৩০শে জুলাই ১৯৯৬ ইংরেজী সোমবার। শ্রদ্ধেয় বনভান্তের সাধনা কুঠিরের উপরের তলা। সময় ভোর বেলা। তাঁর শিষ্যদেরকে দেশনা দিচ্ছিলেন। তিনি যে লোকোত্তর দেশনা প্রদান করেন তা আমার (সংকলক) শারীরিক অসুস্থতা ও জ্ঞান পরিধির অভাবে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারিনি। তবুও যৎ সামান্য ধারণ করেছি তা আপনাদের নিকট প্রকাশ করছি। তাঁর দেশনার প্রধান সারমর্ম হল কোথা হতে দুঃখের সৃষ্টি হয়? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন- অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও উপাদান হতে এ দুঃখ গুলির সৃষ্টি হয়। অবিদ্যা অর্থ না জানা। কি না জানা? দুঃখ কি না জানা। দুঃখ সমুদয় কি না জানা। দুঃখের নিরোধ কিসে হয় না জানা। দুঃখ নিরোধের পথ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সম্বন্ধে না জানা। অর্থাৎ কোন কিছু সম্বন্ধে না জানা বা অজ্ঞানতাই অবিদ্যা।
তিনি বলেন- তৃষ্ণা হল দুঃখের কারণ। কাম তৃষ্ণা, ভব তৃষ্ণা ও বিভব তৃষ্ণা। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে অসার সুখ ভোগ করাকে কাম তৃষ্ণা বলে। ভব তৃষ্ণা অর্থ হল ভবে ভবে অর্থাৎ কামলোকে ও রূপলোকে ঘুরে ঘুরে জন্মগ্রহণ করে সুখ ভোগ করা। বিভব তৃষ্ণা হল উচ্ছেদ জনিত বীত তৃষ্ণা।
উপাদান অর্থ উৎস, উৎপত্তি মূল বুঝায়। উপাদান চার প্রকার। কাম উপাদান, আত্ম উপাদান, দৃষ্টি উপাদান ও শীলব্রত উপাদান।
কাম উপাদানঃ- পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক ইন্দ্রিয়ে সব সময় দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে। কি গ্রহণ করে? গ্রহণ করে লোভ মোহ, দ্বেষ মোহ অর্থাৎ লোভ, দ্বেষ মোহ গ্রহণ করে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ সাপ সব সময় ব্যাঙ তালাশ করে। ঠিক সেরূপ পঞ্চ ইন্দ্রিয়, রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ ও স্পর্শকে সব সময় তালাশ করে ও পিছনে পিছনে ধরার জন্য ধাওয়া করে। তাতে সুখের পরিবর্তে দুঃখের ভাগী হয়।
আত্ম উপাদানঃ- অর্থ হল দেহের মধ্যে আত্মা নামে এক জীব আছে। সেটা অজর অমর, শাশ্বত বলে মনে করে। তাতে ভীষণ অজ্ঞানতার সৃষ্টি হয়ে দুঃখ মুক্তির পথ খুঁজে পায়না। তাতে অনন্তকাল পর্যন্ত দুঃখে কালাতিপাত করে। আত্মা যে অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা ও ক্ষয় ব্যয় শীল বুঝতে সক্ষম নয়।
দৃষ্টি উপাদানঃ- দৃষ্টি উপাদান হল মিথ্যাদৃষ্টি উপাদান অর্থাৎ কোন বিষয় বা জিনিস ভাল মন্দ বিবেচনা করে মন্দটা বাদ দিয়ে ভালটা গ্রহণ করতে পারে না। যেমন অন্ধ ব্যক্তি যে কোন জিনিস ভাল মন্দ বিচার করতে সক্ষম নয়। ঠিক দৃষ্টি উপাদান গৃহীত ব্যক্তি ও সেরূপ সব সময় সুখ মনে করে দুঃখে পতিত হয়।
শীলব্রত উপাদানঃ- কেউ কেউ নির্বাণ ধর্ম বুঝতে না পেরে অন্য ধর্ম, পর ধর্ম, হীন ধর্ম ও মিথ্যা ধর্ম আচরণ করতে থাকে। তারা মনে করে এ ধর্মে সুখ আছে, মুক্তি আছে ও শান্তি আছে। তাতে তারা সুখের পিছনে, মুক্তির পিছনে ও শান্তির পিছনে ধাবিত হয়ে বিপরীতে ফল লাভ করে থাকে। যেমন গরুর মত কচি ঘাস ও পাতা খাওয়াকে গোব্রত বলে। কুকুরের মত মাটি হতে জিহ্বা বা মুখ দিয়ে আহার করা। এটাকে কুকুর ব্রত বলে।
সকল দুঃখের মূল অবিদ্যা, তৃষ্ণা, কাম উপাদান, আত্ম উপাদান, দৃষ্টি উপাদান ও শীলব্রত উপাদান আছে বলে মানুষ সহজে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না। এ সমস্ত উপাদান ধ্বংস হলে কি হয় জান? সত্ত্ব মরে, আত্মা মরে ও মার মরে। যেমন চারি আর্য্যসত্যের মধ্যে দুঃখ সত্য হৃদয়ঙ্গম হলে সৎকায় দৃষ্টি বা আত্মবাদ সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়। দুঃখ সমুদয় নিরোধে উচ্ছেদ দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়। নিরোধ সত্য দর্শনে শাশ্বত দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়। মার্গ সত্য দর্শনে অক্রিয় দৃষ্টি সম্পূর্ণ রূপে উচ্ছেদ হয়।
যারা উচ্ছেদ দৃষ্টি বাদী তারা এক গুয়ে। পুনঃ জন্ম নেই বলে, মরণের পরও দুঃখ নেই, মরণের পর সব শেষ হয়ে যায়, এ রকম তারা বলে থাকে। তাদের মধ্যে বহু দোষ থাকে।
সৎকায় দৃষ্টি বাদীরা পঞ্চ স্কন্ধে আমি আছি বা আমার ধারণা করে। পঞ্চ স্কন্ধ বলতে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে বুঝায়।
অক্রিয়াদৃষ্টি বাদীরা দান, শীল, ভাবনা ও পাপ পূণ্যের বিশ্বাস করেনা। এগুলির কোন ফলও নেই এ ধারণা তাদের বদ্ধমূল।
শ্বাশ্বত দৃষ্টি বাদীরা কিছু মাত্র ধার্মিক থাকে, পরকালও বিশ্বাস করে, কিন্তু তাদেরকে বুঝানো খুবই কঠিন। তারা সব সময় নিজকে ভাল, উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে।
উপসংহারে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে তাঁর শিষ্যদেরকে উদাত্ত কণ্ঠে বলেন- তোমরা জ্ঞান আহরন কর। কিসের জ্ঞান জান? শুধু লোকোত্তর জ্ঞান। লোকোত্তর জ্ঞানে সব দুঃখের অবসান ঘটে। সুতরাং তোমরা অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও উপাদান ধ্বংস করে পরম সুখ নির্বাণ প্রত্যক্ষ কর। নির্বাণ এমন অবস্থা, তা অন্য কেউ দেখিয়ে দিতে পারবে না। যেমন মিলিন্দ রাজা নাগসেন স্থবিরকে বলেছিলেন- নির্বাণ কোথায়? দেখায়ে দিন। তিনি বলেছিলেন- মহারাজ, বাতাস আছে? রাজা বললেন- হ্যাঁ আছে। স্থবির বললেন- তাহলে বাতাস দেখিয়ে দিন। রাজা বললেন- বাতাস দেখিয়ে দেয়া যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। স্থবির তখন বললেন- তাহলে নির্বাণও দেখিয়ে দেয়া যায় না। শুধু নিজে নিজে অনুভব করা যায়। এ বলে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সবাইকে নির্বাণ প্রত্যক্ষ করার জন্যে উৎসাহিত করে তাঁর দেশনার ইতি টানলেন।
#লেখাটি কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে
Subrata Barua