আনাপান চর্চার সুফল
================
লেখক: ইলা মুৎসুদ্দী
.
অনেকদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে লিখতে চাচ্ছি। কারণ এই বিষয়টি বর্তমান সময়ের জন্য খুবই উপযোগী একটি বিষয়। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজে এই বিষয়টি এখন গুরুত্ব সহকারে নেয়া হচ্ছে। সেইজন্য লিখাটির অবতারণা করলাম। বিদর্শন ভাবনা করতে গেলে আমাদের প্রথমেই আনাপান চর্চা করতে হবে। অর্থাৎ মূল প্রবেশদার হচ্ছে আনাপান। পালিতে আন+অপান বা বাংলায় আশ্বাস + প্রশ্বাস। আনাপান চর্চার সুফল সম্পর্কে তথাগত মহাকারুণিক বুদ্ধ বলেছেন, যিনি আনাপান বা আশ্বাস-প্রশ্বাসকে অবলম্বন করে ভাবনা চর্চা করেন, তিনি একাসনে উপবিষ্ট থেকেই সর্বপ্রকারের আ¯্রব ক্ষয় করে অরহত্ত্ব মার্গফলে উপনীত হতে পারেন। তা যদি সম্ভব না হয়, মৃত্যু পূর্ব মুহুর্তে তা প্রাপ্ত হতে পারেন।
আনাপান সাধনায় অরহত্ত্ব মার্গফল কেন পায়, তৎ প্রসঙ্গে বুদ্ধ সংযুক্ত নিকায়ের দ্বিতীয় আনন্দ সূত্রে বলেছেন—যিনি আনাপান করেন, তাঁর চতুর্স্মৃতি প্রস্থান পরিপূর্ণ হয়। এভাবে যার চতুর্স্মৃতি প্রস্থান পরিপূর্ণ হয় তার সপ্তবোধ্যঙ্গ ধর্ম পরিপূর্ণ হয়। সপ্তবোধ্যঙ্গ ধর্ম পরিপূর্ণ হলে সাইত্রিশটি বোধিপক্ষিয় ধর্ম পরিপূর্ণ হয়। সাইত্রিশটি বোধিপক্ষিয় ধর্ম পরিপূর্ণ হলে চুরাশি হাজার ধর্মষ্কন্ধই পরিপূর্ণ ও দর্শিত হয়। চুরাশি হাজার ধর্মষ্কন্ধ বা পরিপূর্ণ নির্বাণ দর্শন লাভ হয় শুধুমাত্র আনাপান চর্চা করলে। শ্বাস টানছি-ছাড়ছি, টানছি-ছাড়ছি, এভাবে শুধুমাত্র এটুকুতেই স্মৃতি রাখলে আপনি বায়ু নামক রূপকায়ের বা শরীরের একটি মহাভূত বা মহাধাতুকে অনবরত পর্যবেক্ষণ করছেন—-এভাবে এক স্মৃতিতে অবিচ্ছেদ্যভাবে কায়কে পস্সনা বা দর্শন করার নাম কায়ানুপস্সনা। স্মৃতিতে থাকতে থাকতে আপনি হয়ত শরীরের বিভিন্নস্থানে ব্যথা, বেদনা, গরম, শীত, ঝিনঝিন ইত্যাদি অনুভব করবেন। তখন সবচেয়ে ষ্পষ্টতর অনুভূতিতে স্মৃতি নিবদ্ধ করতে হবে। এভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে উৎপন্ন ব্যথা বেদনাকে স্মৃতি দ্বারা অনবরত পর্যবেক্ষণ করার নাম বেদনানুপস্সনা।
.
স্মৃতিতে থাকাকালীন আপনার চিত্ত বিভিন্ন দিকে ছুটাছুটি করবে। মনে বিভিন্ন ধ্যান ধারণার জন্ম হবে–চিত্তের এসকল প্রতিক্রিয়াকে অনবরত পর্যবেক্ষণ করার নাম চিত্তানুপস্সনা। স্মৃতিমান থাকাকালীন দেখা যাবে যে, আমাদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও এমনকি অজ্ঞাতে হঠাৎ হঠাৎ করে কামচ্ছন্দ, ব্যাপাদ, থিনমিদ্ধ, উদ্ধচ্চ-কুক্কুচ্চ ও বিচিকিৎসার উদ্রেক হয়েছে। তাতে স্মৃতি রাখায় আপনা-আপনি আবার তা চলেও গেছে। এভাবে রূপ ও নামের বা শরীর ও মনের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার আগমন ও চলে যাওয়া বা উদয়-ব্যয় আমাদের কর্তৃত্বাধীনে বা ইচ্ছাধীনে পরিচালিত হয় না। সেগুলি নিজস্ব গতিতে যায়ও আসে। উদয় হয়, ব্যয় হয়। রূপ ও নামের এই স্বভাব ধর্মকে অবিচ্ছেদ্যভাবে স্মৃতি দ্বারা পর্যবেক্ষণ বা দর্শন করার নাম ধম্মানুপস্সনা। শরীর ও মনের ধর্ম এই শরীরের মধ্যেই বিদ্যমান। নির্বাণ ধর্মও এই শরীরের পঞ্চষ্কন্ধে লুকিয়ে আছে। আনাপান স্মৃতি ভাবনার চর্চা করলেই তার সন্ধান মিলিবে। ।
.
চতুর্স্মৃতি প্রস্থান বা পালিতে সতিপট্ঠান নির্বাণ গমণের একমাত্র পথ। বুদ্ধ স্বয়ং সেই পথে নির্বাণ রাজ্যে গমন করেছেন। পচ্চেক বুদ্ধগণ, অগ্র মহাশ্রাবকগণ, শ্রাবকগণ সহ সকল আর্যপুরুষগণ এই পথে বুদ্ধের অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আনাপান স্মৃতি ভাবনার ফল কোনদিন বৃথা যায় না। আনাপান চর্চা করে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তেও যদি মার্গফল লাভ করতে না পারেন তাহলে মৃত্যুর পর পরই স্বর্গে দেবপুত্র বা দেবকন্যা রূপে উৎপন্ন হয়ে ধর্ম কথিক দেব পুত্রগণের দেশনা শ্রবণে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অরহত্ত্ব মার্গফলে উপনীত হতে পারেন। তাও যদি না হয় অর্থাৎ পূর্বের জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত পুণ্য পারমী যদি কম হয় তাহলে শূণ্যকল্পে অর্থাৎ বুদ্ধ শাসন বহির্ভূত সময়ে পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়ে পচ্চেক বুদ্ধ হয়ে নির্বাণ রাজ্যে গমন করতে পারবেন। তাও যদি না হয় অনাগত কোন এক বুদ্ধের সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হয়ে তাঁর দু’ একটি বচন শ্রবণে অত্যন্ত ক্ষিপ্রজ্ঞান প্রাপ্ত শ্রাবক হয়ে অরহত্ত্ব মার্গফলে উপনীত হয়ে নির্বাণের স্বাদ আস্বাদনে সক্ষম হবেন।
.
বুদ্ধের দেশনা শ্রবণ করতে করতেই বহু দেব-ব্রক্ষ্মা-মনুষ্য অরহত্ত্ব মার্গফলসহ বিভিন্ন স্তরের মার্গফলে উপনীত হয়েছেন। বর্তমান সময়ে আমরা কত দেশনা শুনছি, দীর্ঘদিন ধরে সাধনা করছি, তবু মার্গফল তো দূরের কথা, প্রজ্ঞাও উৎপন্ন হচ্ছে না, কেন? কারণ আমাদের আনাপান স্মৃতি ভাবনা করার পূর্ব জন্মের পারমী বীজ নেই। এজন্য আমাদের পারমী বীজ, পুণ্যের বীজ বপন করতে হবে। প্রথমে দান দিয়ে। তারপর শীলের মাধ্যমে। শীলবান হয়ে হতে হবে বীর্যবান। বীর্য ধারণ করে ভাবনা করলে আসবে সমাধি। চিত্ত সমাধিস্থ হলে উৎপন্ন হবে লোকোত্তর জ্ঞান বা প্রজ্ঞা।
.
সকলের মধ্যে প্রজ্ঞা উৎপন্ন হোক। সকলের জয়মঙ্গল হোক। ধর্মদানজনিত পুণ্যের প্রভাবে আমার অধিষ্ঠান পারমী যাতে পরিপূর্ণ হয় সেই প্রার্থনা করছি। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্ত হোক।

তথ্যসুত্র ঃ মহাকারুণিক

error: Content is protected !!