মৃত্যুর প্রকারন্তর

 – সুলেখা বড়ুয়া

 
পঞ্চস্কন্ধের ভেদই মৃত্যু| মৃত্যুকে চ্যুতি চিত্ত ও বলে| এ মরন সর্ব প্রকার কর্মজ গুণানুসারে কেউ দীর্ঘায়ু,কেউ অল্পায়ু হয়ে থাকে| মানবদ্বয় নিজ নিজ কর্মের দ্বারা দু:খ এবং সুখ ভোগ করে|
মানবের মৃত্যু প্রধানত: দুই প্রকার| ১) লোকীয় মৃত্যু এবং ২) লোকোত্তর মৃত্যু|
লোকীয় মৃত্যু তিন প্রকার| ক) ক্ষনিক মৃত্যু, খ)সম্মতি মৃত্যু এবং গ) সমুচ্ছেদ মৃত্যু|
ক্ষনিক মৃত্যুঃ মাতৃগর্ভ হতে যে মুহুর্তে জন্ম হয় আমাদের, সেই ক্ষন থেকে প্রতি মুহুর্তে মরন সংঘঠিত হচ্ছে| আপাতত: আমাদের মোহবৃত চক্ষে তা ধরা না পড়লে ও প্রজ্ঞানেত্রে কিন্তূ তা দেখা যায়|যেমন- জন্মের মুহুর্ত থেকে ক্ষনে ক্ষনে পরিবর্তনের ধারাবাহিক নিয়মানুসারে ‘শিশুকালের’ পর কৈশোরকাল,উপনীত হয়ে থাকে|একই নিয়মে নিয়ত: পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘কৈশোরকাল’ এর পর ‘যৌবনকাল’ গত হলে পৌঢকাল উপস্হিত হয়|ক্রমশ: পৌঢকাল নিয়ত পরিবর্তনের পর ‘বৃদ্ধকালে’ পদার্পন করে| মানুষ কিন্তূ শিশুকাল পার করে যখন কৈশোরে পদার্পন করে,তখন শত চেষ্ঠা করে ও কেউ শিশুকালে ফিরে যেতে পারে না|এভাবে এক একটা কালের মৃত্যু হয়| অবশেষে ক্ষনে ক্ষনে নিয়ত ক্ষয় হয়ে কর্মের নিবন্ধ আয়ুষ্কাল নি:শেষ হওয়ার পর চ্যুতি-চিত্ত বা মরন সংঘঠিত হয়, তাহাই ক্ষনিক মৃত্যু|
সম্মতি মৃত্যুঃ ইহা বলতে বুঝায় সকলের সম্মতিতে মৃত ব্যাক্তি কারো ছেলে, মামা, দাদা, ভগ্নিপতি, পিতা, ভাগিনা, জামাতা অথবা শ্বশুর ইত্যাদি আত্নীয় ও আত্নীয়াদের সন্মতিতে প্রয়াত অমুক বাবু দিবাগত ৭ ঘটিকায় পরলোক গমন করেন| ইহাই সন্মতি মৃত্যু|
সমুচ্ছেদ মৃত্যুঃ মৃত ব্যক্তি এ ভব সংসারে যে নাম বা গোত্র পরিচয়ে দীর্ঘদিন জীবিত ছিলেন| যে আত্মীয়তার আবদ্ধ ও পরিচয় ছিল, যে পেশায় সংসার নির্বাহ করতেন, যে প্রশংসায় ও সম্মানে ভূষিত তথা গৌরবে গৌরবান্বিত! মৃত্যুর পর দেখা যায় তিনি আর পূর্বের সে নাম, গোত্র বা আত্মীয় পরিচয়ে ফিরে আসে না| পুনরায় ফিরে আসতে কেউ দেখে নাই, দেখবে ও না, ইহা অসম্ভব, কারণ তার তিরোধান চিরকালের জন্য।এজন্য ইহাকে সমুচ্ছেদ মৃত্যু বলে।
লোকোত্তর মৃত্যু চার প্রকার। ক) আয়ুক্ষয়ে মৃত্যু, খ) পূন্যক্ষয়ে অথবা কর্মক্ষয়ে মৃত্যু, গ)আয়ু-পূণ্য উভয়ক্ষয়ে মৃত্যু ঘ)উপচ্ছেদক মৃত্যু।
আয়ুক্ষয়ে মৃত্যুঃ সত্ত্বগন যে ভবে উৎপন্ন হয়; সে ভবে প্রতিসন্ধি নেওয়ার সময় যে কর্ম বলে আয়ু নির্ধারিত থাকে।সে দীর্ঘতম আয়ুর সুপরিমিত আয়ু ক্ষয় হয়ে গেলে,যখন কোন সত্ত্ব দেহ ত্যাগ করে তখন তাকে আয়ুক্ষয়ে মৃত্যু বলে।
পূণ্যক্ষয়ে মৃত্যুঃ জনক কর্ম প্রদত্ত পূণ্যক্ষয় হলে মৃত্যু হয়।তা কিরূপ? যেমন- কোন ব্যক্তি মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব হতে আহার করার ইচ্ছা হয় না। অথবা পথ্য বা আহারের অভাব ঘটে। তার জন্য নির্বাচিত ঔষধ পাওয়া যায় না। অনেক সময় মরণাপন্ন কালে ডাক্তার পাওয়া যায় না কিংবা অতিকষ্টে সন্ধান পেলে ও প্রয়োজনীয় ঔষধ মিলানো সংকট হয়। কষ্ট সন্ধানে পাওয়া গেলে ও মুমুর্ষ ব্যাক্তি গলাধ: করন করতে সক্ষম হয় না। এমন কি অনেক সময় দেখা যায়, কোন মুমুর্ষ ব্যক্তি গ্লুকোজের জল, আঙ্গুরের রস,মধু ইত্যাদি পানীয় দ্রব্য মুখে দিলে তা জিহ্বা দ্বারা ঠেলে ফেরে দেয়। ইহাকে পূন্যক্ষয়ে বা কর্মক্ষয়ে মৃত্যু বলে।
আয়ু-পূন্য উভয় ক্ষয়ে মৃত্যুঃ সাধারণত: শীলবান, দানাদি পূন্যকর্ম ও ভাবনাদি কুশল কর্মে শ্রদ্ধা সম্পন্ন ব্যাক্তিগন কথা বলতে বলতে স্বজ্ঞানে সদ্ধর্ম সুত্রাদি শ্রবন করতে করতে মৃত্যুবরণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বুদ্ধের জীবিত কালে শ্রাবস্তীর এক ধনাঢ্য উপাসক ভগবান বুদ্ধের নিকট প্রাথর্না করে নিমন্ত্রিত ভিক্ষু সংঘ দ্বারা সুত্র শ্রবন করতে করতে যখন মরণাসন্ন কাল উপস্হিত হল, তখন ছয়টি দেবলোক হতে ছয়খানা দিব্যরথ উপস্হিত হয়েছিল।রথের সারথিরা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ রথে উঠবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। তাতে গন্ডগোল হওয়াতে ধার্মিক উপাসক তাঁদের থামতে বললে্’ ভিক্ষু সংঘ মনে করলেন, বোধহয় তাদেরকেই সূত্র পাঠ বন্ধ করতে বলেছেন। তাই ভিক্ষু সংঘ সুত্র পাঠ বন্ধ করে বিহারে চলে গেলেন। অত:পর বুদ্ধ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- তোমরা চলে এসেছ কেন? উনারা আদ্য-পান্ত সব কথা বুদ্ধক নিবেদন করলেন। উত্তরে বুদ্ধ বললেন্ উপাসক তোমাদেরকে নিষেধ করেন নাই।ছয় দেবলোকের সারথিকে নিষেধ করেছেন। ভিক্ষু সংঘ বললে্ন- পুনরায় আমরা কি যাব? তখন বুদ্ধ বললে্ন, এখন গিয়ে কোন ফল হবে না।
এদিকে উপাসকের সংজ্ঞা ফিরে আসলে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভিক্ষু সংঘ কেন সুত্র পাঠ করছেন না? উত্তরে সবাই বললে্ন, আপনি নিষেধ করেছেন, এজন্য ভন্তেরা বিহারে চলে গেছেন। তখন উপাসক বললে্ন, আমি ভিক্ষু সংঘকে কিছু বলি নাই, বলেছি দেবলোক হতে আগত দেব সারথিদেরকে। তখন উপস্হিত সকলেই বললে্ন, আমরা সেই দেবরথ দেখতে পাচ্ছি না! উপাসক বললে্ন, তোমরা যখন দেখবার উপযুক্ত হবে তখন দেখবে। অত:পর উপাসক বললে্ন, তোমরা সকলে কোন দেবলোক পছন্দ কর? সবাই বললে্ন, তুষিত দেবলোক! তবে একটি ফুলের মালা রচনা করে পছন্দ দেবলোকের উদ্দেশ্যে উপর দিকে ছুরে দাও। তা করা হল। তখন সে ফুলের মালা তুষিত দেবলোকের খুঁটিত আটকে শূন্যে ঝুলে রহিল। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে উপাসক সে রথে করে দেবলোকে চলে গেলেন। সুতরাং ইহাতে বুঝা যায়, যাঁরা ধার্মিক পরায়ন, তারা আয়ু পূন্য উভয়ক্ষয়ে সদজ্ঞানে কালগত হন।
উপচ্ছেদক মৃত্যু বা অকাল মৃত্যুঃ আয়ু ও কর্ম উভয় শক্তি বিদ্যমান থাকাকালীন কোন বিরুদ্ধ শক্তির প্রভাবে কেউ মৃত্যু মুখে পতিত হলে, তাকে উপচ্ছেদক মৃত্যু বলা হয়। উপচ্ছেদক কর্মের দ্বারা উপচ্ছেদকে মৃত্যু ঘটে। যেমনঃ কেউ যদি কোন প্রাণীকে তার আয়ু বর্তমান থাকাকালীন অকালে মৃত্যু ঘটায়। সে অসময়ে মৃত্যু ঘটানোই অকাল মৃত্যু বা উপচ্ছেদক মৃত্যু। সে কর্ম বর্তমান জীবনে অনুরূপ উপচ্ছেদক কর্ম কারো দ্বারা সম্পাদিত হলে, যদি সে মুহূর্তে অতীত বিপাক সংযোগ সাধন হয় অথবা প্রতিঘ চিত্ত উপচিত হয়। তবে কেউ কেউ বৃক্ষ হতে পরে, নৌকা ডুবে, স্টীমার বা উড়োজাহাজ তথা সড়ক দূর্ঘটনায়, ট্রেনের লাইনচ্যুত হয়ে, কাটাকাটি, মারামারি, গোলা-গুলি, ইদানীং মানুষ মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ঠ হয়ে ইত্যাদি দুর্ঘটনার দ্বারা অকাল মরন হয়। তদুপরি সন্নিপাত রোগ যেমন- ক্যান্সার, রক্তচাপ, ব্রেইন টিউমার ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধি দ্বারা যে অকাল মৃত্যু হয়, তা উপচ্ছেদক মৃত্যু।
সাধারণত: মৃত্যুর সময় যা করা উচিত এবং উচিত না। মৃত্যুর পূর্বে সকল প্রাণীর শরীরের শক্তি হ্রাস পায়, তাই সব প্রাণীই দূর্বল হয়ে পরে। মানুষ যখন মৃত্যু সমীপবর্তী হয় তখন নাকের আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে শ্বাস- প্রশ্বাস গ্রহন করতে পারে না বিধায় অনেক সময় হা করে মুখ দিয়ে সহজ পথে নিশ্বাস নেয়। তখন প্রকৃতপক্ষে যেটা করা উচিত না, আমরা সেটাই করে থাকি। যেমন- মৃত্যু পথযাত্রীর ছেলে বা মেয়ে বিদেশে থাকে, তার নামে একটু ঢাবের পানি, মধু অথবা মিছিরির পানি খাও বলে মৃত্যু যাত্রীর মুখে ঢুকিয়ে দিই। ঐ ব্যাক্তি যখন নিশ্বাস নেওয়ার জন্য হা করে থাকে, সেই দিকে যদি পানি দেওয়া হয় তখন তার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে? তখন কিন্তূ তাঁহার মনের ভেতরে রাগচিত্ত উৎপন্ন হতে পারে। এ রাগ চিত্ত মৃত ব্যাক্তির চরম ক্ষতি হয়। মৃত্যুর সময় যদি মৃত্যু পথযাত্রী রাগ চিত্ত উৎপন্ন হয়ে মারা যায়, মৃত্যুর পর সর্প যোনিতে জন্ম হয়। সম্রাট অশোক এবং এরকাপত্র এর প্রকৃত উদাহরণ।
সম্রাট অশোক, যিনি এতো দান করার পর মৃত্যুর সময় রাগচিত্তের কারণে মৃত্যুর পর সর্প যোনিতে জম্ম নিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধের সময় এরকাপত্র নামক জনৈক দিব্য নাগরাজ, যিনি কাস্যপ বুদ্ধের সময় এক ধ্যানী ভিক্ষু ছিলেন। তা হলে আমাদের মৃত্যুর সময় কি করা উচিত? ঘরের দরজা-জানলা খুলে দিয়ে, একজন ভন্তের মাধ্যমে সূত্র পাঠ করলে ভাল হয়। যদি ভন্তে পাওয়া না যায় সূত্র কেসেট চালালে ও কাজ হয়। তাও যদি সম্ভব না হয় তা হলে যে কেউ একজন পালিতে সূত্র পাঠ করতে পারলে মঙ্গল হয়। কারণ মানুষ মারা যাওয়ার সময় অনেক ভাল এবং খারাপ দেবতা নিতে আসে। সূত্র পাঠ করলে সেখানে খারাপ দেবতারা থাকতে পারে না, তাই ভাল দেবতারা থেকে ভাল জায়গায় নিয়ে যায়। কি কি পূন্য কাজ করেছে তা মনে করিয়ে দিতে হবে মৃত্যু পথযাত্রীকে। বুদ্ধের ছবি দেখাতে হবে, যেন- বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের স্মরণ নিতে পারে মনে মনে। আর যদি উনি ভাবনাকারী হন, তাহলে কানে কানে বলতে হবে তোমার যেমন লাগে মনে মনে তেমন স্মৃতি করেন। যদি স্মৃতি করতে করতে মৃত্যু হয়, তাহলে সকল মৃত্যর থেকে এ মৃত্যু শ্রেয়! এ বিদর্শন ভাবনা সবসময় চর্চা করলে মৃত্যুর সময় ও ভাবনা অনেক সাহায্য করে।
“জগতের সকল প্রাণী দু:খ থেকে মুক্তি লাভ করুক”।
বি:দ্র:- উৎস গ্রন্হ আর্যশ্রাবক প্রয়াতঃ বোধিপাল শ্রামণের “লোকোত্তর প্রদীপ”এবং বির্দশন ভাবনা চলাকালীন দেশনালব্দ জ্ঞানের আলোকে এ লেখা।
error: Content is protected !!