“হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে হৃদয়ে রয়েছ গোপনে”

সবার জীবনে প্রেম আসে নীরবে- সরবে , কারণে-অকারণে চলমান জীবন প্রবাহে । তাই কিংবদন্তী শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের গানে প্রেমের অনুভূতিটা জাগিয়ে তুলে মনে মনে বলি – প্রেম একবার এসেছিল নীরবে , আমারই এ দুয়ার প্রান্তে , সে তো হায় মৃদু পায় , এসেছিল পারিনি তো জানতে । বেশ কিছুদিন ধরে করোনা কালে সোশ্যাল মিডিয়ার এমন মন কাড়া কিছু আবেদনময়ী ছবি দেখে মনের একান্ত অনুভবে , ভালোবাসা ও প্রেম নিয়ে লেখার অনুভূতি জেগে উঠলো। ভালোবাসা পরের কল্যানে , পরহিত , স্বতন্ত্র , সার্বজনীন এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এক অনুভূতির নাম। ইহা মানবের কল্যানে নিবেদিত এক মহান ব্রত।ভালোবাসার কোন চাওয়া – পাওয়া বা দেনা – পাওনা নেই। মানবতার দায়িত্ববোধ থেকেই পরের কল্যানে নিজেকে সঁপে দেওয়া। আর প্রেম হলো ভালোবাসার একটা অংশ বটে কিন্তু সংকীর্ণ , স্বার্থপরতা , আত্মহিত , আত্মসুখ , আত্মতৃপ্তি ও কামনা বাসনাপূ্র্ন। ভালোবাসা হয় একপক্ষ থেকে আর প্রেম হয় উভয় পক্ষ থেকে। ভালোবাসার জন্য প্রেম আবশ্যক নয় কিন্তু প্রেমের জন্য ভালোবাসা অপরিহার্য। ভালোবাসা আর প্রেম সারাজীবন শব্দ দুটোর ব্যাপক ব্যবহার করে থাকি।কোনদিন গভীরভাবে ভেবে দেখা হয়নি শব্দ দুটোর আসলে পার্থক্য কিরূপ ! আপাতদৃষ্টিতে ভালোবাসা আর প্রেমের মধ্যে তেমন কোন পাথর্ক্য দেখা যায় না। কিন্তু ভালোবাসা আর প্রেমের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। “ভালো” হলো বিশেষণ আর “বাসা” ক্রিয়া তার অর্থ হলো উত্তম, শুভ, হিতকর, নীরোগ, সুস্থ, সৎ, নিরীহ, সুন্দর, দক্ষ বা কল্যান কামনা করা। এক কথায় ভালোবাসা শব্দটির অর্থ গভীর ও বিশাল। ভালোবাসা শাশ্বত ও চিরস্থায়ী। ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ মানব কল্যানে নিজেকে আত্মদান করা। মানব জীবনকে সমৃদ্ধ ও সামাজিক কাছে নিজেকে আত্মনিয়োগ বা সমর্পণ করা যায় একমাত্র ভালোবাসা বা পরের কল্যান সাধনে। ভালোবাসা সাধারনত এক তরফা হয়ে থাকে এবং বহুজনহিতকর ও মোহহীন। ভালোবাসাতে দুই পক্ষের কোন স্বার্থপরতা বিদ্যমান থাকে না। প্রধান ভূমিকা হলো আত্মত্যাগ তাই ভালোবাসা পরহিতকর, মঙ্গলজনক ও কল্যাণকামী। ভালোবাসাটা হচ্ছে মানুষের মনের আবেগ অনুভূতির একটা স্বাভাবিক রূপ। মানুষের প্রতি মানুষের বন্ধুত্ব , শ্রদ্ধাবোধ , মমত্ববোধ ও আত্মীয়তার বন্ধন থেকেই ভালোবাসার সৃষ্টি। ভালোবাসা একেক সময় একেক রকম রূপ , রং ও বৈশিষ্ট্যময়। মাতাপিতার সাথে সন্তানের ভালোবাসা , ভাই-বোনের ভালোবাসা , ছোটদের প্রতি বয়োজ্যেষ্ঠদের ভালোবাসা , সমাজে প্রতিটি স্তরে একে অপরের প্রতি আন্তরিকতার সহিত সুখে দুঃখে একাত্মতায় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ভালোবাসা ব্যতীত এ বিশ্বায়নের যুগে পূর্ব-পশ্চিমে ও উত্তর-দক্ষিণে সর্বত্র যে আত্মার বন্ধনে মিতালী চলছে তা কি আদৌ সম্ভব ছিল ! সত্যিকারের ভালোবাসা কোনদিন ভুলা যায় না বা দূরেও সরে যায় না। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবি ঠাকুরের ভাষায় ,” নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে ,হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে হৃদয়ে রয়েছ গোপনে”।অন্যদিকে প্রেম হলো মনের প্রশান্তি বা মনের একান্ত চাওয়া। প্রেম হলো বিশেষ্য এর অর্থ বন্ধুত্ব , স্নেহ , শ্রদ্ধা , ভক্তি , প্রীতি , আসক্তি , আকর্ষণ , টান , পছন্দ , অনুরাগ , প্রণয় , সুহৃদ , প্রণয়ের পাত্র বা ভালোবাসা , স্বামী বা ভাললাগে এমন ব্যক্তি বা বিষয়। সাধারনত মনের একান্ত চাওয়া , আত্মহিত , আত্মসন্তুষ্টি থেকেই প্রেমের জন্ম বা প্রেমের উৎস। প্রেমটা অবশ্যই দু’পক্ষের হতে হয় কোনভাবেই এক পক্ষ থেকে প্রেম হয় না। প্রেমের গভীরতা বা আবেদন ভালোবাসা থেকেও অনেক বেশী। প্রেম ভালোবাসার একটা রূপ। মনের মত মন খুঁজে সত্যিকারের প্রেম করা এক ধরনের শিল্প বৈকি। প্রেম কখন কার জীবনে আসে বা হানা দেয় তা বলা মুশকিল। তাই বলা হয় , ” Love at first site” যে কোন বয়সে যে কোন সময় প্রেম মানুষের মনে দোলা দিয়ে যায়। অনেকটা মনের আনন্দ বা খোয়াকও বললে কটুক্তি হবে না। প্রেমে বয়স , সম্পর্ক , জাত , লিঙ্গ , সৌন্দর্য তেমন কিছু আসে যায় না মনের ভাললাগাটার প্রাধান্যই অন্যতম। ভালোবাসা ও আসক্তি বেড়ে যাওয়ার হলো প্রেম। দুইটি মন যখন খুব কাছাকাছি , জানাজানি ও বোঝাপড়ার ঐক্যমতে পৌঁছে তখন শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও তাদের মধ্যে প্রেম সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় প্রেম বিষয়টা বলার লোভ সামলাতে পাচ্ছি না। কর্মময় জীবনে দীর্ঘ পরিক্রমার প্রাণপ্রিয় এক কলিগের সাথে এমন হৃদয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি যা আমি আর ঊনার জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। পূর্ব-পশ্চিম আমাদেরকে তেমন আলাদা করতে পারিনি। কোন কাম্যতাও নেই শুধু বিশ্বাস আর আস্হা বা বোঝাপড়া। অনেক স্বামী -স্ত্রী মধ্যেও এমন মিল আছে কিনা সন্দেহ ! লিঙ্গ আর বয়সটা নাই বা বললাম আপাতত। এটা হলো প্লেটোনিক প্রেম ( Platonic Love) বা শুদ্ধতম ভালোবাসা আবার আত্মিক ভালোবাসাও বলা যায়। এ প্রেম শরীরী নয় , অশরীরী। Platonic এ শব্দটির উৎপত্তি মূলত প্লেটোর “প্লেটোনিজম” মতবাদ থেকে। আবার প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল বলেন , যে প্রেম রাজাধিরাজের মতো দুহাত ভরে শুধু দিয়ে যায় , নেয় না কিছুই। যৌনতা ও কামগন্ধহীন শুধু হৃদয়ের বন্ধনেই এই সর্বোৎকৃষ্ট প্রেমকে লাভ করার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর দুঃসহ যন্ত্রনাসমূহও নীরবে সহ্য করতে হয়।কোন রকম চাহিদা বিহীন অনন্ত ভালোবাসা। যা ভালোবাসার সবোর্চ্চ পর্যায়ে এক গভীর ও প্রচন্ড ভালোবাসা ।এমন প্রেমকে স্বর্গ সুখ মনে হয় তা হলো Friendly Love.প্রেমের কবি হেলাল হাফিজ তাঁর “পৃথক পাহাড়” কবিতায় বলেছেন , ” কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়”। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে আজ অবধি ও মানব জন্মের ইতিহাস একই সূত্রে গাঁথা। পৃথিবীর প্রায় সকল সমাজে এই প্রেমকে শাশ্বত এবং পবিত্র বলে ধরে নেওয়া হয়। পৃথিবীর অমর প্রেমগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়।পৃথিবীর প্রথম নর-নারী আদম-হাওয়া পরস্পরের প্রেমে পড়েছিলেন। এ ছাড়া শ্রী রামচন্দ্রের পবিত্রতা স্ত্রী সীতার প্রেমে পড়েছিলেন স্বয়ং রাবন। এজন্য তিনি সীতাকে অপহরণ করে অশোককাননে বন্দী রেখে দেহ-মন পাবার সমস্ত কলাকৌশল অবলম্বন করেছিলেন। বৌদ্ধশাস্ত্রে উল্লেখ আছে , কর্কশ বাক্যজনিত কারণে কর্মের বিপাকে আম্বপালি বৈশালী রাজ্যে রূপের অনন্য খ্যাতি সম্পনা সুন্দরী রমণী হয়ে জন্মেছিলেন। যাঁর চেহারা এত সুন্দর – যে কেউ শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। বৈশালী লিচ্ছবী রাজকুমারগণ তাঁকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় , বৈশালীর রাজা এ মহাবিতর্ক নিরসনে রাজকুমারদের গণিকা করে তাঁর প্রাপ্যতা নির্ধারণ করে দিলেন। মগধের রাজা বিম্বিসারও আম্রপালির প্রেমে মুগ্ধ ছিলেন। তাঁদের গোপন প্রেমে এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। সেই পুত্র বুদ্ধের শাসনে প্রব্রজিত হয় , তিনি নিজের পুত্রের ধর্মসুধা শ্রবণ করে আম্রপালি ভিক্ষুণী হয়ে অচিরে অহর্ৎফল বা জ্ঞানচক্ষু লাভ করেন , দুঃখ হতে চিরমুক্তি হন এবং কর্মবিপাক উপলব্ধি করেন। যাহোক , সুন্দরের প্রেমে রাজা , মহারাজা ও রাজপুত্রগন কেউ বাদ পড়েন না কিন্তু সমাজে প্রেম ভালোবাসার স্বীকৃতি পাওয়াটা আজো কঠিন রয়ে গেল। অপূর্ব সুন্দরী হেলেনের প্রেমে পড়েছিল গ্রীক পুরাণের প্রেমিক পুরুষ প্যারিস। হেলেন তখন রাজা মেনেলাসের স্ত্রী। তাই এই ভালোবাসা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় স্বীকৃত ছিল না। ফলে ধ্বংস হয়েছিল ট্রয় নগরী। ইতিহাসে প্রেমে মিলনের চেয়ে বিরহটাই বেশী দেখা যায়। কথায় আছে , বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না ইহা দূরেও ঠেলে দেয়। যেমন সাইকি – কিউপিড (গ্রীক) , রাধা- কৃষ্ণ (ভারত উপমহাদেশ) , লাইলী- মজনু (পারস্য) , বেহুলা- লখিন্দর (বাংলাদেশ) , রোমিও – জুলিয়েট (রোম) , ওডিয়াস – পেনেলোপ (গ্রীক) , পিরামাস- থিসবি (গ্রীক) , পিগম্যালিয়ন – গ্যালাটিয়া (গ্রীক) , দেবদাস- পার্বতী (ভারত) , ভিক্টোরিয়া- আলবার্ট (বিট্রেন) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। শত বিরহের মধ্যেও ইতিহাস কাঁপিয়ে দেওয়া প্রেম কাহিনী অনেক আছে। তদ্মধ্যে অমর প্রেমের মহাকাব্য রচনা করেছেন মোগল সম্রাট শাহাজাহান তাঁর পরমাসুন্দরী স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম মমতাজ এর জন্য উৎসর্গকৃত সমাধির স্মৃতিসৌধ প্রেমের তাজমহল। আজো স্বগৌরবে নান্দনিক স্থাপত্যকলা ও নির্মাণশৈলীর জন্য পৃথিবীতে সপ্তমাশ্চ্যর্যের স্থান দখল করে আছে। সম্রাট শাহজাহান আর মমতাজ বেগম যে সৌধের ছায়ার চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তা আজও পৃথিবীতে বিরল প্রেমের ভালোবাসার নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে আমার খুব মনে পড়ে কবিগুরু রবি ঠাকুরের রোমান্টিক উপন্যাস “শেষের কবিতার” প্রেমিক পুরুষ ব্যারিস্টার অমিত রায় তাঁর একান্ত ভালোবাসা কে প্রকাশ করে এভাবে , “কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধে ভালোবাসাই , সে যেন ঘড়ার তোলা জল প্রতিদিন তুলবো , প্রতিদিন ব্যবহার করবো। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার ভালোবাসা সে রইলো দীঘি , সে ঘরে আনবার নয় , আমার মন তাতে সাঁতার দিবে”।একান্ত অনুভবে , করোনাকালে মমতাময়ী মা যেমন করোনা ভাইরাস মরণব্যাধি জেনেও মাতৃত্বের বন্ধনে সন্তানকে বুকে নিতে কার্পণ্য করেনি। আবার জীবন জীবিকার সন্ধানে তরুণ স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের বিদায় বেলায় আলিঙ্গন থেকে দূরে থাকতে পারিনি। শ্বাসকষ্ট লাঘব করার জন্য নির্ঘুম পিতার বুকে সন্তানের ভালোবাসার জায়গাটার অভাব হয়নি তদ্রূপ প্রবীন জুটিরাও প্রেমের শেষ আলিঙ্গন করতে ভুলেননি। ভালোবাসা আর প্রেম একাকার হয়ে বিশ্বজগৎ কে মহিমান্বিত করে তোলে চিরকাল। এই ভালোবাসা ও প্রেমের কারণে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা , গান , উপন্যাস , প্রবন্ধ , কাব্য , নাটক , চলচ্চিত্র শিল্পকর্ম তথা বিশাল সাহিত্য ও শিল্প জগত।প্রেম ছিল , আছে ও থাকবে পৃথিবীর সাথে একাত্ম হয়ে মিলেমিশে রচনা করবে হাজারো প্রেম কাহিনী।যেই দিন পৃথিবীতে ভালোবাসা ও প্রেম থাকবে না সেই দিন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে । কারণ ভালোবাসা ও প্রেম থেকেই তো পৃথিবীর সৃষ্টি সভ্যতা চলমান , তাই প্রেম অম্লান ও ঐশ্বর্যময়। সকলেই ভালোবাসা ও প্রেম নিয়ে বাঁচতে চায় জীবনের শেষ অবধি। তাই পরিশেষে বলি, ” We are most alive , When we are in LOVE “.

✍️

লিখেছেন- ঝর্না বড়ুয়া লং বীচ, ক্যালিফোর্নিয়া

error: Content is protected !!