পবিত্র শুভ মধু পূর্ণিমার তাৎপর্য
এস.জ্ঞানমিত্র ভিক্ষু

মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে এক বিশেষ তাৎপর্যময় ঘটনা। এটি ভাদ্র মাসে উদ্যাপিত হয় বলে এটিকে ভাদ্র পূর্ণিমাও বলা হয়। এ পূর্ণিমার বিশেষ দিক হল বানর এবং হস্তীরাজ কর্তৃক বুদ্ধকে সেবা ও পূজা করার ঘটনা। কেননা, ত্রিপিটকে পশু কর্তৃক বুদ্ধকে পূজা ও সেবা দান করার দৃষ্টান্ত খুব বেশী নয়। বানর এবং হস্তীরাজের এরকম বিরল দৃষ্টান্ত আমরা যাঁরা সুদুর্লভ মানব জীবন লাভ করেছি আমাদের অনুকরণীয় তথা শিক্ষণীয় উদাহরণ বৈ কি!

ভগবান তথাগত বুদ্ধ গৌতমের সময়ে বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ এলাহাবাদ হতে প্রায় ১২ মাইল উত্তর পশ্চিমে কৌশাম্বী নামে এক সুসমৃদ্ধশালী নগরে তথাগত খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০ অব্দে তাঁর জীবনের নবম বর্ষাবাস অতিবাহিত করেন। তখন সেখানে একটি বিহারে দুইজন ভিক্ষুর মধ্যে শৌচাগারে জল রাখা সম্পর্কিত বিনয় বিধান নিয়ে কলহ সৃষ্টি হয়। মহামুনি বুদ্ধ ভিক্ষুদের কলহ নিবারণার্থে ‘লটুকিকা’ জাতক, ‘বত্তক’ জাতক দেশনা করলেন। তাতেও ভিক্ষুদের কলহ নিবারিত না হলে রাজা দীঘীতির কাহিনী অর্থাৎ রাজা দীঘীতির উপদেশে কিভাবে রাজপুত্র দীর্ঘায়ু কুমার ও রাজা-রাজার স্ত্রীকে হত্যাকারী অপর রাজার মধ্যে মিত্রতা স্থাপন হয়েছিল সে বিষয় দেশনা করলেন। দেশনার পর মহামুনি সম্বুদ্ধ কলহরত ভিক্ষুদের উপলক্ষ করে বললেন, “হে ভিক্ষুগণ, এরূপ অস্ত্রশস্ত্র ধারী রাজাদের যদি প্রচন্ড শত্র“তা হতে মিলন হতে পারে তবে এমনতরো সু-আখ্যাত ধর্ম বিনয়ে প্রব্রজ্যিত হয়েও তোমরা কেন বিবাদ বিসম্বাদে লিপ্ত। তোমরা কলহ করোনা।” বুদ্ধের কথায় কলহপ্রিয় এক ভিক্ষু যিনি উলি­খিত জাতকদ্বয় বর্ণনাকালেও বুদ্ধকে এ বিষয়ে মাথা না ঘামাতে বলেছিলেন তিনি এবারও তদ্রুপ বললে “মোঘপুরুষগণ অত্যন্ত কলহরত হয়ে গেছে, এদের চৈতন্যোদয় সহজ নয়”, এ ভেবে বুদ্ধ সেখান হতে চলে গেলেন। তদনন্তর তথাগত শাক্যসিংহ কৌশাম্বী থেকে বালক লোণকার গ্রাম এবং সেখান হতে প্রাচীন বংশদাব নামক স্থানে স্থবির অনুরুদ্ধ, স্থবির নন্দিয় এবং স্থবির কিম্বিলের সাথে সাক্ষাৎপূর্বক পারিল্যেয়ক নামক বনে প্রবেশ করলেন।

বর্ষাবাসের সময় ভগবান পারল্যেয় নামক সেই বনে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করলেন। যেটি ছিল বুদ্ধ জীবনের ১০ম বর্ষাবাস। সে সময় বুদ্ধ চিন্তা করলেন, “আমি পূর্বে সেই ভন্ডনকারী, কলহ লিপ্ত, বিবাদ-বিসম্বাদ প্রযুক্ত, বহুবৃথাবাক্য ব্যয়কারী ও নিত্য সংঘের নিকট অভিযোক্তা কৌশাম্বীবাসী ভিক্ষুগণ কর্তৃক উপদ্রুত হয়ে অনুকুলভাবে অবস্থান করতে পারি নি। এখন আমি তাদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে স্বচ্ছন্দে বিহার করতে সমর্থ হচ্ছি।” সে সময় একটি বয়োবৃদ্ধ হস্তীরাজও অপরাপর হস্তী, হস্তীনী, তরুণ হস্তী ও হস্তীশাবক কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে, অপুুষ্টিকর ও অখাদ্য খেয়ে অবস্থান করছিল। অপরাপর হস্তীরা তার গাঁ ঘেষে গমন করত। হস্তীরাজ কর্তৃক যোগাড়কৃত শাখা,পত্র-পল­ব খেয়ে ফেলত, পানীয় জল ঘোলা করে দিত। হস্তীরাজও এরকম হস্তীদের উপদ্রব হতে বাঁচার নিমিত্তে একাকী চলে আসল। অনন্তর হস্তীরাজও চিন্তা করল, “পূর্বে আমি হস্তীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নিপীড়িত নিগৃহীত হতাম, আর এখন তাদের ত্যাগ করে এসে মনানন্দে নির্বিঘ্নে অবস্থান করতে পারছি।”

ভগবান যে স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন সে স্থানটি কৌশাম্বী হতে সাত যোজন(এক যোজন = সাত মাইল দুরত্ব) দূরে এবং সেই বনটি ছিল তিন যোজন প্রমাণ। এই বনের রক্ষিতবনাঞ্চলে ভদ্রশাল বৃক্ষমূলে ভগবান অবস্থান করছিলেন। পারল্যেয় বনে অবস্থানের দরুণ বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে পারল্যেয় হস্তী নামে সমধিক পরিচিত সেই পূর্বোক্ত হস্তীরাজও বনমধ্যে বিচরণ সময় একাকী বুদ্ধকে দেখলেন। বুদ্ধকে দেখেই হস্তীরাজ স্বীয় নির্জনতার উপরোক্ত প্রীতিবাক্য বলেছিলেন। স্বয়ম্ভু শাক্যমুনি নিজের চিত্ত বিতর্ক এবং স্বচিত্তে হস্তীর চিত্ত বিতর্ক অবগত হয়ে উদানগাথা অর্থাৎ আনন্দ গাথা ভাষণ করলেন এভাবে-

“এতং নাগস্স নাগেন ঈসাদন্তস্স হত্থিনো
সমেতি চিত্তং চিত্তেন য়দেকো রমতী বনেতি।”
অনুবাদ:-
ঈষাদন্ত দীর্ঘদন্ত হস্তীনাগ সনে
( ঈষাদন্ত অর্থাৎ রথদন্ডের মত দীর্ঘ দন্ড বিশিষ্ট)
সম্বুদ্ধে মিলায় চিত্ত আপন জীবনে
যেহেতু উভয়ে রমে একা এই বনে।

হস্তী বুদ্ধের নিকট গিয়ে বুদ্ধকে বন্দনা করল। সেখানে অন্য কিছু দেখতে না পেয়ে ভদ্রশাল বৃক্ষের পাদদেশ পায়ের দ্বারা আঘাত করে সমান করে দিল। শুণ্ডের দ্বারা শাখা নিয়ে বৃক্ষতল পরিষ্কার করে দিল। এতদৃশ্য দর্শনে বুদ্ধ হস্তীকে বললেন, “হস্তীরাজ, তুমি একাকী অবস্থান করছ, আমিও একাকী অবস্থান করছি।” সে সময় হতে হস্তী ভগবানকে বিবিধ ভাবে সেবা পরিচর্য্যা করত। বুদ্ধ ভিক্ষান্ন সংগ্রহে যাবার সময় পাত্র নিয়ে আগু বাড়িয়ে দিত, আগমন কালেও আগু বাড়িয়ে নিয়ে আসত। বুদ্ধের মুখ ধোবার ও পান করার জল এনে দিত, বন হতে বিবিধ ফলমূল সংগ্রহ করে ভগবানকে দান দিত সশ্রদ্ধ চিত্তে।

এভাবে বুদ্ধ এবং হস্তীরাজ যখন অবস্থান করছিল সে সময় এক বানর হস্তী কর্তৃক বুদ্ধ পূজা দর্শন করল। বানর চিন্তা করল, “হস্তীও পশু আমিও পশু, হস্তী যদি বুদ্ধের সেবা করতে পারে, দান করতে পারে তবে আমি কেন পারব না? হস্তীর দান যেহেতু বুদ্ধ গ্রহণ করেন, অনুমোদন করেন, ভোজন করেন। আমার দানও নিশ্চয় মহাপুরুষ বুদ্ধ গ্রহণ করবেন, অনুমোদন করবেন, ভোজন করবেন।” তৎপর বানর বুদ্ধকে কি দান করবে তা ভেবে বনে বিচরণ পূর্বক কোন একদিন কোন এক বৃক্ষ দন্ডে মধু মক্ষিকা বিহীন এক মৌচাক দেখতে পেল। বানর অত্যন্ত আহ্লাদিত চিত্তে সেই দন্ডটি ভেংগে দন্ডসমেত মৌচাকটি তথাগতের নিকট নিয়ে আসল এবং একটি কদলীপত্র ছিঁড়ে মৌচাকটি দন্ডসমেত তথাগতকে প্রদান করলে তথাগত তা গ্রহণ করলেন। বুদ্ধ তা পরিভোগ করেন কিনা দেখার নিমিত্তে বানর সে স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকল। বানর দেখল বুদ্ধ তা পরিভোগ করছেন না, শুধু হাতে নিয়েই বসে আছেন। এর কারণ কি তা জানার জন্য বানর মৌচাক দন্ডের প্রান্তভাগ নিয়ে মৌচাকটি উল্টালে দেখা গেল সেখানে কিছু মাছির ডিম। বানর শশব্যস্ত হয়ে ডিম গুলি বিদূরণ করে আবার বুদ্ধকে দিলে বুদ্ধ তা হতে মধু পান করলেন। মধুপান করতে দেখে বানর খুশিতে, আনন্দে আতœহারা হয়ে বৃক্ষ শাখা হতে বৃক্ষশাখায় লাফাতে লাগল। হঠাৎ অসাবধানতাবশতঃ বৃক্ষের শাখা ভেঙ্গে বানর মাটিতে পড়ে গাছের গোড়ায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করল। বুদ্ধকে মধুদান এবং বুদ্ধের প্রতি প্রসন্নচিত্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর বানর তাবতিংস স্বর্গে ত্রিশ যোজন বি¯তৃত কনক বিমান ও সহস্র অপ্সরা লাভ করল।

এদিকে ভিক্ষুরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বর্ষাবাস শেষে তাঁরা বুদ্ধ সেবক ধর্মভান্ডাগারিক আনন্দকে নিয়ে বুদ্ধকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। বুদ্ধ চলে যাবার পর হস্তীরাজও করুণাসিন্ধু বুদ্ধের বিরহ ব্যাথা সইতে না পেরে হৃৎপিন্ড বিদীর্ণ হয়ে মারা গিয়েছিল। কিন্তু শাস্তার প্রতি চিত্ত প্রসন্নতার দরুণ পারল্যেয় হস্তীও তাবতিংস স্বর্গে ত্রিশ যোজন বি¯তৃত সহস্র দেবকন্যার মধ্যে উৎপন্ন হয়েছিল। তার নাম হয়েছিল পারলেয়্য দেবপুত্র। বুদ্ধ পরশে এসে বুদ্ধ পূজা করে তির্যক যোনিজাত হস্তীরাজ ও বানর লাভ করেছিল উন্নত গতি। অহো! বুদ্ধ পূজার কি অপূর্ব ফল। কি অত্যাশ্চর্য মহিমা। তদ্বেতু সকলের উচিত শ্রদ্ধা চিত্তে বুদ্ধ তথা ত্রিরতেœর পূজা করা, অনুশীলন করা তথাগতের বিমুক্তি প্রদায়ী মহান সদ্ধর্মের। যাতে প্রাণে আসে শান্তি, নির্বাপিত হয় সমুদয় দুঃখ সন্তাপ, বন্ধ হয়ে যায় বারংবার আসা যাওয়ার দুঃখময় খেলা।

বৌদ্ধরা হস্তীর সেবা ও বানরের এই মধুদানকে কেন্দ্র করে ভাদ্র পূর্ণিমায় মধু পূর্ণিমা উদ্যাপন করে। এ দিনে বৌদ্ধগণ সকালে বিহারে গিয়ে বুদ্ধ পূজা, প্রদীপ পূজা, অষ্টশীল গ্রহণ, সংঘদান, সংঘসেবা ইত্যাদি বিবিধ পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে। মধু পূর্ণিমার দিন বিকালে সকলে সমবেত হয়ে ছন্দবদ্ধ গাথায় বুদ্ধ প্রণতি জানায়, তৎপর সকলে শ্রদ্ধা ভরে বিভিন্ন ঔষধি বস্তু, যেমন পরীপাতা, বাসক পাতা, মধু, হরীতকী, বহেরা, আমলকী, বিবিধ উপাদেয় যুক্ত খাদ্য, আধুনিক কালের বিবিধ ঔষধ, বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী ইত্যাদি দিয়ে বুদ্ধপূজা দেন এবং মাননীয় ভিক্ষুগণকে দান করেন। অষ্টশীলাদি গ্রহণ ও যথাসাধ্য প্রতিপালন করেন, ভৈষজ্য সংঘদানসমেত বিভিন্ন দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করেন, যেগুলো অতীব কুশলময় কর্ম। মধু পূর্ণিমার পবিত্র প্রেক্ষাপটের মত সবার জীবন দান-শীল-ভাবনার অনূশীলনে পবিত্রতায় ভরে উঠুক, সবার মাঝে উৎপন্ন হোক সদ্ধর্মের বাতাবরণ, সকলেই হোক নির্বাণ রুপ পরম বিমুক্তির পথিক এই শুভেচ্ছায়,
মানবতা উথলে উঠুক সকল মানব অন্তরে
সব অকুশল দূর হয়ে যাক্ মৈত্রী-প্রেমের মন্তরে।

তথ্যঋণ:
মহাবর্গ- পণ্ডিত প্রজ্ঞানন্দ স্থবির
পালি-বাংলা অভিধান- মহাপণ্ডিত শান্তরক্ষিত মহাস্থবির
মহাপরিনিব্বান সুত্তং- রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির

error: Content is protected !!