প্রাচীনকালে বারাণসী নগরে ব্রম্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন । তাঁর সময়ে বোধিসত্ত্ব কোন এক বণিকের ঘরে জন্ম গ্রহন করেন । বড় হয়ে বোধিসত্ত্ব বাণিজ্য করতে লাগলেন । তাঁর পাঁচশো গরুর গাড়ি ছিল । সেই সব গাড়িতে মাল বোঝাই করে তিনি কখনোও পশ্চিম দেশে বাণিজ্য করতে যেতেন ।
সেই সময় বারাণসী নগরে আর একজন নির্বোধ বণিক বাস করত । কি অবস্তায় কি করতে হয় সে বিষয়ে তার কোন জ্ঞান ছিল না ।
একবার বোধিসত্ত্ব তাঁর গাড়িগুলিতে অনেক মূল্যবান মাল বোঝাই করে তা বিক্রি করার জন্য দূরদেশে যাবার জন্য সংকল্প করেন । এমন সময় তিনি শুনতে পেলেন সেই নির্বোধ বণিক পাঁচশো গাড়িতে মাল বোঝাই করে সেই দেশে যাবার জন্য সব ঠিক করে ফেলেছে ।
তখন বোধিসত্ত্ব মনে ভাবলেন এক হাজার গাড়ি ও দুই হাজার বলদ ও এতো লোকজন নিয়ে দুই বণিকের একসঙ্গে যাওয়া উচিত হবে না । এক হাজার গাড়ির চাকার ঘর্ষণে রাস্তা ভেঙ্গেচুরে যাবে । এত সব মানুষ ও পশুর খাদ্য ও পানীয়ের অসুবিধা হবে। তাই তিনি সেই নির্বোধ বণিককে ডাকিয়ে সব কথা বুঝিয়ে বললেন । তিনি বললেন, এখন ভেবে দেখ তুমি আগে যাবে না পরে যাবে।
সেই বণিক সব ভেবে বলল সে আগে যাবে । কারণ সে ভাবে, আগে গেলে সে রাস্তা ভাল পাবে । পথে বলদের জন্য ভাল ঘাস পাবে, মানুষের জন্য গাছে ফলমূল পাবে । তাছাড়া ইচ্ছামত মাল কেনাবেচা করতে পারবে।
সেই বণিককে আগে রওনা হতে বলে বোধিসত্ত্ব ভাবলেন আমার পরে যাওয়াই ভাল। ওদের গরুগুলি যাওয়ার ফলে উচুনীচু রাস্তা সমান হবে। ওদের বলদগুলি এখন পাকা ঘাসপাতা খাবে। পরে সেই সব ঘাসে যে সব কচি পাতা বের হবে আমার বলদগুলি তা খাবে। ওরা পথে জলের জন্য যে সব কূপ খনন করবে আমরা পরে যাওয়াই তা ব্যাবহার করতে পারব। তাছারা ঐ বণিক মাল কেনা বেচার যে দাম ঠিক করবে, পরে আমি সেই দামেই কেনাবেচা করতে পারব। আমাকে আর দরাদরি করতে হবে না কষ্ট করে।
সেই নির্বোধ বণিক যাত্রা করার দিনকটক পরে যাত্রা করেন বোধিসত্ত্ব ।
এদিকে সেই নির্বোধ বণিক কয়েকদিনের মধেই লোকালয় ছেড়ে এক দীর্ঘ বিস্তৃত বনের মধ্যে প্রবেশ করল। ষাট যোজন বিস্তৃত সেই বনের মধ্যে পানীয় জল না থাকায় তারা প্রচুর পরিমাণে পানীয় জল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল ।
সেই বনে যক্ষেরা বাস করত। বণিকদের গাড়িগুলো বনে প্রবেশ করলে যক্ষদের রাজা তা দেখে ভাবল, ঐ বণিক আর তার সঙ্গের মানুষ ও গরুদের খাবার জন্য এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে তারা জলের পাত্রগুল থেকে সব পানীয় জল ফেলে দেয় । তাহলে তারা পানীয় জলের অভাবে ক্রমশ হীনবল হয়ে পরবে । তখন তাদের অনায়াসে ধরে তাধের মাংস খাওয়া যাবে ।
এই ভেবে যক্ষরাজ মায়াবলে একটি সুন্দর গাড়ি সৃষ্টি করল। যক্ষরা মায়া জানত এবং সেই মায়াশক্তিবলে যখন যা খুশি সৃষ্টি করতে পারত। যে কোন রূপ ধারন করতে পারত। যক্ষরাজ সেই গাড়িটি দুতি তুষারের মত সাদা ষাঁড় টানছিল । যক্ষরাজ নিজে গাড়ি চালাচ্ছিল সামনে বসে। তার গলায় ছিল শ্বেতপদ্মের মালা। তার মাথার চুল ও পরনের কাপড় জলে ভেজা ছিল । তার গাড়ির আগে ও পেছনে দশ বার জন অনুচর নানা অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ির চাকাগুলো কাদামাখা ছিল ।
ক্রমে সেই নির্বোধ বণিকের গাড়িগুলো যক্ষরাজের গাড়ির সামনে এসে পরে। সবার আগে সামনের গাড়িতে সেই বণিক নিজে ছিল । যক্ষরাজ বণিককে মধুর স্বরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
বণিক বলল আমি বারাণসী থেকে আসছি। কিন্তু পথে কি বৃষ্টি হচ্ছিল? আপনার মাথার চুল ও কাপড় জলে ভেজা দেখছি । আপনার গলায় ও পদ্মফুলের মালা দেখছি । তবে কি সামনে কোন সরবর বা দিঘী আছে?
যক্ষরাজ বলল, আমি এখন যে পথ দিয়ে সে পথ ত সব সময় বৃষ্টি হচ্ছে। আর সে পথের দুধারে শুধু পদ্মফুলে ভরা দীঘি আর সরোবর ।
এরপর যক্ষরাজ বণিককে বলল, আপনাদের মাল বোঝাই গাড়িগুলিতে জলভরা অনেক মাটির জালা দেখছি। সব জল ফেলে দিয়ে মাটির জালাগুলো ভেঙে দিন। গাড়িগুলো হালকা করুন। আপনারা এতক্ষন যে পথে এলেন সেখানে জলের দরকার ছিল । কিন্তু এবার আর জল বয়ে নিয়ে যাবার আর কোন দরকার নেই ।
নির্বোধ বণিক যক্ষরাজের কথায় বিশ্বাস করে সব জল ফেলে দিয়ে জালা গুলো ভেঙে দিলো ।
যক্ষরাজ তার অনুচরদের নিয়ে ঘরে ফিরে গেল ।
এদিকে সেই পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েও নির্বোধ বণিক পথের দুধারে কথাও কোন জলাশয় ডেকতে পেল না। ফলে তারা পিপাসার্ত হয়ে পড়ল । অথচ সঙ্গের সব পানীয় জল তারা ফেলে দিয়েছে । সূর্য অস্ত যাবার পর বণিক সব গাড়ি থামাবার আদেশ দিল । অনুচরেরা গাড়ি থামিয়ে দিয়ে গরুগুলোকে চাকার সঙ্গে বেঁধে দিল । তারপর তারা সেই গাড়িগুলোর মাঝখানে বিশ্রাম করতে লাগল । ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর থাকার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই গুমিয়ে পড়ল সকলে ।
ক্রমে রাত্রি গভীর হলে জক্ষেরা তাদের পুরী থেকে বেরিয়ে এসে তাদের মাংস ভক্ষণ করে হাড়গুলি ফেলে রেখে চলে গেল । কিন্তু তার গাড়ি বোঝাই মাল্গুল যেমন ছিল তেমনি রইল ।
নির্বোধ বণিক যাত্রা করার দেড়মাস পর তাঁর পাঁচশ মাল বোঝাই গাড়ি নিয়ে বারাণসী নগর হতে যাত্রা করলেন । যথাসময়ে তিনি সেই সব গাড়ি আর লোকজন নিয়ে সেই বনে এসে পোঁছলেন।
আগের বণিকের মতই বোধিসত্ত্ব জলপূর্ণ ভাণ্ড সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সেই মেরু প্রদেশে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বোধিসত্ত্ব ভেরী বাজিয়ে তাঁর সব অনুচরদের একজায়গায় একত্রিত করে তাদের বললেন, এখানে কোথাও জল পাওয়া যায় না। এইখানে অনেক বিষ বৃক্ষ আছে। সুতরাং আমার বিনা আনুমতিতে তোমরা এখানকার কোন জল বা ফল খাবে না।
সেই পথে কিছুদুর গেলে সেই যক্ষরাজ আগের মতই মানুষের বেশ ধারণ করে ভিজে কাপর পরে পদ্মফুলের মালা গলায় দিয়ে বোধিসত্ত্বের সামনে এসে বলল, এইপথে কিছুদূর গিয়েই দেখবে অনেক জলাশয় আছে। সেখানে সব সময় বৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং জল বয়ে নিয়ে যাবার কোন দরকার নেই। জলপূর্ণ বড় বড় পাত্রগুলি হতে সব জল ফেলে দিয়ে তোমাদের গাড়িগুলো হাল্কা কর। বোধিসত্ত্ব লক্ষ্য করলেন, এই লোকটি যক্ষ, মানুষ নয়। করণ তাঁর চোখ রক্তবর্ণ, উগ্রমূর্তি, তার কোন ছায়া পড়ছেনা মাটি্তে।
এই দেখে তিনি তাকে বললেন, দূর হ পাপিষ্ঠ। আমরা বণিক, আমরা নিজের চোখে জল না দেখে আমাদের সঞ্চিত জল ফেলে দেব না। যখন জল পাবার উপায় দেখব তখন নিজের বুদ্ধিতেই জল ফেলে দিয়ে হাড়িগুলো হালকা করব। তোর কাছে পরামর্শ নিতে যাব না।
এইভাবে তার কুউদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় যক্ষরাজ তার নিজের পুরীতে ফিরে গেল।
বোধিসত্ত্বের এক অল্পবুদ্ধি অনুচর কিছুতা দূর থেকে মানুষবেশী যক্ষরাজকে দেখেছিল। সে তার কথায় বিশ্বাস করে বলল, যে লোকটা এসেছিল তার গায়ে জল এবং কাপড় ভিজা ছিল। তার গলায় ছিল পদ্মফুলের মালা। যে পথ দিয়ে এসেছিল সে পথ নিশ্চয় পদ্মফুলে ভরা সরোবর আছে। সে পথে নিশ্চয় সর্বদা বৃষ্টি হচ্ছে। অতএব আমাদের সঞ্চিত জল ফেলে দিয়ে গাড়িগুলো হালকা করাই ভাল।
বোধিসত্ত্ব তখন তার অনুচরদের ডাকিয়ে জড়োকরে তাদের বললেন, যে লোকটি এসেছিল আমার কাছে, সে মানুষ নয়, যক্ষ। তার কথা শুনবেনা। লোকটা বলে গেল, দূরে যে নীল বন দেখা যাচ্ছে সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে সর্বদা। কিন্তু বৃষ্টি হলে এক যোজন দূর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বয়। কিন্তু তোমরা কোন ঠাণ্ডা বাতাস টের পেয়েছ কি?
অনুচরগণ বলল, না।
বোধিসত্ত্ব বললেন, যে মেঘে বৃষ্টি হয় তার একটা অন্তত এক যোজন দূর হতে দেখা যায়। কিন্তু তোমরা দেখতে পাওনি। কোনও বিদ্যুতের চমকও ডেকতে পাওনি। দু এক যোজন দূর হতে মেঘের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু তোমরা কোনও মেঘগর্জনও শুনতে পাওনি।
এখন শোন, যে লোকটা এসেছিল সেই মায়াবি যক্ষটা এক কু-অভিসন্ধি নিয়ে এসেসিল। সে ভেবেছিল আমরা তার কথা শুনে আমাদের সব জল ফেলে দিব। আমরা তৃষ্ণাই ক্লান্ত হয়ে পড়ব। জল অভাবে আহার করতে পারব না। এইভাবে আমারা সকলে হীনবল হয়ে পরলে তারা অনায়াসে বধ করে আমাদের মাংস খাবে। সুতরাং এক বিন্দু জলও ফেলবে না। আমাদের আগে যে বণিক এসেছিল, সে যক্ষের কথাই সব জল ফেলে দিয়েছিল। পরে তারা ক্ষুধাতৃষ্ণাই কাতর হলে যক্ষরা তাদের বধ করে। কিছুদুর গেলেই দেখবে তাদের গাড়িগুলো আরা হাড় কঙ্কাল গুলো পথের উপর পরে আছে।
তখন বোধিসত্ত্ব ও তার অনুচর গণ দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেল, সত্যিই তাদের আগের নির্বোধ বণিকের পাঁচশ গাড়ি পরে আছে। কোনও গরু বা মানুষ নেই। তাদের হাড় কঙ্কাল গুলো শুধু পরে আছে। তা দেখে বোদিসত্ত্বের আনুচরদের চৈতন্য হোল । সেইখানে তারা আহার ও রাত্রি জাপন করলেন। এরপর বোধিসত্ত্ব দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার জন্য তার যে সব গাড়িগুলো প্রায় ভেঙ্গে পরেছিল সেগুলি ফেলে রেখে নির্বোধ বণিকের ভালো ভালো গাড়িগুলো নিয়ে নিলেন। তারপর তার গাড়িগুলোতে যে সব কম মূল্যের মাল ছিলসেগুলি ফেলে দিয়ে নির্বোধ বণিকের বেশি মুল্যের মালগুলি নিজের গাড়িতে তুলে নিলেন। তারপর বোধিসত্ত্ব তার গন্তব্য স্থানে গিয়ে পোঁছলেন। সেখানে তার বাণিজ্য ভালই হোল। আগের বণিক না জেতে পারায় সেখানে মালের চাহিদা ছিল। তিনি তার সব মাল দবি-গুন বা তিন গুন মূল্যে বিক্রি করে অনেক ভালো লাভ করলেন। তারপর নিরাপদে তাঁর দেশে ফিরে গেলেন।
সুত্র ঃ জাতকসমগ্র