ঘরের আবর্জনার চেয়ে মনের আবর্জনা বেশি ক্ষতিকর
লিখেছেনঃ রাজীব বড়ুয়া। সম্পাদক- ষড়রশ্মি।
বৌদ্ধদর্শনের মুলভিত্তি হল মনদর্শন। মনকে সকল কর্মের অগ্রগামী বলা হয়েছে। মন দোষযুক্ত হলে কর্মও দোষযুক্ত হয়। সুতরাং মনের চেতনা থেকেই কর্মের সৃষ্টি এটা স্বচ্ছ জলের ন্যায় পরিষ্কার। তথাগত বুদ্ধ মনকে প্রাধান্য দিয়ে মানসিক বিকাশ সাধন করতে উপদেশ দিয়েছেন। একটি ভাল মনের মানুষ কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না।
মনের আবর্জনা কি? এগুলো কোথায় থাকে? এসব প্রশ্নের সমাধান লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা সহজসাধ্য নয়। তবুও আমার চেষ্টা থাকবে বিষয়টিকে সহজসাধ্য করার।
মন বলতে আত্নাকে বুঝায় না। মন কোন বস্তু নয়, মনের কোন আকার নেই। মন হল অনুভূতির অপর একটি ইন্দ্রিয়। দর্শনের অনুভূতি পেতে চোখ ইন্দ্রিয় হিসেবে, শব্দের অনুভূতি পেতে কান ইন্দ্রিয় হিসেবে, গন্ধের অনুভূতি পেতে নাক ইন্দ্রিয় হিসেবে, স্বাদের অনুভূতি পেতে জিহবা ইন্দ্রিয় হিসেবে, স্পর্শের অনুভূতি পেতে ত্বক ইন্দ্রিয় হিসেবে কাজ করে। ঠিক তেমনি চিন্তার অনুভূতি পেতে মন ইন্দ্রিয় হিসেবে কাজ করে। ছয়প্রকার ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্য মন অধিনায়ক হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। স্বাদ, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি অনুভূতিগুলো মন ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা বিচার করে থাকি। অনুভূতিগুলোকে আবার সংরক্ষণ করি মনের মাধ্যমে। তাহলে এতোটুকুতে মন সম্পর্কিত কিছু ধারণা মেঘমুক্ত আকাশের ন্যায় পরিষ্কার হল। এবার মনের কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্লেষন করা যাক। মনের অনুভূতিগুলোকে নিয়ে সবাই কম বেশি অবগত আছেন। এই অনুভূতিগুলো হল- রাগ, দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ, সুখ, বিষাদ, দুঃখ, আনন্দ, অনুশোচনা ইত্যাদি। এই সকল অনুভূতিগুলোর মধ্যে কিছু কুশল এবং কিছু অকুশল। আমি মনের আবর্জনাকে উপস্থাপন করতে অকুশল প্রবৃত্তিগুলোকে তুলে আনছি। রাগ, দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ, দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতিগুলো মনকে কলুষিত করে। খারাপ কর্ম সাধনে ইচ্ছা তৈরী করে। তথাগত বুদ্ধ এইসব খারাপ প্রবৃত্তিগুলোকে মনের ময়লা বলেছেন। কারো উপর রাগান্বিত হলে ক্ষতিকর কিংবা প্রতিশোধপরায়ন হয়ে খারাপ কাজ করার স্পৃহা সৃষ্টি হবে, একটা পর্যায়ে খারাপ কাজ করেন। এভাবে অপরাপর অকুশল প্রবৃত্তিগুলোও কার্যকারীতা ভেদে কর্ম সাধন করায়। ঘরের ময়লা ঘরের ভেতর থাকলে যেমন বায়ূর সাহচর্য্যে ঘরের ভেতর দূর্গন্ধ ছড়ায়, অনুরূপভাবে মনের ময়লাগুলো বাহ্যিক আচার আচরণের প্রভাবে মনের মাঝে কুচেতনাকে বর্দ্ধিত করে।
মনের এই আবর্জনাগুলো কোথায় থাকে? শান্ত নিরিবিলি অবস্থায় রাগ, হিংসা ক্রোধ নামক আবর্জনাগুলো মনের মাঝে থাকে না। এগুলো তখনই মনকে প্রভাবিত করে যখন আমরা বাহ্যিক কিছুর উপর প্রভাবন্বিত হই। যেমনঃ কেউ আপনাকে গালি দিল, তীর্যক মন্তব্য করলো। এমন পরিস্থিতিতে আপনি তার এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে যাবেন। ঠিক ঐ সময়ে আপনার মন ইন্দ্রিয় রাগ এবং ক্রোধ নামক আবর্জনার দ্বারা আক্রান্ত হবে। আপনি রাগান্বিত হবেন, ক্রোধান্বিত হবেন। এই রাগ কোথা হতে আসে? কোথায় তার অবস্থান? এই নির্ণয় যতক্ষণ করতে না পারবেন আপনার মন ইন্দ্রিয় এসব আক্রমণের শিকার হবেই। মনের এসব আবর্জনা প্রতিদিন পরিষ্কার করা উচিত। যদি তা না করা হয়, তবে আবর্জনার স্তুপ জমে যাবে। একটা পর্যায়ে এসে বিশাল এই আবর্জনার স্তুপ পরিষ্কার করাটা আমাদের পক্ষে অসাধ্য হয়ে পড়ে।
প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় করে ধ্যান অনুশীলন করুন। এতে আপনার আমার মনের আবর্জনা অল্প অল্প করে পরিষ্কার হবে। জমে থাকা আবর্জনাগুলোও আস্তে আস্তে ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। নতুন করে আবর্জনা মনে প্রবেশ করবে না। মনকে শান্ত হতে পারলে শান্তি আপনা আপনি মনে অবস্থান করবে।
অশান্ত মনে আবর্জনা জমে। ঘরের থাকা আবর্জনার ব্যাগটা ঘরে রেখে দিলে দূর্গন্ধ বাড়তে থাকে, তাই আমরা সেটা বাইরে ফেলে দিই। তাহলে মনের ভেতর জন্ম নেয়া আবর্জনাগুলো আমরা কেন মনের ভেতর পুষিয়ে রাখবো! কেনই বা আমরা এই আবর্জনাগুলো দ্বারা মনকে কলুষিত করছি, খারাপ কর্ম করছি। সুতরাং আজ থেকে আমরা মনে আসা আবর্জনাগুলোকে আর জমিয়ে রাখবো না। ভূলে যাবো শত্রুতা, হিংসার বিপরীতে প্রতিহিংসা। মৈত্রীগুণ, ক্ষান্তিগুণ, উপেক্ষাগুণ দিয়ে আমরা এসবে উর্দ্ধে অবস্থান করতে পারবো। আর যত উপরে আপনার অবস্থান হবে ময়লা আপনার নাগালের বাইরে তো থাকবেই তদাপি জ্ঞানের পরিধি উন্নত হবে। ভূমিতে থাকা একজন ব্যক্তি তার চারপাশে বড়জোর এক মাইল পর্যন্ত অবলোকন করতে পারে। ব্যক্তিটি যখন সুউচ্চ পর্বতে আরোহন করবে তখন সে আরো বিস্তৃত জায়গা দেখবে। তার দেখার এবং জানার অভিজ্ঞতা বেড়ে যাবে। যখন সে বিমানে চড়বে তখন বিশাল উচ্চতা থেকে আরো অনেক বিষয় তার দৃষ্টিগোচর হবে। এভাবে করে মনকে এমন এক বিশাল উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে যেখানে মনের আবর্জনা আমাদের মনকে কলুষিত করতে পারবে না। তদুপরি আমাদের জ্ঞান প্রজ্ঞাতে রূপান্তরিত হবে।
সমাপ্তিতে, বুদ্ধের মহামহিমার ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শিরোনামকে অলংকৃত করতে চাই।
একদিন তথাগত বুদ্ধ গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কদাপি, উনার গোচরীভূত হল একজন অসুস্থ ব্যক্তি যিনি ময়লা পরিষ্কার করতেন। ব্যক্তিটি গ্রামের সকলের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করে একটি ভ্যানে করে টেনে আনছিল। আচমকা, তিনি শক্তিহীন হয়ে মাটিতে লুটে পড়লেন। এমনবস্থায় তথাগত বুদ্ধ উনাকে মাটি থেকে টেনে তুলতে গেলে তিনি বুদ্ধকে বারণ করলেন তাকে স্পর্শ না করতে। বুদ্ধ কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি লোকের ঘরে ঘরে ময়লা পরিষ্কার করি। আমি আবর্জনা যুক্ত; তাই আমাকে স্পর্শ করবেন না। তখন বুদ্ধ প্রজ্ঞাস্বরে উনাকে বললেন, তাতে কি হয়েছে! তোমার আর আমার মাঝে তো কোন অন্তর নাই। তুমি যেমনি লোকের ঘরে ঘরে গিয়ে ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার কর, ঠিক তেমনি আমিও লোকের মনে মনে গিয়ে মনের আবর্জনা পরিষ্কার করি। তুমি ঘর পরিষ্কার কর, আর আমি মন পরিষ্কার করি।
তথাগত বুদ্ধের ধর্মটা অনুষ্ঠান দিয়ে নয়, আচরণ দিয়ে ধারণ করতে হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমরা বিশাল বিশাল অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বুদ্ধের ধর্মকে খুঁজতে যাই, ধার্মিক হতে চাই। কেউই বুদ্ধের উপদেশ মতে, মনের আবর্জনা পরিষ্কার করতে উদ্যোগী হয় না। তাই সময় যা অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে তা আর ফিরে আসবে না। বাকি যেসব সময় আমাদের অতিবাহিত করতে হবে সেই সময়গুলোকে কাজে লাগাই ধ্যান অনুশীলন করার মাধ্যমে। অন্তুত দশটা মিনিট তো ধ্যানকার্যে দিতে তো কারো আপত্তি নেই। দিনের ২৪ ঘন্টাতে আমরা টিভি/মোবাইলে/বিনোদনে ৪/৬ ঘন্টা ব্যয় করি। দশটা মিনিট কি বেশি হয়ে যায় মনের ময়লা পরিষ্কার করতে!
লিখাগুলো আমার ব্যক্তিগত অভিমত, মননশীলতা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ প্রতিফলন। আমার সাথে কারো দ্বিমত থাকতেও পারে। চিন্তার স্বাধীনতা সবার আছে এটা আমি বিশ্বাস করি, তবে সেটা গ্রহণযোগ্যতা এবং যুক্তিযুক্ত হতে হবে। লেখনীর গর্ভে ক্রটিবিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে মার্জনাজ্ঞানে দেখবেন। লেখনীর পর্যালোচনা যদি কাউকে কিঞ্চিত পরিবর্তন করে, তবে আমার প্রয়াস আমাকে প্রীত করবে।
প্রজ্ঞার আলো প্রবেশ করুক সকল অন্তরে।
ভবতু সব্ব মঙ্গলং।
তথ্যসুত্র ঃ মহাকারুনিক