বড়ুয়া’দের উৎপত্তি ও ইতিহাস

লিখেছেনঃ

বিপ্লব বড়ুয়া (M.S.S)

শিক্ষকঃ রেজু বরইতলী উচ্চ বিদ্যালয়।

“বড়ুয়া” বর্তমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার একটি সুপরিচিত নাম। এদেশে বসবাসকারী অধিকাংশ বৌদ্ধরাই ‘বড়ুয়া’ নামে অভিহিত। ইতিহাস সূত্রে এটা সুনির্দিষ্টরূপে প্রমাণিত যে, বাঙ্গালী বড়ুয়া বৌদ্ধরা এদেশের আদি বাসিন্দা। এই বড়ুয়া বৌদ্ধরা ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বায় বর্তমানে বিদ্যমান থাকলেও তাদের রয়েছে অতি সমৃদ্ধ গৌরবনীয় ইতিহাস ও প্রসিদ্ধ পরিচয়।প্রথমে ‘বড়ুয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ জানার চেষ্টা করি- “বড়– ধাতুর সাথে ‘উয়া’ প্রত্যয় যোগে ‘বড়ুয়া’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে, অর্থাৎ বড়+উয়া=বড়ুয়া। বিশ্ব কোষ অভিধানে বড়ুয়া সম্বন্ধে লিখিত আছে- ‘একটি আখ্যায়িকা হতে জানা যায় বড়ুয়াগণ একটি প্রতিভাবান বৌদ্ধ রাজবংশের বংশধর’। সংস্কৃত ভাষায় ‘বটুক’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে বড়ুয়া বা শ্রেষ্ঠ”।

‘বড়ুয়া’ শব্দটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিকেই বোঝায়। মগধ বা বিহার হতে আগত লোকেরা চট্টগ্রামে বর্তমানে ‘বড়ুয়া’ নামে পরিচিত।বাংলা একাডেমীর অভিধানে ‘বড়ুয়া’র অর্থ দেখানো হয়েছে -(১) পদস্থ বা সম্মানিত ব্যক্তি; ধনী।(২) চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের ও অহমিয়া হিন্দুদের পদবি; আসামের কোনো কোনো মুসলমানের পদবি (সংস্কৃত উৎস নির্দেশ করা হয়েছে- বড্র >বড় +উয়া (বড় ঘর অর্থে)। “জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস কৃত অভিধানে এর অর্থ লিখা হয়েছে- ‘বড়ুয়া’= (বোড়–আ) বি বটু, ব্রাহ্মণ- কুমার, যুবক, ব্রাহ্মণ”।‘শব্দবোধ অভিধান’বলে- “বড়ুয়া’=(১) আসাম প্রদেশবাসী ব্রাহ্মণদের উপাধি বিশেষ, দেশজ।(২) মহান,অর্থশালী”আসাম প্রদেশে বৈদ্য বড়ুয়া, কায়স্থবড়ুয়ারূপে বিভিন্ন বড়ুয়ার সন্ধান পাওয়া যায়।
’চন্দ্রকান্ত অভিধান’ এ আছে- “বড়ুয়া”= (অং-বর=প্রধান) বি, অহোম রাজার দিনত কোন এক খেলর প্রধান বিষয়া; এই বিলাক বিষয়ার প্রধান কাম আছিল শোধশোধা আরু দেশর শান্তিরক্ষা করা”। গৌহাটির বড়ুয়ারা সিংহ রাজার বংশধর। ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস ‘রাজমালা’তে বড়ুয়া জাতির উল্লেখ আছে। ‘সেকালে পাবর্ত্য প্রধাণগণ তাঁহাদের অধীনস্থ প্রজাগণের নায়করূপ নির্বাচিত হইতেন এবং তাঁহাদিগকে সর্দার, হাজারী ও বড়ুয়া উপাধিতে ভূষিত করিতেন।“বিজয়মাণিক্য রাজারজমিদার আমি,সে রাজার ‘বড়ুয়া’হৈয়া রাজা হৈলা তুমি।” (রাজমালা, পৃ: ১২০)”
এমনকি আরাকান ক্রোণোলজিতেও লেখা আছে যে বাংলাদেশী বৌদ্ধরা আর্যভারত তথা মজ্ঝিমাদেশ বা মধ্যপ্রদেশ থেকে এসেছে।
”Barua” is the last name of a distinct Bengali – speaking ethnic religious minority clan representing the plain area Buddhist community in Bangladesh. They mainly live in the Chittagong region. Many moved to Kolkata, India after partition of India in 1947; many also moved to England in the 1950s and 1960s. The plain Buddhists of Bangladesh known as the Burua-Buddhist are the ancient peoples of Bangladesh who have lived here for five thousand years according to Arakanese chronology. They insist that they came from the Aryavarta or the country of the Aryans which is practically identical to the country later known as the Majjhimadesh or Madhyadesh in Pali literature.Bengali speaking Barua people of Chittagong are all Buddhist by religion, unlike Hindu Barua of Assam who are generally Brahmins or Ahom or may belong to any other general caste in India. The word ‘Barua’ came from ‘Baru’ meaning great and ‘Arya ‘ meaning Noble ones.
“বড়ুয়া’ শব্দের উদ্ভব সম্পর্কে দু’টি মত প্রচলিত আছে। একটি হচ্ছে বড় আর্য (বর অরিয়) থেকে ‘বউড়গ্যা’ বা বড়ুয়া শব্দটি এসেছে। এর সমর্থনে বলা যায়, বৌদ্ধ সমাজে পুত্রবধুগণ শ্বশুড়কে বউড়গ্যা এবং শাশুড়ীকে আযোয়্যাঁ সম্বোধন করত। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় এখানো এ শব্দ দুটির ব্যবহার দৃষ্ট হয়। বউড়গ্যা বড় আর্য এবং আযোয়্যাঁ- আর্যমা শব্দের বিকৃত ব্যবহারিক শব্দ। এখানো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বড়ুয়াকে বউড়গ্যা বলা হয়। যেমন – বউড়গ্যা পাড়া, বউড়গ্যার টেক ইত্যাদি। অতএব, বড় আর্য (বর অরিয়)>বউড়গ্যা> বড়ুয়া এভাবে উদ্ভব হওয়া সম্ভব। আবার সেকালের পরিবার ও সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের বড়িয়া সম্বোধন করা হত বলে জানা যায়। এই বড়িয়া শব্দটি কালক্রমে বড়ুয়া হয়েছে বলে কারো কারো ধারণা।
“বৌদ্ধদের বিশ্বাস বড়ুয়ারা শ্রেষ্ঠ জাতি, তাদের মতে ‘বড়ুয়া’ শব্দটি বড় আর্য (বড়+অরিয়) থেকে এসেছে, এর অর্থ বড় বা উৎকৃষ্ট। ‘বড়ুয়া’ উপাধির অর্থ হল বড় আর্য এবং বড় সৈন্যধ্যক্ষ। “বড়ুয়া’ শব্দের উৎপত্তি সম্বন্ধে কোন কোন পণ্ডিত বলেন- ভগবান বুদ্ধ মানব সমাজের ভব-দুঃখ মুক্তির উদ্দেশ্যে যে সত্যপথ আবিস্কার করেছিলেন, তা পালি ভাষায় ‘অরিয় সচ্চং’ (আর্যসত্য) নামে অভিহিত। যারা বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম তথা আর্যসত্য গ্রহণ করতেন, তারাই বড় আর্য (বুদ্ধের উপাসক বা শিষ্য) নামে অভিহিত হতেন। এই ‘বড় আর্য (বড়+অরিয়) হতে ‘বড়ুয়া’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে, ইহার সমর্থনও যুক্তিপূর্ণ।
“ভারতে প্রকাশ্যে বৌদ্ধ নির্যাতনের ফলে টিকে থাকা অসম্ভব হলে বৃজি বা বজ্জিাকাপুত্ত উপজাতির এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র সাতশত অনুচরসহ মগধ (পাটনা) হতে পালায়ন করে পঁগার পথে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও আধুনিক নোয়াখালীতে এসে উপস্থিত হন। (চট্টগ্রামের ইতিহাস, পুরানা আমল, পৃ.৩৯)। মগধের বৈশালীর বৃজিগণ চট্টগ্রাম আগমন করায় ‘বজ্জি’ হতে ‘বড়ুয়া’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। ‘বড়-য়া’ শব্দটি বৃজি বা বজ্জি কথারই রূপান্তর বলে অনুমান করা হয়েছে। ড. বেনীমাধব বড়ুয়াও বজ্জি হতে ‘বড়ুয়া’ উপাধি এসেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়াও এই মতে বিশ্বাসী।” মগধের বৃজি জাতিরা রাজবংশের বংশধর সেহেতু শ্রেষ্ঠতে ‘বজ্জি’ থেকে অপভ্রংশে ‘বড়ুয়া’ শব্দ হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
“বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে জানা যায়, ভগবানের পরিনির্বাণের পর বৈশালীর লিচ্ছবীগণ কুশীনারার মল্লগণের নিকট দূত প্রেরণ করে জানালেন- ভগবান ক্ষত্রিয় আমারও ক্ষত্রিয়, আমরাও ভগবানের পবিত্র অস্থির অংশ পাওয়ার যোগ্য। বৈশালীর লিচ্ছবীর মত বৃজিরাও ছিল উন্নত জাতি এবং সংস্কৃতিবান- কাজেই বৃজিরাও ক্ষত্রিয় ছিল। বজ্জি ও লিচ্ছবী নাম কখনও কখনও একই অর্থে ব্যবহৃত হত। বজ্জি রাজ্যের মধ্যেই লিচ্ছবীরা অর্ন্তভূক্ত ছিল। বি.সি লাহাও বলেছেনে, বজ্জি ও লিচ্ছবী সমার্থক। লিচ্ছবীদের সম্পর্কে সমস্ত ভারতীয় ঐতিহ্য একমত যে লিচ্ছবীরা ক্ষত্রিয় ছিলেন। বেশী দিনের কথা নয়, বড়ুয়া বধুরা শাশ্বুড়ীকে ‘হাযমা’ বলে সম্বোধন করত। এখনও কোথাও কোথাও এর প্রচলন দেখা যায়। ‘হাযমা’ পালি শব্দ ‘অরিযমা’র অপভ্রংশ, শুদ্ধ বাংলা আর্যমা।স্বামী আর্যপুত্র, শ্বশুর আর্যপিতা, শাশুড়ি আর্যমাতা, এগুলি উন্নত সমাজেরই ভাষা। এতএব, বড়ুয়ার যে উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী তা সহজেই অনুমেয়’।
’বড়ুয়া’ সম্প্রদায়ের উদ্ভব সম্পর্কে একটি প্রচলিত জনশ্রুতি রয়েছে। তা হল, ত্রয়োদশ শতকে তুর্কী আক্রমণ শুরু হলে মগধের বৃজি গোত্রের বৌদ্ধগণ পলায়ন পূর্বক আত্মরক্ষার জন্য পূর্বাঞ্চলের স্বর্ধমীদের নিকট আশ্রয় নিয়েছিল। তারা ক্রমশ দক্ষিণ পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে হতে চট্টগ্রাম বিভাগে উপনীত হয়। চট্টগ্রাম তখন আরাকানের বৌদ্ধ রাজার অধীন ছিল। এখানে আর ধর্মলোপের ভয় ছিল না। তারা ইতিপূর্বে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে মগধ থেকে আগত চন্দ্রসূর্যের সঙ্গীদের উত্তর পুরুষদের সঙ্গে মিলিত হয়। পরবর্তীতে তারা ‘বড়ুয়া’ বৌদ্ধ নামে পরিচিতি লাভ করে। নতুন চন্দ্র বড়ুয়াও প্রায় একই মতে বিশ্বাসী। তাঁর মতে- দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভারতে বৌদ্ধদের উপর উপর্যোপরি মর্মান্তিক নির্যাতন ও বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান গুলো সমূলে ধ্বংস করার ফলে সেখানে বৌদ্ধগণ ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ তিব্বত ও নেপালে চলে যায়।
”বড়ুয়া” উপাধি কবে কখন প্রচলিত হয় তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। একটা ধারণা আছে ত্রয়োদশ শতকে মগধের বৈশালী থেকে আগত চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণকারী বজ্জিবংশীয় লোকেরা নিজেদের নামে শেষে সম্ভ্রান্ত সূচক বজ্জি পদবি ব্যবহার করত। আর স্থানীয় বৌদ্ধরা আদিকাল থেকে নিজেদের গোত্রীয় পদবি ব্যবহার করত। কালক্রমে বৌদ্ধরা সংখ্যায় সংকোচিত হতে থাকলে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য স্থানীয় বৌদ্ধরাও বজ্জিদের অনুকরণে বজ্জি পদবী ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তীতে বজ্জি শব্দ থেকে বড়ুয়া শব্দের উদ্ভব হয়। তবে পঞ্চদশ শতকের শেষ অথবা ষোড়শ শতকের প্রারম্ভ থেকে চট্টগ্রামের বৌদ্ধরা বড়ুয়া পদবি ব্যবহার শুরু করে বলে অনুমিত হয়। এ সময়ে অন্যান্য পদবীরও ব্যবহার ছিল; যেমন-হাজারী, সিং, বিহারী, রাজবংশী, পাল, সিকদার ইত্যাদি। ড. প্রণব কুমার বড়ুয়ার মতে, ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ থেকে ঐ সকল পদবী বিলুপ্ত হয়ে একমাত্র বড়ুয়া পদবী প্রচলিত থাকে। বর্তমানে বাঙ্গালী বৌদ্ধদের সম্প্রদায়গত উপাধি হল বড়ুয়া, এরাই বাংলাদেশের বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়। ষোড়শ শতকের প্রথম পাদের কবি চন্ডীদাসের কবিতার একটি পদে বড়ুয়া শব্দের ব্যবহার দৃষ্ট হয়। তাঁর কবিতার পদটি নিম্নরূপঃ”একে তুমি কুলনারী,কুলে আছে তোমার বৈরী,আর তাহে বড়ুয়ার বধু।”
”বাংলাদেশের বড়ুয়া বৌদ্ধরা মূলত দক্ষিণ পূর্ব বাংলার ষষ্ঠ হতে একাদশ শতাব্দীর প্রাচীন সমতটের সিংহ বংশ, বর্ম বংশ, খড়গ বংশ, ভদ্র বংশ, দেব বংশ, চন্দ্র বংশ, উত্তর বঙ্গের প্রাচীন বাংলার সপ্তম শতাব্দীর বরেন্দ্র ভূমির পাল বংশীয়, চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমান্ত রাজা মনিভদ্র, রাকাই, জয়চন্দ্র ও মুকুট রায়ের পরবর্তী বংশধর। উপরোক্ত বৌদ্ধ রাজন্যবর্গের পরবর্তী বংশধরই বড়ুয়া এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ– প্রাচীন সমতট, বর্তমান কুমিল্লার ময়নামতী, শালবন বিহার, রাজ বিহার (ইট খোলা বিহার), দেব পর্বত, রাজশাহীর পাহাড় পুরের রাজা ধর্মপাল কর্তৃক নির্মিত সোমপুর বিহার, বগুড়ার গোফুল গ্রামের বাসু বিহার, দিনাজপুরের গঙ্গা ও করতোয়া নদীর সঙ্গমস্থলে রামাবতী নগরে রাজা রাম পাল কর্তৃক নির্মিত ‘জগদ্দল বিহার’, ময়নামতী পাহাড়ের দক্ষিণে দেব রাজ কর্তৃক নির্মিত আনন্দ বিহার, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পতি বিহার, চট্টগ্রাম শহরের দেব রাজাদের দেব পাহাড়, পটিয়ার চক্রশালা ইত্যাদি। এসব বিহারের অনুকুল্যেই পুরুষ পরম্পরা বাঙ্গালী বড়ুয়ারা বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা ও অনুশীলন করে আসছেন। যাদের ধর্মচর্চায় বৌদ্ধ বিশ্বের অন্যতম নিকায় থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম নিখূতভাবে বিদ্যমান।

বড়ুয়ারা শত শত বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে (মানছি শুধু চট্টগ্রাম অংশ আরাকান রাজার অধীনে চট্টগ্রামে ছিলো তাও মাত্র ১৪৫৯- ১৬৬৬ পর্যন্ত দুই শত সাত বছরের জন্য, ইংরেজরাও আমাদের প্রায় ২০০ বছর শাসন করেছে। তবে আমরা কি ইংরেজ?)। শত শত বছর ধরে বাংলাদেশে (মাত্র ২০৭ বছর বার্মার অধীনে এবং ১৯০ বছর ইংরেজদের অধীনে) বসবাস করে আসা জাতটার আদি পিতা ভারতের হলেও এখন অবশ্যই তারা বাঙালী। আমরা বাঙালী বড়ুয়া বৌদ্ধ জাতি। ইতিহাসকে কখনোই মিথ্যা বানানো যায় না।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের ‘বড়ুয়া’ জনগোষ্ঠী এদেশের আদিবাসী, স্বতন্ত্র জাতি, এদেশের ভূমিজ ও দেশজ সন্তান। দীর্ঘকালে ঘাত-প্রতিঘাতের পর রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বড়ুয়াদের আচার- অনুষ্ঠানে, কৃষ্টিতে ও সামাজিক জীবনে হিন্দু- মুসলমান প্রভাব পরিলক্ষিত হলেও তাদের নিজস্ব যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে এগুলি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। বড়ুয়ারা এখন বাংলাদেশের এক উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়। বাংলাদেশের বড়ুয়ারা আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বড়ুয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, দিল্লী ও মুম্বাইতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে, বার্মাতেও প্রচুর বড়ুয়া রয়েছে। এছাড়া এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বহু শহরেও বহু বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায় অনেক অগ্রসর এবং বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সামগ্রিক অগ্রগতিতে বড়ুয়া বৌদ্ধদের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত ও ক্রীড়ায় বড়ুয়াদের কৃতিত্ব সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গর্ব। বড়ুয়াদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হল সরলতা, সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, বিশ্বাস, একতা, আতিথেয়তা ও দানশীলতা। এরা সাধারণত সমবেত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং দুর্যোগ ও বিপদের সময় ঐক্যবদ্ধ থাকে। বড়ুয়ারা আচরণে, কথাবার্তায় অত্যন্ত বিনয়ী এবং সংযমী। এদিক থেকে তারা সার্থক বৌদ্ধ। তারা অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, একে অপরের যে কোন সাহায্যে এগিয়ে আসে।

বাংলাদেশের বড়ুয়া সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণীরা এবং যুবক-যুবতীরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও নিজ ধর্ম, কৃষ্টি ও এতিহ্যের প্রতি কখনো আস্থা হারায়নি এটা অতীব গৌরবনীয় বিষয়। বড়ুয়ারা আজ উন্নত সম্প্রদায়, প্রকৃত বৌদ্ধাদর্শে প্রতিষ্ঠিত, সুমহান ঐতিহ্যের অধিকারী এবং উন্নতির পথে অগ্রসরমান। বৌদ্ধ পুরাকীর্তি, প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ এ দেশের ঐতিহ্য ও গর্ব । ইহা প্রাচীন বাংলার নিদর্শন। আর এসব প্রাচীন পুরাকীর্তির পুরুষ পরম্পরা উত্তরসূরী হচ্ছে বাঙ্গালী বড়ুয়া বৌদ্ধ, যা এতক্ষণের আংশিক আলোচনায় আমরা নিঃসন্দেহে অবগত হয়েছি। তবে বর্তমানে কালের প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই বড়ুয়া জাতি, তাদের পূর্বের ঐতিহ্য কতটুকু ধারণ করতে পাচ্ছে – তা বস্তুত প্রশ্নের সম্মুখীন। ইতিহাস জাতির সম্পদ। যে জাতির ইতিহাস নেই, সেই জাতির ঐহিত্য নেই। যে জাতি ইতিহাস জানে না সে জাতি আত্মভোলা জাতি। তাই কালের প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধদের ইতিহাস সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান থাকা অতীব জরুরী।

পরিশেষে, এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে সকলের প্রতি বিশেষকরে আধুনিকতায় শিক্ষিত তরুণ বৌদ্ধ ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সেই ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর সজাগদৃষ্টি ও আত্ম সচেতনতা সৃষ্টির উদাত্ত আহবান জানাই।

তথ্য সংগ্রহ

 বড়ুয়া বৌদ্ধদের আদিকথা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট,বোধিমিত্র বড়ুয়া, ২০১০; পৃ:০৬২। বড়ুয়া জাতি, উমেশচন্দ্র মুৎসুদ্দি, ১৯৫৯; পৃ: ০৫৩। বাংলা একাডেমী অভিধান, পৃ:৮২৪৪। সদ্ধর্মের পুনরুত্থান, পণ্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির, ১৯৬৪; পৃ: ১৫-১৬৫। বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, ড.দীপংকর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া, ২০০৭; পৃ: ১১৯৬। বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া, পৃ :১৪৫ ও সদ্ধর্ম রত্নাকর, পণ্ডিত ধর্মতিলক স্থবির, পৃ:৪৩৯৭। চট্টগ্রামের বৌদ্ধ জাতির ইতিহাস, নতুন চন্দ্র বড়ুয়া, ১৯৮৬; পৃ: ৩৫৮। বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া, প্রাগুক্ত, পৃ : ১৪৫৯। বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ : ১১৭১০। বাঙ্গালী বৌদ্ধদের ইতিহাস ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাগুক্ত, পৃ : ১২০।১১। বাংলাদেশের বড়ুয়া জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সুনীতি রঞ্জন বড়ুয়া, ১৯৯৬; পৃ: ১৮-১৯ ।১২। বাংলাপিডিয়া http://bn.banglapedia.org/index.php১৩। এবং বিশেষ কৃতজ্ঞতা পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের কাছে।

error: Content is protected !!