বুদ্ধত্ব প্রার্থনায় যে আটটি গুণ (অভিনীহার) অবশ্যই থাকা দরকার
__________________________________
লিখেছেনঃ জ্যোতিআর্য ভিক্ষু

পৃথিবীতে বহুকল্প পরে ১জন সম্যক সম্বুদ্ধ উৎপন্ন হন। যেমন আমরা অষ্টবিংশতি বন্দনায় ২৮জন বুদ্ধের সুদীর্ঘ পরিচয় পেয়ে থাকি। উক্ত সকল বুদ্ধগণ পৃথিবীবাসীর জন্য যে অপ্রমেয় ত্যাগ, তিতিক্ষা ও নির্বাণ প্রদায়ী ধর্ম দান দিয়ে যুগ থেকে যুগান্তরে আত্মমুক্তি ও পরকল্যাণে পরম ব্রতী হন সেই উদ্ভাসিত ময় জীবন লাভের জন্য স্বয়ং বুদ্ধও আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। বুদ্ধ বলেন, “প্রাণের প্রিয় ভিক্ষু — ভিক্ষুণী, উপাসক — উপাসিকাগণ পৃথিবীতে সকল প্রাণী বুদ্ধ হওয়ার উপযুক্ত। যার জন্য প্রার্থীদের সাধনা করে এগিয়ে যেতে হবে।”

যেসকল বুদ্ধত্ব প্রার্থীগণ একজন বুদ্ধের কাজ থেকে পনিধান লাভ বা যারা বোধিসত্ত্ব হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেন তাদের ঐ মুহুর্তে ৮টি গুনে বা সম্পদে পরিপূর্ণ থাকতে হবে। ঐ সমস্ত গুণ পারমিতা ধর্মের প্রত্যয়ও বটে। আলোচ্যাংশে বিস্তারিত উপাস্থাপন করা হল:–

(১) “মনুস্সত্তং” —– যিনি বুদ্ধত্ব প্রার্থনা করবেন তাকে অবশ্যই মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করতে হবে। তাকে মনুষ্যত্ব ভাবে দাড়িয়ে বুদ্ধত্ব লাভ করবার জন্য প্রার্থনা করিলে সিদ্ধ হয়। নাগ, সুপর্ণ( পক্ষীকুল) তির্যক যোনিতে জন্ম গ্রহণ করিলে বুদ্ধ হইবার প্রার্থণা সিদ্ধ হয় না। তা বুদ্ধ হবার অনুপযুক্ত অবস্থা।

(২) “লিঙ্গ –সম্পত্তি” —- মনুষ্য- জন্ম লাভ করিলেও পুরুষ হইয়া জন্ম নিতে হয়। পন্ডক –নপুংসক ও উভয় ব্যঞ্জনকের বুদ্ধ হবার প্রার্থনা করলে সফল হয় না। তদ্ধেতু যথোক্তভাবের কারন সমূহ পরিপূর্ণ না থাকিলে প্রার্থনা করিতে পারে না। তাই কথিত হইয়াছে —-“হে ভিক্ষুগণ! ইহাই অনবকাশের অস্থান ও অসময়। নারী জাতি হইয়া বুদ্ধ হইবার প্রার্থনা পূর্ণ হয় না। তাই মানুষ জন্ম হইয়াও স্ত্রী লিঙ্গে থাকিয়া পন্ডকাদি অবস্থায়ও প্রার্থনা সফল হয় না।

(৩) “হেতূতি” —-উপনিশ্রয় সম্পদ। মনুষ্য জাতিতে জন্ম গ্রহণ হইলেও পুরুষত্বরূপ উপনিশ্রয় ও হেতু সম্পন্ন হয় হইয়া প্রার্থনা করিতে হয়; অন্য লিঙ্গ বিশেষের হয় না।

(৪) “সত্থার দস্সনন্তি” —— সম্যক সম্বুদ্ধের সম্মুখে প্রার্থনা করিতে হয়। জীবিত সম্যক সম্বুদ্ধের নিকট পুণ্য কাজ সম্পাদন করতঃ প্রার্থনা করিতে হয়। ভগবান বুদ্ধ পরিনির্বাপিত হইলে ভগবানের পূতাস্থি চৈত্যে, বোধিমূলে, বুদ্ধপ্রতিবিম্বের সম্মুখে, প্রত্যেক বুদ্ধ ও শ্রাবকগণের সামনে বুদ্ধ হইবার প্রার্থনা করিলে সফল হয় না। কেন? অধিকার দেওয়ার অভাবে। কারণ সম্যক সম্বুদ্ধগণই বুদ্ধ হইবার প্রার্থনাকারীকে অষ্টবিধ অভানীহার জ্ঞাত হইয়া কখন কত সুদীর্ঘ কল্পের পরে বুদ্ধ হইবেন সর্বজ্ঞাতা জ্ঞানে নিখুঁত জ্ঞাত হইয়া আর্শীবাদ ও অধিকার দিতে পারেন। ফলতঃ প্রার্থীর প্রার্থনা সফল না হইয়া বুদ্ধ মুখে দেওয়া অধিকার বিনষ্ঠ হইবার কোন সম্ভবনা থাকে না। যেমন রাজার লিখিত কোন নির্দেশ কোন ব্যক্তির কাছে থাকে তদ্বারা সে রাজকর্মে অধিকার যেমন পাইতে কোন বাধা থাকেনা। রাজআজ্ঞাই বলবৎ থাকে।

(৫) “পব্বজ্জাতি” —— ভগবান বুদ্ধের সম্মুখে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য প্রার্থনা করিবার সময় ভিক্ষু বা কর্মবাদী (তাপস) সন্ন্যাসী হইতে হইবে। গৃহী অবস্থায় থাকিয়া প্রার্থনা করিলে সিদ্ধ হয় না। গৃহী অবস্থা বুদ্ধ হইবার প্রার্থনার অতি নিম্মতম স্তর। মহাবোধিসত্ত্ব যেমন গৃহী ছিলেন না। সুমেধ তাপস নামে প্রব্রজ্জিত থাকিয়া যথাভুত অধিষ্ঠানরূপ গুণ–সম্পদে গুণজ্ঞ ছিলেন।

(৬) “গুণসম্পত্তীতি” ——অভিজ্ঞারূপ গুণ — সম্পদ। আবার প্রব্রজিত হইলেও অষ্ঠ সমাপত্তি ধ্যান লাভ, অথবা পঞ্চাভিজ্ঞা ধ্যান লাভ করিতে হইবে। ঐ ধরণের গুণ–সম্পদ– লাভী না হইলে প্রার্থনা পূর্ণ হয় না। কেন? পারমিতা প্রবিচয়নে (অধিগত) অসমর্থ বা অক্ষমতা থাকা। উপনিশ্রয় সম্পদে ও অভিজ্ঞা সম্পদে অধিকারী হইয়া মহাপুরুষের কৃত্যাভিনীহার স্বয়ং পারমিতা ধর্মাদি প্রবিচয়ন করিতে সমর্থ হয়।

(৭) “অধিকারোতি”——-অধিকতর উপকারক। যথাযথ গুণ–সম্পত্তিতে সমন্বিত হইয়া যিনি নিজের জীবনকে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে পরিত্যাগ করিয়া বুদ্ধ হইবার সংকল্প পরিপূর্ণ করিতে ইচ্ছুক হন—— তাহাই অধিকতর উপকারক ধর্ম বলিয়া বলা হয়েছে —তাঁহারই অভিনীহার সমৃদ্ধি সিদ্ধি লাভ করে।

(৮) “ছান্দাতি” ——- কুশল কর্ম সম্পাদন করিবার অধিকতর আগ্রহ, যিনি একান্তভাবে যথোক্ত ধর্মে সমন্বিত থাকিয়া বুদ্ধকারক ধর্মাদিতে পরমার্থ শক্তি অধিগত করিবার মহত্তম ছন্দ (অপরাজেয় ও অপশ্চাদগামী ইচ্ছা)। মহতী প্রার্থনা (বুদ্ধ না হওয়া যাবৎ বুদ্ধকারক কর্মচ্যুত না হওয়া) তাহার প্রার্থনা ধ্রুব পরিপূর্ণতা লাভ করে। (অর্থ্যাৎ বুদ্ধ হইতে পারেন)।
উদাহরণ:–১
সমস্ত চক্রবালে মহাপ্লাবনে জলময় জলাকার হইয়া পরিপূর্ণ হইলে কেহ যদি নিজের বাহুবলে সাঁতার কাটিয়া পরপারে উত্তীর্ণ হইয়া বুদ্ধ হইতে পারে বলিয়া শুনিতে পায় ——- সেইরূপ দুষ্কর কার্য নির্ভয়ে সম্পাদন করিতে অগ্রসর হন যিনি —– তাহাই ছন্দ বলা হইয়াছে।

উদাহরণ :–২
পুনশ্চ যদি সমস্ত চক্রবালেশিখা বিহীন, ধুঁয়া বিহীন প্রজ্জলিত পরিপূর্ণ থাকে —–সেই জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়া যিনি হাটিয়া যাইতে নির্ভয়ে সাহস করেন, কোন দ্বিধাদ্বন্ধ করেন না —-তাহাই বলা হয় বুদ্ধত্ব লাভের ছন্দ।

পুনশ্চ সমস্ত চক্রবালময় সুতীক্ষ্ণ শক্তিশূল প্রোথিত করিয়া পরিপূর্ণ রাখিলে সেই তীক্ষ্ণ ধারাল শক্তিশূলের উপর পা রাখিয়া নিঃসঙ্কোচে নির্ভয়ে হাটিয়ে যাইতে সঙ্কল্প করেন—– তাহাই বলা হয় বুদ্ধত্ব লাভের ছন
পরিশেষে বলা যায় যে আমরা যারা সামাজিক জীবনে আড়ষ্ট হয়ে আছি আমাদেরও বুদ্ধত্ব লাভের জন্য প্রার্থনা করতে হলে উপরে ৮টি দূর্লভ গুণধর্মকে অনুশরণ করা বাচ্ঞনীয়। সাথে যেসকল গুণ বা অভনীহার আমাদের মধ্যে এখনো সৃষ্টি বা গঠন সেগুলো বৃদ্ধিতে আন্তরিক হবো।

সূত্র : প্রজ্ঞালোক মহাথের’রর পারমিতা গ্রন্থ

error: Content is protected !!