প্রবীণের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও নবীনের তেজোদীপ্ত শক্তি : অনন্য পরম্পরা

ঝর্না বড়ুয়া

এক মহাপ্রাণ জীবনের হাত যখন উদীয়মান তেজস্বী দীপ্তমান যুবকের হাতে হাত রাখে তা যে কত দিক থেকে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ হয় -তা সহজে উপলব্ধি করা যাবে না। কত বিনয়, শ্রদ্ধা, সম্মান, গভীর বিশ্বাস ও ভালবাসার জন্ম এই প্রবীণ ও নবীনের মেলবন্ধন এবং আস্থার এক বিশাল ভরসার জায়গাসহ প্রবীণের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও নবীনের তেজোদীপ্ত শক্তির এক যেন মহামিলনের মহাক্ষণ।
মানবজীবনের মানবিক গুণাবলীর মধ্যে নির্মল আচরণ অন্যতম। পরিবার থেকে এই মানবিক গুণাবলী রপ্ত বা অর্জন করে বড়দের শ্রদ্ধা-সম্মান, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ও উদারতা দিয়ে সমাজকে সুন্দর ও ঐক্যবদ্ধ করা যায়। এ মহৎ গুণাবলীতে পরিবারসহ সমাজের সর্বস্তরে সুখ-শান্তি বিরাজ করে। এরূপ সুন্দর মার্জিত আচরনের মধ্য দিয়ে একদিকে নিজেকে পরিশুদ্ধ জীবনের অধিকারী করা যায় অন্যদিকে বড়দের আস্থাভাজন হওয়া যায়। বড়দের ভালবাসা সহজে অর্জন করা যায়। বিনয় মানুষকে সর্বদাই মহান থেকে মহীয়ান করে তোলে। মহামতি গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা থেকে বলা যায় : ‘অসেবনা চ বালানং পন্ডিতানঞ্চ সেবনা / পূজা চ পূজনীয়ানং এতং মঙ্গল মুত্তমং’। ( পালি)। বাংলায় বলা হয়, ‘মূর্খ লোকের সেবা না করা, জ্ঞানী লোকদের সেবা করা ও পূজনীয় ব্যক্তিগণের পূজা করা উত্তম মঙ্গল’।
সভ্যতার শুরু থেকে পরিবার বা সমাজে ছোট-বড় সকলে এক সাথে বসবাস করে আসছে। মাতাপিতা, বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই-বোন, শিক্ষক -শিক্ষিকা ও অভিভাবকরাই সমাজে বড়জন বা গুণীজন। সমাজ সংসারে বয়োজ্যেষ্ঠরা নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। জীবন ও জগৎ সংসারে বড়দের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা ও সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা অনেক বেশী বাস্তবসম্মত সময়োপযোগী প্রাজ্ঞ, গভীর ও সঠিক চিন্তনের বহিঃপ্রকাশ হয় সমাজ বিনির্মাণের সর্বত্র। সেক্ষেত্রে বড়দের আদেশ-উপদেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বিনয়ী হয়ে জীবন চলার পথকে অনুসরণ করলে সে জীবনও হয়ে উঠে মহিমান্বিত, অনুশীলনীয় ও সমাজে দৃষ্টান্তস্বরূপ।
কবিগুরু রবি ঠাকুরের ভাষায়,
‘পাতায় পাতায় আবোল-তাবোল, শাখায় দোলাদুলি,
পান্থ হাওয়ার সঙ্গে ও চায় করতে কোলাকুলি
ওগো প্রবীন, চলো এবার সকল কাজের শেষে
নবীন হাসি মুখে নিয়ে চরম খেলার বেশে’।
বৃদ্ধদের সম্মান করা মানবজীবনের গুণাবলীর অংশ। আমরা সাধারণত বয়স ও সম্পর্কের ভিত্তিতে ছোট-বড় পার্থক্য করে থাকি। বয়সের দিক থেকে কেউ বড় কেউ ছোট। সে বিবেচনায় পরিবার সহ সমাজের বয়োবৃদ্ধরাই সবচেয়ে বড়। তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সম্মান, ভক্তি ও শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য। আবার বড়-ছোট তারতম্য কখনো কখনো শক্তি – সামর্থ্য, জ্ঞান – বিজ্ঞান, পদ – পদবী, প্রভাব – প্রতিপত্তি, মর্যাদা ও ক্ষমতার উপরও নির্ভর করে। যেভাবে ধরা হোক না কেন, মানবের ধর্মই হলো গুণীর পুজা করা, সম্মান করা ও গৌরব করা। এতে করে যেমন গুণী সৃষ্টি হবে, প্রজন্মরা তা ধারণ করবে, গুণীজনদের জ্ঞান- অভিজ্ঞতা থেকে ধারাবাহিকভাবে ছোটরা তা গ্রহণ করে সমাজকে সুসংহত করবে। সর্বোপরি সমাজে ‘চেইন অব কমান্ড’ রক্ষা হবে এবং সবার মধ্যে মৈত্রীপূর্ণ সুসম্পর্ক সৃষ্টি হবে। সমাজে সুখ ও শান্তি বিরাজ করবে। বড়-ছোট সবার মধ্যে গভীর আন্তরিকতা ও বুকভরা আত্মতৃপ্তি নিয়ে আনন্দের সঙ্গে মিলেমিশে একাত্মা হয়ে পৃথিবীতে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারবে। আর বড়রা ছোটদের স্নেহ, মায়া, মমতার পরশ দিয়ে আদর্শ চরিত্র, নেতৃত্ব, প্রতিভাবান ও সর্বোচ্চ পেশায় প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন। এতেই বড়দের সাথে ছোটদের আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। যেখানে ছোটদের ভুল ত্রুটি গুলো বড়দের অভিজ্ঞতা দিয়ে সংশোধন করে আবার নতুন উদ্যেমে পথ চলতে সাহসী করে তোলে। এভাবেই আমরা সকলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠি। আবার অন্যভাবে যদি বলি, ‘সম্মান করলে সম্মান বাড়ে’। তাই বিনয় শিক্ষা গৌরবের শিক্ষা। গুনীজনদের সম্মান করলে গুনীরা যেমন আনন্দিত হয় তেমনি আশীর্বাদও করেন। সেই আশীর্বাদ একদিন গুণী হওয়ার পাথেয় হয়। আমরা আসলেই মানুষের গুণকে তেমনভাবে প্রশংসা না করে দোষ গুলোকে বেশী চিহ্নিত করি। যদি মানবের গুণ গুলো বেশি করে ফুটিয়ে তুলতে পারি তাতে করে মানুষের মনে যেমন শান্তি দেওয়া যায় তেমনি গুণ গুলো অনেকের জীবনে প্রতিফলনও হয়। গুণ বিবেচনায় মানুষকে সম্মান করা উচিত। এতে করে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সমাজে শান্তি- শৃঙ্খলা, আন্তরিকতাপূর্ণ সুন্দর ও সুখী জীবন অতিবাহিত করতে পারি।
কবি মির্জা ওবায়দুর রহমান এর ভাষায় :
‘প্রবীণ হলেও বলোনা কখনও প্রবীণ
মনটা প্রতিটি ক্ষণ রেখো নবীন,
প্রবীণের মাঝে নবীন লুকায়িত
নবীন থেকেই নবধারা প্রবাহিত’।
ব্যক্তিগত অনুভবে বলতে চাই, মানবজীবনে যেসব লোক স্ব স্ব ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মর্যাদা ও সম্মান লাভ করেছেন তারা সকলেই প্রবীণদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজ মেধাশক্তিকে বিকশিত করে নব আবিষ্কার মানব জীবনে মঙ্গল বয়ে এনেছে। কেননা মানুষ বিশ্বাস করে সর্ববিধ গুণের অধিকারী প্রবীণরাই নবীনদের জীবনকে সর্বক্ষেত্রে বাসযোগ্য করে তুলেছেন তাঁহাদের আপন মহিমায়। কারণ প্রবীণরা হলো জ্ঞানবৃক্ষ। যদি বংশানুক্রমিক জন্মগত বৈশিষ্ট্য মানুষের মনোযোগ ও প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হয় তাহলে উত্তম আচার – আচরণ ও সকল ভদ্র আচরণকারী মানুষের সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জন করবে। প্রথমোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে জন্মগত আর শেষোক্ত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উপার্জিত কর্মফল ও চিন্তা-শক্তি প্রসূত। আমাদের এই বিচার শক্তির মাধ্যমে সমগ্র জীবনব্যাপী সুকর্ম পরিচালনা করতে পারি।
যাঁরা জীবনে শ্রেষ্ঠতা ও উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছেন তাঁরা সমাজে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা বা নক্ষত্র হিসাবে মানবতার পথকে সুগম করেছেন। তাঁরা মানুষের নৈতিকতা ও ধর্মের পথে সঠিক পথ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এভাবে মানবজীবনে প্রবীণ ও নবীনের মধ্যে দূরত্ব দূর করে বংশপরম্পরার গুরু-শিষ্যের মত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দিয়ে এ জগৎ সংসারকে জয় করেছেন গুণীজনরা। আগামী প্রজন্মকে সত্য, সুন্দর ও সঠিকভাবে দিক- নির্দেশনা দিয়ে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অগ্রসর করতে প্রবীণ ও নবীনের মেলবন্ধনই যথেষ্ট। সকলের চেষ্টা হউক,
” When you do your best, you become better of what you do”.
জগতে সকলের মঙ্গল হউক।
লেখক : প্রাবন্ধিক

error: Content is protected !!