অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও পিণ্ডচারণ শেষ করে বিহারে ফিরছেন রথীন্দ্র শ্রামণ (বনভান্তে)। এদিক-ওদিক না তাকিয়ে মোটামুটি সংযত দৃষ্টি ও ধীরগতিতে চলছেন। অল্পক্ষণ পর কিছু হইচই ধ্বনি তাঁর কানে আসতে লাগল। সহসা একেবারে কাছে এসে পড়ল। উল্টোদিক থেকে তিন-চার জনের একদল কিশোরী ছাত্রী, হয়ত কলেজে যাচ্ছে। অবিরাম কথা বলছে, খিলখিল করে হাসছে। কী এতো কথা! দুনিয়ার সব কথা যেন তাদের মুখে ফুটছে। আর হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এরূপ মিহি শব্দ শুনে হঠাৎ রথীন্দ্র শ্রামণের মনে ভালোলাগার একটা গোপন অনুরণন ছাড়িয়ে গেল। ভগবান বুদ্ধ বলেছেন- হে ভিক্ষুগণ! আমি অন্য এক শব্দও দেখতেছি না, যা পুরুষের চিত্ত অধিকার করে থাকে, যেমন স্ত্রী শব্দ; স্ত্রী শব্দই পুরুষের চিত্ত অধিকার করে থাকে। (অঙ্গুত্তর নিকায় প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১)। রথীন্দ্র শ্রামণেন বেলায়ও তাই ঘটল। আকর্ষণের বৃত্তে ঢুকে পড়ল তাঁর মন, যদিও সচেতনভাবে টের পেলেন না। তাঁর প্রবল ইচ্ছা জাগল কিশোরীদের একটু খানি দেখার। অপ্রতিরোধ্য এক ইচ্ছার কাছে পরাভূত হয়ে পড়লেন। মাথা উচু করে তাকিয়ে দেখলেন, খুশিতে ঝলমল করে উঠা কয়েকজন ছাত্রী। মায়াময় লাবণ্যে ভরা মুখ। মুখগুলো থেকে উৎসারিত হচ্ছে মায়ার ঢেউ, মায়ার আলো। ওই আলো ফুলের মতো মেলে ধরেছে তাদের দৈহিক গড়নে। দ্রুত এগিয়ে গেল তারা। হাত এবং পায়ের গতির সঙ্গে সমান তালে চলছে ঠোঁটের গতি। একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন রথীন্দ্র। তবে ততক্ষণে সেই সুন্দর মুখগুলোর আকর্ষণে মন অন্যরকম হয়ে উঠল তাঁর। বুকের ভিতর আলোড়নের ঝড় উঠল। সে ঝড় ছুঁয়ে গেল দেহের অনু-পরমাণুতে। মুহূর্তেই কাম বিতর্কে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো লাবণ্য ভরা মুখগুলো। বেশ কিছুক্ষণ কাম বিতর্কের রাজ্যে অবস্থানের পর হুঁস ফিরে আসল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে আত্ম সচেতন হয়ে উঠলেন। এ- কী! আমি এ রকম চিন্তা করছি কেন? ছি ছি! এ-যে বিনয় বিরুদ্ধ, পাপ, মহাপাপ। এই চিন্তা সামাল দিতে হবে, পরিত্যাগ করতে হবে। ফুঁসে উঠা মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। অজ্ঞানের পথে চালিত মনকে জ্ঞানের পথে ফিরিয়ে আনা উচিত এক্ষুণি। এ অবস্থায় আমাকে জয়ী হতে হবে। এই ভেবে রথীন্দ্র শ্রামণ মনে শক্তি সঞ্চার করলেন। সংযম অভ্যাসের গুণে সামলিয়ে নিলেন নিজেকে। আর হন হন করে বিহারের দিকে এগুতে থাকলেন। বিহারে এসে বুদ্ধ বিম্বের সম্মুখে করজোড়ে সে অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। অনুতপ্ত হৃদয়ে ধিক্কার দিলেন নিজেকে বারম্বার। ভবিষ্যতে সেরূপ অশ্রামণোচিত কাজ করবেন না বলে সংকল্পবদ্ধ হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, যাতে করে আর এরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়। তজ্জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করবেন কামভাব জাত আসক্তিকে চিত্তে স্থান না দিতে তৎপর থাকবেন সর্বদা। চোখ বন্ধ করে শান্ত মনে উপলব্ধি করতে থাকলেন, এ দেহ সর্বত্রই অশুচি, ঘৃণিত পদার্থে ভরা। অপবিত্র, দুর্গন্ধময় বিষ্ঠা-মূত্র রয়েছে এ দেহের ভেতরে। কৃমি ও অশুচি, দুর্গন্ধবাহী চর্মের থলি যেন এ দেহ। অজ্ঞানীরা এরূপ ঘৃণিত দেহে আসক্ত হয়। কামতৃষ্ণা উৎপন্ন করে। কামাসক্তি অসি ও শূল্যের ন্যায় মহা দুঃখদায়ক, জ্বলন্ত অগ্নির ন্যায় দগ্ধকারী, মহা অনর্থকর। মুক্তি মার্গের মহা অন্তরায়। বুদ্ধ বলেছেন- ক্ষুধার্ত চণ্ডাল যেমন সম্মুখে কুকুর দেখলে হত্যা করে। তেমনি কামাসক্তিও অজ্ঞজনকে বিনষ্ট করে।