by admin | Nov 15, 2019 | blog
চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর পূর্বে-দক্ষিণে চানখালি ও মুরালী খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত আনােয়ারা উপজেলার অন্তর্গত, ৮নং চাতরী ইউনিয়নস্থ ঐতিহ্যবাহী কেয়াগড় গ্রাম সুজলা, সুফলা, সবুজ বনানী দ্বারা ঢাকা এক শান্ত পতিরূপ নন্দিত জনপদ। প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদের মতে, খ্রিস্টিয় ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীর বৌদ্ধযুগের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ পন্ডিত বিহার এ গ্রাম থেকে প্রায় ২/৩ কিলােমিটার পশ্চিমে দেয়াং পাহাড়েই (পশ্চিম পটিয়ার বড় উঠান) অবস্থিতি ছিল বলে অনেকের বিশ্বাস। বেশ কয়েক বছর আগে। পশ্চিম পটিয়ার বড় উঠানে পন্ডিত বিহারের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই সময়ে অত্র গ্রামে এক বিরাট কেয়াংঘর ছিল। যেখানে প্রায় শতাধিক ছাত্র অবস্থান করে পন্ডিত বিহারে গিয়ে লেখাপড়া করতেন। সেই কেয়াংঘর থেতে কেয়াগড় গ্রামের উৎপত্তি । কালের বিবর্তনে এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির বদৌলতে এই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে কেয়াগড় সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহার। যা,বাংলাদেশ সরকারি অফিসে নথিবদ্ধ। এ বিহারটি শুধু অত্র গ্রাম নয়, সমগ্র বাংলাদেশ বৌদ্ধদের জন্য এক পবিত্র তীর্থ স্থান। কেননা এই গ্রামেরই ধার্মিক উপাসক প্রয়াত ভৈরব চন্দ্র বড়ুয়ার স্বপ্নে প্রাপ্ত আসামের লুসাই পাহাড় থেকে “কালাে গোঁসাই” নামে, একটি মূর্তি এনে এই বিহারেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। অদ্যবধি মূর্তিটি অত্র বিহারে সংরক্ষিত আছে। অত্যন্ত পুত ও পবিত্র মন নিয়ে যে কোন ব্যক্তি কালাে গোঁসাই’র কাছে প্রার্থনা বা মানত করলে অথবা পূজা দিলে ব্যক্তির ইচ্ছে সফল হয়। তা অবিশ্বাস্যভাবে সত্য ও প্রমাণিত। কেননা এই পবিত্র “কালাে গোঁসাই” মূর্তিটি একদা ভেঙ্গে গিয়েছিল। ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এই গ্রামেরই আরেক জন ধার্মিক উপাসক প্রয়াত শৈলেন্দ্র লাল বড়ুয়াকে স্বপ্ন দেখালেন যে, ডাবের পানি ও দুধ দিয়ে স্নান করে দিলে আমি আবার জোড়া লেগে যাবাে। সত্যিই! প্রয়াত ধামিক উপাসক ডাবের পানি ও দুধ দিয়ে স্নান করিয়ে মাথাভাঙ্গা অংশে বসিয়ে দেয়ার পর পরেই নিখুত ভাবে জোড়া লেগে যায়। সেই থেকেই সাধারণ মানুষের কাছে এই বিরল ঘঠনাটি। অসাধারণ হয়ে যায় এবং মনে বিশ্বাস জন্মে। “কালাে গোসাইর” সত্যতা ও গুণ সবদিকে ছড়িয়ে পরে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহর থেকে শহরান্তরে। সব ধর্মের মানুষ এই বিহারে এসে পরিদর্শন করে, প্রার্থনা ও মানত করে এবং পূজা দেয়। তাই জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে এই বিহারটি খুবই পবিত্র স্থান। এই বিহারের পবিত্রতা ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে সকলেরই আন্তরিক সহযােগিতা একান্ত কাম্য । বিহারের নব রূপকার এবং প্রধান ধর্মীয় পুরােহিত বা অধ্যক্ষ হলেন এই গ্রামেরই জন্মজাত কৃতি সন্তান বাংলাদেশ বৌদ্ধ ভিক্ষু মহাসভার সহ-সভাপতি, কর্মবীর শ্রীমৎ আৰ্য্যকীৰ্ত্তি মহাথের।
যেভাবে যাবেন ঃ চট্রগ্রাম কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ থেকে আনোয়ারার বাসে করে আনোয়ারা থানার সামনে নেমে । লোকাল CNG পাওয়া যায় কেয়াঁগড় বড়ুয়াপাড়া যাবার। CNG করে সরাসরি আপনি কেঁয়াগড় সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহারে যেতে পারবেন । অথবা আপনি চট্রগ্রাম শহর থেকে যেকোনো গাড়ি / CNG করে সরাসরি কেয়াঁগড় বড়ুয়াপাড়া যেতে পারেন । সেক্ষেত্রে একই উপায়ে আপনাকে আনোয়ারা থানার সামনে নেমে যেকোনো মানুষের সহযোগিতায় কেয়াঁগড় বড়ুয়াপাড়া যেতে পারেন ।
বি,দ্রঃ আপনি রাস্তা চিনতে কোনো অসুবিধা হলে ত্রিরত্ন ডট কমের হটলাইন নাম্বার এ কল করতে পারেন । আমাদের হটলাইন নাম্বারঃ ০১৮৪৫৮৩৯০৩১
by admin | Nov 15, 2019 | blog
কাঁলো গোঁসাই (বুদ্ধের) জ্যোতির্ময় জ্যোতি
কল্যাণ বড়ুয়া , আবুধাবী প্রবাসী , কেঁয়াগড় , আনোযারা , চট্রগ্রাম।
দক্ষিণে শংখনদী এবং বঙ্গোঁপসাগরের অবারিত ঢেউয়ের সুরের মূঁছনা
পশ্চিমে সবুজ পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত এবং কলকারখানা ও কর্ণফুলী নদীর মোহনা ।
দেয়াং পাহাড়ে অবস্থিত বৌদ্ধযুগের পন্ডিত বিহার মিলে আনোয়ারা উপজেলা
সুজলা , সুফলা , সবুজ বনানী দ্বারা শান্ত পতিরুপ জনপদে বসে কত গ্রাম্য মেলা ।
দেয়াং পাহাড়ে বৌদ্ধযুগে পন্ডিত বিহার ছিল শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
অত্র জনপদে কেয়াংগড় হতে কেঁয়াগড় গ্রামের উপত্তি বৌদ্ধদের তীর্থস্থান।
ঐতিহ্য়বাহি ছায়াঘেরা নিবিড় সৌন্দর্য্য পরিবেষ্টিত পূণ্যভূমি কেঁয়াগড় বৌদ্ধ গ্রাম
ধার্মিক উপাসকের স্বপ্নে প্রাপ্ত লুসাই পাহাড় হতে আনা কাঁলো গোঁসাই বুদ্ধের কত সুনাম
যুগে যুগে কাঁলো গোঁসাই বুদ্ধের চরণে , কত ভিক্ষু , কত বৌদ্ধ মনীষী সেবায় ছিল রত
দূর-দূরান্ত হতে আসে আশীর্বাদ নিতে ধার্মিক উপাসক-উপাসিকা যত।
যুগে যুগে এই বিহারে অবস্থান করেছিল কত ভিক্ষু , কত বৌদ্ধ মনীষী ,
জ্যোতির্ময় জ্যোতির গুনে কাঁলো গোঁসাই (বুদ্ধ) বৌদ্ধদের যেন এক পূর্ণ্য শশী।
অন্নপ্রাসন , প্রব্রজিত , লেখাপড়া চাকুরী , বিদেশযাত্রা আরও কত মানত করে
জীবন-জীবিকায় সুখের আশায় প্রার্থনায় রত অনাবিল সুখের তরে
পূর্ণিমা , অমাবস্যা , অষ্টমী বছরের প্রতিটি শুভদিন শুভক্ষণে
বুদ্ধপূজা সাজিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে দুঃখ মুক্তির অন্বষণে।
কাঁলো গোঁসাই (বুদ্ধের ) অনন্ত গুনের জ্যোতির্ময় জ্যোতিতে
কেউ ফিরেনা খালি হাতে কাঁলো গোঁসাই (বুদ্ধের ) মন্দির হতে।
বুদ্ধ পূর্ণিমা , প্রবারণা পূর্ণিমা , আর মহতী অনুষ্ঠান চীবর দানে
গ্রামবাসী , উপাসক-উপাসিকা রত থাকেন পঞ্চশীল , ধর্মদেশনা শ্রবনে
কত অসহায় , জীর্নশীর্ণ , ব্যাধিগ্রস্ত , আরোগ্র লাভের আশায় প্রতিদিন শুভক্ষণে
সকাল ,দুপুর , সাঁঝে বন্দনা জানায় কাঁলো গোঁসাই বুদ্ধের চরণে।
নিরলস প্রচেষ্টায় সুউচ্চ চূড়ায় নির্মিত বিহার ও ভিক্ষু সীমাঘর করেন নির্মাণ
কাঁলো গোঁসাই বুদ্ধের প্রধান সেবক শ্রীমৎ আর্যকীর্তি ভিক্ষুর কর্মের অবদান |
by admin | Nov 5, 2019 | blog
তথাগত বুদ্ধ জীবিত থাকাকালীন সময়, এক ব্রাহ্মণ বুদ্ধের সাক্ষাতে পানীয় নিয়ে জেতবন বিহারে গিয়েছিলেন।
®ব্রাহ্মণ জেতবন বিহারে এসে বুদ্ধের দেহের দিকে তাকিয়ে তথাগত বুদ্ধের পা থেকে মাথা পর্যন্ত বুদ্ধের দেহকে দেখতে লাগলেন।
®বুদ্ধ ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্রাহ্মণ তুমি এভাবে আমাকে তাকিয়ে কি দেখছো?
®ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে বললেন, প্রভু আপনার দেহকে দেখতেছি।
®বুদ্ধ ব্রাহ্মণের কথা শুনে ব্রাহ্মণকে বললেন, ও দেখ দেখ।
®অতঃপর, ব্রাহ্মণ বুদ্ধের দেহকে দেখা শেষ হলে একপাশে গিয়ে বসলেন।
®বুদ্ধ ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন কিহে ব্রাহ্মণ, তুমি কি আমাকে দেখেছো এবং দেখা শেষ হয়েছে কি?
® উত্তরে, ব্রাহ্মণ বললেন হ্যাঁ প্রভু দেখেছি এবং দেখা শেষ হয়েছে।
®বুদ্ধ ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস কোরলেন, ব্রাহ্মণ তুমি আমাকে কিরূপে দেখেছো?
® উত্তরে, ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে বলতে লাগলেন – বুদ্ধের নয়টি গুন, ধর্মের ছয়টি গুন, সঙ্ঘের নয়টি গুন, মহাপুরুষের বত্রিশ প্রকার লক্ষন, বুদ্ধ গণের ১০টি বর ইত্যাদি।
® ব্রাহ্মণের বলা শেষ হলে, তখন বুদ্ধ ব্রাহ্মণকে বললেন কি হে ব্রাহ্মণ, তুমিতো আমাকে দেখোনি!!
® তখন বুদ্ধ ব্রাহ্মণকে বললেন – ব্রাহ্মন আমাকে দেখতে হলে – চারি আর্য্যসত্য জ্ঞান, আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ জ্ঞান, সাঁইত্রিশ প্রকার বোধি পক্ষিয় ধর্মজ্ঞান, পাতিত্যসামুৎপাদ জ্ঞান, চব্বিশ প্রকার পন্থার জ্ঞান,ইত্যাদি জানতে হবে। তবেই তুমি আমাকে দেখতে পাবে।
®অতঃপর তথাগত বুদ্ধ ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্যে ধর্ম দেশনা দান করলে ব্রাহ্মণ বুদ্ধের ধর্ম দেশনা শ্রবণ করতে করতে অচিরেই সেখানে স্রোতাপত্তি মার্গফল লাভ করলেন..!!
#লেখাটি Rony Barua https://www.facebook.com/roni.barua.98 কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ।
by admin | Nov 5, 2019 | blog
ছোটবেলায় লোক মুখে অনেক যক্ষের গল্প শুনেছি। আধুনিক যুগে ভূত, প্ৰেত, দৈত্য, যক্ষ প্রভৃতি অশরীরি প্রাণী অনেকে কাল্পনিক বলে মনে করে থাকেন। জড়-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সময় এগুলোর সংখ্যাও ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন।
বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে অনেক, ভূত, প্রেত, যক্ষ, দেবতা, ব্রহ্মা এবং বিবিধ অশরীরির বর্ণনা পাওয়া যায়। এগুলিকে উপপাতিক জন্মজ প্রাণী বলা হয়। এ সম্বন্ধে অনুলোম, শুচি লোম এবং আলবক যক্ষের উল্লেখ করা যায়। ত্রিপিটকে বর্ণিত আলবক যক্ষ ভগবান বুদ্ধকে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছিল। তা বর্তমানে বৌদ্ধ নর নারীর অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে। যারা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী তাদের নির্দ্ধিধায় স্বীকার করতে হয়। এ সম্বন্ধে বিমান বত্থু, প্রেত কাহিনী এবং বিভিন্ন অটঠ কথায় প্রচুর অশরীরির প্রমাণ পাওয়া যায়।
এমন কতগুলো ঘটনা আছে তার কোনো যথাযথ লিপিবদ্ধ প্রমাণ নেই। কালক্রমে মানুষের স্মৃতি অটলতলে ডুবে যায়। আজ হতে ছয় বৎসর পূর্বে এক যক্ষিণীর কাহিনী উদঘাটন হয়। শ্রদ্ধেয় বনভান্তে স্বশিষ্যে উক্ত স্থানে পদার্পণ করায় যক্ষিণীর অন্তর্ধান ঘটে। তার ঠিক তথ্য সংগ্ৰহ করতে আমার অনেকদিন সময় লেগেছে। এই তথ্যের প্রতিবেদন লিখে দিয়েছেন বাবু প্ৰমোদ রঞ্জন চাকমা। উক্ত কাহিনী অতি দীর্ঘ বিধায় পাঠকের ধৈৰ্য চুতির ভয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করছি। বাবু নির্মল কান্তি চাকমা শ্রদ্ধেয় বনভান্তের একনিষ্ট উপাসক এবং বনবিহার পরিচালনা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি উচ্চ শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তি। শ্রদ্ধেয় বনভান্তের উপদেশে ১৯৮৩ ইংরেজীতে রফতানী ও মার্কেটিং অফিসার পদ হতে পদত্যাগ করে বাগান ও ব্যবসা বানিজ্যে রত আছেন। তার স্থায়ী ঠিকানা বনরূপার ত্রিদিব নগরে। নির্মল বাবু বাগান করার জন্যে উপযুক্ত স্থান খুঁজতে খুঁজতে হাজারীবাক মৌজার ‘কান্দেবছড়া কাগত্যায়” ৬ একর পাহাড় বন্দোবস্তী করেন। তিনি শুনতে পেলেন এ জায়গায় বহু বৎসর যাবৎ কোন লোক বসতি বা জুম চাষ করতে পারে না। সুতরাং অনাবাদী অবস্থায় পড়ে আছে। কারণ অমনুষ্যের উৎপাতে হয়তো লোক মারা পড়ে নতুবা হঠাৎ রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তিনি সাহস করে সেখানে বিভিন্ন গাছ এবং ফলের বাগান করেন। সেই বাগানে হৃদের ধারে একখানা খামার বাড়িতে তার মেঝ ভাই বাবু প্ৰমোদ রঞ্জন চাকমা, তার স্ত্রী বিজয়লক্ষী চাকমা ও দুই ছেলে মেয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে নির্মল বাবু বাগানের কাজের জন্য কিছু সংখ্যক মজুর নিয়ে সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করেন। এভাবে কোনো উপদ্রব ছাড়া তিন বৎসর কেটে যায়। তারা মনে করেছিলেন এখানে বোধ হয় কোন অমনুষ্য বা যক্ষের উপদ্রব নেই অথবা কালক্রমে তা তিরোহিত হয়েছে।
কোনো একদিন পাহাড়ের অপর প্রান্তে বাগানের কাজে ব্যস্ততায় প্রমোদ বাবু সন্ধ্যার একটু পরে খামারে ফিরছিলেন। এমন সময় বড়জোর ৫০ হাত দূরে দেখতে পেলেন এক বিভৎস ধরণের মূর্তি। কপালে দুটি ও দুই বাহুতে দু’টি ইলেকট্রিক বাল্ব-এর মত বড় বড় চারটি চোখ দেখতে পান। চোখগুলো খুব উজ্জ্বল ও ঝক্ঝক্ করে। চোখের আলোতে শরীরের অন্য অংশও দেখা যায়। প্রথম দর্শনে হুশ হারিয়ে ফেলেন এবং নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অন্ততঃ ২০ মিনিট পরে একটু হুশ ফিরে আসে। মনে মনে চিন্তা করলেন বোধ হয় সে আমাকে কিছু করবে না। অবশেষে বললেন তুমি আমাকে কিছু করতে পারবে না। আমি সব সময় পঞ্চশীল পালন করি। সে কথা বলার পর উক্ত বিভৎস মূর্তি অন্তৰ্হিত হয়। অতপর তিনি কম্পমান দেহে খামারে চলে যান। এ ঘটনা সম্বন্ধে তার স্ত্রী বিজয়লক্ষী চাকমাকে অবহিত করেননি।
প্রমোদ বাবু মধ্যে মধ্যে চিন্তা করেন, ওটা বোধ হয় নিশ্চয়ই যক্ষ হবে। এই ব্যাপারে ভবিষ্যতের জন্য সন্দেহ উপস্থিত হল। আবার চিন্তা করলেন সে বোধ হয় আমাকে কোনো ক্ষতি করবে না। ক্ষতি করলে প্রথম দিনই করত। কিছুদিন অতিবাহিত করার পর এর একদিন সন্ধ্যার পর খামারে ফিরছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন পথ রোধ করে এক লম্বা গাছ। চিন্তা করলেন এ গাছ কোথা থেকে আসল। অন্ততঃ ৪ হাত কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন। ওটা গাছ নয়, বিরাটকায় কাল সাপ। তাতে তার শরীর শিহরিয়ে উঠল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করলেন, সাপ তো এরূপ হতে পারে না। বোধ হয় এটা সেদিনের যক্ষ। কয়েক মিনিট পর অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সাথে সাথেই যক্ষটি অন্তৰ্হিত হয়। অতপর তিনি ত্রিরত্নের নাম স্মরণ করতে করতে খামারে চলে যান। এবার প্রথম দিনের তুলনায় একটু কম ভয় লেগেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বারও কাহারো প্রতি এ বিষয় ব্যক্ত করেননি।
তৃতীয় বার কোন একদিন প্রমোদ বাবু ‘কান্দেবছড়া’ গ্রামের জনৈক লোকের বাড়ি হতে নিমন্ত্রণ খেয়ে আসতেছেন। তখন রাত ৮টা। যখন তার বাগানে পৌছেন। তখন দেখতে পেলেন। পথের উপর একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখা মাত্রই তিনি দাঁড়িয়ে ত্রিরত্নের নাম স্মরণ ও তার শীলগুণ স্মরণ করলেন। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বলেন আমাকে পথ ছেড়ে দাও। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ কেন? সে বলল, তুমি এদিকে এস তোমার সাথে আমার বিশেষ দরকার আছে। তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কোন দরকার নেই। পথ ছাড়। সে আবার বলল, তুমি ভয় করো না। তোমার কোন ভয় নেই, তোমাকে কথা দিচ্ছি। তুমি আমার দিকে এস। তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই। পথ ছাড়। মেয়েটি বলল, আচ্ছা! আজ পথ ছাড়ছি। কিন্তু আগামীকাল এখানে এসে আমার সাথে দেখা করে যেও। প্ৰমোদ বাবু তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন পরনে সাদা কাপড় এবং চোখ দু’টি ঝক্ঝক্ করে জুলছে। চেহারাটি যেন একজন চাকমা মেয়ে। অতঃপর খামারে এসে এ বিষয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
পরবর্তী রাত তিনি আগে আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত যখন ঠিক ১টা বাজল তখন কে যেন তার বাড়ির পাশ থেকে কলারছড়া কেটে নিয়ে যাচ্ছে। শব্দ শুনে তিন ব্যাটারী টর্চ দিয়ে দেখলেন কলাগাছ ঠিকই আছে এবং আশেপাশে কাকেও দেখতে পেলেন না। তিনি প্রস্রাব করে বাড়িতে ঢুকার পথে অর্থাৎ দরজার সামনে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে সে মেয়েটি। প্রথমেই সে বলল তুমি আমার সঙ্গে দেখা করনি কেন? তিনি বললেন, কোন প্রয়োজন নেই সে জন্য। সে বলল, আজও তুমি যাও, আগামীকাল আমার সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করিও। অনেক কথা বলার প্রয়োজন আছে। ক্রমান্বয়ে ভয় কমে যাওয়াতে তিনি বললেন, আচ্ছা কথা দিচ্ছি। দেখা করব। সেই রাতেও সে বিষয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
তারপর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেখানে গেলেন। দেখা গেল সাদা কাপড় পরিহিত মেয়েটি গাছের গোড়ায় বসে আছে। দেখার সাথে সাথেই বলল, এদিকে এস। তোমার কোন ভয় নেই। আমাকে কোনো সন্দেহ করিও না। তিনি বললেন, তুমি ওখান থেকে বল, কি দরকার আছে শুনতে এসেছি। সে আবার বলল তোমার এখনো ভয় ও সন্দেহ রয়ে গেছে। তুমি আমার পাশে এসে বস। তারপর প্রয়োজনীয় কথাগুলো বুঝিয়ে বলব। তিনিও তার কথামতে পাশেই বসে পড়লেন। প্ৰায় বিশ মিনিট পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে থাকার পর বলল তোমরা এ পাহাড়ে এসেছ অনেকদিন যাবৎ আমি তোমাদের সবাইকে চিনি ও ভালবাসি। কিন্তু তোমাকে এবং তোমার মেয়েকে খুব ভালবাসি। তুমি খুব পরিশ্রম কর। তোমার আর পরিশ্রম করতে হবে না। এমনকি তোমার ছেলে মেয়েরও অভাব ঘুচে যাবে। আমি তোমাকে কতগুলো সম্পদ দিতে চাই। অনুগ্রহ করে এগুলো নিয়ে যাও। শুধু তোমাকেই দিচ্ছি, অন্য কারো প্ৰাপ্য নয়। এ কথাগুলো বলার পর তিনি বললেন আমার কোন সম্পদের প্রয়োজন হবে না। আমার যা আছে তা দিয়ে যথেষ্ঠ, এ বলে উঠে চলে আসছেন, তখন সে বলল আজ তোমাকে চিন্তা করার সময় দিচ্ছি। আগামীকাল নিশ্চয়ই আমাকে বলতে হবে। সে দিনও দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খামারে চলে গেলে।
পরের রাত প্ৰমোদ বাবুর যাবতীয় ভয় সন্দেহ ও সংকোচ ভাব একেবারেই চলে যাওয়ায় সরাসরি তার পাশে গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ বসার পর সে বলল— আমার সাথে এস, তোমার ধন সম্পদ বুঝিয়ে নাও। তিনি বললেন, আমি সেদিকে যাব কেন? না আমি যাব না। সে আবার বলল— দেখতে পাচ্ছি তোমাদের মানব জাতির সন্দেহ ও সংকোচভাব এখনও রয়ে গেছে। একথা বলার পর তার পিছনে পিছনে অন্ততঃ ত্ৰিশ হাত পর্যন্ত গেলেন। দেখা গেল দিনের মত পরিস্কার আলো। সামনে দুটি বড় বড় মাটির কলসী। কলসীর ঢাকনা খুলে বলল— ধরে দেখ তোমার সম্পদ। তিনি সেগুলো ধরে দেখলেন। এক কলসীতে স্বর্ণের মোহর, অন্য কলসীতে স্বর্ণের পাতে ভর্তি। সেগুলো স্পর্শ করতে প্ৰমোদ বাবুর শরীর যেন কেমন কেমন লাগতেছে, একটু পরে বললেন— এগুলো আমার দরকার নেই। তোমার ধন-সম্পদ তোমার নিকট থাক। সে পুনরায় বলল, এগুলো তো তোমার জন্য রেখেছি। তুমিই এগুলোর মালিক। তিনি বললেন— আমার মালিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি চলে যাচ্ছি। চলে যাওয়ার সময় সে বলল, এ ব্যাপারে চিন্তা করার জন্য তোমাকে আরো সময় দিচ্ছি। মধ্যে মধ্যে আমার সাথে দেখা করিও। প্রমোদ বাবু বললেন আচ্ছা ঠিক আছে।
প্রায় রাতেই প্রমোদ বাবু যক্ষিনীর পাশে বসে থাকতে থাকতে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। (চাকমা ভাষায় আক্যাং বলে) এভাবে আসতে যেতে দেখে তার স্ত্রী সন্দেহ করে জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি গভীর রাতে প্ৰায় এক ঘন্টা পৰ্যন্ত কোথায় যাও? তিনি হেসে হেসে বললেন— তোমাকে বলতে পারব না। তুমি এই কথা জিজ্ঞাসা করিও না। দিন দিন তার স্ত্রীর সন্দেহের দানা গভীর হওয়ায় বললেন— বলতে পারি। কিন্তু একটা শর্ত আছে। কাউকে প্ৰকাশ করতে পারবে না। ভয়ানক ক্ষতি হতে পারে।
অতঃপর উক্ত বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বলার পর তার স্ত্রী বিজয়লক্ষী চাকমা যক্ষিণীকে দেখার জন্য আগ্রহ প্ৰকাশ করলেন। প্রমোদ বাবু যক্ষিণীর অনুমতি নিয়ে তার স্ত্রীকে সেখানে নিয়ে গেলেন। প্ৰায় পাশে গিয়ে দেখা মাত্ৰ প্ৰমোদ বাবুকে জড়িয়ে ধরে বিজয়লক্ষী বললেন— আমি যাব না। থর থর করে কাঁপতে লাগল। প্রমোদ বাবু বললেন— ভয় নেই, চল তার পাশে বসে আলাপ করে আসি।
খামারে গিয়ে বিজয়লক্ষীর মোটেই ঘুম হল না। মধ্যে মধ্যে ভয়ে চমকে উঠে। ভোর হওয়ার পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বনরূপায় ত্রিদিব নগরে চলে আসেন। এদিকে প্রমোদ বাবু তার দশ বছরের মেয়েটিকে নিয়ে খামারে চলে আসেন। মেয়েটি রান্নার কাজে ও তিনি বাগানের কাজে ব্যস্ত থাকেন। যক্ষিণীর সাথে পুনঃবার দেখা হলে বলল, তোমার স্ত্রী আমাকে দেখে ভয়ে চলে গেছে। ভয় কিসের? মানব জাতির সাধারণত ভয় সন্দেহ ও সংকোচ ভাব থাকে। তোমার এখনো সময় আছে তোমার ধন-সম্পদগুলো নিয়ে সুখে শান্তিতে চলতে পারবে। প্রমোদ বাবুর তবুও লোভ উৎপন্ন হল না।
আর একদিন গ্ৰীষ্মকালে রাত্রি বেলায় প্রমোদ বাবু ত্ৰিদিব নগরস্থ বাড়িতে উঠানে বসে আছেন। হঠাৎ তার সামনে যক্ষিণী উপস্থিত হল এবং বলল— কি ব্যাপার তোমাকে এবং সবাইকে খামারে দেখা যাচ্ছে না কেন? তিনি উত্তরে বললেন— কোনো ব্যাপার নয়। শুধু আমার স্ত্রীকে সন্দেহ করি, যদি কাউকে বলে দেয়। প্রতি উত্তরে যক্ষিণী বললেন— কিছুই হবে না, বলতে পারবে। কোন অসুবিধা হবে না। একথা গুলো বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরে তার স্ত্রী চা নিয়ে এসে বললেন— তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ? তিনি বললেন— যক্ষিণী এই মাত্র চলে গেল। তোমার কথায় বলেছি। অন্য কারো নিকট নাকি প্ৰকাশ করতে পারবে। অনুমতি নিয়েছি, কোনো অসুবিধা হবে না।
পরদিন সকালে নির্মল বাবু এবং পরিবারের অন্যান্যদের কাছে বিগত তিন বৎসরের ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা করলেন। তাতে সবাই আশ্চৰ্য্য ও হতভম্ব হয়ে পড়েন। এমনকি সমগ্ৰ ত্ৰিদিব নগর এলাকায় এ ঘটনা নিয়ে এক তোলপাড়া হয়ে যায়। সকলের মতামত নিয়ে নির্মল বাবু ও প্রমোদ বাবু শ্ৰদ্ধেয় বনভান্তের উদ্দেশ্যে বনবিহারে গমন করেন। বন্দনাদি করার পর শ্রদ্ধেয় বনভান্তেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত করেন। এদিকে বনভান্তের স্নান করার সময় হলে তিনি বললেন— আজি তোমরা চলে যাও। আগামীকাল আবার আস।
পরের দিন যথাসময়ে উভয়ে দেশনালয়ের দিকে যেতে না যেতেই শ্ৰদ্ধেয় বনভান্তে রসিকতা করে বললেন— যক্ষিণীর স্বামী আসতেছে (যক্ষিণীর নেকো এঝের)। তারা বন্দনা করে বসার পর উপাসক-উপাসিকাদের লক্ষ্য করে তিনি আবার বললেন— প্রমোদ বাবু পাঁচশত বৎসর পূর্বে কান্দেবছড়া গ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার কোনো পুত্ৰ-কন্যা ছিল না। অর্ধ বয়সে সে মারা যায়। তার স্ত্রী পরিণত বয়সে মারা যায়। কিন্তু সম্পত্তির প্রতি লোভ-মোহ পরায়ন হওয়ায় সে যক্ষিণীরূপ ধারণ করেছে। কিন্তু তারা যক্ষিণীকে চিনে না। যক্ষিণী তাদের ভালভাবে চিনে। মানুষ যেভাবে মূলা বা খিরা খায়, যক্ষিণীও সেভাবে মানুষ খেতে পারে। মায়া মমতার কারণে সে তাদেরকে কিছু করে না। এ যক্ষিণীকে কেউ তাড়াতে পারবে না। এমনকি যক্ষ মন্ত্র-তন্ত্ৰধারী বৈদ্য বা কোন ভিক্ষুও তাকে তাড়াতে পারবে না। কিন্তু একটা পথ আছে, সেটা হল তার উদ্দেশ্যে সংঘ দান করে পূন্য দান করা।
(উল্লেখ্য যে পার্বত্য ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে কান্দেবছড়া বা তার আশে পাশে কোনো চাকমা বসতি ছিল না। সেখানে ত্রিপুরাদের বসতি ছিল। সুতরাং, প্রমোদ বাবু ত্রিপুরাই ছিলেন)।
সঙ্গে সঙ্গেই নির্মল বাবু ও প্রমোদ বাবু শ্ৰদ্ধেয় বনভান্তেকে স্বশিষ্যে সংঘদান, অষ্টপরিষ্কার দান এবং সূত্রপাঠ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। এ উপলক্ষে একটি বড় লঞ্চ ও বনভান্তের জন্য বোট নিয়ে খামার বাড়িতে যাত্রা করলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বনরূপা, কান্দেবছড়ার উপাসক-উপাসিকরা উপস্থিত ছিলেন। যথাসময়ে পঞ্চশীল প্রার্থনা, সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দান সম্পন্ন হয়।
দুপুর বেলা পরিত্রাণ প্রার্থনা ও ভিক্ষু সংঘের সূত্রপাঠ আরম্ভ হয়। ক্ৰমান্বয়ে তিনটি সূত্র পাঠ করার পর শ্রদ্ধেয় বনভান্তে শিষ্যদের বললেন-যক্ষিণী চলে যাচ্ছে। উপাসক-উপাসিকারা বড় করে সাধুবাদ প্ৰদান করার পর মাইকে এবং সকলের মুখে সমসুরে সাধুবাদ ধ্বনিতে কান্দেবছড়া এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে। যক্ষিণী যাওয়ার সময় গামারী গাছ ও আমগাছের মধ্যবর্তী স্থানে গোল্লার মত শব্দ শোনা যায় এবং গাছের শাখা-প্ৰশাখাগুলো তুফানে নড়াচড়া করার মত দেখা যায়। আরো একটি অত্যাশ্চৰ্য্য ঘটনা হল পাহাড়টিতেও কম্পন হয়েছিল। মনে হল সকলে একখানা বড় লঞ্চের ছাদে বসে আছেন। আরও তথ্য পাওয়া গেল রান্না করার জন্যে যে চুলা খুঁড়েছিল তা কম্পনের ফলে কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছে।
অবশেষে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্যে ধর্ম দেশনা প্রদান করেন। দেশনায় বলেন- মানুষ যেমন বিভিন্ন জাতের, বিভিন্ন প্রকৃতির ও বিভিন্ন স্বভাব চরিত্রের থাকে তেমন অশরীরিদের মধ্যে ভূত, প্রেত, যক্ষ, বৃক্ষ দেবতা, আকাশবাসী দেবতা, ভূমিবাসী দেবতা এবং নানা প্রকার অদৃশ্য প্রাণী থাকে। তারা অনেক সময় মানুষের মত উপকার করে আবার অপকারও করে থাকে।
সাধু সাধু সাধু
তথ্যসূত্র : বিরল ঘটনা সংগ্রহ; সংকলন: শ্রীমৎ ব্রহ্মযান ভিক্ষু
by admin | Oct 26, 2019 | blog
ঘরের আবর্জনার চেয়ে মনের আবর্জনা বেশি ক্ষতিকর
লিখেছেনঃ রাজীব বড়ুয়া। সম্পাদক- ষড়রশ্মি।
বৌদ্ধদর্শনের মুলভিত্তি হল মনদর্শন। মনকে সকল কর্মের অগ্রগামী বলা হয়েছে। মন দোষযুক্ত হলে কর্মও দোষযুক্ত হয়। সুতরাং মনের চেতনা থেকেই কর্মের সৃষ্টি এটা স্বচ্ছ জলের ন্যায় পরিষ্কার। তথাগত বুদ্ধ মনকে প্রাধান্য দিয়ে মানসিক বিকাশ সাধন করতে উপদেশ দিয়েছেন। একটি ভাল মনের মানুষ কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না।
মনের আবর্জনা কি? এগুলো কোথায় থাকে? এসব প্রশ্নের সমাধান লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা সহজসাধ্য নয়। তবুও আমার চেষ্টা থাকবে বিষয়টিকে সহজসাধ্য করার।
মন বলতে আত্নাকে বুঝায় না। মন কোন বস্তু নয়, মনের কোন আকার নেই। মন হল অনুভূতির অপর একটি ইন্দ্রিয়। দর্শনের অনুভূতি পেতে চোখ ইন্দ্রিয় হিসেবে, শব্দের অনুভূতি পেতে কান ইন্দ্রিয় হিসেবে, গন্ধের অনুভূতি পেতে নাক ইন্দ্রিয় হিসেবে, স্বাদের অনুভূতি পেতে জিহবা ইন্দ্রিয় হিসেবে, স্পর্শের অনুভূতি পেতে ত্বক ইন্দ্রিয় হিসেবে কাজ করে। ঠিক তেমনি চিন্তার অনুভূতি পেতে মন ইন্দ্রিয় হিসেবে কাজ করে। ছয়প্রকার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্য মন অধিনায়ক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। স্বাদ, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি অনুভূতিগুলো মন ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা বিচার করে থাকি। অনুভূতিগুলোকে আবার সংরক্ষণ করি মনের মাধ্যমে। তাহলে এতোটুকুতে মন সম্পর্কিত কিছু ধারণা মেঘমুক্ত আকাশের ন্যায় পরিষ্কার হল। এবার মনের কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্লেষন করা যাক। মনের অনুভূতিগুলোকে নিয়ে সবাই কম বেশি অবগত আছেন। এই অনুভূতিগুলো হল- রাগ, দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ, সুখ, বিষাদ, দুঃখ, আনন্দ, অনুশোচনা ইত্যাদি। এই সকল অনুভূতিগুলোর মধ্যে কিছু কুশল এবং কিছু অকুশল। আমি মনের আবর্জনাকে উপস্থাপন করতে অকুশল প্রবৃত্তিগুলোকে তুলে আনছি। রাগ, দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ, দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতিগুলো মনকে কলুষিত করে। খারাপ কর্ম সাধনে ইচ্ছা তৈরী করে। তথাগত বুদ্ধ এইসব খারাপ প্রবৃত্তিগুলোকে মনের ময়লা বলেছেন। কারো উপর রাগান্বিত হলে ক্ষতিকর কিংবা প্রতিশোধপরায়ন হয়ে খারাপ কাজ করার স্পৃহা সৃষ্টি হবে, একটা পর্যায়ে খারাপ কাজ করেন। এভাবে অপরাপর অকুশল প্রবৃত্তিগুলোও কার্যকারীতা ভেদে কর্ম সাধন করায়। ঘরের ময়লা ঘরের ভেতর থাকলে যেমন বায়ূর সাহচর্য্যে ঘরের ভেতর দূর্গন্ধ ছড়ায়, অনুরূপভাবে মনের ময়লাগুলো বাহ্যিক আচার আচরণের প্রভাবে মনের মাঝে কুচেতনাকে বর্দ্ধিত করে।
মনের এই আবর্জনাগুলো কোথায় থাকে? শান্ত নিরিবিলি অবস্থায় রাগ, হিংসা ক্রোধ নামক আবর্জনাগুলো মনের মাঝে থাকে না। এগুলো তখনই মনকে প্রভাবিত করে যখন আমরা বাহ্যিক কিছুর উপর প্রভাবন্বিত হই। যেমনঃ কেউ আপনাকে গালি দিল, তীর্যক মন্তব্য করলো। এমন পরিস্থিতিতে আপনি তার এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে যাবেন। ঠিক ঐ সময়ে আপনার মন ইন্দ্রিয় রাগ এবং ক্রোধ নামক আবর্জনার দ্বারা আক্রান্ত হবে। আপনি রাগান্বিত হবেন, ক্রোধান্বিত হবেন। এই রাগ কোথা হতে আসে? কোথায় তার অবস্থান? এই নির্ণয় যতক্ষণ করতে না পারবেন আপনার মন ইন্দ্রিয় এসব আক্রমণের শিকার হবেই। মনের এসব আবর্জনা প্রতিদিন পরিষ্কার করা উচিত। যদি তা না করা হয়, তবে আবর্জনার স্তুপ জমে যাবে। একটা পর্যায়ে এসে বিশাল এই আবর্জনার স্তুপ পরিষ্কার করাটা আমাদের পক্ষে অসাধ্য হয়ে পড়ে।
প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় করে ধ্যান অনুশীলন করুন। এতে আপনার আমার মনের আবর্জনা অল্প অল্প করে পরিষ্কার হবে। জমে থাকা আবর্জনাগুলোও আস্তে আস্তে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। নতুন করে আবর্জনা মনে প্রবেশ করবে না। মনকে শান্ত হতে পারলে শান্তি আপনা আপনি মনে অবস্থান করবে।
অশান্ত মনে আবর্জনা জমে। ঘরের থাকা আবর্জনার ব্যাগটা ঘরে রেখে দিলে দূর্গন্ধ বাড়তে থাকে, তাই আমরা সেটা বাইরে ফেলে দিই। তাহলে মনের ভেতর জন্ম নেয়া আবর্জনাগুলো আমরা কেন মনের ভেতর পুষিয়ে রাখবো! কেনই বা আমরা এই আবর্জনাগুলো দ্বারা মনকে কলুষিত করছি, খারাপ কর্ম করছি। সুতরাং আজ থেকে আমরা মনে আসা আবর্জনাগুলোকে আর জমিয়ে রাখবো না। ভূলে যাবো শত্রুতা, হিংসার বিপরীতে প্রতিহিংসা। মৈত্রীগুণ, ক্ষান্তিগুণ, উপেক্ষাগুণ দিয়ে আমরা এসবে উর্দ্ধে অবস্থান করতে পারবো। আর যত উপরে আপনার অবস্থান হবে ময়লা আপনার নাগালের বাইরে তো থাকবেই তদাপি জ্ঞানের পরিধি উন্নত হবে। ভূমিতে থাকা একজন ব্যক্তি তার চারপাশে বড়জোর এক মাইল পর্যন্ত অবলোকন করতে পারে। ব্যক্তিটি যখন সুউচ্চ পর্বতে আরোহন করবে তখন সে আরো বিস্তৃত জায়গা দেখবে। তার দেখার এবং জানার অভিজ্ঞতা বেড়ে যাবে। যখন সে বিমানে চড়বে তখন বিশাল উচ্চতা থেকে আরো অনেক বিষয় তার দৃষ্টিগোচর হবে। এভাবে করে মনকে এমন এক বিশাল উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে যেখানে মনের আবর্জনা আমাদের মনকে কলুষিত করতে পারবে না। তদুপরি আমাদের জ্ঞান প্রজ্ঞাতে রূপান্তরিত হবে।
সমাপ্তিতে, বুদ্ধের মহামহিমার ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শিরোনামকে অলংকৃত করতে চাই।
একদিন তথাগত বুদ্ধ গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কদাপি, উনার গোচরীভূত হল একজন অসুস্থ ব্যক্তি যিনি ময়লা পরিষ্কার করতেন। ব্যক্তিটি গ্রামের সকলের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করে একটি ভ্যানে করে টেনে আনছিল। আচমকা, তিনি শক্তিহীন হয়ে মাটিতে লুটে পড়লেন। এমনবস্থায় তথাগত বুদ্ধ উনাকে মাটি থেকে টেনে তুলতে গেলে তিনি বুদ্ধকে বারণ করলেন তাকে স্পর্শ না করতে। বুদ্ধ কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি লোকের ঘরে ঘরে ময়লা পরিষ্কার করি। আমি আবর্জনা যুক্ত; তাই আমাকে স্পর্শ করবেন না। তখন বুদ্ধ প্রজ্ঞাস্বরে উনাকে বললেন, তাতে কি হয়েছে! তোমার আর আমার মাঝে তো কোন অন্তর নাই। তুমি যেমনি লোকের ঘরে ঘরে গিয়ে ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার কর, ঠিক তেমনি আমিও লোকের মনে মনে গিয়ে মনের আবর্জনা পরিষ্কার করি। তুমি ঘর পরিষ্কার কর, আর আমি মন পরিষ্কার করি।
তথাগত বুদ্ধের ধর্মটা অনুষ্ঠান দিয়ে নয়, আচরণ দিয়ে ধারণ করতে হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমরা বিশাল বিশাল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বুদ্ধের ধর্মকে খুঁজতে যাই, ধার্মিক হতে চাই। কেউই বুদ্ধের উপদেশ মতে, মনের আবর্জনা পরিষ্কার করতে উদ্যোগী হয় না। তাই সময় যা অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে তা আর ফিরে আসবে না। বাকি যেসব সময় আমাদের অতিবাহিত করতে হবে সেই সময়গুলোকে কাজে লাগাই ধ্যান অনুশীলন করার মাধ্যমে। অন্তুত দশটা মিনিট তো ধ্যানকার্যে দিতে তো কারো আপত্তি নেই। দিনের ২৪ ঘন্টাতে আমরা টিভি/মোবাইলে/বিনোদনে ৪/৬ ঘন্টা ব্যয় করি। দশটা মিনিট কি বেশি হয়ে যায় মনের ময়লা পরিষ্কার করতে!
লিখাগুলো আমার ব্যক্তিগত অভিমত, মননশীলতা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ প্রতিফলন। আমার সাথে কারো দ্বিমত থাকতেও পারে। চিন্তার স্বাধীনতা সবার আছে এটা আমি বিশ্বাস করি, তবে সেটা গ্রহণযোগ্যতা এবং যুক্তিযুক্ত হতে হবে। লেখনীর গর্ভে ক্রটিবিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে মার্জনাজ্ঞানে দেখবেন। লেখনীর পর্যালোচনা যদি কাউকে কিঞ্চিত পরিবর্তন করে, তবে আমার প্রয়াস আমাকে প্রীত করবে।
প্রজ্ঞার আলো প্রবেশ করুক সকল অন্তরে।
ভবতু সব্ব মঙ্গলং।
তথ্যসুত্র ঃ মহাকারুনিক