নিন্দা ও কুৎসা সর্ম্পকে বৌদ্ধ ধ্যান-ধারণা (The Buddhist Concept On animadversion and calumny)
———–ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়
মানুষ স্বভাবত অষ্ট লোকধর্মের অধীন।বৌদ্ধধর্মে অষ্টলোক ধর্ম বলতে লাভ-অলাভ, যশ-অযশ, সুখ- দু:খ, নিন্দা- প্রশংসা।যেহেতু এ অষ্ট লোকধর্মের অধীন মানব জীবন বুদ্ধ তাতে চিত্তকে কম্পি না করে অপ্রমাদের সাথে জীবন অতিবাহিত করতে বলেছেন।অনেক সময় মানুষ অতি প্রশংসায় যেমন খেল হারিয়ে ফেলে আবার নিন্দা, কুৎসা শুনেও ধৈর্য্য হারিয়ে জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। বুদ্ধ ত্রিপিটকের অনেক জায়গায় এ বিষয়ে মানুষকে সৎ ধারণা দিয়েছেন।অনেক মহাপুরুষেরাও এ বিষয়টি নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একবার জানানো হয়েছিল, একটা লোক তাঁর খুব নিন্দা করছে, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছে। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন‘লোকটার কখনো কোন উপকার করেছি বলে তেমনে হচ্ছে না।’ অর্থ্যাৎ কারো উপকার করলে তার কাছ থেকে নিন্দা ও কুৎসা শোনাই হচ্ছে যিনি উপকার করেন তার বিধিলিপি।
পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দেওয়ার লোক নেই! সামনে দাঁড়িয়ে পথ দেখানোর লোক নেই! কিন্তু পিছনে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করার অনেক লোক আছে।-এ কথা বলেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি -এ.পি.জে আব্দুল কালাম।
‘নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়’ -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(গোরা)।মহামানবেরা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়েই উক্ত বাণী গুলো লিপিবদ্ধ করেছেন।ভগবান বুদ্ধও মুক্ত পুরুষ হতে এর থেকে রক্ষা পায়নি।
এক দিন বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীর জেতবনে ধর্মোপদেশ দিচ্ছিলেন চিঞ্চা নামে অপরূপরূপবতী এক নারী সেখানে এসে সোজা বুদ্ধের কাছে গিয়ে বললÑআপনার দ্বারাই আমি গর্ভবতী হয়েছি, এবার আপনি আমার ভার নিন। চিঞ্চাকে সেখানে পাঠিয়েছিল বুদ্ধ বিরোধী কিছু সন্ন্যাসী, উদ্দেশ্য বুদ্ধের নামে মিথ্যা কুৎসা আর অপবাদের প্রচার। চিঞ্চার আকস্মিক আবির্ভাব আর তার চাঞ্চল্যকর উক্তিতে সভাস্থ সবাই যখন হতবাক, দেবরাজ ইন্দ্র তখন তাঁর চারজন অনুচর নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। অনুচরদের একজন ইন্দ্রের আদেমে ইদুর হয়ে চিঞ্চার বস্ত্রের অভ্যন্তরে ঢুকে একটা রজ্জু বন্ধন কেটে দিতেই তার নকল গর্ভ খসে পড়ল, মুহূর্তে তার ঐ হীন চাতুরী প্রকাশ হয়ে পড়তেই ক্রুদ্ধ জনসাধারণ তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর যথোচিত প্রহার করে সেখান থেকে বিদায় করল তাকে। চিঞ্চা কোন রকম সভা প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসতেই ধরিত্রী মুখব্যাদান করে তাকে অবিচী নরকে গ্রাস করল। ছলনাময়ী নারীর এই ভীষণ পরিণতি সম্বন্ধে ভিক্ষুরা যখন আলোচনা করছিলেন, বুদ্ধ তাদের বললেন
“একং ধম্মং অতীতস্স মুসাবাস্সি জন্তনো
বিতিন্ন পরলোকস্স নত্থি পাপং অকারিয়ং। ধম্মপদ-১৭৬
অর্থ্যাৎ-ধর্ম লঙনকারী, মিথ্যাবাদী এবং পরলোকে আস্থাহীন লোকের অকরণীয় পাপ নেই।
সত্যের থেকে বড় আশ্রয় আর কিছু নেই মানুষের। তাকে ছেড়ে যে মিথ্যাকে অবলম্বন করে সে স্বেচ্ছায় দুঃখকে বরণ করে নেয়। কেননা মিথ্যা থেকে সহ¯্র পাপের উৎপত্তি, তাই মিথ্যাশ্রয়ী ক্রমেই অধঃপতনের অতলে তলায়/ আর এমন পাপ কাজ নেই যা সে করতে পারেনা।বুদ্ধবাণীতে দেখা যায়—-
‘পোরাণমেতং অতুল নেতং অজ্জতনামিব।
নিন্দন্তি তুণহিমাসীণং নিন্দন্তি বহুভাণিনং
মিতভাণিনম্পি নিন্দন্তি নত্থি লোকে অনিন্দিতো ॥
ন চাহু ন চ ভবিস্সতি ন চেতরহি বিজ্জতি
একন্তং নিন্দিতো পোসো একন্তং বা পসংসিতো ॥’ধর্মপদ/২২৭
“হে অতুল, ইহা চিরকালেরই কথা একান্ত নিন্দিত কিংবা একান্ত প্রশংসিত ব্যক্তি অতীতে ছিল না, ভবিষ্যতে হবেনা, এখনও বিদ্যামান নেই।”
নিন্দুকের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা কোনভাবে সম্ভব নয়।অতিভাষী,মিতভাষী, মৌনি প্রক্যেকের কিছু না কিছু দোষ সে খুঁজে বের করবে।হেন ব্যক্তি নেই যে তার সমালোচনার অতীত।তবে নিন্দার হাত থেকেও যেমন মানুষের নিষ্কৃতি নেই তেমনি এমনও কেউ নেই যে শুধু নিন্দাই লাভ করেছে।নিছক প্রশংসার পাত্র যে কেউ নেই তা তো বলাই বাহুল্য।এই যখন জগতের রীতি তখন লোকের নিন্দা -প্রশংসার প্রতি অযথা মূল্য আরোপ করা অবশ্যই অর্থহীন। সত্যের বা ধর্মের পথ লোকের নিন্দা-প্রশংসার দ্বারা নির্ধারিত হয়না।একমাত্র জ্ঞানীরাই তার সন্ধান জানেন।তাই তারা সব কিছু দেখে সমস্ত দিক বিবেচনা করে যাঁকে প্রশংসার যোগ্য মনে করেন তিনি কষ্টিপাথরে যাচাই করা সোনার মতই খাঁটি।সত্যে, শীলে, জ্ঞানে,ধর্মে প্রতিষ্ঠিত সেই পুরুষোত্তম বাস্তবিক সর্বজনীন প্রশংসার যোগ্য।
বুদ্ধ বলেছেনÑ‘অন্যের কৃত বা অকৃত ত্রুটি বিচ্যুতির ও কার্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত নয়। যে সর্বদা অন্যের ছিদ্রান্বেষণ বা ভৎসনা করে তার দোষ সমূহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে আসবক্ষয় হতে দূরবর্তী হয়। অপরের দোষ সহজেই চোখে পড়ে, নিজের দোষ দেখা কঠিন। বাতাসে শস্যের ভূষি উড়িয়ে দেওয়ার মত করে মানুষ পরের দোষ গুলো প্রকাশ করে। কিন্তু ধূর্ত ব্যাধের আত্ম গোপনের ন্যায় নিজের দোষ গোপন করে।’
বুদ্ধ বলেছেন- লোকে নীরবে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে নিন্দা করে, তেমনি বহু ভাষীকে এবং মিতভাষীকেও নিন্দা করে। তাই পৃথিবীতে কোনো অনিন্দনীয় ব্যক্তি নেই। একান্ত নিন্দিত কিংবা একান্ত প্রশংসিত ব্যক্তি নেই। একান্ত নিন্দিত কিংবা একান্ত প্রশংসিত ব্যক্তি অতীতেও ছিলনা, ভবিষ্যতেও হবেনা, এখনও বিদ্যমান নেই।
যার দ্বারা স্বর্গ মোক্ষের অন্তরায় হয়, তাকে অন্তারায়িক কর্ম বলে। তা আবার কর্ম, ক্লেশ, বিপাক, অপবাদ ও আদেশ অতিক্রম ভেদে পাঁচপ্রকার। পঞ্চ অন্তারায়িক কর্ম সমূহকে কর্ম-অন্তারায়িক বলে। ভিক্ষুণী দূষন কর্মও সেরূপ কর্ম-অন্তারায়িক মধ্যে গণ্য। তদ্বারা মাত্র মোক্ষ লাভের অন্তরায় হয়। কিন্তু স্বর্গ সম্পদ লাভের অন্তরায় ঘটেনা। নিয়ত মিথ্যা দৃষ্টি, ক্লেশ অন্তরায়িকা অর্থ্যাৎ ক্লেশ ধ্বংসের অন্তরায় করে। নপুংসক ও তির্যক যোনিতে জন্মগ্রহণ বিপাক অন্তরায়।
যারা আর্য অপবাদ করে, নানা রকম কুৎসারটায় তা আর্য অপবাদ বলে কথিত। আর্য অপবাদ করলে বুদ্ধ, পচ্চেক বুদ্ধ ও বুদ্ধের শ্রাবকদের প্রতি এমনকি গৃহী আর্য শ্রাবকের পর্যন্ত অনিষ্ট কামী হয়ে অন্তিম বস্তু(পারাজিকা আপত্তি অথবা সদগুণ ক্ষয় কর কোন বিষয়ের দ্বারা উপবাদ, আক্রোশ ও নিন্দাকারী বুঝায়। এদের শ্রমণধর্ম নেই, এরা অশ্রমণ ইত্যাদি অপবাদ করলে তাকে‘অন্তিমবস্তু’ দ্বারা উপবাদক বলে। এদের জ্ঞান নেই, মার্গ নেই, ফলও নেই অর্থ্যাৎ লাভ হবে না ইত্যাদি গুণ ক্ষয় কর অপবাদ বাক্যে আর্য পুদ্গলের অপবাদ করলে, জেনে করুক আর না জেনে করুক আর্য অপবাদের মধ্যে পরিগণিত হয়। এ অপবাদের কর্মও অতি গুরুতর আনন্তরিক কর্মের মতোÑ স্বর্গ মোক্ষ লাভের অন্তরায়কর। তাসচেতননা হলে কর্ম বিস্তৃতি হয়ে ফল প্রদান করে।
চিঞ্চা মানবিকা বুদ্ধ নিন্দা করে অবিচি নরকে পতিত হয়েছিলেন। কবিগুরু রবন্দ্রিনাথ ঠাকুর বলেছেন
‘মরে না মরে না কভু সত্য যাহা
শত শতাব্দীর বিস্মৃতির তলে;
নাহি করে উপেক্ষায় অপমানে
না হয় অস্থির আঘাতে না টলে’।
পুণ্যত্মা সমাজের দ্বারা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন যে বিদ্বেষ-বুদ্ধি এবং বৃথাগর্ব ও স্বার্থন্বেষী অহংকার তুষ্টির নিমিত্ত ঘৃণা দোষ সমূহ হতে ঝগড়া বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
বুদ্ধ বলেছেন -যদি কেউ মূর্খতাবশত আমার প্রতি অন্যায় করে, আমি প্রতিদানে অকাতরে তার উপর প্রীতি বর্ষণ করব, অমঙ্গলের প্রতিদানে আমি মঙ্গল বিতরণ করব, সাধুতার সৌরভ সর্বক্ষণ আমি অনুভব করব, অমঙ্গলের অনিষ্টকর বায়ু তাকে স্পর্শ করবে।
বুদ্ধ অমঙ্গলের প্রতিদানে মঙ্গল বিতরণ করেন শুনে এক নির্বোধ বুদ্ধের নিকট এসে বুদ্ধের নিন্দা করল। বুদ্ধ তার নির্বুদ্ধিতার করুণাবশত হয়ে নীরব রইলেন। নির্বোধ তার নিন্দাবাদ সমাপ্ত হলে বুদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করলেন বৎস, যদি কোনো ব্যক্তি উপহার দ্রব্য নিতে অস্বীকার করে তাহলে ঐ দ্রব্য কার হবে? সে উত্তরে বললেন তাহলে সেটা প্রদান কারীর হবে।
বুদ্ধ বললেন-বৎস, তুমি আমাকে দুর্বাক্য আমি নেব না, তুমি নিজের জন্য রেখে দাও। যাকি তোমার যাতনার কারণ হবে না? প্রতিধ্বনি যেরূপ শব্দের অনুগামি, ছায়া যেরূপ দ্রব্যের অনুগামি, সেরূপ যাতনাও দুষ্কৃতের অনুগমন করবেই।
নিন্দুক কোনো উত্তর করলো না। বুদ্ধ তথাপি আবার বললেন দুষ্টের পক্ষে সাধুকে ভৎসনা করা এবং উর্দ্ধে আকাশে নিবিষ্টা নিক্ষেপ করা একই প্রকার। নিষ্টীবন আকাশকে মলিন করেনা, উহা ফিরে এসে নিক্ষেপকারীকে অপবিত্র করে।
নিন্দুক এবং প্রতিকূল বায়ুতে অপরের প্রতি ধুলি নিক্ষেপকারী একই, ধুলি ফিরে এসে নিক্ষেপকারীর উপর পতিত হয়। ধার্মিকের কোন অনিষ্ট হয়না কিন্তু নিন্দুক যে অনিষ্ট করার কল্পনা করে উহা তার নিজের উপর পতিত হয়। নিন্দুক লজ্জিত হয়ে চলে গেল, সে পুনরায় বুদ্ধের শরণ নিলেন।যারা প্রব্রজিৎতের বিরুদ্ধাচরণ কিংবা নিন্দা অপবাদ দিয়ে থাকে তারা জন্মান্তরে অনেক দু:খ ভোগ করে থাকে।তাদের কিছুতেই সুখ শান্তি হয়েছে তার কোন নজির নেই।
বৌদ্ধ শাস্ত্র অনুযায়ী বলা যায়
যেমন করিবে কর্ম সেই রূপ ফল
পাবে সবে এ জগতে না হবে বিফল।
বেশীর ভাগই যে ছেলে-মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে অর্থ্যাৎ সদ্ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মের সাথে গেছে তাদের প্রেমের টানটাই বেশী পরিলক্ষিত হয়।কোন নিন্দা বা কুৎসার কারণে নয়।নিন্দা-কুৎসা কারা রটনা করে, যারা কারো প্রতিভার সাথে পেরে উঠতে পারেনা।সর্বশেষ নিন্দা-কুৎসা রটনা কারীর পরাজয় হয়।সত্য-ন্যায়ের জয় সব সময়। সাময়িক কষ্ট পায় হয়তো। মনকে শক্ত করে ন্যায় এর পথে থাকলে তাদের সাথে কেউ পেরে উঠে না।
জৈনিক কবি লেখেছিলেন—
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরে আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধ ুযারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মত থাকবে পাছে পাছে।
নিন্দুক সে বেঁচে থাকুক বিশ্ব হিতের তরে
আমার আশাপূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে।

*ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়: সম্পাদক ॥সৌগত, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন

error: Content is protected !!