অশোক লিপি
ড. বরসম্বোধি ভিক্ষু
সম্রাট অশোকের রাজত্ব ছিল অখন্ড ভারতবর্ষের সর্বত্র। অখন্ড ভারত বলতে বর্তমানের ভারত ছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ ও মধ্য এশিয়ার অনেক বিস্তৃত অণ্চল পর্যন্ত ছিল। সর্বত্র তিনি পাথরে, পর্বতে বুদ্ধের মানব তথা সর্ব জনকল্যাণকর শিক্ষা ও উপদেশ সমূহ সকলের জ্ঞাতার্থে লিখে প্রচার করেছিলেন। যা অশোক শিলালিপি বা অভিলেখ নামে বর্তমানে পরিচিত।
কলিঙ্গ যুদ্ধের নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর শান্তির অন্বেষায় মহান সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজেকে বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে উৎসর্গ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মকে সার্বজনীন ও বিশ্বধর্মে পরিণত করেন। তাঁর রাজত্বকালে বৌদ্ধধর্ম ভারত ভূখণ্ড ছাডিয়ে এশিয়ার বিশাল আয়তন ও ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। তিনি বৌদ্ধধর্মকে কেন আপন করে নিলেন এজন্য ব্রাহ্মণেরা তাঁকে শত্রুরূপে মনে করতেন। ব্রাহ্মণদের রোষানলের শিকার হয়েছিল সম্রাট অশোক এ একটি মাত্র কারণে। বৌদ্ধধর্মের অপব্যখ্যার সাথে সাথে ব্রাহ্মণেরা সম্রাট অশোককেও করেছিলেন বিকৃত। সংস্কৃত শব্দকোষে অশোকের সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি গর্দভনন্দন, মহামুর্খ। ধ্বংস করেছিল তাঁর শিলালিপি। এমনকি ভারতবর্ষের ইতিহাস হতেও তাঁকে মুছে ফেলা হয়েছিল। চণ্ডাশোকরূপেও ব্রাহ্মণেরা আখ্যায়িত করেছেন তাঁকে।
বৃটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত সম্রাট অশেককে ভারতবাসী জানতে পারেনি। বৃটিশেরাই সম্রাট অশোককে ভারতবর্ষে পুর্নবাসন করে ইতিহাসে স্থান দেন।
মধ্যকালে সর্বপ্রথম সম্রাট অশোকের শিলালিপি আবিস্কৃত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে বাদশাহ ফিরোজ শাহ তুগলগ দু’টি বিশাল অশোক স্তম্ভ উত্তর প্রদেশের টোপরাও মেরট হতে অনেক পরিশ্রম করে লোক মারফত দিল্লিতে আনিয়েছিলেন। তিনি যখন স্তম্ভদ্বয়ে কিছু লেখা দেখেন তাঁর মনে কৌতুহল জাগে তাতে কি লেখা হয়েছে তা জানার জন্য। কিন্তু কেহ সেগুলো পড়ে তখন পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। তৎকালীন অনেক বিদ্বানকে তিনি আহ্বান করেছিলেন তা পড়ার জন্য। কিন্তু কেহ সফলকাম হননি। বাদশাহ্ আকবরও লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনিও ব্যর্থ হন। পড়ার মত কোন বিদ্বান তিনি সে সময় খুঁজে পাননি।
পরবর্তীতে ইংরেজরা যখন ভারতে আসেন তাঁরাও এগুলি দেখে পাঠোদ্ধারে সবিশেষ মনযোগী হয়েছিলেন। প্রথম দিকে তাঁরা অনেক প্রচেষ্টা করেছিলেন। পরে স্যার উইলিয়ম জোন্স শিলালিপি সমূহের ছাপ পাঠিয়েছিলেন বারাণসীর তৎকালীন এক হাকিমের কাছে পাঠোদ্ধারের জন্য। তিনি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন যে, আপনি নিজে না পারলেও বারাণসীর অন্য কোন বিদ্বানের দ্বারা এগুলি পড়ার ব্যবস্থা করুন। তিনি মনে করেছিলেন, বিদ্বানের শহররূপে যেহেতু বারাণসীর খ্যাতি রয়েছে, সেহেতু কেহ না কেহ এগুলির পাঠোদ্বারে সমর্থ হবেন।
অবশেষে বারাণসীর এক বিদ্বান পণ্ডিত দাবী করেছিলেন তিনি পড়তে পারবেন। তবে তিনি পড়ে যা বলেছিলেন তা জেনে আমাদের হতচকিত করার সাথে সাথে হাঁসিরও উদ্রেক করবে। মানুষ কত মুর্খ ও ষঢযন্ত্রকারী হলে এ রকম মিথ্যা, বানোয়াট ও ভ্রান্তি প্রচার করতে পারে। সে শঠ ও ধূর্ত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বলেছিলেন, স্তম্ভে লিখা হয়েছে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের গুপ্ত বনবাসের বিবরণ। কেবল এটুকু বলে তিনি ক্ষান্ত হননি, তিনি অশোক লিপি পড়ার এক নকল বইও রচনা করে দাবী করেছিলেন, তাঁর পড়া শতভাগ সঠিক।
অনেক দিন পর্যন্ত সে শঠ, ধূর্ত ও প্রতারক ব্রাহ্মণের পাঠ শুদ্ধ বলে গণ্য করা হয়েছিল।
১৮৩৪ সালে বৃটিশ কেপ্টেইন ট্রায়র প্রয়াগের অশোক স্তম্ভে খোদাই করা সমুদ্র গুপ্তের লেখার কিছু অংশ পড়েছিলেন। সে বছরে আবার ড. মিল সাহেব পুরা পড়েছিলেন। গাজীপুর জিলার সৈদপুর-ভীতরী নামক গ্রামের পাশে এক স্তম্ভ আছে। যাতে স্কন্ধগুপ্তের লিখা রয়েছে। ১৮৩৭ সালে ড. মল সাহেব কর্তৃক সব পাঠোদ্বার হয়। এ প্রকারে গুপ্তলিপি পড়া হয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মী লিপি দুর্বোধ্য মনে করা হত।
আমাদের ধন্যবাদ দিতে হবে প্রিন্সেপ জোন্সকে। তিনি সঠিকরূপে অশোকে লিপি বা ব্রাহ্মী লিপি পড়তে সক্ষম হন। তাতে জানা যায়, সম্রাট অশোক স্তম্ভগাত্রে বুদ্ধবাণী লোককল্যাণে প্রচার করেছেন। নাহলে এখনও পর্যন্ত বারাণসীর সে ধূর্ত পণ্ডিতের নকল বই অবলম্বনে অশোক স্তম্ভের অভিলেখাকে মহাভারত এবং রামায়নের বানানো কাহিনীরূপেই চালু থাকত।
সুত্র ঃ ধম্মকথা