by admin | Nov 25, 2019 | jatok
প্রাচীনকালে বারাণসী নগরে ব্রম্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন । তাঁর সময়ে বোধিসত্ত্ব কোন এক বণিকের ঘরে জন্ম গ্রহন করেন । বড় হয়ে বোধিসত্ত্ব বাণিজ্য করতে লাগলেন । তাঁর পাঁচশো গরুর গাড়ি ছিল । সেই সব গাড়িতে মাল বোঝাই করে তিনি কখনোও পশ্চিম দেশে বাণিজ্য করতে যেতেন ।
সেই সময় বারাণসী নগরে আর একজন নির্বোধ বণিক বাস করত । কি অবস্তায় কি করতে হয় সে বিষয়ে তার কোন জ্ঞান ছিল না ।
একবার বোধিসত্ত্ব তাঁর গাড়িগুলিতে অনেক মূল্যবান মাল বোঝাই করে তা বিক্রি করার জন্য দূরদেশে যাবার জন্য সংকল্প করেন । এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন সেই নির্বোধ বণিক পাঁচশো গাড়িতে মাল বোঝাই করে সেই দেশে যাবার জন্য সব ঠিক করে ফেলেছে ।
তখন বোধিসত্ত্ব মনে ভাবলেন এক হাজার গাড়ি ও দুই হাজার বলদ ও এতো লোকজন নিয়ে দুই বণিকের একসঙ্গে যাওয়া উচিত হবে না । এক হাজার গাড়ির চাকার ঘর্ষণে রাস্তা ভেঙ্গেচুরে যাবে । এত সব মানুষ ও পশুর খাদ্য ও পানীয়ের অসুবিধা হবে। তাই তিনি সেই নির্বোধ বণিককে ডাকিয়ে সব কথা বুঝিয়ে বললেন । তিনি বললেন, এখন ভেবে দেখ তুমি আগে যাবে না পরে যাবে।
সেই বণিক সব ভেবে বলল সে আগে যাবে । কারণ সে ভাবে, আগে গেলে সে রাস্তা ভাল পাবে । পথে বলদের জন্য ভাল ঘাস পাবে, মানুষের জন্য গাছে ফলমূল পাবে । তাছাড়া ইচ্ছামত মাল কেনাবেচা করতে পারবে।
সেই বণিককে আগে রওনা হতে বলে বোধিসত্ত্ব ভাবলেন আমার পরে যাওয়াই ভাল। ওদের গরুগুলি যাওয়ার ফলে উচুনীচু রাস্তা সমান হবে। ওদের বলদগুলি এখন পাকা ঘাসপাতা খাবে। পরে সেই সব ঘাসে যে সব কচি পাতা বের হবে আমার বলদগুলি তা খাবে। ওরা পথে জলের জন্য যে সব কূপ খনন করবে আমরা পরে যাওয়াই তা ব্যাবহার করতে পারব। তাছারা ঐ বণিক মাল কেনা বেচার যে দাম ঠিক করবে, পরে আমি সেই দামেই কেনাবেচা করতে পারব। আমাকে আর দরাদরি করতে হবে না কষ্ট করে।
সেই নির্বোধ বণিক যাত্রা করার দিনকটক পরে যাত্রা করেন বোধিসত্ত্ব ।
এদিকে সেই নির্বোধ বণিক কয়েকদিনের মধেই লোকালয় ছেড়ে এক দীর্ঘ বিস্তৃত বনের মধ্যে প্রবেশ করল। ষাট যোজন বিস্তৃত সেই বনের মধ্যে পানীয় জল না থাকায় তারা প্রচুর পরিমাণে পানীয় জল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল ।
সেই বনে যক্ষেরা বাস করত। বণিকদের গাড়িগুলো বনে প্রবেশ করলে যক্ষদের রাজা তা দেখে ভাবল, ঐ বণিক আর তার সঙ্গের মানুষ ও গরুদের খাবার জন্য এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে তারা জলের পাত্রগুল থেকে সব পানীয় জল ফেলে দেয় । তাহলে তারা পানীয় জলের অভাবে ক্রমশ হীনবল হয়ে পরবে । তখন তাদের অনায়াসে ধরে তাধের মাংস খাওয়া যাবে ।
এই ভেবে যক্ষরাজ মায়াবলে একটি সুন্দর গাড়ি সৃষ্টি করল। যক্ষরা মায়া জানত এবং সেই মায়াশক্তিবলে যখন যা খুশি সৃষ্টি করতে পারত। যে কোন রূপ ধারন করতে পারত। যক্ষরাজ সেই গাড়িটি দুতি তুষারের মত সাদা ষাঁড় টানছিল । যক্ষরাজ নিজে গাড়ি চালাচ্ছিল সামনে বসে। তার গলায় ছিল শ্বেতপদ্মের মালা। তার মাথার চুল ও পরনের কাপড় জলে ভেজা ছিল । তার গাড়ির আগে ও পেছনে দশ বার জন অনুচর নানা অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ির চাকাগুলো কাদামাখা ছিল ।
ক্রমে সেই নির্বোধ বণিকের গাড়িগুলো যক্ষরাজের গাড়ির সামনে এসে পরে। সবার আগে সামনের গাড়িতে সেই বণিক নিজে ছিল । যক্ষরাজ বণিককে মধুর স্বরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
বণিক বলল আমি বারাণসী থেকে আসছি। কিন্তু পথে কি বৃষ্টি হচ্ছিল? আপনার মাথার চুল ও কাপড় জলে ভেজা দেখছি । আপনার গলায় ও পদ্মফুলের মালা দেখছি । তবে কি সামনে কোন সরবর বা দিঘী আছে?
যক্ষরাজ বলল, আমি এখন যে পথ দিয়ে সে পথ ত সব সময় বৃষ্টি হচ্ছে। আর সে পথের দুধারে শুধু পদ্মফুলে ভরা দীঘি আর সরোবর ।
এরপর যক্ষরাজ বণিককে বলল, আপনাদের মাল বোঝাই গাড়িগুলিতে জলভরা অনেক মাটির জালা দেখছি। সব জল ফেলে দিয়ে মাটির জালাগুলো ভেঙে দিন। গাড়িগুলো হালকা করুন। আপনারা এতক্ষন যে পথে এলেন সেখানে জলের দরকার ছিল । কিন্তু এবার আর জল বয়ে নিয়ে যাবার আর কোন দরকার নেই ।
নির্বোধ বণিক যক্ষরাজের কথায় বিশ্বাস করে সব জল ফেলে দিয়ে জালা গুলো ভেঙে দিলো ।
যক্ষরাজ তার অনুচরদের নিয়ে ঘরে ফিরে গেল ।
এদিকে সেই পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েও নির্বোধ বণিক পথের দুধারে কথাও কোন জলাশয় ডেকতে পেল না। ফলে তারা পিপাসার্ত হয়ে পড়ল । অথচ সঙ্গের সব পানীয় জল তারা ফেলে দিয়েছে । সূর্য অস্ত যাবার পর বণিক সব গাড়ি থামাবার আদেশ দিল । অনুচরেরা গাড়ি থামিয়ে দিয়ে গরুগুলোকে চাকার সঙ্গে বেঁধে দিল । তারপর তারা সেই গাড়িগুলোর মাঝখানে বিশ্রাম করতে লাগল । ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর থাকার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই গুমিয়ে পড়ল সকলে ।
ক্রমে রাত্রি গভীর হলে জক্ষেরা তাদের পুরী থেকে বেরিয়ে এসে তাদের মাংস ভক্ষণ করে হাড়গুলি ফেলে রেখে চলে গেল । কিন্তু তার গাড়ি বোঝাই মাল্গুল যেমন ছিল তেমনি রইল ।
নির্বোধ বণিক যাত্রা করার দেড়মাস পর তাঁর পাঁচশ মাল বোঝাই গাড়ি নিয়ে বারাণসী নগর হতে যাত্রা করলেন । যথাসময়ে তিনি সেই সব গাড়ি আর লোকজন নিয়ে সেই বনে এসে পোঁছলেন।
আগের বণিকের মতই বোধিসত্ত্ব জলপূর্ণ ভাণ্ড সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সেই মেরু প্রদেশে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বোধিসত্ত্ব ভেরী বাজিয়ে তাঁর সব অনুচরদের একজায়গায় একত্রিত করে তাদের বললেন, এখানে কোথাও জল পাওয়া যায় না। এইখানে অনেক বিষ বৃক্ষ আছে। সুতরাং আমার বিনা আনুমতিতে তোমরা এখানকার কোন জল বা ফল খাবে না।
সেই পথে কিছুদুর গেলে সেই যক্ষরাজ আগের মতই মানুষের বেশ ধারণ করে ভিজে কাপর পরে পদ্মফুলের মালা গলায় দিয়ে বোধিসত্ত্বের সামনে এসে বলল, এইপথে কিছুদূর গিয়েই দেখবে অনেক জলাশয় আছে। সেখানে সব সময় বৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং জল বয়ে নিয়ে যাবার কোন দরকার নেই। জলপূর্ণ বড় বড় পাত্রগুলি হতে সব জল ফেলে দিয়ে তোমাদের গাড়িগুলো হাল্কা কর। বোধিসত্ত্ব লক্ষ্য করলেন, এই লোকটি যক্ষ, মানুষ নয়। করণ তাঁর চোখ রক্তবর্ণ, উগ্রমূর্তি, তার কোন ছায়া পড়ছেনা মাটি্তে।
এই দেখে তিনি তাকে বললেন, দূর হ পাপিষ্ঠ। আমরা বণিক, আমরা নিজের চোখে জল না দেখে আমাদের সঞ্চিত জল ফেলে দেব না। যখন জল পাবার উপায় দেখব তখন নিজের বুদ্ধিতেই জল ফেলে দিয়ে হাড়িগুলো হালকা করব। তোর কাছে পরামর্শ নিতে যাব না।
এইভাবে তার কুউদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় যক্ষরাজ তার নিজের পুরীতে ফিরে গেল।
বোধিসত্ত্বের এক অল্পবুদ্ধি অনুচর কিছুতা দূর থেকে মানুষবেশী যক্ষরাজকে দেখেছিল। সে তার কথায় বিশ্বাস করে বলল, যে লোকটা এসেছিল তার গায়ে জল এবং কাপড় ভিজা ছিল। তার গলায় ছিল পদ্মফুলের মালা। যে পথ দিয়ে এসেছিল সে পথ নিশ্চয় পদ্মফুলে ভরা সরোবর আছে। সে পথে নিশ্চয় সর্বদা বৃষ্টি হচ্ছে। অতএব আমাদের সঞ্চিত জল ফেলে দিয়ে গাড়িগুলো হালকা করাই ভাল।
বোধিসত্ত্ব তখন তার অনুচরদের ডাকিয়ে জড়োকরে তাদের বললেন, যে লোকটি এসেছিল আমার কাছে, সে মানুষ নয়, যক্ষ। তার কথা শুনবেনা। লোকটা বলে গেল, দূরে যে নীল বন দেখা যাচ্ছে সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে সর্বদা। কিন্তু বৃষ্টি হলে এক যোজন দূর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বয়। কিন্তু তোমরা কোন ঠাণ্ডা বাতাস টের পেয়েছ কি?
অনুচরগণ বলল, না।
বোধিসত্ত্ব বললেন, যে মেঘে বৃষ্টি হয় তার একটা অন্তত এক যোজন দূর হতে দেখা যায়। কিন্তু তোমরা দেখতে পাওনি। কোনও বিদ্যুতের চমকও ডেকতে পাওনি। দু এক যোজন দূর হতে মেঘের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু তোমরা কোনও মেঘগর্জনও শুনতে পাওনি।
এখন শোন, যে লোকটা এসেছিল সেই মায়াবি যক্ষটা এক কু-অভিসন্ধি নিয়ে এসেসিল। সে ভেবেছিল আমরা তার কথা শুনে আমাদের সব জল ফেলে দিব। আমরা তৃষ্ণাই ক্লান্ত হয়ে পড়ব। জল অভাবে আহার করতে পারব না। এইভাবে আমারা সকলে হীনবল হয়ে পরলে তারা অনায়াসে বধ করে আমাদের মাংস খাবে। সুতরাং এক বিন্দু জলও ফেলবে না। আমাদের আগে যে বণিক এসেছিল, সে যক্ষের কথাই সব জল ফেলে দিয়েছিল। পরে তারা ক্ষুধাতৃষ্ণাই কাতর হলে যক্ষরা তাদের বধ করে। কিছুদুর গেলেই দেখবে তাদের গাড়িগুলো আরা হাড় কঙ্কাল গুলো পথের উপর পরে আছে।
তখন বোধিসত্ত্ব ও তার অনুচর গণ দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেল, সত্যিই তাদের আগের নির্বোধ বণিকের পাঁচশ গাড়ি পরে আছে। কোনও গরু বা মানুষ নেই। তাদের হাড় কঙ্কাল গুলো শুধু পরে আছে। তা দেখে বোদিসত্ত্বের আনুচরদের চৈতন্য হোল । সেইখানে তারা আহার ও রাত্রি জাপন করলেন। এরপর বোধিসত্ত্ব দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য তার যে সব গাড়িগুলো প্রায় ভেঙ্গে পরেছিল সেগুলি ফেলে রেখে নির্বোধ বণিকের ভালো ভালো গাড়িগুলো নিয়ে নিলেন। তারপর তার গাড়িগুলোতে যে সব কম মূল্যের মাল ছিলসেগুলি ফেলে দিয়ে নির্বোধ বণিকের বেশি মুল্যের মালগুলি নিজের গাড়িতে তুলে নিলেন। তারপর বোধিসত্ত্ব তার গন্তব্য স্থানে গিয়ে পোঁছলেন। সেখানে তার বাণিজ্য ভালই হোল। আগের বণিক না জেতে পারায় সেখানে মালের চাহিদা ছিল। তিনি তার সব মাল দবি-গুন বা তিন গুন মূল্যে বিক্রি করে অনেক ভালো লাভ করলেন। তারপর নিরাপদে তাঁর দেশে ফিরে গেলেন।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র
by admin | Nov 25, 2019 | jatok
পুরাকালে বোধিসত্ত্ব এক গোজন্ম লাভ করছিলেন। তাঁর বয়স তখন খুব অল্প ছিল। তাঁর মালিক তাকে নিয়ে এক বৃদ্ধার বাড়িতে বাস করত। পরে ঘরের ভাড়া দিতে না পেরে বোধিসত্ত্বকে বৃদ্ধার কাছে দান করে যায়। বৃদ্ধা তাঁকে নিজের সন্তানের মোট স্নেহ করে পালন করত। লোকে সেই বৃদ্ধাকে ঠাকুমা বলে ডাকত।
বোধিসত্ত্বের গায়ের রঙ খুব কাল ছিল। তাই তাঁর নাম ছিল কৃষ্ণ। তিনি অন্যান্য গরুদের সাথে নদীর ধারে মাঠে চরতেন। আবার গ্রামের ছেলেরা তাঁর সঙ্গে খেলা করে বেড়াত। তাদের আবার কেউ কেউ শিং ধরে টানত। কেউ কেউ আবার তাঁর পিঠের উপর চড়ত।
বোধিসত্ত্ব একদিন ভাবতে লাগলেন, এই বৃদ্ধার আমার মা। তিনি বড় গরীব। তিনি অতি কষ্টে আমাকে পালন করেন। সুতরাং তার জন্য আমার কিছু অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করা উচিত।
এই ভেবে সেদিন বোধিসত্ত্ব নদী তীরে মাঠে চড়তে গেলেন।
সেদিন এক বণিক পাঁচশো বোজাই গরুর গাড়ি নিয়ে সেই পথে কোন দূর দেশে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিল।
তখন নদীতে জল ছিল। কিন্তু নদীগুলোর পথ এত উচু-নীচু ছিল যে পাঁচশো গাড়ির এক হাজার গরু মোটেই গারিগুলো তান্তে পারছিল না।
নদীগুলোর ধারে নিকটেই এক মাঠে বোধিসত্ত্ব অন্যান্য গরুদের সাথে চরছিলেন। বণিক সেই গরুর পালের কাছে এসে উৎকৃষ্ট জাতীয় বলদের খোঁজ করতে লাগলেন। অবশেষে বোধিসত্ত্বের উপর তার চখ পরল।
বোধিসত্ত্ব গরু হয়ে জন্মালেও তাঁর দেহে কতগুলো সুলক্ষণ ছিল যে তাঁকে দেখলেই উৎকৃষ্ট জাতীয় বলে মনে হত। বোধিসত্ত্বকে দেখা মাত্র বণিক বুঝতে পারল এই বলদের দ্বারা তার কাজ সিদ্ধি হবে। এই বলদ তার পাঁচশো গাড়িকে ঐ উচু-নীচু পথ হতে টেনে উদ্ধার করতে পারবে। সে তখন মাঠের রাখালদের জিজ্ঞেস করল, এই গরুতি কার? আমি একে আমার গাড়িতে জুতে গাড়িগুলো পার করতে পারলে উপযুক্ত ভাড়া দেব।
আপনি জুতে দিন। এর কোন মালিক নেই।
কিন্তু বণিক যখন বোধিসত্ত্বের নাকে পড়িয়ে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল, তখন বোধিসত্ত্ব দাঁড়িয়ে রইলেন।এক পাও নড়লেন না। আগে ভাড়া ঠিক না করলে তিনি যাবেন না, এই সঙ্কল্প করলেন তিনি মনে মনে। তখন বণিক তাঁর অভিপ্রায় বুঝতে পেরে বলল, আপনি যদি আমার পাঁচশো গাড়ি পার করে দেন, তাহলে আমি গাড়ি প্রতি দুই মুদ্রা করে দেব। অর্থাৎ মোট সহস্র মুদ্রা।
বণিক এই কথা বলার সাথে সাথে বোধিসত্ত্বকে আর জোর করে টেনে নিয়ে যেতে হল না, তিনি নিজেই গারিগুলর দিকে এগিয়ে গেলেন।
বণিকের অনুচরেরা বোধিসত্ত্বকে এক এক গাড়ির সাথে জুতে দিল আর বোধিসত্ত্ব একে একে গারিগুলকে নদীর পর পারে রেখে এলেন। এইভাবে বণিকের পাঁচশো গাড়িকেই পার করে দিলেন বোধিসত্ত্ব।
বণিক তখন চাতুরি করে গাড়ি প্রতি এক মুদ্রা করে পাঁচশো মুদ্রা একটি থলিতে ভরে সেই থলেতি বোধিসত্ত্বের গলায় বেঁধে দিল।
বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, এ ব্যক্তি যে ভাড়া দেবার কথা বলেছিল সেই ভাড়া দিচ্ছে না। অতএব এক যেতে দেব না।
মনে মনে তিনি এই স্থির করে আগের গাড়িটির সামনে গিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ালেন। বণিকের লোকেরা শত চেষ্টা করেও সরাতে পারল না পথ থেকে। তখন বণিক তার ভুল বুঝতে পারল। বুঝতে পারল এই গরু সাধারণ গরু নয়। আমি একে প্রতিশ্রুত অর্থ দিইনি এ তা বুঝতে পেরেছে। এ অলৌকিক শক্তির অধিকারী।
বণিক এবার এক হাজার মুদ্রা থলিতে ভরে বোধিসত্ত্বের গলায় বেঁধে দিল। বোধিসত্ত্ব সেই মুদ্রা নিয়ে তাঁর পালিকা মাতা সেই বৃদ্ধার কাছে চলে গেলেন। বণিকও তার পাঁচশো গাড়ি নিয়ে তার গন্তব্য স্থানে চলে গেল।
গ্রামের ছেলেরা “বৃদ্ধার ছেলে কি নিয়ে যাচ্ছে” বলে চিৎকার করতে করতে বোধিসত্ত্বের দিকে ছুতে এলে বোধিসত্ত্ব তাদের শিং দিয়ে তাড়িয়ে দিল। শেষে তিনি বৃদ্ধার বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলেন। বৃদ্ধা বোধিসত্ত্বের গলায় একটি থলিতে ভরা এক হাজার মুদ্রা পেয়ে আশ্চার্য হয়ে বলল, একই বাছা, এত মুদ্রা কোথায় পেলি?
তখন রাখালরা বৃদ্ধাকে সব বৃত্তান্ত খুলে বল্ল।বৃদ্ধা সব কথা শূনে বোধিসত্ত্বকে বলল, তুই উপারজ করে আমাকে খাওয়াবি, আমি কি তোকে কখনো একটা বলছি? কেন তুই আমার জন্য এত কষ্ট করতে গেলি?
পাঁচশো গাড়ি টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন বোধিসত্ত্বকে লক্ষ্য করে বৃদ্ধা গরম জলে থাকে স্নান করাল। তারপর তাঁর গায়ে তেল মাখিয়ে উৎকৃষ্ট খাদ্য ও পানীয় দিল।
বৃদ্ধা ও বোধিসত্ত্ব দুজনই এইভাবে সৎ জীবন-যাপন করার পর কর্মের অনুরূপ ফল ভোগের জন্য পরলকে গমন করলেন।
by admin | Nov 25, 2019 | jatok
পুরাকালে ব্রম্মদত্ত যখন বারাণসী রাজা ছিলেন, বোধিসত্ত্ব তখন তার পুরোহিত ছিলেন। বোধিসত্ত্ব তিন বেধ ও অষ্টাদশ বিদ্যাই পারদর্শী ছিলেন। তিনি পৃথিবী জয় মন্ত্র জানতেন। মন্ত্রটি আবর্জনমন্ত্র নামে অভিহিত হত।
একদিন বোধিসত্ত্ব ঐ মন্ত্র আবৃতি করার জন্য এক নির্জন স্থানে গমন করলেন। তারপর একটি পাথর খণ্ডের উপর বসলেন। এই মন্ত্র বিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুস্থান না করে কাউকে শোনাতে নেই। তাই বোধিসত্ত্ব নির্জন স্থানে গিয়েছিলেন।
বোধিসত্ত্ব যখন এই মন্ত্র আবৃতি করছিলেন তখন শৃগাল তার গর্ত থেকে তা শুনতে পেল এবং কণ্ঠস্থ করল। ঐ শৃগাল কোন অতীত জন্মে ব্রাহ্মণ ছিল এবং ঐ মন্ত্র আবৃতি করেছিল।
বোধিসত্ত্ব মন্ত্র আবৃতি করার পর আসন হতে উঠে বললেন, আমি দেখছি এই মন্ত্র সুন্দররূপে কণ্ঠস্থ করেছি।
শৃগাল তখন গর্ত থেকে বের হয়ে বলল, ঠাকুর, আমি এই মন্ত্র আপনার থেকে আরও ভালও করে কণ্ঠস্থ করেছি।
এই বলে শৃগাল পালিয়ে গেল। বোধিসত্ত্ব তার পিছু পিছু ছুটলেন। চিৎকার করে বললেন, শৃগালটাকে ধর, তা না হলে মহা অনর্থ ঘটবে।
কিন্তু কেউ তাকে ধরতে পারল না। সে গভীর অরণ্যে চলে গেল। সে সেখানে গিয়ে একটা শৃগালীর পায়ে ঈষৎ কামড় দিল। শৃগালী জিজ্ঞেস করল, কি আজ্ঞা করছেন প্রভু?
শৃগাল তাকে বলল, আমি কে তা জানিস?
শৃগালী বলল, আমি আপনাকে জানি না।
শৃগাল তখন পৃথিবী জয় মন্ত্র পাঠ করে বনের সমস্ত হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, শূকর, মৃগ প্রভৃত সমস্ত পশুদের তার নিজের কাছে এনে জড়ো করাল। তারপর সে তাদের রাজা হয়ে সর্বদ্রংস্ত্র নাম ধারণ করল এবং এক শৃগালীকে তার অগ্রমহিষী করল। দুটো হাতির পিঠে এক সিংহ বসত এবং সেই সিংহের পিঠে শৃগাল ও তার মহিষীকে নিয়ে বসত। এইভাবে সে তার অরণ্য রাজ্য শাসন করত। বনের সমস্ত জন্তু তাকে সম্মান করত রাজা হিসাবে।
এইভাবে কিছু দিন গত হবার পর মদমত্ত শৃগালের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগল। সে বারাণসী রাজ্য জয় করতে সংকল্প করল। সে বনের সমস্ত পশুদের নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করল এবং বারণসী নগরের প্রান্তে উপস্থিত হয়ে সে তার সেনা নিবেশ করল। সে রাজাকে বলে পাঠাল, না হয় যুদ্ধ কর না হয় রাজ্য ছেড়ে দাও।
নগরবাসীরা ভয়ে নগরের সব নগরদ্বার বন্ধ করে দিল। শৃগালের অনুচরগণ নগরের বাইরে দ্বাদশ যোজন বিস্তার করে নগর অবরোধ করে রইল।
বোধিসত্ত্ব রাজার কাছে গিয়ে বললেন, ভয় নেই মহারাজ। আমি শৃগালের সাথে জুধ করব। আমি ছাড়া তার সাথে কেউ যুদ্ধ করতে পারবে না।
এই বলে তিনি নগরের সিংহদ্বারের পাথরের উপর দাঁড়িয়ে শৃগালকে বললেন, কি হে সর্বদ্রংস্ত্র, কি উপায়ে তুমি নগর জয় করার ইচ্ছা করেছ?
আমি সিংহদের গরজন করতে বলল। সিংহনাদ শূনে নগরবাসী ভয়ে বিহুল হয়ে পরবে। আমি তখন আনায়াসে নগর অধিকার করব।
শৃগাল রাজ সর্বদ্রংস্ত্ররের এই অভিপ্রায় জেনে বোধিসত্ত্ব পাথর থেকে নেমে ভেরী বাজিয়ে দ্বাদশ যোজন বেষ্টিত বারাণসী নগরের সব অধিবাসীদের বলে দিলেন, তোমরা সকলে মাষপিষ্ট দ্বারা নিজ নিজ কর্ণ বিবর বন্ধ করে দাও।
নগরবাসীরা তাই করল। তারপর বোধিসত্ত্ব সেই পাথরের উপর উঠে বলল, কি হে সর্বদ্রংস্ত্র, তুমি এবার সিংহনাদ করাও। সিংহেরা তোমার মত এক বৃদ্ধ শৃগালের আদেশ সুনবে না। তুমি তাদের দিয়ে গর্জন করাতে পারবে না।
সবদ্রংস্ত্র বলল, অন্য সব সিংহের কথা ছেড়ে দিলাম, আমি যে সিংহের পিঠে বসে আছি, সে আমার কথায় অবশ্যই গর্জন করবে।
এই বলে সে সিংহকে গর্জন করতে আদেশ দিলেন। তখন সেই যে হাতির পিঠে বসে ছিল, সে হাতির পিঠে মুখ নিয়ে ঘোর গর্জন করল। সেই ঘোর সিংহ নাদ শূনে হাতিটি ক্ষিপ্ত হয়ে শৃগালকে তার পায়ের তলায় ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষ্ট করে ফেলল। তার মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। তখনি তার প্রাণ বিয়োগ হল।
তখন সব হাতিই উন্মত্ত হয়ে পরস্পরকে আঘাত করল তখন সিংহ ছাড়া সব পশুই মারা গেল। তারপর সিংহেরা বনে পালিয়ে গেল। তখন সেই দ্বাদশ যোজন বিস্তৃত স্থানে কেবল মৃত পশুদের মাংস রাশি পড়ে রইল।
বোধিসত্ত্ব পাথর হতে নেমে ভেরী বাজিয়ে নগরবাসীদের বলে দিলেন, এবার তোমরা তোমাদের কর্ণবিবর হতে মাপিষ্ট ফেলে দাও। অবরোধকারী জন্তুরা সব বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছে। তোমরা ইচ্ছা মত শূকর, মৃগ, শশক প্রভৃতি পশুদের মাংস নিয়ে এস।
নগরবাসীরা এই কথা শূনে ইচ্ছামত মাংস এনে খেল এবং বাকি মাংস শুকিয়ে রাখল।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র
by admin | Nov 25, 2019 | jatok
পুরাকালে বারাণসি রাজা ব্রম্মদত্তের সময় বোধিসত্ত্ব এক ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহন করে ঋষিপ্রবজ্যা গ্রহন করেন।
একদিন লবণ ও অম্ল সংগ্রহের জন্য তিনি বারাণসিতে উপস্থিত হলেন। পরদিন তিনি ভিক্ষার জন্য নগরে গেলেন। একদিন এক সঙ্গতি সম্পন্ন লোক বোধিসত্ত্বের জ্ঞান পরীক্ষা করার অভিপ্রায়ে তাঁকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। তারপর একটা আসন দেখিয়ে বস্তে বলল। তারপর মাছ মাংস প্রভৃতি রান্না করে তাঁকে ভোজন করাল। পরে একপাশে বসে বলতে লাগল, আপনার উদ্দেশ্যেই প্রাণী বধ করে এই মাংস সংগ্রহ করা হয়েছিল। অতএব এতে যে পাপ হয়েছে তা আপনার, আমার নয়।
বোধিসত্ত্ব একটি গাথার মাধ্যমে বললেন, দুরাচারগণ তাঁকে মাংস দিতে পারে। কিন্তু অতিথি যদি প্রজ্ঞাবান হন তাহলে তাতে যে পাপ হয় তা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।
বোধিসত্ত্ব এই কথা বলে গৃহস্থকে উপদেশ দিয়ে আসন থেকে উঠে প্রস্থান করলেন।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র
by admin | Nov 25, 2019 | jatok
পুরাকালে বারাণসীতে ব্রক্ষ্রদত্ত নামের এক রাজা ছিলেন। সেই বোধিসত্ত্ব সংসার জীবনে প্রবেশ না করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে হিমালয়ে গিয়ে বাস করতে থাকেন। তিনি তপস্যা দ্বারা সমাপত্তি লাভ করেছিলেন।
বারাণসীরাজ ব্রক্ষদত্তকুমার। ব্রক্ষদত্ত কুমার যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে বহু অনুচর ও অস্ত্রসত্র নিয়ে সর্বদা ঘুরে বেড়াতেন। কুমারের এই আড়ম্বরপ্রীতি দেখে রাজার সন্দেহ হলো, কুমার হয়ত পিতাকে রাজ্যচ্যুত করে পিতার জীবিতকালেই রাজা হতে চান।
এই সন্দেহের বশে রাজা কুমারকে রাজ্য হতে নির্বাসিত করলেন। ব্রক্ষদত্তকুমার তখন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে হিমালয় চলে গেলেন। সেখানে একটি পর্ণকুটির নির্মাণ করে মাছমাংস ও ফলমূল খেয়ে জী্ন ধারধণ করতে লাগলেন।
রাজকুমারের পত্নীর নাম ছিল অসিতাভা।েএকদিন রাজকুমার িএক সুন্দরী কিন্নরীকে দেখে তার রূপে মোহিত হয়ে স্থির করলেন, তিনি সেই কিন্নরীকে পত্নীরূপে বরণ করে নেবেন। এই মনে করে তিনি অসিতাভাকে উপেক্ষা করে সেই কিন্নরীকে পিছনেই ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
স্বামীকে কিন্নরীর প্রতি আসক্ত দেখে স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলেন অসিতাভা। তিনি ভাবলেন, আমার স্বামীর সঙ্গে আর আমার কোন সম্পর্ক নেই। কারণ তিনি এখন আমাকে উপেক্ষা করে এক কিন্নরীর পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এই ভেবে অভিতাভা বোধিসত্ত্বের নিকট গিয়ে ধর্মোপদেশ গ্রহণ করলেন। তারপর ধ্যানবলে অভিজ্ঞা ও সমাপত্তি লাভ করলেন। তারপর বোধিসত্ত্বকে প্রণাম করে সেই পর্ণশালায় ফিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এদিকে ব্রক্ষদত্তকুমার শত চেষ্টাতেও কিন্নরীর দেখা বা কোন সন্ধান না পেয়ে হতাশ হয়ে তাঁর পর্ণশালায় ফিরে এলেন। অসিতাভা স্বামীকে ফিরে আসতে দেখে আকাশে উত্থিত হয়ে একটি গাথার মাধ্যমে বললেন, আর্যপুত্র, আমি তোমার অনুগ্রহেই এই ধ্যানসুখ লাভ করেছি। যখন দেখলাম তুমি কিন্নরীর প্রেমে আসক্ত হয়ে আমায় ফেলে চলে গেলে, তখনই তোমর প্রতি আমার সব অনুরাগ দূর হয়ে গেল। করাত দ্বারা দুখণ্ড করা গজদণ্ড যেমন আর জোড়া লাগে না, তেমনি মানুষের প্রণয়ও একবার খন্ডিত হলে আর অখন্ড হয় না।
এই বলে তিনি শূন্যে আরও উপরে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কুমার দেখতে গিয়ে তাঁকে দেখতে পেলেন না। তখন একটি গাথার মাধ্যমে আক্ষেপ করতে লাগলেন, দুষ্প্রাপ্যকে পাবার লোভে মত্ত হয়ে আমি আমার সতী অসিতাভাকে হারালাম। আমি কি ঘৃণ্যমতি!
এইভাবে বিলাপ করতে করতে রাজকুমার একাই সেই পর্ণশালায় বাস করতে লাগলেন। পরে পিতার মৃত্যু হলে বারাণসীতে গিয়ে রাজপদ লাভ করলেন।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র