১লা এপ্রিল ১৯৯৪ ইংরেজী রোজ শুক্রবার। ট্রাইবেল অফিসার্স কলোনী, রাঙ্গামাটি। সার্বজনীন সংঘদান ও অষ্ট পরিষ্কার দান উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সশিষ্যে শুভ আগমন। বৌদ্ধ ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করেন বাবু বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা। উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন বাবু রনজিত দেওয়ান। পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন বাবু প্রগতি রঞ্জন খীসা। অনুষ্ঠানের আহবায়ক বাবু যামিনী কুমার চাকমা ও পরিচালনা করেন শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার ভিক্ষু।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে সকাল ১০টা ২০ মিনিট হতে ১০টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ধর্মদেশনা প্রদান করেন। তিনি প্রথমেই বলেন- শ্রদ্ধার সহিত ধর্ম কথা বা ধর্ম দেশনা শ্রবণ, গ্রহণ, ধারণ ও আচরণ করতে হয়। তাতে শ্রোতার অনেক ফল লাভ হয়। শ্রদ্ধা দু’প্রকার। লৌকিক ও লোকোত্তর। ত্রিরত্ন, কর্ম ও কর্মফলকে বিশ্বাস করলে লৌকিক শ্রদ্ধা হয়। ইহকাল-পরকাল ও চারি আর্যসত্যকে বিশ্বাস করলে লোকোত্তর শ্রদ্ধা হয়। অশ্রদ্ধার সহিত ধর্মদেশনা শ্রবণ করলে কোন ফল হয় না।
মনুষ্য ধর্ম পাপ মুক্ত নয় ও দুঃখ। প্রথম সত্য ও দ্বিতীয় সত্য লৌকিক। অর্থাৎ নানাবিধ দুঃখ ও দুঃখের কারণ লৌকিক নামে অভিহিত। এ দু’সত্যে মানুষ সহজে মুক্তি পায় না। তৃতীয় ও চতুর্থ সত্য লোকোত্তর। অর্থাৎ নিরোধ সত্য ও মার্গ সত্য বা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে মানুষ মুক্তি পায়। নির্বাণের পথকে মার্গ সত্য বলে। আবার নির্বাণ সত্যকে কুশলও বলা হয়।
এ কুশল কর্মস্থান বা শমথ-বিদর্শন ভাবনাও বলা হয়। ভাবনা হলো মনের কাজ। ভাবনা ছাড়া বুদ্ধ জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। অলোভ, অদ্বেষ ও অমোহ ব্যক্তি ভাবনা করতে পারে। এগুলিকে ত্রিহেতুক পুদগল বলে। তারা সহজে মুক্তির পথে চলতে পারে বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।
কেউ কেউ দান করে ইহজীবনে সুখভোগ করার জন্যে এবং পরজীবনেও সুখ ভোগ করার জন্যে। কিন্তু নির্বাণ অধিগত করার জন্যে দান করা অতি উত্তম। যেমন দান এভাবে করতে হয়- এ দানের ফলে আমার নির্বাণ লাভের হেতু উৎপন্ন হোক।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ একত্রিশ লোকভূমির মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী।
তাঁর প্রচারিত ধর্মই জ্ঞানের ধর্ম। তাও অসংখ্য বৎসর পর আবির্ভূত হন। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্য সম্পত্তি, দেব সম্পত্তি ও নির্বাণ সম্পত্তি উৎপত্তি হয়। কিন্তু বর্তমানে কিছু সংখ্যক লোকের ধারণা ভগবান বুদ্ধ অজ্ঞানী ও গরীব। তাদের অবিশ্বাসের ফলে তারা বুদ্ধের নির্বাণ পথ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে। যেমন কোন কোন ভিক্ষু গড়ে তোলতেছে। কেউ কেউ সামাজিক কর্মে নিজকে সারাক্ষণ নিয়োজিত রাখছে। আর কেউ কেউ নানাবিধ কর্মের অধীনে থাকে। অর্থের ও প্রতিপত্তির মোহে নিজেও মুক্ত হতে পারছে না এবং অপরকেও মুক্ত করতে পারছে না।
অন্যদিকে সত্যের আশ্রম হলো শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা। সত্যের আশ্রমে অকুশল ধর্মগুলি ত্যাগ করা যায় এবং উচ্চতর জ্ঞান লাভ হয়। কুশলে পূণ্য উৎপত্তি হয়, পাপ ক্ষয় হয়, দুঃখ সমূলে ধ্বংস হয় এবং ইহকাল-পরকালে পরম সুখ লাভ হয়। কর্মের অধীনে থাকা মহা দুঃখজনক। নির্বাণের অধীনে মহাসুখ।
দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- এম. এ পাশ করে নরকে পড়লে সে লেখাপড়ার কোন মূল্যই নেই। যে যতটুকু লেখাপড়া করুক না কেন তার পাপে লজ্জা থাকতে হবে। ভয় থাকতে হবে। পাপের প্রতি ঘৃনা থাকতে হবে। তবেই এম. এ পাশের মূল্য থাকে। শুধু বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করে পাপে নিমগ্ন থাকলে সেই ডিগ্রীর কোন মূল্য থাকে না। অপ্রমাদ বা সাবধানে থাকলে পাপ নেই ও মার নেই। নিজকে নিজে সর্বদা সাবধানে থাকলে পরম সুখ উৎপত্তি হয় এবং অপরকেও সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিতে পারে।
শ্রদ্ধেয় বনভান্তে বলেন- অন্ধকে যে কোন জিনিস দেখানো যেমন বৃথা ঠিক তেমনি মূর্খকেও চারি আর্যসত্য ও উচ্চতর জ্ঞান সম্বন্ধে বুঝানো তেমন বৃথা। মূর্খেরা নানাবিধ দোষ করে ও অবাধ্য থাকে। সব সময় অজ্ঞানে অজ্ঞানে সংঘর্ষ বাঁধে। দুঃশীল, অধর্ম পরায়ন ব্যক্তি বৌদ্ধ ধর্মের নষ্টের কারণ।
তিনি উপসংহারে বলেন- তোমরা মিথ্যার আশ্রয়ে যেয়ো না। সত্যের আশ্রয়ে যাও। সত্য তোমাদের রক্ষা করবে এবং পরম সুখ প্রদান করবে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি মুহূর্তে, কথায়, কাজে ও চিন্তায়, অন্যায়, অপরাধ, ভুল, ত্রুটি, দোষ ও গলদ করো না। অচিরেই তোমাদের পরম সুখ বয়ে আসবে। এ বলে আমার দেশনা আপাততঃ এখানেই শেষ করলাম।
সাধু – সাধু – সাধু।