কোথা হতে দুঃখের সৃষ্টি হয়?

কোথা হতে দুঃখের সৃষ্টি হয়?

৩০শে জুলাই ১৯৯৬ ইংরেজী সোমবার। শ্রদ্ধেয় বনভান্তের সাধনা কুঠিরের উপরের তলা। সময় ভোর বেলা। তাঁর শিষ্যদেরকে দেশনা দিচ্ছিলেন। তিনি যে লোকোত্তর দেশনা প্রদান করেন তা আমার (সংকলক) শারীরিক অসুস্থতা ও জ্ঞান পরিধির অভাবে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারিনি। তবুও যৎ সামান্য ধারণ করেছি তা আপনাদের নিকট প্রকাশ করছি। তাঁর দেশনার প্রধান সারমর্ম হল কোথা হতে দুঃখের সৃষ্টি হয়? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন- অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও উপাদান হতে এ দুঃখ গুলির সৃষ্টি হয়। অবিদ্যা অর্থ না জানা। কি না জানা? দুঃখ কি না জানা। দুঃখ সমুদয় কি না জানা। দুঃখের নিরোধ কিসে হয় না জানা। দুঃখ নিরোধের পথ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্বন্ধে না জানা। অর্থাৎ কোন কিছু সম্বন্ধে না জানা বা অজ্ঞানতাই অবিদ্যা।

তিনি বলেন- তৃষ্ণা হল দুঃখের কারণ। কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে অসার সুখ ভোগ করাকে কাম তৃষ্ণা বলে। ভব তৃষ্ণা অর্থ হল ভবে ভবে অর্থাৎ কামলোকে ও রূপলোকে ঘুরে ঘুরে জন্মগ্রহণ করে সুখ ভোগ করা। বিভব তৃষ্ণা হল উচ্ছেদ জনিত বীত তৃষ্ণা।

উপাদান অর্থ উৎস, উৎপত্তি মূল বুঝায়। উপাদান চার প্রকার। কাম উপাদান, আত্ম উপাদান, দৃষ্টি উপাদান ও শীলব্রত উপাদান।

কাম উপাদানঃ- পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক ইন্দ্রিয়ে সব সময় দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে। কি গ্রহণ করে? গ্রহণ করে লোভ মোহ, দ্বেষ মোহ অর্থাৎ লোভ, দ্বেষ মোহ গ্রহণ করে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ সাপ সব সময় ব্যাঙ তালাশ করে। ঠিক সেরূপ পঞ্চ ইন্দ্রিয়, রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শকে সব সময় তালাশ করে ও পিছনে পিছনে ধরার জন্য ধাওয়া করে। তাতে সুখের পরিবর্তে দুঃখের ভাগী হয়।

আত্ম উপাদানঃ- অর্থ হল দেহের মধ্যে আত্মা নামে এক জীব আছে। সেটা অজর অমর, শাশ্বত বলে মনে করে। তাতে ভীষণ অজ্ঞানতার সৃষ্টি হয়ে দুঃখ মুক্তির পথ খুঁজে পায়না। তাতে অনন্তকাল পর্যন্ত দুঃখে কালাতিপাত করে। আত্মা যে অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা ও ক্ষয় ব্যয় শীল বুঝতে সক্ষম নয়।

দৃষ্টি উপাদানঃ- দৃষ্টি উপাদান হল মিথ্যাদৃষ্টি উপাদান অর্থাৎ কোন বিষয় বা জিনিস ভাল মন্দ বিবেচনা করে মন্দটা বাদ দিয়ে ভালটা গ্রহণ করতে পারে না। যেমন অন্ধ ব্যক্তি যে কোন জিনিস ভাল মন্দ বিচার করতে সক্ষম নয়। ঠিক দৃষ্টি উপাদান গৃহীত ব্যক্তি ও সেরূপ সব সময় সুখ মনে করে দুঃখে পতিত হয়।

শীলব্রত উপাদানঃ- কেউ কেউ নির্বাণ ধর্ম বুঝতে না পেরে অন্য ধর্ম, পর ধর্ম, হীন ধর্ম ও মিথ্যা ধর্ম আচরণ করতে থাকে। তারা মনে করে এ ধর্মে সুখ আছে, মুক্তি আছে ও শান্তি আছে। তাতে তারা সুখের পিছনে, মুক্তির পিছনে ও শান্তির পিছনে ধাবিত হয়ে বিপরীতে ফল লাভ করে থাকে। যেমন গরুর মত কচি ঘাস ও পাতা খাওয়াকে গোব্রত বলে। কুকুরের মত মাটি হতে জিহ্বা বা মুখ দিয়ে আহার করা। এটাকে কুকুর ব্রত বলে।

সকল দুঃখের মূল অবিদ্যা, তৃষ্ণা, কাম উপাদান, আত্ম উপাদান, দৃষ্টি উপাদান ও শীলব্রত উপাদান আছে বলে মানুষ সহজে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না। এ সমস্ত উপাদান ধ্বংস হলে কি হয় জান? সত্ত্ব মরে, আত্মা মরে ও মার মরে। যেমন চারি আর্য্যসত্যের মধ্যে দুঃখ সত্য হৃদয়ঙ্গম হলে সৎকায় দৃষ্টি বা আত্মবাদ সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়। দুঃখ সমুদয় নিরোধে উচ্ছেদ দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়। নিরোধ সত্য দর্শনে শাশ্বত দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়। মার্গ সত্য দর্শনে অক্রিয় দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়।

যারা উচ্ছেদ দৃষ্টি বাদী তারা এক গুয়ে। পুনঃ জন্ম নেই বলে, মরণের পরও দুঃখ নেই, মরণের পর সব শেষ হয়ে যায়, এ রকম তারা বলে থাকে। তাদের মধ্যে বহু দোষ থাকে।

সৎকায় দৃষ্টি বাদীরা পঞ্চ স্কন্ধে আমি আছি বা আমার ধারণা করে। পঞ্চ স্কন্ধ বলতে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে বুঝায়।

অক্রিয়াদৃষ্টি বাদীরা দান, শীল, ভাবনা ও পাপ পূণ্যের বিশ্বাস করেনা। এগুলির কোন ফলও নেই এ ধারণা তাদের বদ্ধমূল।

শ্বাশ্বত দৃষ্টি বাদীরা কিছু মাত্র ধার্মিক থাকে, পরকালও বিশ্বাস করে, কিন্তু তাদেরকে বুঝানো খুবই কঠিন। তারা সব সময় নিজকে ভাল, উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে।

উপসংহারে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে তাঁর শিষ্যদেরকে উদাত্ত কণ্ঠে বলেন- তোমরা জ্ঞান আহরন কর। কিসের জ্ঞান জান? শুধু লোকোত্তর জ্ঞান। লোকোত্তর জ্ঞানে সব দুঃখের অবসান ঘটে। সুতরাং তোমরা অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও উপাদান ধ্বংস করে পরম সুখ নির্বাণ প্রত্যক্ষ কর। নির্বাণ এমন অবস্থা, তা অন্য কেউ দেখিয়ে দিতে পারবে না। যেমন মিলিন্দ রাজা নাগসেন স্থবিরকে বলেছিলেন- নির্বাণ কোথায়? দেখায়ে দিন। তিনি বলেছিলেন- মহারাজ, বাতাস আছে? রাজা বললেন- হ্যাঁ আছে। স্থবির বললেন- তাহলে বাতাস দেখিয়ে দিন। রাজা বললেন- বাতাস দেখিয়ে দেয়া যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। স্থবির তখন বললেন- তাহলে নির্বাণও দেখিয়ে দেয়া যায় না। শুধু নিজে নিজে অনুভব করা যায়। এ বলে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সবাইকে নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্যে উৎসাহিত করে তাঁর দেশনার ইতি টানলেন।

#লেখাটি  Subrata Barua  কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে 

কৌশিক জাতক

কৌশিক জাতক

একবার বারানসি রাজা সবলে যুদ্ধ জাত্রা করছিলেন। তিনি নগর বাইরে এক উদ্যানে শিবির স্থাপন করেছিলেন। বোধিসত্ত্ব তখন রাজার অমাত্য ছিলেন।

ঐ সময় সেই উদ্যানে এক পেচক বাঁশের বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। পেচক নিশাচর প্রাণী। তারা দিনের বেলায় বের হয় না নিজ বাসা থেকে। পেচককে দেকতে পেয়ে দলে দলে কাক এসে তার চারিদিকে ভিড় করল।

পেচক তখন দিন কি রাত সূর্য অস্ত গেছে কিনা তা না দেখেই বাঁশের ঝোপ থেকে বের হয়ে পালাবার চেষ্টা করল। তখন কাকেরা তাকে আঘাত করতে করতে মাটিতে ফেলে দিল।

তখন তা দেখে রাজা বোধিসত্ত্বকে ডেকে বললেন, পণ্ডিত বর, কাকেরা পেচককে মাটিতে ফেলে দিল কেন?

বোধিসত্ত্ব বললেন, যারা অকালে বাসা থেকে বের হয়, তাদের এই দশাই হয়। এইজন্যই অকালে বাসিস্থান হতে বের হতে নেই। তারপর বোধিসত্ত্ব একটি গাথার মাদ্যমে বললেন, যারা বুদ্ধিমান তাদের কালাকাল জ্ঞান থাকে। তারা অকালে বাড়ি থেকে কোথাও যায় না। বহু সেনা থাকা সত্ত্বেও রাজাদের পক্ষে অকালে অথবা বর্ষাকালে জুদ্ধজাত্রা করা অনুচিত। তা হলে অশেষ দুর্গতি ভগ করতে হয়। বিচক্ষণ ব্যক্তি বিপক্ষের সব ছিদ্র জেনে জুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শত্রুদের দমন করে। পেচক দিনে দেখতে পায় না, কিন্তু কাকেরা রাত্রিকালে দেকতে পায় না। তাই পেচক যদি রাত্রি কালে বের হত তাহলে কাকেরা তার কিছুই করতে পারত না।

বোধিসত্ত্বের এই বাণী শূনে প্রীত হলেন বারানসি রাজ। তিনি ঘোষণা করে দিলেন, বর্ষাকালে তিনি যুদ্ধ যাত্রা করবেন না। তিনি নিজের ভুল বুজতে পারলেন। সামান্য একটি পেচকের দৃষ্টান্ত দ্বারা বোধিসত্ত্ব রাজাকে কালাকাল জ্ঞান দান করে কখন বাড়ি থেকে বের হতে হয় বা কখন কোন কাজে বাড়ি থেকে বের হতে নেই তা ব্যাখ্যা করে দিলেন।

কৌশিক পেচকের আর এক নাম।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

মহা মঙ্গল জাতক

মহা মঙ্গল জাতক

পুরাকালে বোধিসত্ত্ব এক এক দূর গ্রামে এক ধনী ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রক্ষিত কুমার। বয়ঃপ্রাপ্তির পর তিনি তক্ষশীলায় গিয়ে বিদ্যা শিক্ষা করেন। তারপর বাড়ি ফিরে এসে বিবাহ করেন।

এরপর তাঁর মাতা পিতার মৃত্যু হলে তিনি সঞ্চিত ধন দেখে বিষয়বৈরাগ্য জাগল তাঁর মনে। তিনি দান করে সমস্ত ধন শেষ করে দিলেন। তারপর বিষয়বাসনা ত্যাগ করে হিমালয়ে চলে গিয়ে ঋষি প্রবজ্যা গ্রহন করলেন। তিনি সেখানে বন্য ফলমূল খেয়ে একটি পর্ণশালায় বাস করতে লাগলেন। তিনি ধ্যানভিজ্ঞা লাভ করলেন। অনেক তাপস তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করল এবং ক্রমে তাঁর শিষ্যত্ব পাঁচশত হল।

একদিন এই সমস্ত তাপস আচার্য বধিসত্তের নিকট গিয়ে বললেন, আচার্য বর্ষাকাল উপস্থিত। আমরা এখন হিমালয় হতে নেমে লবণ ও অম্ল সংগ্রহের জন্য জনপদে গিয়ে ভিক্ষা করি। এতে আমদের শরীর সবল হবে এবং পদব্রজে তীর্থযাত্রাও হবে।

বোধিসত্ত্ব বললেন, যদি ইচ্ছা জয় তাহলে তোমরাই যাও। আমি এখানে থাকব।

তখন শিষ্যরা তাঁকে প্রণাম করে হিমালয় থেকে নেমে জনপদে ভিক্ষা করতে করতে বারাণসীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁরা রাজ্যধ্যানে বাস করতে লাগলেন। নগরবাসীরা বিশেষ সম্মানের সঙ্গে তাদের আদর অভ্যর্থনা করল।

তারপর একদিন বারণসী নগরে এক জায়গায় বহু লোক সমবেত হয়ে মঙ্গল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। কিন্তু সেখানে উপস্থিত সব লকের সংশয় ছেদন করে কেউ মঙ্গল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। তখন সেই সব লোক রাজ্যধ্যানে গিয়ে সেই সব তাপসদের ঐ প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞেস করল। বারণসীরাজ নিজেও সেই আলোচনাসভায় ছিলেন। তিনি সকলের সঙ্গে উদ্যানে তাপসদের কাছে গেলেন। তখন তাপসগণ রাজাকে বললেন, আমরা ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। আমাদের আচার্য মহাপ্রাজ্ঞ। তিনি হিমালয়ে থাকেন। তিনি দেবতা ও মনুষ্য সকলের হৃদয় জয় করে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।

রাজা বললেন, হিমালয় অতি দূর ও দুর্গম। আমি সেখানে যেতে পারব না। আপনারা দয়া করে আচার্যের কাছে গিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর শূনে ফিরে এসে আমাকে বলুন।

শিষ্যরা এতে সম্মত হয়ে হিমালয়ে চলে গেলেন। তাঁরা আচার্যকে প্রণাম করলে আচার্য তাদের জিজ্ঞাসা করল, রাজা কি ধার্মিক? জনপদে লকের চরিত্র কেমন দেখলে?

শিষ্যরা এই প্রশ্নের উত্তর দেবার পর রাজার মঙ্গল প্রশ্নের সব কথা বললেন। বললেন, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যই রাজা তাঁদেরকে এখানে পাথিয়েছেন। অনুগ্রহ করে এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে বুঝিয়ে দিন। তাঁরা একটি গাঁথার মাধ্যমে বললেন, স্বস্ত্যয়নকালে লোকে কোন বেধ, কোন সুত্ত পাঠ করে? টা কিভাবে জপ করে? ইহামুত্র কিভাবে সুরক্ষিত হবে?

তখন বোধিসত্ত্ব কয়েক্তি গাথায় মঙ্গল প্রশ্নের উত্তর দিলেন। তিনি সব গাঁথার মাধ্যমে বলতে লাগলেন, দেবগণে, পিতৃগণে, সরীসৃপ আদিজীবগণে যে জন মৈত্রীগুণ দ্বারা তুস্ত করে সে সর্বদা সবার প্রীতি লাভ করে এবং এতে ভূত স্বস্ত্যয়ন সম্পন্ন হয়।

যারা সবিনয় ব্যবহারে নরনারী, স্ত্রীপুত্র পরিবার ও সর্বভূত পরিতুষ্ট হয়, যে ব্যক্তি অপ্রিয়বাদীদের প্রীয় ও মিস্তবাক্যদ্বারা তুস্ত করে এবং ক্ষমার অবতারের মত শোভা পায়, সে ইহলোক ও পরলোকে সর্বত্র মঙ্গল্ভাজন হয়। তার কোন শত্রুভয় থাকে না। এতেই হয় তার অধিবাস স্বস্ত্যয়ন।
আমি বিদ্যাবলে, কুলমানে, জাতিতে ধনে বড় বলে যে কখনো আস্ফালন করে না, বাল্যবন্ধুকে আত্মজ্ঞানে দেখে এবং কখন তার অপমান করে না, যে ব্যক্তি সাধু, প্রাজ্ঞ ও মতিমান, সে ব্যক্তি অনায়াসে কারজ বিচার করতে পারে, সে সহায় বা বাল্যবন্ধুদের প্রিয় হয় এবং এভাবেই তার সহায়ক স্বস্ত্যয়ন হয়।

যে জন সাধু ব্যাক্তির সাথে মিত্রতা করে মিত্রের বিশ্বাস ভাজন হয়, যে জন আত্মত্যাগী এবং মিত্রকে ধনের ভাগ দেয়, তার মিত্র সবস্ত্যন হয়।
যার স্ত্রীসমান গুণসম্পন্না, ধর্মপরায়ণা, অবন্ধ্যা ও কুলশীলে ধন্যা, তার দ্বার স্বস্ত্যয়ন হয়।

যার রাজা প্রতাপশালী, যশে,মানে, শীলে, তেজে অদ্বিতীয়, যাকে বন্ধুভাবে গ্রহন করে দ্বিধাহীন চিত্তে, সেই ব্যক্তি এতে রাজস্বস্ত্যয়ন হয়।
যে জন শ্রদ্ধার সঙ্গে অন্নদান, মাল্য ও গন্ধবিনোদন প্রসন্নচিত্তে দান করে সকলের মঙ্কে প্রীত করে, তার স্বর্গস্বস্ত্যয়ন হয়।

জ্ঞানবৃদ্ধ সুবিখ্যাত ও শীল্বান ঋষিগণে যে জন অর্চনা করে এবং তাদের কৃপাবলে যার মন শুদ্ধাচারে আর্য ধর্মে রত হয়েছে, যে জন সাধুসঙ্গপরায়ণ ও শ্রদ্ধাবান, তার নিঃসন্দেহে অর্হৎ স্বস্ত্যয়ন সম্পন্ন হয়েছে।

বোধিসত্ত্ব এইভাবে আটটি গাঁথার দ্বারা মঙ্গল প্রশ্ন সম্বন্ধে উপদেশ দিয়ে তার ব্যাখ্যা করলেন। তারপর বললেন, যারা বুদ্ধিমান, তারা এইভবে স্বস্ত্যয়ন করে চলে। নিমিত্ত অসত্য। তাই তার প্রয়োজন নেই।

শিষ্যরা প্রকৃত মঙ্গল কি তা জেনে নিয়ে আশ্রমে সাত আটদিন কাটিয়ে বারাণসীতে ফিরে গিয়ে রাজাকে মঙ্গল-প্রস্নের উত্তর দিলেন। সকলে প্রকৃত মঙ্গল কি তা জেনে মঙ্গল কর্মের অনুষ্ঠান করতে লাগল। এরপরে তাপসেরা হিমালয়ে ফিরে গেলেন।
বোধিসত্ত্ব ব্রহ্মবিহার ধ্যান করতে করতে ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির উপযুক্ত হলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

 

মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ

মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ

১৯৮৫ সাল। মে মাসের শুরু। বনভান্তের গৃহীকালীন মা পুণ্যশীলা বীরপুদি চাকমা ভীষণ অসুস্থ। বিশ/একুশ দিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন। সেই অসুখের মাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে দু’য়েকদিন হতে। মেঝ ছেলে (৩য় পুত্র) জহর লাল চাকমার বঙ্গলতুলিস্থ বাড়ীতে শয্যাশায়ী হয়ে মরণাপন্ন প্রায়। চিকিৎসায় কোন ফল হচ্ছে না দেখে জহর লাল, ভূপেন্দ্র লাল (৪র্থ পুত্র) ও বাবুল (৫ম পুত্র) চাকমারা মায়ের বেঁচে থাকার আশা এক প্রকার ছেড়েই নিলেন। জহর লাল চাকমার মনে পড়ল—“মায়ের এই শেষ অবস্থার খবর তো শ্রদ্ধেয় বনভান্তেকে জানানো দরকার। ভান্তে হলেও তিনি যে আমাদের বড় ভাই, মায়ের প্রথম পুত্র”। কিন্তু, পরক্ষণে সেই চিন্তা বাদ দিতে হল—মন থেকে। ভাবতে লাগলেন—কিভাবে এ’খবর জানাবেন! রাঙামাটি তো বহুদূরে। লঞ্চ যোগে রাঙামাটি গিয়ে ফিরে আসতে কম হলেও তিনদিন হাতে রাখতে হবে। মায়ের এই গুরুতর অসুস্থের সময় তিনদিন বাড়ীর বাইরে থাকা কী করে সম্ভব। অন্যদিকে লঞ্চ করে রাঙামাটি যেতে কতো জায়গায়ই-না আর্মির চেকপোষ্টের ভোগাক্তিতে পড়তে হয়, তার হিসেব নেই। আর সেসময় উল্টোপাল্টা কিছু ঘটলে তো সব-ই শেষ হয়ে যাবে। এসব ভেবে জহর লাল চাকমা রাঙামাটিতে আসতে সাহস করলেন না। ফলে বনভান্তেকে মায়ের মরণাপন্না অবস্থায় কথা জানাতে পারলেন না।

মৃত্যুর তিনদিন আগে মাতৃদেবী বীরপুদি চাকমা পুত্র জহর লালকে বললেন—“আমাকে মূল বাড়ির অমুক কামড়ায় স্থানান্তর কর”। মায়ের নির্দেশ পেয়ে জহর লাল চাকমাও তা-ই করলেন। উল্লেখ্য যে, এই কামড়াটিতে কোন এক অসুস্থতার সময় বনভান্তে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। একজন, দু’জন করে করে পাড়ার লোকজনেরা বীরপুদি চাকমার এ’গুরুতর অসুস্থের অবস্থা দেখে যেতে লাগলেন। মৃত্যুর একদিন আগে বিকেল বেলায় হঠাৎ শয্যাশায়ী বীরপুদি চাকমা বলে উঠলেন—“ভান্তে, তুমি আজ বিকালে এসেছ। সকালে আসলে তো সিয়্যং-এর ব্যবস্থা করতাম”। মায়ের একথা শুনে জহর লাল চাকমারা ভাবলেন, মা অসুখের ঘোরে এসব বলছেন নিশ্চয়। তা না হলে ভান্তেকে দেখলেন কোথায়! ভান্তেকে তো আমরা খবরটুকুও দিতে পারি নি। ভান্তে আসবেন কীভাবে। আর ভান্তে যদি সত্যি সত্যিই আসতেন, তাহলে আমরা সবাই দেখতাম। মা একাই দেখবেন কেন! তবে পরক্ষণে লালের মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। চিন্তা আসলো, আহা-রে! মা তাঁর বড়ো ছেলেকে কতো-ই ভালোবাসেন। এসময়ও তাঁর কথা স্মরণ করছেন। নিশ্চয় খুব দেখতে ইচ্ছা করছে বড়ো ছেলেকে। কিন্তু, আমি তো তাঁকে খবরই দিতে পারি নি। হয়ত মা-এর এটা-ই শেষ ইচ্ছা। মার এ’ইচ্ছাটুকু পূরণ করে দিতে পারছি না, পারলাম না। এভেবে নিজকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল তার। পরদিন ভোরে বীরপুদি চাকমা পুত্রবধুকে “বৌমা, বৌমা” বলে ডেকে উঠলেন। আর নির্দেশের স্বরে বললেন—“তাড়াতাড়ি সিয়্যং রান্না কর। আজ বনভান্তে এখানে এসে সিয়্যং খাবেন”। শ্বাশুড়ির কথায় তেমন বিশ্বাস না জন্মালেও সিয়্যং রান্না করলেন পুত্রবধু। সকাল সাড়ে দশটার দিকে বীরপুদি চাকমা বেশ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন “বৌমা, বনভান্তে আসতেছেন। তাড়াতাড়ি ঐ পালংকের উপর একটা পাটি বিছায়ে দাও, নতুন একটা চাদর বিছায়ে দাও। সিয়্যং রান্না হলে ভান্তেকে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা কর।” তবে কোথায় ভান্তে! পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউ-ই তো দেখতে পাচ্ছেন না। তারপরও তারা পালংকের উপর পাটি বিছায়ে দিলেন, নতুন একটা ছাদর বিছায়ে দিলেন। অল্পক্ষণ পর সেখানে ভান্তের উদ্দেশ্যে সিয়্যং দিলেন যত্নসহকারে। সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে বীরপুদি চাকমা মৃদুস্বরে বলে উঠলেন—“ঐ তো, ঐ তো বনভান্তে আবার আসতেছেন”। একথা বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দিনটি ৬ই মে ১৯৮৫ ইং, ২৩শে বৈশাখ ১৩৯২ বাংলা, ২৫২৮ বুদ্ধাব্দ, রোজ সোমবার। দীর্ঘ ২৬ দিন পর্যন্ত অসুখে ভোগার পর তাঁর মৃত্যু হল।

এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বনভান্তের একনিষ্ঠ উপাসক ও প্রতিদিন বিহারে এসে ভান্তেকে সেবা প্রদানকারী, রাজমাতা আরতি রায়ের ছোট ভগ্নিপতি বাবু সমর বিজয় চাকমা বলেন, “সেদিন বনভান্তে রাজবন বিহারে সিয়্যং গ্রহণ করেন নি। প্রায় সারাদিন তাঁর রুমের ভেতর অবস্থান করেছিলেন। রুমের জানলাও বন্ধ রেখেছিলেন। শ্রামণদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন—তাঁকে যেন ডাকা না হয়। সময় হলে তিনি নিজে রুমের দরজা খুঁলেবেন। সন্ধ্যার দিকে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।” এসব ঘটনা থেকে এটা বলা যায়, বনভান্তে সেদিন মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। উল্লেখ্য যে, তাঁকে প্রব্রজ্যা গ্রহণের অনুমতি প্রদানকালে মাতৃদেবী বীরপুদি চাকমা অনুরোধ করেছিলেন—মৃত্যুর সময় যেন তোমারে দেখতে পাই। সেসময় তুমি যেখানে, যে অবস্থায় থাকেন না কেন। আর তিনিও মায়ের অনুরোধ রক্ষা করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। তাই এ’দিন অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে মায়ের সেই অনুরোধটুকু রক্ষা করলেন।

সাধু সাধু সাধু

(তথ্যসূত্র: বনভান্তের দেশনা (২য় খন্ড)—ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়া)।

সত্য ধর্ম   জাতক

সত্য ধর্ম জাতক

বারণসী রাজা ব্রম্মদত্তের সময় এক পুত্র ছিল। তার নাম ছিল দুষ্টকুমার। তার স্বভাবটা ছিল ঠিক নামের উপযুক্ত। দুষ্টকুমারের স্বভাব এতো নিষ্ঠুর ও ভীষণ ছিল যে, বারাণসী নগরের লোকেরা তাকে সব সময় ভয় করে চলত।
কারো সঙ্গে কোন কথা বলতে হলে দুষ্ট কুমার না হয় তাকে গালাগালি করত, না হয় প্রহার করত। সে রাজপুত্র বলে সবসময় মদমত্ত হয়ে চলত। কেও তার কথার উপর কোন কথা বলতে পারত না। তাকে দেখলেই সকলের মনে হত, একটা রাক্ষস জেন তাদের গ্রাস করতে আসছে।একদিন দুষ্ট কুমার জল ক্রীয়া করার জন্য অনুচরদের সঙ্গে নদী তীরে গেল। তারা নদীর জলে নেমে সকলে জল খেলায় মত্ত হয়ে উঠল। এমন সময় মেঘে মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল এবং ভীষণ জড় উঠল। নদীর ঢেউ গুলো উথাল পাতাল করতে লাগল। কুমার তার অনুচরদের বলল, তোমরা আমাকে মাঝ নদীতে স্নান করিয়ে আন।তখন অনুচরগণ নিজেদের মধ্যে যুক্তি করে বলাবলি করতে লাগল, এই সুযোগে পাপিষ্ঠ তাকে মেরে ফেলি। তারপর রাজা জা করার করবেন। এতো অত্যাচার আর সহ্য হয় না। এর হাত থেকে অন্তত নিস্তার পাই।এই বলে তারা কুমারকে ধরে মাঝনদীতে নিয়ে জলের মধ্যে ফেলে দিয়ে নিজেরা তাড়াতাড়ি জল থেকে উঠে এলো।
কুমারের যে কয়জন সচিব নদীতীরে অপেক্ষা করছিল তারা এ ব্যাপারে কিছু জানত না। তারা অনুচরদের জিজ্ঞাসা করল কুমার কথায়?অনুচরেরা বলল, ঝড়বৃষ্টি দেখে হয়ত আগেই উঠে এসেছেন, হয়ত তিনি জড় জলের মধ্যে বাড়ি চলে গেছেন।
এরপর তারা রাজ বাড়িতে সবাই ফিরে গেলে রাজা তাদের কুমারের কথা জিজ্ঞাসা করলেন।অনুচরেরা বলল, মহারাজ, জল ক্রীয়া করতে করতে দারুণ জড় জল শুরু হওয়ায় আমরা তাঁকে দেখতে না পেয়ে ভাবলাম তিনি হয়ত জল থেকে উঠে একাই বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাই আমরাও ফিরে এলাম।কিন্তু প্রাসাদে কোথাও কুমারকে পাওয়া গেল না। রাজা তৎক্ষণাৎ নিজে নদী তীরে গিয়ে চারদিকে খোঁজ করতে লাগলেন। অনুচরেরা তাঁকেও সাহায্য করতে লাগল। কিন্তু কোথাও খোঁজ পাওয়া গেল না কুমারের। তখন রাজা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।এদিকে দুষ্ট কুমার স্রোতের টানে ভেসে জেতে লাগল অসহায়ভাবে। সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগল। এমন সময় এক্তি বড় কাঠ ভেসে আসছে দেখে তার উপর চেপে বসল। পরে দেখল, একটি সাপ, একটি ইঁদুর ও একটি শুকপাখি স্রোতে ভাসতে ভাসতে সেই কাঠের উপর এসে বসল। দুষ্টু কুমার স্থির হয়ে কাঠের উপর বসে রইল। কাঠ ভেসে যেতে লাগল স্রোতের টানে। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে এল। ঐ সাপ ও ইঁদুর পূর্বজন্মে কৃপণ বণিক ছিল। এই দুই জন বণিকই তাদের জীবিতকালে প্রচুর স্বর্ণ মুদ্রা অর্থাৎ একজন চল্লিশ কোটি ও অপ্র জন ত্রিশ কোটি নদীর তীরে এক জায়গায় গর্ত করে পুঁতে রাখে। মৃত্যুর পর ঐ ধন পাহারা দেবার জন্য তাদের একজন সাপ আর তাদের একজন ইঁদুর হয়ে সেই গর্তের মধ্যে বসে তাদের ঐ গুপ্তধন পাহারা দিতে থাকে। ঝর বৃষ্টিটিতে তাদের গর্তে জল ঢোকায় তারা বাইরে এসে নদীতে পরে গিয়ে ভাসতে ভাসতে ঐ কাঠের উপর উঠে বসে। শুকপাখিটি নদীর ধারে একটি গাছে বাস করত। প্রচণ্ড ঝরে গাছটি উপড়ে পরে নদীতে পরে যায়। তখন শুকপাখিটি ঝরের মদ্যে উরতে না পারায় নদীতে ভেসে যাওয়া ঐ কাঠের উপর বসে।এইভাবে একটি কাষ্ঠখণ্ডের উপর চারটি প্রাণী এসে আশ্রয় নেয়। ক্রমে রাত্রি হল। চারিদিকে অন্ধকারে ঢেকে গেল। যে সময়ে এই ঘটনা ঘটে, সেই সময় বধিসত্ত্ব এক ব্রাক্ষণ কুলে জন্ম নিয়ে পরে সন্ন্যাসী হয়ে ঐ নদীর তীরে এক জায়গায় এক পর্ণকুটিরে বাস করতেন। সেই রাত্রিতে তখন ঝর বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় তাঁর কুটিরের সামনে ইতস্ততঃ পায়চারি করছিলেন। এমন সময় তিনি রাজকুমারের আর্তনাদ সুন্তে পেলেন। তা সুনে তিনি ভাবলেন, দয়া দাক্ষিণ্যই আমার ব্রত। আমি থাকতে কোন প্রাণীর মৃত্যু হতে দেয়া উচিত নয়। আমি ওকে উদ্ধার করব।এই সংকল্প করে বোধিসত্ত্ব তখনি নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে সেই গুঁড়িটিকে সবলে টেনে তীরের কাছে আনলেন। তারপর রাজপুত্রকে ধরে তীরে উঠিয়ে আনলেন। তখন সেই গুরির উপর আর যে তিনটি প্রাণী ছিল তাদেরকেও একে একে তীরে উঠিয়ে আনলেন।পরে তাদের প্রত্যেককে পরম যত্ন সহকারে তাঁর আশ্রমে নিয়ে এলেন। আগুন জ্বেলে প্রথমে ইতর প্রানীদের এবং পরে রাজকুমারের দেহ সেকলেন। তারপর প্রথমে সাপ, ইঁদুর ও শুককে ও পরে রাজকুমারকে ফলমূল খেতে দিলেন।বোধিসত্ত্বের আচারণে ক্রুদ্ধ হলো দুষ্টকুমার। সে ভাবল আমি রাজপুত্র, আর অরা সব ইতর প্রাণী। অথচ সন্ন্যাসী ওদের আগে সেবা করছে।এই কারণে বোধিসত্ত্বের প্রতি দুষ্ট কুমারের মনে ক্রোধের সঞ্চার হলো। যাই হক দু এক দিনের মধ্যে ওরা সকলে সুস্থ হয়ে উঠল। বন্যার জল কমে গেল।একে একে তারা সকলে বিদায় নিল। প্রথমে সাপ বিদায় নেওয়ার সময় বোধিসত্ত্বকে বলল, প্রভু আপনি আমার বড়ই উপকার করেছেন। আমুক জায়গায় আমার অনেক ধন আছে। আপনার যখন প্রয়োজন হবে আপনি ওইখানে গিয়ে দীর্ঘা বলে ডাকবেন। আপনি ডাকলেই গর্ত হতে বের হয়ে আপনাকে সব ধন দিয়ে দেব।এরপর ইঁদুরও একই কথা বলল বোধিসত্ত্বকে। আপনি প্রয়োজন হলেই ওখানে গিয়ে ইঁদুর বলে ডাকবেন। আমি দাক শূনেই বেরিয়ে এসে ধন দিয়ে দেব।শুকপাখি বিদায় নেবার সময় বলল, প্রভু আমার ধন নেই, আমি ধান দিতে পারব। প্রয়োজন হলে ঐ গাছের তলায় গিয়ে শুক বলে ডাকবেন। আমি আমার জ্ঞাতি বন্ধুদের সাহায্যে রাশি রাশি ধান সংগ্রহ করে এনে দিব।রাজপুত্র দুষ্ট কুমার মনে মনে ভাবল, যদি একবার আমি এই সন্ন্যাসী কে হাতের কাছে পাই, তবে ওকে উচিৎ শিক্ষা দেবার পর ওর প্রাণ সংহার করব।কিন্তু সে মনের ভাব গোপন করে বলল, আমি রাজপদ পেলে আপনি সময় করে পায়ের ধুলো দেবেন। আমি যথাসাধ্য উপাচারে আপনার পূজা করব।একদিন বোধিসত্ত্ব এই চার প্রাণী দের মধ্যে কে কীভাবে তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখে তা একে একে পরীক্ষা করে দেখার সংকল্প করলেন। তিনি প্রথমে সাপের কাছে গেলেন। সাপকে তিনি দীর্ঘা বলে ডাকতেই সাপ এসে সসম্ভ্রমে বলল, আপনাকে আমি এখনি আমার সব ধন এনে দিচ্ছি।বোধিসত্ত্ব বললেন এখন না, আমি প্রয়োজন হলে আসব।তারপর তিনি ইঁদুরের কাছে গেলেন। ইঁদুরকেও ইঁদুর বলে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে বলল, আমি এখনি আমার আমার সব দ্গন এনে দিচ্ছি। বোধিসত্ত্ব বললেন এখন নয়, প্রয়োজন হলে এসে তা নিয়ে যাব।
এরপর তিনি নদীর ধারে সুখপাখির কাছে গেলেন। “শুক” বলে ডাকতেই শুক এসে বলল, আপনার কি ধান দরকার? তাহলে আমি তা যোগার করে অবিলম্বে আপনার কুটিরে পোঁছে দেব।
বোধিসত্ত্ব বললেন না এখন নয়, যখন প্রয়োজন হবে আমি এসে তোমায় বলব।
সবশেষে তিনি রাজবাড়িতে যাবার জন্য বারণসী নগরের পথে রওনা হলেন।

এদিকে পিতার মৃত্যুর পর দুষ্ট কুমার তখন রাজা হয়েছিলেন। যেদিন বোধিসত্ত্ব তার কাছে যাচ্ছিলেন সেদিন সে তার হাতির পিটে চড়ে নগর প্রদক্ষিণ করছিল। সে সহসা সেই সন্ন্যাসীকে দূর থেকে দেকতে পেয়েই ভাবল, ঐ সন্ন্যাসী একদিন আমার উপকার করেছে একথা যাতে কাউকে বলতে না পারে তার জন্য আগেই তার ব্যবস্থা করতে হবে।এই ভেবে সে তার কর্মচারীদের বলল, ঐ ভণ্ড সন্ন্যাসীকে এখনি বেঁধে মশানে নিয়ে যাও। ওকে চোঁরাস্তার মোড়ে মোড়ে দাড় করিয়ে প্রহার করবে। তারপর মশানে নিয়ে গিয়ে মাথা কাটবে। তারপর ধড়টাকে শূলে চড়াবে।রাজার লোকেরা বোধিসত্ত্বকে রাস্তার চোঁমাথায় নিয়ে গিয়ে যতই প্রহার করতে লাগল, বোধিসত্ত্ব কোনরূপ প্রতিবাদ না করে একটি গাথার মধ্যে দিয়ে বলতে লাগলেন, মানুষ আর কাঠ ভেসে যাচ্ছে, লকে বলে, মানুষ ভেসে যাক, কাঠ তুলে নাও। এখন বুঝেছি কথাটা খুবই সত্য। আমি কাঠ ছেঁড়ে মানুষকে তুলে এনে ভুল করেছি। কারণ কাঠই বেশী বেশী মূল্যবান।বোধিসত্ত্বকে যখন প্রহার করা হচ্ছিল তখন রাজপথের ওপর অনেক মানুষ ভিড় জমেছিল। তাদের মধ্যে কিছু বৃদ্ধ লোক ছিলেন। বোধিসত্ত্বকে প্রহার করার সময় তিনি বারবার ঐ একই কথা বলছিলেন। এতে বৃদ্ধ লোকদের মনে সন্দেহ জাগল। তাঁরা ভাবলেন, সন্ন্যাসীর একথা বলার পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। তিনি হয়ত রাজার কোন উপকার করেছিলেন।এই ভেবে তাঁরা বোধিসত্ত্বকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি বারবার একই কথা বলছেন কেন?বোধিসত্ত্ব তখন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তিনি বললেন, একদিন সন্ধ্যার সময় এই রাজা একটি কাঠের ওপর বসে গঙ্গার স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছিলেন। তার আর্তনাদ শূনে আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে তাঁকে উদ্ধার করি। সেই কাঠের ওপর আরও তিনটি প্রাণী ছিল। তারা হল একটি সাপ, একটি ইঁদুর ও একটি শুকপাখি। আমি সকলকেই নিজের হাতে উদ্ধার করে আমার আশ্রমে নিয়ে আসি। তারপর তাদের সকলকে সেবা করে সুস্থ করে তুলি। কিন্তু ইতর প্রাণীরা মানুষের থেকে বেশি দুর্বল, তাই তাদের আগে সেবা করাই আমার উপর কুপিত হন রাজা। সেই ইতর প্রাণী তিনটি কিন্তু আজও আমার প্রতি কৃতজ্ঞ আছে। আম্র উপকারের কথা আজও ভোলেনি,আমাকে সাহায্য করতে চায়। অথচ এই রাজা আমার প্রাণ নাশ করতে উদ্যত হয়েছেন।বোধিসত্ত্বের এই কথা শূনে সেই বিজ্ঞ লোকেরা বলতে লাগ্লেন,আমাদের রাজা কিরকম দেখ। যে ব্যক্তি তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে, রাজা তাঁরই প্রাণবধ করতে যাচ্ছে। যে অকৃতজ্ঞ পিশাচ উপকারীর উপকার স্বীকার করে না, তাঁর ক্ষমা নেই। তখন সমবেত জনতা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। তখন তারা বলাবলি করতে লাগল, দুষ্ট রাজার দ্বারা আমাদের কোন কাজ হবে না, অতএব একে এক্ষনি মেরে ফেল।ওই বলে তারা তীর-ধনুক, লাঠি, বল্লম প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে আক্রমন করল রাজাকে। নগরেরে সব অধিবাসীরা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করল। রাজা প্রজাদের জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য ভয়ে পালিয়ে গেল। রাজার সেনারাও এই পাপিষ্ঠ রাজাকে রক্ষা করল না। তাছারা তাঁর ভাবল, রাজ্যের প্রজারা যদি রাজাকে না চায় তাহলে আর তাদের বশীভূত করে রাখা যাবে না।প্রজাদের এই আক্রমনে রাজা হাতির পিঠ থেকে পরে গেলেন মাটিতে। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রাণ ত্যাগ করলেন। বিক্ষুব্ধ প্রজারা রাজার মৃতদেহটাকে টেনে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দিল। তারা তখন এক বাক্যে বলল এই তপস্বী এখন হতে এই রাজ্য শাসন করবেন।প্রজারা এই বলে তখনি বোধিসত্ত্বকে রাজপ্রাসাদে যথাসময়ে নিয়ে গিয়ে রাজপদে অভিষিক্ত করল। বোধিসত্ত্ব যথাধর্ম রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন করতে লাগলেন। তিনি নিয়মিত দানাদি পুন্যকাজ করতে লাগলেন।কিছুকাল পর বোধিসত্ত্ব কয়েকজন অনুচরের সাথে প্রথমে সাপের কাছে গেলেন। তিনি গর্তের বাইরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘা বলে ডাকলেন। তখন সেই সাপ বোধিসত্ত্বকে দেখে প্রনাম করল। বোধিসত্ত্বকে সে চল্লিশ কোটি স্বর্ণ মুদ্রা এনে তাঁর হাতে দিল।এরপর ইঁদুরের কাছে গেলে ইঁদুর ত্রিশ কোটি স্বর্ণমুদ্রা এনে বোধিসত্ত্বের হাতে দিল।সবশেষে শুকপাখিকে ডাকতেই সে এসে করজর করে বলল, আমি ধন সংগ্রহ করে এনে দেব।
বোধিসত্ত্ব বললেন প্রয়োজন হলে বলব।এই ভাবে তিনি সাপ, ইঁদুর ও শুকপাখিকে তিনি রাজপ্রাসাদে নিয়ে গেলেন। তারপর তাদের পরম যত্নের সাথে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করলেন। সাপ ও ইঁদুরের জন্য শোবার গর্ত ও সুড়ঙ্গ নির্দিষ্ট করে দিলেন। আর শুকপাখির জন্য তৈরি হলো শোবার খাঁচা। সাপ ও শুকের আহারের জন্য মধু মিশ্রিত খই আর ইঁদুরের জন্য সুগন্ধি আতপ চাল যোগার করে দিলেন বোধিসত্ত্ব।এইভাবে বোধিসত্ত্ব সাপ , ইঁদুর শুকপাখি ও প্রভৃতি ইতর প্রাণীর সাথে মৈত্রী নীতির সঙ্গে দিন জাপন করতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব রাজ্যের প্রজাদের নিজ সন্তানের মত স্নেহ করতেন। অবশেষে যথাকালে ভবলীলা সংবরন করে নিজ কাজের ফলভোগের জন্য স্বর্গলোক গমন করলেন।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

 

error: Content is protected !!