বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিসত্তা হিসেবে বৌদ্ধরা অতি প্রাচীন। ভারত-বাংলা উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে বৌদ্ধদের অসামান্য অবদান রয়েছে। এদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে বৌদ্ধদের গৌরবময় ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। এদেশের বৌদ্ধ স¤প্রদায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সাহসী কর্মনির্মিতি ছিল অনন্য অসাধারণ। বাংলার ভূমিজ সন্তান হিসেবে বৌদ্ধরা দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায় বলতে বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চাকমা, মারমা, রাখাইন, ¤্রাে, চাক, তনচঙ্গ্যা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বুঝায়। বৌদ্ধরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। তাদের অনেকেই জীবন দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকবাহিনীর অতর্কিত বর্বরোচিত আক্রমণে এদশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলেই অত্যাচার, নির্যাতিত, নিপীড়িত, ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধদের অবদান : চট্টগ্রামের অঞ্চল’ আলোচ্য প্রবন্ধে স্বাধীনতাকালীন বাঙালি বডুয়া বৌদ্ধদের অবদান, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম, বীরাঙ্গনাদের নাম এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের অংশগ্রহণ ও অবদান
বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অত্যন্ত গৌরবময়। সাধারণভাবে ব্রিটিশ আমল থেকে বৌদ্ধরা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে যোগদান করে আসছে। অতীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বৌদ্ধদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। এতে উদীয়মান তরুণ ভূপেন্দ্রনাথ বডুয়া ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দ নির্যাতন ও কারাদÐ ভোগ করেছেন। বিপ্লবী আন্দোলনে বৌদ্ধ যুবক স¤প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিপ্লবী মহেশ বডুয়া, বিহারী বডুয়া, প্রকৃতি বডুয়া প্রমুখ অনেকে ব্রিটিশের কারাগারে তিলে তিলে আত্মদান করেছেন। তেজস্বী রোহিনী বডুয়া ফাঁসির কাষ্টে জীবনের জয়গান গেয়ে যান।
বৌদ্ধদের ইতিহাস বহু বলিষ্ট। বিশেষত বিপ্লব বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ ও বিপ্লবে বৌদ্ধরা অংশ নিয়েছিল। সামরিক বাহিনীতে বৌদ্ধরা বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে বৌদ্ধরা দলে দলে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মগ প্লটনের সদস্যরা সমর কর্মকাÐে প্রশংসা কুঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে বৌদ্ধরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগিতার মনোভাব দেখালেও পরে, তারা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। হিন্দুদের সাথে সাথে বৌদ্ধরাও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজদের নজরে আসে। ইংরেজরা বৌদ্ধদের শৌর্যবীর্যের কথা অবহিত হয়ে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেয়। বৌদ্ধ সৈনিকদের সমন্বয়ে ‘মগ পল্টন’ নামে পৃথক একটি সেনা দল সৃষ্টি করেন। মগ পল্টনের কয়েকজন বডুয়া সৈনিকের নাম ও পরিচয় হল: নারায়ণ সিং সুবেদার, পাহাড়তলী, মোহন সিং সুবেদার, পাহাড়তলী, কালাচান সুবেদার, পাহাড়তলী, দীপচান সুবেদার, জ্যৈষ্টপুরা, জয় সিং সুবেদার, আধাঁরমানিক, উদয়চান জমাদার বাহাদুর, বাঘখালি। ১৯৩০ সালে ভারতে সে সত্যাগ্রহ আন্দোলন হয় তাতে বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ড. প্রণব কুমার বডুয়ার বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বৌদ্ধ স¤প্রদায়’ গ্রন্থের প্রথম অনুচ্ছেদে লিখেছেন, সে সময় বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত ৫৫ জন বৌদ্ধ যুবক ও ছাত্রদের ঠিকানাসহ একটি তালিকা প্রদান করেছেন।
অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বডুয়া বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার ছতরপুটিয়া গ্রামের এই ব্যক্তিত্ব কংগ্রেসের প্রথমসারীর নেতা ছিলেন। এছাড়া চট্টগ্রাম পটিয়ার মৈতলা গ্রামের মহেন্দ্র লাল (চন্দ্র) বডুয়া, ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া, তরনী বডুয়া, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার ভুপেন্দ্রনাথ মুৎসুদ্দী (ভুপেন গান্ধী), আবুরখীলের পুলিন বিহারী বডুয়া, এডভোকেট সারদা প্রসাদ বডুয়া, বাঁশখালীর রাস বিহারী বডুয়া, রাউজান গহিরার নগেন্দ্র লাল বডুয়া, রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামের প্রবীণ বডুয়া ও রাঙ্গুনিয়ার নীরদবরণ তালুকদার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
নীরদ বরণ তালুকদার ও ভুপেন্দ্র নাথ বডুয়া তিন মাস কারাবরণ করেন। নীরদ বরণ তালুকদার পÐিচেরীতে ঋষি অরবিন্দের আশ্রমে যোগ দিয়ে শেষ জীবন মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। বিপ্লবী কর্মধারায় প্রথম অংশ নেন আবুখীলের মতান্তরে নোয়াপাড়ার প্রবীন বডুয়া তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেন, শেষে বার্মায় গমন করেন। জানা যায় নেতাজীর সাথেও তার যোগাযোগ ছিল। পটিয়া থানার মৈতলা গ্রামের সন্তান মহেন্দ্র লাল বডুয়া ছিলেন অন্যতম সাহসী বিপ্লবী সন্তান। অন্যান্য বিপ্লবীদের মধ্যে রোহিনী বডুয়া, জ্যেষ্ঠপুরার ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া, সাতবাড়িয়ার মহেশ বডুয়া, পান্থশালার নীরেন্দ্র বডুয়া, বৈদ্যপাড়ার জীবক বডুয়া, মিস নিরুপমা বডুয়া, ফটিকছড়ির বডুয়া, নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি মঞ্চে আত্মহুতি দেন। মহেশ বডুয়া ধীরেন্দ্র লাল বডুয়া কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। মাদ্রাজে নৌ বিদ্রোহ অংশগ্রহণকারীর বিপ্লবী নিরঞ্জন বডুয়া ফাঁসি হয়। মহেশ বডুয়া ও নীরেন্দ্র চৌধুরীর দীপান্তর হয়। উল্লেখ্য যে, মহামুনির তালতলা পাহাড়, আবুরখীলের জেতবন বিহার, শাকপুরার ধর্মানন্দ বিহার ছিল বিপ্লবীদের গোপন মিলন কেন্দ্র। অনেক বিপ্লবী আবুরখীলের আশ্রয় নিয়েছিল। সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অনেকে যোগদান করেন। তন্মোধ্যে বৈদ্যপাড়ার প্রেম প্রসাদ বডুয়া, কর্তালার প্রেমানন্দ চৌধুরী (গ্রামের পরিচয় জানা যায়নি) ছয়মাস কারাদÐ হয়। অন্যান্যদের মধ্যে হাশিমপুরের অধ্যাপক প্রকৃতি রঞ্জন বডুয়া, পূর্ণেন্দু তালুকদার, আবুরখীলের ড. বিনয় বডুয়া, রাউজানের ভূপেন্দ্র লাল বডুয়া, রাঙ্গুনিয়ার ড. অরুণ চন্দ্র বডুয়া। অধিকন্তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন আবুরখীলের খগেন্দ্র লাল বডুয়া, অজিত বডুয়া (শ্রদ্ধানন্দ ভিক্ষু)। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী কর্মধারার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তন্মোধ্যে সংঘনায়ক শ্রীমৎ আনন্দ মিত্র মহাথের, মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং শ্রীমৎ বঙ্গীশ ভিক্ষুর নাম উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধদের মধ্যে স্বদেশে সংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথের এবং বিদেশে পÐিত জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ রাষ্ট্র জাপান, থাইল্যাÐ, কোরিয়া, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশসমূহ সফরপূর্বক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন।

বাংলাদেশের বিভাগের ফলে বৌদ্ধদের বিরাট অংশ পূর্ববঙ্গে রয়ে গেল। তাঁরা মাতৃভূমির সর্ববিধ উন্নতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেন। দেশের প্রশাসনিক ব্যাপারেও তাঁদের যোগ্য স্থান ছিল। কেউ কেউ রাজ্যসভা ও বিধানসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত হয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশের সুখ দুঃখ সম্পদে বিপদে বৌদ্ধরা সমান অংশগ্রহণ করে যান। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে বহু কৃতি ছাত্র ছাত্রী ও বুদ্ধিজীবি সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দিয়ে ইহাকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবীর ভিত্তিতে প্রতিদ্বদ্বিতা করে এই দাবীগুলিতে অন্ধ সামপ্রদায়িকতা ছিল না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। সেই কারণে দেশের প্রগতিশীল বিরাট অংশ আওয়াগী লীগকে সমর্থন করেন। বাংলার বৌদ্ধেরাও এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের রাউজান থানা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এখানে মুসলিম লীগের কিছু ব্যক্তিও আছেন তাঁরা মুসলীম লীগ সমর্থনের জন্য বৌদ্ধদেরকে নানাভাবে পরোচিত ও ভয় প্রদর্শন করতে থাকে। বৌদ্ধেরা দৃঢ়তার সাথে ইহার প্রতিবাদ করেন এবং প্রতি আওয়ামীলীগ সমর্থন করেন। ফলে নির্বাচনের প্রাক্কালে গুজরা নয়াপাড়ার কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রাম আক্রান্ত হয়। এই সংঘর্ষের ফলে দুইজন বৌদ্ধ নিহত ও কয়েকজন আহত হন। অপর পক্ষেও কিছু হতাহত হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং নয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি স্কুল মাঠে বিরাট জনসভায় ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ শুধু মুসলমানের নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানেরও নয়; বাংলাদেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালির। নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে আওয়ামী লীগপন্থীরা সর্বত্র জয় লাভ করেছেন। আর মুসলীম লীগপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। ইহাতে মুসলীম লীগপন্থীদের অমুসলিম বিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পায়।
২৫শে মার্চ ১৯৭১ সন হতে বাঙালিদের উপর যে জঙ্গীশাহী আক্রমণ হয়েছে, তাতে প্রথম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নিধন কার্য চালায়। পরে সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু বৌদ্ধ ও আওয়ামীলীগ সমর্থকদের ধ্বংস করা হয়েছে। অপ্রস্তুত অবস্থায় বহু সংখ্যক বাঙালি এই আক্রমণে হতাহত হয়েছে। মা বোন মাতৃজাতিরা ধর্ষিত ও লুন্ঠিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে বাঙালিরা আত্মরক্ষার্থে মুক্তিবাহিনী গঠন করে পাক সৈন্যদের অগ্রগতি রোধ করেন। এই বাহিনীতে বৌদ্ধ তরুণ-তরুণীরা প্রচুর পরিমাণে যোগদান করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচÐ আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশ এখন শত্রুর কবল মুক্ত হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীকে প্রতিহত করার নিমিত্ত জঙ্গী নেতারা নির্বাচনে পরাজিত মুসলিম লীগের সহায়তায় সমাজ বিরোধী লোকদেরকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন। তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছে। এই রূপে বাঙালিদের মধ্যে পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করেছে জঙ্গীশাহীরা শাসন ও শোষণ অক্ষুণ্য রাখার পরিকল্পনা করেছেন। ফলে সাত মাসে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি হতাহত ও শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রিত হয়েছেন। তথাকার সংখ্যালঘু স¤প্রদায়সমূহ একেবারে নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হয়েছে। বহু গ্রামে ও মন্দিরের বিপন্ন হিন্দু মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং সুযোগ মত নিরাপদ স্থানে প্রেরিত হয়েছে সেজন্য রাজাকার ও পাক সৈন্যের সম্মিলিত আক্রমণে বহু বৌদ্ধ গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। চট্টগ্রাম পটিয়া থানার সাতবাড়িয়া গ্রাম ও শান্তি বিহার আক্রান্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। জোয়ারা, সুচিয়া প্রভৃতি গ্রামও লুণ্ঠিত হয়েছে। এই রূপে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড ও মিরেরশ্বরাই থানার বৌদ্ধ বিহার ও গ্রাম বিধ্বস্ত ও লুন্ঠিত হয়েছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়া, চকরিয়া হারবাং, মহেশখালির বিহারও আক্রাস্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তি ভগ্ন করা হয়েছে। অষ্টধাতুর বড় বড় বুদ্ধমূর্তি চুর্ণ-বিচুর্ণ করে লুন্ঠিত হয়েছে। বহুধর্মগুরু ও নর-নারী হতাহত হয়েছেন। এই সংগ্রামে অন্তত পঁচিশ সহস্র বৌদ্ধ নিহত ও লক্ষাধিক প্রতিবেশি রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। যতই সময় যাচ্ছে সংখ্যালঘু বৌদ্ধরা প্রায় নিশ্চহ্ন হতে চলেছে। তথাপি বৌদ্ধ তরুণগণ দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে মাতৃভূমিকে শ্ত্রমুক্ত করার নিমিত্ত আত্মনিয়োগ করছেন। শরণার্থী রূপে ভারতে গিয়ে বহু বৌদ্ধ তরুণ পুন মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছেন। বহু তরুণের সম্মুখ সংগ্রামে শত্রু নিধন করে শহীদের গৌরব অর্জনের করেছেন। তথাপি বহু যোদ্ধা সংগ্রাম চালিয়েছেন অসীম সাহসে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী তরুণ বীর সৈনিক রূপে মুক্তি সংগ্রামে প্রবেশ করেছেন।
ধর্মাধার মহাস্থবির উল্লেখ করেছেন, ‘চট্টগ্রামের সাতবাড়িয়া গ্রামের শান্তি বিহার পাক সৈন্যরা গত আগস্ট মাসে লুঠ করে বিহারের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় এবং বৌদ্ধদের ধর্মগুরু সংঘনায়ক শ্রদ্ধেয় অভয়তিষ্য মহাস্থবিরের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। এই রকম ঘটনা বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর আমলে শত শত ঘটিয়াছে।’ মুক্তিযুদ্ধ কালীন পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, বাংলাদেশের বিজয়ে বাঙালি হিসাবে আজ আমরাও গর্বিত এবং সেই দেশের আনন্দযজ্ঞে আমরাও অংশীদার কারণ i যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ জয় কিংবা রাজনৈতিক জয় না, ইহা জয় নয়; মানবিকতার জয়, গণতন্ত্রের জয়, স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের জয়। তাই আমরা আনন্দিত। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে পূর্ববঙ্গে অসহায় নিরীহ জনসাধারণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য শোষণ আমাদের বার বার ব্যথিত করেছে। অসহায়ের মতো আমরা লক্ষ্য করেছি কেমন করে একটি প্রাণবন্ত জাতিকে নির্দয়ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তাই ২৫শে মার্চ পাঁচ জঙ্গী শাসনের নৃশংস অত্যাচারের পর বৌদ্ধরা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছিল।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে। কলকাতায় বৌদ্ধদের মুখপত্র নালন্দার মাধ্যমে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা এবং পূর্ববঙ্গের অসহায় নরনারীদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। নালন্দা পত্রিকার পঞ্চম বর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে এক প্রস্তাবে পূর্ববঙ্গের ইয়াহিয়া সরকার যে ধ্বংসলীলা চালায়া তার তীব্র নিন্দা করে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব উ থান্টকে ঐ নরমেধ যজ্ঞের অবসান ঘটাতে অনুরোধ করা হয় এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ ও মিত্র রাষ্ট্রের প্রধানদের পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ করা হয়। তাছাড়া আগস্ট মাসে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের সমস্যাসমূহ আলোচনা করার জন্য নিখিল ভারত বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হতে প্রায় ৩০০জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশের মুক্তিকামী সংগ্রামরত জনসাধারণের সমর্থনে এবং ইয়াহিয়া সরকারের জঘন্য বর্বরতার নিন্দা জ্ঞাপক পাঁচটি প্রস্তাব সভা সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম এপারের অগণিত বৌদ্ধদের প্রচন্ডভাবে উদ্দীপিত করেছে। তাই ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদে এখানকার বৌদ্ধরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেন। যুদ্ধের অব্যবহিত পরে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক শহরে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ যুব সংঘের সমগ্র এশিয়ার বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার এবং বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের বিরুদ্ধে একটি নিন্দাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপদ প্রত্যাবর্তন ও বাঙালি বৌদ্ধদের পক্ষ হতে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়।
বাংলার মুক্তি সংগ্রামে হিন্দু মুসলমানের ন্যায়স্থানীয় বৌদ্ধদের ভূমিকা খুবই গৌরবজনক। গোড়ার দিকে প্রাক ফৌজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে গণহত্যা চালিয়ে যায়। বৌদ্ধদেশ চীন পাকিস্তানের বন্ধু। চীন ও অপর বৌদ্ধদেশগুলো সৌহার্দ্য লাভের মানসে মাঝখানে পাক সৈন্যেরা বৌদ্ধদের ‘চাইনিস বুদ্ধিস্ট’ আখ্যা দিয়ে অত্যাচার হতে রেহাই দিতে চাইলে বৌদ্ধরা তার পুন সুযোগ গ্রহণ করলেন। প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রাম বিপন্ন হিন্দু মুসলমানের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল। এই সকল আশ্রয়স্থান হতে শরণার্থীদের সন্তর্পণে ভারতের দিকে প্রেরণ করা হয়। তাদের যাত্রাপথে মানিকছড়ির মানরাজ বাহাদুর সহস্র সহস্র শরণার্থী ও মুক্তিবাহনীর সেবার নিমিত্ত তার রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেন। শরণার্থীরা নিরাপদে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ গ্রামগুলি মুক্তিবাহিনীর দুর্গে পরিণত হয়। এসব গ্রামে আত্মগোপন করে মুক্তিবাহিনী তাদের সংগ্রাম চালাতে থাকেন। দলে দলে বৌদ্ধ যুবক যুবতী মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে সংগ্রাম করেন। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ার পর্বতবেষ্টিত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা প্রত্যেক বৌদ্ধকে পরিচয় পত্র দেবার নির্দেশ দিলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে লোককে সম্ভাব্য মৃত্যু হতে রক্ষার নিমিত্ত পরিচয়পত্র দিতে থাকেন। এই সুযোগে অনেক বৌদ্ধ পাক ফৌজের কোপ দৃষ্টি এড়িয়ে ভারতে চলে আসেন। দেশ দ্রোহীদের মাধ্যমে এই সংবাদ পাক সৈন্যদের নিকট পৌঁছলে আবার বৌদ্ধ গ্রামের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চলতে থাকে। বহু ঘরবাড়ী ভস্মীভূত হয়, বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়। বহু বৌদ্ধ ও ধর্মগুরু হতাহত ও নিখোঁজ হন। কিন্তু এই অত্যাচার বেশিদিন চলতে পারেনি ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানে পতন ঘটেছে।
শরণার্থী ও ভারতীয় বৌদ্ধদের পক্ষ হতে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি ও সাহায্যের নিমিত্ত ব্যাপক আন্দোলন চালায়। ভারতে অবস্থিত বৌদ্ধদেশগুলির কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিশ্বের বৌদ্ধদেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘে দাবী করা হয়েছে। শরণার্থী বৌদ্ধ নেতা জ্যোতিঃপাল মহাথের প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সিংহল, থাইল্যাÐ, জাপান, হংকং প্রভৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধদেশগুলোতে প্রচার কার্য চালিয়েছেন। এই প্রচারের ফলে সেই সকল দেশবাসীর মানবীয় বিবেক জাগ্রত হয়েছে। বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকান্ডের নিমিত্ত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার হয়েছে এবং স্বাধীন বাংলার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। মুক্তি সংগ্রামের সকল বিভাগে বৌদ্ধরা সক্রিয় ছিলেন। দীপ্ত শপথ নেন জন্মভূমি শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম করবেন। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলা অচিরেই শত্রু মুক্ত হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের বাঙালি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল পাকসেনাদের দ্বারা অধিক আক্রান্ত। বিশেষ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট, কর্ণফুলি, চট্টগ্রাম সদর, হাটহাজারী, রাউজান, কাপ্তাই, পটিয়া, আজিজনগর, চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার, টেকনাফ প্রভৃতি স্থানে পাকসেনারা বোমা নিক্ষেপ করে। বিভিন্ন জেলায় পাক বাহিনীর অতর্কিত নৃশংস আক্রমণে বৌদ্ধরা ব্যাপক নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিহত হয়েছেন। কোন কোন জেলায় সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের লোকেরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ে ছিল। বৌদ্ধরাও পূর্ববঙ্গের বাংলাদেশের একটি সংখ্যালঘু সমপ্রদায়। তাঁরা প্রধানত বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় বসবাস করেন।
পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি ও ভয়াবহতা বিষয়ে ভারতের আগরতলায় ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল সকাল ১০ টায় একটি জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ, ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা- শ্রী গোপাল ভূষণ চাকমাসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আকাশবাণী, আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং অন্যান্য আঞ্চলিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি বৌদ্ধদের উপর নৃশংস অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যা পরিচালিত হয়। … পরবর্তীতে তিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ, অর্থমন্ত্রী শ্রী কৃষ্ণ দাস ভট্টাচার্য এবং মুখ্যসচিব ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে স্বাক্ষাৎকারে মক্তিযুদ্ধের দুঃখজনক ইতিহাস তুলে ধরেন। … এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রতুত্ব সংস্থা-ব্যাংককের সভাপতি রাজপুত্র পুন-পিসমাই-দিসকুল এবং মহাসচিব মি. ইয়েম সংঘবাসী, শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি শ্রীমাভো বন্দর নায়েক, বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত সংস্থার সকল আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং বৌদ্ধ পরিষদে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের রিপোর্ট প্রেরণ করেন।”
পন্ডিত জ্যোতিঃপাল মহাথের উল্লেখ করেন যে, Moveover, the last day I and Mr. K M Shahabuddin went to Parliament house to meet with Ministers and Members of the Parliament presented the exact scene about the success in freedom of occupied Bangladesh and made an application to stop the landing of Pakistani flight in Sinhala Airport. As a result, Srilankan Prime Minister Mrs. Bander Nayek to stop the landing of Pakistani flight in Colombo Airport. All directions such as north south, east west, and water-land-air were closed for Pak occupied force.
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পাক সৈন্যের আক্রমণে বৌদ্ধদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে জীবিকার নিমিত্তে অনেক বৌদ্ধ বাস করতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চ সরকারি-বেসরকারি চাকুরিজীবী, শিক্ষক, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ি প্রভৃতি ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পাক সেনার প্রথম আক্রমণে নিহত, আহত ও নিখোঁজ হয়েছেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকার বৌদ্ধ বিহার লুন্ঠিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৌদ্ধদের অনেকের বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল। অনেকে পুরুষানুক্রমে শহরবাসী। তাঁদের বাড়ি-ঘর, দোকান-কারখানা লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। চট্টগ্রামের অনাথবাজার বৌদ্ধ বিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, একজন প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু বোমার আঘাতে আহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম শহরের নিকটবর্তী চাঁনগাঁও গ্রাম সুপ্রাচীন বৌদ্ধগ্রাম। এতে অনেক বৌদ্ধদের বাড়ি দুইটি বৌদ্ধ বিহার লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে, অনেকে নিহত হয়েছেন। ঐ গ্রাম জনশূন্য শ্মশানে পরিণত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালীন পÐিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রাম পাক সেনাদের আক্রমণে বিপন্ন হয়েছে, বাড়ী ঘর লুণ্ঠিত ও এখানকার বিহারটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গোলার আঘাতে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। অবশিষ্টেরা পলাতক। এর দুই মাইল দূর মিরথীন গ্রামেও একই অবস্থা। মির্জাপুর এক বর্ধিষ্ণু বৌদ্ধগ্রাম। একদিন অবাঙালি একদল লোক তথাকার হিন্দুদের বাড়ী ঘর লুট করে বৌদ্ধদের বাড়ীঘর লুট করতে থাকে। তারা পুরাতন শান্তিধাম বিহারের শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলে। তরুণগণ প্রবল বাধা দিলে দুবৃত্তরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কয়েক ঘণ্টা পরে তারা হাটহাজারী হতে পাক সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পুনরায় আক্রমণ করে। সৈন্যরা বিহারের একটি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় একজন প্রৌঢ় তথায় এসে তাদেরকে অনুরোধ করেন যে, তাঁরা পাকিস্তানের অনুগত প্রজা, তাঁদের উপর এই অত্যাচার কেন? বার্মার প্রধানমন্ত্রী উ. নূর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের এক বাঁধানো ছবি প্রদর্শন করেন। ইহাতে সৈন্যরা সন্তুষ্ট হন এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার না করার জন্য অবাঙালিদের নির্দেশ দেন। তখন হতে বৌদ্ধদের নিরাতঙ্কে থাকার আশ্বাস দিয়ে যান কিন্তু তার চার দিন পরে একদিন হঠাৎ সৈন্যসহ তারা গ্রামে লুঠতরাজ রাউজান থানার গহিরা গ্রামের লুম্বিনী কানন বিহার পাক বোমায় ধ্বংস হয়েছে। রাঙ্গামাটি রোডের দুই পার্শ্বে বৌদ্ধদের বহু বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত হয়েছে। কয়েকজন লোক মেশিন গানের গোলায় আহত ও নিহত হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী বরজ্ঞান বিহার আক্রান্ত হয়েছে। বুদ্ধমূর্তিভগ্ন ও ভিক্ষুর উপর আঘাত করেছে, ভিক্ষু ও গৃহীগণ গ্রাম ত্যাগ করেছেন। এই সুযোগে মুসলিমলীগপন্থীরা বৌদ্ধদের গৃহপালিত পশুপাক্ষী ধান চাউল তৈজস পত্র লুঠ করেছেন, অনেক গৃহ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বিনাজুরী বিশিষ্ট বৌদ্ধ গ্রাম। নিঃস্ব হিন্দুদেরকে আশ্রয় দেওয়ায় তারা মুসলিমলীগপন্থীদের বিদ্বেষভাজন হন। তথাকার বিহার ও গৃহ আক্রান্ত হয়। রাউজানের আবুরখীলেরও একই অবস্থা।
হোয়ারাপাড়া সুদর্শন বিহার লুণ্ঠিত বুদ্ধমূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়। বুদ্ধের পুতাস্থি অপহৃত হয়েছে। মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের পার্শ্বে কলেজে পাক সেনারা ঘাটি করেছে। গ্রামবাসী নির্যাতিত সতত সন্ত্রস্ত। একজন শিক্ষিত তরুণ ভিক্ষু পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। অনেক শিক্ষিত তরুণ ও বুদ্ধিজীবী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী রাঙ্গুনিয়ার সৈয়দবাড়ি, ইছামতি ও নজরের টিলার অনেক ঘর লুন্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। লোকজন পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। বোয়ালখালি থানার শাকপুরা গ্রামে দুইজন শিক্ষিত বৌদ্ধকে বিহারের বুদ্ধমূর্তির সম্মুখে হত্যা করা হয়। লোকের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পটিয়া, সাতকানিয়া থানার বহু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত লোক হতাহত ও নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রামু ও উখিয়া পালং অঞ্চলের অনেক বৌদ্ধ নিহত, গ্রাম লুণ্ঠিত ও ভস্মীভূত হয়েছে। প্রায় বিশ হাজার বাঙালি বৌদ্ধ আরাকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তথায় মানবোচিত সৌজন্য অভাবে কিছু সংখ্যক ফিরে আসতে বাধ্য হন, কিন্তু স্থানীয় মুসলিম লীগের অত্যাচারে আবার তারা বাস্তুচ্যুত হন।
পÐিত ধর্মাধার মহাস্থবির লিখেছেন, ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের পার্শ্বে সীতাকুÐ, বারবকুÐ, কাঠগড় ও পান্থশালা গ্রাম আক্রান্ত ও ভস্মীভূত হয়। গ্রাম ছেড়ে লোকজন পালিয়ে যান। মিরেরশ্বরাই থানার জোরারগঞ্জ ধ্বংস হয়। এখানে নারী নির্যাতনে অসম্মত বালুচ সৈন্যের সাথে পাঞ্জাবিদের সংঘর্ষ হয়। উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার ১৮/২০ টি গ্রাম বিহারসহ আক্রান্ত হয়েছে। বহুলোক হতাহত, ভিক্ষুরা নির্যাতিত। অবশিষ্ট সহস্র লোক কোন প্রকারে প্রাণ নিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ঐ দুই জেলা একেবারে বৌদ্ধশূন্য হয়েছে। বরিশালে আদিবাসী রাখাইন বৌদ্ধদের উপর ভীষণ অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল। এর শতকরা ৯৭ ভাগ বৌদ্ধ ছিল। ইহার তিন পার্বত্য জেলায় তিনজন বৌদ্ধ রাজা রাজত্ব করেন। উত্তরে রামগড়ের মানরাজা পাকসেনার আক্রমণে ৬/৭ সহস্র উপজাতীয় প্রজাসহ ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়েছেন। তাঁর রাজধানী মানিকছড়ি পাক সৈন্য অধিকার করেছেন। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ চাকমা রাজা

লেখকঃ

ড. জগন্নাথ বডুয়া

সহকারী অধ্যাপক, পালি বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ।

তথ্যসুত্রঃ দি বুড্ডিস্ট টাইমস

error: Content is protected !!