যেই গ্রামে বিহার যত
সেই গ্রামে বিভাজন তত।
যেই সমাজে নেতা যত,
সেই সমাজটি তত ক্ষত।
যাহা ঐক্য নাশে অবিরত।
প্রতিবন্ধক শত শত।
বর্তমানে বড়ুয়া সমাজে যে বিষয়টি বার বার পরিলক্ষিত হয় তা হল বিহার কমিটি, ভিক্ষু-গৃহীদের নেতৃত্বের বারাবারি। বিহার কমিটি আর দায়ক ভিক্ষু নিয়ে বর্তমানে প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম দু-তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে । আগে প্রতিটি গ্রামে পূর্বপুরুষদের স্থাপিত বিহারগুলো ছিল সার্বজনীন। সেখানে ব্যাপক উৎসাহ আর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে গ্রামের সকলের উপস্থিতিতে সকল অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হতো । কিন্তু সার্থান্বেষী নাম স্বর্বস ভিক্ষু ও গৃহীবাবুদের কবলে ক্রমেই সেই পূর্বপুরুষের ঐক্যতায় স্থাপিত বিহারগুলোতে চরম মতানৈক্য দেখা দেয় ও ভিন্ন একটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। বংশ গৌরব আর মাতব্বরি ফলানোয় ব্যাঘাত ঘটায়, একে অন্যকে মেনে নিতে পারে না। ফলে তাদের পক্ষ-বিপক্ষের রোষে উভয় সংকটের মুখে পরতে হয় ভিক্ষুকে। একপক্ষ আলাদা মন্দির স্থাপন করে, সেখানে তাদেরকেও সগৌরবে সমর্থন করতে অন্য ভিক্ষুরাও উঠে পরে লাগে। উভয় পক্ষের সমস্যার সমাধানের দিকে না গিয়ে আয়োজন করেন নানা অনুষ্ঠানাদি, অন্যপক্ষও তারই জবাবে চালিয়ে যান নানা অনুষ্ঠান, তাও আবার একই দিনে। এভাবেই আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান আর কীর্ত্তন চলতে থাকে দুইভাগে। কার আয়োজন কত ভালো হয়, কে কত সফলতার সাথে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলো, এমন অভ্যন্তরীণ তর্ক বিতর্কও চলে। মোটকথা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো দুইপক্ষের শক্তি সামর্থ্য আর হিংসা প্রদর্শনের এক অভিন্ন মাধ্যম হয়ে ওঠে।
এভাবেই ধর্মের নামে গ্রামবাসী দিনের পর দিন একে অপরের শত্রু হয়ে যায়। সামাজিকভাবেও তারা একে অপরকে বয়কট করতে শুরু করেন। এক পক্ষের কেউ অন্যপক্ষের কারো বাড়িতে বিয়ে, শ্রাদ্ধ বা যে কোন সামাজিক বা ধর্মীয় অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান ত্যাগ করতে থাকেন। একপক্ষের লোকজন অন্যপক্ষকে তাদের এলাকার রাস্তা ব্যবহার করতে দেবেন না, অন্যপক্ষের লোকজনের দেয়া দোকান থেকে কোন পন্য কিনবেন না, এমনি করে দুই পক্ষ সম্পূর্ণরুপে একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠেন।মাঝেমাঝে দুইপক্ষে ছোট-খাটো মারামারি হাতাহাতিও চলে, যা থানা কোর্টকাচারি অবদি গড়ায়। কয়েক দফায় মীমাংসা শালিশ হলেও, কে কার কথা শোনে!!!
ধর্ম অবশেষে আমাদের কি দিল? একজনও ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে বিহারে যান না। নীতি নৈতিকতার কোন চর্চা নেই। বাড়লো হিংসা বিভেদ আর হানাহানি। ধর্ম সমাজকে ভিন্ন করলো, নতুন জেনারেশনের মাঝে একটা আকাশ সমান দেয়াল তৈরী করে দিল, আর শত্রুতার বিষে ভাই বন্ধু হয়ে গেল শত্রু। বড়ুয়াদের অনৈক্যতার সূচনা হয় মূলত এখান থেকে। একারনে বড়ুয়ারা কোনো দিন ঐক্য থাকতে পারবে না। ঐক্য না থাকার কারণে যারা জ্ঞানী গুণী নিবেদিত প্রাণ এদের সম্মান ও মান্যতা কালে কালে উপেক্ষিত হয়েছে, হচ্ছে, এবং আগামীতেও হইবে। এমনকি জাতিয় পর্যায়েও স্বঅধিকার আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে। কিছু অদূরদর্শী গতানুগতিক ভিক্ষু ও গৃহীরাই এরজন্য দায়ী। এদের হাতেই সূচনা হয় পক্ষ বিপক্ষ
সমর্থন করা। এর মধ্যেই কিছু কিছু ভিক্ষুরাও এমন একটি পক্ষ বিপক্ষের কোন্দলে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগকে ভিক্ষুজীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন মনে করেন। তাই তারাও বুদ্ধাদর্শ ভুলেগিয়ে বাবুদের অধীনে অনুষ্ঠানাদিতে যোগাদান সহ দায়কদের ফাং গ্রহন-বর্জনে একচোখা হয়ে পরেন। আজ সংঘরাজ নিকায়ের কোন ভিক্ষু যদি সমাজ ও জাতীয় কল্যানে এগিয়ে আসে মাথের নিকায়ের পক্ষের ভিক্ষুরা বলবে ভিন্ন কথা, আবার অন্য দিকে মাথের নিকায়ের কোন ভিক্ষু যদি সমাজ ও জাতির কল্যানে ব্রতী হন সংঘরাজ নিকায়ের ভিক্ষুরা বলবে ভিন্ন কথা। এছাড়া উচিহ্লাবাদী, শীলানন্দবাদী, দিপাংকরবাদী, শরনংকরবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি, এক দল এক দলকে ভিন্ন চোখে দেখে। এদের সবাই সূচি পবিত্র পরিশুদ্ধ বলে নিজ নিজ ভক্তরা শ্লোগান তুলে। আর দায়ক ভক্তরা পূর্বাপর চিন্তা না করে অর্থবলে বিহারের পর বিহার, সংঘটনের পর সংঘটন প্রতিষ্ঠা করে।
সবার দাবী তাদের নিজ নিজ মান্যতাই শ্রেষ্ঠ। তারই সূত্র ধরে একগ্রামে পূর্বে অনেক গুলো বিহার থাকার পরও আবার নতুন বিহার হচ্ছে। কেউ যদি মনে করেন বিহার নির্মান পুন্যের কাজ বুদ্ধ প্রসংশিত। তবে তাতে আমার দ্বিমত রয়েছে। আপনি যদি এতো ধার্মিক হয়ে থাকেন তাহলে বলব- পুরোনো জীর্ণশীর্ণ পুর্বপুরুষদের স্থাপিত বিহারগুলো সংস্কার করুন আর না হয় যে গ্রামে ধর্মচর্চায় প্রতিকুল, যোগাযোগ বিছিন্ন, বিহার ভিত্তিক ধর্মচর্চা সুলভ্য নয় সেসব গ্রাম ও নগরে বিহার স্থাপন করুন তাতে আমার হাজারো সাধুবাদ। তবে দলাদলি আর নেতৃত্বের অপব্যবহারে পাশপাশি নতুন বিহার নয়। তবে হ্যাঁ, বিশ্বমানের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হলে ভিন্ন কথা। উভয় পক্ষের ভিক্ষুদের উচিত তাদের স্ব স্ব গৌরব অক্ষুণ্ণত রেখে জাতিয় ঐক্যের দূরদর্শী হয়ে কিছু স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া গৃহীনেতৃত্বের কবলে নিজেদেরকে বিলিয়ে না দেওয়া এবং বিহার কমিটির অধীনস্থ পঙ্গুত্বতা বরণ না করা। বিনয় লঙ্গিত সঙ্ঘ সদস্যেকে শাস্তি বা বর্জন করা। সাঙ্ঘিক কল্যাণমুখী কর্মে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখা। প্রতিটি বিহারের প্রভাতী ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ব্যয় সঙ্কোচন করে অসুস্থ ভিক্ষুদের চিকিৎসা, ফাং স্থাপন করা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরিশেষে আমাদের মনে রাখা উচিত- ভিক্ষুরা জাতির চালিকা শক্তি ও উত্তোরণের চাবিকাঠি। অনুরোধ থাকবে- কেউ বিষয়টিকে ব্যক্তিগতভাবে না নেওয়ার।
#লেখাটি Subrata Barua কর্তৃক পোস্ট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ।