এক সময় শ্রদ্ধেয় শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) নিজ আবাসিক ভবনে ভিক্ষুসঙ্ঘকে দেশনা প্রদানকালে বলেন—তোমরা কিসের উদ্দেশ্যে প্রব্রজিত হয়েছে? লাভের উদ্দেশ্যে নয় কি? কারণ কেহ লোকসানের উদ্দেশ্যে কিছু করে না। তবে তোমাদের পার্থিব কিছু লাভ করা নয়। তোমরা জ্ঞান লাভ ও নির্বাণ লাভের উদ্দেশ্যে প্রব্রজিত হয়েছে। প্রব্রজিত হয়ে চারি আর্যসত্য জ্ঞান লাভ এবং চারি আর্যসত্য লাভ করাই হল তোমাদের লাভ। আবার এখন তোমাদেরকে কি দর্শন করে অবস্থান করতে হবে জান? বুদ্ধকে দর্শন ও ধর্ম দর্শন করে। বুদ্ধ বলেছেন, যে ব্যক্তি বুদ্ধকে দর্শন করতে সক্ষম সে ব্যক্তি ধর্মকেও দর্শন করতে সমর্থ হয়। বুদ্ধকে দর্শন অর্থাৎ বুদ্ধের জ্ঞানকে দর্শন করা, যথা—দুঃখে জ্ঞান, দুঃখ সমুদয়ে জ্ঞান, দুঃখ নিরোধে জ্ঞান, দুঃখ নিরোধগামিনী পটিপদায় জ্ঞান, এই চারি আর্যসত্য জ্ঞানকে দর্শন করাই হল বুদ্ধের জ্ঞানকে দর্শন করা। ধর্ম দর্শন হল দুঃখ সত্য, সমুদয় সত্য, নিরোধ সত্য, মার্গসত্য এ’চারি আর্যসত্যকে দর্শন করাই হচ্ছে ধর্ম দর্শন করা। তাহলে তোমরা কি দর্শন করবে? জ্ঞান দর্শন, সত্য দর্শনই করবে। যদি বলা হয় একজন যুবতী মেয়ে দর্শন করেছি তবে সেটা কি হবে? অজ্ঞানকে দর্শন করা হবে। সেরূপ অজ্ঞান, মিথ্যাকে দর্শন না করে তোমরা জ্ঞান সত্যকেই দর্শন করবে। অজ্ঞান, মিথ্যাকে দর্শন করলে অজ্ঞান, মিথ্যা বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। আর সেই অজ্ঞান, মিথ্যার ফলে দুঃখ, পাপ উদয় হওত তোমাদেরকে জন্ম জন্মান্তর ধরে অসহ্য ভব যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। এভাবে অজ্ঞান, মিথ্যাকে দর্শন করার ফলে যদি ভব যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় তা’ প্রব্রজিতদের জন্য লোকসানই জানবে। অন্যদিকে সর্বদা জ্ঞান ও সত্যকে দর্শন করার ফলে বুদ্ধ দর্শন, ধর্ম দর্শন হওত ভব বন্ধন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তা’ প্রব্রজিতদের জন্য লাভ (উন্নতি, শ্রীবৃদ্ধি) বলে জানবে। সর্ব নিম্নে কামলোক, তার উপরে রূপলোক, তার উপরে অরূপ লোক, তার উপরে লোকোত্তর। কামলোক, রূপলোক, অরূপলোক এগুলোকে বলা হয় ভব। অর্থাৎ কামভব, রূপভব, অরূপ ভব। সত্ত্বগণের মধ্যে কেহ কামভবকে সুখ মনে করে, কেহ রূপভবকে সুখ মনে করে, কেহ অরূপ ভবকে সুখ মনে করে এবং স্বীয় কাঙ্ক্ষিত সেই ভবের মধ্যে তারা সুখ ভোগে রত থাকে। তোমরা কিন্তু সেসব ভবের মধ্যে না থেকে ভব হতে ঊর্ধ্বে উঠে নির্বাণ বা লোকোত্তর স্তরে উন্নীত হও। তাহলে যে উদ্দেশ্যে প্রব্রজিত হয়েছ সেই উদ্দেশ্য সার্থক হবে, পরম সুখের অকিকারী হওত তোমাদের নির্বাণ লাভ হবে। বলা বাহুল্য প্রব্রজিতগণকে ভব অন্বেষণ করতে নেই, ভব ভবান্তরে সুখ ভোগের ইচ্ছা তাদের জন্য একেবারেই বেমানান। প্রব্রজিত হয়ে যদি ভব ভবান্তরে ভ্রমণ করতঃ সুখ ভোগের প্রত্যাশী হও তা’ নির্লজ্জের কাজও বটে।

 

বৌদ্ধ ধর্মের মতে, নির্বাণই একমাত্র প্রকৃত সুখ। অন্যান্য ধর্মের মতে কেহ স্বর্গকে আর কেহ ব্রহ্মকে প্রকৃত সুখ বলে। কিন্তু বৌদ্ধধর্র্ম স্বর্গ, ব্রহ্মকেও দুঃখ বলে জানে। কারণ স্বর্গ, ব্রহ্ম লাভে অবিদ্যা, তৃষ্ণা হতে বিমুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। স্বর্গ, ব্রহ্মাদি অবিদ্যা তৃষ্ণার অধীন। কাজেই স্বর্গ, ব্রহ্মার মধ্যে প্রকৃত সুখের হদিস মিলে না কখনো। তাই বুদ্ধ বলেছেন—সাধারণ (স্বল্পজ্ঞান) মানুষ আমার এ’ধর্ম অনুধাবন করতে পারবে না। বৌদ্ধধর্ম হল অসাধারণ জ্ঞানের ধর্ম। সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা এ’ধর্ম অনুধাবন করা, আচরণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। যাদের নিকট অসাধারণ জ্ঞান থাকে কেবল তারাই এ’ধর্ম আচরণ, অনুধাবন করতে সমর্থ হন। যেমন, কোন পা বিহীন ব্যক্তির পক্ষে কি দৌঁড়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব হয়? হয় না। তবে পা বিদ্যমান থাকলে তার পক্ষে দৌঁড়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নির্দ্বিধায়। ঠিক তেমনি সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা বৌদ্ধধর্ম অনুধাবন, আচরণ করা যায় না। অসাধারণ জ্ঞানের দ্বারাই বৌদ্ধধর্ম অনুধাবন, আচরণ করতে হয়। আচ্ছা, বর্তমান বৌদ্ধ উপাসক যথা—চাকমা, মারমা, বড়ুয়া এমনকি ভিক্ষুদের মাঝেও অসাধারণ জ্ঞানী আছে কি? নেই। বর্তমানে সবাই সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী মাত্র। কাজেই এদের দ্বারা কিভাবে বৌদ্ধধর্ম অনুধাবন, আচরণ করা সম্ভব হবে আমি ভেবে পাচ্ছি না। সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা বৌদ্ধধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা তো যাবে না। বুদ্ধ বলেছেন—

বিদর্শন ধ্যান বলে লও প্রজ্ঞা জ্ঞান,

সাধারণ জ্ঞানে কিছু হবে না প্রমাণ।

সুখ-দুঃখ অনুভূতি জাগে অবিরাম,

সুখ শুধু স্বপ্ন তাই, দুঃখ পরিণাম।

কিসের জন্য বিদর্শন ভাবনা অনুশীলন করা? জ্ঞান উদয় হওত পঞ্চস্কন্ধকে পরিত্যাগ করার জন্য। কারণ পঞ্চস্কন্ধের মধ্যে কিছুমাত্র সত্য, সার, নিত্য এবং কোন সত্ত্ব বা ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। মার্গ নেই, ফল নেই, নির্বাণ নেই। পঞ্চস্কন্ধকে দুইভাগে দর্শন করা হয়। যারা মার্গফল লাভী তারা পঞ্চস্কন্ধকে অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা ও অশুচিরূপেই দর্শন করে। তাই তারা পঞ্চস্কন্ধে জীব, পুদ্গল, স্ত্রী, পুরুষ, আমি, তুমি সে ইত্যাদি বলে জীব সংজ্ঞায় ধারণা করে না। যারা পৃথগ্‌জন অর্থাৎ মার্গফল লাভী নন তারা পঞ্চস্কন্ধকে নিত্য, সুখ, আত্মা ও শুচিরূপেই দর্শন করে। তজ্জন্য তারা পঞ্চস্কন্ধে জীব, পুদ্গল, স্ত্রী, পুরুষ, আমি, তুমি, সে সব বলে জীব সংজ্ঞা ধারণা করে। আর তাতে আসক্ত হয়ে থাকে। পৃথকজন আবার দুইভাগে বিভক্ত, যথা—(১) কল্যাণ পৃথগ্‌জন ও (২) অন্ধ পৃথগ্‌জন। যারা সর্বদা দান, শীল, ভাবনায় নিজেদেরকে ব্যাপৃত রাখে তারা কল্যাণ পৃথগ্‌জন। যারা সংসার মোহে আচ্ছন্ন তাদেরকে অন্ধ পৃথগ্‌জন বলা হয়। অন্ধ পৃথগ্‌জনেরা কিছুতেই পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে চায় না।

পূজ্য বনভান্তে বলেন—(শাস্ত্রে দেখা যায়) বুদ্ধের সময় দশসন্তানের জননী এক গৃহবধু অরহত্ব লাভের পর সবিস্ময়ে চিন্তা করে-“কী আশ্চর্য! আমি দশ  সন্তানের জননী হয়েও কি করে অরহত্ব লাভ করলাম। সত্যিই আশ্চর্য, অদ্ভুত বটে!” আচ্ছা, সেই দশ সন্তানের জননী কিভাবে অরহত্ব লাভ করেছিল জান? সে তার সন্তানসমূহ মিথ্যারূপে দর্শন করেছে এবং আমিত্ব ধারণা ত্যাগ করেছে, সর্বোপরি অনিত্য দুঃখ অনাত্ম জ্ঞানে সন্তান সন্ততি ত্যাগ করেছে বিধায়। এক কথায় আমি বা আমার বলতে কিছুই নেই এজ্ঞান বর্ধিত করায় সে অরহত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল। তোমাদেরকেও নির্বাণ লাভের জন্য আমি, আমার, আমিত্ব ত্যাগ করতঃ অবিদ্যা নেই, তৃষ্ণা নেই, উপাদান নেই, ক্লেশ নেই ভাবে অবস্থান করতে হবে। অরহত্ব কিরূপে হয় জান? অবিদ্যা নেই, তৃষ্ণা নেই, উপাদান স্কন্ধ নেই, ক্লেশ নেই ভাবে থাকলে। যার চিত্তের মধ্যে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান, ক্লেশ নেই সেই অরহত বা নির্বাণলাভী। তোমরা সকলে এরূপ বল “আমরা অবিদ্যা মুক্ত, তৃষ্ণা মুক্ত, উপাদান মুক্ত, ক্লেশ নিবৃত্তি করে অরহত্ব লাভ করবো। বর্তমানে যেই অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান, ক্লেশ দ্বারা আমরা দুঃখ পাচ্ছি সেই অবিদ্যা, তৃষ্ণাদি প্রহীন করতঃ নির্বাণ পরম সুখে থাকবো।” বৌদ্ধধর্মের চরম ও পরম সুখ নির্বাণ হল অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ও ক্লেশের চির নিবৃত্তি অবস্থা। তাই অন্যান্য ধর্মের মধ্যে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান, ক্লেশ থাকলেও বৌদ্ধধর্মে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান, ক্লেশ নেই। বৌদ্ধধর্ম অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান, ক্লেশ থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত একটি ধর্ম। তাই চিত্তের মধ্যে অবিদ্যা, তৃষ্ণাদি বিদ্যমান থাকলে বৌদ্ধধর্ম হৃদয়ঙ্গম করা দূরে থাক, আচরণ করতেও সমর্থ হবে না।

বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা স্বর্গ ব্রহ্মা লাভের শিক্ষা নয়। ভগবান বুদ্ধ সর্ব দুঃখ হতে মুক্ত নির্বাণ লাভের শিক্ষা দিয়েছেন। তজ্জন্য বলা হয়েছে, কি পন্থা অবলম্বন করলে মানুষ যাবতীয় দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করতে পারে, সেই সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করার জন্য বুদ্ধ গৃহত্যাগে কৃত সংকল্প হন। রাজারপুত্র রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়েও জগতের মঙ্গলার্থে জ্ঞানের সন্ধানে বহির্গত হলেন। আবার বুদ্ধ চিন্তা করেছিলেন যে, পৃথিবীর কোন কার্যই কঠোর সাধনা ব্যতীত সম্পন্ন হয় না। সেই সাধনার মাধ্যমে বুদ্ধ সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভ করেন। এভাবে নিজে সর্ব দুঃখ হতে মুক্ত হয়ে এখন লোকের মুক্তির জন্য ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন। তোমাদেরকেও বীর বিক্রমের সহিত একের পর এক বাধা অতিক্রম করে নির্বাণ লাভ করতে হবে। নির্বাণ লাভের পথে যেই রকম বাধা-বিপত্তি উপস্থিত হোক না কেন সেই সব বিপত্তিকে টপ্‌কিয়ে যেতে হবে। কিছুতেই পিছু হটে আসতে পারবে না। মারের সৃষ্ট শত সহস্র প্রলোভন, লোমহষকর হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদর্শনেও অদম্য বীর্যের সাথে আপন অভিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। আচ্ছা, মারের প্রলোভনে, হুমকিতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তোমরা কি প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে সোজা গৃহী হয়ে যাবে? সে রকম হীন বীর্য হলে তো নির্বাণ লাভ করা যাবে না। মনে রাখবে একবার যখন প্রব্রজিত হয়েছ জীবন ধ্বংস হয়ে গেলেও প্রব্রজ্যা ত্যাগ করবে না। যেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রব্রজিত হয়েছ মাঝপথে এসে সেই লক্ষ্য বিসর্জন দিবে না। “যে বাক্কুয়া ধচ্চ্যা সিবে ধুঝগৈ; আদ্দান্যা ন-গচ্যা”। অর্থাৎ যেই কাজটি শুরু করেছ সেটা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত করে যাও, অর্ধেক বা কিছু অংশ করার পর ইস্তফা দিবে না। তাই বলা হয়েছে—

এগিয়ে চল, এগিয়ে চল

এগিয়ে চল বীর।

ক্লেশ, কাঁটায় ফুটবে না গো

সোজা পথে চলো ধীর।

এসব শুনলে তোমাদের কি বীর্য উৎপন্ন হয় না? আমার তো শতগুণে বীর্য বৃদ্ধি পায়। জঙ্গলে অবস্থান করার সময় এগুলো আমি প্রায়ই আবৃত্তি করতাম। আর প্রবল উৎসাহ সৃষ্টি করতাম মনের মধ্যে। সেই উৎসাহ উদ্দীপনার দ্বারা আমি কখনো ভেঙ্গে পড়িনি নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলেও। তোমাদেরকে সর্বদা আত্মোৎকর্ষ সাধনে তৎপর থাকতে হবে। সেই আত্মোৎকর্ষ কি? আপন উন্নতি, আপন শ্রেষ্ঠত্ব, স্বকীয় উৎকৃষ্টতা। ‘কিরূপে আমি নিজকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব, নিজকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করব এবং নিজকে উৎকৃষ্টরূপে প্রতিষ্ঠা করব’ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাসমূহ তোমাদেরকে সব সময় মনে জাগরুক রাখতে হবে। মনের মধ্যে যাদের নিকট আপন উন্নতি, আপন শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বীয় উৎকৃষ্টতা সাধনের চেষ্টা থাকে তারা কিছুতেই পাপকর্ম সম্পাদন করতে পারে না।

তিনি আরো বলেন—তোমরা পরধর্ম, পরকর্ম সম্পাদন করবে না, নিজধর্ম (সদ্ধর্ম) এবং নিজ (আপন) কর্ম সম্পাদন কর। যদি দুঃশীলতা আচরণ কর তাহলে সেটা পরধর্ম পরকর্ম করতেছ বলে জানবে। ভগবান বুদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘ ও উপাসক-উপাসিকাদের সামগ্রিক জীবন-যাপন এবং আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেই বিনয় বা শীল প্রজ্ঞপ্তি করেছেন আসলে তা কি জান? পরধর্ম পরকর্ম সম্পাদন করতে বারণ করেছেন মাত্র। তজ্জন্য বলা হয়েছে—

বুদ্ধের আপন কাজে শীল রত্ন যত,

কর্মগুণে লও কিনে, পরিধান কর অবিরত।

সদ্ধর্ম আচরণ ও আপনকর্ম সম্পাদন করতেই শীলের প্রয়োজনীয়তা। শীল বা বিনয় শব্দের অর্থ হল দুর্নীতি বিরোধ আদেশ, অপরাধ করলে প্রায়শ্চিত্তের বিধান। তোমরা দুর্নীতি আচরণ না করে, সুনীতি আচরণ কর। নিজকে সবসময় দুর্নীতি হতে পৃথক রেখে সুনীতি আচরণ করাই হল তোমাদের আসল কাজ। আচ্ছা, অপরাধ করলে কিভাবে প্রায়শ্চিত্তের ভোগ করা যায়? কে অপরাধ করে জান? চিত্ত চৈতসিক ও রূপের দ্বারাই অপরাধ সংঘটিত হয়। এই অপরাধ বা পাপ সর্বমোট দেড় সহস্র। যথা চিত্ত ১ + চৈতসিক ৫২ + নিষ্পন্নরূপ ১৮ + লক্ষণরূপ ৪ = ৭৫ এইগুলোকে দশক্লেশ দ্বারা গুণণ করলে ৭৫দ্ধ১০ = ৭৫০। আধ্যত্মিক ও বাহ্যিক ২ কলুষ দ্বারা গুণন করলে ৭৫০দ্ধ২ = ১৫০০। এইরূপে পাপ সর্বমোট দেড় সহস্র। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সমস্ত অপরাধের মূলে রয়েছে চিত্ত, চৈতসিক। প্রায়শ্চিত্ত করার অর্থ চিত্তকে অপরাধ হতে ফিরে আনা। চিত্তে চৈতসিক, রূপ এগুলো হল অনিত্যধর্ম, দুঃখপূর্ণ ধর্ম। আর নির্বাণ হল অনাত্ম ধর্ম, অনাত্ম ধর্মের দ্বারা নির্বাণ লাভ হয়। তোমরা অনিত্য ধর্ম করবে না, দুঃখপূর্ণ ধর্ম করবে না। অনিত্যধর্ম, দুঃখপূর্ণ ধর্ম করলে পাপ উৎপন্ন হয়। চিত্ত, চৈতসিক, রূপের মধ্যে না থাকলে নির্বাণ লাভ হয়। তখন কোন প্রকার পাপ উৎপন্ন হবার অবকাশ নেই, যাবতীয় পাপ হতে চির বিমুক্তি।

তোমরা বাজে কথা বলে বাজে গল্প দিয়ে সময় কাটাবে না। বুদ্ধ বলেছেন—হে ভিক্ষুগণ! তোমরা একে অপরে সাক্ষাৎ হলে ধর্মালাপই করবে। তা না হলে মৌনভাব অবলম্বন করে থাকবে। বুদ্ধ আরো বলেছেন, সমস্ত দিন আলাপে সালাপে কাটায়ে, সারারাত্রি নিদ্রা গিয়ে অজ্ঞানী ব্যক্তি ক’বে সংসার হতে মুক্ত হবে? তাই তোমরা বল-“আমরা সারাদিন আলাপে সালাপে সময় নষ্ট করব না এবং সারারাত্রি নিদ্রা যাব না।” আমি তো তোমাদেরকে মাঝে মাঝে খুব বেশি কথা বলতে শুনি। তোমাদের কি এখনো নিরবতা পালন শিক্ষা বর্ধিত, বহুলীকৃত হয়নি। বেশি কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করবে। যদি কথা বলতে হয় তাহলে দশ প্রকার আর্যসম্মত আলাপই করবে। যথাঃ-(১) শীল কথা-শীল সম্বন্ধীয় আলাপ করা (২) সমাধি কথা-সমাধি সম্বন্ধীয় আলাপ করা (৩) প্রজ্ঞা কথা-প্রজ্ঞা উৎপাদনমূলক আলাপ করা (৪) বিমুক্তি কথা-অরহত্ব ও নির্বাণ বিষয়ক আলাপ করা (৫) বিমুক্তি জ্ঞানদর্শন কথা-অর্জিত জ্ঞানের পর্যবেক্ষণ আলাপ করা (৬) অল্পেচ্ছা কথা-তৃষ্ণাবহুল না হওয়ার জন্য পরস্পরের সহিত আলাপ করা (৭) সন্তুষ্টি কথা-ধর্মত লব্ধ বিষয়ে সন্তুষ্ট থাকার জন্য আলাপ করা (৮) প্রবিবেক কথা-প্রবিবেক তিন প্রকার (ক) নির্জন বাস বিষয়ক কায় বিবেক (খ) কাম চিন্তা ত্যাগে ধ্যান চিত্তোৎপাদক চিত্ত বিবেক (গ) পঞ্চস্কন্ধে আমিত্ব ত্যাগে উপধি বিবেক। এই তিন প্রকার বিবেক বিষয়ে আলাপ করা (৯) অসংসর্গ কথা-স্ত্রী সংসর্গ ত্যাগে সুখ এই সম্বন্ধে (বা প্রকারে) আলাপ করা (১০) বীর্যারম্ভ কথা-কিভাবে বীর্যোপাদন করা যায় সেই সম্বন্ধে আলাপ করা। ভগবান প্রব্রজিতগণকে এই দশ প্রকার আর্যসম্মত আলাপ করে একে অপরকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা দান করতে বলেছেন। যাতে করে প্রব্রজিত জীবন চিরস্থায়ী শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হয়ে থাকে। শীল কি? কায়িক, বাচনিক, মানসিক সংযমই শীল। ব্যতিক্রম ক্লেশসমূহ ধ্বংস করতেই শীল। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যতিক্রম ক্লেশসমূহ ধ্বংস হয়ে না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত শীল পালন করতে হবে। প্রাণীহত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যা, কটু, ভেদ, বৃথা বাক্য ও মিথ্যাজীবিকা এই আটটি ব্যতিক্রম ক্লেশ। গৃহীদের ক্ষেত্রে মৎস্য, মাংস, অস্ত্র, সুরা, বিষ এই পঞ্চ নিষিদ্ধ বাণিজ্যই মিথ্যাজীবিকা। ভিক্ষুসঙ্ঘের ক্ষেত্রে লপন, কুহন, নিমিত্ত, নিষ্পেষণ এই চতুর্বিধ কর্মই মিথ্যাজীবিকা নামে অভিহিত। লপন কর্ম কিরূপ? ভালো, উত্তম প্রত্যয় লাভের আশায় গৃহীর মনোরঞ্জনার্থে তাদেরকেও প্রতিদান দেওয়া। কুহন কর্ম কিরূপ? অত্যাধিক লাভ-সৎকার, যশকীর্তি, সুনাম লাভের জন্য গৃহীর মন আকষণার্থে আমি খুব শীলবান সমাধি লাভী বলে প্রচার করা তথা নিজের নিকট অবিদ্যমান গুণসকল বিদ্যমান আছে বলে প্রকাশ করতঃ অন্যদের সহিত প্রতারণা করাই কুহন কর্ম। নিমিত্ত কর্ম কিরূপ? অলজ্জী অবস্থায় দর্শন করে থাকা, অর্থাৎ কোন একজন দায়ককে খাদ্য নিয়ে যেতে দেখে নিজে কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্য কিহে, উপাসক খাদ্য আনতেছ, বেশ ভালো খাদ্যই তো পেয়েছ বলে দর্শন করে থাকাকে নিমিত্ত কর্ম বলে। নিষ্পেষণ কর্ম কিরূপ? নিষ্পেষণ অর্থ পরের গুণ মেঁছে ফেলা দেওয়া। সে কি আর শীলবান, প্রজ্ঞাবান, নির্বাণলাভী এভাবে পরের শীলগুণ, ধুতাঙ্গগুণ. মার্গফলগুণ, নির্বাণগুণ মুঁছে ফেলে দিয়ে নিজে লাভবান হওয়ার উপায় অবলম্বনকে নিষ্পেষণ কর্ম বলা হয়। বুদ্ধ কর্তৃক ঘৃণিত এই কর্মদ্বারা জীবন-যাপন করাই (ভিক্ষুদের জন্য) মিথ্যাজীবিকা। এই আটটি ব্যতিক্রম ক্লেশ সমূলে ধ্বংস হলে শীল শিক্ষা সমাপ্ত হবে। তারপর সমাধি শিক্ষা শুরু করবে। সমাধি শিক্ষা কতদিন করতে হবে? যতদিন পর্যন্ত পর্যটন ক্লেশ ধ্বংস না হয় ততদিন পর্যন্ত সমাধি শিক্ষা করে যেতে হবে। সেই পর্যটন ক্লেশসমূহ কি? পঞ্চনীবরণ, যথা—কামচ্ছন্দ, ব্যাপাদ, সত্ম্যানমিদ্ধ, ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য, বিচিকিৎসা। সমাধি শিক্ষা দ্বারা পঞ্চনীবরণ ধ্বংস হয়ে গেলে সমাধি শিক্ষা সমাপ্ত হবে। তখন আর সমাধি শিক্ষার প্রয়োজন থাকবে না। সমাধি শিক্ষা সমাপ্ত হলে প্রজ্ঞা শিক্ষা করতে হবে। প্রজ্ঞা শিক্ষা কতদিন পর্যন্ত করে যেতে হবে? যতদিন পর্যন্ত অনুশয় ক্লেশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয় ততদিন পর্যন্ত প্রজ্ঞা শিক্ষা করে যেতেই হবে। দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ যত বৎসর এমনকি জীবন প্রদীপ নিভে যাবার পূর্ব পর্যন্তও যদি অনুশয় ক্লেশ ধ্বংস হয়ে না যায় ততদিন পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রজ্ঞা শিক্ষা করতে হবে। আবার যদি এক, দুই, পনের দিনে অনুশয় ক্লেশ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে পনের দিনে প্রজ্ঞা শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে যাবে। অনুশয় ক্লেশ কি? সপ্ত অনুশয়, যথা—(১) কামারাগানুশয় (২) ভবরাগানুশয় (৩) প্রতিঘানুশয় (৪) মানানুশয় (৫) দৃষ্টি অনুশয় (৬) বিচিকিৎসানুশয় ও (৭) অবিদ্যানুশয়। শীল শিক্ষা দ্বারা ব্যতিক্রম ক্লেশ, সমাধি শিক্ষা দ্বারা পর্যটন ক্লেশ, প্রজ্ঞা শিক্ষা দ্বারা অনুশয় ক্লেশ ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে গেলে দুঃখমুক্তি নির্বাণ হয়। তোমরা অতিসত্বর শীল শিক্ষা, সমাধি শিক্ষা ও প্রজ্ঞা শিক্ষা পর্যায়ক্রমে সমাপ্ত করতঃ নির্বাণ পরম সুখ লাভে তৎপর থাক।

পরিশেষে বনভান্তে বলেন—চারি আর্যসত্য ও প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতিকে যথাযথভাবে জানতে, বুঝতে না পারলে বৌদ্ধধর্ম আচরণ কঠিন হয়ে পড়ে। যারা এই চারি আর্যসত্যকে এবং প্রতীত্য সমুৎপাদনীতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বুঝতে, জানতে অক্ষম তাদের দ্বারা বৌদ্ধধর্ম দুর্জ্ঞেয়। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে চারি আর্যসত্য, প্রতীত্য সমুৎপাদনীতির কথা নেই বলে তারা পুনর্জন্মের বিশ্বাসী নয়। ফলে নানাবিধ দুষ্কর্ম সম্পাদনে তাদের জন্য সহজ কাজ বৈকি! প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতির কথা নেই বলে তারা পুনর্জন্মকে দেখতে পায় না। যাকে দেখা যায় না তাকে অবিদ্যমান ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি জ্ঞানের দ্বারা পুনর্জন্মকে দৃষ্টিগোচর হয়। সুতরাং পুনর্জন্মের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়। সতিপট্‌ঠান সূত্রে পুনর্জন্মকে এভাবে প্রকাশিত করা হয়েছে “যা যং তণ্‌হা পোনোভাবিকা নন্দিরাগ সহগত তত্র তত্রা ভিনন্দিনী”। অর্থাৎ যে তৃষ্ণা পুনর্জন্মের কারণ, যার সহিত আনন্দ ও আসক্তি থাকে, যা যেখানে সেখানে পুনর্জন্ম হবার অভিলাষ করে। যথা—কামতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা, বিভবতৃষ্ণা। কামতৃষ্ণা হল স্বামী-স্ত্রীরূপে সংসারে সুখভোগের ইচ্ছা বা পঞ্চকামগুণ সুখে প্রমত্ত হওত প্রমত্তার মধ্যে সুখ লাভের ইচ্ছা। ভব তৃষ্ণা-ভব ভবান্তরে সুখ ভোগের বাসনা। কামভব, রূপভব, অরূপভব এই ত্রিভবের মধ্যে নানা যোনিতে পুনঃপুন জন্ম হয়ে সুখ ভোগ করার ইচ্ছা। বিভবতৃষ্ণা-উচ্ছেদ ধ্বংস জনিত বীততৃষ্ণা ইত্যাদির মাধ্যমে সুখ ভোগ করে যাওয়ার ইচ্ছা। চাকমা সমাজে একটা কথা আছে “দিলুং ভাতজড়া গঙারে মলে মরিবোং সমারে” এটাও বিভবতৃষ্ণা বলে জানবে।

তোমরা যদি দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করতে চাও, নির্বাণ সুখ প্রত্যক্ষ করতে চাও তাহলে বুদ্ধের শিক্ষা, উপদেশ গ্রহণ কর। বুদ্ধগুরু ব্যতীত অন্য কোন গুরুর আশ্রয়, শিক্ষা, উপদেশ গ্রহণ করবে না। বুদ্ধ গুরু ব্যতিরেকে কোন গুরুর পক্ষে দুঃখমুক্তি নির্বাণ মার্গ প্রদর্শন করার সামর্থ্য নেই। বুদ্ধের শিক্ষা ছাড়া অন্য কারোর শিক্ষায় নির্বাণ লাভ করা যায় না। তজ্জন্য নির্বাণ লাভেচ্ছুকগণকে এরূপ কৃতসংকল্প হতে হবে যে, “আমি একমাত্র বুদ্ধের উপদেশেই নির্বাণ লাভ করব, অন্য কারোর শিক্ষায় বা উপদেশে নয়।” তোমরাও সেরূপ কৃতসংকল্প হয়ে নির্বাণ লাভী হও। বুদ্ধের শিক্ষা বাদ দিয়ে অন্য গুরুর শিক্ষা গ্রহণে নির্বাণ-বিমুক্তি সম্ভব নহে কি? চিত্তকে সেরূপে সংশয়াচ্ছন্ন করা হলে নির্বাণ লাভ হবে না। বুদ্ধের উপদেশ ও শিক্ষা ভিন্ন কিছুতেই নির্বাণ লাভ হয় না। এইরূপ জ্ঞান সম্প্রযুক্ত চিত্তের অধিকারী হয়ে তোমরা নির্বাণ লাভে তৎপর থাক।

সাধু, সাধু, সাধু

# লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে http://rajbanavihara.org/archives/1098#.W98kqZMzbIU  এই ওয়েবসাইট থেকে ।

error: Content is protected !!