নিভৃতচারী ধুতাঙ্গ সাধক ভাবনানন্দ মহাস্থবিরের কথা
লিখেছেন- উজ্জ্বল বড়ুয়া বাসু
কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়েই ভান্তের ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক কী কারণে ভান্তের কাছে প্রথমবার গিয়েছিলাম মনে পড়ে না…. তবে যে কারণেই যাই না কেনো ভান্তের সৌম্য দেহ, সুন্দর বাচনভঙ্গী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কিছু এত বেশি আকর্ষণ করতো যে যখনই একটু ফ্রি সময় পেতাম, কিংবা মনটা বিষন্নতায় ভরে যেত তখনি ভান্তের কাছে ছুটে যেতাম। অন্যরকম এক প্রশান্তিতে ভরে যেত জোয়ারা খানখানাবাদের ভাবনানন্দ বিদর্শন আরামে গেলে। যেতে কিন্তু খুব কষ্টই পেতে হতো। কাঞ্চননগর বাদামতলের আগের স্টেশনে নেমে ফতেনগর মহাবোধি পর্যন্ত কোনো রকমে রিক্সায় যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তারপর হাঁটা শুরু। দুরত্ব যত না বেশি তার চেয়ে বেশি বিপদজনক ছিল রাস্তার কাঁদাগুলো। তারপরও কিসের টানে এই কাঁদা অতিক্রম করে ভান্তের জন্য অল্প ছোয়াইং নিয়ে চলে যেতাম বুঝতাম না। তবে হ্যাঁ তৎকালীন সময়ের প্রচলিত একটি কথাও বেশ নাড়া দিত। জোয়ারারই আশে পাশের কিছু লোকজন একসময পূজ্য বনভান্তের কাছে গিয়েছিলেন। আর সেসময় পূজ্য বনভান্তে নাকি বলেছিলেন আমার কাছে এত কষ্ট করে আসার দরকার কি তোমাদের পাশের গুণীভান্তে ভাবনানন্দ এর সেবা করো। সেই থেকে পূজ্য ভাবনানন্দ ভান্তের কিছুটা প্রচার বেড়ে যায়। ভান্তের ওখানে একটি বিষয় আমাকে বেশ নাড়া দিত। সেটা হচ্ছে ভান্তের ছোয়াইং খাওয়া। ভান্তের শিষ্য পরমানন্দ ভান্তে এবং তিলোকানন্দ ভান্তের কথা মনে আছে উনারা ভান্তের জন্য পাত্র তে করে ছোয়াইং নিয়ে আসতেন। পাত্রের ভিতরে কি আছে তা দূর থেকে দেখা যায়। সেখানে কিছু খাবারের মিশ্রণ। সেগুলো কি ভাত, নাকি তরকারী তা বুঝা যেত না। বলা যায় এই মিশ্রণটা দেখলেই কেমন জানি লাগতো। মনে মনে ভাবতাম যে খাদ্যগুলো দেখতেই ঘৃণা লাগে সেগুলো ভান্তে খায় কিভাবে? ছাবাইকে সবধরণের খাবারগুলো কে একত্রে এমনভাবে মিশ্রিত করতেন যে, কোন সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন ব্যক্তির ওই খাবারের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ জন্মাবে না, খেতে দিলেও মনে হয় ওগুলো কেউ খাবেনা। ভাত এবং তরকারী একত্রে মিশানোর ফলে মিশ্রণটার রংটা কেমন জানি বিদগুটে হয়ে যেত। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করতাম ভান্তে কেনো এভাবে খায়? আবার নিজে নিজেকে উত্তর দিতাম মনে হয় কোন তরকারীর কি মজা তা না বুঝার জন্য এমনটা করেন। তখন বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি না বুঝলেও এখন পিটকীয় নানা বই পড়ে মিলিয়ে দেখলে বুঝতে পারি ভান্তে মূলত পাত্রপিণ্ডিক ধুতাঙ্গ পালন করতেন। আর তাই তো সবকিছু একবারে নিয়ে মিশ্রণ তৈরী করেই তিনি পিণ্ড গ্রহণ করতেন। বিভূষণের জন্য নয়, ক্রীড়ার জন্য নয়, শক্তিপ্রদর্শনের জন্য নয়…….. ক্ষুধারোগ নিবারণের জন্য, ব্রহ্মচর্য অনুগ্রহের জন্য যেভাবে পিটকে পিন্ডগ্রহণের কথা আছে ঠিক যেন তিনি তেমনটাই পালন করতে চাইতেন। পূজ্য ভাবনানন্দ মহাস্থবিরের গৃহী নাম ছিল ঈশ্বর চন্দ্র বড়ুয়া। পিতা ঊমা কিশোর তালুকদার এবং মাতা ধীরমনি তালুকদার এর কোল আলোকিত করে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেন ১৯০৬ইং সনের ২৫জুন । মা-বাবার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ঈশ্বর চন্দ্র বড়ুয়া যৌবনে চাকুরীর সন্ধানে প্রথমে কলকাতায় যান পরবর্তীতে সেখান থেকে বার্মায়(বর্তমান মায়ানমার) যান। বার্মায় চাকুরীর ফাঁকে ফাঁকে ভিক্ষুসংঘের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। আর এই সেবার ব্রতই তাকে ষষ্ঠ সঙ্গায়নে অংশগ্রহণকারীদের ভিক্ষুদের সেবার সুযোগ করে দেয়। সেই সঙ্গায়নেই তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন ১৯৫৬ইং তে প্রখ্যাত বিদর্শন সাধক ঊনু উত্তরা ছেয়াদ এর নিকট। পরবর্তীতে ১৯৬০ইং তে রেঙ্গুনের খ্যাতিমান সাধক কামাইউট মেধাবী ছেয়াদ এর অধীনে তিনি বিদর্শন ধ্যান অনুশীলন করেন। ১৯৬৩ইং তে তিনি বার্মা থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ১৯৬৬ইং তে তিনি বিদর্শন সাধক ভদন্ত ধর্মবিহারী মহাথের (প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া) এর অধীনে উপসম্পদা লাভ করেন। উপসম্পদা লাভের পর তিনি জোয়ারা খানখানাবাদ পঞ্চরত্ন বিহার ও মধ্যম জোয়ারা সুখরঞ্জন বিহারে বর্ষাবাস যাপন করেন। এসময় তিনি মুকুটনাইট বৌদ্ধ সেবাসদনে তিন কক্ষবিশিষ্ট পাকা বিহার নির্মাণ, ফতেনগর বেনুবন বিহারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন, নিজ গ্রামে শ্মশানে ধ্বংস প্রাপ্ত স্মৃতি মন্দির গুলোর পুনঃনির্মাণ করেন। “গৃহীদের মুক্তির সন্ধান’ নামে একটি বইও লিখেন তিনি। পরবর্তীতে নিজের পৈত্রিক ভিটায় “ভাবনানন্দ আরাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। পুজ্যভান্তের নিভৃতে বিনয়োচিত জীবন চলা যখন প্রচার পেয়ে যায় তখন দূরদুরান্ত থেকে অনেক মানুষ যেতেন তাকে দর্শনের উদ্দেশ্যে। ভান্তে ছাবাইক হাতে নিয়েই শিষ্যদের প্রথমে জিজ্ঞেস করতেন যে, উপাসক-উপাসিকাদের জন্য খাবার আছে কিনা। শিষ্য হ্যাঁ বোধক উত্তর দেওয়ার পরই তিনি ছোয়াইং খাওয়া শুরু করতেন। ভান্তের সান্নিধ্যে যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যতজন ব্যক্তিই সেখানে আসুক না কেন কেউই না খেয়ে ফিরতেন না। মনে হত যেন সেখানকার খাদ্যগুলো বেড়েই যেত। আর অল্পতেই খুব তৃপ্তি ভরে খাওয়া যেত সেখানে। ভান্তে গতানুগতিক দেশনা খুব কমই দিতেন, বেশীরভাগ সময় ধর্মালোচনার মত করেই দেশনা দিতেন। যাই হোক, আমার মতো অধমের পরম সৌভাগ্য হয়েছিল যে, এই নিরব সাধকের সান্নিধ্যে প্রায় পনের বারের মত যাওয়া, সেবা করা এমনকি ভান্তের শিষ্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুবাদে আমি এবং আমার কয়েক বন্ধুর ভান্তের মরদেহ কে যেই মঞ্চে রাখা হয়েছিল সেই মঞ্চ পুষ্প দিয়ে সাজানোর দায়িত্ব পাওয়া,ভান্তেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় বিউগলে যে করুণ সুর বাজানো হয়েছিল তার নির্দেশনারও দায়িত্ব পাওয়ার। আলোকিত এই সংঘমনীষা ২০০৬ইং সনের ১১এপ্রিল, মঙ্গলবার ৭.৪৫মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন।