা ছাড়া আসতেন কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত,ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশ হতে শিক্ষার্থীগণ বিদ্যা ও জ্ঞান আহরণ করতে আসতেন। নালন্দা হতে বিশিষ্ট শিক্ষা প্রাপ্ত ছাত্র বাহিরে গিয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচার বড়ই সুনামের সাথে সম্পাদন করতেন। এখানকার ছাত্রদের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের জ্ঞান ভাণ্ডার ও ভারত সংস্কৃতি সমগ্র বিশ্বে প্রসারিত হয়েছিল। অন্যসব ধর্ম দর্শন কেবল ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থেকেছিল। বৌদ্ধধর্ম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম দর্শন বা মতবাদ এত ব্যাপক গবেষণা ও অধ্যয়নের জন্য সর্বসাধারণকে উৎসাহিত করেনি। বৌদ্ধদেরই একমাত্র এরকম দেখা গিয়েছে, যারা এত বেশী বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞান জ্যোতি বিলিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। ইহার মুখ্য কারণ ইহাই ছিল যে, বৌদ্ধধর্ম স্ববিবেককে ব্যবহার করার সুযোগ দিয়ে থাকে।পুস্তক বা পরম্পরা বা গুরুদের ক্রীতদাস হওয়ার শিক্ষা দেয়না। এ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিশ্বের প্রথম উন্নত আবাসীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সুনিয়ন্ত্রিতরূপে এবং বিস্তৃত পরিসরে নির্মিত এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল স্থাপত্য কলারও অদ্ভূত নমুনা। এ বিশাল পরিসরের বিশ্ববিদ্যালয় চারিদিকে দেওয়াল দ্বারা ঘেরা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য এক মুখ্যদ্বার ছিল। উত্তর ও পশ্চিম মুখী হয়ে নির্মিত হয়েছিল মন্দির বা স্তূপ সমূহের কাতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অনেক ভব্য বিহার ও স্তূপ ছিল। সমস্ত স্তূপে বিভিন্ন মুদ্রায় ভগবান বুদ্ধের মুর্তি সমূহ তৈরী করে বসানো ছিল। এখানে বুদ্ধের জন্য ‘ভগবান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নালন্দায় বুদ্ধের জন্য যে ভগবান শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা বৈদিকদের ব্যবহৃত ঈশ্বর অর্থে নয়। পালিতে ভগবান শব্দের অর্থ হল যিনি নিজের অভ্যন্তরস্থ বিকার সমূহ অর্থাৎ লোভ, দ্বেষ ও মোহাদি ভগ্ন বা ধ্বংস করেছেন, তিনিই ভগবান। অর্থাৎ একজন মানুষের আধ্যাত্মিক উচ্চতর অবস্থা প্রাপ্তিকে ভগবান বলা হয়।

এ নালন্দা বিশ্ববিদ্যলয়ে কেন্দ্রস্থিত সাতটি বড় বড় হল ছিল এবং অন্য তিন শত কামরা ছিল। সে সভাগার বা হল সমূহে ধর্ম ও দর্শনের ব্যাখা করা হত এবং কামরায় বিশ্রামের জন্য পাথরের বিছানা পাতা থাকত। প্রত্যেক কামরায় দীপক ও পুস্তক রাখার জন্য আলমারির মত থাক বনানো হয়েছিল এবং প্রত্যেক মঠের অঙ্গনে এক বিশাল বিহার বানানো ছিল। প্রত্যেক বিহারে ভগবান বুদ্ধের বড় মুর্তি, অনেক প্রার্থনা কক্ষ তথা অধ্যয়ন কক্ষ ছাড়াও সে সমস্ত বিহারে সুন্দর ফুলের বাগান এবং ঝিলও বানানো ছিল।

এত বিশাল জ্ঞানের ভাণ্ডার বিশ্ববিদ্যালয়কে বক্তিয়ার খিলজী কেন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, ইহা এক বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে এখনও সবার মনে। এর উত্তর প্রদানে অধিকতর ইতিহাসকারগণ এখনও অনন্ত মৌনব্রত ধারণ করে আছেন। এরকম নয় যে, ইতিহাসকারগণ ইহার সত্য ইতিহাস জানেননা। তাঁরা অবশ্যই জানেন। কিন্তু মৌনব্রত ধারণ করার উদ্দেশ্য হল, তাঁরা যদি সত্যতা প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁদের পূর্বজদের সব ষড়যন্ত্রের পর্দা ফাঁস হয়ে যাবে।

বৈদিক ইতিহাসের ঘালমেল পুস্তকে গ্রন্থকার লিখেছেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ শান্তিপ্রিয় হয়ে থাকেন। এরকম অবস্থায় তাঁদের বিদ্যালয় ও তাঁদের পুস্তক সমূহ জ্বালাতে বক্তিয়ার খিলজীর তো কোন লাভ ছিলনা। তারপরেও তিনি কেন জ্বালিয়েছেন। এর পেছনে কারণ বা সত্যিকার রহস্য কি ছিল?

সে কারণ জানার জন্য সে সময় কালের রাজাদের যে রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল, সে সম্পর্কেও লেখক পুস্তকে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, বর্তমানের বিহার এবং বঙ্গে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্য পর্যন্ত পাল বংশের অন্তিম শাসক গোবিন্দ পালের শাসন ছিল। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ রাজা। তাঁকে পরাজিত করেই সেন বংশ বাংলা ও বিহারের শাসনভার নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে নেন। এ সেন বংশের শাসকগণ ব্রাহ্মণ্য মান্যতানুসারে বেশী করে ব্রাহ্মণ্য মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন এবং যে সমস্ত বৌদ্ধ বিহার ছিল, সে গুলোকে রাজ শক্তি দ্বারা ব্রাহ্মণীকরণ করা হয়েছিল। সে সময়ের নালন্দা অন্চলের শাসক লক্ষ্মণ সেন ছিলেন কঠোর ব্রাহ্মণ্যবাদী, যে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধধর্মকে মাটিতে কবর দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন পূর্ব হতেই। সে সময় বক্তিয়ার খিলজী যখন নালন্দা আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, রাজা লক্ষ্মণ সেন তখন বিরোধ করেননি কেন? যেখানে মহাবিহার নালন্দা ও ইহার তিন তলা বিশিষ্ট তিনটি ভবনের গ্রন্থসমূহ ছয় মাস পর্যন্ত আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলেছিল। ভিক্ষুদের মেরে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। স্থানীয় জমিদার ও রাজা দ্বারা কেন আগুন নেভানোর চেষ্টা করেনি? এরকম কোন প্রমাণও পাওয়া যায় না যে, সেখানে যে সকল আচার্য-প্রাচার্যেরা ছিলেন, তাঁদেরকে বাঁচানোর জন্য কেউ এগিয়ে এসেছেন। এখনও প্রশ্ন আসে যে, এ বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হলে তো লাভ হবে ব্রাহ্মণদের। কিন্তু যাঁর কোন এখানে লাভ নেই, সে বক্তিয়ার খিলজী কেন জ্বালাতে আসলেন? ইহা তো বড় প্রশ্ন ও বড় রহস্য । কেন তিনি এ নিষ্ঠুর ও বর্বর কার্য করতে আসলেন?

সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক রাজীব পাটেল তাঁর পুস্তকে লিখেছেন যে, ১২১০ খৃষ্টাব্দের আশে-পাশে ১১৯৯ হতে ১২০৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যে বখতিয়ার খিলজী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ইহার কাছাকাছি সময়ের ‘তবাখত-এ-নাসিরী’ পুস্তকের লেখক মিনহাজ উস সিরাজ স্বীয় পুস্তকে লিখেছেন যে, বক্তিয়ার খিলজীর এক সময় ভয়ানক এক প্রাণঘাতী রোগ হয়েছিল। তাঁকে আরোগ্য করার জন্য চিকিৎসা করেছিলেন এক ব্রাহ্মণ বৈদ্য বা কবিরাজ। তিনি বলেছিলেন, আমি তোমাকে আরোগ্য করব, তবে এক শর্তে। শর্ত ছিল যে, তোমাকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্বালিয়ে দিতে হবে। বখতিয়ার খিলজী শর্ত মেনে নিলে ব্রাহ্মণ চিকিৎসা দিয়ে ঠিক করলেন। আরোগ্য লাভ করে বখতিয়ার খিলজী নালন্দা মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখানে তো আমাদের কিছু বলার নাই। কেননা এ তবাখত এ নাসিরী সে সময়কালের লিখা। অর্থাৎ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালানোর সমকালীন পুস্তক। তিনি পুস্তকে আরো স্পষ্ট করে লিখেছেন যে, সে ব্রাহ্মণ তাঁর মনের মধ্যে পোষণ করে রেখেছিলেন, যে বখতিয়ার খিলজীর দ্বারা জ্বালানোর কাজটা করাবেন।

সেনবংশের রাজাগণ তো মনে করতেন, যখন তাঁরা বৌদ্ধ রাজাকে পরাস্ত করে দিয়েছেন তখন তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কেন থাকবে? ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, যখনই ধার্মিকগণের দ্বারা শাসন কব্জা করা হয়, তখন তাঁরা সবচেয়ে প্রথমে বুদ্ধিজীবি বর্গকে শেষ করতে চায়। এবং বুদ্ধিজীবিবর্গদের শেষ করতে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল, যে সমস্ত ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সে গুলিকে নষ্ট করে দেওয়া। এ কাজটাই সে সময়ে হয়েছিল।

এভাবে আমরা দেখছি যে, এক বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় নিজের দেশেই কিছু কট্টর গাদ্দারদের কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যখন এস্থানের খনন কার্য ঊনিশ শ’ শতাব্দীতে হয়েছিল, তখন অনেক প্রকারের বুদ্ধের মুর্তি সমূহ পাওয়া গিয়েছিল। সমগ্র পরিসর ছিল বুদ্ধের মুর্তিতে ভর্তি। সে মুর্তিই সে বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে সেন বংশের উত্তরাধিকারীগণ মন্দির বানিয়ে তেলিয়া বাবা ও ভৈঁরো বাবা বলে কব্জা করে বসে আছে এখন।

এ প্রকারে বেদ না মানার কারণে বুদ্ধকে নাস্তিক বানানো হয়েছে, শত্রু বানানো হয়েছে, আবার জ্ঞানী বুদ্ধ বলে অবতার বানানো হয়েছে। আবার তাঁর মুর্তিকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ বানিয়ে দিয়েছে। এবং আবার তাঁর নামে নানা প্রকার অর্ঘ্য ছডানো হচ্ছে। এখন ভাবুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কালে তিনি বুদ্ধ ছিলেন। এবং বর্তমান সময়ে বিভিন্ন প্রকার দেবী-দেবতায় পরিণত হয়েছেন ব্রাহ্মণদের দ্বারা। এ হল ধর্মের নামে মিথ্যাচার, ষড়যন্ত্র, ছল-কপট ও ভাঁওতাবাজী তথা ধান্ধাবাজী। যাঁরা পূর্বে বুদ্ধের বিরোধ করেছিল, এখন তাঁরাই বুদ্ধকে সিন্ধুর, টিকা ও কাপড় পরিবর্তন করে রং মাখিয়ে নানা প্রকার কাল্পনিক দেব-দেবীর নাম দিয়ে পূজা করে পেট পালানোর ধান্ধা করতে রয়েছে। এগুলিই হল ভারতের সত্যিকার ইতিহাস। এখন আপনারা বুঝতে পারছেন যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালানোর পেছনে কত বড় ষড়যন্ত্র রচনা ব্রাহ্মণেরা করেছে। এ সমস্ত সত্যকে দাবানোর জন্য কত কত মিথ্যা পুস্তক ষড়যন্ত্রকারীরা লিখেছে। এ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো কোন দেব-দেবীর মুর্তি পাওয়া যায়নি। কেননা সমস্ত দেব-দেবীর উদ্ভব তো বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পরেই হয়েছে। ‘বৈদিক যুগ কা ঘালমেল’নামক পুস্তকে লেখক আরো বলেছেন, বৈদিক যুগ হল সবই মিথ্যা এবং অষ্টম শতাব্দীর পরেই সব বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনকে ভাঙ্গচুর করে হিন্দু শাক্ত, শৈব যত মত ও পন্থ গঠিত হয়েছে। লেখক সেখানে আরো স্পষ্ট করেছেন পালি ও প্রাকৃত ভাষাকেই সংস্কার করে সংস্কৃত নাম দিয়ে ভাষা তৈরী করেছে। সে জন্য পুস্তকটি সবার পড়া উচিত। পুরাতাত্বিক সম্বলিত সঠিক ইতিহাসকে না জানলে এ সমস্ত ধর্মীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ইতিহাসই মানুষকে সর্বদা ভ্রমিত করবে।

অশাতমন্ত্র জাতক । ত্রিরত্ন ডট কম

ভেরীবাদক জাতক – ত্রিরত্ন ডট কম

বারাণসীরাজ ব্ৰহ্মদত্তের সময়ে বােধিসত্ত্ব একবার ভেরীবাদকের বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি এক গ্রামে বাস করতেন। তিনি তাঁর পুত্রসহ ভেরী বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন বােধিসত্ব শূনতে পেলেন, বারাণসী নগরে কোন পর্ব উপলক্ষে এক বড় উৎসব হবে। মহা সমারােহ হবে নগরে। বহু লােকসমাগম হবে। সমাগত লােকদের কাছে ভেরী বাতালে বেশ কিছু অর্থ পাওয়া যেতে পারে। এই ভেবে তিনি পুত্রসহ ভেরী নিয়ে উৎসবস্থানে চলে গেলেন। সেদিন নগরে ভেরী বাজিযে অনেক ধন লাভ করলেন। বােধিসত্ব। উৎসব শেষ হলে তিনি সেই ধন নিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করলেন। পথে এক বন ছিল। সেই বনে এক দস্যুদল ছিল। | বনের মধ্যে পখিকদের পেলেই তারা উপদ্রব করত। বােধিসত্বের পুত্র সেই বনের মধ্য দিয়ে যাবার সময় একটানা ভেরী বাজিযে চলল। সে ভাবল, এইভাবে ভেরী বাজালে, ভেরীর শব্দ শুনে দস্যুরা পালিয়ে যাবে। কিন্তু বােধিসত্ব ভার ছেলেকে বললেন, এভাবে | একটানা বাজিও না। মাঝে মাঝে বাজাও। ভেরীর শব্দ শুনে দস্যু সত্যিই পালিয়ে গেল। কারণ তারা ভাবল, হ্যত রাঙ্গ বা কোন বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি বহু লােকজন নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা যখন দেখল, একটানা ভেরী বেজে চলেছে, তখন তারা ভয় করল না। ভারা সাহস করে এগিয়ে দেখল মাত্র দুজন লােক যাচ্ছে। দস্যরা তখন বােধিসত্ত্ব ও তাঁর ছেলেকে মারধর করে সব ধন কেড়ে নিল। বােধিসত্ত্ব হায় হায় করতে লাগলেন। বললেন, বহু কষ্ট যে ধন উপার্জন করলাম, দসরা এক নিমেষেই তা কেড়ে নিল। ভারপর তিনি পুত্রকে বললেন, কোন বিষয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। আমি তােমাকে একটানা করেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার কথা না | ভেরী বাজাতে নিষেধ শুনে বিস্তর ভেরী বাজিযে বিপদ ডেকে আনলে।।

উপাসকের পেশা কেমন হওয়া উচিত ? – ত্রিরত্ন ডট কম

উপাসকের পেশা কেমন হওয়া উচিত ? – ত্রিরত্ন ডট কম

উপাসকের পেশা কেমন হওয়া উচিত ?

লিখেছেন- জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু।

ত্রিরত্নের উপাসক বা উপাসিকা হলে তার মিথ্যাবাণিজ্য ত্যাগ করা উচিত। বুদ্ধ বলেছেন, ভিক্ষুগণ, উপাসকের পাঁচ প্রকার বাণিজ্য করা উচিত নয়। অস্ত্রবাণিজ্য, প্রাণিবাণিজ্য, মাংসবাণিজ্য, মদবাণিজ্য, বিষবাণিজ্য (অঙ্গুত্তর নিকায়.৫.১৭৭)। এখানে অস্ত্রবাণিজ্য মানে হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করা। প্রাণিবাণিজ্য মানে হচ্ছে মানুষ বিক্রি করা। মাংসবাণিজ্য মানে হচ্ছে শুয়োর, হরিণ ইত্যাদি বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণি পালন করে বিক্রি করা। সেগুলোকে জবাই করে মাংস বিক্রি করাটাও এই মাংসবাণিজ্যের অন্তর্গত। বর্তমানে শুয়োরের খামার, মুরগির খামার, মাছের খামার এগুলোও মাংসবাণিজ্য। মদবাণিজ্য মানে হচ্ছে যেকোনো ধরনের মদ বিক্রি করা। বিষবাণিজ্য মানে হচ্ছে বিষ বিক্রি করা। এগুলো নিজেও করা উচিত নয়, অন্যদেরকে দিয়ে করানোও উচিত নয়।

অঙ্গুত্তর নিকায়ের টীকামতে, অস্ত্রবাণিজ্য করলে আপনি সেই অস্ত্র দিয়ে অপরের অপরাধের সুযোগ করে দিচ্ছেন। তাই সেটা অকরণীয়। প্রাণিবাণিজ্য বা মানুষ বিক্রি করলে সেটার মাধ্যমে আপনি অপরকে দাস বা চাকর বানানোর পথ দেখাচ্ছেন। তাই সেটা অকরণীয়।
মাংস ও বিষ বাণিজ্য প্রাণিহত্যার কারণ হয়। তাই সেটা অকরণীয়। মদবাণিজ্য করলে সেটা অন্যদের প্রমত্ততা বা মাতলামির কারণ হয়। তাই এধরনের বাণিজ্য বাদ দিয়ে ধর্মত ও ন্যায়সঙ্গত পেশার দ্বারা জীবন যাপন করা উচিত। পাঁচ প্রকারের মিথ্যাবাণিজ্যের মাধ্যমে হয়তো টাকা-পয়সা বা মানসম্মান আসতে পারে। কিন্তু নিজের ভবিষ্যতের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে বুদ্ধের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা কোনো উপাসকের উচিত নয়।

বিশুদ্ধিমার্গ মহাটীকামতে, গৃহীরা যেসমস্ত পেশার মাধ্যমে জীবন ধারণ করে সেগুলোর মধ্যে কাঠমিস্ত্রি ইত্যাদি পেশা হচ্ছে নিম্নশ্রেণির পেশা। কৃষিকাজ, ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদি হচ্ছে উৎকৃষ্ট পেশা। আবার বিভিন্ন শিল্পবিদ্যার ক্ষেত্রেও বেতের কারিগর ইত্যাদি হচ্ছে নিম্নশ্রেণির পেশা। অন্যদিকে মুদ্রা গণনা বা হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি হচ্ছে উৎকৃষ্ট (ৰিসু.মহাটীকা.২.৪২৭)। তবে হীন হোক বা উৎকৃষ্ট হোক, নিজের দক্ষতা ও আগ্রহ অনুসারে এধরনের যেকোনো পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবন ধারণ করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ ঘটিকার ব্রাহ্মণ অনাগামী মার্গফল লাভী হয়েও কুমোরের কাজ করে মাটির হাঁড়ি পাতিল বানিয়ে তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে ভরণপোষণ করত।

error: Content is protected !!