১৯৮৫ সাল। মে মাসের শুরু। বনভান্তের গৃহীকালীন মা পুণ্যশীলা বীরপুদি চাকমা ভীষণ অসুস্থ। বিশ/একুশ দিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছেন। সেই অসুখের মাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে দু’য়েকদিন হতে। মেঝ ছেলে (৩য় পুত্র) জহর লাল চাকমার বঙ্গলতুলিস্থ বাড়ীতে শয্যাশায়ী হয়ে মরণাপন্ন প্রায়। চিকিৎসায় কোন ফল হচ্ছে না দেখে জহর লাল, ভূপেন্দ্র লাল (৪র্থ পুত্র) ও বাবুল (৫ম পুত্র) চাকমারা মায়ের বেঁচে থাকার আশা এক প্রকার ছেড়েই নিলেন। জহর লাল চাকমার মনে পড়ল—“মায়ের এই শেষ অবস্থার খবর তো শ্রদ্ধেয় বনভান্তেকে জানানো দরকার। ভান্তে হলেও তিনি যে আমাদের বড় ভাই, মায়ের প্রথম পুত্র”। কিন্তু, পরক্ষণে সেই চিন্তা বাদ দিতে হল—মন থেকে। ভাবতে লাগলেন—কিভাবে এ’খবর জানাবেন! রাঙামাটি তো বহুদূরে। লঞ্চ যোগে রাঙামাটি গিয়ে ফিরে আসতে কম হলেও তিনদিন হাতে রাখতে হবে। মায়ের এই গুরুতর অসুস্থের সময় তিনদিন বাড়ীর বাইরে থাকা কী করে সম্ভব। অন্যদিকে লঞ্চ করে রাঙামাটি যেতে কতো জায়গায়ই-না আর্মির চেকপোষ্টের ভোগাক্তিতে পড়তে হয়, তার হিসেব নেই। আর সেসময় উল্টোপাল্টা কিছু ঘটলে তো সব-ই শেষ হয়ে যাবে। এসব ভেবে জহর লাল চাকমা রাঙামাটিতে আসতে সাহস করলেন না। ফলে বনভান্তেকে মায়ের মরণাপন্না অবস্থায় কথা জানাতে পারলেন না।
মৃত্যুর তিনদিন আগে মাতৃদেবী বীরপুদি চাকমা পুত্র জহর লালকে বললেন—“আমাকে মূল বাড়ির অমুক কামড়ায় স্থানান্তর কর”। মায়ের নির্দেশ পেয়ে জহর লাল চাকমাও তা-ই করলেন। উল্লেখ্য যে, এই কামড়াটিতে কোন এক অসুস্থতার সময় বনভান্তে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। একজন, দু’জন করে করে পাড়ার লোকজনেরা বীরপুদি চাকমার এ’গুরুতর অসুস্থের অবস্থা দেখে যেতে লাগলেন। মৃত্যুর একদিন আগে বিকেল বেলায় হঠাৎ শয্যাশায়ী বীরপুদি চাকমা বলে উঠলেন—“ভান্তে, তুমি আজ বিকালে এসেছ। সকালে আসলে তো সিয়্যং-এর ব্যবস্থা করতাম”। মায়ের একথা শুনে জহর লাল চাকমারা ভাবলেন, মা অসুখের ঘোরে এসব বলছেন নিশ্চয়। তা না হলে ভান্তেকে দেখলেন কোথায়! ভান্তেকে তো আমরা খবরটুকুও দিতে পারি নি। ভান্তে আসবেন কীভাবে। আর ভান্তে যদি সত্যি সত্যিই আসতেন, তাহলে আমরা সবাই দেখতাম। মা একাই দেখবেন কেন! তবে পরক্ষণে লালের মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। চিন্তা আসলো, আহা-রে! মা তাঁর বড়ো ছেলেকে কতো-ই ভালোবাসেন। এসময়ও তাঁর কথা স্মরণ করছেন। নিশ্চয় খুব দেখতে ইচ্ছা করছে বড়ো ছেলেকে। কিন্তু, আমি তো তাঁকে খবরই দিতে পারি নি। হয়ত মা-এর এটা-ই শেষ ইচ্ছা। মার এ’ইচ্ছাটুকু পূরণ করে দিতে পারছি না, পারলাম না। এভেবে নিজকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল তার। পরদিন ভোরে বীরপুদি চাকমা পুত্রবধুকে “বৌমা, বৌমা” বলে ডেকে উঠলেন। আর নির্দেশের স্বরে বললেন—“তাড়াতাড়ি সিয়্যং রান্না কর। আজ বনভান্তে এখানে এসে সিয়্যং খাবেন”। শ্বাশুড়ির কথায় তেমন বিশ্বাস না জন্মালেও সিয়্যং রান্না করলেন পুত্রবধু। সকাল সাড়ে দশটার দিকে বীরপুদি চাকমা বেশ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন “বৌমা, বনভান্তে আসতেছেন। তাড়াতাড়ি ঐ পালংকের উপর একটা পাটি বিছায়ে দাও, নতুন একটা চাদর বিছায়ে দাও। সিয়্যং রান্না হলে ভান্তেকে খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা কর।” তবে কোথায় ভান্তে! পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউ-ই তো দেখতে পাচ্ছেন না। তারপরও তারা পালংকের উপর পাটি বিছায়ে দিলেন, নতুন একটা ছাদর বিছায়ে দিলেন। অল্পক্ষণ পর সেখানে ভান্তের উদ্দেশ্যে সিয়্যং দিলেন যত্নসহকারে। সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে বীরপুদি চাকমা মৃদুস্বরে বলে উঠলেন—“ঐ তো, ঐ তো বনভান্তে আবার আসতেছেন”। একথা বলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দিনটি ৬ই মে ১৯৮৫ ইং, ২৩শে বৈশাখ ১৩৯২ বাংলা, ২৫২৮ বুদ্ধাব্দ, রোজ সোমবার। দীর্ঘ ২৬ দিন পর্যন্ত অসুখে ভোগার পর তাঁর মৃত্যু হল।
এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বনভান্তের একনিষ্ঠ উপাসক ও প্রতিদিন বিহারে এসে ভান্তেকে সেবা প্রদানকারী, রাজমাতা আরতি রায়ের ছোট ভগ্নিপতি বাবু সমর বিজয় চাকমা বলেন, “সেদিন বনভান্তে রাজবন বিহারে সিয়্যং গ্রহণ করেন নি। প্রায় সারাদিন তাঁর রুমের ভেতর অবস্থান করেছিলেন। রুমের জানলাও বন্ধ রেখেছিলেন। শ্রামণদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন—তাঁকে যেন ডাকা না হয়। সময় হলে তিনি নিজে রুমের দরজা খুঁলেবেন। সন্ধ্যার দিকে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।” এসব ঘটনা থেকে এটা বলা যায়, বনভান্তে সেদিন মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। উল্লেখ্য যে, তাঁকে প্রব্রজ্যা গ্রহণের অনুমতি প্রদানকালে মাতৃদেবী বীরপুদি চাকমা অনুরোধ করেছিলেন—মৃত্যুর সময় যেন তোমারে দেখতে পাই। সেসময় তুমি যেখানে, যে অবস্থায় থাকেন না কেন। আর তিনিও মায়ের অনুরোধ রক্ষা করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। তাই এ’দিন অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে মায়ের সেই অনুরোধটুকু রক্ষা করলেন।
সাধু সাধু সাধু
(তথ্যসূত্র: বনভান্তের দেশনা (২য় খন্ড)—ডাঃ অরবিন্দ বড়ুয়া)।