পুরাকালে ব্রম্মদত্ত যখন বারাণসী রাজা ছিলেন, বোধিসত্ত্ব তখন তার পুরোহিত ছিলেন। বোধিসত্ত্ব তিন বেধ ও অষ্টাদশ বিদ্যাই পারদর্শী ছিলেন। তিনি পৃথিবী জয় মন্ত্র জানতেন। মন্ত্রটি আবর্জনমন্ত্র নামে অভিহিত হত।
একদিন বোধিসত্ত্ব ঐ মন্ত্র আবৃতি করার জন্য এক নির্জন স্থানে গমন করলেন। তারপর একটি পাথর খণ্ডের উপর বসলেন। এই মন্ত্র বিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুস্থান না করে কাউকে শোনাতে নেই। তাই বোধিসত্ত্ব নির্জন স্থানে গিয়েছিলেন।
বোধিসত্ত্ব যখন এই মন্ত্র আবৃতি করছিলেন তখন শৃগাল তার গর্ত থেকে তা শুনতে পেল এবং কণ্ঠস্থ করল। ঐ শৃগাল কোন অতীত জন্মে ব্রাহ্মণ ছিল এবং ঐ মন্ত্র আবৃতি করেছিল।
বোধিসত্ত্ব মন্ত্র আবৃতি করার পর আসন হতে উঠে বললেন, আমি দেখছি এই মন্ত্র সুন্দররূপে কণ্ঠস্থ করেছি।
শৃগাল তখন গর্ত থেকে বের হয়ে বলল, ঠাকুর, আমি এই মন্ত্র আপনার থেকে আরও ভালও করে কণ্ঠস্থ করেছি।
এই বলে শৃগাল পালিয়ে গেল। বোধিসত্ত্ব তার পিছু পিছু ছুটলেন। চিৎকার করে বললেন, শৃগালটাকে ধর, তা না হলে মহা অনর্থ ঘটবে।
কিন্তু কেউ তাকে ধরতে পারল না। সে গভীর অরণ্যে চলে গেল। সে সেখানে গিয়ে একটা শৃগালীর পায়ে ঈষৎ কামড় দিল। শৃগালী জিজ্ঞেস করল, কি আজ্ঞা করছেন প্রভু?
শৃগাল তাকে বলল, আমি কে তা জানিস?
শৃগালী বলল, আমি আপনাকে জানি না।
শৃগাল তখন পৃথিবী জয় মন্ত্র পাঠ করে বনের সমস্ত হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, শূকর, মৃগ প্রভৃত সমস্ত পশুদের তার নিজের কাছে এনে জড়ো করাল। তারপর সে তাদের রাজা হয়ে সর্বদ্রংস্ত্র নাম ধারণ করল এবং এক শৃগালীকে তার অগ্রমহিষী করল। দুটো হাতির পিঠে এক সিংহ বসত এবং সেই সিংহের পিঠে শৃগাল ও তার মহিষীকে নিয়ে বসত। এইভাবে সে তার অরণ্য রাজ্য শাসন করত। বনের সমস্ত জন্তু তাকে সম্মান করত রাজা হিসাবে।
এইভাবে কিছু দিন গত হবার পর মদমত্ত শৃগালের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগল। সে বারাণসী রাজ্য জয় করতে সংকল্প করল। সে বনের সমস্ত পশুদের নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করল এবং বারণসী নগরের প্রান্তে উপস্থিত হয়ে সে তার সেনা নিবেশ করল। সে রাজাকে বলে পাঠাল, না হয় যুদ্ধ কর না হয় রাজ্য ছেড়ে দাও।
নগরবাসীরা ভয়ে নগরের সব নগরদ্বার বন্ধ করে দিল। শৃগালের অনুচরগণ নগরের বাইরে দ্বাদশ যোজন বিস্তার করে নগর অবরোধ করে রইল।
বোধিসত্ত্ব রাজার কাছে গিয়ে বললেন, ভয় নেই মহারাজ। আমি শৃগালের সাথে জুধ করব। আমি ছাড়া তার সাথে কেউ যুদ্ধ করতে পারবে না।
এই বলে তিনি নগরের সিংহদ্বারের পাথরের উপর দাঁড়িয়ে শৃগালকে বললেন, কি হে সর্বদ্রংস্ত্র, কি উপায়ে তুমি নগর জয় করার ইচ্ছা করেছ?
আমি সিংহদের গরজন করতে বলল। সিংহনাদ শূনে নগরবাসী ভয়ে বিহুল হয়ে পরবে। আমি তখন আনায়াসে নগর অধিকার করব।
শৃগাল রাজ সর্বদ্রংস্ত্ররের এই অভিপ্রায় জেনে বোধিসত্ত্ব পাথর থেকে নেমে ভেরী বাজিয়ে দ্বাদশ যোজন বেষ্টিত বারাণসী নগরের সব অধিবাসীদের বলে দিলেন, তোমরা সকলে মাষপিষ্ট দ্বারা নিজ নিজ কর্ণ বিবর বন্ধ করে দাও।
নগরবাসীরা তাই করল। তারপর বোধিসত্ত্ব সেই পাথরের উপর উঠে বলল, কি হে সর্বদ্রংস্ত্র, তুমি এবার সিংহনাদ করাও। সিংহেরা তোমার মত এক বৃদ্ধ শৃগালের আদেশ সুনবে না। তুমি তাদের দিয়ে গর্জন করাতে পারবে না।
সবদ্রংস্ত্র বলল, অন্য সব সিংহের কথা ছেড়ে দিলাম, আমি যে সিংহের পিঠে বসে আছি, সে আমার কথায় অবশ্যই গর্জন করবে।
এই বলে সে সিংহকে গর্জন করতে আদেশ দিলেন। তখন সেই যে হাতির পিঠে বসে ছিল, সে হাতির পিঠে মুখ নিয়ে ঘোর গর্জন করল। সেই ঘোর সিংহ নাদ শূনে হাতিটি ক্ষিপ্ত হয়ে শৃগালকে তার পায়ের তলায় ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষ্ট করে ফেলল। তার মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। তখনি তার প্রাণ বিয়োগ হল।
তখন সব হাতিই উন্মত্ত হয়ে পরস্পরকে আঘাত করল তখন সিংহ ছাড়া সব পশুই মারা গেল। তারপর সিংহেরা বনে পালিয়ে গেল। তখন সেই দ্বাদশ যোজন বিস্তৃত স্থানে কেবল মৃত পশুদের মাংস রাশি পড়ে রইল।
বোধিসত্ত্ব পাথর হতে নেমে ভেরী বাজিয়ে নগরবাসীদের বলে দিলেন, এবার তোমরা তোমাদের কর্ণবিবর হতে মাপিষ্ট ফেলে দাও। অবরোধকারী জন্তুরা সব বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছে। তোমরা ইচ্ছা মত শূকর, মৃগ, শশক প্রভৃতি পশুদের মাংস নিয়ে এস।
নগরবাসীরা এই কথা শূনে ইচ্ছামত মাংস এনে খেল এবং বাকি মাংস শুকিয়ে রাখল।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র