ছোটবেলায় লোক মুখে অনেক যক্ষের গল্প শুনেছি। আধুনিক যুগে ভূত, প্ৰেত, দৈত্য, যক্ষ প্রভৃতি অশরীরি প্রাণী অনেকে কাল্পনিক বলে মনে করে থাকেন। জড়-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সময় এগুলোর সংখ্যাও ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন।

বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে অনেক, ভূত, প্রেত, যক্ষ, দেবতা, ব্রহ্মা এবং বিবিধ অশরীরির বর্ণনা পাওয়া যায়। এগুলিকে উপপাতিক জন্মজ প্রাণী বলা হয়। এ সম্বন্ধে অনুলোম, শুচি লোম এবং আলবক যক্ষের উল্লেখ করা যায়। ত্রিপিটকে বর্ণিত আলবক যক্ষ ভগবান বুদ্ধকে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছিল। তা বর্তমানে বৌদ্ধ নর নারীর অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়েছে। যারা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী তাদের নির্দ্ধিধায় স্বীকার করতে হয়। এ সম্বন্ধে বিমান বত্থু, প্রেত কাহিনী এবং বিভিন্ন অটঠ কথায় প্রচুর অশরীরির প্রমাণ পাওয়া যায়।

এমন কতগুলো ঘটনা আছে তার কোনো যথাযথ লিপিবদ্ধ প্রমাণ নেই। কালক্রমে মানুষের স্মৃতি অটলতলে ডুবে যায়। আজ হতে ছয় বৎসর পূর্বে এক যক্ষিণীর কাহিনী উদঘাটন হয়। শ্রদ্ধেয় বনভান্তে স্বশিষ্যে উক্ত স্থানে পদার্পণ করায় যক্ষিণীর অন্তর্ধান ঘটে। তার ঠিক তথ্য সংগ্ৰহ করতে আমার অনেকদিন সময় লেগেছে। এই তথ্যের প্রতিবেদন লিখে দিয়েছেন বাবু প্ৰমোদ রঞ্জন চাকমা। উক্ত কাহিনী অতি দীর্ঘ বিধায় পাঠকের ধৈৰ্য চুতির ভয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করছি। বাবু নির্মল কান্তি চাকমা শ্রদ্ধেয় বনভান্তের একনিষ্ট উপাসক এবং বনবিহার পরিচালনা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি। তিনি উচ্চ শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তি। শ্রদ্ধেয় বনভান্তের উপদেশে ১৯৮৩ ইংরেজীতে রফতানী ও মার্কেটিং অফিসার পদ হতে পদত্যাগ করে বাগান ও ব্যবসা বানিজ্যে রত আছেন। তার স্থায়ী ঠিকানা বনরূপার ত্রিদিব নগরে। নির্মল বাবু বাগান করার জন্যে উপযুক্ত স্থান খুঁজতে খুঁজতে হাজারীবাক মৌজার ‘কান্দেবছড়া কাগত্যায়” ৬ একর পাহাড় বন্দোবস্তী করেন। তিনি শুনতে পেলেন এ জায়গায় বহু বৎসর যাবৎ কোন লোক বসতি বা জুম চাষ করতে পারে না। সুতরাং অনাবাদী অবস্থায় পড়ে আছে। কারণ অমনুষ্যের উৎপাতে হয়তো লোক মারা পড়ে নতুবা হঠাৎ রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তিনি সাহস করে সেখানে বিভিন্ন গাছ এবং ফলের বাগান করেন। সেই বাগানে হৃদের ধারে একখানা খামার বাড়িতে তার মেঝ ভাই বাবু প্ৰমোদ রঞ্জন চাকমা, তার স্ত্রী বিজয়লক্ষী চাকমা ও দুই ছেলে মেয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে নির্মল বাবু বাগানের কাজের জন্য কিছু সংখ্যক মজুর নিয়ে সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করেন। এভাবে কোনো উপদ্রব ছাড়া তিন বৎসর কেটে যায়। তারা মনে করেছিলেন এখানে বোধ হয় কোন অমনুষ্য বা যক্ষের উপদ্রব নেই অথবা কালক্রমে তা তিরোহিত হয়েছে।

কোনো একদিন পাহাড়ের অপর প্রান্তে বাগানের কাজে ব্যস্ততায় প্রমোদ বাবু সন্ধ্যার একটু পরে খামারে ফিরছিলেন। এমন সময় বড়জোর ৫০ হাত দূরে দেখতে পেলেন এক বিভৎস ধরণের মূর্তি। কপালে দুটি ও দুই বাহুতে দু’টি ইলেকট্রিক বাল্ব-এর মত বড় বড় চারটি চোখ দেখতে পান। চোখগুলো খুব উজ্জ্বল ও ঝক্‌ঝক্‌ করে। চোখের আলোতে শরীরের অন্য অংশও দেখা যায়। প্রথম দর্শনে হুশ হারিয়ে ফেলেন এবং নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অন্ততঃ ২০ মিনিট পরে একটু হুশ ফিরে আসে। মনে মনে চিন্তা করলেন বোধ হয় সে আমাকে কিছু করবে না। অবশেষে বললেন তুমি আমাকে কিছু করতে পারবে না। আমি সব সময় পঞ্চশীল পালন করি। সে কথা বলার পর উক্ত বিভৎস মূর্তি অন্তৰ্হিত হয়। অতপর তিনি কম্পমান দেহে খামারে চলে যান। এ ঘটনা সম্বন্ধে তার স্ত্রী বিজয়লক্ষী চাকমাকে অবহিত করেননি।

প্রমোদ বাবু মধ্যে মধ্যে চিন্তা করেন, ওটা বোধ হয় নিশ্চয়ই যক্ষ হবে। এই ব্যাপারে ভবিষ্যতের জন্য সন্দেহ উপস্থিত হল। আবার চিন্তা করলেন সে বোধ হয় আমাকে কোনো ক্ষতি করবে না। ক্ষতি করলে প্রথম দিনই করত। কিছুদিন অতিবাহিত করার পর এর একদিন সন্ধ্যার পর খামারে ফিরছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন পথ রোধ করে এক লম্বা গাছ। চিন্তা করলেন এ গাছ কোথা থেকে আসল। অন্ততঃ ৪ হাত কাছে গিয়ে দেখতে পেলেন। ওটা গাছ নয়, বিরাটকায় কাল সাপ। তাতে তার শরীর শিহরিয়ে উঠল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করলেন, সাপ তো এরূপ হতে পারে না। বোধ হয় এটা সেদিনের যক্ষ। কয়েক মিনিট পর অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সাথে সাথেই যক্ষটি অন্তৰ্হিত হয়। অতপর তিনি ত্রিরত্নের নাম স্মরণ করতে করতে খামারে চলে যান। এবার প্রথম দিনের তুলনায় একটু কম ভয় লেগেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বারও কাহারো প্রতি এ বিষয় ব্যক্ত করেননি।

তৃতীয় বার কোন একদিন প্রমোদ বাবু ‘কান্দেবছড়া’ গ্রামের জনৈক লোকের বাড়ি হতে নিমন্ত্রণ খেয়ে আসতেছেন। তখন রাত ৮টা। যখন তার বাগানে পৌছেন। তখন দেখতে পেলেন। পথের উপর একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখা মাত্রই তিনি দাঁড়িয়ে ত্রিরত্নের নাম স্মরণ ও তার শীলগুণ স্মরণ করলেন। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বলেন আমাকে পথ ছেড়ে দাও। তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ কেন? সে বলল, তুমি এদিকে এস তোমার সাথে আমার বিশেষ দরকার আছে। তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কোন দরকার নেই। পথ ছাড়। সে আবার বলল, তুমি ভয় করো না। তোমার কোন ভয় নেই, তোমাকে কথা দিচ্ছি। তুমি আমার দিকে এস। তিনি বললেন, তোমার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই। পথ ছাড়। মেয়েটি বলল, আচ্ছা! আজ পথ ছাড়ছি। কিন্তু আগামীকাল এখানে এসে আমার সাথে দেখা করে যেও। প্ৰমোদ বাবু তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন পরনে সাদা কাপড় এবং চোখ দু’টি ঝক্‌ঝক্‌ করে জুলছে। চেহারাটি যেন একজন চাকমা মেয়ে। অতঃপর খামারে এসে এ বিষয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন।

পরবর্তী রাত তিনি আগে আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাত যখন ঠিক ১টা বাজল তখন কে যেন তার বাড়ির পাশ থেকে কলারছড়া কেটে নিয়ে যাচ্ছে। শব্দ শুনে তিন ব্যাটারী টর্চ দিয়ে দেখলেন কলাগাছ ঠিকই আছে এবং আশেপাশে কাকেও দেখতে পেলেন না। তিনি প্রস্রাব করে বাড়িতে ঢুকার পথে অর্থাৎ দরজার সামনে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে সে মেয়েটি। প্রথমেই সে বলল তুমি আমার সঙ্গে দেখা করনি কেন? তিনি বললেন, কোন প্রয়োজন নেই সে জন্য। সে বলল, আজও তুমি যাও, আগামীকাল আমার সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করিও। অনেক কথা বলার প্রয়োজন আছে। ক্রমান্বয়ে ভয় কমে যাওয়াতে তিনি বললেন, আচ্ছা কথা দিচ্ছি। দেখা করব। সেই রাতেও সে বিষয়ে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন।

তারপর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেখানে গেলেন। দেখা গেল সাদা কাপড় পরিহিত মেয়েটি গাছের গোড়ায় বসে আছে। দেখার সাথে সাথেই বলল, এদিকে এস। তোমার কোন ভয় নেই। আমাকে কোনো সন্দেহ করিও না। তিনি বললেন, তুমি ওখান থেকে বল, কি দরকার আছে শুনতে এসেছি। সে আবার বলল তোমার এখনো ভয় ও সন্দেহ রয়ে গেছে। তুমি আমার পাশে এসে বস। তারপর প্রয়োজনীয় কথাগুলো বুঝিয়ে বলব। তিনিও তার কথামতে পাশেই বসে পড়লেন। প্ৰায় বিশ মিনিট পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে থাকার পর বলল তোমরা এ পাহাড়ে এসেছ অনেকদিন যাবৎ আমি তোমাদের সবাইকে চিনি ও ভালবাসি। কিন্তু তোমাকে এবং তোমার মেয়েকে খুব ভালবাসি। তুমি খুব পরিশ্রম কর। তোমার আর পরিশ্রম করতে হবে না। এমনকি তোমার ছেলে মেয়েরও অভাব ঘুচে যাবে। আমি তোমাকে কতগুলো সম্পদ দিতে চাই। অনুগ্রহ করে এগুলো নিয়ে যাও। শুধু তোমাকেই দিচ্ছি, অন্য কারো প্ৰাপ্য নয়। এ কথাগুলো বলার পর তিনি বললেন আমার কোন সম্পদের প্রয়োজন হবে না। আমার যা আছে তা দিয়ে যথেষ্ঠ, এ বলে উঠে চলে আসছেন, তখন সে বলল আজ তোমাকে চিন্তা করার সময় দিচ্ছি। আগামীকাল নিশ্চয়ই আমাকে বলতে হবে। সে দিনও দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খামারে চলে গেলে।

পরের রাত প্ৰমোদ বাবুর যাবতীয় ভয় সন্দেহ ও সংকোচ ভাব একেবারেই চলে যাওয়ায় সরাসরি তার পাশে গিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ বসার পর সে বলল— আমার সাথে এস, তোমার ধন সম্পদ বুঝিয়ে নাও। তিনি বললেন, আমি সেদিকে যাব কেন? না আমি যাব না। সে আবার বলল— দেখতে পাচ্ছি তোমাদের মানব জাতির সন্দেহ ও সংকোচভাব এখনও রয়ে গেছে। একথা বলার পর তার পিছনে পিছনে অন্ততঃ ত্ৰিশ হাত পর্যন্ত গেলেন। দেখা গেল দিনের মত পরিস্কার আলো। সামনে দুটি বড় বড় মাটির কলসী। কলসীর ঢাকনা খুলে বলল— ধরে দেখ তোমার সম্পদ। তিনি সেগুলো ধরে দেখলেন। এক কলসীতে স্বর্ণের মোহর, অন্য কলসীতে স্বর্ণের পাতে ভর্তি। সেগুলো স্পর্শ করতে প্ৰমোদ বাবুর শরীর যেন কেমন কেমন লাগতেছে, একটু পরে বললেন— এগুলো আমার দরকার নেই। তোমার ধন-সম্পদ তোমার নিকট থাক। সে পুনরায় বলল, এগুলো তো তোমার জন্য রেখেছি। তুমিই এগুলোর মালিক। তিনি বললেন— আমার মালিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি চলে যাচ্ছি। চলে যাওয়ার সময় সে বলল, এ ব্যাপারে চিন্তা করার জন্য তোমাকে আরো সময় দিচ্ছি। মধ্যে মধ্যে আমার সাথে দেখা করিও। প্রমোদ বাবু বললেন আচ্ছা ঠিক আছে।

প্রায় রাতেই প্রমোদ বাবু যক্ষিনীর পাশে বসে থাকতে থাকতে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। (চাকমা ভাষায় আক্যাং বলে) এভাবে আসতে যেতে দেখে তার স্ত্রী সন্দেহ করে জিজ্ঞাসা করলেন— তুমি গভীর রাতে প্ৰায় এক ঘন্টা পৰ্যন্ত কোথায় যাও? তিনি হেসে হেসে বললেন— তোমাকে বলতে পারব না। তুমি এই কথা জিজ্ঞাসা করিও না। দিন দিন তার স্ত্রীর সন্দেহের দানা গভীর হওয়ায় বললেন— বলতে পারি। কিন্তু একটা শর্ত আছে। কাউকে প্ৰকাশ করতে পারবে না। ভয়ানক ক্ষতি হতে পারে।

অতঃপর উক্ত বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বলার পর তার স্ত্রী বিজয়লক্ষী চাকমা যক্ষিণীকে দেখার জন্য আগ্রহ প্ৰকাশ করলেন। প্রমোদ বাবু যক্ষিণীর অনুমতি নিয়ে তার স্ত্রীকে সেখানে নিয়ে গেলেন। প্ৰায় পাশে গিয়ে দেখা মাত্ৰ প্ৰমোদ বাবুকে জড়িয়ে ধরে বিজয়লক্ষী বললেন— আমি যাব না। থর থর করে কাঁপতে লাগল। প্রমোদ বাবু বললেন— ভয় নেই, চল তার পাশে বসে আলাপ করে আসি।

খামারে গিয়ে বিজয়লক্ষীর মোটেই ঘুম হল না। মধ্যে মধ্যে ভয়ে চমকে উঠে। ভোর হওয়ার পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বনরূপায় ত্রিদিব নগরে চলে আসেন। এদিকে প্রমোদ বাবু তার দশ বছরের মেয়েটিকে নিয়ে খামারে চলে আসেন। মেয়েটি রান্নার কাজে ও তিনি বাগানের কাজে ব্যস্ত থাকেন। যক্ষিণীর সাথে পুনঃবার দেখা হলে বলল, তোমার স্ত্রী আমাকে দেখে ভয়ে চলে গেছে। ভয় কিসের? মানব জাতির সাধারণত ভয় সন্দেহ ও সংকোচ ভাব থাকে। তোমার এখনো সময় আছে তোমার ধন-সম্পদগুলো নিয়ে সুখে শান্তিতে চলতে পারবে। প্রমোদ বাবুর তবুও লোভ উৎপন্ন হল না।

আর একদিন গ্ৰীষ্মকালে রাত্রি বেলায় প্রমোদ বাবু ত্ৰিদিব নগরস্থ বাড়িতে উঠানে বসে আছেন। হঠাৎ তার সামনে যক্ষিণী উপস্থিত হল এবং বলল— কি ব্যাপার তোমাকে এবং সবাইকে খামারে দেখা যাচ্ছে না কেন? তিনি উত্তরে বললেন— কোনো ব্যাপার নয়। শুধু আমার স্ত্রীকে সন্দেহ করি, যদি কাউকে বলে দেয়। প্রতি উত্তরে যক্ষিণী বললেন— কিছুই হবে না, বলতে পারবে। কোন অসুবিধা হবে না। একথা গুলো বলে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরে তার স্ত্রী চা নিয়ে এসে বললেন— তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ? তিনি বললেন— যক্ষিণী এই মাত্র চলে গেল। তোমার কথায় বলেছি। অন্য কারো নিকট নাকি প্ৰকাশ করতে পারবে। অনুমতি নিয়েছি, কোনো অসুবিধা হবে না।

পরদিন সকালে নির্মল বাবু এবং পরিবারের অন্যান্যদের কাছে বিগত তিন বৎসরের ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা করলেন। তাতে সবাই আশ্চৰ্য্য ও হতভম্ব হয়ে পড়েন। এমনকি সমগ্ৰ ত্ৰিদিব নগর এলাকায় এ ঘটনা নিয়ে এক তোলপাড়া হয়ে যায়। সকলের মতামত নিয়ে নির্মল বাবু ও প্রমোদ বাবু শ্ৰদ্ধেয় বনভান্তের উদ্দেশ্যে বনবিহারে গমন করেন। বন্দনাদি করার পর শ্রদ্ধেয় বনভান্তেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত করেন। এদিকে বনভান্তের স্নান করার সময় হলে তিনি বললেন— আজি তোমরা চলে যাও। আগামীকাল আবার আস।

পরের দিন যথাসময়ে উভয়ে দেশনালয়ের দিকে যেতে না যেতেই শ্ৰদ্ধেয় বনভান্তে রসিকতা করে বললেন— যক্ষিণীর স্বামী আসতেছে (যক্ষিণীর নেকো এঝের)। তারা বন্দনা করে বসার পর উপাসক-উপাসিকাদের লক্ষ্য করে তিনি আবার বললেন— প্রমোদ বাবু পাঁচশত বৎসর পূর্বে কান্দেবছড়া গ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার কোনো পুত্ৰ-কন্যা ছিল না। অর্ধ বয়সে সে মারা যায়। তার স্ত্রী পরিণত বয়সে মারা যায়। কিন্তু সম্পত্তির প্রতি লোভ-মোহ পরায়ন হওয়ায় সে যক্ষিণীরূপ ধারণ করেছে। কিন্তু তারা যক্ষিণীকে চিনে না। যক্ষিণী তাদের ভালভাবে চিনে। মানুষ যেভাবে মূলা বা খিরা খায়, যক্ষিণীও সেভাবে মানুষ খেতে পারে। মায়া মমতার কারণে সে তাদেরকে কিছু করে না। এ যক্ষিণীকে কেউ তাড়াতে পারবে না। এমনকি যক্ষ মন্ত্র-তন্ত্ৰধারী বৈদ্য বা কোন ভিক্ষুও তাকে তাড়াতে পারবে না। কিন্তু একটা পথ আছে, সেটা হল তার উদ্দেশ্যে সংঘ দান করে পূন্য দান করা।

(উল্লেখ্য যে পার্বত্য ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় পাঁচশত বৎসর পূর্বে কান্দেবছড়া বা তার আশে পাশে কোনো চাকমা বসতি ছিল না। সেখানে ত্রিপুরাদের বসতি ছিল। সুতরাং, প্রমোদ বাবু ত্রিপুরাই ছিলেন)।

সঙ্গে সঙ্গেই নির্মল বাবু ও প্রমোদ বাবু শ্ৰদ্ধেয় বনভান্তেকে স্বশিষ্যে সংঘদান, অষ্টপরিষ্কার দান এবং সূত্রপাঠ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। এ উপলক্ষে একটি বড় লঞ্চ ও বনভান্তের জন্য বোট নিয়ে খামার বাড়িতে যাত্রা করলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বনরূপা, কান্দেবছড়ার উপাসক-উপাসিকরা উপস্থিত ছিলেন। যথাসময়ে পঞ্চশীল প্রার্থনা, সংঘদান ও অষ্টপরিষ্কার দান সম্পন্ন হয়।

দুপুর বেলা পরিত্রাণ প্রার্থনা ও ভিক্ষু সংঘের সূত্রপাঠ আরম্ভ হয়। ক্ৰমান্বয়ে তিনটি সূত্র পাঠ করার পর শ্রদ্ধেয় বনভান্তে শিষ্যদের বললেন-যক্ষিণী চলে যাচ্ছে। উপাসক-উপাসিকারা বড় করে সাধুবাদ প্ৰদান করার পর মাইকে এবং সকলের মুখে সমসুরে সাধুবাদ ধ্বনিতে কান্দেবছড়া এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে। যক্ষিণী যাওয়ার সময় গামারী গাছ ও আমগাছের মধ্যবর্তী স্থানে গোল্লার মত শব্দ শোনা যায় এবং গাছের শাখা-প্ৰশাখাগুলো তুফানে নড়াচড়া করার মত দেখা যায়। আরো একটি অত্যাশ্চৰ্য্য ঘটনা হল পাহাড়টিতেও কম্পন হয়েছিল। মনে হল সকলে একখানা বড় লঞ্চের ছাদে বসে আছেন। আরও তথ্য পাওয়া গেল রান্না করার জন্যে যে চুলা খুঁড়েছিল তা কম্পনের ফলে কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়েছে।

অবশেষে শ্রদ্ধেয় বনভান্তে উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্যে ধর্ম দেশনা প্রদান করেন। দেশনায় বলেন- মানুষ যেমন বিভিন্ন জাতের, বিভিন্ন প্রকৃতির ও বিভিন্ন স্বভাব চরিত্রের থাকে তেমন অশরীরিদের মধ্যে ভূত, প্রেত, যক্ষ, বৃক্ষ দেবতা, আকাশবাসী দেবতা, ভূমিবাসী দেবতা এবং নানা প্রকার অদৃশ্য প্রাণী থাকে। তারা অনেক সময় মানুষের মত উপকার করে আবার অপকারও করে থাকে।

সাধু সাধু সাধু

তথ্যসূত্র : বিরল ঘটনা সংগ্রহ; সংকলন: শ্রীমৎ ব্রহ্মযান ভিক্ষু

error: Content is protected !!