মাতৃপোষক জাতক

মাতৃপোষক জাতক

পুরাকালে বারণসী রাজা ব্রম্মদত্তের সময় বোধিসত্ত্ব হস্তীকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর দেহটি শ্বেতবর্ণ ও অতি সুব্দর ছিল। তিনি আশীহাজার হাতির অধিপতি ছিলেন। বোধিসত্ত্বের মাতা অন্ধ ছিলেন। বোধিসত্ত্ব তাঁর অন্ধ মাতার জন্য নানা রকমের মিষ্টি ফল অন্য হাতিদের দিয়ে তাঁর মার কাছে পাথিয়ে দিতেন। কিন্তু তারা সেই ফল তাঁর মাকে না দিয়ে নিজেরাই খেয়ে ফেলত। তখন বোধিসত্ত্ব স্থির করলেন, তিই এবার হতে দলের আদিপত্য ত্যাগ করে অন্যকোথাও গিয়ে মার সেবা করবেন।

এই স্থির করে তিনি একদিন রাত্রিকালে অন্যান্য হাতিদের কাউকে কিছু না বলে, মাকে নিয়ে চণ্ডোরণ পর্বতের পাদদেশে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে এক সরোবরের নিকটে এক পরবত গুহায় মাকে রেখে পোষধব্রত করতে লাগলেন।

একদিন এক ধূর্ত বারাণসী বাসী সেই বনের মধ্যে এসে পথ হারিয়ে বন থেকে বার হতে না পেরে আর্তনাদ করছিল। শীলবান বোধিসত্ত্ব সেই আর্তনাদ শূনে অনুকম্পাবশতঃ লক্তির কাছে এসে বললেন, ভয় নেই, আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব। এই বলে তিনি লোকটিকে তাঁর পিঠের উপর তুলে বন হতে বের করে লোকালয়ে রেখে এলেন। ধূর্ত লোকটি পথের দুপাশের সব পর্বত ও গাছপালা চিনে রাখল।

সেই সময় বারাণসীরাজের মঙ্গল হস্তিটি মারা গিয়েছিল। রাজা নগরে ভেরী বাজিয়ে ঘোষণা করলেন, যদি কেউ আমাকে বহন করার উপযুক্ত কোন ভাল হাতি কোথাও দেখে থাকে তাহলে সে যেন আমাকে বলে যায়।

সেই ধূর্ত লোকটি এই ঘোষণার কোথা শূনে তখনি রাজার কাছে গিয়ে বলল, মহারাজ আমি এক বনে আপনাকে বহন করার উপযুক্ত সর্বাঙ্গ সুন্দর, শীলবান ও শ্বেতবর্ণের একটি হাতি দেখেছি। আপনি তাঁকে ধরে আনার জন্য গজাচার্জদের পাঠান। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।
রাজ এই কোথা শূনে তৎক্ষণাৎ বহু অনুচরসহ একজন গজাচার্জকে সেই লোকটির সঙ্গে পাথিয়ে দিলেন।

গজাচার্জ অনুচরবর্গ সেখানে গিয়ে দেখলেন, বোধিসত্ত্ব সেই সরোবরে নেমে আহার করছেন। বোধিসত্ত্ব গজাচার্জ ও তার অনুচরদের দেখে বুজতে পারলেন, সেই ধূর্ত লোকটি আমাকে ধরার জন্য এদের এখানে এনেছে। তিনি ভাবলেন আমি মহাবল। আমি ক্রুদ্ধ হলে সমস্ত সেনাবাহিনী সহ গোটা রাজ্য ধংস করে দিতে পারি। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবেনা। কিন্তু আমি ক্রুদ্ধ হয়ে বল প্রয়োগ করলে আমার শীলভঙ্গ হবে।

এইভেবে তিনি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। গজাচার্জ দেখলেন, হাতিটি সর্বসুলক্ষণযুক্ত এবং রাজার মঙ্গলহস্তী হবার উপযুক্ত। তিনি বোধিসত্ত্বের এর কাছে গিয়ে বললেন, এস পুত্র।

এই বলে তিনি তাঁর শুঁড় ধরে তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি তাঁর সঙ্গে গেলেন। গজাচার্জ তাঁকে নিয়ে বারাণসী রাজার কাছে গেলেন।
এদিকে বোধিসত্ত্বের অন্ধ মাতা পুত্রকে ফিরে আসতে না দেখে বুজতে পারলেন, রাজার লোকেরা নিশ্চয় আমার বাছাকে কোন দূর দেশে নিয়ে গেছে। এখন আমি অসহায়। আমাকে কে পোষণ করবে??

এই বলে তিনি শোকে বিলাপ করতে লাগলেন।

গজাচার্জ পথ হতে রাজাকে খবর পাঠালেন, তিনি রাজার মঙ্গলহস্তী পেয়েছেন এবং তাঁকে নিয়ে জাচ্ছেন।।

রাজা এই খবর পেয়ে সমস্ত নগর সুসজ্জিত করেছিলেন। গজাচার্জ বোধিসত্ত্বকে সুসজ্জিত ও সুবাসিত হস্তীশালায় নিয়ে গেলেন। রাজা নিজের অনেক উৎকৃষ্ট ও মধুরসযুক্ত খাদ্য এনে বোধিসত্ত্বকে খেতে দিলেন। কিন্তু বোধিসত্ত্ব মাকে ফেলে কোন খাদ্য খাবেন না বলে সঙ্কল্প করে কোন খাদ্য গ্রহন করলেন না। রাজা তাঁকে খাদ্য গ্রহন করার জন্য বারবার অনুরোধ করলে বোধিসত্ত্ব একটি গাঁথার মাধ্যমে বললেন, আমাকে না পেয়ে সেই বৃদ্ধা হস্তিনী চণ্ডোরণ পর্বতে ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করছে।

রাজা তখন জিজ্ঞাসা করলেন, কে সেই অনাথা বৃদ্ধা হস্তিনী?

বোধিসত্ত্ব বললেন, তিনি আমার জননী।, অন্ধ অসহায়।আই ছাড়া তাকে পোষণ করার কেউ নেই।

রাজা এ কথা শূনে বললেন, এই শীলবান হস্তীবড় মাতার পোষণে রত। একে মুক্ত করে দাও। এ মাতার কাছে গিয়ে তাঁর সেবা করুক।
শৃংখল্মুক্ত হয়ে তিনি রাজা কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তখনি চণ্ডোরণ পর্বতে মার কাছে চলে গেলেন। তাঁর মার তখন অনাহারে চলবার শক্তি ছিল না। তিনি গুহায় শুয়ে ছিলেন। বোধিসত্ত্ব মার কাছে গিয়ে বললেন, ওঠ মা, আর তোমার চিন্তা নেই। তোমার পুত্র ফিরে এসেছে। সুবিজ্ঞ ধার্মিক কাশীরাজ আমাকে মুক্তি দিয়েছেন তোমাকে পোষণ করার জন্য।

বোধিসত্ত্বের মাতা কাশীরাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, চিরজীবী হোক সেই রাজা। উত্তরুত্তর তাঁর শ্রী বৃদ্ধি হোক। তাঁর কৃপায় পুত্র আমার মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে।

মাতৃপোষক, মাতৃভক্ত বোধিসত্ত্বের গুনে রাজা প্রসন্ন হয়ে চণ্ডোরণ পর্বত ও সরোবরের নিকট এক গ্রাম বসালেন। সেখান হতে বোধিসত্ত্ব ও তাঁর মার জন্য খাবার পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।

কালক্রমে মাতার মৃত্যু হলে বোধিসত্ত্ব করণ্ডুক আশ্রমে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। সেখানে পাঁচশত তাপস বাস করতেন। রাজা বোধিসত্ত্বের মত তাঁদের জন্যও খাদ্য পাঠাতেন। পরে রাজা বোধিসত্ত্বের একটি শীলামূর্তি স্থাপন করে তাঁর পুঁজা করতেন প্রতিদিন।

সমস্ত জম্বুদ্বীপবাসী প্রতি বছর সেখানে সমবেত হয়ে গজোৎসব পালন করত।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

বালুকা পথ জাতক

বালুকা পথ জাতক

বোধিসত্ত্ব একবার বণিকের ঘরে জন্ম গ্রহন করেছিলেন। সেখানে তিনি বাণিজ্য করতে প্রবৃত্ত হন। তাঁর পাঁচশ গরুর গাড়ি ছিল। সেই সব গাড়িতে পণ্য বোঝাই করে নানা স্থানে বানিজ্য করে বেরাতেন তিনি।

একবার তিনি বাণিজ্যে বের হয়ে এক মরুভুমিতে প্রবেশ করেন। সেই মরুভুমির বালি এত সূক্ষ্ম ছিল যে তা হাতের মুঠোই ধরা জেত না, ধরলেই আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যেত। সুজ্র ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই বালি আগুনের মত গরম হয়ে উঠত। তার উপর ৡদিয়ে আর পথ চলা যেত না।

তাই অনন্যা পথিকের মত দিনের বেলায় এক জায়গায় শিবির খাটিয়ে বিশ্রাম করে, রাত্রিকালে পথ চলতেন। সেখানে নাবিকদের মত মরুপথিকদের রাত্রিকালে নক্ষত্র দেখে পথ চলতে হত। নক্ষত্রঙ্ক দেখে যারা পথ চিনতে পারত তাদের বলা স্থান-নিয়ামক। সব মরুযাত্রিদের দলে একজন করে স্থান-নিয়ামক থাকত।

বোধিসত্ত্বের দলেও একজন স্থান-নিয়ামক ছিলেন। সে রাত্রত্তিবেলা কোন পথে যেতে হবে তা বলে দিতেন। সেদিন বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, আজ রাতেই আমরা মরু অঞ্চল পার হয়ে যেতে পারব।

কিন্তু সেই রাত্রেই তাঁর স্থান-নিয়ামক সাম্নের গাড়িতে বসে থেকে গুমিয়ে পড়ার ফলে পথ দেখাতে পারেনি। ফলে সব গাড়িগুলো উল্টো পথ চলতে থাকে।

এদিকে সেই রাত্রিতেই মরুভুমি পার হয়ে যাবে ভেবে বোধিসত্ত্ব সন্ধার আহারের পর জল কাঠ প্রভৃতি অনেক দ্রব্য অনাবশ্যক ভেবে ফেলে দেবার আদেশ দেন।

গাড়িগুলো উল্টো পথ ধরে সারারাত চলে। ভোঁর বেলায় স্থান-নিয়ামকের ঘুম ভাঙলেই তিনি গাড়ি ঘুরাও, গাড়ি ঘুরাও বলে চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু তখন কোনও উপায় নেই। সূর্য উঠে পড়েছে। দেখা গেল যেখান থেকে তারা যাত্রা করেছিল সেইখানেই এসে পোঁছেছে।

তখন আনুচরেরা বলতে লাগল, আমরা জল, কাঠ সব ফেলে দিয়েছি। এখন আমরা কি খেয়ে বাঁচব? এই বলে বিলাপ করতে করতে আনুচরগণ গাড়ি থামিয়ে গরুগুলিকে খুলে দিয়ে হতাশ হয়ে গারিগুলর তলায় শুয়ে পড়ল।

কিন্তু চরম বিপদে ধৈ্র্য্য ধারণের অসীম ক্ষমতা ছিল বোধিসত্ত্বের। তিনি ভাবলেন, তিনি এখন নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে এতগুলি প্রানী অকালে মারা যাবে। এই ভেবে তিনি জলের সন্ধানে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে এক জাইয়গায় এক গুচ্ছ কুশ ডেকতে পেলেন। তখন তিনি বুজতে পারলেন নিশ্চয়ই এর তলায় জল আছে। তা না হলে মরুভুমিতে কুশ জন্মাতে পারে না।

এই ভেবে তিনি তাঁর অনুচরদের কোদাল দিয়ে কুয়ো খনন করতে বলেন। কিন্তু অনেক মাটি কেটে ষাট হাত নীচেও জল পাওয়া গেল না। উল্টো দেখা গেল সেইখানে মাটি নেই, শুধু পাথর। পাথরে কোদালে কোনও চোট লাগল না। বোধিসত্ত্ব তখন নীচে নেমে গিয়ে সেই পাথরের উপর কান পেতে ভিতরে জল প্রবাহ শুনতে পেলেন। বুঝতে পারলেন সেই পাথরের নীচে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে।

তখন তিনি উঠে এসে তাঁর এক যুবক ভৃত্যকে বললেন, তুমি একটা বড় হাতুড়ী নিয়ে নীচে নেমে গিয়ে পাথরের উপর ক্রমাগত ঘা মারতে থাকে। ওর তলায় জলের ধারা বয়ে যাছে। তুমি এ বিষয়ে উদ্যমহীন হলে সকলেই মারা যাবে।

যুবকটি বলিষ্ঠ ও উদ্যমশীল ছিল । অন্য সকলে হতাশ হয়ে বসে পরলে সে একা বিশেষ উৎসাহের সাথে প্রভুর আদেশ পালন করল । তখনি সেই পাথর ফেটে স্বচ্ছ জলের এক ফোয়ারা বেগে উঠে এল । তখন সকলের আনন্দ আর ধরে না । সবাই সেই জলে স্নান করল, পানের জল তুলে রাখল প্রচুর পরিমাণে । তারপর রান্নার ব্যবস্থা করল । সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু কাঠের দ্রব্য ছিল । সেগুলি চিরে জালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হল ।

খাওয়া দাওয়ার পর সন্ধার সময় তারা গন্তব্য স্থানের পথে রওনা হয়ে পড়ল । এরপর তারা যথাসময়ে বাণিজ্যস্থানে পোঁছে গেল । সেখানে বোধিসত্ত্ব তাঁর সমস্ত পণ্য দ্বিগুণ লাভে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করলেন। এইভাবে কাজ সেরে স্বদেশে ফিরে এলেন ।
কোন কাজে ব্যর্থ হয়ে জ্ঞানীজন চুপ করে বসে থাকেন না, অধ্যাবসায়ের সঙ্গে কাজ করে সাফল্য লাভ করেন ।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

মদমত্ত জাতক

মদমত্ত জাতক

বারাণসীর রাজা ব্রম্মদত্তের সময়ে বোধিসত্ত্ব একবার বাজিকরকুলে জন্মগ্রহন করেছিলেন। বড় হয়ে তিনি জ্ঞানবান ও উপায় কুশল হয়েছিলেন। সেই বাজিকরেরা গাড়ীর উপর দাঁড়িয়ে নাচত ও খেলা দেখাত।

বোধিসত্ত্ব এক বাজিকরেরকাছে শক্তিলঙ্ঘন বিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন। পরপর কয়েকটি সাজানো ধারালো অস্ত্র লাফ দিয়ে পার হবার কৌশল আয়ত্ত করে সেই খেলা দেখিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন বোধিসত্ত্ব । তাঁর বাজিকর শিক্ষক চারটি অস্ত্র লঙ্ঘনের কৌশল জানতেন।

একদিন ঐ আচার্য বাজিকর বোধিসত্তকে সঙ্গে নিয়ে কোন এক গ্রামে খেলা দেখাতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি মদের নেশায় মত্ত ছিলেন। তিনি সবাইকে বললেন, তিনি পাঁচটি অস্ত্র লঙ্ঘন করবেন। তাই তিনি পর পর পাঁচটি অস্ত্র সাজিয়ে রাখলেন।

তা দেখে বোধিসত্ত্ব আচার্যকে বললেন, আপনি পাঁচটি অস্ত্র লঙ্ঘন কৌশল জানেন না। এক্তি অস্ত্র তুলে নিন। না হলে পঞ্চম অস্ত্রের দ্বারা আপনি বিদ্ধ হবেন। তাতে আপনার মৃত্যু ঘটবে।

কিন্তু বোধিসত্ত্ব নেশার ঝোঁকে বোধিসত্ত্বের কথা সুনলেন না। তিনি বললেন তুমি আমার ক্ষমতা জান না।

এই বলে তিনি খেলা দেখাতে শুরু করলেন। তিনি চারটি অস্ত্র ভালভাবে লঙ্ঘন করলেন, কিন্তু পঞ্চম অস্ত্রটি লঙ্ঘন করতে গিয়ে তার উপর পরে গেলেন তিনি। ধারল অস্ত্রের অগ্র ভাগে তাঁর দেহটি বিদ্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু ঘটল।

বোধিসত্ত্ব তাঁর আচার্যের দেহটি তুলে সৎকার করলেন। তারপর এক্তি গাথার মাধ্যমে বললেন, আমার নিষেধ না শুনে মদ্মত্ত হয়ে পঞ্চম চেষ্টা করতে গিয়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হলো।

সুত্র ঃ জাতকসমগ্র

লোকনাথ ভিক্ষুর অসাধারণ জীবন কাহিনী

লোকনাথ ভিক্ষুর অসাধারণ জীবন কাহিনী

 

লোকনাথ ভিক্ষুর অসাধারণ জীবন কাহিনী

লিখেছেন-জ্ঞানশান্ত ভিক্ষু

অভিধর্ম শিখতে গিয়ে প্রায়ই সেয়াদের সাথে আমার এটা ওটা নিয়ে কথা হয়। কথায় কথায় তিনি বললেন লোকনাথ ভিক্ষুর কথা। লোকনাথ ভান্তে ছিলেন ইটালিয়ান। পরে তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বার্মায় আসেন। তার মৃত্যুও হয় বার্মায়। তিনি নাকি একবার এক বার্মিজ সচিবকে বলেছিলেন, গরিব লোকের সন্তান অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে ধনী হয়ে গেলে সে তখন সবকিছু যত্ন করে আগলে রাখে। কোনো কিছু নষ্ট হতে দেয় না। কিন্তু ধনী লোকের সন্তান প্রাচুর্যের মধ্যেই বড় হয়। তাই সে অঢেল সম্পত্তি পেলেও সেগুলোকে অত গুরুত্ব দেয় না। তোমরা হচ্ছো গিয়ে ধনীর সন্তান। তাই ধর্মটাকে পেয়েও অত গুরুত্ব দিচ্ছো না। আমি তোমাদের মতো ভাগ্যবান নই, বরং বড়ই গরীব। অনেক খুঁজে খুঁজে বৌদ্ধধর্মকে এই দেশে এসে খুঁজে পেয়েছি। তাই আমি এটাকে যত্ন করে আগলে রাখি। চেষ্টা করি যাতে নষ্ট না হয়।

তার কথা শুনে আপনি হয়তো মনে করতে পারেন লোকনাথ ভিক্ষু গরীব পরিবারের সন্তান ছিলেন। আপনার ধারণা ভুল। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে, ইটালির সিয়োফি নামের এক ধনী পরিবারে। তার নাম রাখা হয় সালভাদর সিয়োফি। তার ৪ বছর বয়সে সিয়োফি পরিবার আমেরিকায় পাড়ি জমায় এবং ব্রুকলিনে গিয়ে থিতু হয়। সালভাদর সেখানে ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ ও ইটালিয়ান ভাষায় কথা বলতে শেখেন। পরে তিনি একজন দক্ষ বেহালাবাদক হয়ে ওঠেন।

ছোটবেলা থেকেই সালভাদর মাংস খেতে ঘৃণা করতেন। ছোটবেলায় তিনি একটি কবুতরকে ডানা ভাঙ্গা অবস্থায় দেখতে পেয়ে সেবা শুশ্রুষা করে সেটিকে সারিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তার মা একদিন সেটিকে মেরে মাংসের ঝোল রান্না করলেন। এর প্রতিবাদে সালভাদর কয়েকদিন ধরে কোনোকিছু খেতে অস্বীকার করলেন। শেষ পর্যন্ত তার মাকে প্রতিজ্ঞা করতে হলো, আর কখনো কোনো কবুতরকে হত্যা করবেন না। তবেই সালভাদর তার অনশন ভাঙলেন। পরবর্তীতে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়েও তিনি বিভিন্ন কারণে বহুবার এমন অনশন চালিয়েছিলেন।

তরুণ বয়সে সালভাদর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন, কিন্তু তিনি ব্যাঙ ও বিড়ালদের মেরে কেটে ব্যবচ্ছেদ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। ফলে তার আর ডাক্তারি পড়া হলো না। বরং তিনি রসায়নে ডিগ্রি নিয়ে দুয়েকটা কোম্পানিতে চাকরি করলেন।

একদিন তার এক সহকর্মী তাকে অনেকগুলো বৌদ্ধ ধর্মীয় বই দিল পড়ার জন্য। সালভাদর তো রীতিমত রোমাঞ্চিত হলেন বইগুলো পেয়ে। বিশেষ করে ধর্মপদ বইটা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বইটা পড়লাম এবং বৌদ্ধ হয়ে গেলাম।’ চিন্তা করুন, এই ছোট ছোট ধর্মের পদ বা ধর্মের গাথাগুলোর এমন শক্তি যে সেগুলো অনুসন্ধিৎসু মানুষকে নিমেষেই বদলে দিতে পারে! তিনি দেখেছিলেন যে বুদ্ধের শিক্ষার একটা নৈতিক ও দার্শনিক গ্রহণযোগ্যতা আছে। আর এটি আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সহজেই খাপ খায়। তিনি বলেছিলেন, ‘নিজেকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে সবচেয়ে উচ্চস্তরের গবেষণা। আমি রসায়ন পড়েছি, যার কাজ কারবারই হচ্ছে বিভিন্ন কেমিক্যাল নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা। আর সেখান থেকে আমি এসে পৌঁছেছি বৌদ্ধধর্মে, সেই ধর্মটাও হচ্ছে বিশ্লেষণমূলক ধর্ম।’

কিন্তু তিনি বৌদ্ধধর্মে যত ঝুঁকে পড়লেন, তার পরিবারের সাথে টানাপোড়েন তত গভীর হলো। তার পরিবার ছিল রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান। তার বড় ভাই ছিলেন গির্জার পাদ্রী, যিনি পরবর্তীতে একটা প্রভাবশালী অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সালভাদর তাই বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজে আলাদা একটা এপার্টমেন্টে চলে গেলেন। আর চাকরির ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু সময় পেলেন তা নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত বইগুলো পড়তে লাগলেন।

পঁচিশ বছর বয়সে তিনি তার জীবনের গতিপথ বেছে নিলেন। বাবা-মা ও ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে তিনি পাড়ি জমালেন ইংল্যাণ্ডে, সেখান থেকে ইণ্ডিয়ায়। ইণ্ডিয়ার বুদ্ধগয়া ও সারনাথে তীর্থভ্রমণ করে তিনি চলে গেলেন শ্রীলঙ্কায়। সেখানে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষিত হলেন এবং সেখান থেকে চলে আসলেন রেঙ্গুনে। কিন্তু রেঙ্গুনের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে সমস্যা বোধ করায় তিনি আবার তার জন্মভূমি ইটালিতে ফিরে গেলেন।

ইটালিতে গিয়ে তিনি একজন চিরাচরিত বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে চলার চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি নির্জনে ধ্যান করতেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করতেন। কিন্তু ইটালিয়ান লোকজন তাদের মাঝে এরকম ভবঘুরে বৌদ্ধ ভিক্ষুকে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তাকে বার বার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে হলো। তার পরিচিতি লাভ হলো ‘নিরীহ ধর্ম পাগলা’ হিসেবে। পরে কর্তৃপক্ষ তাকে তার ইটালিয়ান আত্মীয়স্বজনের হাতে তুলে দিল এবং চীবর কেড়ে নিয়ে গৃহী পোশাক পরিয়ে দিল।

সালভাদর ভাবলেন স্থানীয় ইটালিয়ানদের মধ্যে কে তার কথা শুনবে, কে তার দুঃখ বুঝবে। সেখানে তখন ছিলেন জিওলজির প্রফেসর ও ইটালিতে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের অগ্রদূত জোসেপ ডি লরেঞ্জো। সালভাদর বিনা আমন্ত্রণেই প্রফেসরের অফিসে গিয়ে হাজির হলেন এবং একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে নিজের পরিচয় দিলেন। প্রফেসর লরেঞ্জো শুনলেন তার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের কথা, তার এশিয়া ভ্রমণের কথা এবং বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির কথা। তিনি তাকে আবার ইণ্ডিয়ায় ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন।

সালভাদরের পরিবার কিন্তু তাতে বাদ সাধল। তারা যেহেতু ইটালীর ধনী ও প্রভাবশালী পরিবার, তাই তারা কর্তৃপক্ষকে বলে দিল যেন সালভাদরকে ইটালি ত্যাগের অনুমতি না দেয়া হয়। কয়েক মাস ধরে বিরোধ চলল। সালভাদর আবারো আমরণ অনশনে নামলেন। সপ্তাহখানেক অনশন শেষে তার পরিবার ক্ষান্ত দিল এবং তিনি ইটালি ছেড়ে চলে এলেন।

বুদ্ধের রীতি অনুসরণ করে তিনি কেবল চীবর ও ভিক্ষাপাত্রকে সম্বল করে পায়ে হেঁটে ইটালি থেকে রওনা দিলেন ইণ্ডিয়ার উদ্দেশ্যে। ১৪ মাস ধরে ৫০০০ মাইল ভ্রমণ করে তিনি একে একে পেরোলেন সুইজারল্যাণ্ড, ফ্রান্স, যুগোস্লাভিয়া, গ্রীস, তুরস্ক, লেবানন, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইরাক ও ইরান। এই কষ্টকর পদযাত্রায় তিনি অসংখ্য দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ফ্রান্সের পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিল। সিরিয়ার আর্মিদের হাতে তিনি বন্দী হয়েছিলেন। আরো বহুবার তার উপর হামলা হয়েছিল, লুটপাত হয়েছিল।

একবার তিনি তুরস্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছেন, এসময় দুজন গুণ্ডা তাকে মনে করল স্পাই। তাই তারা তাকে ধরে নিয়ে গলা কেটে ফেলার হুমকি দিল। তার কাছে আত্মরক্ষার কোনো অস্ত্র ছিল না। একমাত্র ছিল গৌতম বুদ্ধের দেয়া সেই মৈত্রীর অস্ত্র। তাই তিনি মাটিতে বসে ধ্যানস্থ হলেন এবং সর্বস্ব উজাড় করে সেই লোক দুটোর উপরে মৈত্রী বিস্তার করতে লাগলেন। লোক দুটো হুমকি ধামকি দিতে লাগল, কিন্তু তিনি নিরবে মৈত্রীভাব নিয়ে রইলেন। অবশেষে তারা তাকে যেতে দিল। এই ঘটনাটা তার জীবনে গভীর দাগ কেটেছিল।

ইণ্ডিয়ায় এসে তিনি কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কান বিহারগুলোতে অবস্থান করে সেখানে শিক্ষা করতে লাগলেন এবং হিমালয়ের কাছাকাছি পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে ধ্যান করতে লাগলেন। তিনি সেখানে নিরিবিলিতে ধুতাঙ্গ চর্চা করতেন, রাতেও বসে বসেই ঘুমাতেন। এরপর রেঙ্গুনে গিয়ে তিনি নতুন করে ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা নেন। এবার তার নাম দেয়া হয় লোকনাথ ভিক্ষু।

এরপর থেকে তিনি মহাউদ্যমে ধর্ম প্রচারে নেমে পড়েন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পৃথিবীর বুদ্ধিজীবি মহল যদি বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করে, তাহলে বাদবাকি জনতা এমনিতেই তাদের পথ ধরে বৌদ্ধধর্মের ছায়াতলে চলে আসবে। এই ধারণার ভিত্তিতে তিনি বহু দেশে ধর্মপ্রচারে যান। ১৯৩৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো আমেরিকায় ধর্মপ্রচারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার জন্ম ও শিক্ষাদীক্ষা লাভ হয়েছিল পশ্চিমা দেশে। তাই বৌদ্ধধর্মকে আধুনিক, বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ধর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করতে তিনি ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তিনি ছিলেন সেব্যাপারে খুবই উৎসাহী। তিনি তার এশিয়ান ভক্তদের বলতেন, তোমরা এতদিন রবার, টিন এসব সস্তা জিনিস রপ্তানি করেছ, এবার থেকে তোমরা সবচেয়ে দামী জিনিস রপ্তানি করা শুরু করবে, আর সেটা হচ্ছে বৌদ্ধধর্ম!

কিন্তু তার এমন প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও সেবার তাকে আমেরিকায় যেতে দেয়া হয় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তৎকালীন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে ইণ্ডিয়ায় যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটকে রাখে। তবে কারাগারের মধ্যেও তিনি সেখানকার কয়েকজনকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা দেন। তিনি নিউইয়র্কে তার তিন ভাইকে মেসেজ পাঠান যেন তারা সাক্ষ্য প্রমাণ পাঠায় যে তিনি একজন আমেরিকান এবং আমেরিকায় ফিরতে চান। কিন্তু তারা তিনজনই সাফ বলে দেয় লোকনাথকে আগে খ্রিস্টান ধর্মে ফিরে যেতে হবে। লোকনাথ বৌদ্ধধর্ম ত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তাকে বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় বছর ধরে কারাবন্দী হিসেবে কঠোর দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। তবে তিনি অবশ্য পরবর্তীতে ঠিকই আমেরিকায় গিয়ে ধর্মপ্রচার করে আসেন এবং বহুজনকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন।

এদিকে ১৯৩৫ সালে ড. আম্বেদকর ঘোষণা দিলেন, ‘আমি যদিও হিন্দু হিসেবে জন্মেছি, কিন্তু হিন্দু হিসেবে আমি মরবো না।’ তা শুনে শিখ, খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মের প্রতিনিধিরা তাকে সরাসরি তাদের ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দেয়। এর পেছনে ছিল আম্বেদকরের লাখ লাখ অনুসারী। আম্বেদকর যেদিকেই যোগ দেবেন সেদিকেই তারা দল ভারী করবে।

লোকনাথ দেখলেন এক অপূর্ব সুযোগ। তিনি এবার আম্বেদকরকে বৌদ্ধধর্মে আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালালেন এবং নিজেও ব্যক্তিগতভাবে দুবার তার সাথে দেখা করে এব্যাপারে কথা বললেন। পরবর্তীতে তিনি তার অনুসারীদের মাধ্যমেও আম্বেদকরের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। অবশেষে দুই দশক পরে ১৯৫৬ সালে বার্মায় এসে আম্বেদকর বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।

লোকনাথ ভিক্ষু এভাবে বহুবছর ধরে মহাউৎসাহ নিয়ে তার ধর্মপ্রচারের কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু ১৯৬৫ সালে তার কপালে একটা ক্ষত দেখা দেয়, যা ক্যান্সারে রূপ নেয়। তিনি পরের বছর পিউলুউইন শহরে ৬৯ বছর বয়সে মারা যান।

তাই আপনারা যদি হতোদ্যমী হয়ে পড়েন তাহলে অন্তত একবার এই মহাউদ্যমী বৌদ্ধভিক্ষুর কথাটাকে স্মরণ করুন। তিনি কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, গরিব লোকের সন্তান অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে ধনী হয়ে গেলে সে তখন সবকিছু যত্ন করে আগলে রাখে। কোনো কিছু নষ্ট হতে দেয় না। কিন্তু ধনী লোকের সন্তান প্রাচুর্যের মধ্যেই বড় হয়। তাই সে অঢেল সম্পত্তি পেলেও সেগুলোকে অত গুরুত্ব দেয় না। তোমরা হচ্ছো গিয়ে ধনীর সন্তান। তাই ধর্মটাকে পেয়েও অত গুরুত্ব দিচ্ছো না। আমি তোমাদের মতো ভাগ্যবান নই, বরং বড়ই গরীব। অনেক খুঁজে খুঁজে বৌদ্ধধর্মকে এই দেশে এসে খুঁজে পেয়েছি। তাই আমি এটাকে যত্ন করে আগলে রাখি। চেষ্টা করি যাতে নষ্ট না হয়।

আসুন আমরা ধর্মটাকে যত্ন করে আগলে রাখি। সেটাকে মনেপ্রাণে চর্চা করার চেষ্টা করি। মনেপ্রাণে ধর্মচর্চা করি যাতে নিজেরও মঙ্গল হয়, অপরেরও মঙ্গল হয়। পরিশেষে সবাই সুখে শান্তিতে থাকুক এই কামনা রইল।

সুত্র ঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সংগ্রহিত ।

 

কী এতো কথা?

কী এতো কথা?

অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও পিণ্ডচারণ শেষ করে বিহারে ফিরছেন রথীন্দ্র শ্রামণ (বনভান্তে)। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে মোটামুটি সংযত দৃষ্টি ও ধীরগতিতে চলছেন। অল্পক্ষণ পর কিছু হইচই ধ্বনি তাঁর কানে আসতে লাগল। সহসা একেবারে কাছে এসে পড়ল। উল্টোদিক থেকে তিন-চার জনের একদল কিশোরী ছাত্রী, হয়ত কলেজে যাচ্ছে। অবিরাম কথা বলছে, খিলখিল করে হাসছে। কী এতো কথা! দুনিয়ার সব কথা যেন তাদের মুখে ফুটছে। আর হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এরূপ মিহি শব্দ শুনে হঠাৎ রথীন্দ্র শ্রামণের মনে ভালোলাগার একটা গোপন অনুরণন ছাড়িয়ে গেল। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন- হে ভিক্ষুগণ! আমি অন্য এক শব্দও দেখতেছি না, যা পুরুষের চিত্ত অধিকার করে থাকে, যেমন স্ত্রী শব্দ; স্ত্রী শব্দই পুরুষের চিত্ত অধিকার করে থাকে। (অঙ্গুত্তর নিকায় প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১)। রথীন্দ্র শ্রামণেন বেলায়ও তাই ঘটল। আকর্ষণের বৃত্তে ঢুকে পড়ল তাঁর মন, যদিও সচেতনভাবে টের পেলেন না। তাঁর প্রবল ইচ্ছা জাগল কিশোরীদের একটু খানি দেখার। অপ্রতিরোধ্য এক ইচ্ছার কাছে পরাভূত হয়ে পড়লেন। মাথা উচু করে তাকিয়ে দেখলেন, খুশিতে ঝলমল করে উঠা কয়েকজন ছাত্রী। মায়াময় লাবণ্যে ভরা মুখ। মুখগুলো থেকে উৎসারিত হচ্ছে মায়ার ঢেউ, মায়ার আলো। ওই আলো ফুলের মতো মেলে ধরেছে তাদের দৈহিক গড়নে। দ্রুত এগিয়ে গেল তারা। হাত এবং পায়ের গতির সঙ্গে সমান তালে চলছে ঠোঁটের গতি। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন রথীন্দ্র। তবে ততক্ষণে সেই সুন্দর মুখগুলোর আকর্ষণে মন অন্যরকম হয়ে উঠল তাঁর। বুকের ভিতর আলোড়নের ঝড় উঠল। সে ঝড় ছুঁয়ে গেল দেহের অনু-পরমাণুতে। মুহূর্তেই কাম বিতর্কে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো লাবণ্য ভরা মুখগুলো। বেশ কিছুক্ষণ কাম বিতর্কের রাজ্যে অবস্থানের পর হুঁস ফিরে আসল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে আত্ম সচেতন হয়ে উঠলেন। এ- কী! আমি এ রকম চিন্তা করছি কেন? ছি ছি! এ-যে বিনয় বিরুদ্ধ, পাপ, মহাপাপ। এই চিন্তা সামাল দিতে হবে, পরিত্যাগ করতে হবে। ফুঁসে উঠা মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। অজ্ঞানের পথে চালিত মনকে জ্ঞানের পথে ফিরিয়ে আনা উচিত এক্ষুণি। এ অবস্থায় আমাকে জয়ী হতে হবে। এই ভেবে রথীন্দ্র শ্রামণ মনে শক্তি সঞ্চার করলেন। সংযম অভ্যাসের গুণে সামলিয়ে নিলেন নিজেকে। আর হন হন করে বিহারের দিকে এগুতে থাকলেন। বিহারে এসে বুদ্ধ বিম্বের সম্মুখে করজোড়ে সে অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। অনুতপ্ত হৃদয়ে ধিক্কার দিলেন নিজেকে বারম্বার। ভবিষ্যতে সেরূপ অশ্রামণোচিত কাজ করবেন না বলে সংকল্পবদ্ধ হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, যাতে করে আর এরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। তজ্জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করবেন কামভাব জাত আসক্তিকে চিত্তে স্থান না দিতে তৎপর থাকবেন সর্বদা। চোখ বন্ধ করে শান্ত মনে উপলব্ধি করতে থাকলেন, এ দেহ সর্বত্রই অশুচি, ঘৃণিত পদার্থে ভরা। অপবিত্র, দুর্গন্ধময় বিষ্ঠা-মূত্র রয়েছে এ দেহের ভেতরে। কৃমি ও অশুচি, দুর্গন্ধবাহী চর্মের থলি যেন এ দেহ। অজ্ঞানীরা এরূপ ঘৃণিত দেহে আসক্ত হয়। কামতৃষ্ণা উৎপন্ন করে। কামাসক্তি অসি ও শূল্যের ন্যায় মহা দুঃখদায়ক, জ্বলন্ত অগ্নির ন্যায় দগ্ধকারী, মহা অনর্থকর। মুক্তি মার্গের মহা অন্তরায়। বুদ্ধ বলেছেন- ক্ষুধার্ত চণ্ডাল যেমন সম্মুখে কুকুর দেখলে হত্যা করে। তেমনি কামাসক্তিও অজ্ঞজনকে বিনষ্ট করে।

error: Content is protected !!