Paharpur Buddhist Monastery ( সোমপুর মহাবিহার )

Paharpur Buddhist Monastery ( সোমপুর মহাবিহার )

Paharpur Buddhist Monastery

written by – Labanaya Barua

Paharpur Buddhist Monastery, also known as Somopura Mahavihara (সোমপুর মহাবিহার) was a renowned intellectual center until the 12 the century. It is very important archaeological site in Bangladesh which is situated in Badalgachi Upazila under the present Naogaon district, near Rajshahi, northwestern Bangladesh. Paharpur Buddha Monastery can be called the world’s largest Buddhist temple. It was declared as a World Heritage site in 1985.

This area was named Sompur during Pala period. During this pala period, Sri Dharmapaldev (770-810AD), the second king of the Palais (Varendri-Magadha), built this monastery in the late 8th or early nineteenth century. In 1879 Sir Cunningham developed this great work.

The Paharpur Buddhist Monastery were developed for Buddhist religion’s high excellence in this pala period. In addition to various places in the Indian subcontinent, Buddhists of China, Tibet, Myanmar (earlier Burma), Malaysia, Indonesia, etc. used to come here to acquire religious knowledge. According to the history, Acharya (great scholar) Atish Dipankar lived for some time in Paharpur Buddhist monastery. His teacher Ratnakar Shamitya was the Mahasthabi (chief Pandit) of the Bihar. Ancient Carpenter Kanyapa and-and his guru, Jalandharan-pa, or Hari-Pa used to live here. After the end of the power of the Palas, this monastery became a ruin due to historical and geographical reasons.

It is a large square rectangle which is approximately 922 feet (270 meters) in north and 919 feet in the west and is composed of monks’ cells; the structure holds more than 177 rooms around the main temple. Each of these rooms is 14 feet long and 13 feet in width. The main wall of Bihar was found to be 20 feet wide. There are many smaller temples available in the enclosure. The central sanctuary has a solid ground plan which ascents in 3 terraces above ground level to a peak of 70 feet. The above-ground walls and ceilings have long been disintegrated. The area that was found intact was 280 meters in length and 278 meters wide.

The wondrous main temple is the unique architecture of the building industry. Extraordinary artistic planning. There are about 2 thousand terracotta plaques available in the wall of the temple.
It was dispersed in the anticipated reflection of the general public life of East Bengal. For example – people, hunters, dancing women, shepherds, plants, flowers, animals, elephants, horses and much more. The dramatic composition of beautiful cultural history is seen in the eyes of the eyes. Buddhist terra-cotta artwork and sacred Hindu sculptures are found in its base walls.

Reference

  • Temple, A. (2019). Paharpur Bihar, Sompur Bihar. Retrieved from https://worldheritagebd.blogspot.com/2015/05/paharpur-bihar.html
  • Centre, U. (2019). UNESCO World Heritage Centre. Retrieved from https://whc.unesco.org/
  • (2019). Retrieved from http://en.banglapedia.org/index.php?title=Main_Page
  • World Heritage Journeys Buddha. (2019). Retrieved from https://visitworldheritage.com/en/buddha
  • Buddhist archaeological sites in Bangladesh | daily sun. (2019). Retrieved from https://www.daily-sun.com/printversion/details/307344/2018/05/08/Buddhist-archaeological-sites-in-Bangladesh
বুদ্ধের ধর্ম মতে কর্ম ও কর্মফলের বিধান ও অঙ্গুলিমালের মুক্তি

বুদ্ধের ধর্ম মতে কর্ম ও কর্মফলের বিধান ও অঙ্গুলিমালের মুক্তি

বুদ্ধের ধর্ম_মতে কর্ম ও কর্মফলের বিধান ও অঙ্গুলিমালের মুক্তিঃ 
এস.জ্ঞানমিত্র ভিক্ষু, থাইল্যাণ্ড হতে

“যস্স পাপং কতং কম্মং কুসলেন পিধীযতি…. ” অর্থাৎ, পূর্বকৃত পাপকর্ম লোকোত্তর কুশল কর্ম দ্বারা আবৃত করা যায়। (থেরগাথা-পৃষ্টা ৪৩৪)

অঙ্গুলিমাল,(পিতা- গার্গ, মাতা মৈত্রায়নী) সুতরাং তিনি গার্গ-মৈত্রায়নীপুত্র নামেও অভিহিত। তিনি গুরুদক্ষিণা (১০০০ অঙ্গুলি দিয়ে গুরুপূজার জন্য) প্রদানের জন্য গুরুর অনৈতিক উপদেশে গুরুর প্রতি অন্ধভক্তি ভাবাপন্ন হয়ে বহুলোক হত্যা করেছিলেন (৯৯৯ জন মানুষ হত্যার কথা উল্লেখ নেই স্পষ্টভাবে, উল্লেখ আছে বহুলোক।)। তিনি শেষতম অঙ্গুলি সংগ্রহের জন্য বিচরণ করার সময় মাতাকে দেখে মাতৃহত্যা করে ১০০০ আঙ্গুল পূরণ করতে উদ্যত হন। এদিকে অঙ্গুলিমালের মার্গফল অর্জনের হেতু আছে জ্ঞাত হয়ে বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহার হতে অঙ্গুলিমালের নিকট শ্রাবস্তী হতে প্রায় ত্রিশযোজন দূরে (আচার্য বুদ্ধঘোষের মতে ১ যোজন=৭মাইল, সুতরাং ত্রিশ যোজন=২১০ মাইল, ১ মাইল = ১৭৬০ গজ) জালিনী বনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে ঋদ্ধি প্রদর্শন ও উপদেশ প্রদান করে অঙ্গুলিমালের বোধ উৎপন্ন করে তাঁকে ভিক্ষুত্বে দীক্ষা প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি অরহৎত্ব ফলে প্রতিষ্টিত হয়ে চির দুঃখের অবসান করেন। (থেরগাথা- ৪৩১-৪৩৩ পৃষ্ঠা)।

মাতাকে হত্যা উদ্যত হবার বিষয়টি ব্যতীত উপরিল্লিখিত বাকি বিষয়গুলো মধ্যম নিকায়ের ৮৬ নং সূত্র (দ্বিতীয় ভাগ-রাজবর্গ)-এ উল্লেখ আছে। মাতাকে হত্যা উদ্যত হবার বিষয়টি উল্লেখ না থাকার কারণ হিসেবে বলা চলে সূত্র কারোও জীবন কাহিনী বা আত্মকথন নয়। সূত্রটি কিভাবে অঙ্গুলিমাল পূর্বে প্রমত্ত থেকে শেষে অপ্রমত্ত হয়ে মার্গফল লাভ করেছিল তার উপদেশমূলক ব্যাখ্যা। আর থেরগাথা হলো থেরগণের আত্মকথন, থেরগণের জীবনীমূলক এবং তাদের মার্গফলের লাভের অনুভূতিমূলক আখ্যান।

ভিক্ষুত্বে দীক্ষা লাভের পর যখন অঙ্গুলিমাল স্থবির নগরে পিণ্ডপাতে বের হতেন তখন তাঁকে ঢিল, লাঠি ইত্যাদি ছুঁড়ে রক্তাক্ত করা হত। তিনি বিহারে ফিরলে বুদ্ধ তাঁকে বলতেন, তুমি সহ্য করো, তুমি যে পাপকর্ম করেছ, সেগুলোর ফলে অনেক হাজার বছর তোমাকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো। অথচ,তুমি -সেই কর্মফল ইহ জন্মেই ভোগ করে যাচ্ছ। (থেরগাথা- ৪৩৪ পৃষ্ঠা)।

তবে জিজ্ঞাসু ব্যক্তি প্রশ্ন করতেই পারে যে, যদি বৌদ্ধধর্মমতে কর্মের ফল ভোগ করতেই হয় আর অঙ্গুলিমাল যদি বহু মানুষ হত্যা করে তবে সেটার উপযুক্ত ফল কেন তিনি ভোগ করলেন না? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য নিন্মোক্ত অনুচ্ছেদটি পড়তে অনুরোধ রইল।

#ফল_প্রদান_অনুসারে_কর্ম_চার_প্রকার:

জীবগণ জন্ম-জন্মান্তরে কুশলাকুশল বিবিধ কর্ম সম্পাদন করে। জীবের জন্মজন্মান্তরে কৃত বিবিধ কুশলাকুশল কর্মের মধ্যে বহু কর্ম বিরুদ্ধ কর্ম শক্তি দ্বারা প্রতিহত হয়, বহু কর্মশক্তি সংস্কাররূপে মন প্রবাহে সঞ্চিত থাকে। কিছু কর্মের ফলভোগ চলমান থাকে, আর কিছু কর্ম ফল প্রদানোন্মুখ থাকে। উক্ত সকল কর্মের মধ্যে যেই কর্মশক্তিসমূহ মৃত্যুক্ষণ বা জন্মক্ষণে ফল প্রদান করে সেগুলোকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়।

(১)গুরু কর্ম- এটি কুশল ও অকুশল দুই’ই হয়। কুশল গুরুকর্ম হলো অষ্টসমাপত্তি ধ্যান চিত্ত (চার রূপ ব্রহ্মলোক ও চার অরূপ ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হবার মতোন চিত্তের অবস্থা)। এই চিত্তধারীর মন বা চিত্ত কাম, ক্রোধ, আলস্য, অবসাদ, সন্দেহ, ঔদ্ধত্য, অনুতাপ সর্বতোভাবে চিত্ত হতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং এগুলোর বিপরীত মনের অবস্থাকে জাগ্রত ও প্রতিষ্ঠিত করে।
অকুশল গুরুকর্ম হল পঞ্চ আনন্তরিক কর্ম, অর্থাৎ যেই কর্ম সম্পাদিত হলে অবশ্যই পরবর্তী জন্মে কর্মকর্তাকে নরকগামী হতে হয়। এই কর্মকে আনন্তরিক কর্ম বলার কারণ হলো এই অকুশল গুরুকর্ম সম্পাদন হলে এই কর্মের ফল প্রদান পরবর্তী জন্মেই হয় এর মধ্যে অন্য জন্মের ফাঁক নেই। এবং এটি মার্গ-ফলাদি লাভে অন্তরায়কর।

অকুশল গুরুকর্ম বা পঞ্চ আনন্তরিক কর্ম হল:
ক). মাতৃ হত্যা, খ). পিতৃ হত্যা, গ) .অরহৎহত্যা, ঘ).দ্বেষ চিত্তে বুদ্ধের পা হতে রক্তপাত ও ঙ). লোভ-দ্বেষ ও সম্মানের বশবর্তী হয়ে ভিক্ষু-সঙ্ঘের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। এই কর্ম সম্পাদিত হলে স্রোতাপত্তি বা তদুর্দ্ধ মার্গ ও ফল লাভে অন্তরায় হয়।

এছাড়া, যিনি ভিক্ষুণী দূষণ করেন তারও সেই কর্ম মার্গ-ফলাদি লাভে অন্তরায় সৃষ্টি করে। (সাধনার অন্তরায়- জ্যোতিঃপাল মহাথের, পৃষ্টা-৪)।

(২)আসন্ন কর্ম- মৃত্যুর পূর্বক্ষণে ইহজীবনীক যেই অন্তিম কুশল বা অকুশল কর্মচেতনা জীবের মনে উৎপন্ন হয় ঠিক সেই কর্মচেতনা জীবকে পরবর্তী জন্মে জন্মধারণ করায়। (বিঃদ্রঃ- আমাদের জ্ঞাতিগণের তাই উচিৎ মুমূর্ষু ব্যক্তির সম্মুখে কান্নাকাটি বা হৈ-হুল্লোড় না করে মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির অন্তরে কুশল চেতনা জাগ্রত হয় মতোন কার্য করা, যেমন- মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত কুশল কর্ম স্মরণ করানো, সূত্রাদি শ্রবণ করানো প্রভৃতি।)

(৩) আচরিত কর্ম- জীব সারা জীবন ব্যাপী যেই সকল কর্মসমূহ বেশি বেশি করে করেছে সেই কর্মগুলোকে আচরিত কর্ম বলে। এইসকল কর্ম যদি অকুশল হয় তবে মৃত্যু মুহুর্তে জীবের চিত্তে অনুতাপ উৎপন্ন হয় এবং কুশল হলে প্রীতি উৎপন্ন হয়। উপরোক্ত গুরু কর্ম ও আসন্ন কর্মের অভাবে এই আচরিত কর্মই জীবের পরবর্তী জন্ম নির্ধারণ করে। তাই সকলের উচিৎ কুশল বা সৎ কর্ম বারংবার সম্পাদন করা। এবং অকুশল কর্ম সর্বভাবেই পরিত্যাগ করা। (ধর্মপদ, পাপবর্গ ১১৮-১১৯ গাথাদ্বয় দেখুন।)

(৪) উপচিত কর্ম- জীবগণ বর্তমান ও অতীত অতীত জন্মে অনেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম করে যেগুলো বৃহৎ কর্মশক্তিদ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ঠিক পরবর্তী জন্মে ফল প্রদান করতে পারে না। কিন্তু এগুলো ক্ষুদ্র হলেও সংখ্যায় বেশি হবার দরুণ শক্তিশালী হয়ে গুরুকর্ম-আসন্নকর্ম-আচরিত কর্মের অভাবে এই উপচিত কর্মই পরবর্তী জীবনে ফল প্রদান করে।

উল্লেখ্য, গুরুকর্ম-আসন্নকর্ম-আচরিত কর্ম ঠিক পরবর্তী জীবনে একটির অভাবে অন্যটি ফল দেয়, এবং অকুশল গুরুকর্ম ছাড়া আসন্ন ও আচরিত কর্ম নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে ফল প্রদানের সামর্থ্য রাখে না। কিন্তু এই আচরিত কর্ম হতে নিষ্কৃতি পাওয়া অতীব দুষ্কর। বলা হয়েছে, জীব যে সকল কর্ম করে সেগুলোর অতি অল্পই বিরুদ্ধ কর্মশক্তিদ্বারা প্রতিহত হয় এবং এগুলো জীবের চিত্তপ্রবাহে প্রচ্ছন্ন থাকে। সুযোগ পেলেই ফল দেয়।

#_কৃত্যানুসারে_কর্ম_৪_প্রকার:

‘কর্ম’, কৃত্যানুসারে চার প্রকার, যেমন- (১)জনক কর্ম- যেটি অতীত অতীত কর্মের প্রভাবে বিভিন্ন কুশল-অকুশল কর্ম গঠন করে।

(২) উপস্তম্ভক বা সহকারী (উপকারী) কর্ম- এটি জনক কর্মকে সাহায্য করে। জনক কর্ম যদি কুশল কর্ম তৈরী করে তবে উপস্তম্ভক বা সহকারী কর্মটি সেই কুশল কর্ম বৃদ্ধিতে উপকার বা সাহায্য করে। জনক কর্ম অকুশল হলে উপস্তম্ভক বা সহকারী কর্মটি সেই অকুশল কর্ম বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

(৩) উৎপীড়ক কর্ম- অতীতের শক্তিশালী কর্মের দ্বারা এটি পূর্বোক্ত উপস্তম্ভক বা উপকারী কর্মের সাথে বিরোধ ঘটায়, বাধা দেয়, দুর্বল করে। যেমন, প্রখর রোদে কেউ ধান শুকোতে দিল বৃষ্টি এসে বাধা দিল, কোন ছাত্র পড়তে বসল কোনও বন্ধু এসে পড়তে সমস্যা সৃষ্টি করল। কারো ভাল মেধা আছে তবে আর্থিক কারণে পড়তে পারছে না। এখানে ধান শুকোনো, ছাত্রের পড়তে বসা, ছাত্রের মেধা হলো উপস্তম্ভক কর্ম আর বৃষ্টি, বন্ধুর দ্বারা ছাত্রের পড়ায় সমস্যা সৃষ্টি বা মেধাবী ছাত্রের আর্থিক অবস্থা হলো উৎপীড়ক কর্মশক্তি। উপস্তম্ভক কর্ম যদি কুশল হয় তবে এই উৎপীড়ক কর্মটি অকুশল হবে আর উপস্তম্ভক কর্ম অকুশল হলে উৎপীড়ক কর্মটি কুশল হবে।

(৪)উপঘাতক কর্ম- উপঘাতক কর্মও উৎপীড়ক কর্মের মতোন, তবে অধিক শক্তিশালী। উৎপীড়ক কর্ম শুধু বিরুদ্ধ কর্মকে বাধা দিয়ে ও দুর্বল করেই ক্ষান্ত হয়। তবে উপঘাতক কর্ম বিরুদ্ধ কর্মকে পুরোপুরি পরাজিত করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বিরুদ্ধ কর্ম অকুশল হলে উপঘাতক কর্ম সেটিকে পরাস্ত করে তা কুশলের দিকে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে বিরুদ্ধ কর্ম কুশল হলে উপঘাতক কর্ম সেটিকে পরাজিত করে অকুশলের দিকে নিয়ে যায়।

#ফলদানের_সময়_অনুসারে_চার_প্রকার_কর্ম

(১) দৃষ্টধর্ম বেদনীয় কর্ম- এই কর্ম ইহজীবনেই ফল প্রদান করে। এই জাতীয় কর্মগুলো কুশল হোক বা অকুশল হোক, যদি সেগুলো অতি নিকৃষ্ট বা অতি উৎকৃষ্ট হয় তবে এ জন্মে ফল অবশ্যই ভোগতে হয়। কিন্তু, এই কর্মগুলো যদি ইহজীবনে কোনও কারণে বিরুদ্ধ কর্মশক্তিদ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফল দিতে না পারে তবে আর কখনোই ফল প্রদান করতে পারে না; নিষ্ফলা বা বন্ধ্যা হয়ে যায়।

(২) উপপাদ্য বেদনীয় কর্ম- এই জাতীয় কর্মগুলো ঠিক পরবর্তী জন্মেই ফল দেয়। উপরোক্ত দৃষ্টধর্ম বেদনীয় কর্মের মতোন এই কর্ম যদি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বিরুদ্ধ কর্মশক্তি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তী জন্মে ফল প্রদান করতে না পারে তবে তৃতীয় জন্ম হতে আর ফল প্রদান করতে পারে না। এই কর্ম যদি কোন ব্যক্তি একাধিক করে তবে একটিই ফলদায়ী হবে বাকিগুলো ব্যর্থ বা নিষ্ফলা হবে। যেমন, দেবদত্ত সঙ্ঘভেদ ও বুদ্ধপাদ হতে রক্তপাত জাতীয় দুটি গুরুকর্ম করলেও একটি ব্যর্থ হয়ে গেছে। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে কোন ব্যক্তি যদি ১০০টিও খুন করে তবে একবারই তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা যায়।

(৩) অপরপর্যায় বেদনীয় কর্ম- জীবের তৃতীয় জন্ম হতে পূর্ণমুক্তি অর্থাৎ অরহত্ত্ব ফল লাভ করে নির্বাণ লাভ না করা অবধি এই কর্ম যখনই সুযোগ পায় তখনই ফল প্রদান করে। এ জাতীয় অকুশল কর্মকে উপলক্ষ্য করেই বুদ্ধ বলেছেন, আকাশ, সমুদ্র, পর্বতগুহা যে স্থানেই জীব অবস্থান করুক না কেন কর্মের ফল হতে নিস্তার নেই। (ধর্মপদ-পাপবর্গ-১২৭ নং গাথা)।

(৪) অহোসি কর্ম- যে সকল কুশল বা অকুশল কর্মগুলো বিরুদ্ধ কর্মশক্তি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত বা দুর্বল হয়ে ফল প্রদান করতে না পেরে নিষ্ফলা হয়ে যায়, বন্ধ্যা হয়ে যায় সে সকল কর্ম সমূহকে অহোসি কর্ম বলে। ‘অহোসি’ শব্দের অর্থ হলো একদা ফল প্রদানের শক্তি ছিল কিন্তু কারণবশতঃ দুর্বল বা ফলহীন হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, পূর্বোক্ত, অপরপর্যায় বেদনীয় কর্ম ও অকুশল গুরুকর্ম বাদে অন্যান্য কর্মগুলো যথাসময়ে ফল প্রদান করতে না পারলে ফলহীন বা নিষ্ফলা হয়ে যায়। এভাবে ১২ প্রকার ভাগে কর্মকে বিভাজিত করা হয়েছে।

অঙ্গুলিমাল যেহেতু পঞ্চ আনন্তরিক কর্ম করেন নি, তাই তিনি পূর্ব অরহত্ত্ব লাভের হেতু বশতঃ, বুদ্ধের সরাসরি উপদেশে, শক্তিশালী পারমীর গুণে ইহজীবনের কৃত অকুশল কর্মকে পরাজিত করেন এবং অরহত্ত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হন। আর, অরহৎ-এর পুনর্জন্ম নেই, তদ্বেতু তিনি লঘু ফল ভোগ করেছিলেন। কর্মগুলো ফল পূর্ণাঙ্গরূপে দিতে না পেরে অনেকটাই অহোসি কর্মে পরিণত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যদি অঙ্গুলিমাল মাতৃ হত্যা বা তৎজাতীয় অকুশল গুরুকর্ম করতো তবে তিনি অরহত্ত্ব ফল লাভ তো করতোই না বরঞ্চ নরক গমন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়তো।

উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, মগধরাজ অজাতশত্রুর পূর্ব মার্গফল লাভের হেতু থাকা সত্ত্বেও পিতা বিম্বিসারকে হত্যার মত গুরু অকুশল কর্ম করায় তিনি ইহজীবনেই পুত্র উদায়িভদ্রের হাতে নিহত হয়ে দৃষ্টধর্মবেদনীয় কর্মফল যেমন ভোগ করেন তদ্রুপ গুরুকর্মের অবশ্যম্ভাবী ফলসরূপ মৃত্যুর মত নিরয়গামী হয়েছিলেন।

#সহায়ক_গ্রন্থ:
১. কর্মতত্ত্ব-শ্রী জ্যোতিঃপাল স্থবির, ২.থেরগাথা,
৩. ধর্মপদ, শ্রী ধর্মাধার মহাস্থবির, ৪. অজাতশত্রু- শ্রী শীলালংকার স্থবির।

গৌতম বুদ্ধঃ জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও পরিনির্বাণ

গৌতম বুদ্ধঃ জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও পরিনির্বাণ

গৌতম বুদ্ধ দেবতা নন, ঈশ্বর প্রেরিত মানবও নন। তাঁর মহানতা ঐশী দান নয়। তিনি কঠোর সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেন। এটি বুদ্ধের একান্তই স্বোপার্জন। বুদ্ধ বলেছেন, ‘‘মানবজন্ম অনেক পূণ্যের ফল- তাই ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই ধর্ম।’’ প্রাচীন ভারতবর্ষে বা জম্বুদ্বীপে অঙ্গ, মগধ, কাশী, কোসল, বজ্জী, মল্ল, চেতী, বৎসা, কুরু, পঞ্চাল, মচ্ছ, সূরসেন, অস্সক, অবন্তী, গান্ধার ও কম্বোজ নামে ১৬টি রাজ্য ছিল। কোসল রাজ্যের অধীনে শাক্য নামে একটি প্রদেশ ছিল যার রাজধানী ছিল কপিলাবস্ত্ত। এ প্রদেশের রাজা শুদ্ধোধন বায়ান্ন বছর পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। রাণীর নাম মায়াদেবী। তিনি আবার পার্শ্ববর্তী কোলীয় রাজ্যের রাজকুমারী। আষাঢ়ী পূর্ণিমার শেষ প্রহরে রানী মায়াদেবী স্বপ্নে দেখলেন- স্বর্গ থেকে চার দেবতা এসে তাঁর রত্নপালঙ্ক তুলে হিমালয় পর্বতের এক মনোরম স্থানে রাখলেন। মানস সরোবরে তিনি স্নান সারলেন। একটু দূরে রৌপ্যময় পর্বতের সুবর্ণ অট্টালিকায় দেবতারা তাঁকে নিয়ে গেলেন। পূর্বদিকে শিয়র রেখে তিনি শুয়ে পড়লেন, এমন সময় এক শ্বেত হস্তী কপালে তার সিন্দুরের মতো টিপ, দ্বিতীয়ার চাঁদের ন্যায় বাঁকা বাঁকা কচি দুটি দাঁত, সে যেন হিমালয়ের ওপার থেকে মেঘের ওপর দিয়ে এসে তার শুঁড়ের শ্বেতপদ্মটি রাণীর কোলে এনে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রানীর দেহমনে অনিবর্চনীয় এক আনন্দশিহরণ হয়ে গেল। অতঃপর সব কোথায় যেন মিলিয়ে গেল আর কিছু দেখতে পেলেন না। রাণীর স্বপ্ন ভাঙ্গার সাথে সাথে ভোর হলে তাঁর স্বপ্ন বৃত্তান্ত স্বামীকে অবহিত করলেন। রাজা সঙ্গে সঙ্গে রাজজ্যোতিষী ডেকে স্বপ্নের কারণ জানতে চাইলেন। জ্যাতিষীরা মহারানী পুত্রবতী হতে চলেছেন বলে রাজাকে শুভ সংবাদ দিলেন। জ্যোতিষীরা আরো বললেন, ভূমিষ্ঠতব্য শিশুর শরীরে মহাপুরুষের বত্রিশটি লক্ষণ বিদ্যমান বিধায় আপনার পুত্র কালে যশস্বী মহাপুরুষ হবেন। সূর্যস্বপ্নে রাজপুত্র মহাতেজস্বী হয়। শ্বেত হস্তীর স্বপ্নে শান্ত গম্ভীর জগৎ-দুর্লভ এবং জীবের দুঃখহারী মহাধার্মিক ও মহাজ্ঞানী পুত্রলাভ। এক মহাপুরুষ শাক্যবংশে জন্ম নেবেন।
গৌতম ককোসান্দ বুদ্ধের সময়ে রাজা খেমা, কোনাগমন বুদ্ধের সময়ে মিথিলায় ক্ষত্রিয় (Chatriya) বংশের পববতা দেন (Pabbata then) আর কাস্যপ বুদ্ধের সময়ে জতিপালা নামে এক ব্র্রাহ্মিন যুবক হিসেবে বোধিসত্ত্ব জীবনে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গৌতম বুদ্ধের অনুসারী। তিনি ২৮ তম বুদ্ধ। বুদ্ধ মতে গৌতম বুদ্ধের আগে আরো ২৭ বুদ্ধ ছিলেন। এ বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে ৪ বুদ্ধ এবং কোটি কোটি বছর আগে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের আরো ২৪ বুদ্ধ ছিলেন। গৌতম বুদ্ধ জীবদ্দশাই নিজেই বলেছেন এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে তিনিই শেষ বুদ্ধ নন। কথিত আছে, মায়াদেবী গৌতম জন্মের আগে পিত্রালয়ে যাবার ইচ্ছা পোষণ করলে রাজা সেমতে সব ব্যবস্থা করেন। কপিলাবস্ত্ত থেকে মায়াদেবীর পিত্রালয় দেবদহ পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা পতাকা, মঙ্গলঘট ইত্যাদি দিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো হয়। রাণী সাড়ম্বরে রাজপালকিতে চড়ে পিতৃগৃহে চলতে থাকলেন। যাবার পথে কপিলাবস্ত্ত থেকে কয়েক মাইল দূরে নেপালের লুম্বিনী নামক শালবনে খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ জন্ম লাভ করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। গৌতম ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে ডান হাতের আঙ্গুল উত্তোলন করে বলেছিলেন, ‘‘অগ্গো হসস্মি, জেটিঠা, হমম্মি, অয়মন্তিমা জতি, নত্থি দানি পুনবভবো’তি’’। অর্থাৎ “আমি অগ্র, আমি শ্রেষ্ঠ, ইহাই অন্তিম জন্ম। এরপর আর জন্ম হবে না’’। কথিত আছে, কুমার সিদ্ধার্থ হয় গৃহত্যাগী হয়ে বুদ্ধ হবেন নতুবা সংসারী হয়ে রাজচক্রবর্তী সম্রাট হয়ে রাজ্য শাসন করবেন। পরে লুম্বিনী কানন থেকে নবজাত শিশুসহ শোভাযাত্রা সহকারে মায়াদেবী মনের সুখে কপিলাবস্ত্ততে প্রত্যাবর্তন করলেন। রাজা শুদ্ধোধন রাজপুত্রের নাম রাখেন সিদ্ধার্থ। পরে গৌতম নামেও তিনি অভিহিত হন। ছোট বেলা থেকে গৌতম বিদ্যাশিক্ষা শুরু করেন। অতি অল্প বয়সে ক্ষত্রিয়দের নানাবিধ অস্ত্রবিদ্যাও তিনি পারদর্শী হয়ে যান। খেলাধুলা ও কৃষিকাজেও তিনি অন্যান্য সমবয়সীদের চেয়ে অভাবনীয় দক্ষ হয়ে যান। পিতার সাথে হল-কর্ষণ উৎসবে গিয়ে মাঝে মাঝে আনমনে ধ্যানমগ্ন হয়ে যান। কাকতালীয়ভাবে সিদ্ধার্থ, য়শোধারা, ভালো দ্রব্যে ভরা কলসী (চার নিধি-কুম্ভ), আনন্দ, অশ্বরাজ কন্ঠা (কন্ঠক), সারথি ছন্দক, কালুদায়ী (উদায়ী) নামে এক অমাত্য ও বুদ্ধগয়ার মহাবোধি বৃক্ষ একই দিনে জন্ম নেয়।
ছোটবেলা থেকে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ সংসারের প্রতি উদাসীন ও চিন্তাশীল ছিলেন। রাজপুত্র বড় হয়ে যে সংসারত্যাগী হবেন রাজা শুদ্ধোধন তা আগে থেকে জানতেন। তাই পার্শ্ববর্তী কোলিয় রাজ্যের অপরূপ সুন্দরী রাজকুমারী (মামাতো বোন) য়শোধারা’র সাথে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিয়ে দেন। ২৯ বছর বয়সে গৌতম পুত্র সন্তানের জনক হন। পিতা কর্তৃক পুত্রের নাম রাখা হয় রাহুল। পুত্র রাহুল জন্মের পর সিদ্ধার্থ ভাবলেন, বড় হলে রাহুল তাঁকে সংসার জালে আবদ্ধ করে দুঃখ কষ্টে নিমজ্জিত করবে। একদিন সিদ্ধার্থ নগর পরিভ্রমণে বৃদ্ধ, রোগী, মৃতদেহ ও সন্ন্যাসী এ চার দৃশ্য অবলোকন করে সংসারের প্রতি বিরাগী হয়ে যান। বলা যায় তখন থেকে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৃহ ত্যাগের মনস্থির করে ফেলেন। পুত্র রাহুলের জন্মের দিন (মতান্তরে সাত দিন পরে) রাজপুত্র সিদ্ধার্থ খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৪ অব্দে আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে সারথী ছন্দককে সঙ্গে নিয়ে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন। সেদিন ছিল সোমবার। প্রাসাদ ত্যাগের পূর্বে প্রিয়তমা স্ত্রীর কক্ষে গিয়ে এক নজর পুত্রকে দেখে নেন। ঘুমের মধ্যেও মা নিজ শিশুকে কিভাবে বুকের মধ্যে আগলে রেখে মায়াজালে জড়িয়ে রাখছে এ দৃশ্যটি অবলোকন করতে সিদ্ধার্থের মন কিছুক্ষণের জন্য হলেও বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। অশ্বরাজ কণ্ঠকের পিঠে আরোহণ করে অশ্বানুচর সারথি ছন্দক অশ্ব লেজ ধরে যাচ্ছিলেন। দেবতারাই তাদের যাবার জন্য নগরদ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন বলে ‘নিদান কথায়’ উল্লেখ রয়েছে। শাক্য ও কোলীয় রাজ্য অতিক্রম করে মল্ল রাজ্যও অতিক্রম করেন। কাউকে না জানিয়ে রাজপ্রাসাদ পরিত্যাগ করে মল্ল রাজ্যের প্রান্তসীমা দিয়ে প্রবাহিত রামগ্রামের অনোমা নদীর তীরে শেষ রাতে তাঁরা পৌঁছেন। এসময় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ রাজপোষাকসহ সমস্ত রাজঅলংকারাদি ছন্দকের নিকট জমা দিয়ে কণ্ঠক ও ছন্দককে বিদায় দিয়ে বহনকৃত রাজ তরবারি দিয়ে নিজের চুল ছেদন করে শূন্যে নিক্ষেপ করে দেন। ঘটিকারা নামক এক ব্রহ্ম এ সময় রাজপুত্রকে চীবর দান করেন। গৌতমের প্রিয় অশ্ব কন্ঠক রাজপুত্রের এহেন বিদায় সহ্য করতে না পেরে সেখানে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ফেলেন। ভগ্নমনে সারথি ছন্দক রাজধানী কপিলাবস্ত্ততে প্রত্যাবর্তন করে রাজপ্রাসাদে সংবাদটি প্রচার করলে রাজপ্রাসাদে অবধারিতভাবে কান্নাররোল নেমে আসে। তিনি মগধের রাজধানী রাজগৃহের দিকে যাত্রা করলেন। যাত্রাপথে কপিলাবস্ত্তর মন্ত্রী ও রাজপুরোহিতের সাথে দেখা হয়ে যায়। তাঁরা রাজপুত্রকে প্রাসাদে ফিরিয়ে যাবার নিস্ফল চেষ্টা করে। সে সময়ে রাজগৃহ ছিল সাধু-সন্ন্যাসীদের আবাসস্থল। প্রথমে পান্ডব পর্বত, পরে গৃধকুট পর্বতে গিয়েও অভিষ্ট সিদ্ধির কোন উপায় না দেখে সিদ্ধার্থ বন জঙ্গল পেরিয়ে নদী, নদী পেরিয়ে বনরাজি-পাহাড় পর্বতে যেতে থাকেন। পাহাড় ধারে বনের সংকীর্ণ রাস্তা। সাত দিন সাত রাত পেরিয়ে গৌতম বৈশালী নগরের জটাধারী ঋষি আলাড় কালামের আশ্রমে পৌঁছে ধ্যান-সাধনা শিক্ষা গ্রহণ করলেন। ঋষি আলাড় কালাম সমাধির সাতটি স্তর শিষ্যদের শিক্ষা দিতেন। সিদ্ধার্থ গৌতম ধ্যানের প্রথম স্তরসহ দর্শন ও ধর্মশাস্ত্র আলাড় কালামের নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এ সময় মগধরাজ অপুত্রক বিম্বিসার গৌতমকে রাজ্যের কিছু অংশ রাজত্ব করার অনুরোধ জানান। রাজা বিম্বিসার সিদ্ধার্থের চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট। নিজ রাজ্য ও রাজলোভ পরিত্যাগ করে ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জন্য এখানে আগমন বিধায় গৌতমকে কোন লোভ লালসার পরিব্যাপ্ত হতে পারল না। রাজা বিম্বিসার পুত্রলাভের আশায় হাজার পাঁঠা বলি দিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করতে যাচ্ছিলেন। ছাগলের মা মা (মেৎ-মেৎ) আর্তস্বরে কান্না শুনে সিদ্ধার্থ মগধরাজ বিম্বিসারকে পুত্র লাভের আশায় পশু বলি দিতে বারণ করেন। সিদ্ধার্থের অনুরোধে সাড়া দিয়ে রাজা বিম্বিসার মগধ রাজ্যে পশুবলি না দেয়ার ঘোষণা করেন। রত্নগিরি গুহা থেকে সিদ্ধার্থ গৌতম ধ্যান লাভোত্তর অদ্বিতীয় পন্ডিত বনে গেলেন। তারপরও গৌতমের এহেন জ্ঞান লাভের তৃপ্ত না হওয়ায় পরবর্তীতে আলাড় কালামের চেয়ে জ্ঞানী আচার্য ঋষি উদ্দক রামপুত্র (রুদ্রক) এর নিকট কিছুকাল ধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রাচীন ভারতের শ্রাবস্তির আশ্রমে রুদ্রক নিজের উপলব্ধ সত্যজ্ঞান ও উচ্চতর সাধন শিক্ষা দিতেন। শিক্ষার জন্য আরো কিছু সঞ্চিত আছে কিনা এরূপ গৌতমের প্রশ্নের জবাব দিতে রুদ্রক ব্যর্থ হওয়ায় গৌতম জ্ঞানমার্গে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার নিমিত্তে একা জ্ঞানার্জনের জন্য উরুবেলার জনবিরল গহীন বন-জঙ্গলে বেড়িয়ে পড়েন। গৌতম একা জ্ঞান অর্জনের জন্য এক বন থেকে আর এক বন, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য ভ্রমণ করতে থাকেন। দিনে দিনে তাঁর জ্ঞান ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। নৈরঞ্জনার নদীর সাথে গৌতমের সম্পর্ক পাঁচ বছরেরও অধিক। নদীর পাশে একাকীর ধ্যানের সময় ঋষি আলাড় কালামের তিন শিষ্য কৌন্ডিণ্য, বপ্পা ও অশ্বজিৎ এবং ঋষি উদ্দক রামপুত্রের দু’শিষ্য মহানাম ও ভদ্দিয় এসে যোগ দেয়। তাঁরা গৌতমকে গুরুর ন্যায় সেবা শুশ্রুষা করতে থাকে। তাঁদের সাহচর্যে সিদ্ধার্থ গৌতম কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন। ধীরে ধীরে গৌতমের শরীর জরাশীর্ণ বিবর্ণ হতে থাকল। কৌন্ডিণ্য পূর্বের নাম ছিল সুদত্ত। আটজন জ্যোতিষীর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কৌন্ডিণ্যই রাজা শুদ্ধোধনকে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিলেন যে, একদিন গৌতম সংসারের মায়া পরিত্যাগ করে ভবিষ্যতে অবশ্যই বুদ্ধ হবেন। অপর জ্যেষ্ঠ সাতজন জ্যোতিষী গৌতমকে রাজা বা সন্ন্যাসী/বু্দ্ধ হবেন মর্মে ভবিষ্যৎবাণি করেছিলেন। কঠোর ধ্যান সাধনা কেবলই শরীর কষ্ট, এহেন ধ্যানে কোন বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ না হওয়ায় সিদ্ধার্থ গৌতম চলমান কঠিন পথ পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে লাগলেন। একদিন ভিক্ষান্নের উদ্দেশ্যে সেনানীর গ্রামে প্রবেশ মুখে ন্যাগ্রোধ বৃক্ষমূলে বিশ্রামকালে সিদ্ধার্থ গৌতম ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। উক্ত এলাকার বিত্তশালীর বনিকের সুজাতা (নন্দবালা) নাম্মী সতী সাধ্বী এক পতিব্রতা নারী বৃক্ষ দেবতাকে পূজা দেয়ার মানসে পায়সান্ন দিয়ে বৃক্ষতলে সশরীরে উপস্থিত হয়। সুজাতা কুমারী থাকা অবস্থায় জাতিকুল সম্পন্ন উপযুক্ত বরের সাথে বিয়োত্তর প্রথম গর্ভে যদি পুত্র সন্তান হয় তাহলে উক্ত বৃক্ষ দেবতাকে পূজা দেয়ার বিষয়ে মানত করেছিলেন। যথাসময়ে সুজাতার মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ায় তিনি পায়সান্ন দিয়ে বৃক্ষ দেবতাকে পূজা অর্পণকালে প্রত্যুষে বৃক্ষতলে ধ্যানমগ্ন একজন সন্ন্যাসীকে (সিদ্ধার্থ গৌতম) দেখতে পান। সুজাতা পুত্রের নাম য়াশ। য়াশ পরবর্তীতে বুদ্ধের শিষ্য গ্রহণ করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। সুজাতা মনের আনন্দে বহনকৃত পায়সান্ন পাত্র (পায়েস/গানানঁ ছোওয়েন) গৌতমের হস্তে অর্পণ করে নিগর্মন হন। পরে সিদ্ধার্থ নৈরঞ্জনার নদীতে স্নানান্তে নদীর কিনারায় পায়সান্ন গ্রহণ করলেন। এ দৃশ্য দূর থেকে পাঁচশিষ্য অবলোকন পূর্বক অপরিচিত নারী হতে অন্ন গ্রহণ সিদ্ধার্থের এহেন মধ্যপন্থা অবলম্বনে পাঁচ শিষ্য বিরক্ত ও সন্দিহান হয়ে তাঁকে পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন। পায়েস গ্রহণোত্তর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সিদ্ধার্থ নদীরপারে বনের ধারে পশ্চিমদিকে বিরাট এক অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে তৃণাসন পেতে পূর্বমুখী হয়ে বসে পড়লেন। দৃঢ় সংকল্প হয়ে পালি ভাষায় উচ্চারণ করলেন,
‘‘ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থি মাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্প দুর্লভং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে’’।।
বঙ্গানুবাদ – এ আসনে আমার শরীর শুকিয়ে যাক, ত্বক-অস্থিমাংস ধ্বংস প্রাপ্ত হোক, তথাপি অপ্রাপ্ত বহুকল্পে দুর্লভ বোধিজ্ঞান লাভ না করা পর্যন্ত আমার এ দেহ এ আসন ত্যাগ করে উঠবে না।
এহেন কঠিন সংকল্পের মাঝেও গৌতমের মনে ক্ষণে ক্ষণে প্রিয়তমা স্ত্রী য়শোধরা ও পুত্রধন রাহুলের মায়াবী চেহারা তাঁর বারংবার মানসপটে ভেসে আসে। কখনোবা রাজপ্রাসাদে শোকার্ত পিতা, আত্মীয় স্বজন ও সহচরদের চেহারা তাঁকে ফের সংসার জীবনের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। পুরুষ সিংহ সিদ্ধার্থের মন অটল থেকে দৃঢ়কন্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘‘হিমালয় পর্বত স্থানচ্যুত হতে পারে, ত্রিভুবন শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে, আকাশের সমস্ত নক্ষত্র ধূলায় লুঠাতে পারে, মহাসমুদ্রের জলরাশি শুকিয়ে যেতে পারে- তথাপি আমি আমার সংকল্প থেকে তিলমাত্র বিচলিত হব না। আমার প্রতিজ্ঞা সুমেরুর মত অটল. সূর্যের মত স্থির এবং বজ্রের মত কঠিন।’’
‘মেঁহ্ নেৎ’/Mara (Demon) নামে অসুর বিশেষ অপদেবতা গৌতমের ধ্যান ধ্বংসের জন্য সর্বদা অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। তিনি সসৈন্যে সিদ্ধার্থের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য নানাবিধ অপচেষ্টা চালাতে থাকে। মার ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অবসাদ, ভীতি, সন্দেহ ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ করেও সিদ্ধার্থের ধ্যান ভাঙ্গতে পারল না। তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল। মার অর্থ নির্বাণের বিপরীত কখনো কখনো জাগতিক অস্তিত্ব/ পুনর্জম্মের স্থানকে বুঝায়। মার বুদ্ধের তপোবিঘ্নকারক। মার বিষয়ে চুল্লনিদ্দেসে বলা হয়েছে, ‘‘কম্মাভিসঙ্খার- বসেন পটিসন্ধিকো খন্ধমারো, ধাতুমারো, আসতনমারো।’’ অসৎ প্রকৃতির মার অপদেবতা স্বীয় পুত্র-কন্যাসহ দলবল নিয়ে অনেক ভয় ও প্রলোভন দেখিয়েও গৌতমের ধ্যান ভগ্ন করতে সক্ষম হননি। নানা ছদ্মবেশে গৌতমের ধ্যান স্থলে উপস্থিত হয়ে বুদ্ধত্ব লাভে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।
তথাগত বুদ্ধ ভারতে বিহার প্রদেশে বুদ্ধগয়ায় মহাবোধিবৃক্ষ হতে প্রায় ৭০ ফুট পূর্বে এসে অজপল নামক অন্য আর এক বটবৃক্ষের নিচে বসে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। ৫ম সপ্তাহে (অজপাল সপ্তাহ) ধ্যান সাধনার সময় মারের নির্দেশে তারই অপরূপা পরমী সুন্দরী তিনকন্যা যথাক্রমে তান্-হা (তৃষ্ণা)/Tanha, আ-র-তি (রতি)/Arati ও রা-গা (প্রীতি)/Raga হৃদয় নিংড়ানো উত্তেজক পোষাক পরিধান করে নেচে গেয়ে গৌতমকে রিপু (Sex) আক্রমণ করার উদ্যত্ত হলেও তিনকন্যা কোনভাবে সফলকাম হতে পারেনি। এ সময়ে গৌতম বিশাল গুণের অধিকারী ছিলেন। ইচ্ছা করলে তিনি নিজেকে পাঁচশত ফুট উচু বা তার চেয়ে কোটির গুণ উচ্চতা সম্পন্ন মানব বনে যেতে পারেন। মারের মেয়েত্রয় বুদ্ধের সংষ্পর্শ পাওয়ার দূরের কথা বরং তারা তুলার মতে বাতাসে উড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। তান্-হা অপরূপ রূপের অধিকারিণী ও প্রেমাকাঙ্খী (Craving), আ-র-তি তীব্র আবেদনময়ী ও ছলনাময়ী, (Boredom) আর রা-গা অত্যন্ত কামুক, ভাবাবেগ ও যৌনকাঙ্খী (Passion) কামদেব মারের তিন মেয়ে। মোহরূপ অলঙ্কারে বিভূষিতা রতি সংসারের বিবিধ সুখের বর্ণনাসহ ধ্যানমগ্ন গৌতমকে এপথ থেকে পরিহার করে তার সাথে যাবার জন্য প্রলোভন পূর্বক বিমোহিত করে যাচ্ছিল। ঘুমমগ্ন ব্যক্তি যেমন কারো কথা শুনতে পায় না, ধ্যানমগ্ন গৌতমও রতি’র কোন কথা শুনতে পেলেন না। রতি’র কথা শেষ হতে না হতেই তৃঞ্চা ও প্রীতি এসে তারাও নানা প্রলোভন দেখাতে লাগল। কৃতাঞ্জলিপুটে তারা গৌতমকে বলল, ‘‘হে ভগবান, আমরা আপনার আশ্রয়ে আগমন করেছি। আপনি আমাদের প্রবজ্যাধর্ম প্রদান করুন। আপনার কথা শ্রবণে আমরা গৃহস্থ্যধর্ম ত্যাগ করে সুবর্ণপুর হতে এ স্থানে আগমন করেছি। আমরা কন্দর্পের দুহিতা। আমাদের পাঁচশত ভ্রাতা, তারাও সদ্ধম গ্রহণ করতে উৎসুক। আপনি বৈরাগ্য অবলম্বন করেছেন, অতএব আমি ও আমার ভগিনীগণ, আমরা সকলেই আজ বিধবা হলাম।’’ মারের তিন ছেলের নাম বিভ্রম, হর্ষ ও দর্প। গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক মার বিজয়ের বর্ণনা মূল সুত্তনিপাতের পধান সুত্ত (প্রধান সূত্রে)-এ বর্ণনা রয়েছে। এছাড়া কাশ্মিরী কবি ক্ষেমঙ্কর রচিত ‘ললিতবিস্তর’ নামক গ্রন্থেও এসব বর্ণনা রয়েছে।
তথাগত বুদ্ধ রিপুকে জয় করেন। মার জয় করে তিনি সিদ্ধ হয়েছেন। বুদ্ধ হয়েছেন, দুঃখের শেষ দেখেছেন। মারকে বৌদ্ধ শয়তান বা পারসিদের অমঙ্গল দেবতা অহ্রিমান বলা যায়। তার আর এক নাম কামদেব। যে ইন্দ্রিয়দ্বার দ্বারা মনুষ্য শরীরে প্রবেশ করে এ মার কামাদি রিপুসকুল উত্তেজিত করেন। গৌতম বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে ও পরে এ মার নানাভাবে বুদ্ধকে উত্তেজিত করেছিল। এ বিষয়ে পরে গৌতম বুদ্ধ শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘‘হে ভিক্ষুগণ, ‘মার’ এইরূপ তোমাদের ছিদ্রান্বেষণে ফিরিতেছে- তোমাদের চক্ষুদ্বার, কর্ণদ্বার, নাসিকা, জিহবা দেহ-মনোদ্বার কখন কোন দরজা খোলা পায় সেই অবসর খুঁজিতেছে, সন্ধি পাইলেই প্রবেশ করিবে। অতএব সাবধান! ইন্দ্রিয়দ্বারের উপর নিয়ত প্রহরী নিযুক্ত রাখ, তাহা হইলে পাপাত্মা ‘মার’ বিফল-প্রযত্ন হইয়া তোমাদের ছাড়িয়া দূরে যাইবে, শৃগাল যেমন কচ্ছপ হইতে দূরে যাইতে বাধ্য হইয়াছিল।’’ দুখের কারণ-তৃষ্ণাকে তিনি ক্ষয় করেছেন। তৃষ্ণা থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, তৃষ্ণার প্রভাবেই জীবজগৎ চক্রবৎ বিশ্বে ঘুরছে।
গৌতম ছয় বছর কঠোর তপস্যা ও সাধনার পর খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে বুদ্ধগয়ার নিকটে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। সেদিন ছিল বুধবার। বৃক্ষটি পরবর্তীতে বোধিধ্রুম বা বোধিবৃক্ষ নামে পরিচিত লাভ করে। বৈশাখী পূর্ণিমার প্রথম প্রহরে সিদ্ধার্থ গৌতম পূর্ব জীবনের কথা পরিজ্ঞাত হলেন, দ্বিতীয় প্রহরে দিব্যচক্ষু লাভ করলেন, তৃতীয় প্রহরে দর্শন করলেন ভবচক্র (প্রতীত্য সমুৎপাদবাদ) ও চতুর্থ প্রহরে সর্বজ্ঞতা লাভ করে অর্হত্ব লাভ করেছিলেন। তিনি তখন বুদ্ধ। গৌতম বুদ্ধ। অনাথপিন্ডের মাধ্যমে সুজাতা পরবর্তীতে বুদ্ধের সান্নিধ্য পান। তিনি বুদ্ধের নিকট থেকে সাত প্রকার স্ত্রীর বর্ণনা অবগত হন। সাত প্রকার স্ত্রী হচ্ছে- ভীমা উগ্রচন্ডা (অসতী স্ত্রী), কুটিলা কলহপ্রিয়া, প্রিয়ম্বদা (পতিব্রতা সতী স্ত্রী), সুশীলা, সুগৃহিনী, প্রিয়সখী ও সেবিকা। বুদ্ধের প্রশ্নের জবাবে সুজাতা নিজেকে পতিব্রতা সতী স্ত্রীর মত হবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। পূর্ব কোন এক জন্মে সুজাতা ছিলেন থিংজেমাং নামে এক রাজার নাতনি। নাম ছিল গা না চিং। তাঁর বাবার নাম ওয়েছেনডারা। রাজপুত্র ওয়েছেনডারা ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও দানশীল। তিনি একদিন রাজ্যের অমূল্য সম্পদ ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত শ্বেত হস্তি একজন ভিক্ষা চাইলে তিনি মুক্তমনে দান করে দেন। রাজা ঘটনাটি অবহিত হয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের ছেলেকে পরিবারসহ রাজ্য থেকে বহিস্কার করেন। রাজপুত্র ওয়ে ছেন ডারা নির্বাসনে থাকাবস্থায় জ-তা-ঘা পুনা নামে ৭০ বছরের এক সন্ন্যাসী ভিক্ষা চাইলে নিজের অতিপ্রিয় বড় ছেলে জা লি ও ছোট মেয়ে গা না চিং-কে মুক্তমনে দান করে দেন। রাজপুত্র কর্তৃক সন্ন্যাসীকে দু’ হাত জোড়ে নিবেদন করা হয় যে, তার বুকের ধন দু’ছেলেমেয়েকে যেন নির্যাতন করা না হয়। ১৭ বছরের ঋষির সহধর্মিণী তার বাসায় কাজের ছেলে মেয়ে রাখার মানসে অবুঝ ও শান্তশিষ্ট দু’ভাইবোনকে সন্ন্যাসী রাজপুত্র থেকে দান গ্রহণের এ প্রচেষ্টা। অকৃতজ্ঞ, লোভী ও বরখেলাপকারী জ-তা-ঘা পুনা অত্যন্ত নির্দয়ভাবে নির্যাতনক্রমে জালি ও গানাচিং-কে তাঁর অলস বউ এর নিকট নিয়ে যাওয়ার পথে দেবলোক থেকে দেবতারা অবলোকন করে ফেলেন। দেবতারা জ তা গা পুনা-কে নিজ বাড়িতে না নিয়ে জালি ও গানাচিং পিতামহ’র রাজপ্রাসাদের দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। রাজা থিং জে মাং জ-তা-ঘা পুনা থেকে উচ্চমূল্যে জালি ও গানাচিং-কে ক্রয় করে ফেলেন। রাজপ্রাসাদে অসহায় জালি ও গানাচিং এর সাথে আলাপচারিতায় তাদের বাবার পরিচয় পাওয়ার পর রাজা জেনে যায় যে, জালি ও গানাচিং আর কেউ নয়, তাঁরই আপন নাতি-নাতনি।
সর্বজীবের প্রতি মৈত্রী ও করুণার জন্য বুদ্ধের অপর নাম মহাকারুণিক। অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎ বিষয়ে অবহিত বলেই তাঁর নাম তথাগত। গৌতম শাক্য বংশের জন্ম বিধায় তাঁকে আবার শাক্যসিংহ বলে। বুদ্ধত্ব লাভের পর তাঁর নাম হয় শাক্যমুনি। জাপানীরা বুদ্ধকে শাক্যমুনী বলে। বুদ্ধ ছিলেন এক বিষ্ময়কর মহামানব। এমন অসামান্য, অনুপম ও বিরল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মহাপুরুষ বিশ্বে কদাচিৎ জন্মগ্রহণ করে। তিনি অমৃতলোক বা মহাশক্তি নির্বাণের পথ প্রদর্শক ও অরি ধ্বংসকারী অর্হৎ। তিনি বলেছেন, ‘‘ন মে আচরিয়ো অত্থি, সদিমো মে ন বিজ্জতি।’’ অর্থাৎ আমার কোন আচার্য নেই, দেব মনুষ্যলোকে আমার সদৃশ কেহ বিদ্যমান নেই। সাধনাক্রমে অর্জিত জ্ঞান বুদ্ধ নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বিশ্বেও সর্বজীবের মঙ্গলের জন্য তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রত্যেকের মধ্যে বুদ্ধ হবার মহান শক্তি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। এ সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করার দায়িত্বও মানুষের নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইচ্ছা করলে মানুষ উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারে আবার নিজকে অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যেতে পারে।’’ প্রত্যেক মানবে এ সুপ্ত সম্ভাবনা ও অপরিসীম শক্তির কথা ভগবান বুদ্ধ প্রথম ঘোষণা করেন।
বুদ্ধত্ব লাভের পর তথাগত বুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৮ থেকে ৫৪৪ অব্দ পর্যন্ত ভারত বর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর সিদ্ধার্থের বোধিসত্ত্ব জীবনের পরিসমাপ্তি হয়। তিনি লাভ করেন নির্বাণ মার্গের তত্ত্ব ও জন্ম জন্মান্তরের সমস্ত কাহিনী। তিনি আরো লাভ করেন চারি আর্যসত্য (The four noble truths) t
১) দুঃখ আর্যসত্য (Suffering)
২) দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য (Cause of suffering)
৩) দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য ( Decay of suffering)
৪) দুঃখ নিরোধকারী আর্যসত্য (The way that leads to the decay of suffering) এবং এর অন্তর্গত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ ( The Noble Eight-fold Path) নিম্নরূপঃ
১) সম্যক দৃষ্টি (Right Perspective)
২) সম্যক সংকল্প (Right Aspiration)
৩) সম্যক বাক্য (Right Speech)
৪) সম্যক কর্ম (Right Action)
৫) সম্যক আজীব বা জীবিকা (Right Livelihood)
৬) সম্যক ব্যায়াম বা উদ্যম বা প্রযত্ন (Right Effort)
৭) সম্যক স্মৃতি (Right Mindfulness) ও
৮) সম্যক সমাধি (Right Concentration)।
বুদ্ধ বলেছেন, ‘‘চতুসচ্চং বিনিমুত্তং ধম্মং নাম নত্থি’’। অর্থাৎ এ চার আর্যসত্য ছাড়া অন্য কোন ধর্ম বিদ্যমান নাই। এ চার আর্যসত্যকে সম্যকভাবে জানলে কেবল দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। মানব, দেব, ব্রহ্মা ও রাক্ষসকূলে সৎ, ধার্মিক, চরিত্রবান, পরোপকারী, কৃতজ্ঞ ও আন্তরিকতাপূর্ণ যেমন আছে তেমন অসৎ, অধার্মিক, চরিত্রহীন, পরক্ষতিকারী, অকৃতজ্ঞ ও আন্তরিকতাহীন মানব, দেব, ব্রহ্ম নিশ্চয় ছিল। গৌতম বুদ্ধ ২৯ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত বুদ্ধত্ব লাভের নিমিত্তে গভীর ধ্যানমগ্ন থাকাবস্থায় অসুর লোক (Asura) থেকে পৃথিবীতে এসে ‘আলা ওয়াকা বেলু:’ (আলা ওয়াকা রাক্ষস) নামে এক অসুর (রাক্ষস) গৌতমের ধ্যান ভগ্ন করার জন্য প্রাণপণ অপচেষ্টা করেছিল। জরাজীর্ণ দেহ দিয়ে দৈত্যাকৃতি বলবান এক রাক্ষসের সাথে গৌতমকে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে হয়নি। গৌতম তাঁর ধ্যান থেকে অর্জিত জ্ঞান ও শক্তি দিয়ে ‘আলা ওয়াকা’ রাক্ষসকে পরাজিত করে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন।
বুদ্ধের এই নব ধর্ম ও মার্গ ফল প্রথম প্রচার করেন তাঁর পঞ্চশিষ্য কৌন্ডিণ্য, ভদ্রজিৎ, (ভদ্দিয়), বাষ্প (বপ্পা), মহানাম ও অশ্বজিৎ। কৌন্ডিণ্যই বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্ব সর্বপ্রথম অবহিত হন। বৌদ্ধ ধর্মে এঁরা পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু নামে পরিচিত। বৌদ্ধ দর্শনের মূল সুর অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্মা পৃথিবীর সবকিছুই অনিত্য। দুঃখই সত্য, আত্মা বলে স্থিত কিছু নেই। অদৃশ্য কোন কিছুর প্রতি, অলৌকিক কিছুকে বুদ্ধ বিশ্বাস করতে বলেননি। এমনকি তাঁর ধর্মমতকে তিনি পারাপারের ভেলা হিসেবে তুলনা করেছেন। গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মের নাম বৌদ্ধ ধর্ম। এ ধর্মে কোন জাতিভেদ নেই। অহিংসা পরম ধর্মই হচ্ছে এ ধর্মের মূলকথা। গৌতম বুদ্ধ সাধারণ মানুষদের পঞ্চশীল (The Five Precepts) পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন। পঞ্চশীল হচ্ছে, জীব হত্যা না করা (Avoid killing or harming), চুরি না করা (Avoid stealing), কামে বশীভূত না হওয়া (Avoid Sexual misconduct), মিথ্যা না বলা (Avoid Lying) ও মদ্যাসক্ত না হওয়া (Avoid alcohol & other intoxacating drugs)। তথাগত বুদ্ধ এক জন্মের পুণ্যফলে বুদ্ধ হন নাই। এক জন্মের কর্মফলে কেউ সম্যকবুদ্ধ হতে পারেন না। গৌতম বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব বা বুদ্ধাঙ্কুররূপে কোটিকল্পকাল মানুষ, দেবতা, পশু পাখিসহ অসংখ্য যোনিতে জন্মজন্মান্তর গ্রহণ করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধত লাভের জন্য বুদ্ধকে জন্ম-জন্মান্তর ব্যাপী সাধনা করতে হয়েছে। দশ পারমী যথা- দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, প্রজ্ঞা, বীর্য, ক্ষান্তি, সত্য, অধিষ্ঠান (দৃঢ় প্রত্যয়), মৈত্রী ও উপেক্ষা পরিপূর্ণ করেই বুদ্ধত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রত্যেক পারমী আবার উপ-পারমী ও পরমার্থ পারমীভেদে তিন ভাগে বিভক্ত। ৩০ পারমী পরিপূর্ণ ব্যতীত বুদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। বুদ্ধ বলেন, ‘‘সবেব সত্তা কম্মম্মাকা’’ অর্থাৎ সকল প্রাণী স্বকৃত কর্মেই সৃষ্টি। বৌদ্ধমতে জগৎ অনাদি-অনন্ত। এ অনন্ত জগতে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা হলেন অবিদ্যা বা তৃষ্ণা। এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড জাত বা অজাত নহে। সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বীরা বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার বলে মানেন। তাই তারা বুদ্ধকে ‘ভগবান বুদ্ধ’ বা ‘বু্দ্ধদেব’ বলে। গৌতম বুদ্ধ ভগবান নয়, উনি দেবতাও নন। গৌতম বুদ্ধ অবতার নন, তিনি মানব। তবে সাধারণ মানব নন। এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে জন্মগ্রহণকারী একজন মহামানব।
বৌদ্ধ ধর্মের নিম্নোক্ত চারি দানের কথা প্রচলিত রয়েছে।
ক) ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ/সংস্কার ;
খ) বৌদ্ধদের চার মহা-তীর্থস্থানে কাউকে প্রবজ্যা/উপসম্পদা করা;
গ) সংঘ দান তথা দুস্থদের অন্ন দান ও
ঘ) ঔষধ সামগ্রী দান।
উল্লিখিত চারি দানের মধ্যে কোনটি সর্বোত্তম এ বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নাই। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সাধ্যানুযায়ী এসব দান করে পূণ্যবান হতে পারেন বৈকি!
গৌতম বুদ্ধ ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভের পর ৪৫ বছর স্বয়ং ও তাঁর অনুসারীদের দিয়ে ধর্ম প্রচার করেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মের মধ্যে প্রধানত সকল ভেদাভেদ ভুলে সদাচারণ, সর্বজীবে দয়া, সংযম, শীল, নির্বাণ, শৃংখলা, ধর্মশিক্ষা, ধর্মোপদেশ, অহিংসা বাণি ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারত বর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক জাতিগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত ও অনেক জাতিগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। ঋষিপতনে (সারনাথ) প্রথম বর্ষাবাস, রাজগৃহে (রাজগীর) ৩ বারে ৫ বর্ষাবাস, বৈশালীতে পঞ্চম ও সর্বশেষ অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশতম বর্ষাবাস কাটান। এছাড়া বিহারের মংকুল পর্বত, তাবতিংশ স্বর্গ (ত্রয়োন্ত্রিংশ স্বর্গ), সুৎসুমার গিরি (চুনার), কৌশাম্বী (এলাহাবাদ), পারিল্যেয়্যক (মির্জাপুর), নালা (বিহার), বৈরঞ্জা (কনোজ-মথুরার মাঠ), কপিলাবস্ত্ত (নেপাল), আলবী (অরবল) এলাকায় ১ বর্ষাবাস করে ভগবান বুদ্ধ অতিবাহিত করেন। বিহারের চালিয় পর্বতে ৩ বারে ৩ বর্ষাবাস ও শ্রাবস্তিতে চৌদ্দতম বর্ষাবাসসহ একনাগাড়ে একবিংশ থেকে চুয়াল্লিশতম অর্থাৎ ২৩ বর্ষাবাস (মৌসুমী বিশ্রাম) অতিবাহিত করেন।
বু্দ্ধ মতে পৃথিবীর আদিও নেই, অন্তও নেই। পৃথিবী ছিল, আছে এবং থাকবে। কালের বিবর্তনে ও বিপর্যয়ে পৃথিবীর রূপান্তর হয় মাত্র। সৌর মন্ডলের প্রভাবে অগ্নি, বায়ু, পানি ইত্যাদি ওলট পালটের কারণে পৃথিবীর সব সৃষ্টি এক সময় ধ্বংস হয়, পরে আবার গড়ে ওঠে। ত্রিপিটকের সুত্ত পিটকে ‘অগ্গঞঞ সূত্রে’ মানব জাতির সুচণাকাল তথা ক্রমবিকাশের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। উক্ত বর্ণনায় সংসার চক্রের তথা পৃথিবীর সূচণাকে কার্যকারণ বা হেতু প্রবাহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অপধাতু, তেজধাতু, বায়ুধাতু ও ভূমিধাতুর সমন্বয়ে এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সূচণা হয় এবং কালের পরিক্রমায় নানাবিধ কারণে সমস্ত সৃষ্টি আবার ঐসব ধাতুর প্রভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, কেউ সৃষ্টি করতে আসেন না, ধ্বংস করতেও আসেন না। জাগতিক প্রক্রিয়ায় জাগতিক ধাতু সমূহের কারণেই এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড বা পৃথিবী সৃষ্টি হয়- ধ্বংস হয়। যাকে পালিতে ‘পটিচ্চ সমুপ্পদ’ বা হেতু প্রত্যয় কারণ বলা হয়ে থাকে। কোন কারণে এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড বা পৃথিবী ধ্বংস হলে নতুন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে ফের প্রাণী কিভাবে সৃষ্টি হয় এসব প্রশ্নের জবাবে বৌদ্ধ মত হচ্ছে, চারিধাতু বা যে কোনটির কারণে পৃথিবীর প্রাণী বা উদ্ভিদ ধ্বংস হলে এক সময় এ জগতে আর কিছুই থাকে না। দেবলোক, ব্রহ্মলোক পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে এমন কিছু ব্রহ্মলোক বিদ্যমান থাকে যাঁরা ধ্বংস হয় না। সেখান থেকে সত্ত্বগণচ্যুত হয়ে নতুন পৃথিবী গঠিত হলে মর্ত্যলোকে কর্মানুযায়ী জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে পৃথিবীতে কোন উদ্ভিদ থাকে না। ব্রহ্মলোক হতে জন্মগ্রহণকৃত ব্যক্তিগণের নারী পুরুষ চিন্তা ভাবনা থাকে না। এ ব্রহ্মসত্ত্বগণই পৃথিবীর আদি বাসিন্দা।
বুদ্ধের মতে মৈত্রী হচ্ছে সকল প্রাণীর প্রতি কল্যাণ কামনায় ব্রতী হওয়া। বুদ্ধ মৈত্রীর বিষয়ে বলেছিলেন, ‘‘মা যেমন তার স্বীয় একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে বিপথ থেকে রক্ষা করে, তদ্রুপ সব প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী প্রদর্শন করে।’’ এহেন মৈত্রী শত্রুকে মিত্র আর দূরের মানুষকে নিকটে আনয়ন করার একমাত্র ধারক ও বাহক। মৈত্রীই বিশ্বভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সৌহার্দ্য ও নৈকট্য গড়ে তোলার চাবিকাঠি। এর মাধ্যমে স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, আত্মকেন্দ্রিকতা দূর হয়। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও পন্ডিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গৌতম বুদ্ধকে ‘পৃথিবীর প্রথম সাম্যবতার’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র এ প্রসঙ্গে আরো লেখেন, ‘‘তখন বিশুদ্ধাত্মা শাক্যসিংহ অনন্তকালস্থায়ী মহিমা বিস্তার পূর্বক, ভারতাকাশে উদিত হইয়া, দিগন্ত প্রধাবিত রূপে বলিলেন-আমি উদ্ধার করিব। আমি তোমাদিগকে উদ্ধারের বীজমন্ত্র দিতেছি, তোমরা সেই মন্ত্রসাধন কর। তোমরা সবাই সমান। ব্রাহ্মণ-শূদ্র সমান। মনুষ্যে মনুষ্যে সকলেই সমান। সকলেই পাপী। সকলেরই উদ্ধার সদাচরণে। বর্ণ বৈষম্য মিথ্যা। সুখ মিথ্যা, কে রাজা-কে প্রজা, সব মিথ্যা। ধর্মই সত্য। মিথ্যা ত্যাগ করিয়া সকলেই সত্যধর্ম পালন কর।’’
তথাগত বুদ্ধ যুক্তির অনুশীলনে বিশ্বমানবের মধ্যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, ক্ষমা, অহিংসা, শান্তি ও কল্যাণের বাণি ছড়িয়েছিলেন। মানবে মানবে ভেদাভেদ ঘোচাতে সাম্য মৈত্রীর কথা প্রচার করেছেন। মানুষে মানুষে সংঘাত, দ্বন্দ্ব, অন্ধ কুসংস্কার, জাতিভেদ ইত্যাদি অন্যায় অবিচার বিষয়ে গৌতম বুদ্ধ প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি মনে প্রাণে চেয়েছিলেন সব মানুষ সকল মানুষকে ভালবাসবে। পরস্পরের প্রতি কেবলই কল্যাণ কামনা করে। সব মানুষের কল্যাণ, সমগ্র জাতির শান্তি এটিই ছিল বুদ্ধের বাণি ও দর্শনের মূলকথা। বুদ্ধ যে দর্শন প্রচার করেছিলেন মানবকল্যাণে সেটি হচ্ছে মানবধর্ম। তিনি ইহলৌকিক মানবের জীবনধারার প্রবহমানতায় পাপ-পূণ্যেও সীমারেখা নির্ধারণ করেছেন। তাঁর অনুসারী ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘‘চরথ ভিক্খবে চারিকং বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়/লোকানুকম্পায় অত্তায় হিতায় সুখায় দেবমনুসানং’’। অর্থাৎ হে ভিক্ষুগণ! বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, দেবতা ও মানুষের কল্যাণের জন্য তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর। তোমরা সদধর্ম প্রচার কর। যার আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ ও অন্তে কল্যাণ যা অর্থযুক্ত, ব্যঞ্জনযুক্ত ও পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রচার কর। ভগবান বুদ্ধই প্রথম প্রচার করেন যে, এক অখন্ড সমাজ ও পৃথিবীর সব মানব এক অবিচ্ছেদ্য পরম আত্মীয়তার সূত্রে গ্রথিত। বু্দ্ধ বলেছেন, ‘‘ নহি বেরেন বেরানি সম্মাম্ভীধ কুদাচনং/অবেরেণ চ সম্মন্তি এস ধম্মো সনন্তনো।’’ অর্থাৎ বৈরিতার দ্বারা বৈরিতা, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতা কখনো প্রশমিত হয় না। অবৈরিতা ও মৈত্রী দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়। হিংসাকে হিংসা দ্বারা জয় করা যায় না। অহিংসা দিয়েই হিংসাকে জয় করতে হয়। আগুনকে আগুন দিয়ে যেমন নেভানো যায় না, তেমনি অসাধুতাকে সাধুতার প্রভাবে জয় করাটাই চিরন্তন সত্য ধর্ম।
পাবানগরে স্বর্ণকারের পুত্র চুন্দ আমন্ত্রণে বুদ্ধ সশিষ্য তাঁর বাসভবনে মধ্যাহ্ন আহার সারেন। চুন্দ নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যের সাথে শূকরের মাংসও স্বহস্তে বুদ্ধকে পরিবেশন করেন। বুদ্ধের সময়ে ভিক্ষুসংঘকে শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি কর্তৃক প্রদেয় সর্বপ্রকার আহার্য গ্রহণ করার প্রথা ছিল। বুদ্ধ কখনো মাংস খেতেন না। তারপরও সেদিন নিজে শূকরের মাংস (শুকুরমদ্দব) গ্রহণ করে অন্য ভিক্ষুদেরকে না খেতে বারণ করেন। অনভ্যস্ত খাবার খেয়ে বুদ্ধ আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে কুশীনগরের দিকে যাত্রাপথে এক বৃক্ষ ছায়ায় বিশ্রাম নেন। সেবক আনন্দ তখন জল এনে দিয়ে বুদ্ধের তৃষ্ণা নিবারণ করেন। গৌতম বুদ্ধ তখন অশীতিপর বৃদ্ধ। তখন বুদ্ধকে সেবা শুশ্রূষা করার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রধান সেবক আনন্দ নিয়োজিত ছিলেন। বুদ্ধ ৮০ বছর বয়সে যে পরিনির্বাণ লাভ করবেন তিনি তা আগে থেকে জানতেন। সেবক আনন্দ গৌতম বুদ্ধের আপন চাচাতো ভাই আর বুদ্ধের যেদিন জন্ম আনন্দের জন্মও একই দিবসে। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, প্রখর জ্ঞান সম্পন্ন ও শ্রুতিধর ছিলেন। বুদ্ধ যেথায় যেতেন সেবক আনন্দকে সর্বদা সাথে নিতেন। একদিন বুদ্ধ উপস্থিত শিষ্যসহ আনন্দকে বলেছিলেন ‘‘আনন্দ তুমি আমার সেবা শুশ্রূষা করছ, আর্শীবাদ করি তোমার কল্যাণ হউক। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ধর্মপথে চল, বিষয়াশক্তি, অহমিকা, অবিদ্যা হতে পরিত্রাণ পাবে। যতদিন আমার শিষ্যেরা শুদ্ধাচারী হয়ে সত্যপথে চলবে, ততদিন আমার ধর্ম এ বিশ্বে প্রচলিত থাকবে। পাঁচ সহস্র বৎসর পরে যখন সত্যজ্যোতিঃ সংশয় মেঘজাল আচ্ছন্ন হবে, তখন যোগ্যকালে অন্যতম বুদ্ধ উদিত হয়ে আমার উপদিষ্ট ধর্ম পুনরায় উদ্ধার করবে।’’ শিষ্যরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘সে বুদ্ধের নাম কি হবে?’’ বুদ্ধ উত্তরে বললেন, ‘‘মৈত্রেয় বুদ্ধ’’। মৈত্রেয় (সংস্কৃত-Maitreya, পালি- Matteyya) এখন তুশিতা স্বর্গে (Tusita Heaven) বোধিসত্ত্ব হয়ে ধ্যানরত আছেন। মৈত্রেয় মাত্র সাত দিনের ধ্যান ও তপশ্যায় এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে ভারতের বিহার প্রদেশে বুদ্বগয়ায় শালবন বৃক্ষের নিচে বুদ্ধত্ব লাভ করবেন। বৌদ্ধদের ন্যায় বাহাই ধর্মাবলম্বীরাও ভবিষ্যতে যে কোন সময় মৈত্রেয় বুদ্ধ আবির্ভাবের তথ্যটি বিশ্বাস করে থাকেন। গৌতম বুদ্ধ এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে জন্মাবার পূর্বে তুশিতা স্বর্গে বাস করেছিলেন। কিছু বোধিসত্ত্বও বুদ্ধ হওয়ার পূর্বে তুশিতা স্বর্গে বাস করেছিলেন। মৈত্রেয় বুদ্ধের প্রতিমূর্তি ২য় শতাব্দীতে মথুরা যাদুঘরে, ৩য় শতাব্দীতে গান্ধারায়, ৪-৫ম শতাব্দীতে কোরিয়ায়, ৭-৮ম শতাব্দীতে আফগানিস্তানের তাপা সরদারে (গজনী) টেম্পারার দেয়ালচিত্রে দেখা যায়। ছবিটি নষ্ট হওয়ায় পুনঃ অঙ্কিত করা হয়। ১৯৭০ সালে ইতালির আর্কিওলজিক্যাল (Archaeological) মিশন এ বিষয়ে কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে। বিভিন্ন বাস্তব বৈশিষ্ট্যগত সমন্বিত ঘটনার মাধ্যমে এ বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে শেষ বুদ্ধ মৈত্রেয় বুদ্ধের আগমন ঘটবে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে (মতান্তরে ৫৪৪, এটি বুদ্ধগয়ায় উৎকীর্ণ আছে) গৌতম বুদ্ধ ৮০ বছর বয়সে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে কুশীনারার মল্লদের শালবনে পরিনির্বাণ লাভ করেন। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। বৌদ্ধদের চার-মহাতীর্থ স্থানের কুশিনারা বা কুশীনগর অন্যতম। প্রাচীনকালে কুশীনগর হিরণ্যতীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছিল। তখন কুশীনগর ছিল মল্ল রাজ্যের রাজধানী। এলাকাটি বর্তমান অবস্থান ভারতের উত্তর প্রদেশের গোরঙ্গপুর জেলার কোশিয়া এলাকায়। দুই যমক শাল তরুর মধ্যখানে সিংহ শয্যায় শায়িত হয়ে বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভ করেন। মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত ভিক্ষুসংঘের নিকট বুদ্ধের শেষ বাণি ছিল, ‘‘হন্দদানি ভিকখবে আমন্তযামী বো, বয় ধম্মা সঙ্খরা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা’তি।’’ ভিক্ষুগণ! আমি তোমাদেরকে সম্বোধন করে বলছি যে, সংস্কার ধর্মসমূহ একান্ত ক্ষয়শীল, অনিত্য। তোমরা অপ্রমাদ বা সম্যক স্মৃতির সাথে সকল কর্তব্য সম্পাদন করবে। বুদ্ধ ৪৫ বছরের দেশিত ধর্মোপদেশ সমূহ অপ্রমাদ শব্দের দ্বারা প্রকাশ করেছিলেন। অপ্রমাদ শব্দের অর্থ সম্যক স্মৃতি চর্চা, বিদর্শন ভাবনা। যে কেউ বিদর্শন ভাবনা নিবিড়ভাবে অনুশীলন করলে অনিত্য দুঃখ ও অনাত্ম জীবনের এ ত্রি-লক্ষণ অতি সহজে অবহিত হবেন। জগতে যা কিছু উৎপন্ন তা সবই অনিত্য, পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল। জগতে কোন কিছুই স্থায়ী নয়। মহাকারুণিক বুদ্ধের রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এ পঞ্চস্কন্ধময় দেহও এক সময় বিলীন হয়ে যায়।
বুদ্ধের পরিনির্বাণের বছর থেকে যে সালের গণনা শুরু হয় তাকে বুদ্ধাব্দ বলে। বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভের তিন মাস পরে রাজগৃহের নিকটবর্তী সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথম মহাসংগীতি (1st Buddhist Council) অনুষ্ঠিত হয়। বিহার প্রদেশের বুদ্ধগয়া থেকে ৭৮ কিলোমিটার ও নালন্দা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে রাজগৃহ (রাজগীর) অবস্থিত। মগধরাজ অজাতশত্রু’র পৃষ্ঠপোষকতায় মহাকাশ্যপ পুরোহিতের সভাপতিত্বে ৫০০ অর্হৎ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে রাজগৃহের বৈভোর পাহাড়ের উত্তরে সপ্তপর্ণী’র গুহার সম্মুখে মহাসংগীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মহাকারুনিক ও তথাগত বুদ্ধের দেহাবশেষ কুশিনারার মল্লরা এক ভাগ, মগধের রাজা অজাতশত্রু এক ভাগ, এভাবে বজ্জী রাজ্যের রাজধানী বৈশালীর লিচ্ছবিরা, কপিলাবস্ত্তর শাক্যরা, অল্পকল্পের বুলিরা, রামগ্রাহের কেলিয়রা, পাবার মল্লরা ও বেথদীপের বুলিয়গণ (এক বাসিন্দা) এক ভাগ করে মোট আট ভাগে দাবিদার হিসেবে সমান ভাগ করে নেয়। প্রত্যেক দেহাবশেষ অংশের উপর একটি স্তূপ স্থাপন করা হয়। সম্রাট অশোক রামগ্রাহ ব্যতীত সমস্ত অস্থি ধাতু সংগ্রহ করে ৮৪,০০০ ধর্মরাজিক স্ত্তূপ নির্মাণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সম্রাট অশোক ধম্নবিনয় অভিযানের সময় তাঁর গুরু মোগগলিপুত্তকে বুদ্ধ প্রচারিত ধম্মের বিষয় কত বড় প্রশ্ন করলে জবাবে মোগগলিপুত্ত বলেন, ‘‘ধম্মের আছে ৮৪,০০০ ভাগ’’। পরে মৌর্য সম্রাট অশোক তাঁর সাম্রাজ্যের নির্দিষ্ট শহরে স্তূপ নির্মাণ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে নিজ সাম্রাজ্যের বাইরেও ৮৪,০০০ স্তূপ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আরেকটি কিংবদন্তী হলো প্রত্যেক মানব দেহে ৮৪,০০০ পরমাণু আছে। গৌতম বুদ্ধের প্রতিটি পরমাণুকে সম্মান করতে সম্রাট অশোকের এহেন মহতি উদ্যোগ বলে মনে করা হয়।
গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ ও পরিনির্বাণ এ ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা বৌদ্ধদের নিকট শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা নামে পরিচিত। বৈশাখ মাসে অভূতপূর্ব ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা ঘটেছিল বিধায় দিবসটি বৈশাখী পূর্ণিমা নামেও অভিহিত। বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভারত, নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ বিশ্বে আরো বিভিন্ন দেশের থেরবাদী বৌদ্ধরা ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের সাথে দিবসটি পালন করে থাকে। পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরেও বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক সকালে ধর্ম দেশনা, প্রধান সড়কে ধর্মীয় শোভাযাত্রা প্রদক্ষিণ, মধ্যাহ্নে ভিক্ষুসংঘসহ উপোসথ গ্রহণকারীদের পিন্ড দান, ধর্মীয় কোরাস পরিবেশন, রাতে ধর্ম দেশনাসহ নানাবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে। ১০মে’ ২০১১ খ্রিস্টাব্দ তারিখ দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারিভাবে বুদ্ধের জন্ম দিবস পালন করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের রাস্তায় আলো ঝলমলে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত দিবসটিকে বেসাখ দে হিসেবে United Nation day of Vesak (UNDV) ঘোষণা করে। মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিউইয়র্কে ২০০০ খ্রিঃ প্রথম দিবসটি পালন করে। মহারাজ কনিঙ্ক এর পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগার্জুনের প্রভাবে ভারতের নালন্দা হতে স্বতন্ত্র মহাযান মতবাদ প্রচারিত হয় যা ইউরোপীয় পন্ডিতদের মতে Northhern School নামে পরিচিতি লাভ করে। থেরবাদী (Southern School) ও মহাযানী বৌদ্ধদেশ সমূহ দিবসটি ধর্মীয় ভাব গার্ম্ভীযের সাথে উদ্যাপন করে থাকে। উৎসবের পাশাপাশি সভা, সেমিনার ও আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়।
-মং বা অং (মং বা)


তথ্যসূত্র : রাখাইন রাজাওয়ান (প্রকাশকাল- ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, পত্রপৃষ্ঠা ২৭-৪৫)

তথ্যসুত্র ঃ mrashid.wordpress.com

ধুতাঙ্গ সাধক শ্রদ্ধেয় শরণংকর থের মহোদয়ের জন্মদিন

ধুতাঙ্গ সাধক শ্রদ্ধেয় শরণংকর থের মহোদয়ের জন্মদিন

ভদন্ত/সৌম্য,

আগামী ১৬ আগষ্ট ২০১৯ইং, পহেলা ভাদ্র ১৪২৬ বাংলা, ২৫৬৩বুদ্ধাব্দ (শুক্রবার) সদ্ধর্মগ্রাম ফলাহারিয়া জ্ঞানশরণ মহাঅরণ্যের প্রজ্ঞাবান শ্মশানচারী ধুতাঙ্গ সাধক শ্রদ্ধেয় শরণংকর থের মহোদয়ের জন্মদিন উপলক্ষেে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।উক্ত মহতী পূর্নময় অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সকলে আমন্ত্রিত।

অনুষ্ঠান সূচী:
• সকাল ০৯.০০টায় শিষ্যেমন্ডলীসহ পূজনীয় ভান্তের পিন্ডাচরণ।
• দুপুর ১১.০০টায় :পূজনীয় ভান্তের একক সদ্ধর্মদেশনা।

স্থান : সদ্ধর্মগ্রাম ফলাহারিয়া জ্ঞানশরণ মহাঅরণ্য ভূমি(ধুতাঙ্গ পাহাড়)
ফলাহারিয়া, উত্তর পদুয়া,রাঙ্গুনিয়া,চট্টগ্রাম।

আয়োজনে: ভেন শরণংকর ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ও পূজনীয় ভান্তের সকল সেবকবৃন্দ।

পথনির্দেশনা:-চট্টগ্রাম বাসটার্মিনাল/কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে (সিএনজি করে)গোডাউন,ওখান থেকে পদুয়া রাজারহাট(দক্ষিণ রাংগুনিয়া)সেখান থেকে জ্ঞানশরণ মহাঅরণ ভূমি।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা বুদ্ধের ৫ ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বয়

আষাঢ়ী পূর্ণিমা বুদ্ধের ৫ ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বয়

সিদ্ধার্থ গৌতম বা তথাগত বুদ্ধ মানবকূলে জন্ম নেওয়ার জন্য তার মাতৃগর্ভে (রাণী মহামায়া) প্রতিসন্ধি গ্রহণ, সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ, সর্বপ্রথম গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা বা বৌদ্ধ ধর্মমত প্রচার, প্রাতিহার্য ঋদ্ধি তথা আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদর্শন এবং গৌতম বুদ্ধের পরলোকগত মা (রাণী মহামায়া) কে অভিধর্ম দেশনা।

মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম ও তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের জন্মপূর্ব এবং জন্মোত্তর জীবনের ৫টি ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বয় আষাঢ়ী পূর্ণিমা। এটি বৌদ্ধদের পরম কল্যাণময় ও পূণ্যময় তিথি।

এ পূর্ণিমা তিথিতেই তথাগত গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রতের নিয়মও প্রবর্তন করেন। এসব প্রেক্ষাপটে আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের অত্যন্ত স্মরণীয়-বরণীয় তিথি। বৌদ্ধদের জন্য এটি একটি পরম মুহূর্ত ও শুভদিন।

বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে, বৌদ্ধ জীবন নানা কারণে ঐতিহাসিকভাবে অর্থবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে মায়াদেবীর গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য, মহাপুরুষরা যথাসময়ে উপযুক্ত, ভৌগোলিক সীমায়, কাম্যস্থানে উত্তম বংশের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম যথানিয়মে তার পিতা রাজা শুদ্ধোধনের ঔরশে রাণী মহামায়ার গর্ভে জন্ম নিয়ে ধরাধামে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন।

জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, সন্ন্যাসী এ চারনিমিত্ত দর্শন করে রাজকুমার সিদ্ধার্থ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে সংসারের মায়া-মোহ ছিন্ন করে বুদ্ধত্ব লাভের প্রেরণায় গৃহত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ৬ বছর কঠোর তপস্যার মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করে তিনি আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে তার নবধর্ম (বৌদ্ধ ধর্ম) ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন। পরবর্তীতে মায়ের মৃত্যুর পর একই পূর্ণিমা তিথিতে তিনি মায়াদেবীকে সদ্ধর্ম দেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। এ পূর্ণিমাতেই বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত বা ওয়া অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন।

উপবসত শব্দ থেকে ‘উপোসথ’ শব্দের উৎপত্তি। পালি শব্দ ‘উপোসথ’ থেকে উপবাস শব্দের উৎপত্তি। এখানে উপ একটি উপসর্গ। এর অর্থ হল নিকটে বা পাশাপাশি এবং বসত অর্থ হলো বাস করা। সুতরাং উপবসত শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল পাশাপাশি বসে ধর্ম শ্রবণ করা। অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোসথিকগণ এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমার সময় দান, শীল, ভাবনা করে আধ্যাত্মিক জীবন গঠন করে। বৌদ্ধ ধর্মানুসারে উপোসথ চার প্রকার। তা হল- প্রতিজাগর উপোসথ, গোপাল উপোসথ, নির্গ্রন্থ উপোসথ এবং আর্য উপোসথ। উপোসথিকগণ প্রাণীহত্যা, অপ্রদত্তবস্তু গ্রহণ, মিথ্যা ভাষণ, মাদকদ্রব্য সেবন, ব্রহ্মচর্য আচরণ, কামাচার, রাতে আহার, মালাধারণ ও সুগন্ধদ্রব্য ব্যবহার, কোনো উঁচু আসনে শয়ন কিংবা উপবেশন করেন না। এগুলো অষ্টাঙ্গ উপোসথিকের অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য। উপোসথ আত্মশাসন, আত্মসংযম ও চিত্ত-সাধনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বৌদ্ধজীবনে এটি হচ্ছে প্রজ্ঞা ও ধ্যান সাধনার জন্য মহৎ কাজ। দুঃখের নিবৃত্তির জন্য এ উপোসথ বৌদ্ধজীবন পদ্ধতিতে অত্যন্ত কার্যকর।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা ও বর্ষাবাসের কার্যক্রমের সঙ্গে উপোসথ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৌদ্ধ ধর্মে উপোসথের গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মীয় জীবনযাপনের লক্ষ্যে তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ স্বয়ং উপোসথের প্রবর্তন করেন। উপোসথ হল ধর্মীয় অনুশাসন বা জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ শিবির।

তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ কর্তৃক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বা ওয়ার নিয়ম প্রবর্তন আষাঢ়ী পূর্ণিমার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ধর্ম প্রচারের প্রথমাবস্থায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সারাবছরই নিয়োজিত থাকতেন। তখন বর্ষাব্রতের কোন বিধান ছিল না। যেহেতু বর্ষাকালে ভিক্ষুদের গৈরিক বসন বা চীবর বৃষ্টিতে ভিজে ও মাটি-বালি লেগে নোংরা হয়, রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পিচ্ছিল হলে পথ চলায় বিঘ্ন ঘটে। সবুজ ঘাস, লতা, ক্ষেতের আইল, জমির ফসল ইত্যাদি ভিক্ষুদের পদাঘাতে বিনষ্ট হয়। এছাড়া এসময় পদতলে পিষ্ট হয়ে পোকামাকড়, কীট-পতঙ্গ ও অন্যান্য ছোট-ছোট প্রাণীর জীবন নাশেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে তথাগত গৌতম বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিন ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাকালীন বষাব্রতের নিয়ম প্রবর্তন করেন। এটি অবস্থার প্রেক্ষাপটে গৃহিত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

ভিক্ষুরা প্রধানত আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরদিন থেকে একটি উপযুক্ত স্থানে ৩ মাসব্যাপী বর্ষাব্রতের অধিষ্ঠান করেন। বর্ষাব্রত পালনের মাধ্যমে ভিক্ষুদের আত্মশুদ্ধি ঘটে ও তাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ বিকশিত হয়। দীর্ঘ সময়ব্যাপী সংযম, সাধনা ও বিশ্রামের ফলে তাদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। দুঃখ-নিবৃত্তির পথ প্রশস্ত হয়। এছাড়া বর্ষাব্রতোত্তর ধর্ম প্রচারে মনোবল বৃদ্ধি পায়। ভিক্ষু সংঘের পাশাপাশি বর্ষাব্রত বা ওয়ার ৩ মাস সময়ে গৃহিরা উপোসথ পালনসহ দান, শীল ও ভাবনায় অধিকতর নিয়োজিত থাকার পরিবেশ লাভ করে। অধিকন্তু ভিক্ষুর বর্ষাব্রত পালনের মধ্য দিয়ে ‘প্রবারণা’ উদযাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং প্রবারণার ধারাবাহিকতায় ‘কঠিন চীবর দান’ সম্পাদনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করা যায়। এখানে স্মরণীয় এই, সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগের পর নিজের চুল কেটে সত্যক্রিয়া করে সেগুলো আকাশে উড়িয়ে দিলে দেবতারা সেই চুল নিয়ে স্বর্গে চৈত্য তৈরি করেন।

এরই আলোকে বৌদ্ধরা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের পর আকাশ প্রদীপ বা ফানুস উত্তোলনের মধ্য দিয়ে জগতের সকল প্রাণীর সুখ-শান্তি কামনা করেন।

তথ্যসুত্র ঃ banglanews24.com

error: Content is protected !!