দরিদ্র এক পুণ্যবান ব্যক্তি। গুড়, দধি বিক্রয় করে যিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন বাজারে যাওয়ার সময় মধুপূর্ণ মৌচাক দেখতে পেয়ে তা সংগ্রহ করে সুকৌশলে মধু সংগ্রহ করে বিক্রয় প্রত্যাশায় বাজারের দিকে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে কিছু লোক উনার মধুসমেত পাত্রটি চড়া দামে ক্রয়ের জন্য সম্মত হলেন। সেই পুণ্যবান ব্যক্তি ভাবলেন কি ব্যাপার- উনারা এত দামে মধু কিনে কি করবেন? জিজ্ঞেস করলে ক্রেতারা- “বিপস্সী বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্খুসংঘকে দান করবেন বলে ব্যক্ত করলেন”।
নিজের সব খাবার নিজ হাতেই “বিপস্সী’’ বুদ্ধকে দান করে দিলেন। চিন্তা করেনি নিজে কি খাবেন! সেই দানের মহাফল আর পদুমুত্তর বুদ্ধ হতে বর প্রাপ্ত হয়ে তিনি হলেন গৌতম বুদ্ধের সময়ে “লাভীশ্রেষ্ঠ সীবলী স্থবির”।
শুন শুন সর্বজন অপূর্ব কাহিনী, যাহা প্রচারিল মুখে প্রভু মহামুনি।
সীবলী চরিতকথা অমৃত সমান, যাহার শ্রবণে নর লাভে দিব্যজ্ঞান।
সীবলীর গুণগাথা যে করে পঠন, হবে গ্রহদোষ শান্তি অন্যথা না হন।
ধুপ-দীপ-আদিবহু উপাচারে, ভক্তি চিতে যেই জন পূজে সীবলীরে।
অরহত শ্রী সীবলী মহাতেজবান, মহাজ্ঞানী, মহালাভী মহাপূণ্যবান।
তাঁহার প্রভাবে দুঃখ রবে না কখন, সীবলীর ব্রত সদা যে করে পালন।
ব্যবসা-বাণিজ্যে বৃদ্ধি নিশ্চয় হইবে, সীবলীর গুণগাথা যে জন স্মরিবে।
খাদ্য বস্ত্র অভাবেতে আছ যত নর, সীবলী চরিত কথা অহরহ স্মর।
দরিদ্র লভিবে বিত্ত, ধনী, মহাধন সীবলীর ব্রত যেবা করে পালন
ধনের কামনা করি ভবে নরগণ, কাল্পনিক দেবদেবী করিয়া সৃজন।
করে নিত্য পূজা তারা ধনলাভ তরে; কিন্তু সীবলীর পূজা বহুগন ধরে।
লঙ্কা, ব্রম্মা, শ্যাম, চীন, তিব্বত, জাপান, সীবলী পূজাতে তাঁরা অতি নিষ্ঠাবান।
সীবলীর পরিচয় এবং নামকরণ:
ভারতের সমৃদ্ধ নগরী ‘বৈশালী’র লিচ্ছবি রাজ্যের রাজপুত্র মহালী কুমার। অন্যদিকে কোলীয় রাজকন্যা পরমা সুন্দরী সুপ্রবাসা। অতীতের কর্মসূত্রে এ দুই রাজপুত্র-কন্যা মণি-কাঞ্চনের মত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। যেদিন সুপ্রবাসা গর্ভবতী হল সেদিন হতেই তার গর্ভজাত সন্তান মহাপূণ্যবান তা উপলব্ধি করল। কেননা সেদিন হতে তিনি নানা উপঢৌকন, রাশি রাশি অর্থ, বস্ত্রালংকার এবং নানা প্রকার ঈস্পিত-মনোজ্ঞ বস্তুসামগ্রী তিনি লাভ করতে লাগলেন। রাজা-রাণীর রাজপরিবার ধন-দৌলতলতে পরিপূর্ণ হতে লাগল। এমনকি সুপ্রবাসাকে স্পর্শ করে কৃষক বীজ বপন করতঃ একবীজ হতে নাল জন্মে শত শত। সুপ্রবাসার হস্তস্পর্শে চাষীরা গোলাতে শস্য উঠালে, শস্য খরচ করার পরও গোলা পূর্ণ থাকত। অভূতপূর্ব-অকল্প
নীয় এ দৃশ্যে সবাই জ্ঞাত হল যে, সুপ্রবাসার গর্ভপুত্র যেন স্পর্শমনি!
রাজ্যের চতুর্দিকে আনন্দের সাড়া আর রাজা-রাণী পুত্র প্রেমে হলো মাতোয়ারা। সবাই অধির আগ্রহে রাজার নন্দনের জন্মক্ষণ গণনায় ব্যাকুল। ক্রমে ক্রমে দশমাস দশদিন গত হবার পরও রাজপুত্রের জন্ম হল না! সবাই বিষ্ময়ে হতবাক! এরূপে সাত বছর গত হবার পর রাণী সুপ্রবাসা প্রসব বেদনা অনুভূত করতে লাগলেন। অতঃপর সুপ্রবাসা মহাকারুণিক বুদ্ধের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসানে রাজপুরীতে আনন্দের বন্যা বয়ে সাত বছর সাতদিনে রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন। পুত্রমুখ দর্শনে রাণীর সমস্ত যন্ত্রণা দূর হল। অন্তর অপার পুত্রপ্রেমে প্রফুল্ল হল। রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ল আনন্দোল্লাস।
চারদিক সুশোভিত হল রাজপুরী। নৃত্য-গীত ধ্বনিতে রাজ্য যেন স্বর্গপুরী। আয়োজন করা হল দাল শালা। অকাতরে দানধর্ম চলছিল। ইষ্ট-মিত্র, জ্ঞাতিগণ সকলে সমবেত হলেন। সকলেই রাজকুমারকে এক নয়ন দেখার জন্য সানন্দে অধির অপেক্ষা করতে লাগলেন। অবশেষে রাজকুমারের দর্শন মিলল। রাজকুমারের এমন সুবর্ণ ন্যায় মুখ দেখে সকলের মনপ্রাণ যেন সুশীতল। এ হেতু নাম রাখা হয়- সীবলী কুমার।
প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষা এবং অর্হত্বলাভ:
রাজা-রাণীর আরাধনায় মহাকারুণিক বুদ্ধ, সারিপুত্র স্থবিরসহ সশিষ্যে রাজপ্রসাদে এসে উপস্থিত হলেন। তথায় বুদ্ধকে বন্দনা-পূজা সমাপন করে মাতা-পুত্রে সারিপুত্র স্থবিরকে বন্দনা করার প্রত্যয়ে স্থবিরের নিকটে উপস্থিত হলেন। সারিপুত্র স্থবির সীবলী কুমারকে উপলক্ষ করে জিজ্ঞাসা করলেন- কুমার, তোমার সপ্তবর্ষ গর্ভবাস যন্ত্রণার কথা মনে আছে কী? কুমার প্রতুত্তরে বললেন- ভন্তে, অসহ্য অনন্ত দুঃখ গর্ভ কারাগার, লৌহকুম্ভী নরকের চেয়ে মাতৃগর্ভ কম কিছু নয়। তারপর সারিপুত্র স্থবির প্রকাশ করলেন- সজ্ঞানে তুমি জন্ম দুঃখ অবগত হয়েছ! নিরোধ নির্বাণ ব্যতীত সুখ নেই। তোমার প্রব্রজ্যা ইচ্ছা আছে কী? কুমার সবিনয়ে বললেন- ভন্তে, আমি প্রব্রজ্যাই গ্রহণ করব। ইহা ব্যতীত দুঃখ মুক্তি আর দেখি না। সপ্তম বর্ষীয় কুমারের এরূপ পরিপক্ষ জ্ঞান-ধর্মালাপে সুপ্রবাসা আনন্দিত হয়ে সারিপুত্র স্থবিরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ভন্তে, আপনাদের আলাপচারিতা কী নিয়ে? তখন সারিপুত্র স্থবির ব্যক্ত করলেন- দুঃখ সত্য প্রসঙ্গে আমাদের এ আলাপচারিতা। এবং কুমার ইচ্ছা পোষণ করছে প্রব্যজ্যা গ্রহণে! কিন্তু অনুমতি ব্যতীত কেমন করে প্রব্রজ্যা প্রদান করব!
ইহা শুনে সুপ্রবাসা সারিপুত্র স্থবিরকে বন্দনা নিবেদন করতঃ কুমারকে প্রব্রজ্যা প্রদান করার অনুমতি প্রদান করলেন। তখন বুদ্ধ সশিষ্যে সীবলী কুমারকে সাথে নিয়ে বৈশালী বিহারে উপস্থিত হয়ে প্রব্রজ্যা প্রদানের ব্যবস্থা করলেন। সারিপুত্র স্থবির আদি কর্মস্থান দিতে গিয়ে কুমারকে উপলক্ষ করে বললেন- হে কুমার, তুমি সপ্তবর্ষ গর্ভবাস যন্ত্রণা ভোগের কথা স্মরণ কর! সীবলী কুমার গর্ভবাস যন্ত্রণার নরকসম দুঃখের কথা স্মরণ করতে লাগলেন। এমতাবস্থায় মস্তক মুণ্ডনকালে চুলের প্রথম গোছা কর্তন করার সময় কেশ কেশ ভাবনাতে কুমার স্রোতাপন্ন হন, চুলের দ্বিতীয় গোছা কর্তন শেষে মার্গফল লাভ করলেন, তৃতীয় গোছাতে কুমার অনাগামী ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন এবং সর্ব কেশ ছেদন শেষে কোন প্রকার ক্লেশ আর অবশিষ্ট রইল না। তিনি অর্হত্ব ফল লাভের মধ্যদিয়ে দুঃখ জয়ে সমর্থ হলেন।
তদবধি ভিক্খুদের অভাব ঘুচিল, ভৈষজ্য-চীবর আদি চতুর্প্রত্যয়,
অজস্র করিছে দান দেবনরচয়।
রাশি রাশি খাদ্যভোজ্য সংখ্যা নাহি তার, দেখিয়া বিষ্ময় লাগে মনে সবাকার।
যেদিকে সীবলী থের করেন গমন, বৃষ্টিধারা সম দান হয় বরিষণ।
সপ্তবর্ষ গর্ভবাসের কর্মফল বর্ণনা:
অতীতের কর্ম্মশক্তি থাকে সুপ্তাকারে, সকলেই কর্ম্মতত্ত্ব বুঝিতে না পারে।
আম্র হতে আম্র জন্মে, কাঠাঁলে কাঠাঁল, নিম হতে জন্মে নিম, মাকালে মাকাল*।
তাই বলি কর্ম্মফলে হও সাবধান, কর সুচরিত কর্ম্ম হয়ে মতিমান।
ভাল কর্ম্মে ভাল ফল, মন্দে মন্দ হয়, কর্ম্মের প্রকৃতি ইহা জানিবে নিশ্চয়।
সুদূর অতীতে বারাণসীতে ব্রহ্মদত্ত নামে এক অধিপতি ছিলেন। তিনি উত্তমরূপে রাজধর্ম পালন করতেন। রাজ্যে তার সুখ্যাতি প্রত্যেক প্রজামুখে। কিন্তু অতর্কিতভাবে একদিন শত্রুরাজ দ্বারা বারাণসীতে আক্রমণ হল। শত্রুরাজ রাজা ব্রহ্মদত্তকে হত্যা করে বারাণসীর সিংহাসন দখল করে নিলেন। এবং পূর্ব রাজরাণীকে অগ্র মহিষীরূপে ভূষিত করলেন।
এদিকে রাজা ব্রহ্মদত্তের পুত্র গুপ্তদ্বার দিয়ে পলায়ন করে প্রাণ রক্ষা করলেন। তিনি দূরদেশী জ্ঞাতিকুলে আশ্রয় নিয়ে ধীরে ধীরে সৈন্য সংগ্রহ এবং নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। অতঃপর, সৈন্যসহ পিতৃরাজ্য পুনরুদ্বারে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে বারাণসীর দিকে রওনা হলেন। গোপন সংবাদে মা পুত্রের আগমন বার্তা পেয়ে গোপন সংবাদ প্রেরণ করেন-
“আগে বন্ধ কর নগরের বহির্দ্বার, খাদ্যের অভাবে কষ্ট হোক সবার।
নগরবাসীরা যবে অতিষ্ঠ হইবে, ক্রোধে তারা শত্রুরাজে মারিয়া ফেলিবে।
তাহা হলে বিনাযুদ্ধে লভিবে বিজয়, ইহাই উত্তম যুক্তি জানিও নিশ্চয়”।
মায়ের বার্তা পেয়ে নগরের বাইরের দরজা সৈন্যদল দিয়ে সাত বছর অবরুদ্ধ করা রাখা হয়। তবুও রাজ্যের মধ্যে খাদ্যের অভাব, হাহাকার উঠেনি। কারণ নগরবাসীরা গুপ্তদ্বার দিয়ে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে আনত। তখন পুনরায় মায়ের সংবাদে গুপ্তদ্বার অবরোধ করা হলে নগর মাঝে খাদ্যদ্রব্যের হাহাকারে প্রজাসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে রাজাকে হত্যা করে। অতপরঃ রাজা ব্রহ্মদত্তের পুত্র পিতৃরাজ্য নিজের করে নিলেন। (রাজা ব্রহ্মদত্তের সেই রাজপুত্র ছিলেন ‘সীবলী কুমার’)।
সপ্তবর্ষ সপ্তদিন দ্বার রুদ্ধ করি, সেই পাপে লৌহকুম্ভী নরকেতে পড়ি।
ভুগিয়াছি, বহু দুঃখ না যায় বর্ণন, অবশেষে লভিয়াছি মানব জনম।
ভুগিয়াছি পাপের ফল কিছু বাকী ছিল, সে কারণে মাতৃগর্ভে এত কষ্ট হল।
সীবলী পরিত্রাণ (বাংলা):
০১) মহাজ্ঞানী বুদ্ধশিষ্যগণ সকলেই শ্রাবক পারমী পুর্ণ করিয়াছেন। সীবলীর এ পারমী গুণতেজ সম্বলিত সেই পরিত্রাণ পাঠ করিতেছি। (বন্ধনী স্থিত বিষয়গুলীর অর্থ সুবোধ্য নহে) সম্ববতঃ সীবলী গুণ প্রকাশক সাংকেতিক শব্দ।
০২) সমস্ত স্বভাব ধর্মে চক্ষুষ্মান পদুমুত্তর নামক বুদ্ধ এই হইতে লক্ষকল্প পূর্বে জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
০৩) সীবলী মহাস্থবির চতুর্ব্বিধ প্রত্যয়াদি পাইবার যোগ্য মহাপুরুষ। তিনি দেব-মানবগনের, উত্তম ব্রহ্মাগণের ও নাগসুপর্ণগণের প্রিয়পাত্র ছিলেন। সেই পীণেন্দ্রীয় মহাপুরুষকে আমি নমস্কার করিতেছি।
০৪) তিনি দেব-মানবগনের পূজিত, তাহার গুণ প্রকাশক “নাসং সীসো চ মোসীসং, নানজালীতি সংজলিং” এই বাক্যের প্রভাবে আমার সকল বিষয় লাভ হোক।
০৫) আমি ভূমিষ্ট হইবার সময় সপ্তাহকাল মাতৃযোনিতে মহাদুঃখ পাইয়াছি। আমার মাতাও এইরূপ মহাদুঃখ ভোগ করিয়াছেন।
০৬) আমি প্রব্রজ্যার জন্য কেশচ্ছেদনের সময় অর্হত্ব প্রাপ্ত হইয়াছি। দেব-নাগ-মনুষ্যগণ আমার জন্য উপকরণ করিয়া থাকেন।
০৭) আমি পদুমুত্তর ও বিপস্সী নামক বিনায়ক বুদ্ধকে বিশেষ বিশেষ বস্তুর দ্বারা সন্তুষ্ট চিত্তে পূজা করিয়াছি।
০৮) তাঁহাদের বিশিষ্টতা ও বিপুল উত্তম কর্মের প্রভাবে, বনে-গ্রামে-জলে ও স্থলে এই মহাপৃথিবীর সর্বত্র আমি প্রয়োজনীয় বস্তু লাভ করিয়া থাকি।
০৯-১০) তখন দেবতা আমার জন্য উত্তম বস্তু আনিয়াছিলেন। আমি সেই উপকরণের দ্বারা সঙ্ঘসহ লোকনায়ক বুদ্ধকে পুজা করিলাম। ভগবান বুদ্ধ রেবত স্থবিরকে দর্শন করিতে গেলেন। সেইখান হইতে জেতবনে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া আমাকে লাভীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থান প্রদান করিলেন।
১১-১২) জগতের অগ্রনায়ক বুদ্ধ ত্রিশহাজার ভিক্ষুসহ যখন রেবত স্থবিরকে দেখিতে গিয়াছিলেন, তখন সর্ব্বলোক হিতৈষী শাস্ত্রা ভিক্ষুদিগকে ডাকিয়া কহিলেন- হে ভিক্ষুগণ, আমার লাভী শিষ্যদের মধ্যে ‘সীবলী অগ্র’। এই বলিয়া পরিষদের মধ্যে আমার প্রশংসা করিয়াছিলেন।
১৩) আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হইয়া গিয়াছে। সমস্ত ভব (অর্থাৎ উৎপত্তির কারণ) বিহত হইয়াছে। আমি বন্ধন ছিন্ন হস্তীতুল্য সংসার-বন্ধন শুন্য হইয়া বিহরণ করিতেছি।
১৪) ভগবান বুদ্ধের চরণ তলে আগমন আমার পক্ষে “স্বাগতম” অর্থাৎ সুন্দর আগমন হইয়াছে। আমি ত্রিবিদ্যা লাভ করিয়া বুদ্ধের শাসন প্রতিপালন করিয়াছি।
১৫) আমি চারি প্রতিসম্ভিদা, অষ্টবিমোক্ষ ও ষড় অভিজ্ঞা প্রত্যক্ষ করিয়া বুদ্ধশাসন রক্ষা করিয়াছি।
১৬-১৭) বুদ্ধপুত্র, জিনশ্রাবক, মহাতেজীয়ান, মহাবীর, মহাস্থবির সীবলী নিজের শীলতেজে জিন-শাসন রক্ষা করিয়া যশস্বী-ধনবান সদৃশ ছিলেন।
১৮) বুদ্ধ মার সৈন্য পরাজয় করিবার জন্য কল্পকাল স্থায়ী বোধিদ্রুম মূলে উপবেশন করিয়াছিলেন। (সেই সত্য বাক্যের প্রভাবে ) সীবলী আমাকে সর্বদা রক্ষা করুন।
১৯) আমার (একান্ত পুজনীয়) সীবলী স্থবির অগ্রলাভী দশবিধ পারমিতা পূর্ণ করিয়া গৌতম জিন-শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ পূর্বক শাক্যপুত্র নামে পরিচিত হইয়াছেন।
২০) ভগবান বুদ্ধের অশীতিজন মহাশ্রাবকের মধ্যে পূণ্ণস্থবির যশস্বী আর ভোগ্য বস্তু লাভী মধ্যে সীবলী অগ্রলাভী। তাহাদিগকে আমি অবনত শিরে বন্দনা করিতেছি।
২১) বুদ্ধগুণ অচিন্তনীয়, ধর্ম্মগুণ অচিন্তনীয় এ প্রকার অচিন্তনীয় বিষয়ে যাঁহারা প্রসন্ন হন, তাহাদের প্রসন্নতার ফলও অচিন্তনীয়।
২২-২৩-২৪) [২২-২৩-২৪ নং গাথার অর্থ হল “তাঁহাদের সত্য, শীল, ক্ষান্তি ও মৈত্রী বলের দ্বারা তাঁহারা আমাকে রক্ষা করুন, আমার সকল দুঃখ বিনাশ হউক। আমার সকল ভয় ও সকল রোগ বিনাশ প্রাপ্ত হোক”]।
সীবলী বন্দনা ও পূজা উৎসর্গ:
বন্দনা: সীবলীযং মহাথের লাভীনং সেট্ঠতং গতো মহন্তং পুঞ্ঞাবন্তং তং অভিবন্দামি সব্বদা। (তিন বার)
পূজা উৎসর্গ: ইতিপি সো সব্ব লাভীনং সীবলী অরহং তম্হং ভগবন্তং সধম্মং সসঙ্ঘং ইমেহি আহারেহি, ইমেহি নানা বিধেহি, ফলমূলেহি, ইমেহি পূপ্ফেহি, ইমেহি পদীপেহি, উদকেহি, সুগন্ধেহি, মধুহি, লাজেহি, তাম্বুলেহি, নানাবিধেহি, অগ্গরসেহি, পূজোপচারেহি। তম্হং ভগবন্তং সধম্মং সসঙ্ঘং সীবলী নাম অরহং মহাথেরস্স পূজেমি, পূজেমি, পূজেমি।
ইমিনা পূজা সাক্খার অনুভাবেন যাব নিব্বাণস্স পত্তিতাব জাতি জাতিযং সুখ-সম্পত্তি সমঙ্গীভূতেন সংসরিত্বা নিব্বাণং পাপুনিতুং পত্থনং করোমি। তেজানুভাবেন সব্ব লাভং ভবন্তু মে।
ইদং নানা বিধেহি পূজাপচারেহি পূজানুভাবেন বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ, অগ্গসাবক, মহাসাবক, অরহন্তানং সদ্ধিং সীবলী মহালাভী স্বভাবসীলং।
অহম্পি তেসং অনুবত্তকো হোমি, ইদং পূজোপচারং দানি বণ্ণেনপি সুবণ্ণং, গন্ধেননপি সুগন্ধং, সণ্ঠানেনপি সুসণ্ঠানং, খিপ্পমেব দুব্বন্নং, দুগ্গন্ধং, দুস্সণ্ঠানং, অনিচ্চতং পাপুনিস্সতি। এবমেব সব্বে সংখার অনিচ্চা, সব্বে সংখার দুক্খা, সব্বে ধম্মা অনত্তা’তি।
ইমিনা বন্দনা মানন পূজা পটিপত্তি অনুভাবেন আসবক্খায বহং হোতু সব্বদুক্খা পমুঞ্চন্তু। ইমায ধম্মানুধম্মা পটিপত্তিযা বুদ্ধো ধম্ম সঙ্ঘস্স সদ্ধিং সীবলীযং পূজেমি।
অদ্ধা ইমায ধম্মানুধম্মা পটিপত্তিযা জাতি, জরা, ব্যাধি, মরণম্হা ধম্মো পরিমুচ্চিস্সামি।
পরিশিষ্ট:
‘সীবলী পরিত্রাণ’ পালি ও বাংলায় পাঠ করা কর্তব্য। সীমাহীন দুঃখের এ জীবনে ঈস্পিত বস্তু না পাওয়ায় দুঃখে আমরা যেখানে সদা জর্জরিত কিন্তু সেখানে লাভীশ্রেষ্ঠ অর্হৎ সীবলী স্থবির ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন লাভীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি যখন যা প্রত্যাশা করতেন তখন তা পেতেন। তিনি মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করার পর হতেই তার পিতা-মাতা/পরিবারের লাভ-সৎকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই বৌদ্ধগণও ঈস্পিত বস্তু এবং লাভ-সৎকার বৃদ্ধি মানসে সীবলী পূজা এবং সীবলী পরিত্রাণ পাঠ করে/শ্রবণ করে থাকে। অন্তরে প্রবল শ্রদ্ধা-ভক্তি-বিশ্বাস নিয়ে সীবলী বন্দনা, পূজা, পরিত্রাণ পাঠ/শ্রবণ করতঃ লাভ-সৎকার বৃদ্ধি, পারিবারিক সৌভাগ্য-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি, নানাবিধ বিপদাপদ হতে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া এহেন পূজ্য অরতহের পূজার ফল কখনো বৃথা যায় না এতে প্রভূত পূণ্য ব্যতীত অপূণ্য সাধিত হয়না।
সীবলীর ব্রতকথা যে করে পঠন, তাহার দুঃখ রবে না কখন।
পাপগ্রস্থ দোষে দুঃখ যখন পাইবে, যতনে সীবলী পূজা তখনি করিবে।
হবে গ্রহদোষ-শান্তি নিশ্চয় নিশ্চয়, সর্বজ্ঞ বুদ্ধের বাণী কভু মিথ্যা নয়।
“সাধু, সাধু, সাধু, জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক”
*মাকাল = লতা জাতীয় উদ্ভিদ, বাইরে সুন্দর অথচ ভিতরে দূর্গন্ধ ও খাদ্য শাসযুক্ত ফলবিশেষ, সুদর্শন অথচ গুণহীন ব্যক্তি।
তথ্যসূত্র: সীবলী ব্রতকথা- বিশুদ্ধাচার স্থবির।