পুরাকালে বারণসী রাজা ব্রম্মদত্তের সময় বোধিসত্ত্ব হস্তীকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর দেহটি শ্বেতবর্ণ ও অতি সুব্দর ছিল। তিনি আশীহাজার হাতির অধিপতি ছিলেন। বোধিসত্ত্বের মাতা অন্ধ ছিলেন। বোধিসত্ত্ব তাঁর অন্ধ মাতার জন্য নানা রকমের মিষ্টি ফল অন্য হাতিদের দিয়ে তাঁর মার কাছে পাথিয়ে দিতেন। কিন্তু তারা সেই ফল তাঁর মাকে না দিয়ে নিজেরাই খেয়ে ফেলত। তখন বোধিসত্ত্ব স্থির করলেন, তিই এবার হতে দলের আদিপত্য ত্যাগ করে অন্যকোথাও গিয়ে মার সেবা করবেন।
এই স্থির করে তিনি একদিন রাত্রিকালে অন্যান্য হাতিদের কাউকে কিছু না বলে, মাকে নিয়ে চণ্ডোরণ পর্বতের পাদদেশে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে এক সরোবরের নিকটে এক পরবত গুহায় মাকে রেখে পোষধব্রত করতে লাগলেন।
একদিন এক ধূর্ত বারাণসী বাসী সেই বনের মধ্যে এসে পথ হারিয়ে বন থেকে বার হতে না পেরে আর্তনাদ করছিল। শীলবান বোধিসত্ত্ব সেই আর্তনাদ শূনে অনুকম্পাবশতঃ লক্তির কাছে এসে বললেন, ভয় নেই, আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব। এই বলে তিনি লোকটিকে তাঁর পিঠের উপর তুলে বন হতে বের করে লোকালয়ে রেখে এলেন। ধূর্ত লোকটি পথের দুপাশের সব পর্বত ও গাছপালা চিনে রাখল।
সেই সময় বারাণসীরাজের মঙ্গল হস্তিটি মারা গিয়েছিল। রাজা নগরে ভেরী বাজিয়ে ঘোষণা করলেন, যদি কেউ আমাকে বহন করার উপযুক্ত কোন ভাল হাতি কোথাও দেখে থাকে তাহলে সে যেন আমাকে বলে যায়।
সেই ধূর্ত লোকটি এই ঘোষণার কোথা শূনে তখনি রাজার কাছে গিয়ে বলল, মহারাজ আমি এক বনে আপনাকে বহন করার উপযুক্ত সর্বাঙ্গ সুন্দর, শীলবান ও শ্বেতবর্ণের একটি হাতি দেখেছি। আপনি তাঁকে ধরে আনার জন্য গজাচার্জদের পাঠান। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।
রাজ এই কোথা শূনে তৎক্ষণাৎ বহু অনুচরসহ একজন গজাচার্জকে সেই লোকটির সঙ্গে পাথিয়ে দিলেন।
গজাচার্জ অনুচরবর্গ সেখানে গিয়ে দেখলেন, বোধিসত্ত্ব সেই সরোবরে নেমে আহার করছেন। বোধিসত্ত্ব গজাচার্জ ও তার অনুচরদের দেখে বুজতে পারলেন, সেই ধূর্ত লোকটি আমাকে ধরার জন্য এদের এখানে এনেছে। তিনি ভাবলেন আমি মহাবল। আমি ক্রুদ্ধ হলে সমস্ত সেনাবাহিনী সহ গোটা রাজ্য ধংস করে দিতে পারি। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবেনা। কিন্তু আমি ক্রুদ্ধ হয়ে বল প্রয়োগ করলে আমার শীলভঙ্গ হবে।
এইভেবে তিনি নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। গজাচার্জ দেখলেন, হাতিটি সর্বসুলক্ষণযুক্ত এবং রাজার মঙ্গলহস্তী হবার উপযুক্ত। তিনি বোধিসত্ত্বের এর কাছে গিয়ে বললেন, এস পুত্র।
এই বলে তিনি তাঁর শুঁড় ধরে তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি তাঁর সঙ্গে গেলেন। গজাচার্জ তাঁকে নিয়ে বারাণসী রাজার কাছে গেলেন।
এদিকে বোধিসত্ত্বের অন্ধ মাতা পুত্রকে ফিরে আসতে না দেখে বুজতে পারলেন, রাজার লোকেরা নিশ্চয় আমার বাছাকে কোন দূর দেশে নিয়ে গেছে। এখন আমি অসহায়। আমাকে কে পোষণ করবে??
এই বলে তিনি শোকে বিলাপ করতে লাগলেন।
গজাচার্জ পথ হতে রাজাকে খবর পাঠালেন, তিনি রাজার মঙ্গলহস্তী পেয়েছেন এবং তাঁকে নিয়ে জাচ্ছেন।।
রাজা এই খবর পেয়ে সমস্ত নগর সুসজ্জিত করেছিলেন। গজাচার্জ বোধিসত্ত্বকে সুসজ্জিত ও সুবাসিত হস্তীশালায় নিয়ে গেলেন। রাজা নিজের অনেক উৎকৃষ্ট ও মধুরসযুক্ত খাদ্য এনে বোধিসত্ত্বকে খেতে দিলেন। কিন্তু বোধিসত্ত্ব মাকে ফেলে কোন খাদ্য খাবেন না বলে সঙ্কল্প করে কোন খাদ্য গ্রহন করলেন না। রাজা তাঁকে খাদ্য গ্রহন করার জন্য বারবার অনুরোধ করলে বোধিসত্ত্ব একটি গাঁথার মাধ্যমে বললেন, আমাকে না পেয়ে সেই বৃদ্ধা হস্তিনী চণ্ডোরণ পর্বতে ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করছে।
রাজা তখন জিজ্ঞাসা করলেন, কে সেই অনাথা বৃদ্ধা হস্তিনী?
বোধিসত্ত্ব বললেন, তিনি আমার জননী।, অন্ধ অসহায়।আই ছাড়া তাকে পোষণ করার কেউ নেই।
রাজা এ কথা শূনে বললেন, এই শীলবান হস্তীবড় মাতার পোষণে রত। একে মুক্ত করে দাও। এ মাতার কাছে গিয়ে তাঁর সেবা করুক।
শৃংখল্মুক্ত হয়ে তিনি রাজা কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তখনি চণ্ডোরণ পর্বতে মার কাছে চলে গেলেন। তাঁর মার তখন অনাহারে চলবার শক্তি ছিল না। তিনি গুহায় শুয়ে ছিলেন। বোধিসত্ত্ব মার কাছে গিয়ে বললেন, ওঠ মা, আর তোমার চিন্তা নেই। তোমার পুত্র ফিরে এসেছে। সুবিজ্ঞ ধার্মিক কাশীরাজ আমাকে মুক্তি দিয়েছেন তোমাকে পোষণ করার জন্য।
বোধিসত্ত্বের মাতা কাশীরাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, চিরজীবী হোক সেই রাজা। উত্তরুত্তর তাঁর শ্রী বৃদ্ধি হোক। তাঁর কৃপায় পুত্র আমার মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে আমার কাছে।
মাতৃপোষক, মাতৃভক্ত বোধিসত্ত্বের গুনে রাজা প্রসন্ন হয়ে চণ্ডোরণ পর্বত ও সরোবরের নিকট এক গ্রাম বসালেন। সেখান হতে বোধিসত্ত্ব ও তাঁর মার জন্য খাবার পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।
কালক্রমে মাতার মৃত্যু হলে বোধিসত্ত্ব করণ্ডুক আশ্রমে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। সেখানে পাঁচশত তাপস বাস করতেন। রাজা বোধিসত্ত্বের মত তাঁদের জন্যও খাদ্য পাঠাতেন। পরে রাজা বোধিসত্ত্বের একটি শীলামূর্তি স্থাপন করে তাঁর পুঁজা করতেন প্রতিদিন।
সমস্ত জম্বুদ্বীপবাসী প্রতি বছর সেখানে সমবেত হয়ে গজোৎসব পালন করত।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র