অরহৎ প্রসঙ্গ

– রক্তিম বড়ুয়া।

ত্রিপিটকের অঙ্গুত্তর নিকায়ে আম্র সুত্র নামে একটি সূত্র রয়েছে তথায় বলা হয়েছে- ‘চার ধরণের আম রয়েছে। যেমন:
১. দেখতেও কাঁচা ভেতরেও কাঁচা ২. দেখতে কাঁচা ভেতরে পাকা ৩. দেখতে পাকা ভেতরে কাঁচা ৪. দেখতেও পাকা ভেতরেও পাকা। তদ্রুপ জগতে মানুষও চার ধরনের। যথা: ১. কেউ কেউ বাইরে অর্থাৎ কায়িক, বাচনিক ভাবে অপরিশুদ্ধ আবার ভেতরে অর্থাৎ মানসিক ভাবেও অপরিশুদ্ধ, ২.কেউ কেউ বাইরে অর্থাৎ কায়িক, বাচনিক ভাবে অপরিশুদ্ধ কিন্তু ভেতরে অর্থাৎ মানসিক ভাবে পরিশুদ্ধ ৩. কেউ কেউ বাইরে পরিশুদ্ধ একদম সাধু কিন্তু মানসিক ভাবে অপরিশূদ্ধ ৪. কেউ কেউ বাইরেও শুদ্ধ ভিতরেও শুদ্ধ।

এই সূত্রটি ছাড়াও অঙ্গুত্তর নিকায়ের চতুর্থ নিপাতের তৃতীয় পঞ্চাশক এর বলাহক বর্গের দুতিযবলাহক সুত্র, কুম্ভসুত্র, হ্রদসুত্র, উদকরহদসুত্র, মূসিকসুত্র, বলীবদ্দসুত্র, রুক্খসুত্র, আশীবিসসুত্তং প্রভৃতি ৯-১০ টি সুত্রে এবিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।অরহত তিনি যিনি কায়িক, মানসিক, বাচনিক এই ত্রিদ্বারেই পরিশুদ্ধ। অর্থাৎ বাইরেও পাকা ভেতরেও পাকা। বাহির থেকে যেমন একটি আম পাকছে কি পাকে নাই বুঝা যায় না তদ্রুপ বাহির থেকে দেখে অরহৎ চেনা যায় না। কেননা উপরে সাধু হলেও তার চিত্তে দোষ থাকতে পারে। এখন কে বুঝবে আরেক জন অরহৎ হয়েছে কিনা? উত্তর হচ্ছে যাঁর অন্তত পরচিত্তবিজানন জ্ঞান রয়েছে। অরহৎ হলে যিনি অন্তত পক্ষে ত্রিবিদ্যা অধিগত করেছেন। তিনিই জানবেন।আর সব অরহৎ যেহেতু ত্রিবিদ্যা লাভ করতে পারেন না। তাই তাঁরা অরহৎ হয়েও অন্যে অরহত হয়েছেন কিনা জানবেন না।কারণ তাঁদের মাঝে ত্রিবিদ্যা নাই। এদেরকে সূক্ষ্ণ বিদর্শক অরহৎ ও বলা হয়।আরো মনে রাখা দরকার, যেমন একজন অরহৎ ত্রিবিদ্যাধর আবার আরেকজন ষড়াভিজ্ঞা। এক্ষেত্রে ত্রিবিদ্যাধর অরহৎ ষড়াভিজ্ঞা অরহতের চিত্ত পড়তে পারবে না। একই অবস্থা অবশ্য দেবগনের মধ্যে বিদ্যমান। উচ্চ স্তরের দেবগণ নিচের স্তরের দেবগণকে সহজেই দেখতে পান কিন্তু নিচের স্তরের দেবগণ, উচ্চ স্তরের দেবগন নিজেরা দেখা না দিলে, দেখেন না।
যেখানে অরহৎ গনই ত্রিবিদ্যা ব্যতীত অপরজন অরহত হয়েছেন কিনা জানেন না সেখানে আমরা বাংলাদেশীরা সাধারণ ভান্তে দেরকেও অরহৎ বানাই। বর্তমানে একজনকে তো পুরা ছোট বুদ্ধ (যদিও বুদ্ধ একটাই) বানায় ফেলছে মানুষ। অবাক লাগে সেই সব ভান্তেরা প্রকাশ্যে কেন ঘোষণা দেন না যে তারা বুদ্ধ নন………….!!!!

জগতে বুদ্ধ তিন প্রকার। যথা:
১. সম্যক সম্বুদ্ধ
২. প্রত্যেক বুদ্ধ
৩. শ্রাবক বুদ্ধ।

আবার সম্যকসম্বুদ্ধও তিন প্রকার। যথা:
১. প্রজ্ঞাধিক (আমাদের গৌতম বুদ্ধ) ২. বীর্যাধিক এবং ৩. শ্রদ্ধাধিক। প্রত্যেক বুদ্ধের প্রকার ভেদ সম্পর্কে তেমন কোন
তথ্য পাই নি। তবে দেবদত্ত প্রত্যেকবুদ্ধ হবেন। প্রত্যেক বুদ্ধগণ ধর্ম প্রচার করেন না। এদের জ্ঞান শ্রাবক বুদ্ধ থেকে উন্নত
কিন্তু সম্যকবুদ্ধ থেকে নিচে। শ্রাবকবুদ্ধ গণের অনেক প্রকার ভেদ রয়েছে। যেমন: ১. অগ্রমহাশ্রাবক (সারিপুত্র এবং
মৌদগলায়ন ) ২. মহাশ্রাবক (মহাকাশ্যপ, আনন্দ এরকম ৭৮ জন) ৩. প্রতিসম্ভিদা লাভী এবং অষ্ঠ সমাপত্তিলাভী ৪.ষড়ভিজ্ঞা ৫. পঞ্চভিজ্ঞা ৬. ত্রিবিদ্যা ৭. সুক্ষ্ণ বিদর্শক ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছেন উপাধি প্রাপ্ত অরহৎ যেমন: মোগ্গলিপুত্ততিষ্য স্থবির যিনি তৃতীয় সংগীতির প্রধান, অরহৎ উপগুপ্ত, মিলিন্দ প্রশ্নে নাগসেন। উনারা উপাধি প্রাপ্ত। আবার বুদ্ধের বর প্রাপ্ত অরহতও রয়েছেন। যেমন সংগীতিকারক অরহৎ গন যারা পূর্ব থেকেই বর প্রাপ্ত। বর্তমানে যে যুগ তাতে সর্বোচ্চ ত্রিবিদ্যা লাভ করে অরহৎ হওয়া যায়। ষড়ভিজ্ঞা, পঞ্চভিজ্ঞা গণের যুগ শেষ। এবিষয়ে ত্রিপিটকে এবং অর্থকথায় কি
বলা হয়েছে একটু দেখা যাক:
১. দীর্ঘনিকায় অর্থকথায় (পি. টি. এস পৃষ্ঠা: ৩. ৮৯৯) বলা হয়েছে

‘‘পটিসম্ভিদাপত্তেহি ৰস্সসহস্সং অট্ঠাসি, ছল়ভিঞ্ঞেহি ৰস্সসহস্সং, তেৰিজ্জেহি ৰস্সসহস্সং, সুক্খৰিপস্সকেহি ৰস্সসহস্সং, পাতিমোক্খেন ৰস্সসহস্সং অট্ঠাসী’’তি। “
২. সংযুক্ত নিকায় অর্থকথায় (পি. টি. এস পৃষ্ঠা: ২.২০২)বলা হয়েছে

‘‘পঠমবোধিযঞ্হি ভিক্খূ পটিসম্ভিদাপত্তা অহেসুং। অথ কালে গচ্ছন্তে পটিসম্ভিদা পাপুণিতুং ন সক্খিংসু, ছল়ভিঞ্ঞা অহেসুং, ততো ছ অভিঞ্ঞা পত্তুং অসক্কোন্তা তিস্সো ৰিজ্জা পাপুণিংসু। ইদানি কালে গচ্ছন্তে তিস্সো ৰিজ্জা পাপুণিতুং অসক্কোন্তা আসৰক্খযমত্তং পাপুণিস্সন্তি, তম্পি অসক্কোন্তা অনাগামিফলং, তম্পি অসক্কোন্তা সকদাগামিফলং, তম্পি অসক্কোন্তা সোতাপত্তিফলং, গচ্ছন্তে কালে সোতাপত্তিফলম্পি পত্তুং ন সক্খিস্সন্তী’’তি
৩. বিনয় পিটকের চুল্লবর্গ অর্থকথায় (পি. টি. এস পৃষ্ঠা: ৬.১২৯১)বলা হয়েছে

“ৰস্সসহস্সন্তি চেতং পটিসম্ভিদাপভেদপ্পত্তখীণাসৰৰসেনেৰ ৰুত্তং। ততো পন উত্তরিম্পি সুক্খৰিপস্সকখীণাসৰৰসেন
ৰস্সসহস্সং, অনাগামিৰসেন ৰস্সসহস্সং, সকদাগামিৰসেন ৰস্সসহস্সং, সোতাপন্নৰসেন ৰস্সসহস্সন্তি এৰং পঞ্চৰস্সসহস্সানি পটিৰেধসদ্ধম্মো ঠস্সতি।”
৪. অভিধর্মের মাতিকা পালি গ্রন্থে (মায়ানমার ত্রিপিটক ২৮১ পৃষ্ঠা)বলা হয়েছে

“পঞ্চ হি অন্তরধানানি নাম অধিগমঅন্তরধানং পটিপত্তিঅন্তরধানং পরিযত্তিঅন্তরধানং লিঙ্গঅন্তরধানং ধাতুঅন্তরধানন্তি। তত্থ অধিগমোতি মগ্গফলাভিঞ্ঞাপটিসম্ভিদাযো, সো পরিহাযমানো পটিসম্ভিদাতো পট্ঠায পরিহাযতি। পরিনিব্বানতো হি বস্সসহস্সমেব পটিসম্ভিদা নিব্বত্তেতুং সক্কোন্তি, ততো পরং অভিঞ্ঞা, তাপি নিব্বত্তেতুং অসক্কোন্তা সুক্খৰিপস্সকখীণাসৰা হোন্তি, ততো অনাগামিনো, ততো সকদাগামিনো, সোতাপন্না চ হোন্তি, তেসু ধরন্তেসুপি অধিগমো অনন্তরহিতোৰ হোতি, পচ্ছিমকস্স পন সোতাপন্নস্স জীৰিতক্খযেন অধিগমো অন্তরহিতো নাম হোতি।” ৫. অঙ্গুত্তর নিকায় টীকায় (মায়ানমার ত্রিপিটক ৩.২৪৩ পৃ্ষ্ঠা) বলা হয়েছে-

‘‘বুদ্ধানঞ্হি পরিনিব্বানতো ৰস্সসহস্সমেৰ পটিসম্ভিদা নিব্বত্তেতুং সক্কোন্তি, ততো পরং ছ অভিঞ্ঞা, ততো তাপি নিব্বত্তেতুং অসক্কোন্তা তিস্সো ৰিজ্জা নিব্বত্তেন্তি, গচ্ছন্তে গচ্ছন্তে কালে তাপি নিব্বত্তেতুং অসক্কোন্তা সুক্খৰিপস্সকা হোন্তি। এতেনেৰ উপাযেন অনাগামিনো সকদাগামিনো সোতাপন্না’’তি

এই পাঁচটি রেফারেন্সের মধ্যে শেষোক্তটির বাংলা হচ্ছে- বুদ্ধের পরিনির্বানের পর

প্রতিসম্ভিদা-জ্ঞান প্রাপ্ত অর্হৎ গণদের শাসন প্রথম ১০০০ বৎসর।
ষড়াভিজ্ঞা-জ্ঞান প্রাপ্ত অর্হৎ গণদের শাসন দ্বিতীয় ১০০০ বৎসর।
ত্রিবিদ্যা-জ্ঞান প্রাপ্ত অর্হৎ গণদের শাসন তৃতীয় ১০০০ বৎসর।
সূক্ষ-বির্দশক-জ্ঞান প্রাপ্ত অর্হৎ গণদের শাসন চতুর্থ ১০০০ বৎসর।
প্রাতিমোক্ষ সংবরণ শীল গণদের শাসন পঞ্চম ১০০০ বৎসর।

৬.ভিক্ষুনীক্খন্ধকে অর্থকথায় (মায়ানমার ত্রিপিটকের শাসন বংশের ৮১ পৃষ্ঠায় )বলা হয়েছে-

প্রতিসম্ভিদা জ্ঞান প্রাপ্ত অরহৎ প্রথম ১০০০ বৎসর।

শুক্ষ বিদর্শক অর্হৎ দ্বিতীয় ১০০০ বৎসর।

অনাগামী তৃতীয় ১০০০ বৎসর।

সকৃদাগামী চতুর্থ ১০০০ বৎসর।

স্রোতাপন্ন পঞ্চম ১০০০ বৎসর।

এছাড়াও সংগীতিতে গৃহিত বই ‘শাসন বংশের পৃষ্ঠা-১০২, সীমাবিশোধনী পাঠ পৃষ্ঠা-২০, অনুদীপনী পাঠ পৃষ্ঠা-৩০ পড়লেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।বাংলাদেশে রচিত ষষ্ঠ সংগীতিকারক, অগ্রমহাপন্ডিত শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক মহাস্থবির কতৃক রচিত বুদ্ধের যোগনীতি নামক গ্রন্থের ‘যোগতত্ত্বের পূর্ব্বাভাষ’ পড়লেও এ বিষয়ে জানতে পারবেন।বর্তমানে সম্যক সম্বুদ্ধের শাসন ২০০০ হাজার বছর অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ এখন চলছে তৃতীয় ১০০০ বৎসর। প্রথম রেফারেন্সগুলোকে আমরা যদি পুরুষের এবং ভিক্ষুনীস্কন্ধকের দেয়া বিবৃতিকে যদি আমরা মহিলাদের প্রতি বুদ্ধের বাণীরূপে গ্রহণ করি তাহলে বলা যায় পুরুষরা বর্তমানে বুদ্ধ শাসনে সর্বোচ্চ ত্রিবিদ্যা লাভ করতে পারবেন। আর মহিলারা অনাগামী ফলে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন।বর্তমানে বাংলাদেশে অনেকেই “অনুবুদ্ধ, প্রতিসম্ভিদা এবং ষড়াভিজ্ঞা’’ শব্দটি টাইটেল হিসেবে ব্যবহার করছেন বিভিন্ন ভাবে। উল্লেখ্য আমরা ত্রিপিটক এবং অর্থকথায় বর্তমান যুগে তেমন অরহতের সমর্থন পাই না। কারণ ’অনুবুদ্ধ’ শব্দটির অর্থ
যদি আমরা ধরে নেই ছোট বুদ্ধ বা বুদ্ধের চেয়ে অল্পমাত্র জ্ঞানী তবে বুদ্ধের পরবর্তী কেউ তাহলে ত্রিপিটকে একমাত্র
‘সারিপুত্র’ স্থবিরকেই এই পরিচয় পাবার যোগ্য কারণ তাঁর জ্ঞান প্রভা ত্রত বিস্তৃত ছিল যে তিনি কল্পকাল বৃষ্টি হলে কত ফোঁটা
বৃষ্টি পানিতে এবং কত ফোঁটা বৃষ্টি মাটিতে পড়েছে তা গণনা করে বলতে পারতেন। আর তিনি হচ্ছেন প্রথম অগ্রশাবক এবং
ধর্মসেনাপতি। সারিপুত্রের শুধুমাত্র একটি সুত্র-‘সমচিত্ত সুত্র’ দেশনাতে ১,০০০,০০০,০০০,০০০ জন দেব-মনুষ্য-ব্রহ্মা অরহৎ হয়েছেন। আর কত জন ঐ শুধুমাত্র একটি সুত্রে স্রোতপন্ন, সকৃতাগামী এবং অনাগামী হয়েছেন তাকে ‘অসংখ্যেয়’ বলা
হয়েছে।এতো গেল শুধু মাত্র একটি সুত্রের বর্ণনা। সারিপুত্র তো অনেক দেশনাই করেছেন। এখন উনার সাথে বাংলাদেশী ‘ভিক্ষুটির’
তুলনা কতটুক তা প্রশ্নসাপেক্ষ! ত্রিপিটক অনুসারে বর্তমান যুগে তাই ‘অনুবুদ্ধ’ উৎপন্ন হবার ক্ষেত্রটি পুরোপুরি প্রতিকূল। আর
আরেক জায়গায় লেখা ছিল- পৃথিবীর সব সাগরের জল যদি গৌতম বুদ্ধ হয় তবে তার থেকে আট বিন্দু জল আলাদা করে নিলে হবে সারিপুত্র। আর বাকিদের কথা নাই বললাম। বিশুদ্ধিমার্গেও উল্লেখ আছে- বুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীর সব অরহতের (মৌগদলায়ণ, আনন্দ থেকে সবাই) জ্ঞান সারিপুত্রের ষোল ভাগের এক ভাগ না।

দীর্ঘনিকায় (মহাপরিনির্বাণ সুত্র), মধ্যমনিকায় (ব্রহ্মনিমন্ত্রণ সুত্র), অঙ্গুত্তর নিকায়ের চতুর্থ (অনুবুদ্ধ সুত্র), ষষ্ঠ (মহাকাত্যায়ণ সুত্র), সপ্তম (সপ্ত সূয্য সুত্র), নবম নিপাতের (আনন্দ সুত্র) যে সমস্ত সুত্রে ‘অনুবুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে একমাত্র গৌতম বুদ্ধই ‘অনুবুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
এখানে অনুবুদ্ধ বলতে বুদ্ধ স্বয়ং উপলব্দ চারটি গুনের কথা বলেছেন- শীল, সমাধি, প্রজ্ঞা এবং বিমুক্তি। সুত্রপিটকে অনুবুদ্ধ বলতে এখানে গৌতম বুদ্ধ কতৃক স্বয়ং এবং সম্যকরুপে জ্ঞাতকে বুঝানো হয়েছে। অন্য কারো কতৃক এই শব্দটির ব্যবহার এখনো আমি পাই নি।

তবে ত্রিপিটক বর্হিভূত কিন্তু সংগীতিতে গৃহিত একটি মূল্যবান বইতে অনুবুদ্ধ বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা সম্যক সম্বুদ্ধের ধর্মকায়কে (ধর্ম ও বিনয়কে বা ত্রিপিটককে) ধারণ করে (মুখস্ত করে) বুদ্ধ গুণ সাধারণ জ্ঞানে বুঝতে সক্ষম তাদেরকে। পালিতে- “ৰুত্তে পুথুজ্জনোপি উপচারৰসেন ৰাচনামগ্গস্স বোধত্তা অনুবুদ্ধো নাম।” এই ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদেরকে শ্রাবকবুদ্ধে পর্যন্ত অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। কারণ তারা বিদর্শনে বা যোগবশে আর্যসত্য উপলব্দি করেন নি। তাই তারা আর্যশ্রাবকও নয়।

এই বিষয়ে আরেকটি বড় কারণ আমরা ত্রিপিটক বিশ্লেষণে বলব:
পুদগল বা ব্যাক্তি পারমী অনুসারে চার ধরণের-
১. প্রত্যুতপন্নমতি (এই পুদগল গণ বুদ্ধের সাক্ষাৎ এবং বুদ্ধের মুখ নিসৃত বাণী শ্রবণ করার সাথে সাথেই অরহৎ ফল প্রাপ্ত হন যাঁদের উৎপন্ন হবার সময় বর্তমানে আর নেই। )
২. বিচিন্তমতি (এই পুদগল গণ বুদ্ধের সাক্ষাৎ এবং বুদ্ধের মুখ নিসৃত চার লাইনের বাণী শ্রবণ করার সাথে সাথেই অরহৎ ফল প্রাপ্ত হন যাঁদের উৎপন্ন হবার সময় বর্তমানে আর নেই। )
৩.নেয়্য (এই পুদগলদের মধ্যে কারো কারো উৎপন্ন হবার সময় এখনও আছে। এরা কঠোর সাধনার মাধম্যে অতীত পারমী অনুসারে বিভিন্ন সময়ে অর্হৎ ফল প্রাপ্ত হন। কারো কারো ৭দিন কিংবা কারো কারো ৬০ বৎসর কিংবা তারও অধিক সময়ও লাগতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পুদগলের অর্হৎ হবার সম্ভবনা একদম কমে যায় যদি তিনি শেষ বয়সে এসে সাধনা করেন।)এবং
৪.পদপরম (এই পুদগল গণ যদিও বুদ্ধের শাসনের সাক্ষাৎ পান তবে তারা যদি এই জন্মে অক্লান্ত চেষ্টাও করেণ তবুও তাদের অরহৎ হবার কোন সম্ভবনা নেই। তার একমাত্র কারণ অতীত পারমী। তবে তাদের বর্তমান জন্মের এই সাধনা যদি সঠিক হয় তবে তা পারমী পূরণে সহায়তা করে যা তাদেরকে ভবিষ্যতে কোন এক জন্মে অরহৎ হতে সহায়তা করবে।)।
বর্তমান এই যুগ নেয়্য এবং পদপরম পুদগল দের যুগ। এখন কোন এক পুদগল যদি হাজার বৎসরও জীবিত থাকেন এবং ধ্যান সমাধি করেন তবুও তাদেরকে ‘অরহৎ’ বলা আমাদের জন্য কতটুকু সমীচীন তা হিসেব করা প্রয়োজন কারণ আমরা নিশ্চয় এটা নিশ্চিত না যে তিনি নেয়্য পুদগল কি না। কারণ নেয়্য পুদগল না হলে তিনি এই জন্মে যত সাধনাই করুক না কেন অরহৎ হতে পারবেন না।
আর সারিপুত্রের মত কোন অরহৎ (বোধিসত্ব কিংবা ভবিষ্যত অগ্রশ্রাবক, মহাশ্রাবক, ষড়াভিজ্ঞা লাভ করতে পারবেন এমন সত্ব থাকলেও থাকতে পারেন কিন্তু অরহৎ না।) বর্তমানে থাকার বিষয়টি অযৌক্তিক এবং ‘ষড়াভিজ্ঞা’ লাভী অরহৎ গণদের উৎপত্তিও ত্রিপিটক অর্থকথা বিশ্লেষণে কতটুকু যৌক্তিক তা আমার বোধগম্য না। বিনয় এর পারাজিকা অনুসারে একজন ভিক্ষু যদি লোকত্তর বিষয় নিয়ে মিথ্যা সম্ভাষণ করেন তবে তার ভিক্ষুত্ব থাকবে কিনা তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পরে। ভিক্ষুদের প্রথম চারটি শীলভঙ্গ হলে ভিক্ষুত্বই চলে যায়। আমরা কোন ভিক্ষু টাকা পয়সা না ধরলে, গাছের পাতা না ছিড়লে উনাকে শীলবান মনে করি কিন্তু এই গুলো ভিক্ষুর জন্য প্রধান শীল নয়। আর আমরা বিশেষত: মনে করি পাহাড়ে বা শশ্মানে কিছুদিন ধ্যান করলেই অরহত হয়ে গেল। এবং তারাই শুধু শীলবান। কিন্তু মূল প্রধান চারটি শীল তারা কতটুক পালন করছেন তাই প্রশ্নবিদ্ধ!

ভাবনার হিতজনক সপ্ত বিধিতে বলা হয়েছে-
৩২ প্রকার সারহীন আলোচনা যেন ভাবনাকারীগণ না করেন। সেখানে রয়েছে- রাজনৈতিক, ভয়জনক, কামোদ্দীপক, দ্বেষমূলক আলোচনা না করা। পত্রিকা, উপন্যাস, সারহীন গ্রন্থ পাঠ না করা। কারণ তাতে স্মৃতি চ্যুত হয়। বাংলাদেশে আমরা যাদেরকে অরহৎ ভাবি তাদের একজনকে আমি নিজের চোখে ‘প্রথম আলো’ পড়তে দেখেছি। নিজের চোখে দেখেছি মাউথ স্পিকার ছুঁড়ে মারতে রাগান্বিত হয়ে। তারা যদি অরহতই হয়ে থাকেন তারা কেন সারহীন লোভ, দ্বেষ, মোহ আচ্ছন্ন পত্রিকায় মনোনিবেশ করবেন??? আবার যদি ষড়ভিজ্ঞায় হন তাহলে পত্রিকা পড়ার কি দরকার! উনি জানতে চাইলেই তো সব জানতে পারেন। কেউ যদি নিজে প্রচার করেন, কিংবা অনুমোদন দেন যে তিনি বর্তমানে অনুবুদ্ধ, প্রতিসম্ভিদালাভী, ষড়াভিজ্ঞা তবে সত্যিকার অর্থেই বলি উনি কোন ভিক্ষুই নন।

এখন আসা যাক আরেকটি বিষয় সম্পর্কে। ত্রিপিটকে বহু নিদর্শণ রয়েছে যে কিছু কিছু ভিক্ষু অনেকদিন ভাবনা করার পর নিজেদের অরহত ভাবত কিন্তু তারা অরহত নন। এমন একটি নির্দশণ বলছি-
একসময় ৩০ জন ভিক্ষু বর্ষাবাসের সময় কোন এক অরণ্যে টানা তিনমাস ভাবনা করতে গিয়েছিল। বর্ষাবাস শেষ হবার পর তারা ভাবল তারা অরহত হয়ে গেছে। কারণ অনেকেই ঋদ্ধি শক্তি অর্জন করেছিল। তারপর তারা বলল চলো আমরা বুদ্ধকে দর্শণ করতে যাই। বুদ্ধ দেখলেন তারা অরহত হন নি। ঐ দিন একটি ষোল বছরের একটি খুব সুন্দর মেয়ে মারা যায়। বুদ্ধ তা বিহারের সামনের এক জায়গায় রাখতে নির্দেশ দিলেন। তখন ঐ ৩০ জন ভিক্ষু বিহারে এসে ঐ মৃত মেয়েটিকে দেখে ভাবলেন হয়তো মেয়েটি শুয়ে আছে। মেয়েটি এত সুন্দর ছিল যে তাদের মধ্যে তৃষ্ণা চলে এল। এতে তারা বুঝতে পারল তারা অরহত নন। তখন বুদ্ধ তাদেরকে বললেন এই মেয়েটি মৃত। তখন তিনি অনিত্য, দুঃখ, অনাত্মা ব্যাখা করাতে তারা সাথে সাথে অরহত হলেন।

বুদ্ধের সময় ছয়জন লোক নিজেদের বুদ্ধ ভাবত এমন উদাহরণও ত্রিপিটকে আছে। তাই আসুন আমরা এসব বিড়াল তপস্বীদের কাছ থেকে সাবধান হই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় বুদ্ধ তিনবারের অধিক কোন কথা বলতেন না। সেই বুদ্ধ সর্বমোট ৪৪ বার ত্রিপিটকে বলেছেন ‘‘যথাভূতং ঞাণায সত্থা পরিয়েসিতব্বো’ অর্থাৎ যর্থাথ জ্ঞান লাভের জন্য সঠিক গুরুর সন্ধান উচিত। বিভিন্ন দেশনা গ্রন্থে যারা প্রচার করেছেন গুরু ব্যতিরেকে আমরা অরহৎ হয়েছি তারা তো সারিপুত্রকেও হার মানিয়েছেন! শুধুমাত্র সম্যক সম্বুদ্ধ এবং প্রত্যেক বুদ্ধ ব্যতীত সবাইকে সঠিক গুরুর সন্ধান নিতে হবে। অন্যথায় ভূল পথে গিয়ে ভূয়া অরহৎ হবেন। এবং তাদের অনুসারীরাও ভূল পথে পা বাড়াবেন। তাই আসুন সৎ গুরুর সন্ধান লাভ করি এবং সঠিক ধর্মের অনুশীলন করি।
তথ্যসূত্র:
১. দীর্ঘনিকায়
২. মধ্যমনিকায়
৩. অঙ্গুত্তর নিকায়
৪. ধর্মসূধা- শ্রীমৎ আনন্দমিত্র মহাস্থবির
৫. দীর্ঘনিকায় অর্থকথা
৬. সংযুক্তনিকায় অর্থকথা
৭. চুল্লবর্গ অর্থকথা
৮. অভিধর্ম মাতিকা পালি
৯. অঙ্গুত্তর নিকায় অর্থকথা
১০ ভিক্ষুনী স্কন্ধক অর্থকথা
১১. বিশুদ্ধি মার্গ
১২. শাসন বংশ
১৩. অনুদীপনী পাঠ
১৪. সীমাবিশোধনী পাঠ
১৫. দেশনা কল্পতরু- শ্রীমৎ উ পঞঞা জোত মহাথের
১৬. বুদ্ধের যোগনীতি- শ্রীমৎ প্রজ্ঞালোক স্থবির
১৭. বিদর্শন সাধনা পদ্বতি ও দীক্ষা- শ্রীমৎ উ পঞ্ঞা জোত মহাথের
১৮. হেমবত সুত্র- ষষ্ঠ সংগীতিতে প্রশ্লকারী অগ্রমহাপন্ডিত মহাসী সেয়াদ
১৯. সারসংগ্রহ
২০. পারাজিকা
২১. বার বেশি না তের বেশি- ভদন্ত রাষ্ঠ্রপাল মহাথের।

error: Content is protected !!