থেরবাদ ও মহাযানে বুদ্ধ
লিখেছেনঃ সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু
বি, এ (অনার্স) এম, এ. এম, এড
বুদ্ধের পরিনির্বাণে একশত বছর পর বৌদ্ধ ধর্মে স্থাবিরবাদ ও মহাসাংঘিক এই দুই প্রধান নিকায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই মহাসাংঘিক বাদীরা পরবর্তীকালে কতগুলো সুত্র গ্রস্থ রচনা করেন। তাদের নিজস্ব কোন ত্রিপিঠক গ্রন্থ ছিলনা। এই মহাসাংঘিক নিকায় হতে মহাযান মতের উৎপত্তি হয়। স্থবিরবাদীরা বুদ্ধের প্রচরিত ধর্ম ও বিনয় নিয়ে পরিচালিত হন। পরবর্তীতে তাঁরা থেরবাদ বা হীনযান রুপে পরিচিত হন। নিম্নে হীনযান ও মহাযানে বুদ্ধের যেরুপ চিত্রায়ণ হয়েছে তা আলোচনা করা গেল –
বৌদ্ধ ধর্মে সাধকদের রুচি ভেদে যান বা সাধনা মার্গ ত্রিবিধ যান প্রচলিত আছে। যথা- শ্রাবক যান, প্রত্যেক বুদ্ধযান ও বোধিসত্ত্ব যান। শ্রাবক যানের সাধক স্বীয় দুঃখ মুক্তির জন্য গুরুর নিকট ধ্যান সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহন করে অহর্ত্ব লাভে সচেষ্ঠ হন। যে সাধক গুরুর উপদেশ ছাড়া নিজস্ব জ্ঞান বলে সাধনা করে বোধি লাভের সমর্থ হন। তিনি প্রত্যেক বুদ্ধ নামে অভিহিত হন। তার নাম প্রত্যেক বুদ্ধ যান। কিন্তু তাঁরা জীবগণকে বোধিমার্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রবৃত্ত হন না। বোধিসত্ত্ব যানে সাধক শুধু নিজের মুক্তির নয়, সর্বজীবের দুঃখ মুক্তির জন্য বুদ্বত্ব লাভের ইচ্ছুক। অতএব শ্রাবকবান ও প্রত্যেক বুদ্ধ যান দুটো হীনযান নামে এবং বোধিসত্ত্ব যানকে মহাযান নামে আখ্যায়িত করা হয়।
অহর্ত্ব ও প্রত্যেক বুদ্ধত্বের উর্ধে পূর্ণ বুদ্ধত্ব। একমাত্রই পূর্ণ বুদ্ধই সম্যক সম্বুদ্ধের অধিকারী। তাঁর মধ্যে অর্হৎ ও প্রত্যেক বুদ্ধের সবগুনই বর্তমান। অধিকন্ত আর্ত মানবের কাছে তিনি ধর্মের বার্তাবাহক। বহু যুগ পরপর তমসাচ্ছন্ন অধিক্লিষ্ঠ মানবের হিতার্থে তাঁর অর্বিভাব ঘটে। শাক্যবংশীয় সিদ্ধার্থের জন্ম ও এমনি এক বুদ্ধ যুগের প্রারম্ভে। বৌদ্ধ ধর্মের এই সনাতনী রুপের সমর্থক হীনযানী সম্প্রদায় বুদ্ধের মানবত্ব এখানে স্বীকৃত। তবে সাধারণ মানষের থেকে মহান বুদ্ধের পাথর্ক্য যে শিষ্য-প্রশিষ্য পরিবৃত হয়ে তিনি বহু জনের হীতার্থে ধর্ম শিক্ষা দানে একাগ্র চিত্ত।
পরবর্তীকালে, মহাযনী বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্মের সনাতন রুপের অনেক পরিমার্জন ও পরির্বধন ঘটালেন, তৈরী হলো মহাযান সুত্র, বুদ্ধ উন্নীত হলেন, দেবতার আসনে এবং এই দেবতার ভক্তি পূর্ণ অর্চনার মধ্যেই আছে মুক্তি মার্গ। এই সঙ্গে পূর্ন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হলো বোধিসত্ত্ব সম্পর্কীয় ধারনা। যে ধারণার বিশেষ গুরুত্ব হীনযানী মতবাদে নেই।
হীনযানরা মনে করেন যে, সংসার দুঃখময়, তৃষ্ণা একমাত্র দুঃখের মূল। এই তৃষ্ণাকে ধ্বংস করতে হলে ধ্যান বা সাধনা দ্বারা করতে হয়। তবে সমস্ত দুঃখ ধ্বংস করে নির্বাণলাভ করা সম্ভব। এরা মনে করেন, ধ্যান হচ্ছে প্রধান স্বয়ং বুদ্ধ এই ধ্যানে নিবিষ্ঠ হয়ে নির্বাণ বা দুঃখ মুক্তি লাভ করেছেন। ধ্যান বা সাধনা করলে তির্যক, প্রেত, অসুর যোনিতে জম্ম গ্রহন করার সম্ভাবনা থাকে না।
হীনযানীরা আরও মনে করেন, ইহ লোকে মানুষের এক রকম নির্বাণ লাভ করার অধিকার আছে। গৌতম বুদ্ধ নিজে সেই নির্বাণ লাভ করে ছিলেন। কেবল ধ্যান বা সাধনা দ্বারা। তাঁরা তাদের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বিশ্বাস করতেন নির্বাণ লাভের উপর। সে নির্বাণ বুদ্ধ নিদের্শিত পথে আসবে, কিন্তু সে পথটি হচ্ছে, শীল পালনের মাধ্যমে নিষ্ঠাপূর্ণ সাধনার পথ। এরা শুধু দুঃখ মক্তির জন্য সচেষ্ঠ তাই তাঁদেরকে শুষ্ক অর্হৎ বলা হত।
মহাযানীরা মনে করেন, হীনযানীদের নির্বাণ সাধনা এ উদ্দেশ্যটা সঠিক নয়। নির্বাণ লাভ করার চেয়ে বদ্ধত্ব লাভ করাটা বড়। বুদ্ধত্ব লাভ বলতে তাঁরা মনে করতেন বোধি চিত্তের অধিকার লাভ। তাঁদের কাছে বুদ্ধত্ব লাভ মানে শ্রেষ্ঠ লাভ। তাঁরা মনে করতেন হীনযানীদের নিষ্ঠাপূর্ণ সাধনা সঠিক নয়। বুদ্ধত্ব লাভের জন্য বোধি সত্ত্বকে সংকল্প গ্রহন করতে হয় যে, আমি বুদ্ধ হয়ে অন্যকেও বোধি লাভের সাহায্যে করব। নিজে মুক্ত হয়ে অন্যকেও মুক্ত করব, নিজে সংসার সাগর উত্তীর্ণ হয়ে অন্যকেও উত্তীর্ণ করব।
তাঁরা মনে করতেন হীনযানীদের নিষ্ঠাপূর্ণ আচার-পরায়ণতা সঠিক ধর্ম সাধনা নয়। ধর্ম সাধনাকে এই পর্যায়ে রাখলে শেষে সেটা একটা শুষ্ক আচার-পরায়নতায় পর্যবসিত হবে। তাকে করতে হবে ব্যক্তি জগত উপলদ্বি সাধনার সিদ্ধির বস্তু। তাই সেখানে গন্ডীবদ্ধ নৈতিকতায় আবদ্ধ থাকলে চলবে না। প্রতিষ্ঠা করতে হবে মনোময় ব্যক্তি সাপেক্ষতা এবং বর্জন করতে হবে আচার নৈতিকতাকে, তাই মহাযানী ধর্ম সাধনায় সাধকের আছে নিয়ম নিষ্ঠা বস্তুতান্ত্রিক কঠোর অচার-পরায়নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার অবকাশ। এই মুক্তি অবকাশ আছে বলেই মহাযানী সাধন পদ্ধিতে সমসাময়িক অবৌদ্ধ ধমের্র নানা ধারার অনুপ্রবেশ করার সুযোগ বেশি হয়েছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশে খ্রীষ্ঠীয় অষ্ঠম-নবম শতকে মহাযান বেশি পন্থী বৌদ্ধধর্মের নানা রকম তান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া এসে পড়ে। চর্যাপদের সমসাময়িক কালে বা তার সামান্য কিছু আগে গুহ্য সাধনতত্ত্ব, পুজা আচার ও নীতি পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়।
পরিশেষে বলাযায় এই মহাযানী ভাবধারা চীন, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর হীন যানী ভাব ধারা বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোভিয়া ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বৌদ্ধ ধর্মের পরবর্তী দ্বারা দুটি ধারায় বর্তমানে পরিচিতি লাভ করেছে। মহাযানী মতাদর্শে বুদ্ধ হয়ে উঠেন দেবতা রূপে।